শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

চন্দন-মূর্তি

বৌদ্ধ ভিক্ষু বলিতে যে-চিত্রটি আমাদের মনে উদয় হয়, একালের সাধারণ বাঙালীর চেহারার সঙ্গে সে-চিত্রের মোটেই মিল নাই। অথচ, যাঁহার কথা আজ লিখিতে বসিয়াছি সেই ভিক্ষু অভিরাম যে কেবল জাতিতে বাঙালী ছিলেন তাহাই নয়, তাঁহার চেহারাও ছিল নিতান্তই বাঙালীর মতো।

আরম্ভেই বলিয়া রাখা ভাল যে ভিক্ষু অভিরামের আগাগোড়া জীবন-বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করা আমার অভিপ্রায় নয়, থাকিলেও তাহা সম্ভব হইত না। তাঁহার বংশ বা জাতি-পরিচয় কখনও শুনি নাই, তিনি বাঙালী হইয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গণ্ডীতে কি করিয়া গিয়া পড়িলেন সে ইতিহাসও আমার কাছে অজ্ঞাত রহিয়া গিয়াছে। কেবল এক বৎসরের আলাপে তাঁহার চরিত্রের যে-পরিচয়টি আমি পাইয়াছিলাম এবং একদিন অচিন্তনীয় অবস্থার মধ্যে পড়িয়া কিরূপে সেই পরিচয়ের বন্ধন চিরদিনের জন্য ছিন্ন হইয়া গেল, তাহাই সংক্ষেপে বাহুল্য বর্জন করিয়া পাঠকের সম্মুখে স্থাপন করিব। আমাদের দেশ ধর্মোম্মত্ততার মল্লভূমি, ধর্মের নামে মাথা ফাটাফাটি অনেক দেখিয়াছি। কিন্তু ভিক্ষু অভিরামের হৃদয়ে এই ধর্মানুরাগ যে বিচিত্র রূপ গ্রহণ করিয়াছিল তাহা পূর্বে কখনও দেখি নাই এবং পরে যে আর দেখিব সে সম্ভাবনাও অল্প।

ভিক্ষু অভিরামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ইম্পীরিয়াল লাইব্রেরিতে। বছর-চারেক আগেকার কথা, তখন আমি সবেমাত্র বৌদ্ধ যুগের ইতিহাস লইয়া নাড়াচাড়া আরম্ভ করিয়াছি। একখানা দুষ্প্রাপ্য বৌদ্ধ পুস্তক খুঁজিতে গিয়া দেখিলাম তিনি পূর্ব হইতে সেখানা দখল করিয়া বসিয়া আছেন।

ক্রমে তাঁহার সহিত আলাপ হইল। শীর্ণকায় মুণ্ডিতশির লোকটি, দেহের বস্ত্রাদি ঈষৎ পীতবর্ণ, বয়স বোধ করি চল্লিশের নীচেই। কথাবার্তা খুব মিষ্ট, হাসিটি শীর্ণ মুখে লাগিয়াই আছে; আমাদের দেশের সাধারণ উদাসী সম্প্রদায়ের মতো একটি নির্লিপ্ত অনাসক্ত ভাব। তবু তাঁহাকে সাধারণ বলিয়া অবহেলা করা যায় না। চোখের মধ্যে ভাল করিয়া দৃষ্টিপাত করিলেই বুঝিতে পারা যায়, একটা প্রবল দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা সদাসর্বদা সেখানে জ্বলিতেছে। জটা কৌপীন কিছুই নাই; তথাপি তাঁহাকে দেখিয়া রবীন্দ্রনাথের ‘পরশপাথরে’র সেই ক্ষ্যাপাকে মনে পড়িয়া যায়—

ওষ্ঠে অধরেতে চাপি                অন্তরের দ্বার ঝাঁপি

রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে।

দুটো নেত্র সদা যেন                নিশার খদ্যোত-হেন

উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে।

বাঙালী বৌদ্ধ ভিক্ষু বর্তমান কালে থাকিতে পারে এ কল্পনা পূর্বে মনে স্থান পায় নাই, তাই প্রথম দর্শনেই তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছিলাম। ক্রমশ আলাপ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হইল। তিনি সময়ে অসময়ে আমার বাড়িতে আসিতে আরম্ভ করিলেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রে তাঁহার জ্ঞান যেরূপ গভীর ছিল, বৌদ্ধ ইতিহাসে ততটা ছিল না। তাই বুদ্ধের জীবন সম্বন্ধে কোনও নূতন কথা জানিতে পারিলে তৎক্ষণাৎ আমাকে আসিয়া জানাইতেন। আমার ঐতিহাসিক গবেষণা সম্বন্ধেও তাঁহার ঔৎসুক্যের অন্ত ছিল না; ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থির হইয়া বসিয়া আমার বক্তৃতা শুনিয়া যাইতেন, আর তাঁহার চোখে সেই খদ্যোত-আলোক জ্বলিতে থাকিত।

খাদ্যাদি বিষয়ে তাঁহার কোনও বিচার ছিল না। আমার বাড়িতে আসিলে গৃহিণী প্রায় ভক্তিভরে তাঁহাকে খাওয়াইতেন; তিনি নির্বিবাদে মাছ মাংস সবই গ্রহণ করিতেন। আমি একদিন প্রশ্ন করায় তিনি ক্ষীণ হাসিয়া বলিয়াছিলেন, ‘আমি ভিক্ষু, ভিক্ষাপাত্রে যে যা দেবে তাই আমাকে খেতে হবে, বাছ-বিচার করবার তো আমার অধিকার নেই। তথাগতের পাতে একদিন তাঁর এক শিষ্য শূকর-মাংস দিয়েছিল, তিনি তাও খেয়েছিলেন।’ ভিক্ষুর দুই চক্ষু সহসা জলে ভরিয়া গিয়াছিল।

প্রায় ছয়-সাত মাস কাটিয়া যাইবার পর একদিন তাঁহার প্রাণের অন্তরতম কথাটি জানিতে পরিলাম। আমার বাড়িতে বসিয়া বৌদ্ধ শিল্প আলোচনা হইতেছিল। ভিক্ষু অভিরাম বলিতেছিলেন, ‘ভারতে এবং ভারতের বাইরে কোটি কোটি বুদ্ধমূর্তি আছে। কিন্তু সবগুলিই তাঁর ভাব-মূর্তি। ভক্ত-শিল্পী যে-ভাবে ভগবান তথাগতকে কল্পনা করেছে, পাথর কেটে তাঁর সেই মূর্তিই গড়েছে। বুদ্ধের সত্যিকার আকৃতির সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না।’

আমি বলিলাম, ‘আমার তো মনে হয়, ছিল। আপনি লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয় যে, সব বুদ্ধমূর্তিরই ছাঁচ প্রায় এক রকম। অবশ্য অল্পবিস্তর তফাৎ আছে, কিন্তু মোটের উপর একটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়— কান বড়, মাথায় কোঁকড়া চুল, ভারী গড়ন— এগুলো সব মূর্তিতেই আছে। এর কারণ কি? নিশ্চয় তাঁর প্রকৃত চেহারা সম্বন্ধে শিল্পীদের জ্ঞান ছিল, নইলে কেবল কাল্পনিক মূর্তি হলে এতটা সাদৃশ্য আসতে পারত না। একটা বাস্তব মডেল তাদের ছিলই।’

গভীর মনঃসংযোগে আমার কথা শুনিয়া ভিক্ষু অভিরাম কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘কি জানি। বুদ্ধদেবের জীবিতকালে তাঁর মূর্তি গঠিত হয়নি, তখন ভাস্কর্যের প্রচলন ছিল না। বুদ্ধমূর্তির বহুল প্রচলন হয়েছে গুপ্ত-যুগ থেকে, খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে, অর্থাৎ বুদ্ধ-নির্বাণের প্রায় সাত-শ’ বছর পরে। এই সাত-শ’ বছর ধরে তাঁর আকৃতির স্মৃতি মানুষ কি করে সঞ্জীবিত রেখেছিল? বৌদ্ধ শাস্ত্রেও তাঁর চেহারার এমন কোনও বর্ণনা নেই যা থেকে তাঁর একটা স্পষ্ট চিত্র আঁকা যেতে পারে। আপনি যে সাদৃশ্যের কথা বলছেন, সেটা সম্ভবত শিল্পের একটা কনভেনশ্যন— প্রথমে একজন প্রতিভাবান্‌ শিল্পী তাঁর ভাব-মূর্তি গড়েছিলেন, তারপর যুগপরম্পরায় সেই মূর্তিরই অনুকরণ হয়ে আসছে।’ ভিক্ষু একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন, ‘না— তাঁর সত্যিকার চেহারা মানুষ ভুলে গেছে। — টুটেনখামেন আমেন-হোটেপের শিলা-মূর্তি আছে, কিন্তু বোধিসত্ত্বের দিব্য দেহের প্রতিমূর্তি নেই।’

আমি বলিলাম, ‘হ্যাঁ, মানুষের স্মৃতির উপর যাদের কোনও দাবি নেই তারাই পাথরে নিজেদের প্রতিমূর্তি খোদাই করিয়ে রেখে গেছে, আর যাঁরা মহাপুরুষ তাঁরা কেবল মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অমর হয়ে আছেন। এই দেখুন না, যীশুখ্রীস্টের প্রকৃত চেহারা যে কি রকম ছিল তা কেউ জানে না।’

তিনি বলিলেন, ‘ঠিক। অথচ কত হাজার হাজার লোক তাঁর গায়ের একটা জামা দেখবার জন্য প্রতি বৎসর তীর্থযাত্রা করছে। তারা যদি তাঁর প্রকৃত প্রতিমূর্তির সন্ধান পেত, কি করত বলুন দেখি। বোধ হয় আনন্দে পাগল হয়ে যেত।’

এই সময় তাঁহার চোখের দিকে আমার নজর পড়িল। ইংরাজীতে যাহাকে ফ্যানাটিক বলে, এ সেই তাহারই দৃষ্টি। যে উগ্র একাগ্রতা মানুষকে শহীদ করিয়া তোলে, তাঁহার চোখে সেই সর্বগ্রাসী তন্ময়তার আগুন জ্বলিতেছে। চক্ষু দুটি আমার পানে চাহিয়া আছে বটে, কিন্তু তাঁহার মন যেন আড়াই হাজার বৎসরের ঘন কুজ্ঝটিকা ভেদ করিয়া এক দিব্য পুরুষের জ্যোতির্ময় মূর্তি সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে।

তিনি হঠাৎ বলিতে লাগিলেন, ‘ভগবান বুদ্ধের দন্ত কেশ নখ দেখেছি; কিছু দিনের জন্য এক অপরূপ আনন্দের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলুম। কিন্তু তবু তাতে মন ভরল না। কেমন ছিল তাঁর পূর্ণাবয়ব দেহ? কেমন ছিল তাঁর চোখের দৃষ্টি? তাঁর কণ্ঠের বাণী— যা শুনে একদিন রাজা সিংহাসন ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছিল, গৃহস্থ-বধূ স্বামী-পুত্র ছেড়ে ভিক্ষুণী হয়েছিল— সেই কণ্ঠের অমৃতময় বাণী যদি একবার শুনতে পেতুম—’

দুর্দম আবেগে তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া গেল। দেখিলাম, তাঁহার দেহ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছে, অজ্ঞাতে দুই শীর্ণ গণ্ড বাহিয়া অশ্রুর ধারা গড়াইয়া পড়িতেছে। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম; এত অল্প কারণে এতখানি ভাবাবেশ কখনও সম্ভব মনে করি নাই। শুনিয়াছিলাম বটে, কৃষ্ণনাম শুনিবামাত্র কোনও কোনও বৈষ্ণবের দশা উপস্থিত হয়, বিশ্বাস করিতাম না; কিন্তু ভিক্ষুর এই অপূর্ব ভাবোন্মাদনা দেখিয়া আর তাহা অসম্ভব বোধ হইল না। ধর্মের এ-দিকটা কোনও দিন প্রত্যক্ষ করি নাই; আজ যেন হঠাৎ চোখ খুলিয়া গেল।

ভিক্ষু বাহ্যজ্ঞানশূন্যভাবে বলিতে লাগিলেন, ‘গৌতম! তথাগত! আমি অর্হত্ত্ব চাই না, নির্বাণ চাই না, — একবার তোমার স্বরূপ আমাকে দেখাও। যে-দেহে তুমি এই পৃথিবীতে বিচরণ করতে সেই দেব-দেহ আমাকে দেখাও। বুদ্ধ, তথাগত—’

বুঝিলাম বৌদ্ধ ধর্ম নয়, স্বয়ং সেই কালজয়ী মহাপুরুষ ভিক্ষু অভিরামকে উন্মাদ করিয়াছেন।

পা টিপিয়া টিপিয়া ঘর হইতে বাহির আসিলাম। এই আত্মহারা ব্যাকুলত বসিয়া দেখিতে পারিলাম না, মনে হইতে লাগিল যেন অপরাধ করিতেছি।