বাঘের বাচ্চা

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

পুণা গ্রাম হইতে প্রায় সাত-আট ক্রোশ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে উপত্যকা হইতে বহু ঊর্ধ্বে গিরিসংকটের ভিতর দিয়া দুইজন সওয়ার নিম্নাভিমুখে অবতরণ করিতেছিল। চারিদিকেই উচ্চনীচ ছোটবড় পাহাড়ের শ্রেণী— যেন কতকগুলা অতিকায় কুম্ভীর পরস্পর ঘেঁষাঘেঁষি হইয়া তাল পাকাইয়া এই হেমন্ত অপরাহ্ণের সোনালী রৌদ্রে শুইয়া আছে। তাহারি মধ্যে পিপীলিকার মতো দুইটি প্রাণী সূর্যের দিকে পশ্চাৎ করিয়া ক্রমশ দীর্ঘায়মান ছায়া সম্মুখে ফেলিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া আসিতেছিল।

এখান হইতে উপত্যকা দৃষ্টিগোচর নয়, পথেরও কোনও চিহ্ন কোথাও নাই। চতুর্দিকে কেবল উলঙ্গ কর্কশ পাহাড়, মাঝে মাঝে দুই একটা খর্বাখৃতি কণ্টকগুল্ম। এই সকল চিহ্ন ছাড়া পথিককে বহুদূরস্থ জনপদে পরিচালিত করিবার কোনও নিদর্শন নাই— অনভিজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে এরূপ স্থানে দিক্‌ভ্রান্ত হইবার সম্ভাবনা অত্যন্ত অধিক।

অশ্বারোহী দুইজন যে পথ দিয়া নামিতেছিল তাহাকে পথ বলা চলে না, বর্ষার জল চূড়া হইতে নামিবার সময় পর্বতগাত্রে যে উপলপিচ্ছিল প্রণালী রচনা করে, এ সেইরূপ একটি প্রণালী, পাহাড়ের শীর্ষ হইতে প্রায় ঋজুরেখায় পাদমূল পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে।

সওয়ার দুইজন ঘোড়ার বল্গা ছাড়িয়া দিয়া পরস্পর বাক্যালাপ করিতে করিতে চলিয়াছিল, খর্বদেহ রোমশ পাহাড়ী ঘোড়া স্বেছামত সেই ঢালু বিপজ্জনক পথে সাবধানে অবতরণ করিতেছিল। এই স্থানে পথ এত বেশি ঢালু যে একবার অশ্বের পদস্খলন হইলে আরোহীর মৃত্যু অনিবার্য; কিন্তু সেদিকে আরোহীদের দৃষ্টি নাই।

আরোহীদের মধ্যে একজন প্রাচীন বয়স্ক; মাথার চুল ও গোঁফ পাকা, বর্ণ এত বয়সেও তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়। কপালের একপ্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত শ্বেতচন্দনের দুইটি রেখা বোধ করি জরাজনিত ললাটরেখাকে ঢাকিয়া দিয়াছে। মস্তকে শুভ্র কার্পাসবস্ত্রের উষ্ণীষ; দেহে তুলট্‌ আংরাখার ফাঁকে বাম স্কন্ধের উপর উপবীতের একাংশ দেখা যাইতেছে। চোখে-মুখে একটি দৃঢ় অচঞ্চল বুদ্ধির প্রভা। দেখিলেই বুঝা যায় ইনি একজন শাস্ত্রাধ্যায়ী অভিজাতবংশীয় ব্রাহ্মণ। ইহার হস্তে কোনও অস্ত্র নাই, কিন্তু যেরূপ স্বচ্ছন্দ নিশ্চিন্ততার সহিত অবতরণশীল অশ্বপৃষ্ঠে অটল হইয়া বসিয়া আছেন, তাহাতে মনে হয় কেবল ব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলন করিয়াই ইনি জীবন অতিবাহিত করেন নাই।

দ্বিতীয় আরোহীটি ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। বয়স বোধ করি ষোল বৎসরও অতিক্রম করে নাই; দেহের বর্ণ শ্যাম, কিন্তু মুখের গঠন অতিশয় ধারালো। মৃদঙ্গসদৃশ মুখের মধ্যস্থলে শ্যেনচঞ্চুর মতো নাসিকা এই অল্প বয়সেই তাহার মুখে শিকারীর মতো একটা শাণিত তীব্রতা আনিয়া দিয়াছে। চক্ষু দু’টি বড় বড়, চক্ষুতারকা নিবিড় কৃষ্ণবর্ণ; বালকসুলভ চঞ্চলতা সত্ত্বেও দৃষ্টি অতিশয় তীক্ষ্ণ ও মর্মভেদী। ওষ্ঠের উপর ও চিবুকের নিম্নে ঈষন্মাত্র রোমরেখা দেখা দিয়াছে, তাহাও বর্ণের মলিনতার জন্য স্পষ্ট প্রতীয়মান নয়। ভ্রূ-যুগল সূক্ষ্ম ও দূরপ্রসারিত। সহসা এই বালকের মুখ দেখিলে একটা অপূর্ব বিভ্রম জন্মে, মনে হয় যেন একখানা তীক্ষ্ণধার বাঁকা কৃপাণ সূর্যালোকে ঝক্‌ঝক্ করিতেছে।

মুখ হইতে দৃষ্টি নামাইয়া দেহের প্রতি চাহিলে কিন্তু আরো চমক লাগে। মুখের মতো দেহের সৌষ্ঠব নাই, প্রস্থের তুলনায় দৈর্ঘ্যে দেহ অত্যন্ত খর্ব। প্রথমেই মনে হয়, অতিশয় বলশালী। কটি হইতে পায়ে শুঁড়তোলা নাগরা জুতা পর্যন্ত প্রাণসার অথচ ক্ষীণ, মৃগচরণের মতো যেন অতি দ্রুত দৌড়িবার জন্যই সৃষ্ট হইয়াছে; কিন্তু কটি হইতে ঊর্ধ্বে দেহ ক্রমশ প্রশস্ত হইয়া বক্ষঃস্থল এরূপ বিশাল আয়তন ধারণ করিয়াছে যে বিস্মিত হইতে হয়। আরো অদ্ভুত তাহার দুই বাহু; আজানুলম্বিত বলিলেও যথেষ্ট হয় না, সন্দেহ হয় ঘোড়ার পিঠে বসিয়া হাত বাড়াইলে মাটি হইতে উপলখণ্ড তুলিয়া লইতে পারে। তাহার উপর যেমন সুপুষ্ট তেমনি পেশীবহুল; দুই বাহু দিয়া কাহাকেও সবলে জড়াইয়া ধরিলে তাহার পঞ্জর ভাঙিয়া যাওয়া অসম্ভব নয়।

এই বালক হাসিতে হাসিতে চতুর্দিকে চঞ্চল চক্ষে দৃষ্টিপাত করিতে করিতে নামিতেছিল। ঘোড়ার রেকাব নাই, লাল রেশমের জরিমোড়া লাগামও ছাড়িয়া দিয়াছে, অথচ কম্বলের জিনের উপর এমনভাবে বসিয়া আছে যেন সে আর ঘোড়া পৃথক নয়— কোন ক্রমেই তাহাদের বিচ্ছিন্ন করা যাইবে না। বাম হস্তে আগাগোড়া লোহার ভারী বল্লমটা এমনি অবহেলাভরে ধরিয়া আছে যেন পাগড়ির উপর খেলাচ্ছলে রোপিত শুকপুচ্ছটার চেয়েও সেটা হালকা।

ঘোড়া দুইটি পাহাড়ের পাদমূলে আসিয়া দাঁড়াইল। সম্মুখে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে আর একটা পাহাড় আরম্ভ হইয়াছে, এবার সেইটাতে চড়িতে হইবে। সূর্য পিছনের উচ্চ পাহাড়ের চূড়া স্পর্শ করিল, শীঘ্রই তাহার আড়ালে ঢাকা পড়িবে।

বালক চতুর্দিকে চাহিয়া যেন প্রাণশক্তির আতিশয্যবশতঃই উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল, তারপর বলিল, “দাদো, প্রতিধ্বনি শুনবে? হোয়া হো হো হো হো! চুপ! এইবার শোনো।”

কয়েক মুহূর্ত পরেই তিন দিক হইতে ভৌতিক শব্দ ফিরিয়া আসিল— হোয়া! হো হো হো!

বালক অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া উত্তর দিকের একটা উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দেখাইয়া বলিল, “ঐটে সবচেয়ে দূরে। আওয়াজ ফিরে আসতে কত দেরি হল দেখলে? চোখে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না কোন্‌টা কাছে, কোন্‌টা দূরে। অন্ধকার রাত্রে পথ হারিয়ে গেলে প্রতিধ্বনি ভারী কাজে লাগে। — না দাদো?”

বৃদ্ধ মৃদুহাস্যে উত্তর করিলেন, “তা লাগে; কিন্তু অন্ধকার রাত্রে এ-রকম জায়গায় পথ হারিয়ে যাবার তোমার কোনও সম্ভাবনা আছে কি?”

বালক বলিল, “তা নেই। তুমি আমার চোখ বেঁধে দাও, দেখ আমি ঠিক পুণায় ফিরে যেতে পারব।”

বৃদ্ধ বলিলেন, “সে আমি জানি। লেখাপড়ার দিকে তোমার একেবারে মন নেই, কেবল দিবারাত্রি পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পেলেই ভালো থাকো। তোমার বাবা যখন আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইবেন, তখন যে আমি কি কৈফিয়ৎ দেব তা জানি না।”

বালকের মুখে একটা দুষ্টামির হাসি খেলিয়া গেল, সে বৃদ্ধের দিকে আড়চোখে কটাক্ষপাত করিয়া বলিল, “আচ্ছা দাদো, ‘আলিফ ভালো, না ‘অ’ ভালো? বাঁ দিক থেকে ডান দিকে লেখা সুবিধে, না ডান দিক থেকে বাঁ দিকে?”

বৃদ্ধ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “সে তুমি বুঝতে পারবে না। ষোল বছর বয়স হল, এখনো নিজের নাম সই করতে শিখলে না। তোমার লেখাপড়ার চেষ্টা করাই বৃথা!— কিন্তু শিকারের দিকেও তো তোমার মন নেই দেখতে পাই। আজ সারাদিন ঘুরে একটা খরগোসও মারতে পারলে না।”

বালক আক্ষেপে হস্ত উৎক্ষিপ্ত করিয়া বলিল, “খরগোস আমি মারতে পারি না, আমার ভারী মায়া হয়। ঐটুকু জানোয়ার, তার ওপর হিংসার লেশ তার শরীরে নেই— খালি প্রাণপণে পালাতে জানে।”

বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কোন্‌ জানোয়ার মারতে চাও শুনি— বাঘ!”

উৎসাহ-প্রদীপ্ত চক্ষে কিশোর বলিল, “হ্যাঁ, বাঘ। এ পাহাড়ে বাঘ পাওয়া যায় না, দাদো?”

বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “না, শুনেছি আরো দক্ষিণে পাহাড়ের গুহায় বাঘ আছে; কিন্তু তুমি বাঘ মারবে কি করে?”

কিশোর বলিল, “কেন, এই বল্লম দিয়ে মারব। মাটিতে সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে মারব।”

“ভয় করবে না?”

“ভয়!” বালকের উচ্চহাস্য আবার চারিদিকে প্রতিধ্বনি তুলিল। “আচ্ছা দাদো, ভয় জিনিসটা কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারো? সকলের মুখেই ওই কথাটা শুনতে পাই, কিন্তু ওটা যে কি পদার্থ তা বুঝতে পারি না। ভয় কি ক্ষুধার মতো একটা প্রবৃত্তি?”

দাদো বলিলেন, “ভয় কি তা বুঝতে পারবে, যেদিন প্রথম যুদ্ধে নামবে, যেদিন হাতিয়ারবন্দ্‌ শত্রুকে সামনে দেখতে পাবে।”

বালক কি একটা বলিতে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল।

দাদো বলিলেন, “আমি বড় বড় বীরের মুখে শুনেছি যে তাঁরাও প্রথমে শত্রুর সম্মুখীন হয়ে ভয় পেয়েছেন। এতে লজ্জার বিষয় কিছু নেই; সেই ভয়কে জয় করাই প্রকৃত বীরত্ব।”

সূর্য গিরিশৃঙ্গের অন্তরালে অদৃশ্য হইল, সঙ্গে সঙ্গে নিম্নভূমির উপর ছায়ার একটা সূক্ষ্ম যবনিকা পড়িয়া গেল। শুধু ঊর্ধ্বে নগ্ন গিরিকূট এবং আরো ঊর্ধ্বে নীল আকাশে একখণ্ড মেঘ সিন্দূরবর্ণ ধারণ করিয়া জ্বলিতে লাগিল।

দাদো নিজের অশ্ব সম্মুখে চালিত করিয়া কহিলেন, “আর দেরি নয়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এখনো দুটো পাহাড় পার হতে বাকি। পুণা পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।”

বালক তাঁহার অনুগামী হইয়া বলিল, “তা হলেই বা? আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে ঠিক নিয়ে যাব।”

দাদো বলিলেন, “রাত্রে এসব পাহাড়-পর্বত নিরাপদ নয়। শোনোনি, এদিকের গাঁয়ে-বস্তিতে আজকাল প্রায় লুঠ-তরাজ হচ্ছে?”

বালক ভারী বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, “তাই নাকি? কৈ, আমি তো শুনিনি। কারা লুঠ-তরাজ করছে?”

দাদো বলিলেন, “তা কেউ জানে না। বোধ হয় এই দিকের বুনো পাহাড়ী মাওলীরা ডাকাতি করছে। বিজাপুর এলাকার তিনটে বড় বড় গ্রাম গত চার মাসের মধ্যে লুণ্ঠ হয়ে গেছে। শুনতে পাই তাদের সর্দার একজন ছোকরা, লোহার সাঁজোয়া আর মুখোস পরে ঘোড়ায় চড়ে লুঠেরাগুলোকে ডাকাতি করতে নিয়ে যায়। ছোঁড়াটা নাকি ভয়ংকর কালো, বেঁটে আর জোয়ান।”

বালক তাহার হাতের বল্লমটা খেলাচ্ছলে ঘুরাইতে ঘুরাইতে তাচ্ছিল্যভরে জিজ্ঞাসা করিল, “তাই নাকি? তুমি এত কথা কোথা থেকে জানলে, দাদো?”

দাদো পাহাড়ে ঘোড়া চড়াইতে চড়াইতে বলিলেন, “ও অঞ্চলের দেশমুখরা দরবারে নালিশ করতে এসেছিল। তাদের বিশ্বাস ডাকাতের সর্দার পুণার লোক।”

দাদোর পশ্চাতে বালকও পাহাড়ে উঠিতে উঠিতে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা দরবার থেকে কি ব্যবস্থা করলে?”

দাদো বলিলেন, “কিছু করা হয়নি। দেশমুখদের তোমার বাবার কাছে বিজাপুরে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

বালক পশ্চাতে থাকিয়া মিটিমিটি হাসিতেছিল, দাদো তাহা দেখিতে পাইলেন না। কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না।

পাহাড়ের পিঠের উপর উঠিয়া দুইজনে ক্ষণকাল পাশাপাশি দাঁড়াইলেন। এখানে আবার সূর্যকিরণ আসিয়া বালকের বল্লমের ফলায় যেন আগুন ধরাইয়া দিল।

সম্মুখের পাহাড়তলিতে তখন ঘোর-ঘোর হইয়া আসিয়াছে, নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বালক বলিল, “আচ্ছা দাদো, এখন যদি আমাদের ডাকাতে আক্রমণ করে, তুমি কি করো?”

দাদো ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে একবার চতুর্দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কি আর করি! তাদের সঙ্গে লড়াই করি।”

“তারা যদি পঞ্চাশজন হয়?”

“তা হলেও লড়ি।”

বালক বলিল, “কিন্তু সে যে ভারী বোকামি হবে, দাদো। পঞ্চাশজনের সঙ্গে লড়াই করে তুমি পারবে কেন?”

দাদো বলিলেন, “তাতে কি! না হয় লড়াই করতে করতে মরব।”

বালক বিস্মিত হইয়া বলিল, “কিন্তু এরকম মরে লাভ কি, দাদো?” তারপর মাথা নাড়িয়া বলিল, “আমি কিন্তু লড়ি না, তীরের মতো এই ধার বেয়ে পালাই। এত জোরে পালাই যে ডাকাতের বর্শা আমাকে ছুঁতেও পারবে না।”

ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে দাদো বলিলেন, “ক্ষত্রিয়ের ছেলে তুমি, দুশমনের সামনে থেকে পালাবে? এই না বলছিলে, ভয় কাকে বলে জানো না?”

বালক বলিল, “ভয়! পালানোর সঙ্গে ভয়ের সম্পর্ক কি? পালাব, কারণ পালালেই আমার সুবিধে হবে, পরে ডাকাতদের জব্দ করতে পারব। আর লড়ে যদি মরেই যাই, তাহলে তো ডাকাতদের জিত হল।”

দাদো মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “না না, এসব শিক্ষা তুমি কোথা থেকে পাচ্ছ? না লড়ে পালিয়ে যাওয়া ভয়ংকর কাপুরুষতা। যে বীর, সে কখনো পালায় না। রাজপুত বীরদের গল্প শোনোনি?”

বালক বলিল, “রাজপুতদের গল্প শুনলে আমার গা জ্বালা করে। তারা শুধু লড়াই করতে পারে, বুদ্ধি এতটুকু নেই। যিনি যতবড় বীর, তিনি ততবড় বোকা।”

দাদো খোঁচা দিয়া বলিলেন, “তুমিও তো রাজপুত! মায়ের দিকে থেকে তোমার গায়েও তো যদুবংশের রক্ত আছে।”

বালক সবেগে শিরঃসঞ্চালন করিয়া বলিল, “না, আমি রাজপুত হতে চাই না, আমি মারাঠী।” বালকের ললাট মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে হাসিয়া উঠিয়া বলিল, “আচ্ছা দাদো, তোমার কাছে তো বড় বড় যুদ্ধের গল্প শুনেছি, কিন্তু একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারি না। সম্মুখ-যুদ্ধ করার মানে কি?”

দাদো সহসা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলেন না। শেষে বলিলেন, “সম্মুখ-যুদ্ধ মানে সামনা-সামনি শক্তি পরীক্ষা। যার শক্তি বেশি সেই জিতবে।”

“আর যার শক্তি কম, সে যদি চালাকি করে জিতে যায়?”

“সে তো আর ধর্মযুদ্ধ হল না।”

“নাই বা হল! যুদ্ধে হার-জিতই তো আসল— ধর্মযুদ্ধ হল কি না তা দেখে লাভ কি?”

দাদো অনেকক্ষণ বালকের জিজ্ঞাসু মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, শেষে দুঃখিতভাবে ঘাড় নাড়িয়া বিড়বিড় করিয়া বলিলেন, “বাপের স্বভাব ষোল আনা পেয়েছে, তেমনি ধূর্ত আর হুঁশিয়ার— সর্বদাই লাভ-লোকসানের দিকে নজর। আর শুধু বাপ কেন, বংশটাই ধূর্ত! মালোজী ভোঁস্‌লে যদি চালাকি করে যদুবংশের মেয়ে ঘরে না আনতে পারত, তাহলে ভোঁস্‌লে বংশকে চিনত কে? আর শাহুই বা এতবড় জায়গীরদার হত কোথা থেকে?”

পলকের মধ্যে বালকের সংশয়প্রশ্নপূর্ণ মুখভাবের পরিবর্তন হইল। বালকোচিত কৌতূহলে দাদোর নিকটে সরিয়া গিয়া সানুনয়কণ্ঠে বলিল, “দাদো, তুমি যে আমার মা’র বিয়ের গল্প বলবে বলেছিলে, কৈ বললে না? বলো না দাদো, কি করে ঠাকুর্দা যদুবংশী মেয়ে ঘরে আনলেন।”

এই সময় নিম্নের ছায়াচ্ছন্ন প্রদোষান্ধকার হইতে গাভীর হাম্বারব ভাসিয়া আসিল। বালক সচকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “ঐ শোনো, দেওরামের গরু ঘরে ফিরে এলো। চলো, চলো দাদো, আর দেরি নয়; সমস্ত দিন ঘুরে ঘুরে ভারী ক্ষিদে পেয়ে গেছে— এতক্ষণ তা লক্ষ্যই করিনি। দেওরামের মেয়ে নুন্নার সঙ্গে সেই যে সকলবেলা তেঁতুলবনের ধারে দেখা হয়েছিল, সে বলেছিল ফেরবার সময় তাজা দুধ খাওয়াবে। জয় ভবানী!”

বালক দুই পা দিয়া ঘোড়ার পেট চাপিয়া ধরিতেই ঘোড়া লাফাইয়া সম্মুখ দিকে অগ্রসর হইল। আঁকিয়া বাঁকিয়া পার্বত্য হরিণের মতো পাথর হইতে পাথরের উপর ধাপে ধাপে লাফাইয়া পড়িয়া বিদ্যুদ্বেগে নীচের দিকে অদৃশ্য হইল।

দাদো বালকের উচ্চ কণ্ঠস্বর দূর হইতে শুনিতে পাইলেন, “চলে এসো দাদো, দেওরামের ঘর ঝর্ণাতলার টালের উত্তর দিকে কুলগাছের জঙ্গলের মধ্যে; যদি খুঁজে না পাও, হাঁক দিও— নুন্না এসে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।”

বৃদ্ধ পর্বত হইতে অবতরণ করিয়া বদরীবনের মধ্যে যখন দেওরামের কুটির অঙ্গনে পৌঁছিলেন, তখন দেখিলেন একটি বারো-তেরো বছরের মাওলী চাষার মেয়ে একটা ক্ষুদ্রকায় গাভীকে দোহনের চেষ্টা করিতেছে এবং বালক ঘোড়া ছাড়িয়া দিয়া অদূরে দাঁড়াইয়া সকৌতুকে সেই দৃশ্য দেখিতেছে। গাভীটা বোধ হয় অপরিচিত ব্যক্তি ও ঘোড়া দেখিয়া ভয় পাইয়াছে, তাই কিছুতেই স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া দুগ্ধ দোহন করিতে দিতেছে না, চেষ্টা করিবামাত্র সরিয়া সরিয়া যাইতেছে।

মেয়েটি বিব্রত হইয়া বলিল, “তুমি ওর শিং দুটো একবার ধরো না, নইলে বজ্জাত গরু কিছুতেই দুইতে দেবে না।”

বালক গরুর শিং ধরিবার কোনও চেষ্টা না করিয়া তামাসা করিয়া বলিল, “তুই কেমন মাওলার মেয়ে— গাই দুইতে জানিস না? দাঁড়া, বিশুয়াকে বলে দেব, সে আর তোকে বিয়ে করবে না।”

ক্ষুব্ধ লজ্জায় নুন্না এতটুকু হইয়া গিয়া বলিল, “তোমার ঘোড়া দেখেই তো আজ ও অমন করছে, নইলে আমিই তো রোজ দুই।”

বালক মুরুব্বিয়ানা দেখাইয়া বলিল, “হ্যাঁ, দুই! আর বড়াই করতে হবে না। দে আমায় ঘটি, আমি দুয়ে দিচ্ছি।”

নুন্না বলিল, “তুমি পারবে না। আমি আর বাবা ছাড়া কেউ ওকে দুইতে পারে না। তোমাকে ও এখনি ফেলে দেবে।”

বালকের আত্মাভিমানে ভীষণ আঘাত লাগিল, সে তর্জন কারিয়া বলিল, “কি! ফেলে দেবে! দেখি তো কেমন তোর গরু? দে ঘটি।”

নুন্নার হাত হইতে জোর করিয়া ঘটি কড়িয়া লইয়া বালক দুগ্ধ দোহন করিতে বসিল। গরুটা ঘাড় বাঁকাইয়া একবার দোহনকারীকে দেখিয়া লইয়া চক্রাকারে ঘুরিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু বালকও ছাড়িবার পাত্র নয়, ঘটি লইয়া মুখে নানাপ্রকার প্রীতিসূচক শব্দ করিতে করিতে তাহার পশ্চাতে ঘুরিতে লাগিল। অবশেষে কি মনে করিয়া গাভীটা দাঁড়াইয়া পড়িল। তখন বালক সন্তর্পণে তাহার দেহে হাত বুলাইয়া দিয়া গাভীর পশ্চাদ্দিকে বসিয়া দুই জানুর মধ্যে ভাণ্ডটি ধরিয়া যেমন গাভীর ঊধসের দিকে হাত বাড়াইয়াছে, অমনি গাভী এক চরণ তুলিয়া তাহাকে এরূপ সবেগে পদাঘাত করিল যে বালক ভাণ্ডসমেত চিৎ হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।

নুন্না কলকণ্ঠে উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। গাভীটা যেন কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রোমন্থন করিতে লাগিল।

বৃদ্ধ দাদো অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া বালকের কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “লেগেছে নাকি?”

বালক অঙ্গের ধূলা ঝাড়িতে ঝাড়িতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “গরু নয়— ঘোড়া। গরু কখনো অমন চাট ছোঁড়ে? নে নুন্না, তোর ঘটি, আমি ঘোড়ার দুধ খেতে চাই না। বাড়ি চললুম।”

বালক অশ্বপূষ্ঠে উঠিতে যায় দেখিয়া নুন্না মিনতি করিয়া বলিল, “আর একটু দাঁড়াও না, বাবা এলো বলে। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে বলছিলে— ঘরে বাজরার রুটি আছে, এনে দেব?”

বালক বলিল, “না, তোর রুটি-দুধ— কিছু খেতে চাই না। আমি চললুম।”

এমন সময় কুটিরের পশ্চাতের ঘন ঝোপের ভিতর হইতে দুইটি লোক বাহির হইয়া আসিল। একজন খর্বকায় বৃষস্কন্ধ মধ্যবয়স্ক লোক, অপরটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের দৃঢ়শরীর যুবা। হাতের বল্লম কুটিরের গায়ে হেলাইয়া রাখিয়া মধ্যবয়সী লোকটি দ্রুতপদে আসিয়া বালকের ঘোড়ার রাশ ধরিল। বালক তখন ঘোড়ার উপর চড়িয়া বসিয়াছে, লোকটি সানুনয় নিম্নকণ্ঠে বলিল, “রাজা, ঘোড়া থেকে নামো, দুধ না খেয়ে যেতে পাবে না।”

যুবকটিও এতক্ষণে সসম্ভ্রম হাস্যোদ্ভাসিত মুখে নিকটে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। বালক একলম্ফে ঘোড়া হইতে নামিয়া দৌড়িয়া গিয়া নুন্নার চুলের মুঠি ধরিল, তাহাকে চুল ধরিয়া টানিতে টানিতে যুবকের সম্মুখে লইয়া গিয়া প্রায় তাহার বুকের উপর ফেলিয়া দিয়া বলিল, “এই নে বিশুয়া, এটাকে তুই ঘরে নিয়ে যা, তোর সঙ্গে ওর বিয়ে দিলুম। যদি বজ্জাতি করে, খুব পিটবি। আর ওই হতভাগা গরুটাকেও তুই নিয়ে যা, ওটা হল তোর বিয়ের যৌতুক।”

নুন্না বালকের হাত ছাড়াইয়া কুটিরের ভিতর পলাইয়া গেল। বিশুয়া হাসিতে হাসিতে হেঁট হইয়া বালকের পদস্পর্শ করিয়া বলিল, “তুমি যখন দিলে রাজা, তখন আর আমার ভাবনা কি! এবার ঘোড়ার পিঠে তুলে ওকে ঘরে নিয়ে যাব। কি বলো, দেওরাম?”

দেওরাম গম্ভীরভাবে একটু হাসিয়া বলিল, “তা যাস্‌। রাজা যখন তোর হাতে নুন্নাকে দিয়েই দিয়েছে, তখন আর আমি কি বলব? আর, আমি নুন্নার মন জানি, সেও তোকেই বিয়ে করতে চায়।”

এই সময় নুন্নার হাসিমুখ কুটিরের ভিতর হইতে পালকের জন্য দেখা গেল। সে সশব্দে কুটির-দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

দেওরাম ভূপতিত ঘটিটা তুলিয়া লইয়া দুগ্ধ-দোহনে প্রবৃত্ত হইল। গাভীটা এবার আর কোনও আপত্তি করিল না।

বৃদ্ধ দাদো এতক্ষণ অদূরে দাঁড়াইয়া ইহাদের কথাবার্তা শুনিতেছিলেন। তাহার মুখে সংশয় ও সন্দেহের ছায়া ঘনীভূত হইতেছিল। এই নির্জন বনের মধ্যে একটিমাত্র কুটির, তাহার অধিবাসী এই ভীমকায় দেওরাম। ইহারা কে এবং বালকের সহিত ইহাদের পরিচয় হইল কিরূপে?

তিনি অগ্রসর হইয়া বিশুয়াকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা এঁকে চিনলে কি করে?”

নিমেষের জন্য বিশুয়া ও বালকের চোখে চোখে একটা ইঙ্গিত খেলিয়া গেল। বিশুয়ার মুখ ভাবলেশহীন হইয়া গেল, সে কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিল, “দরবারে ওঁকে দেখেছি, উনি জাগীরদারের ছেলে।”

বৃদ্ধ সন্দিগ্ধভাবে পুনশ্চ প্রশ্ন করিলেন, “তোমরা ওঁকে রাজা বলে ডাকছ কেন?”

বিশুয়া কোনও উত্তর খুঁজিয়া পাইল না, দুগ্ধদোহন করিতে করিতে দেওরাম জবাব দিল, “জাগীরদারের ছেলে, উনিই একদিন মালিক হবেন, তাই রাজা বলে ডাকি।”

দাদো উত্তরে সন্তুষ্ট হইলেন না, বলিলেন, “ইনি জায়গীরদারের মেজো ছেলে তাও জানো না? সে যাক—” বালকের দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিন্তু তুমি এদের চিনলে কি করে জিজ্ঞাসা করি?”

বালক অত্যন্ত সরলভাবে উত্তর করিল, “শিকার করতে এসে এদের সঙ্গে ভাব হয়েছে, দাদো। তুমি তো আর প্রত্যেকবার আমার সঙ্গে আসো না, তাই জানো না। কতবার শিকার করে ফেরবার মুখে দেওরামের জোয়ারী রুটি খেয়েছি— দেওরাম আমাকে ভারী যত্ন করে।”

দাদো বালকের ছলনাহীন মুখের দিকে কিয়ৎকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকিয়া শুধু কহিলেন, “হুঁ।” মনে মনে ভাবিলেন, — তোমার গতিবিধির উপর এখন হইতে একটু বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। ব্যাপার ঠিক বুঝা যাইতেছে না।

ধারোষ্ণ দুগ্ধের পাত্র আনিয়া দেওরাম বালকের হাতে দিল। বালক জিজ্ঞাসা করিল, “দাদো, তুমি খাবে না?”

দাদো কহিলেন, “না, তুমি খাও। আমার এখনো আহ্নিক বাকি।”

দুগ্ধপাত্র দুই হস্তে ধরিয়া বালক অদূরে একটি শিলাখণ্ডের উপর গিয়া বসিল। দেওরামও তাহার অনুবর্তী হইয়া পাশে গিয়া দাঁড়াইল। এক চুমুক দুগ্ধ পান করিয়া বালক অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে তাকাইয়া নিম্নস্বরে বলিল, “পরশু অমাবস্যা।”

দেওরামও অলসভাবে ঊর্ধ্বে দৃষ্টি করিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, “হ্যাঁ। লোক সব তৈরি আছে। কোথায় থাকতে হবে?”

“রাক্ষসমুখো গুহার মধ্যে। আমি দেড় পহর রাত্রে আসব। পঁচিশ জনের বেশি লোক যেন না হয়।”

“বেশ। এবার কোন্‌ দিকে যাওয়া হবে?”

“উত্তর দিকে। দক্ষিণে আর নয়, সেদিকে বড় হৈ চৈ হয়েছে। দরবার পর্যন্ত খবর গেছে।”

দাদো তাহাদের দিকে লক্ষ্য করিতেছেন দেখিয়া দেওরাম প্রকাণ্ড একটা হাই তুলিয়া অপেক্ষাকৃত উচ্চকণ্ঠে বলিল, “আচ্ছা। হরিণ কিন্তু এদিকে পাওয়া যায় না।”

বালক বাকি দুগ্ধটুকু নিঃশেষে পান করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহজভাবে বলিল, “আজ তাহলে চললুম, দেওরাম। নুন্নার বিয়ের দিন আমাকে খবর দিও— আমি দাদোকে নিয়ে আসব। দাদো একজন ভারী শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত জানো তো? উনিই নুন্নার বিয়ে দেবেন।”

ঘোড়ার পিঠে একলাফে উঠিয়া বালক বলিল, “আর যদি হরিণছানা পাও, পুণায় নিয়ে যেও। আর দেরি করব না, রাত হয়ে এলো। দাদোর আবার ভারী ডাকাতের ভয়!”

বিশুয়া ও দেওরাম দাঁড়াইয়া রহিল, অশ্বারোহী দুইজনে বদরীকানন পার হইয়া ঝরনার সঞ্চিত অগভীর ক্ষুদ্র জলাশয়ের পাশ দিয়া আবার পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করিল। এইটি শেষ পাহাড়— ইহার পরই উপত্যকা। কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না, দুইজনেই স্ব স্ব চিন্তায় মগ্ন। এদিকে অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিতেছে। ঘোড়া দুটি সতর্কভাবে পর্বতগাত্র আরোহণ করিতেছে।

হঠাৎ চমক ভাঙিয়া বালক দাদোর দিকে দৃষ্টিপাত করিল, দেখিল দাদো তাহারই মুখের প্রতি সন্দেহাকুল চক্ষে চাহিয়া আছেন। বালক অপ্রতিভ হইয়া পড়িল, তারপর জোর করিয়া হাসিয়া বলিল, “কি দেখছো, দাদো? এবার আমার মা’র বিয়ের গল্প বলো।”

বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া কিয়ৎকাল নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন, আপনার মনে বলিলেন, “বংশের ধারা বদলানো যায় না; বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়, শৃগাল হয় না— ঈশ্বরের এই বিধান। কে জানে, হয়তো এর মধ্যে মঙ্গলেরই বীজ নিহিত আছে।”

বালক তাঁহাকে দীর্ঘকাল চিন্তা করিবার অবকাশ না দিয়া পুনশ্চ কহিল, “বলো না, দাদো?”

দাদো আবার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন, “গল্প অতি সামন্যই। কিন্তু তোমার ঠাকুর্দা মালোজী ভোঁস্‌লে যে কি রকম চতুর ছিলেন, এই গল্প থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়।

“তোমার মাতুলবংশের মতো এতবড় বিখ্যাত যশস্বী বংশ দাক্ষিণাত্যে খুব অল্পই আছে। আজ থেকে নয়, চারশো বছর আগে আলাউদ্দিন খিল্‌জির আমল থেকে দেবগিরির যদুবংশের নাম দক্ষিণাত্যের পাথরে পাথরে তলোয়ার দিয়ে খোদাই হয়ে আসছে।

“অতীতের কোন্ যুগে এই যদুবংশ রাজপুতানা থেকে এসে দেবগিরিতে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে কাহিনী লুপ্ত হয়ে গেছে। দেবগিরির রাজ্যও আর নেই; কিন্তু বীরত্বে, ধর্মনিষ্ঠায়, মহানুভবতায় এই বংশ আজ পর্যন্ত হিন্দুমাত্রেরই আদর্শ হয়ে আছে।

“এ-হেন বংশে তোমার দাদামশায় লিখুজী যদুরাও একজন পরাক্রমশালী মহাতেজস্বী পুরুষ ছিলেন। দশ হাজার সিপাহী নিত্য তাঁর রুটি খেত। বিজাপুর-গোলকুণ্ডা তাঁকে যমের মতো ভয় করত, আমেদনগর রাজ্যের তিনি ছিলেন প্রধান স্তম্ভ। মালিক অম্বর যদি তাঁর সঙ্গে কপটাচারিতা না করত— কিন্তু সে অন্য কথা। এখন আসল গল্পটা বলি।

“সে আজ বহুদিনের ঘটনা, তখন আমার বয়স দশ-এগারো বছরের বেশি নয়; কিন্তু সেদিনকার প্রত্যেক ঘটনাটি স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল ফাল্গুনী পৌর্ণমাসী, রাজপুতদের একটা মস্ত উৎসবের দিন। দাক্ষিণাত্যে দোলপূর্ণিমার দিন আবীর খেলার প্রথা এই যদুবংশই প্রচার করেছিলেন। সেদিন দেশের সমস্ত গণ্যমান্য লোক, এমন কি বিজাপুর, গোলকুণ্ডা, আমেদনগর দরবারের বড় বড় হিন্দু আমীর-ওমরা এসে লখুজীর কেল্লার মতো বিশাল ইমারতে জমা হতেন। সমস্ত রাত্রিদিনব্যাপী উৎসব চলত, ফাগ, রং এবং সুরার স্রোত বয়ে যেত।

“সেবার লিখুজীর প্রকাণ্ড প্রাসাদের দরবার-ঘরে মজলিস বসেছে। মেঝের ওপর পার্সী গালিচা পাতা, তার ওপর অনেকে বসেছেন; দরবার লোকে লোকারণ্য। সিপাহী থেকে সর্দার পর্যন্ত সকলের অবাধ যাতায়াত। সামান্য সৈনিক পাঁচহাজারী সর্দারের মুখে আবীর মাখিয়ে দিচ্ছে, মন্‌সবদার সিপাহীকে মাটিতে ফেলে তার মুখে মদ ঢেলে দিচ্ছে। হাসির হর্‌রা ছুটছে। ছোট বড়, উচ্চ নীচ কোনও প্রভেদ নেই, এই একদিনের জন্যে সকলে সমান। সবাই আমোদে মত্ত।

“সভার মাঝখানে মস্তবড় একটা চাঁদির থালায় আবীর স্তূপীকৃত রয়েছে, সেই থালা ঘিরে প্রধান প্রধান অতিথিরা বসেছেন। পানদান, গুলাবপাশ, আতরদান চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে। স্বয়ং লখুজী এখানে আসীন; তোমার ঠাকুর্দা মালোজীও আছেন। মালোজী তখন লখুজী অনুগৃহীত একজন সামান্য সর্দার মাত্র; কিন্তু তাঁর কূটবুদ্ধি ও রণনৈপুণ্যের জন্যে লখুজী তাঁকে ভারী স্নেহ করতেন। তাই মালোজীও সাহস করে এই সভায় এসে বসেছেন। সকলের মুখেই আবীরের প্রলেপ, দেহের বস্ত্র এবং মিরজাই রঙে রক্তবর্ণ, চক্ষু ঢুলুঢুলু। এখানে গানের মজলিস বসেছে; আরো অনেক লোক চারিদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে গান শুনছে এবং মজা দেখছে।

“গান গাইছেন আমেদনগরের একজন বুড়ো ওমরা— তাঁর নাম ভুলে গেছি। মস্ত ওস্তাদ বলে তাঁর খ্যাতি ছিল। গড়গড়া টানতে টানতে হঠাৎ তিনি বসন্তরাগের এক তান মারলেন— সুরের ধমকে পাকা গোঁফ থেকে একরাশ আবীর উড়ে গেল। তোমার ঠাকুর্দা মালোজী সারঙ্গী কোলে করে ওস্তাদের পিছনে বসে ছিলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে সংগত আরম্ভ করলেন। লখুজী নিজে মৃদঙ্গ বাজাতে লাগলেন।

“গান থামলে প্রশংসাধ্বনির একটা ঝড় বয়ে গেল, লখুজী পাখোয়াজ ফেলে প্রায় এক তোলা অম্বুরী আতর পলিতকেশ গায়কের গোঁফে মাখিয়ে দিয়ে দাড়ি ধরে নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘কৎল্‌ কিয়া বিবি! আর একঠো ফর্মাও!’

“বৃদ্ধ দন্তহীন হাসি হেসে চোখ ঠেরে আবার গান ধরলেন, ‘চোলিমে ছিপাউঁ কৈসে যোবনা মোরি’।

“বিরাট হাসির একটা হল্লা পড়ে গেল। লখুজী ওস্তাদকে কোলে তুলে নিয়ে নৃত্য শুরু করে দিলেন। — কি আনন্দের দিনই গিয়েছে; এখন সব স্বপ্ন বলে মনে হয়।”

দাদো একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।

ঘোড়া দুইটি ইতিমধ্যে পর্বত পার হইয়া উপত্যকায় নামিয়া আসিয়াছে, কিন্তু পথ এখনো শিলা-সংকুল। আশেপাশে মাটি ফাটিয়া বড় বড় খাদ রচনা করিয়াছে। শুষ্ক পয়ঃপ্রণালীর মতো এই খাদগুলি অন্ধকারে বড়ই বিপজ্জনক, ঘোড়া একবার পা ফস্কাইয়া উহার মধ্যে পড়িলে কোথায় অন্তর্হিত হইবে তাহার স্থিরতা নাই। এদিকে দিবার দীপ্তিও সম্পূর্ণ নিবিয়া গিয়াছে, কেবল সম্মুখে বহুদূরে পুণার দীপগুলি মিট্‌মিট্‌ করিয়া জ্বলিতেছে।

বালক একাগ্রমনে গল্প শুনিতেছিল, দাদো থামিতেই সাগ্রহে গলা বাড়াইয়া বলিল, “তারপর?”

দাদো বলিলেন, “হুঁশিয়ার হয়ে পথ চলো, রাস্তা বড় খারাপ।” তারপর গল্প আরম্ভ করিলেন, “দু’টি ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে এই দরবার ঘরের চারিদিকে খেলা করে বেড়াচ্ছিল, দু’জনেরই লাল বেনারসী চেলির জোড় পরা, কানে কুণ্ডল, হাতে বালা, গলায় হার। ছেলেটির বয়স পাঁচ বছর, আর মেয়েটির তিন।

“এদের দিকে কারো দৃষ্টি ছিল না, এরা নিজের মনে ঘরময় খেলে বেড়াচ্ছিল। কখন এক সময় মেয়েটি দূর থেকে ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল, গম্ভীর মুখে ছেলেটির আপাদমস্তক দেখে নিয়ে আধ-আধ ভাষায় প্রশ্ন করলে, ‘তুমি কে?’

“ছেলেটিও মেয়েটির দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে বললে, ‘আমি শাহু। আমি তীর ছুঁড়তে পারি। তুমি কে?’

“মেয়েটির দুই চক্ষু সম্ভ্রমে ভরে উঠল, সে ফুলের মতো ঠোঁট দুটি খুলে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে বললে, ‘আমি দিদা।’ তারপর একটু ভেবে আবার বললে, ‘আমার বাবাও তীর ছুঁড়তে পারে।’

“অতঃপর এই বীর এবং বীরকন্যার মধ্যে ভাব হতে বেশি দেরি হল না। শাহু গিয়ে মেয়েটির গলা জড়িয়ে নিলে, মেয়েটিও শাহুর কোমর জড়িয়ে ধরলে। এইভাবে তারা অনেকক্ষণ দরবার-ঘরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তাদের মধ্যে চুপিচুপি কি কথা হল তারাই জানে। খুব সম্ভব শাহু তার অসামান্য শৌর্য-বীর্যের কথা খুব ফলাও করে ব্যাখ্যা করে মেয়েটির ছোট্ট প্রাণটুকু জয় করে নিচ্ছিল। আর মেয়েটিও বোধ হয় নিঃসংশয় সহানুভূতি এবং প্রশংসা দ্বারা শাহুর বীর-হৃদয় সম্পূর্ণ বশীভূত করে ফেলছিল।

“এদিকে গানের মজলিস তখন টিলে হয়ে এসেছে; বৃদ্ধ গায়ক তিন পাত্র গুলাবি সরবত খেয়ে কিংখাপের তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে হাঁপাচ্ছেন, — এমন সময় এই দু’টি ছেলে-মেয়ে গলা-জড়াজড়ি করে তাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। এতগুলো লোক চারপাশে বসে আছে, কিন্তু সেদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই, নিজেদের কথাতেই তারা মশগুল। বৈঠকে যাঁরা বসেছিলেন তাঁদের সকলের মুগ্ধ দৃষ্টি একসঙ্গে তাদের ওপর গিয়ে পড়ল। এ কি অপূর্ব আবির্ভাব! আজ দোলের দিনে সত্যিই কি বৃন্দাবন-লীলা তাঁদের চোখের সামনে অভিনীত হচ্ছে? সকলে চোখ মুছে দেখলেন, — তাই তো! ছেলেটির বর্ণ নবজলধরশ্যাম, আর মেয়েটি বিদ্যুল্লতার মতো গৌরী!

“মেয়েটির হঠাৎ কি খেয়াল হল, সে আতরদানে তার ছোট্ট চাঁপার কলির মতো আঙুল ডুবিয়ে শাহুর নাকের নীচে আঙুলটি বুলিয়ে দিলে। শাহুও আদর-আপ্যায়নে কম যাবার পাত্র নয়, সে চাঁদির থালা থেকে এক মুঠি আবীর তুলে নিয়ে সযত্নে মেয়েটির মুখে কপালে মাখিয়ে দিলে।

“সকলে আনন্দে জয়ধ্বনি করে উঠলেন, ‘রাধা-গোবিন্দজী কি জয়!’

“লখুজী আর মালোজী ছাড়া আর কেউ জানতেন না এ ছেলে-মেয়ে দু’টি কে। লখুজী উচ্চহাস্য করে উঠলেন, তারপর দু’টিকে কাছে টেনে নিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে বললেন, ‘রাধা-গোবিন্দজী নয়, এরা আমার মেয়ে আর মালোজীর ছেলে। বন্ধুগণ, এ দু’টির বিয়ে হলে কেমন মানায় বলুন তো?’

“লখুজী পরিহাসচ্ছলেই কথাটা বলেছিলেন, তা ছাড়া গুলাবি সরবতের নেশাও অল্পবিস্তর ছিল। তাঁর কথা শুনে সকলে হেসে উঠলেন, কিন্তু মালোজী ভোঁস্‌লে তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে করজোড়ে সকলকে বললেন, ‘মহাশয়গণ, আপনারা সাক্ষী থাকুন, লিখুজী তাঁর কন্যাকে আমার পুত্রের সঙ্গে বাগদত্তা করলেন।’

“সকলে অবাক হয়ে রইলেন, লিখুজীর নেশা ছুটে গেল। তাঁর মুখ আবীর-প্রলেপের ভিতর থেকে ক্রোধে কালো হয়ে উঠল। তাঁর মেয়েকে— দেবগিরির রাজবংশের মেয়েকে যে মালোজীর মতো একজন সামান্য প্রাণী নিজের পুত্রবধূ করবার স্পর্ধা করতে পারে, এ তাঁর কল্পনারও অতীত; কিন্তু তবু কথাটা যে তাঁর মুখ থেকেই বেরিয়ে গেছে এ কথাও অস্বীকার করা চলে না। মালোজীর দিকে কট্‌মট্‌ করে চেয়ে লিখুজী বললেন, ‘মালোজী, তুমি পাগলের মতো কথা বলছ। আমার মেয়ে রাজার ঘরে পড়বে।’

“মালোজী পূর্ববৎ জোড়করে বললেন, ‘আমার ছেলে আপনার মেয়ের মুখে আবীর দিয়েছে, আপনার মেয়ে আমার ছেলের মুখে আতর দিয়েছে, তারপর আপনি তাদের কোলে নিয়ে যা বলেছেন তা উপস্থিত সকলেই শুনেছেন। ধর্মতঃ, আপনার মেয়ে আমার ছেলের বাগ্‌দত্তা। এখন যদি আপনি সে কথা প্রত্যাহার করতে চান, করুন, আমার আপত্তি নেই।’

“ক্রোধে লিখুজী আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, কিন্তু মুখ দিয়ে তাঁর কথা বেরুল না। একবার সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কিন্তু তাঁদের মনোভাব বুঝতেও বিলম্ব হল না; সকলেই নীরবে মালোজীর কথার সমর্থন করছেন। লখুজী নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ঝড়ের মতো অন্তঃপুরে চলে গেলেন।

“মালোজীও ছেলে নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন। চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল যে লখুজীর মেয়ে প্রকাশ্য দরবারে মালোজীর ছেলের বাগ্‌দত্তা হয়েছে। কথাটা অবশ্য বেশি দিন চাপা থাকত না, প্রকাশ হয়ে পড়তই; কিন্তু এমনি তোমার ঠাকুর্দার উদ্যম আর তৎপরতা যে সপ্তাহ মধ্যে মহারাষ্ট্রের সর্বত্র এই সুসংবাদ প্রচার হয়ে পড়ল, জনপ্রাণীরও জানতে বাকি রইল না।

“লখুজী নিষ্ফল ক্রোধে ফুলতে লাগলেন। মালোজীর সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়ে গেল, এমন কি মুখ-দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, মালোজীর মতো ধড়িবাজ অকৃতজ্ঞ লোককে আর তিনি কোনও সাহায্য করবেন না, বরং তার যাতে অনিষ্ট হয় সেই চেষ্টাই করবেন।

“তাঁর প্রতিজ্ঞা কিন্তু রইল না। যতই বছরের পর বছর কেটে যেতে লাগল, ততই তিনি বুঝতে পারলেন চতুর মালোজী তাঁকে কি বিষম ফাঁদে ফেলেছে। তিনি বুঝলেন অন্যত্র মেয়ের বিয়ে দিলে মেয়ে সুখী হবে না, যত তার বয়স বাড়ছে শাহু ছাড়া আর কেউ যে তার স্বামী হতে পারে না, এ ধারণা তার মনে ততই দৃঢ় হচ্ছে। তাছাড়া অন্যের বাগ্‌দত্তা মেয়ে কেউ জেনেশুনে বিয়ে করতে চায় না, দু’-চারটে ঘরানা ঘরে সম্বন্ধ করতে গিয়ে লজ্জা পেয়ে লখুজীকে ফিরে আসতে হল। শেষ পর্যন্ত তিনি দেখলেন শাহু ছাড়া জিজার গতি নেই।

“এইভাবে ন’-দশ বছর কেটে গেছে। মালোজী কপালের জোরে এবং বুদ্ধিবলে খুব উন্নতি করেছেন, বিষয়-সম্পত্তিও হয়েছে। লখুজীর বিদ্বেষ ও অনিচ্ছা ক্রমেই কমে আসতে লাগল। তারপর একদিন মালোজীকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে বললেন, ‘ভাই, আমারই ভুল; জিজাকে তুমি তোমার ছেলের জন্যে নিয়ে যাও।’

“ব্যাস্‌, আর কি! এইখানেই গল্প শেষ। মালোজীর মতলব সিদ্ধ হল, মহা ধুমধাম করে তোমার বাপের সঙ্গে তোমার মায়ের বিয়ে হয়ে গেল। তখন তোমার মা’র বয়স তেরো বৎসর, আর শাহুর পনেরো। বিয়ের রাত্রে তোমার মা’র গর্বোজ্জ্বল হাসিভরা মুখ আমার আজও মনে আছে।

“তবে একথা ঠিক যে জন্মান্তরের সম্বন্ধ না হলে এত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে, এতবড় সামাজিক পার্থক্য লঙ্ঘন করে এ বিয়ে কখনই হতে পারত না। তোমার মা-বাবা পূর্বজন্মেও স্বামী-স্ত্রী ছিলেন।”

বৃদ্ধ দাদো মৌন হইলেন। কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না, দুইজনে নীরবে চলিলেন। অন্ধকার তখন বেশ গাঢ় হইয়াছে, পাশের লোকও স্পষ্ট দেখা যায় না। দাদো লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন, বালক দুই কর যুক্ত করিয়া ললাটে ঠেকাইয়া বারংবার কাহার উদ্দেশে নমস্কার করিতেছে। দাদো কথা কহিলেন না, অপূর্ব আবেগভরে তাঁহার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল।

কিয়ৎকাল পরে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া অর্ধস্ফুটস্বরে বালক বলিল, “কি সুন্দর গল্প! আমার মা’র মতো এমন মা পৃথিবীর আর কারো নেই— না দাদো?”

দাদো সংযতকণ্ঠে বলিলেন, “না। তোমার মায়ের মতো এমন অসামান্য নারী আর কোথাও নেই। সেই তিন বছর বয়স থেকে আজ পর্যন্ত দেখে আসছি, এমনটি আর দেখিনি।”

পূর্ণ হৃদয় লইয়া দুইজনে নীরব রহিলেন। ক্রমে পুণার আলোক নিকটবর্তী হইতে লাগিল, পথ সমতল ও অনুদ্ঘাত হইল। অশ্বদ্বয় আশু গৃহে পৌঁছিবার আশায় দ্রুতবেগে চলিতে আরম্ভ করিলে।

পুণা পৌঁছিতে যখন পাদক্রোশ মাত্র বাকি আছে, তখন কে একজন সম্মুখের অন্ধকার হইতে উচ্চকণ্ঠে হাঁকিল, “হো শিব্বা হো! হো দাদোজী!”

বালক শিব্বা চমকিয়া উঠিয়া সানন্দে চিৎকার করিয়া উঠিল, “তানা! তানা!” তারপর তীরবেগে সম্মুখে ঘোড়া ছুটাইয়া দিল।

অন্ধকারে তানাজী মালেশ্বর ঘোড়ার উপর বসিয়া ছিল, শিব্বা প্রায় তাহার ঘাড়ের উপর গিয়া পড়িল।

তানাজী তিরস্কারের সুরে বলিল, “আজ কি আর বাড়ি ফিরতে হবে না? কোথায় ছিলে এতক্ষণ? মা কত ভাবছেন, শেষে আর থাকতে না পেরে আমাকে পাঠালেন?”

শিব্বা ঘোড়ার উপর হইতেই তানাজীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “মা কোথায় রে, তানা?”

তানাজী বলিল, “কোথায় আবার— বাড়িতে! দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পথের পানে চেয়ে আছেন। তোমার এত দেরি হল কেন?” গলা খাটো করিয়া বলিল, “দেওরামের সঙ্গে দেখা হল নাকি? ওদিকের কি খবর? কবে?”

শিব্বা অন্যমনস্কভাবে বলিল, “খবর ভালো। অমাবস্যার রাত্রে সব ঠিক হয়েছে — চল্‌ তানা, শীগ্গির বাড়ি যাই। মাকে সমস্ত দিন দেখিনি— ভারী মন-কেমন করছে।”

দুই কিশোর বন্ধু তখন নীড়-প্রতিগামী পাখির মতো দ্রুতবেগে গৃহের দিকে অগ্রসর হইল।

বৃদ্ধ দাদোজী কোণ্ডু বহুদূর পশ্চাতে পড়িয়া রহিলেন।

১৩৩৮