অষ্টম সর্গ

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

সেদিন সন্ধ্যার আকাশে দ্রুত সঞ্চরমাণ মেঘের দল শিপ্রার বর্ষাস্ফীত বক্ষে ধূমল ছায়া ফেলিয়া চলিয়াছিল। বৃষ্টি পড়িতেছে না বটে, কিন্তু পশ্চিম হইতে খর আর্দ্র বায়ু বহিতেছে— শীঘ্রই বৃষ্টি নামিবে। ছিন্ন ধাবমান মেঘের আড়ালে পঞ্চমীর চন্দ্রকলা মাঝে মাঝে দেখা যাইতেছে— যেন মহাকালের করচ্যুত বিষাণ খসিয়া পড়িতেছে, এখনই দিগন্তরালে অদৃশ্য হইবে।

শিপ্রার পূর্বতটে উজ্জয়িনীর পাষাণ-নির্মিত বিস্তৃত ঘাট। ঘাটের অসংখ্য সোপান বহু ঊর্ধ্ব হইতে ধাপে ধাপে নামিয়া শিপ্রার গর্ভে প্রবেশ করিয়াছে, ক্ষিপ্র জল-ধারা এই পাষাণ প্রতিবন্ধকে আছাড়িয়া পড়িয়া আবর্ত সৃষ্টি করিয়া বহিয়া যাইতেছে। কিন্তু শূন্য ঘাটে আজ শিপ্রার আক্ষেপোক্তি শুনিবার কেহ নাই।

ঘাট নির্জন। অন্যদিন এই সময় বহু স্নানার্থিনীর ভিড় লাগিয়া থাকে; তাহাদের কলহাস্য ও কঙ্কণকিঙ্কিণী মুখরভাবে শিপ্রাকে উপহাস করিতে থাকে; তাহাদের ঘটোচ্ছিলিত জল মসৃণ সোপানকে পিচ্ছিল করিয়া তোলে। আজ কিন্তু ভিড় নাই। মাঝে মাঝে দুই একটি তরুণী বধূ আকাশের দিকে সশঙ্ক দৃষ্টি হানিয়া ঘট ভরিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিতেছে। ক্বচিৎ এক ঝাঁক কিশোরী বয়স্যা মঞ্জীর বাজাইয়া গাগরী ভরিতে আসিতেছে; তাহারাও অল্পকাল জলক্রীড়া করিয়া পূর্ণঘট-কক্ষে চঞ্চল-চরণে সোপান আরোহণ করিয়া প্রস্থান করিতেছে। নির্জন ঘাটে সন্ধ্যার ছায়া আরও ঘনীভূত হইতেছে।

ঘাট নির্জন বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ জনশূন্য নহে। একটি পুরুষ নিম্নতর সোপানের এক প্রান্তে চিন্তামগ্নভাবে নীরবে বসিয়া আছেন। পুরুষের বয়স বোধ হয় পঁয়ত্রিশ কিংবা ছত্রিশ বৎসর হইবে। — যৌবনের মধ্যাহ্ন। দেহের বর্ণ তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়, মস্তক মুণ্ডিত, স্কন্ধে উপবীত, ললাটে শ্বেত চন্দনের ত্রিপুণ্ড্রক। মেঘাচ্ছন্ন প্রাবৃট-সন্ধ্যার স্বল্পালোকেও তাঁহার খড়্গের ন্যায় তীক্ষ্ণ নাসা ও আয়ত উজ্জ্বল চক্ষু স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। তিনি কখনও আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছেন, কখনও উদ্বেল-যৌবনা নদীর তরঙ্গ-ভঙ্গ নিরীক্ষণ করিতেছেন, কখনও ক্রীড়া-চপলা তরুণীদের রহস্যালাপ শ্রবণ করিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছেন।

কিন্তু তাঁহার মুখ চিন্তাক্রান্ত। গত দুইদিন হইতে একটি দুরূহ সমস্যা কিছুতেই তিনি ভঞ্জন করিতে পারিতেছেন না। অলঙ্কারশাস্ত্র ঘাঁটিয়া শেষ করিয়া ফেলিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার প্রশ্নের উত্তর কোথাও পাওয়া যায় নাই। এদিকে মহারাজ অবন্তীপতি ও সভাস্থ রসিক-মণ্ডলী সাগ্রহে প্রতীক্ষা করিয়া আছেন। ঘরে গৃহিণী তাঁহার ঔদাস্য ও অন্যমনস্কতায় সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিতেছেন। নানা দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় এই মধুর আষাঢ় মাসেও রাত্রিতে নিদ্রা নাই!

কয়েকটি যুবতী এই সময় মঞ্জীর-ঝঙ্কারে অমৃতবৃষ্টি করিয়া সোপানশীর্ষ হইতে  জলের ধারে নামিয়া আসিল। পুরুষকে কেহ লক্ষ্য করিল না— উত্তরীয় কলস নামাইয়া রাখিয়া জলে অবতরণ করিল; কৌতুক-সরস আলাপ করিতে করিতে পরস্পরের দেহে জল ছিটাইতে লাগিল। পুরুষ একবার সচকিতে তাহাদের প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া নতমুখে তাহাদের আলাপের ছিন্নাংশ শুনিতে লাগিলেন।

‘কাল তোর বর দেশে ফিরিয়াছে— না? তাই—’

সমুচ্চ কলহাস্যে বাকি কথাগুলি চাপা পড়িয়া গেল।

‘কি ভাই? কি হইয়াছে ভাই?’

‘তুই আইবুড় মেয়ে— আমাদের সঙ্গে মিশবি কেন লা? তোকে কিছু বলিব না।’

‘আহা বল্ বল্— ওর তো এই মাসেই বর আসিবে— ও এখন আমাদের দলে। …’

‘মধু, মোম, কুঙ্কুম আর ইঙ্গুদী-তৈল মিশাইয়া ঠোঁটে লাগাস্— আর কোনও ভয় থাকিবে না। সেই সঙ্গে একটু কেয়ার রেণুও দিতে পারিস্‌, কিন্তু খুব সামান্য …’

‘ওলো দ্যাখ্ দ্যাখ্, কপোতিকার কি দশা হইয়াছে…’

পুরুষ আড়নয়নে দেখিলেন, কপোতিকা তাড়াতাড়ি আবক্ষ জলে ডুবাইয়া বসিল।

‘…লোলার কি দুঃখ ভাই! তাহার স্বামী আজিও ফিরিল না— কে জানে হয়তো— যবদ্বীপ কতদূর ভাই?’

‘সিংহল পার হইয়া যাইতে হয়— ছয় মাসের পথ— লোলার জন্য বড় দুঃখ হয়— আমাদের সঙ্গে আসে না—’

‘— দ্যাখ, মেঘগুলা আজ পূর্বমুখে ছুটিয়াছে—’

‘— হ্যাঁ। এ মেঘ অলকায় যাইবে না।’

পুরুষ কর্ণ উদ্যত করিয়া শুনিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু আর অধিক শুনিতে পাইলেন না। যুবতীরা গাত্র মার্জনা সমাপন করিয়া তীরে উঠিল।

এই যুবতীযূথের মধ্যে একটিকে পুরুষ চিনিতেন। তাহারা বস্ত্র-পরিবর্তন সমাপ্ত করিলে তিনি ডাকিলেন— ‘ময়ূরিকে, তোমরা একবার এদিকে শুনিয়া যাও।’

চমকিত হইয়া সকলে মুখ ফিরাইল। বোধ করি একটু লজ্জাও হইল। তাই উত্তরীয় দ্বারা তাড়াতাড়ি অঙ্গ আবৃত করিয়া ফেলিল।

ময়ূরিকা নিম্নকণ্ঠে পুরুষের নাম উচ্চারণ করিল, নিমেষের মধ্যে চোখে চোখে একটা উত্তেজিত ইঙ্গিত খেলিয়া গেল। তারপর সকলে সংযতভাবে পুরুষের সমীপবর্তী হইয়া দাঁড়াইল।

ময়ূরিকা যুক্তকরে প্রণাম করিয়া বলিল— ‘ভট্ট, আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন।’

ভট্ট স্মিতমুখে আশীর্বাদ করিলেন— ‘আয়ুষ্মতী হও। তোমরা এতক্ষণ কি কথা কহিতেছিলে?’

সকলে পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিল। যে সকল কথা হইতেছিল, তাহা পুরুষকে, বিশেষত ভট্টকে কি করিয়া বলা যাইতে পারে?

মঞ্জরিকা ইহাদের মধ্যে ঈষৎ প্রগল্‌ভা, সে-ই উত্তর দিল। কৌতুক-চঞ্চল-দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল— ‘ভট্ট, আজ আকাশের মেঘদল পূর্বদিকে চলিয়াছে। উত্তরে অলকাপুরীতে পৌঁছিতে পারিবে না, তাই আমরা আক্ষেপ করিতেছিলাম।’

ভট্ট জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘সে জন্য আক্ষেপ কেন?’

মঞ্জরিকা বলিল— ‘যক্ষপত্নী বিরহ-বেদনায় কালযাপন করিতেছেন, যক্ষের সংবাদ পাইবেন না,— এই জন্য আক্ষেপ।’

এতক্ষণে যেন বুঝিতে পারিয়াছেন এমনিভাবে ভট্ট বলিলেন— ‘বুঝিয়াছি। তোমরা মেঘদূত কাব্যের কথা বলিতেছ। ভাল, তোমরা দেখিতেছি কাব্যশাস্ত্রে সুচতুরা। আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পার?’

সকলে যুক্তকরে বলিল— ‘আজ্ঞা করুন।’

ভট্ট চিন্তা করিলেন; পরে শিরঃসঞ্চালন করিয়া কহিলেন— ‘না, সে বড় কঠিন প্রশ্ন, তোমরা পরিবে না।’

মঞ্জরিকা অনুনয় করিয়া বলিল— ‘তবু আজ্ঞা করুন আর্য।’

ভট্ট সকলের চক্ষে অধীর কৌতূহল লক্ষ্য করিয়া বলিলেন— ‘উত্তম, বলিতেছি শুন। — তোমরা বলিতে পার, কাব্যে নায়ক-নায়িকার বিবাহ সম্পাদিত হইবার পর কবির আর কিছু বক্তব্য থাকে কি না?’

সকলে বিস্মিতভাবে নীরব রহিল; ভট্ট যে তাহাদের মতো অপরিণত-বুদ্ধি যুবতীদের নিকট কাব্যশাস্ত্র সম্বন্ধীয় এরূপ প্রশ্ন করিবেন, তাহা যেন সহসা ধারণা করিতেই পারিল না।

শেষে ময়ূরিকা বলিল— ‘আর্য, নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটিলেই তো কাব্য শেষ হইল! তাহার পর কবির আর কি বক্তব্য থাকিতে পারে?’

ভট্ট বলিলেন— ‘ময়ূরিকে, আমি মিলনের কথা বলি নাই, বিবাহের কথা বলিয়াছি।’

বিস্মিতা মঞ্জরিকা বলিল— ‘উভয়ই এক নহে কি?’

ভট্ট গূঢ় হাসিয়া বলিলেন— ‘উহাই তো প্রশ্ন।’

ভট্টের কথার মর্ম কেহ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল না, সকলে নির্বাক্ হইয়া রহিল। ভট্ট ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া চিন্তিতভাবে রহিলেন।

অবশেষে অরুণিকা কথা কহিল। সে ইহাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা চতুরা, এতক্ষণ কথা বলে নাই, এবার মুখ টিপিয়া জিজ্ঞাসা করিল— ‘ভট্ট, এ প্রশ্নটি কখনও ভট্টিনীর নিকট করিয়াছিলেন কি?’

ভট্ট চমকিয়া মুখ তুলিলেন। দেখিলেন অরুণিকার অরুণ ওষ্ঠপ্রান্তে একটু চাপা হাসি খেলা করিতেছে। তিনি ঈষৎ বিব্রতভাবে বলিলেন— ‘না, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি নাই, স্মরণ ছিল না। আজ গৃহে ফিরিয়াই জিজ্ঞাসা করিব। — কিন্তু তোমরা আর বিলম্ব করিও না, এবার গৃহে যাও। রাত্রি আগতপ্রায়।’

বক্রোক্তিটা সকলের কানে পৌঁছিল না; শুধু অরুণিকা বুঝিল, ভট্ট মৃদু রকমের প্রতিশোধ লইলেন। সকলে যুক্তহস্তা হইয়া বলিল— ‘আর্য, আমাদের আশীর্বাদ করুন।’

ভট্ট হাসিলেন— ‘তোমাদের আমি আর কি আশীর্বাদ করিব? আমি শঙ্করের দাস— অথচ স্বয়ং শঙ্করারি তোমাদের সহায়। ভাল, আশীর্বাদ করিতেছি—’ মুহূর্ত-কাল নীরব থাকিয়া জলদগম্ভীর-কণ্ঠে কহিলেন, ‘মাভূদেবং ক্ষণমপি চ তে স্বামিনা বিপ্রয়োগঃ।’

সকলে কপোতহস্তে আশীর্বাদ গ্রহণ করিয়া শিরোধার্য করিল। তারপর প্রফুল্ল মনে প্রীতিবিম্বিতমুখে শ্রোণি-কলস-ভার-মন্থর পদে প্রস্থান করিল।

ভট্ট বসিয়া রহিলেন। যুবতীদের নূপুরনিক্কণ ক্রমে শ্রুতি-বহির্ভূত হইয়া গেল। তখন আবার তাঁহার মুখ চিন্তাচ্ছন্ন হইল। কি করা যায়? এ প্রশ্নের কি সমাধান নাই? তীরে আসিয়া শেষে তরী ডুবিবে? অবশ্য এ কথা সত্য যে, নায়ক-নায়িকার বিবাহ দিবার পর কবির কর্তব্য শেষ হয়। কিন্তু তবু তাঁহার মন সন্তোষ মানিতেছে না কেন? কাব্য তো শেষ হইয়াছে;— আর এক পদ অগ্রসর হইলে প্রতিজ্ঞা-লঙ্ঘন হইবে, যাহা প্রতিপন্ন করিবার জন্য লেখনী ধারণ করিয়াছিলেন তাহার অতিরিক্ত কথা বলা হইবে। তাহা করিবার প্রয়োজন কি? নায়িকার মুখে সলজ্জ হাসি ফুটাইয়া বিদায় লওয়াই তো কবির উচিত; আর সেখানে থাকিলে যে রসভঙ্গ হইবে। সবই ভট্ট বুঝিতেছেন, তবু তাঁহার মন উঠিতেছে না। কেবলি মনে হইতেছে— এ হইল না, কাব্য শেষ হইল না, চরম কথাটি বলা হইল না।

এদিকে রাত্রি মেঘের ধূসর পক্ষে আশ্রয় করিয়া দ্রুত অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। সন্ধ্যা-আহ্নিকও হয় নাই— মন বিক্ষিপ্ত! ভট্ট উঠিবার চেষ্টা করিয়া চারিদিকে চাহিলেন। দেখিলেন, কলস-কক্ষে একটি তরুণী নিঃশব্দে নামিয়া আসিতেছে। তাহার গতিভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল— যাহা দেখিয়া ভট্ট উঠিতে পারিলেন না, আবার বসিয়া পড়িলেন।

তরুণী ধীরে ধীরে কলস নামাইয়া সোপানের শেষ পৈঠায় আসিয়া বসিল। কোনও দিকে লক্ষ্য করিল না, বিষণ্ণ ব্যথিত চক্ষু দুটি তুলিয়া যেখানে শিপ্রার স্রোত দূরে বাঁকের মুখে অদৃশ্য হইয়াছে, সেই দিকে চাহিয়া রহিল।

ভট্ট দেখিলেন— রমণীর দেহে সৌভাগ্যের চিহ্ন ব্যতীত অন্য কোনও অলঙ্কার নাই। রুক্ষকেশের রাশি একটা-মাত্র বেণীতে আবদ্ধ হইয়া অংসের উপর পড়িয়া আছে, শুষ্ক অশ্রুহীন চোখে কজ্জল নাই।

এই নীরব শোকপরায়ণা একবেণীধরা যুবতীকে ভট্ট বালিকা-বয়সে চিনিতেন। সম্প্রতি বহুদিন দেখেন নাই। তাঁহার চক্ষে  জল আসিল, কিন্তু বক্ষে আনন্দের ক্ষণপ্রভাও খেলিয়া গেল। তিনি ডাকিলেন— ‘লোলা!’

তন্দ্রাহতের ন্যায় যুবতী ফিরিয়া চাহিল। ভট্টকে দেখিয়া সলজ্জে উত্তরীয় দ্বারা অঙ্গ আবৃত করিয়া সঙ্কোচ-জড়িত-পদে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। ভট্টের চক্ষু বড় তীক্ষ্ণ, বস্ত্র ভেদ করিয়া দেহ ও দেহ ভেদ করিয়া মনের অন্তরতম কথাটি দেখিয়া লয়। লোলা কুণ্ঠিত নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।

ভট্ট জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘তুমি রৈবতক নাবিকের বধূ?’

লোলা হেঁটমুখে রহিল, উত্তর করিল না। তাহার অধর কাঁপিতে লাগিল।

ভট্ট পুনরায় বলিলেন— ‘তোমার স্বামী শ্রেষ্ঠী বরুণমিত্রকে লইয়া গত বৎসর যবদ্বীপে গিয়াছে— আজিও ফিরে নাই?’

লোলার চক্ষু দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। সে কেবল মাথা নাড়িল।

ভট্ট সুস্মিত মুখে বলিলেন— ‘তুমি ভয় করিও না, রৈবতক কুশলে আছে।’

ব্যাকুল নয়নে লোলা ভট্টের মুখের দিকে চাহিল। তাহার দৃষ্টির কাতর-বিহ্বল প্রশ্ন ভট্টের বক্ষে সূচীবেধবৎ বিঁধিল। তিনি লজ্জিত হইলেন— ছি, ছি, এতক্ষণ এই বালিকার আকুল আশঙ্কা লইয়া তিনি খেলা করিতেছিলেন!

অনুতপ্তস্বরে বলিলেন— ‘আজ রাজসভায় সংবাদ আসিয়াছে— রৈবতক সমস্ত নৌকা লইয়া সমুদ্র-সঙ্গমে ফিরিয়াছে! দুই-এক দিনের মধ্যেই গৃহে ফিরিবে। তুমি নিশ্চিন্ত হও।’

থরথর কাঁপিয়া লোলা সেইখানেই বসিয়া পড়িল। তারপর গলদশ্রুনেত্রে গলবস্ত্র হইয়া ভট্টকে প্রণাম করিল, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল— ‘দেব, আপনি আজ অভাগিনীর প্রাণ দিলেন। মহাকাল আপনাকে জয়যুক্ত করুন।’ উদ্গত অশ্রু সম্বরণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল— ‘আজ সংবাদ আসিয়াছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘সকলে নিরাপদে আছেন?’

‘হ্যাঁ, সকলেই নিরাপদে আছেন। — লোলা, তুমি অনুপমা। রৈবতক আসিলে তাহাকে আমার কাছে পাঠাইয়া দিও, তাহাকে তোমার কথা বলিব।’

অশ্রু মার্জনা করিয়া লোলা সিক্ত হাসি হাসিল, অস্ফুটস্বরে বলিল— ‘যে আজ্ঞা।’

এতক্ষণে শীকরকণার ন্যায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল, বায়ুতাড়িত জলকণা তির্যকভাবে ভট্টের মুখে পড়িতে লাগিল। তিনি উঠিলেন, সস্নেহস্বরে লোলাকে বলিলেন— ‘লোলা, দুঃখের অন্তেই মিলন মধুর হয়। আমার উমাকে আমি যে দুঃখ দিয়াছি তাহা স্মরণ করিলেও বক্ষ বিদীর্ণ হয়; কিন্তু চরমে সে ঈপ্সিত বর লাভ করিয়াছে। মদন পুনরুজ্জীবিত হইয়াছে। — তুমিও আমার গৌরীর ন্যায় সুভগা। তোমার জীবনেও মদন পুনরুজ্জীবিত হইবেন। কল্য তাঁহার মন্দিরে পূজা পাঠাইও।’

লোলা কৃতাঞ্জলি হইয়া বসিয়া রহিল, ভট্টের সকল কথা বুঝিতে পারিল না, কিন্তু অপরিমিত সুখাবেশে তাহার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া গেল। ভট্ট সহাস্যে তাহার মস্তকে একবার হস্তার্পণ করিয়া ত্বরিত পদে সোপান অতিবাহিত করিয়া প্রস্থান করিলেন।

ঘাট হইতে পথে অবতীর্ণ হইয়া তিনি দেখিলেন, পথ পিচ্ছিল, কর্দমপূর্ণ। সম্মুখেই মহাকালের কৃষ্ণপ্রস্তুর-নির্মিত গগনভেদী মন্দির মেঘলোকে চূড়া তুলিয়া আছে। ভট্ট সেইদিকে অগ্রসর হইতেই মন্দির-অভ্যন্তর হইতে ঘোর রবে ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। সন্ধ্যারতির কাল উপস্থিত। মন্দিরের অঙ্গনে বহু লোক আরতি দেখিবার জন্য উপস্থিত হইয়াছে। ভট্ট ভিতরে প্রবেশ করিলেন না, বাহির হইতে বদ্ধাঞ্জলি হইয়া ইষ্টদেবতাকে ভক্তিভরে প্রণাম করিলেন। শঙ্খ-ঘণ্টার রোল চলিতে লাগিল; কালাগুরু ধূপ ও গুগ্গুলের গন্ধ চারিদিকের বায়ুকে সৌরভে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিল।

আরতি শেষ হইলে ভট্ট আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন। অন্ধকার আকাশ হইতে সূক্ষ্ম বারিপতন হইতেছে— রাজপথে লোক নাই। এখন রাত্রি হইয়াছে, অথচ পাষাণ-বনদেবীর হস্তে পথদীপ জ্বলে নাই; মধ্যরাত্রির পূর্বে বনদেবীগণ প্রদীপহস্ত হইবেন না। পথিপার্শ্বের সুবৃহৎ অট্টালিকা-সমূহে বর্তিকা জ্বলিতেছে বটে, কিন্তু তাহা অভ্যন্তর মাত্র আলোকিত করিয়াছে; ক্বচিৎ নাগরিকদিগের বিলাস-কক্ষের মুক্ত গবাক্ষপথে আলোক-রশ্মি ও জাতী কদম্ব কেতকী যূথীর মিশ্র গন্ধ নির্গত হইয়া পথচারীকে গৃহের জন্য উন্মনা করিয়া তুলিতেছে। ভট্ট এই ঈষদালোকিত কর্দম-পিচ্ছিল পুষ্প-সুবাসিত পথ দিয়া সাবধানে চলিতে লাগিলেন।

উজ্জয়িনীর পথ অতিশয় সঙ্কীর্ণ, কোনওমতে দুইটি রথ বা প্রবহন পাশাপাশি চলিতে পারে। পথ ঋজু নহে, সংসর্পিত হইয়া আঁকিয়া-বাঁকিয়া বহু শাখা প্রশাখা বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। ভট্ট হেঁটমুণ্ডে গৃহাভিমুখে চলিতে চলিতে অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছেন— কোনও দিকে লক্ষ্য ছিল না; সহসা একটা মোড় ঘুরিয়া সম্মুখে দীপোদ্ভাসিত প্রাসাদ-তোরণ দেখিয়া তাঁহার চমক ভাঙ্গিল।

তোরণের পশ্চাতে প্রাসাদ, সেখানেও দীপোৎসব। তোরণ-সম্মুখে বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির রথ, দোলা, যানবাহন যাতায়াত করিতেছে। প্রাসাদের অভ্যন্তর হইতে সঙ্গীতের সুমিষ্ট ধ্বনি কানে আসিতেছে। ভট্টের স্মরণ হইল, আজ প্রিয়দর্শিকার গৃহে সমাপানক। স্বয়ং মহামাণ্ডলিক অবন্তীপতি এই সমাপানকে যোগদান করিবেন বলিয়াছেন। ভট্টেরও নিমন্ত্রণ আছে।

ভট্টের মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইয়া উঠিল। কি আশ্চর্য! এ কথাটা তাঁহার এতক্ষণ মনে হয় নাই কেন? তাঁহার নিদারুণ সমস্যার যদি কেহ সমাধান করিতে পারে তো সে ঐ মহাবিদুষী চতুঃযষ্টিকলার পারংগতা অলোকসামান্যা বারবধূ প্রিয়দর্শিকা। তাহার মতো সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিতা অবন্তীরাজ্যে অন্য কে আছে? সত্য কথা বলিতে কি, তাঁহার কাব্যের নিগূঢ় রস ব্যঙ্গোক্তি প্রিয়দর্শিকা যতটা বুঝিবে, এত আর কেহ বুঝিবে না। সে সামান্যা রূপোপজীবিনী নহে— রাজ্যের বারমুখ্যা। স্বয়ং আর্যাবর্তের অধীশ্বর বিক্রমাদিত্য উজ্জয়িনীতে পদার্পণ করিয়াই প্রিয়দর্শিকাকে স্মরণ করেন; শুধু তাহার অলৌকিক রূপযৌবনের জন্য নহে, তাহার অশেষ গুণাবলীর জন্য তাহাকে সম্মান প্রদর্শন করেন। সেই প্রিয়দর্শিকার গৃহে নিমন্ত্রিত হইয়াও তিনি এতক্ষণ ভুলিয়া ছিলেন? ভট্ট সহর্ষে তোরণ অভিমুখে অগ্রসর হইলেন।

কিন্তু তোরণের সমীপবর্তী হইয়া ভট্টের মুখে ঈষৎ উদ্বেগের ছায়া পড়িল। গৃহে ভট্টিনী প্রতীক্ষা করিয়া আছেন; তিনি এসব পছন্দ করেন না। বিশেষত প্রিয়দর্শিকাকে তিনি ঘোর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। দেশে নিন্দুকের অভাব নাই, ভট্টের সহিত প্রিয়দর্শিকার গুপ্ত প্রণয়ের একটা জনশ্রুতি ভট্টিনীর কানে উঠিয়াছে। তদবধি প্রিয়দর্শিকার নাম শুনিলেই তিনি জ্বলিয়া যান। সুতরাং গণ্ডের উপর পিণ্ডের ন্যায় আজ যদি ভট্ট প্রিয়দর্শিকার গৃহে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত যাপন করেন, তাহা হইলে আর রক্ষা থাকিবে না।

তোরণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ভট্ট ইতস্তত করিতেছেন দেখিয়া তোরণপালিকা কিঙ্করীগণ কলকণ্ঠে তাঁহাকে সম্ভাষণ করিল— ‘আসুন কবীন্দ্র। স্বাগত! আসুন পণ্ডিতবর, আর্যা প্রিয়দর্শিকা আপনার জন্য অধীরভাবে প্রতীক্ষা করিতেছেন। আসুন মহাভাগ, আপনার অভাবে নবরত্নমালিকা আজি মধ্যমণিহীন। স্বাগত! শুভাগত!’

দাসীগণ সকলেই যৌবনবতী, রসিকা ও সুন্দরী। তাহাদের কাহারও হস্তে পুষ্পমালা, কাহারও হস্তে জলপূর্ণ ভৃঙ্গার, কেহ বা সুগন্ধি দ্রব্যপূর্ণ স্থালী লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহারা সকল অতিথিকেই মহা সম্মানপূর্বক স্বাগত-সম্ভাষণ করিতেছে; কিন্তু কবিকে দেখিয়া তাহারা যেরূপ সমস্বরে সাহ্লাদে আহ্বান করিল, তাহাতে কবি আর দ্বিধা করিতে পারিলেন না। গৃহের চিন্তা মন হইতে অপসারিত করিয়া হাস্যমুখে তোরণ-পথে প্রবেশ করিলেন।

মর্মর-পট্টের উপর পদার্পণ করিবামাত্র একটি দাসী ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার চরণে  জল ঢালিয়া দিতে লাগিল, অন্য একজন নতজানু হইয়া বসিয়া পদ প্রক্ষালন করিয়া দিল। তৃতীয় দাসী শুভ্র কার্পাস বস্ত্র দিয়া পা মুছাইয়া দিল। কবিকে উজ্জয়িনীর নাগরিক-নাগরিকা যেরূপ ভালবাসিত, এরূপ আর কাহাকেও বাসিত না। তাই তাঁহার সেবা করিবার সৌভাগ্যের জন্য দাসীদের মধ্যে হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল।

গন্ধদ্রব্যের স্থালী হস্তে কবির সম্মুখে দাঁড়াইতেই তিনি অঙ্গুলির প্রান্ত চন্দনে ডুবাইয়া সকৌতুকে তাহার ভ্রূমধ্যে তিলক পরাইয়া দিলেন। সকলে আহ্লাদে হাস্য করিয়া উঠিল। যাহার হাতে পুষ্পমাল্য ছিল, সে আসিয়া তাড়াতাড়ি কবির গলায় যূথীর একটি স্থূল মালা পরাইয়া দিল। কবি তাহাকে ধরিয়া বলিলেন— ‘সুলোচনে, এ কি করিলে? তুমি আমার গলায় মালা দিলে?’

সুলোচনাও বাক্যবিন্যাসে কম নহে, সে কুটিল হাসিয়া উত্তর করিল— ‘কবিবর, এখানে আমরা সকলেই আর্যা প্রিয়দর্শিকার প্রতিনিধি।’

মুখের মতো উত্তর পাইয়া কবি হাসিতে হাসিতে প্রাসাদ অভিমুখে চলিলেন। উদ্যানের মধ্য দিয়া শ্বেত প্রস্তরের পথ, তাহার দুইধারে ধ্যানাসীন মহাদেবের মূর্তি। মূর্তির শীর্ষস্থ জটাজাল হইতে সুগন্ধি বারি উৎসের ন্যায় নিক্ষিপ্ত হইতেছে।

প্রথম মহল নৃত্যশালা। সেখানে প্রবেশ করিয়া কবি দেখিলেন তরুণ নাগরিকদের সভা বসিয়া গিয়াছে। মধ্যস্থলে নর্তকী বাহুবল্লরী বিলোলিত করিয়া অপাঙ্গে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করিয়া কেয়ূর-কিঙ্কিণী মঞ্জীর-শিঞ্জনে অপূর্ব সম্মোহন সৃষ্টি করিয়া রাগ-দীপক নৃত্যে অপ্সরালোকের ভ্রান্তি বহিয়া আনিতেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিপুণ চরণনিক্ষেপের তালে তালে মৃদঙ্গ ও সপ্তস্বরা বাজিতেছে। মৃদঙ্গীর চক্ষু নর্তকীর চরণে নিবদ্ধ; বীণা-বাদকের ললাটে ভ্রূকুটি, চক্ষু মুদিত। অন্য সকলে নর্তকীর অপরূপ লীলা-বিভ্রম দেখিতেছে। সকলেই গুণী রসজ্ঞ— কলা-সঙ্গত বিশুদ্ধ নৃত্য দেখিতে দেখিতে তাহাদের চক্ষু ভাবাতুর। কেহ নড়িতেছে না, মূর্তির মতো বসিয়া দেখিতেছে।

কবি কিছুক্ষণ বসিয়া দেখিলেন, তারপর নিঃশব্দে কক্ষ হইতে নির্গত হইলেন। দ্বিতীয় প্রাসাদ নৃত্যশালার সংলগ্ন, মধ্যে একটি অলিন্দের ব্যবধান। সেখানে গিয়া কবি দেখিলেন, কথা-কাহিনীর আসর বসিয়াছে। বক্তা স্বয়ং বেতালভট্ট। তিনি মণিকুট্টিমের মধ্যস্থলে শঙ্খরচিত কমলাসনে বসিয়াছেন, তাঁহাকে ঘিরিয়া বহু নাগরিক-নাগরিকা করতলে চিবুক রাখিয়া অবহিত হইয়া শুনিতেছে। চষকহস্তা কিঙ্করীগণ পূর্ণ পানপাত্র সম্মুখে ধরিতেছে, কিন্তু কাহারও ভ্রূক্ষেপ নাই। কিঙ্করীরাও পাত্র হস্তে চিত্রার্পিতার ন্যায় গল্প শুনিতেছে।

বেতালভট্ট গম্ভীর কণ্ঠে কহিতেছেন— ‘পিশাচ অট্ট অট্ট হাস্য করিল; কহিল, মহারাজ, এই শ্মশানভূমির উপর আপনার কোনও অধিকার নাই, ইহা আমার রাজ্য। ঐ যে নরমেদঃ-শোণিতলিপ্ত মহাশূল মশানের মধ্যস্থলে প্রোথিত দেখিতেছেন, উহাই আমার রাজদণ্ড।’

কবি আর সেখানে দাঁড়াইলেন না, হাস্য গোপন করিয়া চুপিচুপি নিষ্ক্রান্ত হইলেন। যাইবার পূর্বে সকলের মুখ একবার ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া লইলেন, কিন্তু প্রিয়দর্শিকাকে শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে দেখিতে পাইলেন না।

তৃতীয় প্রাসাদটি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও সুরম্য। সভার ন্যায় সুবিশাল কক্ষ, তাহার চারিদিকে বহুবিধ আসন ও শয্যা বিস্তৃত রহিয়াছে, কেন্দ্রস্থলের মর্মর-কুট্টিম অনাবৃত; তাহার উপর মণিময় অক্ষবাট অঙ্কিত রহিয়াছে। ছাদ হইতে সুবর্ণ শৃঙ্খলে অগণিত দীপ দুলিতেছে, কক্ষ-প্রাচীরে সারি সারি দীপ, উপরন্তু হর্ম্যতলে স্থানে স্থানে স্বর্ণদণ্ডের শীর্ষে সুগন্ধি বর্তিকা জ্বলিতেছে। কক্ষের কোথাও লেশমাত্র অন্ধকার নাই। এই কক্ষের দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া কবির মনে হইল, কক্ষে বুঝি কেহ নাই— এত বিশাল এই কক্ষ যে সেখানে প্রায় ত্রিশজন লোক থাকা সত্ত্বেও উহা শূন্য মনে হইতেছে। সখী ও পরিচারিকাগণ ছায়ার মতো গমনাগমন করিতেছে; তাহাদের নূপুরগুঞ্জনও যেন মৃদু ও অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে।

ঘরের মধ্যস্থলে উপস্থিত হইয়া কবি দেখিলেন, মহারাজা অবন্তীশ্বর বররুচির সহিত অক্ষ-ক্রীড়ায় বসিয়াছেন। তাঁহাদের একপার্শ্বে রত্নখচিত সুরাভৃঙ্গার ও চষক, অন্যপার্শ্বে তাম্বূল-করঙ্ক। দুইজনেই খেলায় নিমগ্ন। কবি গিয়া দাঁড়াইতেই মহারাজ অন্যমনস্কভাবে চক্ষু তুলিয়া পার্ষ্টি ঘষিতে ঘষিতে বলিলেন— ‘কালিদাস? এস বন্ধু, আমার সহায় হও। বররুচি আমার অঙ্গদ জিতিয়া লইয়াছে— এবার কঙ্কণ পণ—’ বলিয়া পার্ষ্টি ফেলিলেন। গজদন্তের পার্ষ্টিতে মরকতের অক্ষি আলোকসম্পাতে ঝলসিয়া উঠিল।

রাজার আহ্বানে কালিদাস বসিলেন। অন্যদিন হইলে নিমেষমধ্যে তিনিও খেলায় মাতিয়া উঠিতেন; কিন্তু আজ তাঁহার মন লাগিল না। বিশেষ ইহারা দুইজনেই খেলায় এত একাগ্র যে, মাঝে মাঝে সূরাপাত্র নিঃশেষ করা ব্যতীত আর কোনও দিকে মন দিতে পারিতেছেন না। কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া কালিদাস উঠিলেন; ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিতে করিতে দেখিলেন, দূরে নীল পক্ষ্মল চীনাংশুকের আস্তরণের উপর প্রিয়দর্শিকা বসিয়া আছে— যেন সরোবরের মাঝখানে একটি মাত্র কমল ফুটিয়াছে। তাহার সম্মুখে বসিয়া একজন পুরুষ হাত নাড়িয়া কি কথা বলিতেছে, পশ্চাৎ হইতে কালিদাস তাহার মুখ দেখিতে পাইলেন না। প্রিয়দর্শিকা কপোলে হস্ত রাখিয়া তাহার কথা শুনিতেছিল। কালিদাস সেইদিকে ফিরিতেই দুইজনের চোখাচোখি হইল। প্রিয়দর্শিকা স্মিত হাসিয়া চোখের ইঙ্গিতে কবিকে ডাকিল।

কবি বুঝিলেন, প্রিয়দর্শিকা বিপদে পড়িয়াছে। তিনি মন্দমন্থর পদে সেই দিকে অগ্রসর হইলেন। নিকটে গিয়া দেখিলেন, যে ব্যক্তি প্রিয়দর্শিকার সহিত কথা কহিতেছে, সে অত্যন্ত পরিচিত— তাহার মুখ শূকরের ন্যায় কদাকার, দেহ রোমশ, মস্তকের কেশ কণ্টকবৎ ঋজু ও উদ্ধত। কবি মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন, কহিলেন— ‘কে ও? বরাহ— না না—মিহিরভট্ট যে! প্রিয়দর্শিকে, জ্যোতির্বিশারদ কি তোমার ভাগ্য-গণনা করিতেছেন?’

বাধাপ্রাপ্ত বরাহমিহির ক্রুদ্ধমুখে কবির দিকে ফিরিলেন। প্রিয়দর্শিকা যেন ইতিপূর্বে কবিকে দেখে নাই, এমনিভাবে তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া করজোড়ে তাঁহাকে প্রণাম করিল। তাহার কর্ণে নীলকান্তমণির অবতংস দুলিয়া উঠিল। কণ্ঠস্বরে মধু ঢালিয়া দিয়া বলিল— ‘কবিবর, স্বাগতোহসি। আপনার পদার্পণে আজ আমার গৃহে পরমোৎসব। আসন গ্রহণ করুন আর্য। — হলা বকুলে, শীঘ্র কবিবরের জন্য পানীয় লইয়া আয়।’

কালিদাস বসিলেন, বলিলেন— ‘আচার্য মিহির, কিসের আলোচনা হইতেছিল? ফলিত জ্যোতিষ? উত্তম কথা, আমার ভাগ্যটা একবার গণনা করিয়া দেখুন তো। সম্প্রতি বড় বিপদে পড়িয়াছি।’

বরাহমিহির মুখে হাসির একটা অনুকৃতি করিয়া বলিলেন— ‘কবি, তুমি এখন বিনাইয়া বিনাইয়া একটা বর্ষা-সংহার কাব্য লেখ গিয়া। এসব কথা তুমি বুঝিবে না।’

পরিচারিকা স্ফটিকপাত্রে আসব লইয়া আসিল, প্রিয়দর্শিকা তাহা স্বহস্তে লইয়া কবিকে দিল। কবি পান করিয়া পাত্র দাসীকে ফিরাইয়া দিলেন, তারপর প্রিয়দর্শিকার হস্ত হইতে তাম্বূল লইয়া বলিলেন— ‘কেন বুঝিব না? জ্যোতিষশাস্ত্রে শক্ত কি আছে? দ্বাদশ রাশি সপ্তবিংশতি নক্ষত্র আর নবগ্রহ— এই লইয়া তো ব্যাপার। ইহাও যদি বুঝিতে না পারি—’

বরাহমিহির কবিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া প্রিয়দর্শিকার দিকে ফিরিয়া অসমাপ্ত বক্তৃতা আবার আরম্ভ করিলেন। বলিলেন— ‘একবার ভাবিয়া দেখ, আমাদের অপৌরুষেয় শাস্ত্রের উপর এই অর্বাচীন যাবনিক বিদ্যা বলাৎকারপূর্বক বসাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ফল কিরূপ বিষময় হইয়াছে তাহা জান কি? অশ্বিন্যাদি বিন্দু পুরা তিন অংশ সরিয়া গিয়াছে।’

বরাহমিহির ক্ষুদ্র রক্তবর্ণ নেত্রে প্রিয়দর্শিকাকে দগ্ধ করিবার উপক্রম করিলেন, যেন এই অপরাধের পরিপূর্ণ দায়িত্ব তাহারই— ‘তিন অংশ! কল্পনা কর— তিন অংশ! ইহার ফলে সমগ্র ভ-চক্র তিন অংশ সরিয়া গিয়াছে। সর্বনাশ হইতে আর বাকি কি? যে সকল গর্ভদাস এই কুকার্য করিয়াছে, তাহারা জানে না যে, আকাশচক্র রথচক্র নয়— উহা চিরস্থির চির-নিরয়ন। এই গ্রহতারামণ্ডিত ব্যোম নিরন্তর ঘূর্ণমান হইয়াও অচল গতিহীন—’

কালিদাস হাসিয়া উঠিলেন; দেখিলেন, বরাহ আজ যেরূপ ক্ষেপিয়াছে, সহজে উহার কবল হইতে প্রিয়দর্শিকাকে উদ্ধার করা যাইবে না। তিনি উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন— ‘মিহিরভট্ট, ওটা আপনার ভুল। আকাশচক্র সত্যই রথচক্র— মহাকালের নিঃশব্দ ঘর্ঘরহীন রথচক্র। উহা নিরন্তর ঘুরিতেছে এবং সেই সঙ্গে আমরাও ঘুরিতেছি।’

বরাহ কবির দিকে কেবল একটা কষায়িত নেত্রপাত করিয়া আবার কহিতে লাগিলেন— “শুধু কি তাই! এই দ্বাদশ রাশির অভিযানের ফলে ফলিত জ্যোতিষ একেবারে লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছে! অভিজিৎ আজ কোথায়? অভিজিৎকে ছাগমুণ্ড করিয়া তাহার গলা কাটিয়া তাহাকে নক্ষত্রলোক হইতে নির্বাসিত করা হইয়াছে! দ্বাদশ রাশিকে সুতন্ত্রিত করিবার জন্য অষ্টবিংশতি নক্ষত্র এখন সপ্তবিংশতি হইয়াছে। দু’দিন পরে অভিজিতের নাম পর্যন্ত লোকে ভুলিয়া যাইবে— জ্যোতিঃশাস্ত্র মূর্খের দ্বারা লাঞ্ছিত অবজ্ঞাত হইবে—’

শুনিতে শুনিতে কবি অন্যত্র প্রস্থান করিলেন। প্রিয়দর্শিকা তাঁহার প্রতি একবার করুণ-কটাক্ষ নিক্ষেপ করিল; কিন্তু উপায় নাই। দৈত্য কর্তৃক আক্রান্ত উর্বশীকে পুরুরবা উদ্ধার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু এ দৈত্য অবধ্য। বিমর্ষভাবে চিন্তা করিতে করিতে কবি কক্ষে ইতস্তত ঘূরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। রাত্রিও ক্রমে গভীর হইতেছে; কবি ভাবিলেন, আজ আর কিছু হইল না, গৃহে ফিরি। এই সময় তাঁহার দৃষ্টি পড়িল কক্ষের দূর কোণ হইতে একব্যক্তি হস্ত-সঙ্কেতে তাঁহাকে ডাকিতেছে। লোকটি বোধ হয় কিছু অধিক মাত্রায় মাদক-সেবা করিয়াছে, কারণ সে আসন হইতে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু পারিতেছে না এবং যতই উঠিতে অসমর্থ হইতেছে, ততই আর এক চষক পান করিয়া শক্তি সংগ্রহে যত্নবান হইতেছে। তিনজন গূঢ়হাস্যমুখী দাসী তাহার আসব যোগাইতেছে।

লোকটি বৃদ্ধ, কিন্তু বেশভূষা নবীন নাগরিকের ন্যায়। দেহটি স্থূল, মুখ বর্তুলাকার ও লোলমাংস; কিন্তু অতি যত্ন সহকারে অঙ্গ-সংস্কার করা হইয়াছে। চক্ষে কজ্জল, কর্ণে সুবর্ণ কুণ্ডল, কণ্ঠে মুক্তাহার, রোমশ দেহে পত্রচ্ছেদ্য— নব যুবক সাজিবার কোনও কৌশলই পরিত্যক্ত হয় নাই। কালিদাস তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি চক্ষু তুলিয়াই সহসা কাঁদিয়া ফেলিলেন। দাসীরা মুখ ফিরাইয়া হাসিল।

কালিদাস বৃদ্ধের পাশে বসিয়া উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করিলেন— ‘বটু, কি হইয়াছে? এত কাতর কেন?’

চক্ষু মার্জনা করিয়া বৃদ্ধ স্খলিত বচনে কহিলেন— ‘বরাহমিহির একটা ষণ্ড!’

সমবেদনাপূর্ণ হৃদয়ে কালিদাস বলিলেন— ‘সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু কি হইয়াছে?”

বৃদ্ধ পুনশ্চ বলিলেন— ‘বরাহমিহির একটা বৃষ!’

কবি বলিলেন— ‘বটু, এ বিষয়ে আমি তোমার সহিত একমত। কিন্তু ব্যাপার কি— বৃষটা করিয়াছে কি?’

ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধ আবার আরম্ভ করিলেন— ‘বরাহমিহির একটা—’

‘বলীবর্দ!’ কবি বৃদ্ধের পৃষ্ঠে হাত রাখিয়া বলিলেন— ‘উক্ষা ভদ্রো বলীবর্দঃ ঋষভো বৃষভো বৃষঃ’ আমার কণ্ঠস্থ আছে— সুতরাং আবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। এখন বলীবর্দটার দুস্কৃতি সম্বন্ধে সবিশেষ জানিতে পারিলে নিশ্চিন্ত হইতে পারি।’

বৃদ্ধ আর এক চষক মদ্য পান করিলেন, তারপর কহিলেন— ‘কালিদাস, তুমি আমার প্রাণাধিক বয়স্য, তোমার সঙ্গে শৈশবে একসঙ্গে খেলা করিয়াছি, তোমার কাছে আমার গোপনীয় কিছুই নাই। আমি প্রিয়দর্শিকার প্রেমে মজিয়াছি।’— এইখানে বৃদ্ধ আর এক চষক পান করিলেন— ‘তাহাকে যে কতবার কত মদনালঙ্কার উপহার দিয়াছি, কত সঙ্কেত জানাইয়াছি, তাহার ইয়াত্ত নাই। কিন্তু দুষ্টা আমাকে দেখিলেই ‘তাত’ বলিয়া সম্বোধন করে— এমন ছলনা দেখায় যেন আমার মনের ভাব বুঝিতেই পারে নাই!— আজি আমি সঙ্কল্প করিয়া আসিয়াছিলাম যে, প্রিয়দর্শিকার চরণে আত্মনিবেদন করিব— কোনও ছল-চাতুরী শুনিব না। কিন্তু আসিয়াই দেখিলাম, ঐ বরাহটা উহাকে কর-কবলিত করিয়াছে। সেই অবধি কেবলই সুযোগ খুঁজিতেছি, কিন্তু শূকরটা কিছুতেই উহার সঙ্গ ছাড়িতেছে না।’ বলিয়া সুরাবিহ্বল নেত্রে যতদূর সম্ভব বিদ্বেষ-সঞ্চার করিয়া যেখানে বরাহমিহির বসিয়া ছিলেন, সেইদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।

প্রবল হাস্যোচ্ছ্বাস দমন করিয়া কালিদাস কহিলেন— ‘বটু, তোমার বুদ্ধিভ্রংশ হইয়াছে— প্রিয়দর্শিকার প্রতি প্রেমসঞ্চার তোমার পক্ষে অতীব গর্হিত। তুমি বালকমাত্র— প্রিয়দর্শিকা বর্ষীয়সী,— তাহার সহিত তোমার প্রণয় কদাপি যুক্তিযুক্ত নয়। তুমি বরঞ্চ তোমার বয়সোপযোগিনী কোনও কুমারী কন্যার প্রতি আসক্ত হও।’

বৃদ্ধ বিবেচনা করিয়া বলিলেন — ‘সে কথা যথার্থ। কিন্তু আমি প্রিয়দর্শিকাকে মনপ্রাণ সমর্পণ করিয়া ফেলিয়াছি, এখন আর ফিরাইয়া লইতে পারি না।’ তারপর কালিদাসের হস্ত ধারণ করিয়া কাতরভাবে বলিলেন— ‘কালিদাস, তুমি আমার সখা, আজ সখার কার্য কর, ঐ শূকরটাকে প্রিয়দর্শিকার নিকট হইতে খেদাইয়া দাও। নতুবা বন্ধুহত্যার পাপ তোমাকে স্পর্শ করিবে।’

অকস্মাৎ একটা কূটবুদ্ধি কালিদাসের মাথায় খেলিয়া গেল। ঠিক হইয়াছে— কণ্টকেনৈব কণ্টকম্! তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘শুধু প্রিয়দর্শিকার নিকট হইতে খেদাইয়া দিলেই হইবে? আর কিছু চাহ না?’

‘আর কিছু চাহি না।’

‘ভাল, চেষ্টা করিয়া দেখি।’ কালিদাস উঠিলেন। কিছু দূর গিয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন— ‘একটা কথা। বটু, পৃথিবীর আহ্নিক গতি আছে, এ কথা তুমি বিশ্বাস কর?’

বৃদ্ধ বলিলেন — ‘পৃথিবীর আহ্নিক গতি থাক্ বা না থাক্ —’

কালিদাস বলিলেন— ‘না না, ওটা একান্ত আবশ্যক! বরাহমিহির আহ্নিক গতিতে বিশ্বাস করেন না।’

নিজের ঊরুর উপর প্রচণ্ড চপেটাঘাত করিয়া বটুক বলিলেন— ‘তবে আমি বিশ্বাস করি। মুক্তকণ্ঠে কহিতেছি —’

কবি হাসিয়া বলিলেন— ‘থাক, উহাতেই হইবে। একেবারে মিথ্যা বলিতে চাহি না।’

বরাহমিহির তখন নিজের বাগ্নিতায় মাতিয়া উঠিয়াছেন; কালিদাস তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া দুঃখিতভাবে মস্তক আন্দোলন করিয়া কহিলেন— ‘আর্য মিহিরভট্ট, বড়ই দুঃসংবাদ শুনিতেছি।’

বরাহমিহির বাক্যস্রোত সম্বরণ করিয়া কহিলেন— ‘কি হইয়াছে?’

কালিদাস উপবেশন করিয়া বলিলেন— ‘এতক্ষণ তাত অমরসিংহের সহিত কথা হইতেছিল। তিনি বলিলেন, আর্যভট্টের মীমাংসাই সত্য; পৃথিবীর আহ্নিক গতি আছে।’

মিহিরভট্ট শূকর-দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া সক্রোধে বলিলেন— ‘অমরসিংহ একটা নখদন্তহীন বৃদ্ধ ভল্লুক, তাহার বুদ্ধি লোপ পাইয়াছে।’

কালিদাস কহিলেন— ‘তিনি বলিতেছেন যে, ‘আহ্নিক’ নামে একটি নূতন শব্দ শীঘ্রই  অমরকোষে সংযোজিত করিবেন। তাহাতে আর্যভট্টের মীমাংসাই—’

মিহিরভট্ট আর স্থির থাকিতে পারিলেন না, অর্ধরুদ্ধ একটি গর্জন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তারপর— ‘জড়বুদ্ধি জরদ্গব।’ ‘শৌণ্ড’ ‘উন্মাদ’ ইত্যাদি কটূক্তি করিতে করিতে অমরসিংহের অভিমুখে ধাবিত হইলেন।

প্রিয়দর্শিকা ও কালিদাস পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিলেন। এই বারাঙ্গনা ও কবির মধ্যে এমন একটি অন্তর্গূঢ় পরিচয় ছিল যে, একে অন্যের মুখের দিকে চাহিয়াই তাহার মনের অন্তরতম কথাটি জানিতে পারিতেন। আজ কবির চিত্ত কোনও কারণে উৎক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহা প্রিয়দর্শিকা বুঝিয়াছিল। কিন্তু সে সে-কথা না বলিয়া শ্রদ্ধাবিগলিত অস্ফুট কাকলিতে কহিল— ‘কবি, অবলার দুঃখমোচনে যদি পুণ্য থাকে, তবে সে পুণ্য আপনার।—কিন্তু ওদিকে যে গজকূর্মের যুদ্ধ বাধিল বলিয়া।’

কবি প্রাণে এক অপরূপ শান্তি অনুভব করিতে লাগিলেন। কেবলমাত্র এই নারীর সাহচর্যই যেন তাঁহাকে প্রসন্ন করিয়া তুলিল। তিনি শয্যার উপর অর্ধশায়িত হইয়া প্রিয়দর্শিকার দিকে চাহিয়া রহিলেন। প্রিয়দর্শিকা তাঁহার বাহুর নিম্নে সযত্নে একটি উপাধান ন্যস্ত করিয়া দিল।

কিছুক্ষণ দুইজনে মুখোমুখি বসিয়া রহিলেন। কবির চোখে প্রশান্ত নিস্তরঙ্গ শান্তি, — প্রিয়দর্শিকা কিছু বিচলিত।

তারপর প্রিয়দর্শিকা চক্ষু নত করিল; তাম্বূল-করঙ্ক কবির সম্মুখে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল— ‘ভট্টিনীর সংবাদ কি?’

কবি ঈষৎ চমকিত হইয়া তাম্বূল লইলেন, ভ্রূ একটু কুঞ্চিত হইল, বলিলেন— ‘ভট্টিনী? সংবাদ কিছু নাই, তিনি গৃহে আছেন।’

একটা দুঃসহ ক্ষোভের ছায়া প্রিয়দর্শিকার মুখের উপর দিয়া বহিয়া গেল। কিন্তু তাহা নিমেষকালের জন্য। সে হাস্যমুখেই বলিল— ‘হায় কবি, এই সপ্তসাগরা পৃথিবী তোমার গুণে পাগল, কিন্তু তোমার গৃহিণী তোমাকে চিনিলেন না।’

বিস্ময়ে ভ্রূ তুলিয়া কালিদাস বলিলেন— ‘চিনিলেন না। কিন্তু তিনি তো আমাকে —’

প্রিয়দর্শিকা পূর্ণদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া ব্যথা-বিদ্ধ কণ্ঠে কহিল— ‘আমি সব জানি কবি, আমার কাছে কোনও কথা গোপন করিবার চেষ্টা করিও না।’ তারপর মুহূর্তমধ্যে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করিয়া চটুল স্বরে বলিল— ‘কিন্তু থাক্‌ ও কথা। আজ কবির ললাটে চিন্তারেখা দেখিতেছি কেন? যে কাব্য শেষ হইতে আর দেরি নাই বলিয়া সকলকে আশ্বাস দিয়া রাখিয়াছেন, তাহা কি এখনও শেষ হয় নাই?’

কালিদাস উঠিয়া বলিলেন— ‘প্রিয়দর্শিকে, বড়ই বিপদে পড়িয়াছি,— গত তিন রাত্রি হইতে আমার নিদ্রা নাই। তোমার পরামর্শ চাহি।’

বিস্মিতা প্রিয়দর্শিকা বলিল— ‘কি ঘটিয়াছে?’

কালিদাস বলিলেন— ‘আমি যে কাব্য লিখিতেছি, তাহারই সংক্রান্ত ব্যাপার— অনেক ভাবিয়াও কিছু স্থির করিতে পারিতেছি না। তোমাকে উপদেশ দিতে হইবে।’

আনন্দে প্রিয়দর্শিকার মুখ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, বাষ্পাচ্ছন্ন নেত্রে সে বলিল — ‘কবি, আপনি রসের অমরাবতীতে বিজয়ী বাসব, কল্পনার ধ্যানলোকে আপনি শূলপাণি, আমি আপনাকে উপদেশ দিব? আমাকে লজ্জা দিবেন না।’

প্রিয়দর্শিকার জানুতে করাঙ্গুলি স্পর্শ করিয়া কবি কহিলেন — ‘প্রিয়দর্শিকে, অবন্তীরাজ্যে যদি প্রকৃত রসের বোদ্ধা কেহ থাকে তো সে তুমি — এ কথা অকপটে কহিলাম। আর সকলে পল্লবগ্রাহী, মধুর শব্দে মুগ্ধ, বাহ্য সৌন্দর্যে আকৃষ্ট; রসের অতলে কেবল তুমিই ডুবিতে পারিয়াছ। তুমি ভাগ্যবতী।’

সজলনেত্রে যুক্তপাণি হইয়া প্রিয়দর্শিকা বলিল— ‘কবিবর, আমি সত্যই ভাগ্যবতী। কিন্তু কি আপনার সমস্যা, শুনি। কাব্য কি শেষ হয় নাই?’

কবি বলিলেন— ‘কাব্য শেষ হইয়াছে কি না, তাহা বুঝিতে পারিতেছি না।’

বিস্ময়-কৌতূহল-মিশ্রিত স্বরে প্রিয়দর্শিকা বলিল— ‘কাব্য শেষ হইয়াছে কি না বুঝিতে পারিতেছেন না? এ তো বড় অদ্ভুত কথা!’

কালিদাস আরও নিকটে সরিয়া আসিয়া আগ্রহে বলিতে লাগিলেন— ‘এ পর্যন্ত অন্য কাহাকেও বলি নাই, তোমাকে প্রথম বলিতেছি, শুন। আমার কাব্যের নাম কুমারসম্ভব। স্বয়ং মহেশ্বর এই কাব্যের নায়ক— পার্বতী নায়িকা। কাব্যের বিষয় এইরূপ— তারকাসুরের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হইয়া দেবগণ ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হইলেন। ব্রহ্মা কহিলেন, মহাদেবের ঔরসে স্কন্দ জন্মগ্রহণ করিয়া তারকাসুরকে সংহার করিবেন। সতীর দেহত্যাগের পর শঙ্কর তখন ধ্যানমগ্ন; ও-দিকে সতী হিমালয় গৃহে উমা হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। উমা যৌবনপ্রাপ্ত হইয়া হরের পরিচর্যার জন্য তাঁহার তপোভূমিতে উপস্থিত হইলেন। হরের তপস্যা কিন্তু ভাঙ্গে না। তখন দেবগণ মদনকে তপস্যা ভঙ্গের জন্য পাঠাইলেন। মদন তপোভঙ্গ করিলেন বটে, কিন্তু স্বয়ং হরনেত্রজন্মা বহ্নিতে ভস্মীভূত হইলেন। মহাদেব তপোভূমি ত্যাগ করিয়া গেলেন। ভগ্নহৃদয়া উমা তখন পতিলাভার্থে কঠোর তপশ্চর্যা আরম্ভ করিলেন। ক্রমে মহেশ্বর প্রীত হইয়া উমার নিকট ফিরিয়া আসিলেন; তারপর উভয়ের বিবাহ হইল।’

এই পর্যন্ত বলিয়া কবি থামিলেন। প্রিয়দর্শিকা তন্ময় হইয়া শুনিতেছিল, মুখ তুলিয়া চাহিল।

কবি বলিলেন— ‘সপ্তম সর্গে আমি হরপার্বতীর বিবাহ দিয়াছি। বধূর সলজ্জ মুখে হাসি ফুটিয়াছে— কন্দর্প পুনরুজ্জীবিত হইয়াছে।  কুমারসম্ভব কাব্যের যাহা প্রতিপাদ্য, তাহা প্রতিপন্ন হইয়াছে। সুতরাং কাব্যকলা-সঙ্গত ন্যায়ে কাব্য শেষ হইয়াছে— যথার্থ কি না?’

প্রিয়দর্শিকা উত্তর করিল না, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কবির প্রতি চাহিয়া রহিল। ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া কবি বলিলেন— ‘আমিও বুঝিতেছি যে শাস্ত্রমতে কাব্য এইখানেই সমাপ্ত হওয়া উচিত! তথাপি মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জাগিয়াছে।’

‘কিসের সন্দেহ?’

‘মনে হইতেছে যেন কাব্য সম্পূর্ণ হইল না। উমা-মহেশ্বরের পূর্বরাগ ও বিবাহ বর্ণনা করিলাম বটে, কিন্তু তবু কাব্যের মূল কথাটি অকথিত রহিয়া গেল। প্রিয়দর্শিকে, তোমার কি মনে হয়? দেবদম্পতির বিবাহোত্তর জীবন চিত্রিত করা কি কাব্যকলা-সঙ্গত হইবে?’

প্রিয়দর্শিকা বলিল— ‘অলঙ্কার-শাস্ত্রমতে হইবে না। প্রথমত বিষয়াতিরিক্ত বর্ণনা বাগ্‌বাহুল্য বলিয়া বিবেচিত হইবে। দ্বিতীয়ত জগৎপিতা ও জগন্মাতার দাম্পত্যজীবন-বর্ণনা অতিশয় গর্হিত বলিয়া নিন্দিত হইবে।’

কবি জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘তবে তোমার মতে বিবাহ দিয়াই কাব্য শেষ করা কর্তব্য?’

প্রিয়দর্শিকা দীর্ঘকাল করতলে কপোল রাখিয়া বসিয়া রহিল। অবশেষে বলিল— ‘কবি, কাব্যশাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়। সত্যের অনুজ্ঞায় সকলেই শাস্ত্র লঙ্ঘন করিতে পারে, তাহাতে বাধা নাই।’

কবি বলিলেন— ‘কিন্তু এ ক্ষেত্রে সত্য কাহাকে বলিতেছ?’

প্রিয়দর্শিকা বলিল— ‘হরপার্বতীর মিলনই সত্য।’

কবি বলিলেন— ‘তাহাই যদি হয় তবে সে সত্য তো পালিত হইয়াছে।’

‘হইয়াছে কি?’

‘হয় নাই?’

‘তাহা আমি বলিতে পারিব না; উহা কবির অন্তরের কথা।’

কবি কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘আমার অন্তরের কথা আমি বুঝিতে পারিতেছি না— তাই এই সংশয়। তোমার অভিমত কি বল।’

প্রিয়দর্শিকা মৃদু হাস্য করিয়া বলিল— ‘আমার অভিমত শুনিবেনই?’

‘হ্যাঁ।’

‘না শুনিয়া নিরস্ত হইবেন না?’

‘না।’

‘ভাল। আজ আপনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করুন— রাত্রি গভীর হইয়াছে। কাল প্রাতে যদি আপনার মনে কোনও সংশয় থাকে, আমার অভিমত জানাইব।’ — বলিয়া প্রিয়দর্শিকা উঠিয়া দাঁড়াইল।

কবি ঈষৎ নিরাশ হইলেন, কিন্তু মুখে কিছু বলিলেন না। প্রিয়দর্শিকা তোরণদ্বার পর্যন্ত তাঁহার সঙ্গে আসিল। বিদায়কালে কবি বলিলেন— ‘চলিলাম। মিহিরভট্ট ও অমরসিংহ হইতে দূরে দূরে থাকিও। আর কথাটা চিন্তা করিয়া দেখিও।’ দুইজনের চোখে চোখে স্মিতহাস্য বিনিময় হইল।

প্রিয়দর্শিকা বলিল— ‘দেখিব।’

কবি যখন নিজ গৃহদ্বারে পৌঁছিলেন, তখন রাত্রি তৃতীয় প্রহর। দ্বার ভিতর হইতে অর্গলবদ্ধ— অন্ধকার। কবি উৎকর্ণ হইয়া শুনিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনও শব্দ পাইলেন না। বোধ হয় সকলে নিদ্রিত।

তিনি কবাটে করাঘাত করিলেন।

ভিতর হইতে কণ্ঠস্বর শুনা গেল— ‘কে?’

কবি কুণ্ঠিতস্বরে উত্তর করিলেন— ‘আমি— কালিদাস।’

গৃহের কবাট খুলিল— কবি সভয়ে দেখিলেন প্রদীপ হস্তে স্বয়ং গৃহিণী!

গৃহিণী কহিলেন— ‘আসিয়াছ? এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে?’

গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া কবি ক্ষুব্ধস্বরে কহিলেন— ‘প্রিয়ে, তুমি এতক্ষণ জাগিয়া আছ কেন? দাসীকে বলিলেই তো—’

কবিপত্নী কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে?’

সঙ্কুচিত হইয়া কবি কহিলেন— ‘সমাপানকে গিয়াছিলাম—’

কবিপত্নীর অবরুদ্ধ ক্রোধ এতক্ষণে ফাটিয়া পড়িল, তিনি প্রজ্বলিত নেত্রে কহিলেন— ‘প্রিয়দর্শিকার গৃহে গিয়াছিলে! বল বল, লজ্জা কি? কেহ নিন্দা করিবে না। তুমি মহাপণ্ডিত, তুমি সভাকবি, তুমি ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ— বেশ্যালয়ে রাত্রিযাপন করিয়াছ, তাহাতে আর লজ্জা কি?’

‘প্রিয়ে—’

‘ধিক্‌! আমাকে প্রিয়সম্বোধন করিতে তোমার কুণ্ঠা হয় না? কে তোমার প্রিয়া? আমি— না ঐ সহস্রভোগ্যা পথকুক্কুরী প্রিয়দর্শিকা?’

কবি নিরুত্তর দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাঁহার নীরবতা কবিপত্নীর ক্রোধে ঘৃতাহুতি দিল— ‘ধিক্‌ মিথ্যাচারী! ধিক্‌ লম্পট! কি জন্য রাত্রিশেষে গৃহে আসিয়াছ? বেশ্যার উচ্ছিষ্টভোগীকে স্পর্শ করিলে কুলাঙ্গনাকে স্নান করিয়া শুচি হইতে হয়! যাও— গৃহে তোমার কি প্রয়োজন? যেখানে এতক্ষণ ছিলে, সেইখানেই ফিরিয়া যাও!’ — এই বলিয়া কবিপত্নী শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া সশব্দে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন।

অন্ধকারে কবি নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। এই তাঁহার গৃহ! এই তাঁহার ভার্যা! গৃহিণী সচিব সখী প্রিয়শিষ্যা! গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কবি ফিরিলেন। যে ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে বসিয়া কাব্য-রচনা করিতেন সেই প্রকোষ্ঠে গিয়া দীপ জ্বালিলেন।

মৃগচর্ম বিছাইয়া উপবেশন করিতেই অদূরে কাষ্ঠাসনে রক্ষিত কুমারসম্ভবের বৃহৎ পুঁথির উপর দৃষ্টি পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎচমকের ন্যায় আকস্মিক প্রভা তাঁহার মস্তিষ্কের মধ্যে খেলিয়া গেল। প্রিয়দর্শিকা ঠিক বুঝিয়াছিল। সে বলিয়াছিল— ‘কাল প্রাতে যদি কোনও সংশয় থাকে—।’ না, তাঁহার মনে আর লেশমাত্র সংশয় নাই। পত্নীর সহিত সাক্ষাতের সঙ্গে সঙ্গে সংশয়ের অন্ধকার কাটিয়া গিয়াছে।

কালিদাস উঠিলেন। প্রদীপদণ্ড আনিয়া আসনপার্শ্বে রাখিলেন, কাষ্ঠাসন-সমেত পুঁথি সম্মুখে স্থাপন করিলেন। মসীপাত্র, লেখনী ও তালপত্র পাড়িয়া আবার আসিয়া বসিলেন।

ক্রমে তাঁহার মুখের ভাব স্বপ্নাচ্ছন্ন হইল। লেখনী মুষ্টিতে লইয়া তালপত্রের উপর পরীক্ষা করিলেন, তারপর ধীরে ধীরে লিখিলেন— ‘অষ্টমঃ সর্গঃ।’

এই পর্যন্ত লিখিয়া অতি দীর্ঘকাল দৃষ্টিহীন নয়নে গবাক্ষের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বাহিরে তামসী রাত্রি, টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। কিন্তু কবির মানসপটে যে চিত্রগুলি একে একে ভাসিয়া উঠিতে লাগিল, তাহা বসন্তের গন্ধে বর্ণে কাকলিতে সমাকুল— বর্ষা রজনীর শ্যামসজল ছায়া তাহার অম্লান দীপ্তিকে স্পর্শ করিতে পারিল না।

সহসা অবনত হইয়া কবি লিখিতে আরম্ভ করিলেন, শরের লেখনী তালপত্রের উপর শব্দ করিয়া চলিতে লাগিল— ‘পাণিপীড়নবিধেরনন্তরম্‌—’

৩০ আষাঢ় ১৩৪০