চুয়াচন্দন
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
একদিন গ্রীষ্মের শেষভাগে, সূর্য মধ্যাকাশে আরোহণ করিতে তখনও দণ্ড তিন-চার বাকি আছে, এমন সময় নবদ্বীপের স্নানঘাটে এক কৌতুকপ্রদ অভিনয় চলিতেছিল।
ভাগীরথীর পূর্বতটে নবদ্বীপ। স্নানের ঘাটও অতি বিস্তৃত— এক গঙ্গাঘাটে লক্ষ লোক স্নান করে। ঘাটের সারি সারি পৈঠাগুলি যেমন উত্তর-দক্ষিণে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত, তেমনি প্রত্যেকটি পৈঠা প্রায় সেকালের সাধারণ রাজপথের মতো চওড়া। গ্রীষ্মের প্রখরতায় জল শুকাইয়া প্রায় সব পৈঠাই বাহির হইয়া পড়িয়াছে— দু’-এক ধাপ নামিলেই নদীর কাদা পায়ে ঠেকে। স্নানের ঘাট যেখানে শেষ হইয়াছে, সেখান হইতে বাঁধানো খেয়াঘাট আরম্ভ। তথায় খেয়ার নৌকা, জেলে-ডিঙ্গি, দুই-একটা হাজারমনী মহাজনী ভড় বাঁধা আছে। নৌকাগুলির ভিতরে দৈনিক রন্ধনকার্য চলিতেছে,— ছই ভেদ করিয়া মৃদু মৃদু ধূম উত্থিত হইতেছে।
বহুজনাকীর্ণ স্নান-ঘাটে ব্যস্ততার অন্ত নাই। আজ কৃষ্ণা চতুর্দশী। ঘাটের জনতাকে সমগ্রভাবে দর্শন করিলে মনে হয়, মুণ্ডিতশীর্ষ উপবীতধারী ব্রাহ্মণ ও প্রৌঢ়া-বৃদ্ধ নারীর সংখ্যাই বেশি। ছেলে-ছোকরার দলও নেহাৎ কম নয়; তাহারা সাঁতার কাটিতেছে, জল তোলপাড় করিতেছে। নারীদের স্নানের জন্য কোনও পৃথক ব্যবস্থা নাই, যে যেখানে পাইতেছে সেখানেই স্নান করিতেছে। তরুণী বধূরা ঘোমটায় মুখ ঢাকিয়া টুপ্ টুপ্ ডুব দিতেছে। পর্দাপ্রথা বলিয়া কিছু নাই বটে, তবু অবগুণ্ঠন দ্বারা শালীনতারক্ষার একটা চেষ্টা আছে; যদিও সে চেষ্টা তনু-সংলগ্ন সিক্তবস্ত্রে বিশেষ মর্যাদা পাইতেছে না। সেকালে বাঙালী মেয়েদের দেহলাবণ্য গোপন করিবার সংস্কার বড় বেশি প্রবল ছিল না; গৃহস্থ-কন্যাদের কাঁচুলি পরিবার রীতিও প্রচলিত হয় নাই।
যে যুগের কথা বলিতেছি, তাহা আজ হইতে চারি শতাব্দীরও অধিককাল হইল অতীত হইয়াছে। সম্ভবত আমাদের ঊর্ধ্বতন পঞ্চদশ পুরুষ সে সময় জীবিত ছিলেন। তখন বাংলার ঘোর দুর্দিন যাইতেছিল। রাজশক্তি পাঠানের হাতে; ধর্ম ও সমাজের বন্ধন বহু যুগের অবহেলায় গলিত রজ্জু-বন্ধনের ন্যায় খসিয়া পড়িতেছে। দেশও যেমন অরাজক, সমাজও তেমনি বহুরাজক। কেহ কাহারও শাসন মানে না। মৃত বৌদ্ধধর্মের শবনির্গলিত তন্ত্রবাদের সহিত শাক্ত ও শৈব মতবাদ মিশ্রিত হইয়া যে বীভৎস বামাচার উত্থিত হইয়াছে— তাহাই আকণ্ঠ পান করিয়া বাঙালী অন্ধ-মত্ততায় অধঃপথের পানে স্খলিতপদে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। সহজিয়া সাধনার নামে যে উচ্ছৃঙ্খল অজাচার চলিয়াছে, তাহার কোনও নিষেধ নাই। কে কাহাকে নিষেধ করিবে? যাহারা শক্তিমান, তাহারাই উচ্ছৃঙ্খলতায় অগ্রবর্তী। মাতৃকাসাধন, পঞ্চ-মকার উদ্দাম নৃত্যে আসর দখল করিয়া আছে। প্রকৃত মনুষ্যত্বের চর্চা দেশ হইতে যেন উঠিয়া গিয়াছে।
তখনও স্মার্ত রঘুনন্দন আচারকে ধর্মের নিগূঢ় বন্ধনে বাঁধিয়া সমাজের শোধন-সংস্কার আরম্ভ করেন নাই। কাণভট্ট রঘুনাথ মিথিলা জয় করিয়া ফিরিয়াছেন বটে, কিন্তু নবদ্বীপে সরস্বতীর পীঠ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। নদের নিমাই তখনও ব্যাকরণের টোলে ছাত্র পড়াইতেছেন ও নানাপ্রকার ছেলেমানুষি করিতেছেন। তখনও সেই হরিচরণস্রুত প্রেমের বন্যা আসে নাই— বাঙালীর ক্লেদকলুষিত চিত্তের বহু শতাব্দী সঞ্চিত মলামাটি সেই পূত প্রবাহে ধৌত হইয়া যায় নাই।
১৪২৬ শকাব্দের প্রারম্ভে এক কৃষ্ণা চতুর্দশীর পূর্বাহ্ণে বাংলার কেন্দ্র নবদ্বীপের ঘাটে কি হইতেছিল, তাহাই লইয়া এই আখ্যায়িকার আরম্ভ।
ঘাটে যে সকলেই স্নান করিতেছে, তাহা নয়। এক পাশে সারি সারি নাপিত বসিয়া গিয়াছে; বহু ভট্টাচার্য গোঁসাই গলা বাড়াইয়া ক্ষৌরী হইতেছেন। বুরুজের গোলাকৃতি চাতালে একদল উলঙ্গপ্রায় পণ্ডিত দেহে সবেগে তৈলমর্দন করিতে করিতে ততোধিক বেগে তর্ক করিতেছেন। বাসুদেব সার্বভৌম মিথিলা হইতে সর্ববিদ্যায় পারংগম হইয়া ফিরিয়া আসিবার পর হইতে নবদ্বীপে বিদ্যাচর্চার সূত্রপাত হইয়াছিল। কিন্তু বিদ্যা তখনও হৃদয়ে আসন স্থাপন করেন নাই; তাই বাঙালী পণ্ডিতের মুখের দাপট কিছু বেশি ছিল। শাস্ত্রীয় তর্ক অনেক সময় আঁচড়া-কামড়িতে পরিসমাপ্তি লাভ করিত।
তৈল-মসৃণ পণ্ডিতদের তর্কও ন্যায়শাস্ত্রের সীমানা ছাড়াইয়া অরাজকতার দেশে প্রবেশ করিবার উপক্রম করিতেছিল। একজন অতি গৌরকান্তি যুবা— বয়স বিশ বছরের বেশি নয়— তর্ক বাধাইয়া দিয়া, পাশে দাঁড়াইয়া তাহাদের বিতণ্ডা শুনিতেছিল ও মৃদু মৃদু হাস্য করিতেছিল। তাহার ঈষদরুণ আয়ত চক্ষু হইতে যেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, পণ্ডিত্যের অভিমান ও কৌতুক একসঙ্গে ক্ষরিয়া পড়িতেছিল।
জলের কিনারায় বসিয়া কেহ কেহ পায়ে ঝামা ঘষিতেছিল। নারীরা বস্ত্রাবরণের মধ্যে ক্ষার-খৈল দিয়া গাত্র মার্জনা করিতেছিল। কয়েকজন বর্ষীয়ান্ ব্রাহ্মণ আবক্ষ জলে নামিয়া পূর্বমুখ হইয়া আহ্নিক করিতেছিলেন।
এই সময় দক্ষিণ দিকে গঙ্গার বাঁকের উপর দুইখানি বড় সামুদ্রিক নৌকা পালের ভরে উজান ঠেলিয়া ধীরে ধীরে নবদ্বীপের ঘাটের দিকে অগ্রসর হইতেছিল— অধিকাংশ স্নানার্থীর দৃষ্টি সেই দিকেই নিবদ্ধ ছিল। সমুদ্রযাত্রী বানিজ্যতরীদের দেশে ফিরিবার সময় হইয়াছে; প্রতি সপ্তাহেই দুটি একটি করিয়া ফিরিতেছিল।
ক্রমে নৌকা দুইটি খেয়ার ঘাটে গিয়া ভিড়িল। মধুকর ডিঙ্গার ছাদের উপর একজন যুবা দাঁড়াইয়া পরম আগ্রহের সহিত ঘাটের দৃশ্য দেখিতেছিল; পাল নামাইবার সঙ্গে সঙ্গে সেও তীরে অবতরণ করিবার জন্য ছাদ হইতে নামিয়া গেল।
বড় নৌকা ঘাটের নিকট দিয়া যাইবার ফলে জলে ঢেউ উঠিয়া ঘাটে আঘাত করিতে আরম্ভ করিয়াছিল; অনেক ছেলে-ছোকরা কোমরে গামছা বাঁধিয়া ঢেউ খাইবার জন্য জলে নামিয়াছিল। ঢেউয়ের মধ্যে বহু সন্তরণকারী বালকের হস্তপদসঞ্চালনে ঘাট আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছিল।
হঠাৎ তীর হইতে একটা ‘গেল গেল’ রব উঠিল। যে গৌরকান্তি যুবাটি এতক্ষণ দাঁড়াইয়া তর্করত পণ্ডিতদের রঙ্গ দেখিতেছিল, সে দুই লাফে জলের কিনারায় আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি হয়েছে?”
কয়েকজন সমস্বরে উত্তর দিলে, “কানা-গোঁসাই এতক্ষণ জলে দাঁড়িয়ে আহ্নিক করছিলেন, হঠাৎ তাঁকে আর দেখা যাচ্ছে না। ভাবে-ভোলা মানুষ, হয়তো নৌকোর ঢেউ লেগে তলিয়ে গেছেন।”
যুবা কোমরে গামছা বাঁধিতে বাঁধিতে শুনিতেছিল, আদেশের স্বরে কহিল, “তোমরা কেউ জলে নেমো না, তাহলে গণ্ডগোল হবে। আমি দেখছি।” — বলিয়া সে জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল।
গ্রীষ্মকালে ঘাটে স্নান করা ভাবে-ভোলা মানুষদের পক্ষে সর্বদা নিরাপদ নয়। কারণ, জলের মধ্যে দুই ধাপ সিঁড়ি নামিয়াই শেষ হইয়াছে— তারপর কাদা। এখানে বুক পর্যন্ত জলে বেশ যাওয়া যায়, কিন্তু আর এক পা অগ্রসর হইলেই একেবারে ডুবজলে। যুবক জলে ঝাঁপ দিয়া কয়েক হাত সাঁতার কাটিয়া গেল, তারপর অথৈ জলে গিয়া ডুব দিল।
কিছুক্ষণ তাহার আর কোনও চিহ্ন নাই। ঘাটের ধারে কাতার দিয়া লোক দাঁড়াইয়া দেখিতেছে। সকলের মুখেই উদ্বেগ ও আশঙ্কার ছায়া। কয়েকজন প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক ক্রন্দন-করুণ সুরে হা-হুতাশ করিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
পঞ্চাশ গুণিতে যতক্ষণ সময় লাগে, ততক্ষণ পরে যুবকের মাথা জলের উপর জাগিয়া উঠিল। সকলে হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল— কিন্তু পরক্ষণেই আবার নীরব হইল। যুবক নিমজ্জিত ব্যক্তিকে খুঁজিয়া পায় নাই, সে বার-কয়েক সুদীর্ঘ নিশ্বাস টানিয়া আবার ডুব দিল।
এবারও সমধিক কাল ডুবিয়া থাকিয়া সে আবার উঠিল; একবার সজোরে মস্তক সঞ্চালন করিয়া এক হাতে সাঁতার কাটিয়া তীরের দিকে অগ্রসর হইল।
সকলে সচিৎকারে প্রশ্ন করিল,” পেয়েছ? পেয়েছ?”
যুবক হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “বলতে পারি না। তবে এক মুঠো টিকি পেয়েছি।”
যুবক যখন তীরে আসিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তখন সকলে বিস্মিত হইয়া দেখিল, তাহার বামমুষ্টি এক গুচ্ছ পরিপুষ্ট শিখা দৃঢ়ভাবে ধরিয়া আছে এবং নিমজ্জিত পণ্ডিতের দেহসমেত মুণ্ড উক্ত শিখার সহিত সংলগ্ন হইয়া আছে।
কিয়ৎকাল শুশ্রূষার পর পণ্ডিতের চৈতন্য হইল। তিনি কিছু জল পান করিয়াছিলেন, তাহা উৎক্ষিপ্ত হইবার পর চক্ষু মেলিয়া চাহিলেন। যুবক সহাস্যকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “শিরোমণি মশায়, বলুন দেখি বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন? আপনার নব্য ন্যায়শাস্ত্র কি বলে?”
শিরোমণি এক চক্ষু দ্বারা কিছুক্ষণ ফ্যাল্ফ্যাল্ করিয়া চাহিয়া থাকিয়া ক্ষীণকণ্ঠে কহিলেন, “কে— নিপাতনে সিদ্ধ? ডুবে গিয়েছিলুম— না? তুমি বাঁচালে?” যুবককে শিরোমণি মহাশয় ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ বলিয়া ডাকিতেন। একটু ব্যাকরণের খোঁচাও ছিল; কূটতর্কে অপরাজেয় শক্তির জন্য সমাদরমিশ্রিত স্নেহও ছিল।
নিপাতনে সিদ্ধ হাসিয়া বলিল, “বাঁচাতে পেরেছি কি না, সেই কথাই তো জিজ্ঞাসা করছি। যদি বেঁচে থাকেন, ন্যায়ের প্রমাণ দিন।”
কাণভট্ট ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিলেন। এইমাত্র মৃত্যুর মুখ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছেন— শরীরে বল নাই; কিন্তু তাঁহার এক চক্ষুতে প্রাণময় হাসি ফুটিয়া উঠিল; তিনি বলিলেন, “প্রমাণ নিম্প্রয়োজন। আমি বেঁচে আছি— এ কথা স্বয়ংসিদ্ধ। আমি বেঁচে নেই, এ কথা যে বলে, সে তৎক্ষণাৎ প্রমাণ করে দেয় যে, সে বেঁচে আছে। বাজিকর যত কৌশলী হোক, নিজের স্কন্ধে আরোহণ করতে অক্ষম; মানুষ তেমনি নিজেকে অস্বীকার করতে পারে না।”
নৈয়ায়িকের কথায় সকলে হাসিয়া উঠিল। নিপাতনে সিদ্ধ বলিল, “যাক, তাহলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। — এখন উঠতে পারবেন কি?”
শিরোমণি তাহার হাত ধরিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, “হঠাৎ হাতে পায়ে কেমন খিল ধরে গিয়েছিল। নিপাতন তুমিই জল থেকে টেনে তুলেছ, না?”
নিপাতন বলিল, “উঁহু। আপনাকে টেনে তুলেছে আপনার প্রচণ্ড পাণ্ডিত্যের বিজয়নিশান।”
“সে কি?”
“আপনার নধর শিখাটিই আপনার প্রাণদাতা! ওটি না থাকলে কিছুতেই টেনে তুলতে পারতাম না।”
“জ্যাঠা ছেলে।”
“আপনার পৈতে ছুঁয়ে বলছি— সত্যি কথা। — কিন্তু সে যা হোক, একলা বাড়ি ফিরতে পারবেন তো?”
“পারব, এখন বেশ সুস্থ বোধ করছি।” তারপর তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, “বিশ্বম্ভর, এত দিন জানতাম তুমি নিপাতনেই সিদ্ধ, কিন্তু এখন দেখছি প্রাণদানেও তুমি কম পটু নও। আশীর্বাদ করি, এমনি ভাবে মজ্জমানকে উদ্ধার করেই যেন তোমার জীবন সার্থক হয়।”
নিপাতন হাসিয়া বলিল, “কি সর্বনাশ! শিরোমণি মশায়, ও আশীর্বাদ করবেন না। তাহলে আমার ব্যাকরণ-টোলের কি দশা হবে?”
ও-দিকে নৌকার মালিক যুবকটি এ-সব ব্যাপার কিছুই জানিতে পারে নাই। সে নগর-ভ্রমণের উপযুক্ত সাজসজ্জা করিয়া ঘাটে নামিল। স্নান-ঘাটের দিকে দৃষ্টি পড়িতেই সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। দেখিল, এক অতি গৌরকান্তি সুপুরুষ যুবা একজন একজন মধ্যবয়স্ক একচক্ষু ব্যক্তির সহিত দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছে। এই গৌরাঙ্গ যুবকের অপূর্ব দেহসৌষ্ঠব দেখিয়া সে মুগ্ধ হইয়া গেল। সে পৃথিবীর অনেক দেশ দেখিয়াছে; সিংহল, কোচিন, সুমাত্রা, যবদ্বীপ— কোথাও যাইতে তাহার বাকি নাই। কিন্তু এমন অপরূপ তেজোদীপ্ত পুরুষমূর্তি আর কখনও দেখে নাই।
একজন জেলে-মাঝি নিজের ক্ষুদ্র ডিঙ্গিতে বসিয়া জাল বুনিতেছিল, যুবক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বাপু, ঐ লোকটি কে জানো?”
জেলে একবার চোখ তুলিয়া বলিল, “ঐ উনি? উনি নিমাই পণ্ডিত।”
যুবক ভাবিল— পণ্ডিত! এত অল্প বয়সে পণ্ডিত! যুবকের নিজের পাণ্ডিত্যের সহিত কোনও সুবাদ ছিল না। সে বেনের ছেলে, বুদ্ধির বলেই সাত সাগর চষিয়া সোনাদানা আহরণ করিয়া আনিয়াছে। সে আর একবার নিমাই পণ্ডিতের অনিন্দ্য দেহকান্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া হৃষ্টচিত্তে নগর পরিদর্শনে বাহির হইল।
বেনের ছেলের নাম চন্দনদাস। বেশ সুশ্রী চোখে-লাগা চেহারা; বয়স একুশ-বাইশ। বুদ্ধিমান, বাক্পটু, বিনয়ী— বেনের ছেলের যত প্রকার গুণ থাকা দরকার, সবই আছে; বরং দেশ-বিদেশে ঘুরিয়া নানাজাতীয় লোকের সহিত মিশিয়া আরও পরিমার্জিত হইয়াছে। বেশভূষাও ঘরবাসী বাঙালী হইতে পৃথক। পায়ে সিংহলী চটি, পরিধানে চাঁপা রঙের রেশমি ধুতি মালসাট করিয়া পরা; স্কন্ধে উত্তরীয়। দুই কানে হীরার লবঙ্গ; মাথার কোঁকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত পড়িয়াছে— মাঝখানে সিঁথি। গলায় সোনার হার বণিক্পুত্রের জাতি-পরিচয় দিতেছে।
চন্দনদাস অগ্রদ্বীপের প্রসিদ্ধ সওদাগর রূপচাঁদ সাধুর পুত্র। রূপচাঁদ সাধুর বয়স হইয়াছে, তাই এবার নিজে না গিয়া উপযুক্ত পুত্রকে বাণিজ্যে পাঠাইয়াছিলেন। এক বৎসর নয় মাস পরে ছেলে বিলক্ষণ দু-পয়সা লাভ করিয়া দেশে ফিরিতেছে। বহুদিন একাদিক্রমে নৌকা চালাইয়া মাঝি-মাল্লারা ক্লান্ত; তাই একদিনের জন্য চন্দনদাস নবদ্বীপে নৌকা বাঁধিয়াছে। কাল প্রভাতেই আবার গৃহাভিমুখে যাত্রা করিবে।
চন্দনদাস হরষিত-মনে গঙ্গাঘাটের পথ ধরিয়া নগর দর্শনে চলিল। সে-সময় নবদ্বীপের সমৃদ্ধির বিশেষ খ্যাতি ছিল। পথে পথে নাট্যশালা, পাঠশালা, চূর্ণ-বিলেপিত দেউল, প্রতি গৃহচূড়ায় বিচিত্র ধাতু-কলস, প্রতি দ্বারে কারু-খচিত কপাট; বাজারের এক বিপণিতে লক্ষ তঙ্কার সওদা কেনা যায়। পথগুলি সংকীর্ণ বটে, কিন্তু তাহাতে নগরশ্রী আরও ঘনীভূত হইয়াছে। রাজপথে বহু লোকের ব্যস্ত যাতায়াত নগরকে সজীব ও প্রাণবন্ত করিয়া তুলিয়াছে।
অনায়াস-মন্থরপদে চন্দনদাস চারিদিকে চাহিতে চাহিতে চলিয়াছিল; কিছুদূর যাইবার পর একটি জিনিস দেখিয়া হঠাৎ তাহার বাইশ বছরের মুণ্ড ঘুরিয়া গেল; সে পথের মাঝখানেই মন্ত্রমুগ্ধবৎ দাঁড়াইয়া পড়িল। বেচারা চন্দনদাস সাত সাগর পাড়ি দিয়াছে; কিন্তু সে বিদ্যাপতির কাব্য পড়ে নাই— “মেঘমাল সঞে তড়িতলতা জনু হৃদয়ে শেল দেই গেল”— এরূপ ব্যাপার যে সম্ভবপর, তাহা সে জানিত না। বিদ্যাপতি জানা থাকিলে হয়তো ভাবিতে পারিত—
অপরূপ পেখলুঁ রামা
কনকলতা অব- লম্বনে উয়ল
হরিণহীন হিমধামা।
কিন্তু চন্দনদাস কাব্যরসবঞ্চিত বেনের ছেলে, আত্মবিস্মৃতভাবে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল। প্রভাতে সে কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিল কে জানে, কিন্তু আজ তাহার সুন্দর মুখ দেখিবার পালা।
যাহাকে দেখিয়া চন্দনদাসের মুণ্ড ঘুরিয়া গিয়াছিল, সে মেয়েটি একজন বয়স্ক সহচরীর সঙ্গে ঘাটে স্নান করিতে যাইতেছিল। পূর্ণযৌবনা ষোড়শী— তাহার রূপের বর্ণনা করিতে গিয়া হতাশ হইতে হয়। বৈষ্ণব-রসসাহিত্য নিঙড়াইয়া এই রূপের একটা কাঠামো খাড়া করা যাইতে পারে; হয়তো এমনই কোনও গোরোচনা গোরী নবীনার নববিকশিত রূপ দেখিয়া প্রেমিক বৈষ্ণব কবি তাঁহার রাই-কমলিনীকে গড়িয়াছিলেন, কে বলিতে পারে? মেয়েটির প্রতি পদক্ষেপে দর্শকের হৃৎকমল দুলিয়া দুলিয়া উঠে, যেন হৃৎকমলের উপর পা ফেলিয়া সে চলিয়াছে। তাহার মদির নয়নের অপাঙ্গদৃষ্টিতে মনের মধ্যে মধুর মাদকতা উন্মথিত হইয়া উঠে।
কিন্তু এত রূপ সত্ত্বেও মেয়েটির মুখখানি ম্লান, যেন তাহার উপর কালো মেঘের ছায়া পড়িয়াছে। চোখ দুটি অবনত করিয়া ধীরপদে সে চলিয়াছে; তৈলসিক্ত চুলগুলি পিঠের উপর ছড়ানো; পরণে আটপৌরে রাঙাপাড় শাড়ি। দেহে একখানিও গহনা নাই, এমন কি, নাকে বেসর, কানে দুল পর্যন্ত নাই। কেবল দুই হাতে দু’গাছি শঙ্খ।
মেয়েটির সঙ্গে যে সহচরী রহিয়াছে, তাহাকে সহচরী না বলিয়া প্রতিহারী বলিলেই ভালো হয়। সে যেন চারিদিক হইতে তাহাকে আগলাইয়া চলিয়াছে। তাহাকে দেখিলেই বুঝা যায়, বিগতযৌবনা ভ্রষ্টা স্ত্রীলোক। আঁটসাঁট দোহারা গঠন, গোলাকৃতি মুখ, কলহপ্রিয় বড় বড় দুইটা চোখ যেন সর্বদাই ঘুরিতেছে।
চন্দনদাস হাঁ করিয়া পথের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া রহিল, মেয়েটি তাহার পাশ দিয়া চলিয়া গেল। পাশ দিয়া যাইবার সময় একবার চকিতের ন্যায় চোখ তুলিল, আবার তৎক্ষণাৎ মাথা হেঁট করিল। সঙ্গিনী স্ত্রীলোকটা কটমট করিয়া চন্দনদাসের পানে তাকাইল, তাহার আত্মবিস্মৃত বিহ্বলতার জন্য যেন কিছু বলিবে মনে করিল। কিন্তু চন্দনদাসের বিদেশীর মতো সাজ-সজ্জা দেখিয়া কিছু না বলিয়া সমস্ত দেহের একটা স্বৈরিণীসুলভ ভঙ্গি করিয়া চলিয়া গেল।
চন্দনদাসও অমনি ফিরিল। তাহার নগর-ভ্রমণের কথা আর মনে ছিল না, সে একদৃষ্টি মেয়েটির দিকে তাকাইয়া রহিল! মেয়েটিও কয়েক পা গিয়া একবার ঘাড় বাঁকাইয়া পিছু ফিরিয়া চাহিল। ‘গেলি কামিনী, গজহু গামিনী, বিহসি পালটি নেহারি’— চন্দনদাসের যেটুকু সর্বনাশ হইতে বাকি ছিল, তাহাও এবার হইয়া গেল।
সেও গঙ্গাঘাটের দিকে ফিরিল, অগ্রবর্তিনী স্নানার্থিনীদের দৃষ্টি-বহির্ভূত হইতে না দিয়া তাহাদের পিছু পিছু চলিল।
ক্রমে তাহারা ঘাটের সম্মুখে পৌঁছিল। এখানে চন্দনদাস আবার নিমাই পণ্ডিতকে দেখিতে পাইল। তিনি স্নান শেষ করিয়া বোধ হয় গৃহে ফিরিতেছিলেন; ভিজা গামছা গায়ে জড়ানো। চন্দনদাস লক্ষ্য করিল, মেয়েটির প্রতি দৃষ্টি পড়িতেই নিমাই পণ্ডিতের মুখে একটা ক্ষুব্ধ কারুণ্যের ভাব দেখা দিয়াই মিলাইয়া গেল। তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন।
অতঃপর স্ত্রীলোক দুইটি ঘাটে গিয়া স্নান করিল। চন্দনদাস একটু আড়ালে থাকিয়া চোরা চাহনিতে দেখিল। চন্দনদাস দুষ্মন্ত নয়, — “অসংশয়ং ক্ষত্রপরিগ্রহক্ষমা” তাহার মনে আসিল না; কিন্তু নানা ক্ষুদ্র কারণে তাহার ধারণা জন্মিল যে, মেয়েটি বেনের মেয়ে, তাহার স্বজাতি। কিন্তু একটা কথা সে কিছুতেই বুঝিতে পারিল না, এত বয়স পর্যন্ত মেয়েটি অনূঢ়া কেন? বিধবা নয়, হাতের শঙ্খ ও রাঙাপাড় শাড়ি তাহার প্রমাণ। তবে ষোল-সতের বছরের মেয়ে বাংলাদেশে অবিবাহিতা থাকে কি করিয়া?
কিন্তু সে যাহা হউক, স্নান সারিয়া তাহারা যখন ফিরিয়া চলিল, তখন সেও তাহাদের পিছু লইল।
চন্দনদাসের ব্যবহারটা বর্তমানকালে কিছু বর্বরোচিত বোধ হইতে পারে; কিন্তু একালের রুচি দিয়া সেকালের শিষ্টাচার বিচার করা সর্বদা নিরাপদ নয়। তা ছাড়া, উপস্থিত ক্ষেত্রে শিষ্টাচারের সূক্ষ্ম অনুশাসন মানিয়া চলিবার মতো হৃদ্যন্ত্রের অবস্থা চন্দনদাসের ছিল না। তাঁহার কাঁচা হৃদ্যন্ত্রটা একেবারেই অবশ হইয়া পড়িয়াছিল। বিশেষ দোষ দেওয়াও যায় না। অনুরূপ অবস্থায় পড়িয়া সেকালের ঠাকুর-দেবতারাও কিরূপ বিহ্বল বে-এক্তিয়ার হইয়া পড়িতেন, তাহা তো ভক্ত কবিগণ লিপিবদ্ধ করিয়াই গিয়াছেন। — “এ ধনি কে কহ বটে!”
মোট কথা, চন্দনদাস তাহার মন-চোরা মেয়েটির পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। এ-পথ হইতে ও-পথে কয়েকটা মোড় ফিরিয়া প্রায় একপোয়া পথ অতিক্রম করিবার পর মেয়েটি এক গলির মধ্যে প্রবেশ করিল। চন্দনদাস দেখিল, পাড়াটা অপেক্ষাকৃত গরিব বেনেপাড়া। অধিকাংশ বাড়ির খড়ের বা খোলার চাল।
গলির মধ্যে কিছুদূর গিয়া মেয়েটি এক ক্ষুদ্র পাকা বাড়ির দালানে উঠিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। বাড়িটা পাকা বটে, কিন্তু অতিশয় জীর্ণ ও শ্রীহীন। বাড়ির সম্মুখীন হইয়া চন্দনদাস দেখিল, দালানের উপর একটি ক্ষুদ্র বেনের দোকান। আদা, মরিচ, হলুদ, চই ছোট ছোট ধামাতে সাজানো আছে; একজন বৃদ্ধা স্ত্রীলোক বেসাতি করিতেছে। দালানের পশ্চাদ্ভাগে একটি দ্বার, উহাই অন্দরে প্রবেশ করিবার পথ। চন্দনদাস বুঝিল, ঐ পথেই মেয়েটি ও তাহার সঙ্গিনী অন্দরে প্রবেশ করিয়াছে।
চন্দনদাস বড় সমস্যায় পড়িল। সে কোনও মতলব স্থির করিয়া ইহাদের অনুসরণ করে নাই, গুণের নৌকার ন্যায় অদৃশ্য রজ্জুবন্ধন তাহাকে টানিয়া আনিয়াছে। কিন্তু এখন সে কি করিবে? কেবলমাত্র মেয়েটির বাড়ি দেখিয়া ফিরিয়া যাইবে? চন্দনদাস বাড়ির সম্মুখ দিয়া কয়েকবার অলসভাবে যাতায়াত করিয়া কর্তব্য স্থির করিয়া লইল। তাহার হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, তাহার মা তাহাকে নবদ্বীপ হইতে ভালো চুয়া কিনিয়া আনিতে বলিয়াছিলেন। সে-কথা সে ভুলে নাই, আজ নগর-ভ্রমণের সময় কিনিয়া লইবে স্থির করিয়াছিল; কিন্তু চুয়া কিনিবার অছিলা এমনভাবে সদ্ব্যবহার করিবার কথা এতক্ষণ তাহার মনেই আসে নাই।
সে দৃঢ়পদে দোকানের সম্মুখীন হইল; মিঠা হাসিয়া বুড়িকে জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁগো ভালোমানুষের মেয়ে, তোমার দোকানে ভালো চুয়া আছে?”
যে বৃদ্ধা বেসাতি করিতেছিল, তাহার দেহ-যষ্টিতে বিন্দুমাত্র রস না থাকিলেও, প্রাণটা তাজা ও সরস ছিল। চন্দনদাসকে বাড়ির সম্মুখে অকারণ ঘুর্ঘুর্ করিতে দেখিয়া বুড়ি এই অনিশ্চিত ঘোরাঘুরির গূঢ় কারণটি ধরিয়া ফেলিয়াছিল এবং মনে মনে একটু আমোদ অনুভব করিতেছিল। পাড়ার কোনও চ্যাংড়া ছোঁড়া হইলে বুড়ি মুখ ছাড়িত; কিন্তু এই কান্তিমান সুদর্শন ছেলেটির বিদেশীর মতো সাজ-পোশাক দেখিয়া সে একটু আকৃষ্ট হইয়াছিল।
চন্দনদাসের প্রশ্নের উত্তরে সে বলিল, “আছে বইকি বাছা। এসো, বসো।”
চন্দনদাসও তাই চায়, সে দালানে উঠিয়া জলচৌকির উপর চাপিয়া বসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁগা, তোমাদের বাড়িতে কি পুরুষমানুষ নেই? তুমি নিজে বেসাতি করছ যে?”
বৃদ্ধা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “সে কথা আর বলো না বাছা; একটা ব্যাটাছেলে ঘরে থাকলে কি আজ আমাদের এমন খোয়ার হয়?” তারপর কথা পাল্টাইয়া বলিল, “তা হ্যাঁ বাছা, তোমাকে তো আগে কখনও দেখিনি, ন’দের লোক নও বুঝি?”
চন্দনদাস বলিল, “না, আমার বাড়ি অগ্রদ্বীপ।”
বুড়ি বলিল, “ও— তাই। কথায়-বার্তায় যেন বেনের ছেলে বলে মনে হচ্ছে।”
চন্দনদাস তখন জাতি-পরিচয় দিল, নিজের ও পিতার নাম উল্লেখ করিল। বুড়ি দু’দণ্ড বসিয়া গল্প করিবার লোক পায় না, সে আহ্লাদে গদ্গদ হইয়া বলিল, “ও মা, তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে গো— স্বজাত! আহা, যেমন সোনার কার্তিকের মতো চেহারা, তেমনি মা’র কোল জুড়ে বেঁচে থাকো। — কোথায় বিয়ে-থা করেছ?”
চন্দনদাস কহিল, “তের বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল আয়ি, এক বছর পরেই বৌ মরে যায়। তারপর আর বিয়ে করিনি।”
বুড়ি একটু বিমনা হইল; তারপর উৎসুকভাবে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।
চন্দনদাস কথাপ্রসঙ্গে বলিল, “সমুদ্রে গিয়েছিলাম আয়ি, দু’বছর পরে দেশে ফিরছি। তা ভাবলাম, ন’দেয় একদিন থেকে যাই; মা’র বরাত আছে চুয়া কেনবার, চুয়া কেনাও হবে, একটু জিরেন দেওয়াও হবে।”
বুড়ি বলিল, “তা বেশ করেছ বাছা, ভাগ্যিস এসেছিলে তাই তো আমন চাঁদমুখখানি দেখতে পেলাম।” বুড়ি একটা নিশ্বাস ফেলিল। তাহার প্রাণের ভিতরটা হায় হায় করিয়া উঠিল। আহা, যদি সম্ভব হইত!
চন্দনদাস এতক্ষণ ফাঁক খুঁজিতেছিল, জিজ্ঞাসা করিল, “আয়ি, তোমার আপনার জন কি আর কেউ নেই?”
“একটি নাতনী আছে, আর সব মরে হেজে গেছে। পোড়াকপালী ছুঁড়ির কপাল।”— বলিয়া বুড়ি আঁচলে চোখ মুছিল।
“নাতনী!”— চন্দনদাস সচকিত হইয়া উঠিল; তবে বুড়ির নাতনীকেই সে দেখিয়াছে। — “তবে তুমি বুড়োমানুষ দোকান দেখ কেন? সে দেখতে পারে না?”
বুড়ি উদাস আশাহীন সুরে বলিল, “সে অনেক কথা, বাছা। আমাদের দুঃখের কাহিনী কাউকে বলবার নয়। সমাজ আমাদের বিনা দোষে জাতে ঠেলেছে, মুখ তুলে চাইবার কেউ নেই। আর কাকেই বা দোষ দেব, সব দোষ ঐ হতভাগীর কপালের। এমন রূপ নিয়ে জন্মেছিল, ঐ রূপই ওর শত্তুর।”
চন্দনদাসের কৌতূহল ও উত্তেজনা বাড়িয়াই চলিয়াছিল। সে সাগ্রহে প্রশ্ন করিল, “কি ব্যাপার আয়ি? সব কথা খুলেই বলো না।”
বুড়ি কিন্তু রাজী হইল না, বলিল, “কি হবে বাবা, আমাদের লজ্জার কথা শুনে? কিছু তো করতে পারবে না, কেবল মনে দুঃখ পাবে।”
“কে বললে, কিছু পারব না?”
“না বাবা, সে কেউ পারবে না। — আহা! সোনার প্রতিমা আমার কালই জলে ভাসিয়ে দিতে হবে রে!”— বলিয়া বুড়ি হঠাৎ মুখে কাপড় চাপা দিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
চন্দনদাস বুড়ির হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “আয়ি, আমি বেনের ছেলে, তোর গা ছুঁয়ে বলছি, মানুষের যা সাধ্য আমি তা করব। তোর নাতনীর কি বিপদ বল্।”
বুড়ি উত্তর দিবার পূর্বেই, বোধ করি তাহার ক্রন্দনের শব্দে আকৃষ্ট হইয়া সেই বিগতযৌবনা প্রহরিণী বাহির হইয়া আসিল, কর্কশকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “কাঁদছিস কেন রে, বুড়ি? কি হয়েছে?”
বুড়ি বিলক্ষণ বুদ্ধিমতী, তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া আমতা আমতা করিয়া বলিল, “কিছু নয় রে চাঁপা— অমনি। এই ছেলেটি দূর-সম্পর্কে আমার নাতি হয়, অনেক দিন পরে দেখলুম— তাই—”
চাঁপা চন্দনদাসের দিকে ফিরিল, বৃহৎ সুবর্তুল চক্ষু তাহার মুখের উপর স্থাপন করিয়া বুড়ির উদ্দেশে বলিল, “হুঁ— নাতি!— তোর নাতি আছে, আগে কখনও বলিসনি তো?” বুড়ি কম্পিতস্বরে বলিল, “বললুম না, দূর-সম্পর্কে। আমার পিসতুত বোনের—”
চাঁপা বলিল, “বুঝেছি।” — তারপর চন্দনদাসকে প্রশ্ন করিল, “তোমাকে আজ পথে দেখেছি না?”
চন্দনদাস সটান মিথ্যা কথা বলিল, “কই, না! আমার তো মনে পড়ছে না।”
চাঁপা তীক্ষ্ণ-চক্ষে আরও কিছুক্ষণ চন্দনদাসকে নিরীক্ষণ করিল, শেষে মুখে একটু হাসি আনিয়া বলিল, “তবে আমারই ভুল। বুড়ি, তুই তাহলে তোর নাতির সঙ্গে কথা ক’— আমি একটু পাড়া বেড়িয়ে আসি। তোর নাতি আজ এখানে থাকবে তো? দেখিস, ছেড়ে দিসনি যেন, এমন রসের নাতি কালেভদ্রে পাওয়া যায়।”— বলিয়া চোখ ঘুরাইয়া বাহিরের দিকে প্রস্থান করিল।
চাঁপা দৃষ্টি-বহির্ভূত হইয়া গেলে চন্দনদাস জিজ্ঞাসা করিল, “এটি কে?”
বুড়ির তখনও হৃদ্কম্প দূর হয় নাই, সে বলিল, “ও মাগী যমের দূত। বাবা, এমন ভয় হয়েছিল— এখনি টুঁটি টিপে ধরত। তুই যা দাদা, আর এখানে থাকিসনি। ওরে, তুই আমাদের কি ভালো করবি? ভগবান আমাদের ভুলে গেছেন। তুই এখান থেকে পালা, শেষে কি মায়ের নিধি বেঘোরে প্রাণ দিবি?”
চন্দনদাস বলিল, “সে কি ঠান্দি, নাতিকে কি এমনি করেই তাড়াতে হয়? একটা পান পর্যন্ত দিতে নেই? তা ছাড়া চুয়া কিনতে এসেছি, চুয়া না দিয়েই তাড়িয়ে দিচ্ছিস? তুই কেমন বেনের মেয়ে?”
বুড়ি এবার হাসিয়া ফেলিল। এই ছেলেটির মুখের কথা যতই সে শুনিতেছিল, ততই তাহার মন ভিজিতেছিল। তাহার প্রাণের একান্তে বিদলিত মুহ্যমান আশা একটু মাথা তুলিল। তবে কি এই শেষ সময়ে ভগবান মুখ তুলিয়া চাহিলেন?
বুড়ি মনে ভাবিল,— যা হয় তা হয়, একবার শেষ চেষ্টা করিয়া দেখিব। কে বলিতে পারে, হয়তো অভাগিনীর ভাগ্যে চরম দুর্গতি বিধাতা লেখেন নাই; নচেৎ নিরাশার গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে এই অপরিচিত বন্ধু কোথা হইতে আসিয়া জুটিল?
তখন বুড়ি সংকল্প স্থির করিয়া বলিল, “ও মা, সত্যি তো! চুয়ার কথা মনে ছিল না। তা দেব, দাদা— কিন্তু বড় দামী জিনিস, দাম দিতে পারবে তো?”
“দাম কত?”
“জীবন-যৌবন-মন-প্রাণ সব দিলেও সে জিনিসের দাম হয় না।”
চন্দনদাস একটু অবাক হইল, কিন্তু হারিবার পাত্র সে নয়, বলিল, “আচ্ছা, আগে জিনিস দেখি।”
“এই যে, দেখাই। ওলো ও চুয়া, একবার এদিকে আয় তো, দিদি।”
চন্দনদাস তড়িৎস্পৃষ্টের মতো চমকিয়া উঠিল। তবে মেয়েটির নাম চুয়া! আর সে চুয়া কিনিতে এখানে আসিয়াছে! এ কি দৈব যোগাযোগ!
“কি বলছি ঠান্দি?”— বলিতে বলিতে চুয়া অন্দরের দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। চন্দনদাসকে দেখিয়া সে চমকিয়া বুকের উপর হাত রাখিল। চন্দনদাস সেই দিকেই তাকাইয়া ছিল, দেখিল, চুয়ার কুমুদের মতো গাল দুটিতে কে যেন কাঁচা সিঁদুর ছড়াইয়া দিল। তারপর ম্রিয়মাণ লজ্জায় তাহার চোখ দুটি ধীরে ধীরে নত হইয়া পড়িল। চন্দনদাস বুঝিল, চুয়া তাহাকে চিনিতে পারিয়াছে; পথের ক্ষণিক-দেখা মুগ্ধ পান্থকে ভুলে নাই।
বুড়ি বলিল, “চুয়া, অতিথি এসেছে; একটু মিষ্টিমুখ করা, পান দে।”
চুয়া মুখ তুলিল না, আস্তে আস্তে চন্দনদাসের সতৃষ্ণ চক্ষুর সম্মুখ হইতে সরিয়া গেল।
কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না। চন্দনদাস দ্বারের দিকেই তাকাইয়া রহিল। শেষে বুড়ি বলিল, “আমার চুয়াকে দেখলে?”
“দেখলাম।”— আগেও যে দেখিয়াছে, তাহা আর চন্দনদাস ভাঙিল না। বুড়িও সে দিক দিয়া গেল না, বলিল, “কেমন মনে হল?”
“মনে হল—” সহসা চন্দনদাস বুড়ির দিকে ঝুঁকিয়া ব্যগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “ঠান্দি, চুয়ার কি বিপদ আমায় বলো। কেন তোমাদের সবাই জাতে ঠেলেছে? ওরা এখনও বিয়ে হয়নি কেন?”
দ্বারের নিকট হইতে জবাব আসিল, “কি হবে তোমার শুনে?”
এক হাতে ফুল-কাঁসার ছোট রেকাবির উপর চারিখানি বাতাসা ও দুটি পান, অন্য হাতে জলের ঘটি লইয়া চুয়া ফিরিয়া আসিয়াছে। চন্দনদাসের শেষ কথাগুলি সে শুনিতে পাইয়াছিল; শুনিয়া লজ্জায় ধিক্কারে তাহার মন ভরিয়া উঠিয়াছিল। কেন এই অপরিচিত যুবকের এত কৌতূহল? তাহাকে বলিয়াই বা লাভ কি? চুয়া রেকাবি ও ঘটি চন্দনদাসের সম্মুখে নামাইয়া আরক্ত-মুখে তীব্র অধীর স্বরে বলিল, “কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ? কি হবে তোমার আমাদের কথা শুনে?”
ক্ষণকালের জন্য চন্দনদাস বিস্ময়ে হতবাক্ হইয়া রহিল; তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া চুয়ার মুখের উপর চোখ রাখিয়া শান্ত সংযত স্বরে বলিল, “চুয়া, আমি তোমার স্বজাতি; আমার বাড়ি অগ্রদ্বীপ। নবদ্বীপের ঘাটে আমার ডিঙ্গা বাঁধা আছে। তোমার কি বিপদ আমি জানি না; কিন্তু আমি যদি তোমায় সাহায্য করতে চাই, আমার সাহায্য কি নেবে না?”
চুয়ার মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানা সাদা হইয়া গেল। তাহার চোখে পরিত্রাণের ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষণ-বিস্ফারিত আশার আলো ফুটিয়া উঠিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তারপর সে রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, “কেন আমাকে মিছে আশা দিচ্ছ?”— বলিয়া দাঁতে ঠোঁট চাপিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।
চন্দনদাস বসিয়া পড়িল। কিয়ৎকাল বসিয়া থাকিয়া অন্যমনস্কভাবে একখানা বাতাসা তুলিয়া লইয়া মুখে দিল; তারপর আলগোছে ঘটির জল গলায় ঢালিয়া জলপান করিল। শেষে পান দুটি মুখে পুরিয়া বুড়ির দিকে তাকাইয়া মৃদুহাস্যে বলিল, “ঠান্দি, এবার তোমার গল্প বলো।”
“বলব, কিন্তু তুমি আগে একটা কথা দাও।”
“কি?”
“তুমি ওকে উদ্ধার করবে?”
“করব। অন্তত প্রাণপণে চেষ্টা করব।”
“বেশ, উদ্ধার করা মানে ওকে এ দেশ থেকে নিয়ে পালাতে হবে। পারবে?”
“পারব— খুব পারব।”
“ভালো, কিন্তু তারপর?”
“তারপর কি?”
বুড়ি একটু দ্বিধা করিল; শেষে বলিল, “কিছু মনে করো না, সব কথা স্পষ্ট করে বলাই ভালো। তুমি জোয়ান ছেলে, চুয়াও যুবতী মেয়ে, তুমি ওকে চুরি করে নিয়ে যাবে। তারপর?”
চন্দনদাস জিজ্ঞাসুনেত্রে চাহিয়া রহিল।
বুড়ি তখন স্পষ্ট করিয়া বলিল, “ওকে বিয়ে করতে পারবে?”
চন্দনদাসের চোখের সম্মুখে যেন একটা নূতন আলো জ্বলিয়া উঠিল; সে উদ্ভাসিত মুখে বলিল, “পারব।”
“তোমার বাপ-মা—”
“তাঁরা আমার কথায় অমত করবেন না।”
বৃদ্ধা কম্পিত স্বরে বলিল, “বেঁচে থাকো দাদা, তুমি বড় ভালো ছেলে। কিন্তু ছুঁড়ির যা কপাল—”
বুড়ি তখন চুয়ার কাহিনী বলিতে আরম্ভ করিল। চন্দনদাস করতলে কপোল রাখিয়া শুনিতে লাগিল। শুনিতে শুনিতে সে টের পাইল, চুয়া কখন চুপি চুপি আসিয়া দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়াছে।
চুয়ার বাপের নাম কাঞ্চনদাস। বেনেদের মধ্যে সে বেশ সংগতিপন্ন গৃহস্থ ছিল; চুয়ার বয়স যখন সাত বৎসর, তখন কাঞ্চনদাস বাণিজ্যের জন্য নৌকা সাজাইয়া সমুদ্রযাত্রা করিল। কাঞ্চনদাসের নৌকা গঙ্গার বাঁকে অদৃশ্য হইয়া গেল— আর ফিরিল না। সংবাদ আসিল, নৌকাডুবি হইয়া কাঞ্চনদাস মারা গিয়াছে।
এই ঘটনার এক বৎসর পরে চুয়ার মাও মরিল। তখন বুড়ি ছাড়া চুয়াকে দেখিবার আর কেহ রহিল না। বুড়ি কাঞ্চনদাসের মাসী— আট বছর বয়স হইতে সে হাতে করিয়া চুয়াকে মানুষ করিয়াছে।
নৌকাডুবিতে কাঞ্চনদাসের সমস্ত সম্পত্তিই ভরাডুবি হইয়াছিল, কেবল এই ভদ্রাসনটি বাঁচিয়াছিল। বুড়ি দোকান করিয়া কষ্টে সংসার চালাইতে লাগিল।
এইভাবে বৎসরাধিক কাল কাটিল। চুয়ার বয়স যখন দশ বছর, তখন এক গৃহস্থের ছেলের সঙ্গে তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইল।
এই সময় একদিন জমিদারের ভ্রাতুষ্পুত্র ঘোড়ায় চড়িয়া এই পথ দিয়া যাইতেছিল। চুয়াকে বাড়ির সম্মুখে খেলা করিতে দেখিয়া সে ঘোড়া হইতে নামিল। দুর্দান্ত জমিদারের মহাপাষণ্ড ভাইপো মাধবের নাম শুনিয়া দেশের লোক তো দূরের কথা, কাজি সাহেব পর্যন্ত থরথর করিয়া কাঁপে। রাজার শাসন— সমাজের শাসন কিছুই সে মানে না। জাতিতে ব্রাহ্মণ হইলে কি হয়, স্বভাব তার চণ্ডালের মতো। সে দশ বছরের চুয়াকে চিবুক তুলিয়া ধরিয়া দেখিল, তারপর বাড়িতে আসিয়া তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল। বুড়ি ভয়ে ভয়ে পরিচয় দিল। শুনিয়া মাধব বলিল, এ মেয়ের বিবাহ দেওয়া হইবে না, ইহাকে দৈবকার্যের জন্য মানত করিতে হইবে। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত কুমারী থাকিবে, তারপর মাধব আসিয়া তাহাকে লইয়া যাইবে। তান্ত্রিক সাধনায় উত্তরসাধিকার স্থান অধিকার করিয়া কন্যার ষোল বছরের কৌমার্য সার্থক হইবে। সাধক— স্বয়ং মাধব।
এই হুকুম জারি করিয়া মাধব প্রস্থান করিল। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল; তান্ত্রিক সাধনার গূঢ় মর্মার্থ বুঝিতে কাহারও বাকি রহিল না। বণিক-সমাজ মাধবের বিরুদ্ধে কিছু করিতে সাহস করিল না, তাহারা চুয়াকে জাতিচ্যুত করিল। বিবাহও ভাঙিয়া গেল।
ক্রমে চুয়ার বয়স বাড়িতে লাগিল— বারো বছর বয়স হইল। বুড়ি দেশে কাহারও নিকট সাহায্য না পাইয়া শেষে চুয়াকে লইয়া দেশ ছাড়িয়া পলাইবার মতলব করিল। কিন্তু বুড়ির হাতে পয়সা কম, আত্মীয়বন্ধুরও একান্ত অভাব। তাহার মতলব সিদ্ধ হইল না; মাধবের কানে সংবাদ গেল।
মাধব আসিয়া বুড়িকে পদাঘাত মুষ্ট্যাঘাত দ্বারা শাসন করিল; তারপর চুয়াকে পাহারা দিবার জন্য চাঁপাকে পাঠাইয়া দিল। নাপিত-কন্যা চাঁপা চুয়ার অভিভাবিকাপদে অধিষ্ঠিত হইল। চাঁপা বয়সকালে তান্ত্রিক সাধন-ভজন করিয়াছিল, এখন যৌবনান্তে ধর্মকর্ম ত্যাগ করিয়াছে। সে চুয়া ও বুড়ির উপর কড়া নজর রাখিতে লাগিল।
এইভাবে চারি বৎসর কাটিয়াছে। কয়েক দিন আগে মাধব আসিয়াছিল। সে চুয়াকে দেখিয়া গিয়াছে এবং বলিয়া গিয়াছে যে, আগামী অমাবস্যার রাত্রিতেই চুয়াকে দৈবকার্যে উৎসর্গ করিতে হইবে— সেজন্য যেন সে প্রস্তুত থাকে। অনুষ্ঠানের যাহাতে কোনও ত্রুটি না হয়, এজন্য মাধব নিজেই সমস্ত বিধান দিয়া গিয়াছে। অমাবস্যার সন্ধ্যার সময় চুয়া গঙ্গার ঘাটে গিয়া স্নান করিবে; স্নানান্তে রক্তবস্ত্র, জবামাল্য ও রক্তচন্দনের ফোঁটা পরিয়া ঘাট হইতে একেবারে সাধনস্থলে অর্থাৎ উদ্যানবাটিকায় উপস্থিত হইবে। সঙ্গে ঢাক-ঢোল ইত্যাদি বাজিতে বাজিতে যাইবে। মাধব এইরূপ শাস্ত্রীয় ব্যবস্থা দিয়া চলিয়া যাইবার পর পাঁচ দিন কাটিয়া গিয়াছে। আজ কৃষ্ণা চতুর্দশী— কাল অমাবস্যা।
গল্প শেষ করিয়া বুড়ি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “দাদা, সব কথা তোমায় বললুম। এখন দেখ, যদি মেয়েটাকে উদ্ধার করতে পারো। তুমি ছাড়া ওর আর গতি নেই।”
গল্প শুনিতে শুনিতে চন্দনদাসের বুকের ভিতরটা জ্বালা করিতেছিল, ঐ দানবপ্রকৃতি লোকটার বিরুদ্ধে ক্রোধ ও আক্রোশ অগ্নিশিখার মতো তাহার দেহকে দাহ করিতেছিল। সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিয়া উঠিল, “আমি যদি চুয়াকে বিয়ে করে কাল আমার নৌকোয় তুলে নিয়ে দেশে নিয়ে যাই— কে কি করতে পারে?”
দ্বারের আড়ালে চুয়ার বুক দুরুদুরু করিয়া উঠিল। কিন্তু বুড়ি মাথা নাড়িয়া ক্ষুব্ধস্বরে বলিল, “তা হয় না দাদা। চাঁপা রাক্ষসী আছে— সে কখনই হতে দেবে না।”
চন্দনদাস বলিল, “চাঁপাকে সোনায় মুড়ে দেব। তাতে রাজী না হয়, মুখে কাপড় বেঁধে ঘরে বন্ধ করে রাখাব।”
বুড়ি কাঁপিতে লাগিল, এতখানি দুঃসাহস তাহার পক্ষে কল্পনা করাও দুষ্কর; কিন্তু বুড়ির প্রাণে আশা জাগিয়াছিল, আশা একবার জাগিলে সহজে মরিতে চায় না। তবু বুড়ি কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “সে যেন হল, কিন্তু বিয়ে হবে কি করে? বিয়ে দেবে কে?”
“কেন— ন’দেয় কি পুরুত নেই?”
বৃদ্ধা মাথা নাড়িয়া বলিল, “তুমি মাধবকে জানো না। তার ভয়ে কোনও বামুন রাজী হবে না।”
চন্দনদাস আশ্চর্য হইয়া বলিল, “এখানকার বামুনরা এত ভীরু?”
“কার ঘাড়ে দশটা মাথা আছে দাদা, যে জমিদারের ভাইপোর শত্রুতা করবে? তা— শুনেছি, জগন্নাথ ঠাকুরের ছেলে নিমাই পণ্ডিত বড় ডাকাবুকো ছেলে, কাউকে ভয় করেন না। বয়স কম কিনা। — কিন্তু তিনি কি রাজী হবেন?”
চন্দনদাস মহা উৎসাহে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “ভালো মনে করিয়ে দিয়েছ, ঠান্দি। — নিমাই পণ্ডিতই উপযুক্ত লোক। তাঁকে আমি আজ গঙ্গাঘাটে দেখেছি; ঠিক দেবতার মতো চেহারা— তিনি নিশ্চয় রাজী হবেন। — ঠান্দি, আমি এখন তাঁর খোঁজে চললাম, ওবেলা সব ঠিক করে আবার আসব। তখন—”
“কিন্তু তিনি যদি রাজী না হন?”
চন্দনদাস চিন্তা করিল, “যদি রাজী না হন— তিনি রাজী হোন বা না হোন, রাত্রিতে কোনও সময় আমি আসবই। — নাই বা হল বিয়ে? আজ রাত্রিতে চুয়াকে চুরি করে নিয়ে যাব। তারপর দেশে গিয়ে বিয়ে করব। — কি বলো?”
বুড়ির মুখে আশঙ্কার ছায়া পড়িল। চন্দনদাসের যে কোনও দুরভিসন্ধি নাই, তাহা সে অন্তরে বুঝিতেছিল; কিন্তু তবু— চন্দনদাস একেবারে অপরিচিত। সেও যে একজন ধূর্ত প্রবঞ্চক নয়, তাহা বুড়ি কি করিয়া জানিবে? বারবার দাগা পাইয়া বুড়ির মন বড় সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। সে ইতস্তত করিতে লাগিল।
এই সময় চুয়া দরজার আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিল। সংশয়-সংকোচ করিবার তাহার আর সময় ছিল না। এক দিকে অবশ্যম্ভাবী সর্বনাশ, অন্য দিকে সম্ভাবনা। চুয়া সজল চক্ষু চন্দনদাসের মুখের উপর রাখিয়া কম্পিত্যকণ্ঠে কহিল, “তুমি আজ রাত্তিরে এসো। নিমাই পণ্ডিত যদি রাজী না হন, তবু, তোমার ধর্মের ওপর বিশ্বাস করে আমি তোমার সঙ্গে যাব।”
চন্দনদাসের বুক নাচিয়া উঠিল। সে আনন্দের উচ্ছ্বাসে কি বলিতে যাইতেছিল— এমন সময় বাধা পড়িল।
গলির মধ্যে দ্রুত অশ্বক্ষুর-ধ্বনি শুনা গেল। চুয়া একটা আর্ত চিৎকার গলার মধ্যে রোধ করিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গিয়া ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া দিল। বুড়ি থরথর করিয়া কাঁপিয়া দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজিয়া বসিয়া পড়িল।
পরক্ষণেই একজন অশ্বারূঢ় ব্যক্তি বাড়ির সম্মুখে আসিয়া ঘোড়া থামাইল। লোকটার গায়ে লাল রঙের কোর্তা, কোমরে তরবারি, মাথায় পাগ নাই, ঝাঁকড়া রুক্ষ চুল কাঁধ পর্যন্ত পড়িয়াছে; কপালে প্রকাণ্ড একটা সিন্দূরের ফোঁটা। ফোঁটার নিচে বিশাল ভাঁটার মতো চোখ দুটাও প্রায় অনুরূপ রক্তবর্ণ। মুখে ঘনকৃষ্ণ গোঁফ এবং গালে গালপাট্টা। বয়স বোধ করি পঁয়তাল্লিশ।
এই ভীষণাকৃতি লোকটার মুখের প্রতি অবয়বে যেন জীবনব্যাপী দুষ্কৃতি ও পাপ পঙ্কিল রেখায় অঙ্কিত হইয়া আছে। এমন দুষ্কার্য নাই— যাহা সে করে নাই; এমন মহাপাতক নাই— যাহা সে করিতে পারে না। একটা ঘৃণার শিহরণ চন্দনদাসের দেহের উপর দিয়া বহিয়া গেল; সে চিনিল, ইনিই জমিদারের দুর্দান্ত ভ্রাতুষ্পুত্র মাধব।
মাধব একলাফে ঘোড়া হইতে নামিয়া ঘোড়া ছাড়িয়া দিয়া দালানের উপর উঠিল। সম্মুখেই চন্দনদাস; রক্তচক্ষু দ্বারা আপাদমস্তক তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া স্বভাবকর্কশ ভয়ংকর সুরে মাধব প্রশ্ন করিল, “তুই কে?”
চন্দনদাসের ইচ্ছা হইল, মাধবের দম্ভস্ফীত মুখে একটা লাথি পারে; কিন্তু সে তাহা করিল না। তাহার মাথার মধ্যে বিদ্যুতের মতো চিন্তাকার্য চলিতেছিল। মাধবের অভাবনীয় আবির্ভাবে তাহার সমস্ত মতলব পণ্ড হইয়া গিয়াছিল; সে ভাবিতেছিল, এ অবস্থায় কি করিলে সব দিক রক্ষা হয়? মাধবের সঙ্গে একটা গণ্ডগোল বাধাইলে লাভ হইবে না, বরং অনিষ্টের সম্ভাবনা। উপস্থিত ক্ষেত্রে কোনও হাঙ্গামা না করিয়া অপসৃত হওয়াই সুবিবেচনার কাজ। অথচ এই পাষণ্ডটার মুখ দেখিলে ও কথা শুনিলে মেজাজ ঠিক রাখা দুষ্কর। চুয়ার সর্বনাশ করিবার জন্যই এই নরপশু তাহাকে ছয় বৎসর জিয়াইয়া রাখিয়াছে, ভাবিতে চন্দনদাসের চোখের দৃষ্টি পর্যন্ত রক্তাভ হইয়া উঠিল।
তবু সে যথাসাধ্য আত্মদমন করিয়া মাধবের কথার উত্তর দিল, বলিল, “সে খোঁজে তোমার দরকার কি?”
মাধব একটা অকথ্য গালি দিয়া বলিল, “তুই এখানে কি চাস?”
চন্দনদাস আর ধৈর্য রক্ষা করিতে পারিল না, তাহার মাথায় খুন চাপিয়া গেল। সে প্রত্যুত্তরে মাধবের নাসিকায় বজ্রসম কিল বসাইয়া দিয়া বলিল, “এই চাই।”
এই নিরীহ-দর্শন যুবকের নিকট হইতে মাধব এত বড় দুঃসাহসিক কার্য একেবারে প্রত্যাশা করে নাই, সে চক্ষে সরিষার ফুল দেখিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল।
চন্দনদাস দেখিল, আর বিলম্ব করা সমীচীন নয়; সে নিরস্ত্র, মাধবের কোমরে তরবারি রহিয়াছে। ঘোড়াটা সম্মুখেই দাঁড়াইয়াছিল, সে দালান হইতে লাফ দিয়া তাহার পিঠে চড়িয়া বসিল। এই সময় মাধব ষণ্ডের মতো গর্জন করিয়া কোমর হইতে তরবারি বাহির করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু তাহার নাগালে পৌঁছিবার পূর্বেই চন্দনদাস তেজী ঘোড়ার পেট দুই পায়ে চাপিয়া ধরিয়া সবেগে ঘোড়া ছুটাইয়া দিল।
কেহ কেহ লুকাইয়া পাপাচরণ করে। কিন্তু ধর্ম ও সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া পাশবিক বলে প্রকাশ্যভাবে পাপানুষ্ঠান করিতে যাহারা অভ্যস্ত, তাহাদের অপরাধ-ক্লান্ত জীবনে এমন অবস্থা আসে, যখন কেবলমাত্র রমণীর সর্বনাশ করিয়া আর তাহারা তৃপ্তি পায় না। তখন তাহারা পাপাচারের সহিত ধর্মের ভণ্ডামি মিশাইয়া তাহাদের দুষ্কার্যের মধ্যে এক প্রকার নূতন রস ও বিলাসিতা সঞ্চারের চেষ্টা করে। মাধব এই শ্রেণীর পাপী।
চন্দনদাস তাহারই ঘোড়ায় চড়িয়া তাহাকে ফাঁকি দিয়া পলায়ন করিবার পর মাধব নিষ্ফল আক্রোশে আর কাহাকেও সম্মুখে না পাইয়া বুড়িকে ধরিল; বুড়ির চুলের মুঠি ধরিয়া তলোয়ার দিয়া তাহাকে কাটিতে উদ্যত হইল। কিন্তু কাটিতে গিয়া তাহার মনে হইল, বুড়িকে মারিলে হয়তো সেই ধৃষ্ট যুবকের পরিচয় অজ্ঞাত রহিয়া যাইবে। কিল খাইয়া কিল চুরি করিবার লোক মাধব নয়; তখনও তাহার নাকের রক্তে গোঁফ ভাসিয়া যাইতেছিল। সে বুড়ির চুল ধরিয়া টানিতে টানিতে ভিতরে লইয়া চলিল।
আঙ্গিনার মাঝখানে বুড়িকে আছড়াইয়া ফেলিয়া তাহার শীর্ণ হাতে একটা মোচড় দিয়া মাধব বলিল, “হারামজাদী বুড়ি, ও ছোঁড়া তোর কে বল্।”
পূর্বেই বলিয়াছি, বুড়ি বুদ্ধিমতী; তাই ভয়ে প্রাণ শুকাইয়া গেলেও তাহার চিন্তা করিবার শক্তি ছিল। সে বুঝিয়াছিল, কোনও কথা না বলিলেও প্রাণ যাইবে এবং ষড়যন্ত্র প্রকাশ করিয়া ফেলিলেও প্রাণ যাইবে; সুতরাং মধ্যপথ অবলম্বন করাই যুক্তিসঙ্গত। সর্বনাশ উপস্থিত হইলে পণ্ডিতগণ অর্ধেক ত্যাগ করেন, বুড়িও তেমনই ষড়যন্ত্রের অংশটা বাদ দিয়া আর সব সত্য কথা বলিবে স্থির করিল। তাহাতে আর কিছু না হউক, মাধবের হাতে প্রাণটা বাঁচিয়া যাইতে পারে।
বুড়ি তখন অকপটে চন্দনদাসের যতটা পরিচয় জানিতে পারিয়াছিল, তাহা মাধবের গোচর করিল। চাঁপা পাছে অনর্থক হাঙ্গামা করে, এই ভয়ে মিছামিছি চন্দনদাসকে নাতি বলিয়া পরিচিত করিয়াছিল, তাহাও স্বীকার করিল। কাঁদিতে কাঁদিতে, অনেক মাথার দিব্য, চোখের দিব্য দিয়া বলিল যে, চন্দনদাসকে সে পূর্বে কখনও দেখে নাই, আজ প্রথম সে তাহার দোকানে আসিয়া মিষ্ট কথায় তাহার সহিত আলাপ করিতে আরম্ভ করে। তাহার কোনও দূরভিসন্ধি ছিল কি না, তাহাও বুড়ির অজ্ঞাত।
চাঁপা মাধবের বাড়িতে খবর দিতে গিয়াছিল, এতক্ষণে এক ঝাঁক পাইক সঙ্গে লইয়া পদব্রজে ফিরিল। পাইকদের হাতে সড়কি, ঢাল; জাতিতে তেঁতুলে বাগ্দী। ইহাদেরই বাহুবলে মাধব দেশটাকে সন্ত্রস্ত করিয়া রাখিয়াছিল। প্রভু ও ভৃত্যে অবস্থাভেদ ছাড়া প্রকৃতিগত পার্থক্য বিশেষ ছিল না।
বুড়িকে নানা প্রশ্ন করিয়া শেষে বোধ হয় মাধব তাহার গল্প বিশ্বাস করিল। চাঁপা যাহা বলিল, তাহাতে বুড়ির কথা সমর্থিত হইল। তা ছাড়া মাধবের রক্তচক্ষুর সম্মুখে বুড়ি মিথ্যা কথা বলিবে, ইহাও দাম্ভিক মাধব বিশ্বাস করিতে পারে না। সে এদিক-ওদিক তাকাইয়া বলিল, “তোর নাতনী কোথায়?”
বুড়ি বলিল, “ঘরেই আছে, বাবা।”
মাধব চাঁপাকে হুকুম করিল, “দেখে আয়।”
চাঁপা দেখিয়া আসিয়া বলিল, চুয়া ঘরেই আছে বটে।
মাধবের তখন বিশ্বাস জন্মিল, চুয়া সম্বন্ধে ভয়ের কোনও কারণ নাই। তবু সে দুইজন পাইককে বুড়ির বাড়ি পাহারা দিবার জন্য নিযুক্ত করিল, বলিল, “কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দিবিনে। যদি কেউ ঢুকতে চায়, তার গলায় সড়কি দিবি।”
এইরূপে বাড়ির সুব্যবস্থা করিয়া মাধব বাহিরে আসিল। এই সময় একবার তাহার মনে হইল, আর বৃথা দেরি না করিয়া আজই চুয়াকে নিজের প্রমোদ-উদ্যানে টানিয়া লইয়া যায়। কিন্তু তাহা হইলে এত বৎসর ধরিয়া যে চরম বিলাসিতার আয়োজন করিয়াছে, তাহা ব্যর্থ হইয়া যাইবে। মাধব নিরস্ত হইল। তৎপরিবর্তে যে স্পর্ধিত বেনের ছেলেটা তাহার গায়ে হাত তুলিতে সাহস করিয়াছে, তাহার নৌকা লুঠ করিয়া তাহাকে নিজের চক্ষুর সম্মুখে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতিয়া কুকুর দিয়া খাওয়াইবার আয়োজনে দিনটা সদ্ব্যয় করিতে মনস্থ করিল। এটাও একটা মন্দ বিলাসিতা নয়।
বাহিরে আসিয়া মাধব তাহার সর্দার-পাইককে বলিল, “বদন, তুই দশ জন পাইক নিয়ে গঙ্গাঘাটে যা। সেখানে চন্দনদাস বেনের নৌকো আটক কর্। আমি যাচ্ছি।”— বলিয়া আর একজন পাইককে ঘোড়া আনিতে পাঠাইল।
বদন সর্দার প্রভুর আজ্ঞা শিরোধার্য করিয়া যখন ঘাটে পৌঁছিল, তখন চন্দনদাসের নৌকা দু’খানি ভাগীরথীর বক্ষে শুভ্র পাল উড়াইয়া উজান বাহিয়া চলিয়াছে; বহুপদবিশিষ্ট বিরাট জল-পতঙ্গের মতো তাহাদের দাঁড়গুলি যেন গঙ্গার উপর তালে তালে পা ফেলিতেছে।
ওদিকে চন্দনদাস তীরবেগে ঘোড়া ছুটাইয়া দিয়াছিল। দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে, পথে লোকজন কম। চন্দনদাস ধাবমান ঘোড়ার পিঠে বসিয়া চিন্তা করিতেছিল— এখন কর্তব্য কি? প্রথমত, চুয়াকে রক্ষা করিতে হইবে। মাধবের নাকে কিল মারার ফলে তাহার ক্রোধ কোন্ পথ লইবে, অনুমান করা কঠিন; মাধব চুয়ার কথা ভুলিয়া তাহার প্রতি ধাবমান হইতে পারে; তাহাতে চুয়া কিছুক্ষণের জন্য রক্ষা পাইবে। দ্বিতীয়ত, তাহার নৌকা বাঁচাইতে হইবে। ক্রোধান্ধ মাধব প্রথমে তাহাকেই ধরিতে আসিবে; তখন তাহার অমূল্য পণ্য ও সোনাদানায় বোঝাই নৌকা লুণ্ঠিত হইবে। মাধব রেয়াৎ করিবে না।
ঘাটে পৌঁছিবার পূর্বেই চন্দনদাস কর্তব্য স্থির করিয়া ফেলিল। অশ্বত্থ-শাখায় ঘোড়া বাঁধিয়া সে দ্রুতপদে নৌকায় গিয়া উঠিল; দেখিল, মাঝি-মাল্লারা আহার করিতে বসিয়াছে। চন্দনদাস সর্দার-মাঝিকে ডাকিয়া পাঠাইয়া বলিল, “এখনি নৌকো খুলতে হবে।”
হতবুদ্ধি মাঝি বলিল, “এখনি? কিন্তু—”
“শোনো, তর্ক করবার সময় নেই। এই দণ্ডে নৌকো খোলো— পাল আর দাঁড় দুই লাগাও। আজ সন্ধ্যে পর্যন্ত যতদূর সম্ভব উজান বেয়ে যাবে, তারপর গাঙের মাঝখানে নোঙর ফেলবে। আমি যতদিন না ফিরি সেইখানে অপেক্ষা করবে। বুঝলে?”
“আপনি সঙ্গে যাবেন না?”
“না। এখন যাও, আর দেরি করো না। যতদিন আমি না ফিরি সাবধানে নৌকো পাহারা দিও।”
“যে আজ্ঞা।”— বলিয়া প্রাচীন মাঝি চলিয়া গেল। মুহূর্ত পরে দুই নৌকার মাঝি-মাল্লার হাঁকডাক ও পাল তোলার হুড়াহুড়ি আরম্ভ হইল। এই অবকাশে চন্দনদাস নৌকার পশ্চাতে মাণিকভাণ্ডারে গিয়া কিছু জিনিস সংগ্রহ করিয়া লইল। প্রথমে সিন্দুক হইতে মোহর-ভরা একটা সর্পাকৃতি লম্বা থলি বাহির করিয়া কোমরে জড়াইয়া লইল। যে-কার্যে যাইতেছে, তাহাতে কত অর্থের প্রয়োজন কিছুই স্থিরতা নাই; অথচ বোঝা বাড়াইলে চলিবে না। চন্দনদাস ভাবিয়া চিন্তিয়া একছড়া মহামূল্য সিংহলী মুক্তার হার গলায় পরিয়া লইল। যদি মোহরে না কুলায়, হার বিক্রয় করিলে যথেষ্ট অর্থ পাওয়া যাইবে।
এ ছাড়া আরও দুইটি জিনিস চন্দনদাস সঙ্গে লইল। একটি ইস্পাতের উপর সোনার কাজ করা ছোট ছোরা; এটি সে কোচিনে এক আরব বণিকের নিকট কিনিয়াছিল। দ্বিতীয়, এক কাফ্রির উপহার একটি লোহার কাঁটা। কৃষ্ণবর্ণ দ্বিভুজ লোহার কাঁটা, সেকালে শৌখীন স্ত্রী-পুরুষ এইরূপ কাঁটা চুলে পরিত। এই কাঁটার বিশেষত্ব এই যে, ইহার তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ শরীরের কোনও অংশে ফুটিলে তিনবার নিশ্বাস ফেলিতে যতক্ষণ সময় লাগে, ততক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হইবে। চন্দনদাস কাঁটার সূক্ষ্মাগ্র সোনার খাপে ঢাকিয়া সাবধানে নিজের চুলের মধ্যে গুজিয়া লইল।
নৌকা হইতে নামিয়া চন্দনদাস নগরের ভিতর দিয়া আবার হাঁটিয়া চলিল। ঝাঁ-ঝাঁ দ্বিপ্রহর, আশেপাশে দোকানের মধ্যে দোকানী নিদ্রালু; মধ্যাকাশ হইতে সূর্যদেব প্রখর রৌদ্র ঢালিয়া দিতেছেন। গাছ-পালা পর্যন্ত নিঝুম হইয়া পড়িয়াছে; মানুষ গৃহতলের ছায়ায় আশ্রয় লইয়াছে।
কিছুদূর যাইবার পর একটা মোড়ের মাথায় পৌঁছিয়া চন্দনদাস এবার কোন্ পথে যাইবে ভাবিতেছে, এমন সময় তাহার চোখে পড়িল, একটা নয়-দশ বছরের কটিবাসপরিহিত শীর্ণকায় বালক প্রচণ্ড মার্তণ্ড-ময়ুখ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া পথের মধ্যে একাকী ডাণ্ডাগুলি খেলিতেছে। চন্দনদাস হাতছানি দিয়া তাহাকে ডাকিল। বালক ক্রীড়ায় বিরাম না দিয়া, যষ্টির আঘাতে ক্ষুদ্র কাষ্ঠখণ্ডটিকে চন্দনদাসের দিকে তাড়িত করিতে করিতে তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তারপর প্রবীণের মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চন্দনদাসের বেশভূষা নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “সওদাগর! সমুদ্দুর থেকে আসছ— ন্যাঃ?”
বালকের ভাষা ও বাক্প্রণালী অতি অদ্ভুত— আমরা তাহা সরল ও সহজবোধ্য করিয়া দিলাম।
চন্দনদাস বলিল, “হ্যাঁ। নিমাই পণ্ডিতের বাড়ি কোথায় জানিস?”
বালক বলিল, “হিঃ— জানি।”
“আমাকে সেখানে নিয়ে চল্।”
বালকের ধূর্ত মুখে একটু হাসি দেখা দিল, সে এক চক্ষু মুদিত করিয়া বলিল, “ডাংগুলি খেলছি যে।”
“পয়সা দেব।”
আকর্ণ দন্তবিকাশ করিয়া বালক হাত পাতিল, “আগে দাও।”
চন্দনদাস তাহাকে একটা কপর্দক দিল, তখন সে আবার ডাংগুলি খেলিতে খেলিতে পথ দেখাইয়া লইয়া চলিল।
বেশি দূর যাইতে হইল না; নিম্ববৃক্ষচিহ্নিত একটা বাড়ি যষ্টি-নির্দেশে দেখাইয়া দিয়া বালক প্রস্থান করিতেছিল, চন্দনদাস তাহাকে ফিরিয়া ডাকিল, বলিল, “তুই যদি আর একটা কাজ করতে পারিস, তোকে চারটে পয়সা দেব।”
“কি?”
“কাঞ্চন বেনের বাড়ি জানিস?”
বালকের চক্ষু উজ্জ্বল হইল, “চুয়া? মাধায়ের কইমাছ? জানি। — হি হি!”
চন্দনদাসের ইচ্ছা হইল, অকালপক্ব ছোঁড়ার গালে একটা চপেটাঘাত করে; কিন্তু সে কষ্টে ক্রোধ সংবরণ করিয়া বলিল, “হ্যাঁ, চুয়া। শোন্, তার বাড়ির সামনে দিয়ে যাবি, কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করবি না, কেবল দেখে আসবি, সেখানে কি হচ্ছে। পারবি?”
বালক বলিল, “হিঃ— পয়সা দাও।”
চন্দনদাস মাথা নাড়িয়া বলিল, “না, আগে খবর নিয়ে আসবি, তবে পয়সা পাবি। আমি এইখানেই থাকব।”
বালক ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া মনে মনে গবেষণা করিল, চন্দনদাসকে বিশ্বাস করা যাইতে পারে কি না? শেষে ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইয়া পূর্ববৎ ডাংগুলি খেলিতে খেলিতে প্রস্থান করিল।
চন্দনদাস তখন নিমাই পণ্ডিতের গৃহে প্রবেশ করিল। সম্মুখেই টোলের আটচালা; ছাত্ররা কেহ নাই, নিমাই পণ্ডিত একাকী বসিয়া আছেন। তাঁহার কোলে তুলটের একখানি নূতন পুঁথি; পাশে লেখনী ও মসীপাত্র। চন্দনদাসের পদশব্দে নিমাই পণ্ডিত মুখ তুলিলেন; প্রশান্ত বিশাল চক্ষু হইতে শাস্ত্র-চিন্তাজনিত স্বপ্নাচ্ছন্নতা দূর করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাকে চান?”
চন্দনদাস বলিল, “নিমাই পণ্ডিতকে।”
“আমিই নিমাই পণ্ডিত।”
পাদুকা খুলিয়া চন্দনদাস গিয়া নিমাই পণ্ডিতকে প্রণাম করিল। নিমাই পণ্ডিত বয়সে তাহার অপেক্ষা ছোট হইলেও ব্রাহ্মণ। তুলসীপাতার ছোট বড় নাই।
নিমাই পণ্ডিত প্রণাম গ্রহণ করিয়া বলিলেন, “দেখেছি বলে মনে হচ্ছে— আপনিই কি আজ দুখানি নৌকা নিয়ে সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরেছেন?”
চন্দনদাস বিনীতভাবে বলিল, “আজ্ঞা হাঁ, আমিই।”
নিমাই পণ্ডিত হাসিয়া বলিলেন, “আজ আপনার নৌকার ঢেউয়ে নবদ্বীপের একটি অমূল্য রত্ন ভেসে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে রক্ষা করা গিয়েছে। যা হোক, আপনি—?”
চন্দনদাস নিজের পরিচয় দিয়া শেষে করজোড়ে বলিল, “আপনি ব্রাহ্মণ এবং মহাপণ্ডিত, আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করলে আমার অপরাধ হয়।”
নিমাই পণ্ডিত বলিলেন, “বেশ, কি ব্যাপার বলো তো?”
চন্দনদাস বলিল, “একটা কাজে আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি। নবদ্বীপে কাউকে আমি চিনি না, কেবল আপনার নাম শুনেছি। শুনেছি, আপনি শুধু অপরাজেয় পণ্ডিত নন, সৎকার্য করবার সাহসও আপনার অদ্বিতীয়। আমাকে সাহায্য করবেন কি?”
নিমাই পণ্ডিত বুঝিলেন, বণিকতনয় আজ গুরুতর কোনও কাজ আদায় করিতে আসিয়াছে, মৃদুহাস্যে বলিলেন, “তোমার নম্রতা আর বিনয় দেখে ভয় হচ্ছে। যা হোক্, প্রস্তাবটা কি শুনি?”
চন্দনদাসও হাসিল; বুঝিল, নিমাই পণ্ডিতকে মিষ্ট চাটুকথায় বিগলিত করা চলিবে না, তাঁহার সহিত অকপট ব্যবহার করাই শ্রেয়ঃ। সে ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিল, “আপনি কাঞ্চন বেনের মেয়ে চুয়াকে জানেন?”
নিমাই পণ্ডিত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চন্দনদাসের মুখের পানে চাহিলেন। তাঁহার মুখ ঈষৎ গভীর হইল, বলিলেন, “জানি। চুয়ার কথা নবদ্বীপে সকলেই জানে।”
চন্দনদাস বলিয়া উঠিল, “তবু তাকে উদ্ধারের চেষ্টা কেউ করে না?”
নিমাই পণ্ডিত স্থির হইয়া রহিলেন, কোনও উত্তর দিলেন না।
চন্দনদাস তখন বলিল, “আমি চুয়াকে বিয়ে করতে চাই। আপনি সহায় হবেন কি?”
নিমাই পণ্ডিত বিস্মিত হইলেন। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া কোল হইতে পুঁথি নামাইয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, “কিন্তু চুয়া সম্বন্ধে সব কথা তুমি জানো কি?”
“যা জানি, আপনাকে বলছি।”— এই বলিয়া আজ নৌকা হইতে নামিবার পর এ পর্যন্ত যাহা যাহা ঘটিয়াছিল সমস্ত সবিস্তারে বর্ণনা করিল; শেষে কহিল, “এই নির্বান্ধব পুরীতে চুয়া যেমন একা, আমিও তেমনি একা। এখন আপনি যদি সাহায্য করেন, তবেই কিছু করিতে পারি। নচেৎ একটি বালিকার সর্বনাশ হয়।”
নিমাই পণ্ডিত ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া চিন্তামগ্ন হইলেন।
এই সময় সেই বালক ডাংগুলি হস্তে ফিরিয়া আসিল। চন্দনদাস সাগ্রহে তাহাকে কাছে ডাকিতেই সে বলিল, “চুয়ার বাড়ির সামনে দুটো পাক্ বসে আছে; যে যাচ্ছে তারে হুমকি দিচ্ছে।”
“আর কি দেখলি?”
“চুয়া আর তার ঠান্দি ঘরে আছে। চাঁপা নাপতিনী বুড়ির সঙ্গে কোঁদল করছে।”
“আর কিছু?”
“আর মাধাই চন্নন বেনের ডিঙ্গি লুঠ করতে গেছে। পয়সা দাও।”
খুশি হইয়া চন্দনদাস বালককে চার পয়সার স্থলে দু’গণ্ডা দিল। হৃষ্ট বালক তীক্ষ্ণস্বরে একবার “উ—” বলিয়া উল্লাস জ্ঞাপনপূর্বক ডাংগুলি খেলিতে খেলিতে প্রস্থান করিল।
বালককে বিদায় করিয়া চন্দনদাস নিমাই পণ্ডিতের দিকে ফিরিতেই তিনি উদ্দীপ্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “আমি তোমাকে সাহায্য করব। তোমার উদ্যম প্রশংসনীয়; আমরা গাঁয়ের লোক যা করিনি, তুমি বিদেশী তাই করতে চাও। তোমার স্বার্থ আছে জানি, কিন্তু তাতে তোমার মহত্ত্বের কিছু মাত্র হানি হয় না; আমি কি করতে পারি বলো।”
চন্দনদাস বলিল, “তা আমিও জানি না। আপাতত পরামর্শ দিতে পারেন।”
“বেশ, এসো, পরামর্শ করা যাক। মাধব যে রকম দুর্ধর্ষ পাষণ্ড, তার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে কোনও ফল হবে না। আমার মনে হয়—”
চন্দনদাস বলিল, “একটি নিবেদন আছে। আমার বড় তৃষ্ণা পেয়েছে; ব্রাহ্মণবাড়ি একটু পাদোদক পেতে পারি?”
নিমাই সচকিত হইয়া বলিলেন, “তুমি এখনও আহার করোনি?”
চন্দনদাস হাসিয়া বলিলেন, “না, কেবল চুয়ার দেওয়া একখানি বাতাসা খেয়েছি।”
“কি আশ্চর্য! এতক্ষণ বলোনি কেন? দাঁড়াও, আমি দেখি।”— বলিয়া খড়ম পরিয়া ত্বরিতে অন্দরে প্রবেশ করিলেন।
বেলা তখন তৃতীয় প্রহর। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী ভৃত্য-পরিজন সকলকে খাওয়াইয়া নিজে আহারে বসিতে যাইতেছিলেন, নিমাই গিয়া বলিলেন, “একজন অতিথি এসেছে। খেতে দিতে পারবে?”
বিষ্ণুপ্রিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “পারব।” তারপর ক্ষিপ্রহস্তে দালানে জল-ছড়া দিয়া পিঁড়ি পাতিয়া নিজের অন্নব্যঞ্জন অতিথির জন্য ধরিয়া দিয়া স্বামীর মুখের গানে চাহিলেন।
নিমাই দাঁড়াইয়া দেখিতেছিলেন, স্মিতমুখে চন্দনদাসকে ডাকিতে গেলেন। এই নীরব কর্মপরায়ণা অনাদৃতা বধূটি ক্ষণকালের জন্য নিমাই পণ্ডিতের মন হইতে লক্ষ্মীদেবীর স্মৃতি মুছিয়া দিল।
অতঃপর চন্দনদাস পরিতোষপূর্বক ব্রাহ্মণগৃহে প্রসাদ পাইল।
পরামর্শ স্থির করিতে অপরাহ্ণ গড়াইয়া গেল। যে সকল ছাত্র টোলে পড়িতে আসিল, নিমাই পণ্ডিত তাহাদের ফিরাইয়া দিলেন।
সংকল্প স্থির করিয়া নিমাই বলিলেন, “এ ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখি না। তৃতীয় ব্যক্তিকে দলে টানতে ভয় করে; কথাটা জানাজানি হয়ে যদি মাধবের কানে ওঠে, তাহলে আর কোনও ভরসা থাকবে না।”
চন্দনদাস জিজ্ঞাসা করিল, “এ দেশের মাঝি-মাল্লাদের বিশ্বাস করা যেতে পারে?”
“অন্য ব্যাপারে বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু যে ব্যাপারে মাধব আছে, তাতে কাউকে বিশ্বাস করা চলে না। ঘূণাক্ষরে আমাদের মতলব টের পেলে তারা আমাদেরই মাধবের হাতে ধরিয়ে দেবে।”
“তাহলে—”
নিমাই হাসিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, মাঝি-মাল্লার কাজ আমাকেই করতে হবে। কাণভট্টের আশীর্বাদ দেখছি, এরি মধ্যে ফলতে আরম্ভ করেছে।”
চন্দনদাস বলিল, “চূয়াকে আমি খবর দেব। শেষ রাত্রির দিকে পাইকরা ঘুমিয়ে পড়বে— সেই উপযুক্ত সময়। কি বলেন?”
“হ্যাঁ। তুমি তোমার নৌকা পাঠিয়ে দিয়ে বড় বুদ্ধিমানের কাজ করেছ। মাধব নিশ্চিন্ত থাকবে, হয়তো রাত্রিতে চুয়ার বাড়িতে পাহারা না থাকতে পারে।”
“অতটা ভরসা করি না। যা হোক, দেখা যাক।”
সন্ধ্যার প্রাক্কালে দুই জন বাহির হইলেন। ব্রাহ্মণপল্লী হইতে অনেকটা উত্তরে গঙ্গাতীরে নৌ-কর সূত্রধরদের বাস। সেখানে উপস্থিত হইয়া দুই জনে দেখিলেন, রাশি রাশি স্তূপীকৃত শাল, পিয়াল, সেগুন, জারুল কাষ্ঠের প্রাকারের মধ্যে ছোট বড় নানাবিধ নৌকা তৈয়ার হইতেছে। কোনটির কংকালমাত্র গঠিত হইয়াছে, কোনটি পাটাতনে শোভিত হইয়া পূর্ণাঙ্গ হইয়া উঠিতেছে। বড় বড় বজরা— পঞ্চাশ দাঁড়ের নৌকা— কাহারও হাঙ্গর-মুখ, কেহ বা ময়ূরপঙ্ক্ষী, কেহ বা হংসমুখী। আবার ক্ষুদ্রকায় ডিঙ্গি, সংকীর্ণ-দেহ ছিপও আছে। কোনটি সম্পূর্ণ হইয়াছে, কোনটি এখনও অসম্পূর্ণ।
দুই জনে অনেক নৌক দেখিয়া শেষে একটি ছোট ডিঙ্গি পছন্দ করিলেন। ডিঙ্গির সুন্দর গঠন, আড়াই হাত চওড়া, আট হাত লম্বা— শোলার মতো হালকা। মাত্র চারি জন লোক তাহাতে বসিতে পারে।
নিমাই পণ্ডিত ছুতারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দাম কত?”
ছুতার কিন্তু ডিঙ্গি বেচিতে রাজী হইল না, বলিল, ‘ফরমাশী ডিঙ্গি।”
চন্দনদাস জিজ্ঞাসা করিল, “এ ডিঙ্গির জন্যে কত দাম পাবে?”
ছুতার একটু বাড়াইয়া বলিল, “তিন তঙ্কা।”
চন্দনদাস নিঃশব্দে তাহার হাতে এক মোহর দিল। ছুতার স্বপ্নেও এত মূল্য কল্পনা করে নাই, সে কিছুক্ষণ হতবাক্ থাকিয়া মহানন্দে ডিঙ্গির মালিকত্ব চন্দনদাসকে সমর্পণ করিল।
ডিঙ্গি তৎক্ষণাৎ গঙ্গার জলে ভাসানো হইল। নিমাই পণ্ডিত ও চন্দনদাস তাহাতে আরোহণ করিয়া দুই জোড়া দাঁড় হাতে লইলেন। দাঁড়ের আঘাতে ডিঙ্গি জ্যা-মুক্ত তীরের মতো জলের উপর ছুটিয়া গেল।
কিছুক্ষণ গঙ্গাবক্ষে দাঁড় টানিয়া উভয়ে দেখিলেন, ডিঙ্গি নির্দোষ ও অতি সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। দুই জনে সন্তুষ্ট হইয়া তীরে ফিরিলেন। তারপর নৌকা ছুতারের তত্ত্বাবধানে রাখিয়া নিমাই পণ্ডিত বলিলেন, “কাল বৈকালে আমি এসে ডিঙ্গি নিয়ে যাব।”
ছুতার সাহ্লাদে এক দিনের জন্য নৌকা রাখিতে সম্মত হইল।
অতঃপর নিমাই পণ্ডিত গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন। চন্দনদাসের তখনও কাজ শেষ হয় নাই, সে গঙ্গার ধারা দিয়া ঘাটের দিকে চলিল।
যে ঘাটে দ্বিপ্রহরে নৌকা বাঁধিয়াছিল, সেই ঘাটে যখন উপস্থিত হইল, তখন সন্ধ্যার ছায়া ঘনীভূত হইয়া আসিতেছে। ঘাটে কয়েকটি ক্ষুদ্র ডিঙ্গি বাঁধা ছিল; চন্দনদাস কয়েকজন মাঝিকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাপু, তোমরা জেলে তো?”
“আজ্ঞে কর্তা।”
“তোমাদের মোড়ল কে?”
একজন বৃদ্ধ-গোছের জেলে বলিল, “আজ্ঞে কর্তা, আমি মোড়ল। আমার নাম শিবদাস।”
“বেশ। তোমার সঙ্গে আমি কিছু কারবার করতে চাই। এখানে যত জেলে আছে, সবাই তোমার অধীন তো?”
“আজ্ঞে।”
“কত জেলে-ডিঙ্গি তোমাদের আছে?”
“তা— ত্রিশ-চল্লিশখানা হবে।”
“বেশ। শোনো; তোমাদের যত জেলে-ডিঙ্গি আছে, সব আমি ভাড়া করলাম। তোমরা জেলে-মাঝির দল কাল বেলা তিন পহরের সময় বেরুবে; বেরিয়ে সটান স্রোতের মুখে দক্ষিণে গিয়ে শান্তিপুরের ঘাটে নৌকো বাঁধবে। তারপর সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। সন্ধ্যে পর্যন্ত আমি যদি না যাই, তাহলে আবার ফিরে আসবে। — বুঝলে?”
“বুঝলাম কর্তা। কিন্তু কাজটা কি, তা তো এখনও জানতে পারিনি।”
“কাজের কথা শান্তিপুরের ঘাটে জানতে পারবে। কেমন, রাজী আছ?”
“আজ্ঞে, গররাজী নই। কিন্তু ধরুন, শান্তিপুরের ঘাটে যদি আপনার দেখা না পাই?”
“বলেছি তো, তাহলে ফিরে আসবে।”
“কিন্তু আমাদের যাওয়া-আসা যে তাহলে না-হক হয়রানি হয়, কর্তা। আপনাকে তখন পাব কোথায়? আপনাকে তো চিনি না।”
চন্দনদাস হাসিয়া বলিল, “তা হলেও তোমাদের লোকসান হবে না। তোমাদের অর্ধেক ভাড়া আমি আগাম দিয়ে যাব। সব নৌকো শান্তিপুরে যাওয়া-আসার জন্যে কত ভাড়া লাগবে?”
শিবদাস মোড়ল বিবেচনা করিয়া বলিল, “আজ্ঞে, দশটি তঙ্কার কমে হবে না।”
চন্দনদাস একটু ব্যবসাদারি করিল। কারণ, এক কথায় রাজী হইয়া গেলে জেলেরা কিছু সন্দেহ করিতে পারে। কিছুক্ষণ কষা-মাজার পর নয় তঙ্কা ভাড়া ধার্য হইল। চন্দনদাস পাঁচ তঙ্কা শিবদাস মোড়লের হাতে দিয়া বলিল, “এই নাও। কিন্তু কথার নড়াচড় যেন না হয়।”
“আজ্ঞে”— শিবদাস মুদ্রা গনিয়া লইল, “আপনি নিশ্চিন্দি থাকুন কর্তা, ঠিক সময়ে আমরা শান্তিপুরের ঘাটে হাজির থাকব—”
“সব ডিঙ্গি নিয়ে যাবে, একখানাও বাদ না পড়ে।”
“আজ্ঞে, একখানাও বাদ পড়বে না।”
এইরূপে নবদ্বীপ হইতে সমস্ত ডিঙ্গি তফাৎ করিবার বন্দোবস্ত করিয়া চন্দনদাস কতকটা নিশ্চিন্তমনে নিমাই পণ্ডিতের গৃহে ফিরিল। সেইখানেই তাহার রাত্রিতে থাকিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল।
রাত্রি তিন প্রহরে, চুয়ার বাড়ির দালানে পাইক দুই জন বসিয়া বসিয়াই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। একজন দেয়ালে ঠেস দিয়া পদযুগল প্রসারিত করিয়া দিয়াছিল। দ্বিতীয় ব্যক্তি ঘুমের ঘোরে কখন কাৎ হইয়া শুইয়া পড়িয়াছিল; তাহার নাসারন্ধ্র হইতে কামারের হাপরের মতো একপ্রকার শব্দ নির্গত হইতেছিল।
চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার; কিন্তু অন্ধকারে চক্ষু অভ্যস্ত হইলে কিছু কিছু দেখা যায়। চন্দনদাস নিঃশব্দে ছায়ার মতো দালানে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার বাঁ হাতে সেই ক্ষুদ্র ছোরা। কিয়ৎকাল মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া সে পাইকের নাসিকাধ্বনি শুনিল তারপর দালানের গাঢ়তর অন্ধকারের ভিতর তাহার চক্ষু বস্তু নির্বাচন করিতে আরম্ভ করিল।
যে পাইকটা বসিয়া বসিয়া ঘুমাইতেছে, তাহার পদদ্বয় ঠিক দরজার সম্মুখে প্রসারিত; ভিতরে প্রবেশ করিতে হইলে তাহাকে লঙ্ঘন করিয়া যাইতে হইবে। তা ছাড়া দরজার কবাট ভেজানো রহিয়াছে, ভিতর হইতে অর্গলবদ্ধ কি না, বুঝা যাইতেছে না। চন্দনদাস ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে হাত বাড়াইয়া কবাট একটু ঠেলিল। মরিচাধরা হাঁসকলে ছুঁচার ডাকের মতো শব্দ হইল। দরজা ঈষৎ খুলিল।
হাঁসকলের শব্দে পাইকের হাপর হঠাৎ বন্ধ হইল। চন্দনদাস স্পন্দিত-বক্ষে ছোরা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কিন্তু পাইক জাগিল না, আবার তাহার নাক ডাকিয়া উঠিল।
চন্দনদাস তখন আবার কবাট একটু ঠেলিল, কবাট খুলিয়া গেল। এবারও একটু শব্দ হইল বটে, কিন্তু কেহ জাগিল না। তখন চন্দনদাস ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করিয়া নিঃশব্দে পাইকের পদযুগল লঙ্ঘন করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।
আঙ্গিনায় উপস্থিত হইয়া চন্দনদাস চারিদিকে চাহিল। সম্মুখে কয়েকটা ঘর অস্ফুটভাবে দেখা যাইতেছে। কিন্তু কোন্ ঘরে চুয়া ঘুমাইতেছে? চাঁপাও বাড়িতে আছে; চুয়াকে খুঁজিতে গিয়া যদি চাঁপা জাগিয়া উঠে, তবেই সর্বনাশ। চন্দনদাস কি করিবে ভাবিতেছে, এমন সময় তাহার হাতে মৃদু স্পর্শ হইল।
চন্দনদাস চমকিয়া উঠিয়া অজ্ঞাতসারেই ছোরা তুলিল। এই সময় তাহার কানের কাছে মৃদু শব্দ হইল, “এসেছ?”
“চুয়া!” কোমরে ছোরা রাখিয়া চন্দনদাস দুই হাতে চুয়ার হাত ধরিল, বলিল, “চুয়া! এসেছি।”
চুয়ার নিশ্বাসের মতো মৃদু চাপা স্বর থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল; সে বলিল, “তুমি আসবে বলেছিলে, তাই আমি তোমার জন্যে সারা রাত জেগে আছি।”
অন্য সময় কথাগুলি অভিসারিকার প্রণয়বাণীর মতো শুনাইত; কিন্তু বিপদের মাঝখানে দাঁড়াইয়াও চন্দনদাসের মনে হইল, এত মধুর শব্দসমষ্টি সে আর কখনও শুনে নাই। চুয়ার মুখখানি দেখিবার জন্য তাহার প্রাণে দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা জাগিতে লাগিল। অথচ অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। চন্দনদাস চুয়ার কানে কানে বলিল, “চুয়া, একটা আলো জ্বালতে পারো না? তোমাকে বড় দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
দু’জনে অন্ধকারে হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, চুয়া ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিল, “আচ্ছা, এসো।”— বলিয়া হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। চন্দনদাস তেমনই মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “চাঁপা কোথায়?”
“ঘুমুচ্ছে।”
“ঠান্দি?”
“ঠান্দিও ঘূমিয়ে পড়েছে।”
গোহালের মতো একটা পরিত্যক্ত ঘরে লইয়া গিয়া চুয়া চকমকি ঠুকিয়া আলো জ্বালিল। তখন প্রদীপের ক্ষীণ আলোকে চুয়ার মুখ দেখিয়া চন্দনদাস চমকিয়া উঠিল— চোখ দুটি জবাফুলের মতো লাল, চোখের কোলে কালি পড়িয়াছে; আশা, আশঙ্কা ও তীব্রোৎকণ্ঠার দ্বন্দ্বে চুয়ার অনুপম রূপ যেন ছিঁড়িয়া ভাঙ্গিয়া একাকার হইয়া গিয়াছে।
চন্দনদাসের বুকে বেদনার শূল বিঁধিল, সে বাষ্পাকুল কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “চুয়া!”
চুয়া মাটিতে বসিয়া কাঁদিতে লাগিল; রোদনরুদ্ধ স্বরে বলিল, “তোমার নৌকা চলে গেছে শুনে এত ভয় হয়েছিল!”
চন্দনদাস চুয়ার পাশে বসিয়া আর্দ্রকণ্ঠে বলিল, “চুয়া, আর ভয় নেই। তোমার উদ্ধারের সমস্ত ব্যবস্থা করেছি।”
চুয়া চোখ মুছিয়া মুখ তুলিল, “কি?”
চন্দনদাস বলিল, “বলছি। আগে বলো দেখি, তুমি সাঁতার কাটতে জানো?”
অবসাদ-ভরা সুরে চুয়া বলিল, “জানি। তাই তো ডুবে মরতে পারিনি। কতবার সে চেষ্টা করেছি।”
চন্দনদাসের ইচ্ছা হইল, চুয়াকে বুকে জড়াইয়া লইয়া সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু সে লোভ সংবরণ করিল, বলিল, “ও কথা ভুলে যাও, চুয়া, বুকে সাহস আনো। আমি এসেছি দেখেও তোমার সাহস হয় না?”
চুয়া কেবল তাহার কালিমালিপ্ত চোখ দুটি তুলিয়া চন্দনদাসের মুখের পানে চাহিয়া রহিল; হয়তো নিজের একান্ত নির্ভরশীলতার কথা প্রকাশ করিয়া বলিতে চাহিল, কিন্তু বলিতে পারিল না। চন্দনদাস তখন সংক্ষেপে প্রাঞ্জলভাবে উদ্ধারের উপায় বিবৃত করিয়া বলিল; চুয়া ব্যগ্র বিস্ফারিতনয়নে শুনিল। শুনিতে শুনিতে তাহার চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল।
চন্দনদাসের বিবৃতি শেষ হইলে চুয়া কিছুক্ষণ হেঁটমুখে নীরব হইয়া রহিল। লজ্জা করিবার সে অবকাশ পায় নাই,— হৃদয়ের তুমুল আন্দোলনের মধ্যে এই তরুণ উদ্ধারকর্তাটিকে সে যে কি দৃষ্টিতে দেখিয়াছে, তাহা নিজেই জানিতে পারে নাই। তাই উদ্ধারের আশা যখন তাহার সংশয়ময় চিত্তে আগুনের মতো জ্বলিয়া উঠিল, তখন সে আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, চন্দনদাসের পায়ের উপর আছড়াইয়া পড়িল। দুই হাতে পা জড়াইয়া কাঁদিয়া কহিল, “একটা কথা বলো।”
চন্দনদাস চুয়ার মুখ তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতে করিতে বলিল, “চুয়া, চুয়া, কি কথা?”
“বলো, আমায় বিয়ে করবে? তুমি আমায় প্রবঞ্চনা করছ না?”
চন্দনদাস জোর করিয়া চুয়ার মুখ তুলিয়া তাহার চোখের উপর চোখ রাখিয়া বলিল, “চুয়া, আমার মায়ের নামে শপথ করছি, তোমাকে যদি বিয়ে না করি, যদি আমার মনে অন্য কোনও অভিসন্ধি থাকে, তবে আমি কুলাঙ্গার।”
চুয়ার মাথা আবার মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। তারপর সে চোখ মুছিয়া উঠিয়া বসিল, বলিল, “তবে আমাকে এখনই নিয়ে যাচ্ছ না কেন?”
চন্দনদাসের ইচ্ছা হইতেছিল, এখনই এই কারাগার হইতে চুয়াকে মুক্ত করিয়া লইয়া পলায়ন করে; কিন্তু সুবুদ্ধি নিষেধ করিল। রাত্রি শেষ হইয়া আসিতেছে, ধরা পড়বার সম্ভাবনা বড় বেশি। সে মাথা নাড়িয়া বলিল, “না— এখন ভরসা হয় না। বাড়ির দোরে পাহারা— যদি ওরা জেগে ওঠে। —কিন্তু আমার এখানে আর থাকা বোধ হয় নিরাপদ নয়— চাঁপার ঘুম ভাঙতে পারে।”— বলিয়া চন্দনদাস অনিচ্ছাভরে উঠিয়া দাঁড়াইল।
চুয়ার মনে আবার ভয় প্রবেশ করিল। সম্মুখে সমস্ত দিন পড়িয়া আছে; কি জানি কি হয়! সে ভয়-কাতর চক্ষু দুইটি তুলিয়া বলিল, “যাচ্ছ?— কিন্তু—”
“কোনও ভয় নেই, চুয়া।”
“কিন্তু— যদি বিঘ্ন হয়— যদি— একটা জিনিস দিতে পারবে?”
“কি?”
“একটু বিষ। যদি কিছু বিঘ্ন হয়—”
চন্দনদাস কিছুক্ষণ শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে নিজের চুল হইতে সেই কাঁটা বাহির করিয়া দিল। গাঢ়স্বরে বলিল, “চুয়া, যদি দেখ কোনও আশা নেই তবেই ব্যবহার করো, তার আগে নয়।”— বলিয়া কাঁটার ভয়ংকর কার্যকারিতা বুঝাইয়া দিল।
এতক্ষণে চুয়ার মুখে হাসি দেখা দিল। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রোজ্জ্বল চক্ষে বলিল, “আর আমি ভয় করি না।”
চন্দনদাসের মুখে কিন্তু হাসির প্রতিবিম্ব পড়িল না। সে চুয়ার দুই হাত লইয়া নিজের বুকের উপর রাখিয়া বলিল, “চুয়া—”
বাক্পটু চন্দনদাস ইহার অধিক আর কথা খুঁজিয়া পাইল না।
চুয়া অশ্রু-আর্দ্র হাসিমুখ একবার চন্দনদাসের বুকের উপর রাখিল, অস্ফুটস্বরে কহিল, “চুয়া নয়— চুয়া-বউ। এই আমাদের বিয়ে।”
ঘরের বাহিরে আসিবার পর একটা কথা চন্দনদাসের মনে পড়িল, সে বলিল, “ঠান্দির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। তাকে ব’লো— কাল সন্ধের পর বাড়ি থেকে পালিয়ে যেন নিমাই পণ্ডিতের বাড়িতে যায়। সেখানে দু’-এক দিন লুকিয়ে থাকবে, তারপর আমি তাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব।”
গ্রীষ্মের হ্রস্ব রাত্রি তখন শেষ হইয়া আসিতেছে। কাক-কোকিল ডাকে নাই, কিন্তু বাতাসে আসন্ন প্রভাতের স্পর্শ লাগিয়াছে। পূর্বকাশে শুকতারা দপ্ দপ্ করিয়া জ্বলিতেছে।
আঙ্গিনায় দাঁড়াইয়া চন্দনদাস আর একবার চুয়ার দুই হাত নিজের বুকে চাপিয়া লইল। তারপর যে ভাবে আসিয়াছিল, সেই ভাবে ছায়ামূর্তির মতো বাহির হইয়া গেল।
পাইক দুই জন শেষ রাত্রির গভীর ঘুম ঘুমাইতে লাগিল।
অমাবস্যার সংশয়পূর্ণ দিবস ধীরে ধীরে ক্ষয় হইয়া আসিল। অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটিল না। কেবল দ্বিপ্রহরে মাধব চুয়ার গৃহে আসিয়া তদারক করিয়া গেল ও জানাইয়া গেল যে, তাহার প্রদত্ত শাস্ত্রীয়-বিধান যেন যথাযথ পালিত হয়।
এখানে চাঁপার কাজ শেষ হইয়াছিল; মাধবের অনুমতি পাইয়া সে প্রমোদ-উদ্যানে পূজার আয়োজন করিতে গেল।
সায়াহ্নে নবদ্বীপের ঘাটে স্নানার্থীর বিশেষ ভিড় ছিল না। দুই-চারি জন নারী গা ধুইয়া যাইতেছিল, কেহ কেহ কলসে ভরিয়া গঙ্গাজল লইয়া যাইতেছিল। পুরুষের সংখ্যা অল্প। কেবল একজন পুরুষ অধীরভাবে সোপানের উপর পদচারণ করিতেছিল ও মাঝে মাঝে স্থির হইয়া উৎকর্ণভাবে কি শুনিতেছিল। তাহার গলায় মুক্তাহার বিলম্বিত— অন্যথা সাধারণ বাঙালীর বেশ। বলা বাহুল্য, সে চন্দনদাস।
ক্রমে সূর্য নদীর পরপারে অস্তমিত হইল। নিদাঘকালের দ্রুত সন্ধ্যা যেন পক্ষ বিস্তার করিয়া আসিয়া ভাগীরথীর জলে ধূসর ছায়া বিছাইয়া দিল। পাশে নৌকাঘাট নির্জন ও নিস্তব্ধ। জেলে-ডিঙ্গি একটিও নাই। দুই-একখানি স্থূলকলেবর মহাজনী কিস্তি নিঃসঙ্গ অসহায়ভাবে বিস্তীর্ণ ঘাটে লাগিয়া আছে।
গঙ্গাবক্ষেও নৌকা নাই। কেবল দূরে উত্তরে একটি ক্ষুদ্র ডিঙ্গি স্রোতের মুখে ভাসিয়া আসিতেছে। অস্পষ্ট আলোকে মনে হয়, একটি লোক দাঁড় ধরিয়া তাহাতে বসিয়া আছে।
ক্রমে ডিঙ্গি মাঝগঙ্গা দিয়া ঘাটের সম্মুখীন হইল; কিন্তু ঘাটের নিকটে আসিল না, গঙ্গাবক্ষে স্থির হইয়া রহিল। নৌকারূঢ় ব্যক্তি মাঝে মাঝে দাঁড় টানিয়া নৌকা ভাসিয়া যাইতে দিল না।
চন্দনদাস চিন্তিতমুখে অধীরপদে ঘুরিতে ঘুরিতে হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল— ঐ আসিতেছে। পথে দূরাগত বাদ্যোদ্যম শুনা গেল। চন্দনদাস একবার গঙ্গাবক্ষস্থ ডিঙ্গির দিকে তাকাইল, তারপর স্পন্দিতবক্ষে একটা গোলাকার বুরুজের উপর গিয়া বসিল।
বাদ্যধ্বনি ক্রমশ কাছে আসিতে লাগিল। মহারোলে কাঁসর-ঘণ্টা শিঙা-ঢোল বাজিতেছে। তামাসা দেখিবার জন্য বহু স্ত্রী-পুরুষ-বালক জুটিয়াছিল, তাহাদের কলরব সেই সঙ্গে মিশিয়া কোলাহল তুমুল হইয়া উঠিয়াছে।
ঘাটের শীর্ষে আসিয়া কোলাহল থামিল; বাজনা বন্ধ হইল। চন্দনদাস দেখিল, কৌতূহলী জনতাকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া দুই সারি ঢাল-সড়কিধারী পাইক নামিয়া আসিতেছে। তাহাদের দুই সারির মধ্যস্থলে মুক্তকেশী জবামাল্য-পরিহিতা চুয়া। চন্দনদাসও কৌতূহলী দর্শকের মতো দাঁড়াইয়া এই বিচিত্র শোভাযাত্রা দেখিতে লাগিল।
পাইকগণ সদম্ভে অস্ত্র আস্ফালন করিয়া দর্শকদের ঠেলিয়া সরাইয়া দিয়া ঘাটের দিকে নামিতে আরম্ভ করিল। তাহাদের মধ্যবর্তিনী চুয়া মন্থরপদে এদিক-ওদিক চাহিতে চাহিতে সোপান অবরোহণ করিতে লাগিল।
তারপর চন্দনদাসের সঙ্গে তাহার চোখাচোখি হইল। নিমেষের দৃষ্টি-বিনিময়ে যে ইঙ্গিত খেলিয়া গেল, আর কেহ তাহা দেখিল না।
বুরুজের পাশ দিয়া যাইবার সময় চন্দনদাস অগ্রগামী পাইককে উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁ সর্দার, এ তোমাদের কিসের মিছিল?”
বদন সর্দার প্রশ্নকারীর দিকে ভ্রূকুটি করিয়া তাকাইল, তাহার গলায় দোদুল্যমান মুক্তার হার দেখিল, তারপর রূঢ়স্বরে কহিল, “তোর অত খবরে দরকার কি?”
চন্দনদাস মুখে বিনীতভাব প্রকাশ করিয়া বলিল, “না না, তাই জিজ্ঞাসা করছি।” মনে মনে বলিল, “মালিক আর চাকরের রা দেখি একই রকম। দাঁড়াও, তোমার মুণ্ডপাতের ব্যবস্থা করছি!”
পরবর্তী পাইকগণ সকলেই চোখ পাকাইয়া চন্দনদাসের দিকে তাকাইল; তাহার গলায় লোভনীয় মুক্তাহার কাহারও দৃষ্টি এড়াইল না। দুর্দান্ত প্রভুর উচ্ছৃঙ্খল ভৃত্য— হারছড়া কাড়িয়া লাইবার জন্য সকলেরই হাত নিশপিশ করিতে লাগিল।
জলের কিনারায় গিয়া পাইকের দল থামিল। চুয়া সোপান হইতে ঝুঁকিয়া গঙ্গাজল মাথায় দিল; তাহার ঠোঁট দুটি অব্যক্ত প্রার্থনায় একটু নড়িল। তারপর সে ধীরে ধীরে জলে অবতরণ করিল। প্রথমে এক হাঁটু, ক্রমে এক কোমর, শেষে বুক পর্যন্ত জলে গিয়া দাঁড়াইল। গলার মালা জলে ভাসাইয়া দিয়া ডুব দিল।
পাইকেরা কিনারায় কেহ বসিয়া, কেহ দাঁড়াইয়া গল্প করিতে করিতে গোঁফে মোচড় দিতে লাগিল।
এই সময় একটি ক্ষুদ্র ব্যাপার ঘটিল। চন্দনদাস ইতিমধ্যে বুরুজ হইতে নামিয়া পাইকদের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, হঠাৎ ব্যাকুলস্বরে বলিয়া উঠিল, “ঐ যাঃ!”
একজন পাইক ফিরিয়া দেখিল, চন্দনদাসের গলার মুক্তাহার ছিঁড়িয়া গিয়াছে এবং মুক্তাগুলি সুতা হইতে ঝর্ঝর্ করিয়া ঘাটের শানের উপর ঝরিয়া পড়িতেছে। সে লাফাইয়া আসিয়া মুক্তা কুড়াইতে লাগিল। তাহাকে মুক্ত কুড়াইতে দেখিয়া বাকি কয়জন পাইক হুড়মুড় করিয়া আসিয়া পড়িল। মুক্তার হরির লুট— এমন সুযোগ বড় ঘটে না। সকলে কড়াকড়ি করিয়া মুক্তা চুনিতে লাগিল, ঠেলা খাইয়া চন্দনদাস বাহিরে ছিটকাইয়া পড়িল।
পাইকেরা মুক্তা কুড়াইতেছে, দর্শকেরা তাহাদের ঘিরিয়া লুব্ধচক্ষে দেখিতেছে। কেহ লক্ষ্য করিল না যে, এই অবকাশে চন্দনদাস গঙ্গায় নামিল। চুয়া তখন সাঁতার দিতে আরম্ভ করিয়াছে।
চুয়া ও চন্দনদাস পাশাপাশি সাঁতার কাটিয়া চলিল। অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে; তাহাদের কালো মাথা দুটি কেবল জলের উপর দেখা যাইতেছে। চুয়া চন্দনদাসের পানে তাকাইল, তাহার সিক্ত মুখের উচ্ছলিত হাসি চন্দনদাসকে পুরস্কৃত করিল।
তাহারা যখন ঘাট হইতে প্রায় চল্লিশ হাত গিয়াছে, তখন ঘাটে একটা হৈ-হৈ শব্দ উঠিল। তারপর “ধর্ ধর্, পালাল, পালাল—” বলিয়া কয়েক জন পাইক জলে লাফাইয়া পড়িল, কয়েক জন নৌকার সন্ধানে ছুটিল। কিন্তু নৌকা কোথায়? বদন সর্দার ষাঁড়ের মতো চেঁচাইতে লাগিল।
গঙ্গার বুকে যে ছোট্ট ডিঙ্গি ভাসিতেছিল, তাহা ক্রমে নিকটবতী হইতে লাগিল। চন্দনদাস বলিল, “চুয়া যদি হাঁপিয়ে পড়ে থাকো, আমার কাঁধ ধরো।”
চুয়া বলিল, “না আমি পারব।”
চন্দনদাস পিছু ফিরিয়া দেখিল, যে পাইকগুলা জলে ঝাঁপ দিয়াছিল, তাহারা সজোরে সাঁতারিয়া আসিতেছে। কিন্তু তাহারা এখনও অনেক দূরে, নৌকা সম্মুখেই। কয়েক মুহূর্ত পরে দুই জনে একসঙ্গে গিয়া নৌকার কানা ধরিল।
নিমাই পণ্ডিত দাঁড় ছাড়িয়া চুয়াকে ধরিয়া নৌকায় তুলিলেন। চন্দনদাস তাহার পরে উঠিল।
যে পাইকটা সর্বাগ্রে আসিতেছিল, সে প্রায় বিশ হাতের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল। সে হাত তুলিয়া ভাঙা গলায় চিৎকার করিয়া কি একটা বলিল। প্রত্যুত্তরে চন্দনদাস উচ্চ হাসিয়া দু’খানা দাঁড় হাতে তুলিয়া লইল। নিমাই পণ্ডিতও দাঁড় হাতে লইলেন।
দুই জনে একসঙ্গে দাঁড় জলে ডুবাইয়া টানিলেন। প্রদোষের ছায়ালোকে ক্ষুদ্র ডিঙ্গি পাখির মতো উড়িয়া চলিল।
নবদ্বীপ হইতে পাঁচ ক্রোশ উত্তরে গঙ্গাবক্ষে চন্দনদাসের দুই সমুদ্রতরী নোঙর করা ছিল। অন্ধকারে তাহাদের একচাপ গাঢ়তর অন্ধকারের মতো দেখাইতেছিল।
রাত্রি এক প্রহরকালে ক্ষুদ্র নৌকা গিয়া চন্দনদাসের মধুকর ডিঙ্গার গায়ে ভিড়িল। মাঝিরা সজাগ ও সতর্ক ছিল; মুহূর্তমধ্যে সকলে বড় নৌকায় উঠিলেন।
নিমাই পণ্ডিত বলিলেন, “আমার কাজ তো শেষ হল, আমি এবার ফিরি।”
চন্দনদাস হাত জোড় করিয়া বলিল, “ঠাকুর, এত দয়া করলেন, একটু বিশ্রাম করে যান।”
নৌকায় দুইটি কুঠুরি— একটি মাণিকভাণ্ডার, অপরটি চন্দনদাসের শয়নকক্ষ। শয়নকক্ষের মেঝেয় রঙীন পক্ষ্মল সুতির আস্তরণ। ঘরে দীপ জ্বলিতেছিল; সকলে তাহাতে প্রবেশ করিলেন। চুয়া এক কোণে জড়সড় হইয়া অর্ধশুষ্ক বসন গায়ে জড়াইয়া দাঁড়াইল। চন্দনদাস তাড়াতাড়ি পেটারি হইতে নিজের একখানা ক্ষৌমবস্ত্র বাহির করিয়া চুয়ার গায়ে ফেলিয়া দিল। চুয়া কাপড় লইয়া পাশের ঘরে গেল।
নিমাই পণ্ডিত আস্তরণের উপর আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন; চুয়া প্রস্থান করিলে চন্দনদাস চুপি চুপি বলিল, “ঠাকুর, বিয়েটা আজ রাতেই দিয়ে দিলে ভাল হয়।”
নিমাই হাসিয়া বলিলেন, “এত তাড়া কিসের? বাড়ি গিয়ে বিয়ে করো।”
চন্দনদাস ভারি ভালমানুষের মতো বলিল, “না ঠাকুর, চুয়া যদি কিছু মনে করে?— তা ছাড়া, নৌকোয় একটি বই শোবার ঘর নেই।”
নিমাই বলিলেন, “কিন্তু বিয়ে দিই কি করে? উপকরণ কই?”
“ঠাকুর, আপনি পণ্ডিতমানুষ, সামান্য পুরুত তো নন। আপনি ইচ্ছে করলে শুধু হাতেই বিয়ে দিতে পারেন।”
নিমাই স্মিতমুখে চিন্তা করিয়া বলিলেন, “মন্দ কথা নয়। তুমি কন্যাকে হরণ করে এনেছ সুতরাং তোমাদের রাক্ষস-বিবাহ হতে পারে। রাক্ষস-বিবাহে কোনও অনুষ্ঠানের দরকার নেই।”
চন্দনদাস মহা উল্লাসে উঠিয়া গিয়া চুয়ার হাত ধরিয়া লইয়া আসিল; বলিল, “চুয়া, ঠাকুর এখনই আমাদের বিয়ে দেবেন।”
পট্টাম্বরপরিহিতা চুয়া নত-নয়নে রহিল। নিমাই হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “চন্দনদাস নাছোড়বান্দা, আজই বিয়ে করে তবে ছাড়বে।” চুয়ার মুখে অরুণরাগ দেখিয়া বুঝিলেন তাহার অমত নাই। বলিলেন, “বেশ। ফুলের মালা তো হবে না, দু’ছড়া হার যোগাড় করো।”
পুলকিত চন্দনদাস মাণিকভাণ্ডার হইতে দু’গাছা মুক্তার মালা বাহির করিয়া দিল। তখন বিবাহ-ক্রিয়া আরম্ভ হইল।
নিমাই একটি হার চুয়ার হাতে দিয়া বলিলেন, “দু’জনে দু’জনের গলায় দাও।”
উভয়ে মালা-বদল করিল।
নিমাই বলিলেন, “ঈশ্বর সাক্ষী করে গঙ্গার বুকের উপর ব্রাহ্মণ-সাক্ষাতে আজ তোমরা স্বামী-স্ত্রী হলে। আশীর্বাদ করি, তোমাদের মঙ্গল হোক।”
উভয়ে নতজানু হইয়া ভক্তিপূত-চিত্তে এই দেবকল্প তরুণ ব্রাহ্মণের পদধূলি লইল।
তারপর উঠিয়া চন্দনদাস বলিল, “ঠাকুর, এ বিয়ে লোকে মানবে তো?”
নিমাই পণ্ডিতের নাসা স্ফুরিত হইল, তিনি গর্বিতস্বরে বলিলেন, “নিমাই পণ্ডিত যে-বিয়ের পুরুত, সে-বিয়ে অমান্য করে কে?”
চন্দনদাস তখন নিমাই পণ্ডিতের পদতলে এক মুঠি মোহর রাখিয়া বলিল, “দেবতা, আপনার দক্ষিণা।”
নিমাই এইবার হাসিয়া উঠিলেন, “ঐটি পারব না। — যাক্, আজ উঠলাম। বুড়িকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা শীগ্গির করো। আর, বাড়ি গিয়ে যথারীতি লৌকিক বিবাহ করো। অধিকন্তু ন দোষায়।”
“তা করব। কিন্তু ঠাকুর, আপনি ক্লান্ত, পাঁচ-ছ’ ক্রোশ দাঁড় টেনে এসেছেন, আজ রাত্রিটা নৌকোয় কাটিয়ে গেলে হত না?”
“না— আজই আমায় ফিরতে হবে। রাত্রিতে না ফিরলে মা চিন্তিত হবেন। তা ছাড়া, তোমার নৌকায় তো একটি বই ঘর নেই।”— বলিয়া মৃদু হাসিলেন।
চন্দনদাস একটু লজ্জিত হইল।
তারপর সেই মসীকৃষ্ণ অমাবস্যার মধ্যযামে নিমাই পণ্ডিত ডিঙ্গিতে উঠিয়া একাকী নবদ্বীপের পানে ফিরিয়া চলিলেন। যতক্ষণ তাঁহার দাঁড়ের শব্দ শুনা গেল, চুয়া ও চন্দন জোড়হস্তে তদগতচিত্তে নৌকার পাশে দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়া রহিল।
১৮ অগ্রহায়ণ ১৩৪১