রক্ত-সন্ধ্যা
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
মানুষের সহজ সাধারণ বৈচিত্র্যহীন জীবনযাত্রার মাঝখানে ভূমিকম্পের মতো এমন এক-একটা ঘটনা ঘটিয়া যায় যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার সহিত তুলনা করিয়া সেটাকে একটা অসম্ভব অঘটন বলিয়া মনে হয়। যে গল্পটা আজ বলিতে বসিয়াছি, সেটাও একদিন এমনই অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে আমার জীবনে আসিয়া হাজির হইয়াছিল। যদিও শুধু দর্শক হিসাবে ছাড়া এ গল্পের সঙ্গে আমার কোনও সংস্রব নাই, তবু ইহা আমার মনের উপর এমন একটা গভীর দাগ কাটিয়া দিয়াছে— যাহা বোধ করি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুছিবে না।
যে লোকটার কাহিনী আজ লিপিবদ্ধ করিতে বসিয়াছি, আজ সাত দিন হইল সে হাইকোর্টের রায় মাথায় করিয়া পরলোক যাত্রা করিয়াছে। সুতরাং সাক্ষীসাবুদ উপস্থিত করিবার আমার আর উপায় নাই। তবে সংবাদপত্রের নথি হইতে এবং আসামীর বিচারের সময় সাক্ষীদের মুখের যে যে কথা এই গল্পে কাজে আসিতে পারে, তাহা প্রয়োজনমত ব্যবহার করিব। বিশ্বাস আমি কাহাকেও করিতে বলি না এবং নিছক গাঁজা বলিয়া যাঁহারা উড়াইয়া দিতে চাহেন, তাঁহাদের বিরুদ্ধেও আমার কোনও নালিশ নাই। আমি শুধু এইটুকুই ভাবি যে, সে লোকটা মরিবার পূর্বে নিজের দোষ-ক্ষালনের বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করিয়াও এতগুলি অনাবশ্যক মিথ্যা কথা বলিয়া গেল। কেন?
এই সময় দৈনিক সংবাদপত্র ‘কালকেতু’তে এই ঘটনার যে বিবরণ বাহির হইয়াছিল, তাহাই সর্বাগ্রে উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি—
“গতকল্য বেলা প্রায় সাড়ে নয়টার সময় কলিকাতার দুর্গাচরণ ব্যানার্জির লেনে এক কসাইয়ের দোকানে ভীষণ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়া গিয়াছে। দোকানের মালিক গোলাম কাদের অন্য দিনের ন্যায় যথারীতি মাংস বিক্রয় করিতেছিল। দোকানে কয়েকজন ফিরিঙ্গী ও মুসলমান খরিদ্দার উপস্থিত ছিল। এমন সময় একজন অপরিচিত ফিরিঙ্গী দোকানে প্রবেশ করিয়া কিছু গোমাংস খরিদ করিতে চাহে। তাহাকে দেখিয়াই দোকানদার গোলাম কাদের ভীষণ চিৎকার করিয়া মাংস-কাটা ছুরি হস্তে তাহার উপর লাফাইয়া পড়ে এবং নৃশংসভাবে তাহার বুকে, পেটে, মুখে ছুরিকাঘাত করিতে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি মাটিতে পড়িয়া যায়, তখন গোলাম কাদের তাহার বুকের উপর বসিয়া এক একবার ছুরিকাঘাতের সঙ্গে সঙ্গে বলিতে থাকে, “ভাস্কো-ডা-গামা, এই আমার স্ত্রীর জন্যে— এই আমার কন্যার জন্যে— এই আমার বৃদ্ধ পিতার জন্যে।” দোকানে যাহারা ছিল সকলেই এই লোমহর্ষণ কাণ্ড দেখিয়া দ্রুত পলায়ন করিয়া পুলিসে খবর দেয়। পুলিস আসিয়া যখন গোলাম কাদেরকে গ্রেপ্তার করিল, তখনও সে মৃতদেহের উপর ছুরি চালাইতেছে ও পূর্ববৎ বকিতেছে।
“সন্দেহ হয় যে, গোলাম কাদের হঠাৎ পাগল হইয়া গিয়াছে। কারণ, হত ব্যক্তির সহিত পূর্ব হইতে তাহার পরিচয় ছিল বলিয়া জানা যাইতেছে না এবং তাহার স্ত্রী, কন্যা বা বৃদ্ধ পিতা কেহই বর্তমান নাই। অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে যে, গোলাম কাদের প্রায় পনেরো বৎসর পূর্বে বিপত্নীক হইয়াছিল। তাহার স্ত্রী এক মৃত কন্যা প্রসব করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাহার পর সে আর বিবাহ করে নাই।
“পুলিস-তদন্তে বাহির হইয়াছে যে, হত ব্যক্তি গোয়া হইতে নবাগত একজন পোর্তুগীজ ফিরিঙ্গী, ব্যবসায় উপলক্ষে কয়েকদিন পূর্বে কলিকাতায় আসিয়া এক ক্ষুদ্র হোটেলে বাস করিতেছিল। তাহার নাম গেব্রিয়েল ডিরোজা।
“গোলাম কাদের এখন হাজতে আছে। ডিরোজার লাস পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্রেরিত হইয়াছে।”
ঘটনাস্থলের খুব কাছেই আমার বাড়ি এবং অনেকদিন হইতে এই গোলাম কাদের লোকটার সহিত আমার মুখ- চেনাচিনি ছিল বলিয়াই ব্যাপারটা বেশি করিয়া আমাকে আকৃষ্ট করিয়াছিল। তাহা ছাড়া আর একটি জিনিস আমার কৌতূহল উদ্রিক্ত করিয়াছিল, সেটি ভাস্কো-ডা-গামার নাম। ছেলেবেলা হইতেই আমি ইতিহাসের ভক্ত, তাই হঠাৎ কসাইখানার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এই ইতিহাস-প্রসিদ্ধ নামটা উঠিয়া পড়ায় আমার মন সচকিত ও উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছিল। ‘ভাস্কো-ডা-গামা’ সাধারণ প্রচলিত নাম নহে; একজন অশিক্ষিত মুসলমান কসাইয়ের মুখে এ নাম এমন অবস্থায় উচ্চারিত হইতে দেখিয়া কোন্ এক গুপ্ত রোমান্সের গন্ধে আমার মনটা ভরিয়া উঠিয়াছিল। কি অদ্ভুত রহস্য এই বিশ্রী হত্যাকাণ্ডের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে? কে এই গেব্রিয়েল ডিরোজা— যাহাকে হত্যাকারী ভাস্কো-ডা-গামা বলিয়া সম্বোধন করিল? সত্যই কি ইহা কেবলমাত্র এক বাতুলের দায়িত্বহীন প্রলাপ?
তা সে যাহাই হউক, কৌতূহল আমার এতই বাড়িয়া গিয়াছিল যে, যেদিন এই মোকদ্দমা করোনারের কোর্টে উঠিল, সেদিন আমি একটু সকাল সকাল আদালতে গিয়া হাজির হইলাম। করোনার তখনও উপস্থিত হন নাই, কিন্তু আসামীকে আনা হইয়াছে। চারিদিকে পুলিস গিসগিস করিতেছে। আসামীর হাতে হাতকড়া— একটি টুলের উপর চুপ করিয়া বসিয়া আছে। আমাকে দেখিয়া সে চিনিতে পারিল এবং হাত তুলিয়া সেলাম করিল। পাগলের লক্ষণ কিছুই দেখিলাম না, নিতান্ত সহজ মানুষের মতো চেহারা। মুখে ভয় বা উৎকণ্ঠার কোনও চিহ্নই নাই। দেখিয়া কে বলিবে, এই লোকটাই দুই দিন আগে এমন নির্দয়ভাবে আর একটা লোককে হত্যা করিয়াছে।
করোনার আসিয়া পড়িলেন। তখন কাজ আরম্ভ হইল। প্রথমেই ডাক্তার আসিয়া এজাহার দিলেন। তিনি বলিলেন, লাসের গায়ে সর্বসুদ্ধ সাতান্নটি ছুরিকাঘাত পাওয়া গিয়াছে। এই সাতান্নটির মধ্যে কোন্টি মৃত্যুর কারণ, বলা শক্ত। কারণ, সবগুলিই সমান সাংঘাতিক।
ডাক্তারের জবানবন্দি শেষ হইলে জর্জ ম্যাথুস নামক একজন দেশী খ্রীস্টানকে সাক্ষী ডাকা হইল। অন্যান্য সওয়াল জবাবের পর সাক্ষী কহিল, ‘আমি গত দশ বৎসর প্রায় প্রত্যহ গোলাম কাদেরের দোকানে মাংস কিনিয়াছি; কিন্তু কোনও দিন তাহার এরূপ ভাব দেখি নাই। সে স্বভাবত বেশ শান্তশিষ্ট লোক।’
প্রশ্ন— আপনার কি মনে হয়, সে যে-সময় হত ব্যক্তিকে আক্রমণ করে, সে সময় সে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না?
উত্তর— হত ব্যক্তি দোকানে প্রবেশ করিবার আগে পর্যন্ত সে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল— আমাদের সঙ্গে সহজভাবে কথাবার্তা কহিতেছিল; কিন্তু ডিরোজাকে দেখিয়াই একেবারে যেন পাগল হইয়া গেল।
প্রশ্ন— আপনার কি বোধ হয়, আসামী হত ব্যক্তিকে পূর্ব হইতে চিনিত?
উত্তর-হাঁ। কিন্তু তাহার আসল নাম না বলিয়া ভাস্কো-ডা-গামা বলিয়া ডাকিয়াছিল।
প্রশ্ন— ডিরোজা আক্রান্ত হইয়া কোনও কথা বলিয়াছিল?
উত্তর— না।
প্রশ্ন— আসামী মদ বা অন্য কোনও নেশা করে, আপনি জানেন?
উত্তর— আমি কখনও তাহাকে নেশা করিতে বা মাতাল হইতে দেখি নাই।
প্রশ্ন— আসামীর ভাবে ইঙ্গিতে কি আপনার বোধ হইয়াছিল যে, সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার জন্য ডিরোজাকে খুন করিতেছে?
উত্তর— হাঁ। তাহার কথায় ও মুখের ভাবে আমার মনে হইয়াছিল যে, ডিরোজা পূর্বে তাহার স্ত্রী, কন্যা ও বৃদ্ধ পিতার উপর কোনও অত্যাচার করিয়া থাকিবে।
জর্জ ম্যাথুসের পরে আরও কয়েকজন সাক্ষী প্রায় ওই মর্মে এজাহার দিবার পর পুলিসের ডেপুটি কমিশনার এজাহার দিতে উঠিলেন। তিনি বলিলেন যে, গোয়া হইতে খবর পাইয়াছেন যে, ডিরোজা সেখানকার একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, জাতিতে ফিরিঙ্গী পোর্তুগীজ— বয়স বিয়াল্লিশ বৎসর। সে পূর্বে কখনও গোয়া ছাড়িয়া অন্যত্র যায় নাই— জীবনে এই প্রথম কলিকাতায় পদার্পণ করিয়াছিল। আসামী সম্বন্ধে ডেপুটি কমিশনার বলিলেন, ‘আসামীর আত্মীয়-স্বজন স্ত্রী পুত্র পরিবার কেহ নাই। অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে যে, গত ত্রিশ বৎসরের মধ্যে সে কলিকাতা ছাড়িয়া কোথাও যায় নাই। তাহার বয়স অনুমান সাতচল্লিশ বৎসর। সুতরাং ডিরোজার সহিত তাহার যে পূর্বে কখনও দেখা-সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহা সম্ভব বলিয়া বোধ হইতেছে না।’
আসামী এতক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। এবার সে কথা কহিল, বলিল, ‘ডা-গামাকে আমি অনেকবার দেখিয়াছি।’
মুহূর্তমধ্যে ঘর একেবারে নিস্তব্ধ হইয়া গেল। করোনার ডেপুটি কমিশনারকে চুপ করিতে ইঙ্গিত করিয়া আসামীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি ডিরোজাকে পূর্ব হইতে জানো?’
আসামী বলিল, ‘ডিরোজাকে আমি কখনও দেখি নাই— আমি ভাস্কো-ডা-গামাকে চিনি। ভাস্কো-ডা-গামা ছদ্মবেশে আমার দোকানে মাংস কিনিতে আসিয়াছিল।’
করোনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আসামীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, ভাস্কো-ডা-গামাকে তুমি কোথায় দেখিয়াছ?’
আসামী কহিল, ‘প্রথম দেখি কালিকটের বন্দরে— শেষ দেখি সমুদ্রের বুকের উপর—’ এই পর্যন্ত বলিয়া আসামী হঠাৎ থামিয়া গেল। দেখিলাম, তাহার মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিয়াছে, মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না। সে অবরুদ্ধকণ্ঠে একবার ‘ইয়া খোদা!’— বলিয়া দুই হাতে মুখ গুঁজিয়া বসিয়া পড়িল— আর কোনও কথা বলিল না।
তারপর করোনার যথাসময়ে রায় দিলেন যে, ক্ষণিক উন্মত্ততার বশে গোলাম কাদের ডিরোজাকে খুন করিয়াছে।
কোর্ট হইতে যখন বাহিরে রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইলাম, তখন আমার মাথার ভিতর ঝাঁ-ঝাঁ করিতেছে। ‘কালিকট’, ‘সমুদ্রের বুকের উপর’— আসামী এ সব কি বলিল? আরও কত কথা, না জানি কোন্ অপূর্ব কাহিনী এই মূর্খ নিরক্ষর কসাই গোলাম কাদেরের বুকের মধ্যে লুকানো আছে। কারণ, সে যে পাগলামির ভান করিতেছে না, তাহা নিঃসন্দেহ। কোনও কথা বা কাজই তাহার পাগলের মতো নহে। অথচ দুই-একটা অসংলগ্ন কথার ভিতর দিয়া অতীতের পর্দার একটা কোণ তুলিয়া ধরিয়া এ কি এক আশ্চর্য রূপকথার ইঙ্গিত দিয়া গেল!
ইহার পর গোলাম কাদেরের ভাগ্যে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা বিস্তারিতভাবে বলিবার কোনও প্রয়োজন দেখিতেছি না। দায়রা-সোপর্দ হইয়া মামলা হাইকোর্টে উঠিলে হাইকোর্টের জজবাহাদুর গোলাম কাদেরকে এক মাস ডাক্তারের নজরবন্দিতে থাকিবার হুকুম দিলেন। এক মাস পরে ডাক্তারের রিপোর্ট আসিল— গোলাম কাদের সুস্থ সহজ মানুষ, পাগলামির চিহ্নমাত্র তাহার মধ্যে নাই। তারপর বিচার। বিচারে গোলাম কাদের নিজের উকিলের পরামর্শ অগ্রাহা করিয়া স্পষ্ট ভাষায় বলিল, ‘আমি খুন করিয়াছি, সে জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখিত বা অনুতপ্ত নই। আবার যদি তাহার সহিত দেখা হয়, আবার তাহাকে এমনই ভাবে হত্যা করিব।’
হাইকোর্ট নিরুপায় হইয়া তাহার ফাঁসির হুকুম দিলেন।
আমি শেষ পর্যন্ত আদালতে উপস্থিত ছিলাম। গোলাম কাদেরের জীবননাট্যে বিচারের অঙ্কটা শেষ হইয়া গেলে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। বিচারে তাহার মুক্তির প্রত্যাশা কোন দিনই করি নাই, কিন্তু তবু অকারণে মনটা অত্যন্ত খারাপ হইয়া গেল। বুকের নিভৃত স্থানে যেন একটা সংশয় লাগিয়াই রহিল যে, এ সুবিচার হইল না, কোথায় যেন কি একটা অত্যন্ত জরুরী প্রমাণ বাদ পড়িয়া গেল।
এইসব নানা কথা ভাবিতেছি, এমন সময় কয়েকজন পুলিসের লোক আসামীকে বাহিরে লইয়া আসিল। আমি গোলাম কাদেরের মুখের দিকে চাহিতেই সে ইসারা করিয়া আমাকে কাছে ডাকিল। তারপর গলা নামাইয়া বলিল, ‘বাবুজী, আপনি আমার মোকদ্দমার শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত আছেন, তাহা আমি দেখিয়াছি। আমি তো চলিলাম, আমার একটি শেষ আর্জি আছে— একবার জেলে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবেন, আমার কিছু বলিবার আছে।’
আমি বলিলাম, ‘নিশ্চয় করিব।’
গোলাম কাদের হাতকড়া-বাঁধা দুই হাত তুলিয়া আমাকে সেলাম করিয়া জেলের গাড়িতে চড়িয়া চলিয়া গেল।
তারপর কি করিয়া কর্তৃপক্ষের অনুমতি লইয়া জেলে তাহার সহিত দেখা করিলাম, সে বিবৃতি এখানে অনাবশ্যক। শুধু কন্ডেম্ড আসামীর কক্ষে বসিয়া মৃত্যুর দুই দিন পূর্বে সে আমাকে যে গল্প বলিয়াছিল, তাহাই বাংলাভাষায় অনূদিত করিয়া আনুপূর্বিক উদ্ধৃত করিতেছি। —
গোলাম কাদের বলিল, ‘বাবুজী, আমার এই কাহিনী আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি যে পাগল নই— আমার এই কথাটি আপনি অবিশ্বাস করিবেন না। সত্য কথা বলিতে কি, আমার কাছেও ইহা এক অদ্ভুত ব্যাপার। আমি কিতাব পড়ি নাই, আজীবন মাংস বিক্রয় করিয়াছি। গল্প বানাইয়া বলিবার শক্তি আমার নাই। যাহা আজ বলিব, তাহা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করিয়াছি বলিয়াই বলিব। অথচ এ সকল ঘটনা আমার— এই গোলাম কাদেরের জীবনে যে ঘটে নাই, তাহাও নিশ্চিত। আপনাকে কেমন করিয়া বুঝাইব জানি না, আমি মূর্খ লোক। শুধু এইটুকু বলিতে পারি যে, ইহা আজিকার ঘটনা নয়, বহু বহু যুগের পুরাতন।
‘তবে শুরু হইতেই কথাটা বলি। পনের-ষোল বৎসর পূর্বে আমার স্ত্রী এক কন্যা প্রসব করিতে গিয়া মারা যায়, মেয়েটিও মারা গেল। কি করিয়া জানি না, আমার মনের মধ্যে বদ্ধমূল হইয়া গেল যে, কোনও দুশমন আমার স্ত্রী-কন্যাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিয়াছে। শোকের অপেক্ষা ক্রোধ ও প্রতিহিংসায় আমার অন্তঃকরণ অধিক পূর্ণ হইয়া উঠিল; সর্বদাই মনে হইত, যদি সেই অজ্ঞাত দুশমনটাকে পাই, তাহা হইলে তাহার প্রতি অঙ্গ ছিড়িয়া ছিঁড়িয়া ইহার প্রতিশোধ লই।
‘এইভাবে কিছুদিন কাটিবার পর ক্রমে বুঝিতে পারিলাম যে, ইহা আমার ভ্রান্তি— সত্যের উপর ইহার কোনও প্রতিষ্ঠা নাই। তারপর যত দিন কাটিতে লাগিল, আস্তে আস্তে শোক এবং ক্রোধ দুই ভুলিতে লাগিলাম; কিন্তু আর বিবাহ করিতে পারিলাম না। শেষ পর্যন্ত হয়তো জীবনটা আমার এমনই সহজভাবে কাটিয়া যাইত, যদি না সে-দিন অশুভক্ষণে সেই লোকটা আমার দোকানে পদার্পণ করিত।
‘শুনিয়াছি, মানুষ জলে ডুবিলে তাহার বিগত জীবনের সমস্ত ঘটনা ছবির মতো চোখের পর্দার উপর দেখিতে পায়। এই লোকটাকে দেখিবামাত্র আমারও ঠিক তাহাই হইল। এক মুহূর্তের মধ্যে চিনিয়া লইলাম— এই সেই নৃশংস রাক্ষস, যে আমার স্ত্রী-কন্যা এবং পিতাকে হত্যা করিয়াছিল। ছবির মতো সে সকল দৃশ্য আমার চোখের উপর জাগিয়া উঠিল। মজ্জমান জাহাজের উপর সেই মরণোন্মুখ অসহায় যাত্রীদের হাহাকার কানে বাজিতে লাগিল। ভাস্কো-ডা-গামার সেই ক্রূর হাসি আবার দেখিতে পাইলাম।
‘আমার জজসাহেবরা হত্যার কারণ খুঁজিতেছিলেন, কৈফিয়ৎ চাহিতেছিলেন। বাবুজী, আমি কি কৈফিয়ৎ দিব, আর দিলেই বা তাহা বুঝিত কে?
‘আপনি হয়তো বুঝিবেন। আপনার চোখে মুখে আমি তাহার পরিচয় পাইয়াছিলাম, তাই আপনাকে এই কষ্ট দিয়াছি। ইহাতে ফল কিছু হইবে না জানি, কিন্তু আমার হৃদয়ভার লাঘব হইবে; এ ছাড়া আমার অন্য স্বার্থ নাই।
‘আমার এই কসাই-জীবনের ইতিহাসটা এখানেই শেষ করিতেছি। এবার যাহার কথা আরম্ভ করিব, তাহার নাম মির্জা দাউদ বিন্ গোলাম সিদ্কী। আমিই যে এই মির্জা দাউদ, তাহা এখন ভুলিয়া যান। মনে করুন, ইহা আর কাহারও জীবনের কাহিনী।’—
কালিকটের নাম আপনি শুনিয়া থাকিবেন। মালাবার উপকূলে অতি সুন্দর মহার্ঘ মণিখণ্ডের মতো একটি ক্ষুদ্র নগর। মোরগের ডাক যতদূর শুনা যায়, ততদূর তাহার নগর-সীমানা। নগরের পশ্চাতে ছোট ছোট পাহাড়, উপত্যকা, কঙ্করপূর্ণ সমতল ক্ষেত্র, এবং তাহার পশ্চাতে অভ্রভেদী পশ্চিমঘাট সমস্ত পৃথিবী হইতে যেন এই স্থানটুকুকে পৃথক করিয়া ঘিরিয়া রাখিয়াছে। সম্মুখে অপার সমুদ্র ভিন্ন কালিকটে প্রবেশ বা নিষ্ক্রমণের অন্য সুগম পথ নাই। এই সমুদ্রপথে অসংখ্য বাণিজ্যতরণী কলিকটের বন্দরে প্রবেশ করে, আবার পাল তুলিয়া সমুদ্রে বিলীন হইয়া যায়। কালিকট যেন পৃথিবীর সমগ্র বণিক-সমাজের মোসাফিরখানা।
পীতবর্ণ চৈনিক, তাম্রবর্ণ বাঙালী, লোহিতবর্ণ পারসিক, কৃষ্ণবর্ণ মূর— সকলেই কলিকটের পথে সমান দর্পে পা ফেলিয়া চলে, কেহ কাহারও অপেক্ষা হীন নহে। চীন হইতে লাক্ষা, দারুশিল্প; ব্রহ্ম হইতে গজদন্ত; মলয়দ্বীপ হইতে চন্দন; বঙ্গ হইতে ক্ষৌম পট্টবস্ত্র, মলমল, ব্যাঘ্রচর্ম; চম্পা ও মগধ হইতে চামর, কস্তুরী, চারু-কেশরার পুষ্পবীজ; দাক্ষিণাত্য হইতে অগুরু, কর্পূর, দারুচিনি; লঙ্কা হইতে মুক্ত আসিয়া কালিকটে স্তূপীকৃত হয়। পশ্চিম হইতে তুরস্ক, পারসিক, আরব ও মূর সওদাগর তাহাই স্বর্ণের বিনিময়ে ক্রয় করিয়া জাহাজে তুলিয়া, কেহ বা পারস্যোপসাগরের ভিতর দিয়া ইউফ্রাটেস নদের মোহনায় উপস্থিত হয়, কেহ বা লোহিত সাগরের উত্তর প্রান্তে নীলনদের সন্নিকটে গিয়া তরণী ভিড়ায়। তথা হইতে প্রাচী-র পণ্য সমগ্র পাশ্চাত্য খণ্ডে ছড়াইয়া পড়ে। কালিকটের রাজা সামরী বাণিজ্যতরণীর শুল্ক আদায় করিয়া রাজ্যের ব্যয়ভার নির্বাহ করেন। রাজকোষ সর্বদা সুবর্ণ-মণিমাণিক্যে পূর্ণ। রাজ্যে কোথাও দৈন্য নাই, অশান্তি নাই, অসন্তোষ নাই; ইতর-ভদ্র সকলেই সুখী।
মির্জা দাউদ এই কালিকটের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। তাঁহার একুশখানি বাণিজ্যতরী আছে,— হোয়াংহো হইতে নীলনদের প্রান্ত পর্যন্ত তাহাদের গতিবিধি। যখন এই তরণী সকল শুভ্র পাল তুলিয়া শ্রেণীবদ্ধভাবে সমুদ্রযাত্রায় বাহিত হয়, তখন মনে হয়, রাজহংসশ্রেণী পক্ষ বিস্তার করিয়া নীল আকাশে ভাসিয়া চলিয়াছে।
মির্জা দাউদ জাতিতে মূর। কলিকটে তাঁহার শ্বেত-প্রস্তরের প্রাসাদ মূর-প্রথায় নির্মিত। সুদূর মরক্কো দেশে এখনও তাঁহার বৃদ্ধ পিতা বর্তমান; কিন্তু তিনি কালিকটকেই মাতৃভূমিত্বে বরণ করিয়াছেন। অনেক বৈদেশিক সওদাগরই এরূপ করিয়া থাকেন। মির্জা দাউদ ধর্মে মুসলমান হইলেও একপত্নীক। সম্প্রতি চৌত্রিশ বৎসর বয়সে প্রথমে একটি কন্যা জন্মিয়াছে। কন্যার জন্মদিনে মির্জা দাউদ এক সহস্র তোলা সুবর্ণ বিতরণ করিয়াছেন— তারপর তাঁহার গৃহে সপ্তাহব্যাপী উৎসব চলিয়াছিল। নগরে ধন্য ধন্য পডিয়া গিয়াছিল।
বস্তুত মির্জা দাউদের মতো সর্বজনপ্রিয় বহু-সম্মানিত ব্যক্তি নগরে আর দ্বিতীয় নাই। উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। স্বয়ং রাজা সামরী তাঁহাকে বন্ধুর মধ্যে গণ্য করেন। এদিকে ব্যবসায়ে দিন দিন অধিক অর্থাগম হইতেছে। মানুষ পৃথিবীতে যাহা কিছু পাইলে সুখী হয়, কিছুরই তাঁহার অভাব নাই।
একদিন গ্রীষ্মের সায়াহ্নে পশ্চিম দিগ্বলয় রঞ্জিত করিয়া সূর্যাস্ত হইতেছে। সমুদ্রের জল যতদূর দৃষ্টি যায়, রাঙা হইয়া টলমল করিতেছে। দূর লাক্ষাদ্বীপ হইতে সুগন্ধ বহন করিয়া স্নিগ্ধ বায়ু বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। আকাশ মেঘ-নির্মুক্ত।
সমস্ত দিন গরম ভোগ করিয়া নগরের নরনারী শীতল বায়ু সেবন করিবার জন্য এই সময় বন্দরের ঘাটে আসিয়া জমিয়াছে। বহুদূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অর্ধচন্দ্রাকৃতি ঘাট— বড় বড় চতুষ্কোণ পাথর দিয়া বাঁধানো। পাথরের উপর সারি সারি জাহাজ বাঁধিবার লোহার কড়া। জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল ওই ঘাটের কানায় কানায় ভরিয়া উঠে, আবার ভাঁটার সময় সিক্ত বালুকারাশি মধ্যে রাখিয়া দূরে সরিয়া যায়। এই ঘাটই নগরের কর্মকেন্দ্র। ক্রয়-বিক্রয়, দর-দস্তুর, আমোদ-প্রমোদ সমস্তই এই স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। তাই সকল সময় এখানে মানুষের ভিড়।
সে সময় ঘাটে একটিও নবাগত কিংবা বহির্গামী বাণিজ্যতরী ছিল না। কাজকর্ম কিছু শিথিল। নাগরিকগণ নানা বিচিত্র বেশ পরিধান করিয়া কেহ সস্ত্রীক সপুত্রকন্যা পাদচারণা করিতেছে, কেহ উচ্চৈঃস্বরে গান ধরিয়াছে। চঞ্চলমতি কিশোরগণ ছুটাছুটি করিয়া খেলা করিতেছে, আবার কেহ বা ঘাট হইতে সমুদ্রের জলে লাফাইয়া পড়িয়া সন্তরণ করিতেছে।
চীনদেশীয় এক বাজিকর নানা প্রকার অদ্ভুত খেলা দেখাইতেছে। জনতার মধ্য হইতে মাঝে মাঝে উচ্চ হাসির রোল উঠিতেছে।
বাজিকর একজন স্থূলকায় প্রৌঢ় সিংহলীকে ধরিয়া তাহার কানের মধ্যে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, ‘তোমার মাথার মধ্যে ২৫৬টি পাথরের নুড়ি রহিয়াছে, বল তো বাহির করিয়া দিই।’ অমনিই জনতা সোল্লাসে চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘বাহির কর, বাহির কর।’ তখন বাজিকর ক্ষিপ্রহস্তে ক্ষুদ্র চিমটা দিয়া তাহার কর্ণ হইতে সুপারীর মতো বড় বড় অসংখ্য পাথর বাহির করিয়া মাটিতে স্তূপীকৃত করিল। প্রৌঢ় সিংহলী বিস্ময়ে বিহ্বল হইয়া চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাহা দেখিতে লাগিল। ভারি হাসির একটা ধুম পড়িয়া গেল। একজন পরিহাস করিয়া বলিল, ‘শেঠ, তোমার মাথা যে এত নিরেট, তাহা জানিতাম না।’
ক্রমে সূর্য অস্তমিত হইল। সমুদ্রের গায়ে সীসার রং লাগিল। দিগন্তরেখার যে স্থানটায় সূর্য অস্ত গিয়াছিল, তাহাকে কেন্দ্র করিয়া সন্ধ্যার রক্তিমাভা ধীরে ধীরে সংকুচিত হইয়া আসিতে লাগিল।
এমন সময় দূর সমুদ্রবক্ষে সেই রক্তিমাভার সম্মুখে তিনটি কৃষ্ণবর্ণের ছায়া আবির্ভূত হইল। সকলে দেখিল, তিনখানি জাহাজ বন্দরের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে।
তখন, জাহাজ কোথা হইতে আসিয়াছে, কাহার জাহাজ— ইহা লইয়া ঘাটের দর্শকদিগের মধ্যে তর্ক চলিতে লাগিল। কেহ বলিল, আরবী জাহাজ, কেহ বলিল, চীনা; কিন্তু অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতেছিল— কোন্ দেশীয় জাহাজ, নিশ্চয়রূপে কিছু বুঝা গেল না।
মির্জা দাউদ ঘাটে ছিলেন। তিনি বহুক্ষণ একদৃষ্টে সেই জাহাজ তিনটির প্রতি চাহিয়া রহিলেন। ক্রমে তাঁহার মুখে উদ্বেগের চিহ্ন দেখা দিল। তিনি অস্ফুটস্বরে কহিলেন, ‘পোর্তুগীজ জাহাজ!— কিন্তু ফিরিঙ্গী কোন্ পথে আসিল?’
তারপর গগনপ্রান্তে দিবা-দীপ্তি নিবিয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি জীর্ণ সিন্ধুবিধ্বস্ত ক্ষুদ্র পোত ছিন্ন পাল নামাইয়া কালিকটের বন্দরে আসিয়া ভিড়িল।
পরদিন প্রভাতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মির্জা দাউদ বন্দরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, কয়েকজন বিদেশীকে ঘিরিয়া ভারি ভিড় জমিয়া গিয়াছে। ফিরিঙ্গীগণ অপরিচিত ভাষায় কি বলিতেছে, কেহই বুঝিতেছে না এবং প্রত্যুত্তরে নানা দেশীয় ভাষায় তাহাদের প্রশ্ন করিতেছে। মির্জা দাউদ ভিড় ঠেলিয়া তাহাদের সম্মুখীন হইলেন। তাঁহাকে আসিতে দেখিয়া সকলে সসম্মানে পথ ছাড়িয়া দিল।
আগন্তুকদিগের মধ্যে একজন বলিল, ‘এখানে পোর্তুগীজ ভাষা বুঝে, এমন কেহ কি নাই? আমি জামোরিনের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাই— দোভাষী খুঁজিতেছি।’
মির্জা দাউদ দেখিলেন, বক্তা শালপ্রাংশু বিশালদেহ এক পুরুষ। তপ্ত কাঞ্চনের ন্যায় বর্ণ, দীর্ঘ স্বর্ণাভ কেশ এবং হ্রস্ব সূচ্যগ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল। ঊর্ধ্বাঙ্গে সোনার জরির কাজ-করা অতি মূল্যবান মখমলের অঙ্গরক্ষা, কটি হইতে জানু পর্যন্ত ঐ মখমলের জাঙিয়া এবং জানু হইতে নিম্নে পদদ্বয় চর্মনির্মিত খাপে আবৃত। মস্তকে টুপির উপর কঙ্কপত্র বক্রভাবে অবস্থিত; এই পুরুষের সহিত অন্য পাঁচ-ছয় জন যাহারা রহিয়াছে, তাহারাও প্রায় অনুরূপ বেশধারী। সকলের কটিবন্ধে তরবারি।
মির্জা দাউদ এই প্রধান পুরুষের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া গভীরস্বরে কহিলেন, “আমি পোর্তুগীজ ভাষা বুঝি।”
নবাগত কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে মির্জা দাউদের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। তাহার মুখ অন্ধকার হইল। সে ধীরে ধীরে কহিল, ‘তুমি দেখিতেছি মূর!’
এই তিনটি শব্দের অন্তর্নিহিত যে সুতীক্ষ্ণ ঘৃণা, তাহা মীর্জা দাউদকে বিদ্ধ করিল। তিনিও মনোগত বিদ্বেষ গোপন করিবার চেষ্টা না করিয়া কহিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি মূর। তোমরা দেখিতেছি পোর্তুগীজ— জলদস্যু; তোমাদের সহিত পরিচয় আমার প্রথম নহে, কিন্তু ফিরিঙ্গীর সঙ্গে আমাদের সদ্ভাব নাই।’
এতক্ষণে দ্বিতীয় একজন পোর্তুগীজ কথা কহিল। তাহার বয়স অল্প, উদ্ধতকণ্ঠে বলিল, ‘মূর-কুক্কুরের সহিত আমরা সদ্ভাব রাখি না— মূরের উচ্ছেদ করাই আমাদের ধর্ম।’
নিমেষমধ্যে মির্জা দাউদের কটি হইতে ছুরিকা বাহির হইয়া আসিল, দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল; কিন্তু পরক্ষণেই আগন্তুকদিগের প্রধান ব্যক্তি হাত তুলিয়া তাহাকে নিরস্ত করিল। বিনীতস্বরে কহিল, ‘মহাশয়, আমার এই স্পর্ধিত সঙ্গীকে ক্ষমা করুন। আপনি মূর এবং আমরা পোর্তুগীজ বটে; কিন্তু আমরা উভয়েই ব্যবসায়ী, জলদস্যু নহি। অন্যত্র যাহাই হোক্, এখানে আমার সহিত আপনাদের বিবাদ নাই। বরঞ্চ আপনার হৃদ্যতা লাভ করিলেই আমরা কৃতার্থ হইব।’ তারপর নিজ সঙ্গীর দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘পেড্রো, আর কখনও যদি তোমার মুখে এরূপ কথা শুনিতে পাই, তোমার প্রত্যেক অস্থি চাকায় ভাঙিয়া তারপর ডালকুত্তা দিয়া খাওয়াইব।’
ভয়ে পেড্রোর মুখ পীতবর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু তথাপি সে কম্পিত বিদ্রোহের কণ্ঠে কহিল, ‘আমি সত্য কথা বলিতে ভয় করি না। মূরমাত্রেই আমাদের ঘৃণার পাত্র। আপনি নিজেও তো মূরকে—’
তাহার কথা শেষ হইবার পূর্বেই প্রথম ব্যক্তি বিদ্যুতের মতো দুই হাত বাড়াইয়া তাহার কণ্ঠ চাপিয়া ধরিল। বজ্রমুষ্টিতে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাহার কণ্ঠনালী চাপিয়া থাকিবার পর ছাড়িয়া দিতেই পেড্রো হতজ্ঞান হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। তাহার প্রতি আর দৃক্পাত না করিয়া প্রথম ব্যক্তি মির্জা দাউদের দিকে ফিরিয়া ঈষৎ হাস্যে কহিল, ‘মিথ্যাবাদীর দণ্ডদান ধার্মিকের কর্তব্য। এখন দয়া করিয়া আমার সহিত জামোরিনের নিকট গিয়া আমার নিবেদন তাঁহাকে বুঝাইয়া দিলে আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ রহিব।’— বলিয়া মাথার টুপি খুলিয়া আভূমি লুণ্ঠিত করিয়া অভিবাদন করিল। দর্শকবৃন্দ— যাহারা পোর্তুগীজ ভাষা বুঝিল না, তাহারা অবাক্ হইয়া এই দুর্বোধ্য অভিনয় দেখিতে লাগিল।
মির্জা দাউদ আগন্তুকের মিষ্ট বাক্যে ভুলিলেন না, অটল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। শেষে ধীরে ধীরে কহিলেন, ‘ফিরিঙ্গী, তুমি অতি ধূর্ত। কি জন্য সামরীর রাজ্যে আসিয়াছ, সত্য বল।’
‘বাণিজ্য করিতে।’
‘খ্রীস্টান, আমি তোমাদের চিনি। কলহ তোমাদের ব্যবসায়, লোভ তোমাদের ধর্ম, পরশ্রীকাতরতা তোমাদের স্বভাব। এ রাজ্যে কলহ-বিদ্বেষ নাই— হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, হিব্রু নির্বিবাদে শান্তিতে ব্যবসায়-বাণিজ্য করিতেছে। সত্য বল, তোমরা কি উদ্দেশ্যে এই হিন্দে পদার্পণ করিয়াছ?’
ফিরিঙ্গীর মুখ রক্তহীন হইয়া গেল। শুধু তাহার চক্ষুযুগল জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো নিষ্ফল ক্রোধ ও হিংসা বিকীর্ণ করিতে লাগিল; কিন্তু পরক্ষণেই আপনাকে সংবরণ করিয়া সে কণ্ঠবিলম্বিত সুবর্ণ-ক্রুশ হস্তে তুলিয়া বলিল, ‘এই ক্রুশ স্পর্শ করিয়া সত্য করিতেছি— সকলের সহিত সদ্ভাব রাখিয়া বাণিজ্য করা ব্যতীত আমাদের আর অন্য উদ্দেশ্য নাই।’
ক্ষণকাল নিঃশব্দে তাহার মুখের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘তোমার কথা বিশ্বাস করিলাম। চল, সামরীর প্রাসাদে তোমাদের লইয়া যাই।’
তখন বিদেশীরা মির্জা দাউদের অনুসরণ করিয়া রাজপ্রাসাদ অভিমুখে চলিল। পেড্রোর সংজ্ঞাহীন দেহ ঘাটের পাথরের উপর মৃতবৎ পড়িয়া রহিল।
প্রাসাদে উপস্থিত হইয়া সামরীর সম্মুখে নতজানু হইয়া তাঁহার বস্ত্রপ্রান্ত চুম্বন করিয়া পোর্তুগীজ বণিকদিগের অধিনায়ক বলিল, ‘আমার নাম ভাস্কো-ডা-গামা— আমি পোর্তুগালের রাজদূত। আপনার নিকট কালিকটে বাণিজ্য করিবার অনুমতি প্রার্থনা করিতেছি।’ এই বলিয়া পোর্তুগাল-রাজ-প্রেরিত মহার্ঘ উপঢৌকন সকল সামরীর সম্মুখে স্থাপন করিতে সঙ্গীগণকে ইঙ্গিত করিল।
মুখে যাহাই বলুন, সন্দেহ এবং অবিশ্বাস মির্জা দাউদের অন্তর হইতে দূর হইল না। তিনি ফিরিঙ্গীকে পূর্ব হইতেই চিনিতেন— মূরমাত্রেই চিনিত। স্বদেশে বহু সংঘর্ষের ভিতর দিয়া এই পরিচয় ঘনিষ্ঠ হইয়াছিল। তাহারা জনিত যে, ফিরিঙ্গী অতিশয় অর্থলিপ্সু ও ভোগলুব্ধ। ইহাদের জন্মভূমি অর্থপ্রসূ নহে; তাই অন্নের জন্য ইহাদিগকে দৈহিক ও মানসিক কঠোরতার মধ্যে জীবনযাপন করিতে হয় বটে, কিন্তু এই জন্যই ইহারা অপেক্ষাকৃত ধনী মুসলমানদিগকে অত্যন্ত ঈর্ষা করে। পরের উন্নতি ইহাদের চক্ষুশূল। কোথাও একবার ধনরত্ন-ঐশ্বর্যের সন্ধান পাইলে ইহাদের লালসা ও ক্ষুধা এত উগ্র, নির্মম হইয়া উঠে যে, কোনও মতে সেখানে প্রবেশ লাভ করিয়া নিজেকে একবার ভালরূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিলে শত্রুমিত্রনির্বিচারে সকলের উপর দুর্বিনীত বাহুবল, স্পর্ধা ও জুলুম প্রকাশ করিতে থাকে। ইহারা নিরতিশয় কলহপ্রিয় ও যুদ্ধনিপুণ। স্বার্থরক্ষার জন্য এমন কাজ নাই যাহা ইহারা পারে না এবং স্বজাতির স্বার্থবর্ধনের জন্য প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করিতে ইহারা তিলমাত্র কুণ্ঠিত নহে।
পোর্তুগাল হইতে সমুদ্রপথে আফ্রিকা প্রদক্ষিণ করিয়া আজ পর্যন্ত কেহ ভারতবর্ষে আসে নাই, এ পথ এতদিন অজ্ঞাত ছিল। ভাস্কো-ডা-গামা সেই পথ ইউরোপীয়দের জন্য উন্মুক্ত করিয়া দিয়া বহু নূতন সম্ভাবনা ও দুর্ভাবনার সৃষ্টি করিল। সম্প্রতি ভাস্কো-ডা-গামার উদ্দেশ্যও নিশ্চয়ভাবে বুঝা যায় না। অথচ উদ্ধত ও কটুভাষী পেড্রোর কণ্ঠরোধ করিয়া সে যে একটা গূঢ় অভিপ্রায় গোপন করিয়া গেল, তাহাও বুঝিতে মির্জা দাউদের বিলম্ব হইল না। শঙ্কা ও সংশয়ের মেঘে তাঁহার মন আচ্ছন্ন হইয়া রহিল।
পোর্তুগীজগণ কালিকটে বাস করিতে লাগিল এবং দিন দিন নূতন পণ্যে তরণী পূর্ণ করিতে লাগিল। অতি অপদার্থ পণ্য দ্বিগুণ চতুর্গুণ মূল্য দিয়া কিনিতে লাগিল। ইহাতে নির্বোধ ব্যবসায়ীরা যতই উৎফুল্ল হউন না কেন, মির্জা দাউদের ন্যায় বহুদর্শী শ্রেষ্ঠীদের মনে সন্দেহ ততই ঘনীভূত হইয়া উঠিল। উচিত মূল্যের অধিক মূল্য দিয়া পণ্য ক্রয় করা ব্যবসায়ীর স্বভাব নহে, অথচ নবাগতরা অব্যবসায়ী বা নির্বোধ নহে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য ছিলমাত্র, অন্য কোনও দুরভিসন্ধি তাহাদের অন্তরে প্রচ্ছন্ন আছে, ইহা অনুমান করিয়া বিচক্ষণ ব্যবসায়ীদের চিন্তা ও উৎকণ্ঠার অবধি রহিল না।
এইরূপে কিছুকাল বিগত হইল। কালিকটের জীবনপ্রবাহ পূর্ববৎ প্রশান্তভাবে চলিতে লাগিল।
একদিন শরৎকালে মেঘমার্জিত আকাশে শুভ্র পাল উড়াইয়া দুইটি জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করিল। সঙ্গে সঙ্গে নগরে রাষ্ট্র হইয়া গেল যে, বঙ্গদেশ হইতে প্রভাকর শ্রেষ্ঠীর নৌকা আসিতেছে। প্রভাকর শেঠ অতি প্রসিদ্ধ বণিক— প্রতি বৎসর এই সময় লক্ষাধিক মুদ্রার বস্ত্রাদি পণ্য বহন করিয়া তাহার তরণী কালিকটে উপস্থিত হয়। কাশ্মীরের শাল, বারাণসীর চেলি, কৌশেয় পট্ট, বাংলার মলমল কিনিবার জন্য কালিকটে সওদাগর সমাজে হুড়াহুড়ি পড়িয়া যায়। এত সুন্দর এবং এত মূল্যবান বস্ত্র কেহই আনিতে পারে না, সেজন্য প্রভাকরের এত খ্যাতি।
প্রভাকরের নৌকা ঘাটে লাগিবার পূর্বেই নগরের বড় বড় ব্যবসায়ীরা ঘাটে সমবেত হইয়াছিলেন। প্রভাকর নৌকার উপর দাঁড়াইয়া পরিচিত সকলকে নমস্কার-সম্ভাষণাদি করিতে লাগিল। সে অতিশয় বাক্পটু ও রহস্যপ্রিয়, এজন্য সকলেই তাহাকে ভালবাসিত।
হিব্রু মুশা ইব্রাহিম তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘প্রভাকর, এবার তোমার দেরি দেখিয়া আমরা ভাবিয়ছিলাম, বুঝি আর আসিলে না— পথে তোমাদের সুন্দরবনের কুমীর তোমাকে পেটে পুরিয়াছে।’
প্রভাকর হাসিয়া বলিল, ‘মুশা সাহেব, পেটে পুরিলেও কুমীর আমাকে হজম করিতে পারিত না!— এই যে মির্জা সাহেব! আদাব আদাব— শরীর-গতিক সব ভালো তো? এবার আপনার ফরমাশী জিনিস সমস্ত আনিয়াছি, কত লইতে পারেন দেখিব। আপনার কোমরে তলোয়ারখানি নূতন দেখিতেছি, ডামাস্কাসের বুঝি? আমার কিন্তু এক জোড়া চাই— গৌড়েশ্বরের কাছে বাক্যদত্ত হইয়া আছি। ভালো কথা, পথে আসিতে শ্রীখণ্ডের নিকট আপনার যবদ্বীপ-যাত্রী জাহাজের সঙ্গে দেখা হইয়াছিল— খবর সব ভালো। — হায়দর মুস্তফা যে, ইতিমধ্যে কয়টি সাদি করিলেন? এবার কিন্তু ইস্পাহানী আঙ্গুরের রস না খাওয়াইলে বড়ই অন্যায় হইবে। — জাম্বো, শাঁখালুর মতো দাঁত বাহির করিয়া হাসিস না— দড়িটা ধর্।’
নৌকা বাঁধা হইলে প্রভাকর ঘাটে নামিয়া সকলের সহিত আলিঙ্গনাদি করিল। তখন মির্জা দাউদ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘প্রভাকর, কি কি সওদা আনিলে?’
প্রভাকর বলিল, ‘এবার যে মলমল আনিয়াছি, মির্জা সাহেব, তেমন মলমল আজ পর্যন্ত কখনও চোখে দেখেন নাই। মাকড়শার জালের চেয়েও নরম, কাশফুলের চেয়েও হালকা— মুঠির মধ্যে দেড়শ গজ কাপড় ধরা যায়। কিন্তু এক থান কাপড়ের দাম পাঁচ তোলা সোনা, তার কমে দিতে পারিব না। কোচিনে চার তোলা পর্যন্ত দিতে চাহিয়াছিল— আমি লই নাই। শেষে কি লোকসান দিয়া ঘরে ফিরিব। শেঠনী তাহা হইলে আমার মুখ দেখিবে না।’
মির্জা দাউদ হাসিয়া বলিলেন, ‘তা না দেখুক। তোমার মুখ না দেখিলেও শেঠনীর কোনও লোকসান হইবে না। — এখন তোমার সওদা দেখাও।’
প্রভাকর বলিল, ‘বলেন কি মির্জা সাহেব, লোকসান হইবে না? শেঠনীর এখন যৌবনকাল, কাঁচা বয়স; এখন স্বামীর মুখদর্শন না করিলে জীবন-যৌবন সমস্তই লোকসান হইয়া যাইবে যে!— ভালো কথা, গতবারে শুনিয়াছিলাম, আপনার বিবি-সাহেবা নাকি অসুস্থ। তা কোনও শুভ সংবাদ আছে নাকি?’
মির্জা দাউদ বলিলেন, ‘খোদার দয়ায় একটি মেয়ে হইয়াছে—’
প্রভাকর বলিল, ‘এত বড় আনন্দের সংবাদ এতক্ষণ চাপিয়া রাখিয়াছিলেন! আমাদের দেশে বলে, মেয়ে হইলে পিতার পরমায়ু বৃদ্ধি হয়। তাহা হইলে আজ রাত্রে আপনার দৌলতখানায় আমার নিমন্ত্রণ রহিল। দেশে কুক্কুটাদি ভোজনের সুবিধা হয় না— দুষ্প্রাপ্যও বটে, আর ব্রাহ্মণগুলো বড়ই গণ্ডগোল করে। — ও বাবা! এটি আবার কে, মির্জা সাহেব? এ রকম পোশাক-পরিচ্ছদ তো কখনও দেখি নাই। ইহারা কোথা হইতে আসিল?’
মির্জা দাউদ ফিরিয়া দেখিলেন, ভাস্কো-ডা-গামা দুই জন সহচর সঙ্গে সেই দিকে আসিতেছে। ইতিমধ্যে কালিকটের পথে-ঘাটে দুই জনের দেখা-সাক্ষাৎ ঘটিয়াছিল বটে, কিন্তু কোন পক্ষেই সৌহার্দ্য বর্ধনের আগ্রহ দেখা যায় নাই। বরঞ্চ উভয়ে উভয়কে যথাসম্ভব এড়াইয়া চলিয়াছেন।
প্রভাকরের প্রশ্নের উত্তরে মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘ইহারা পোর্তুগীজ। ক্রমে পরিচয় পাইবে।’
ইত্যবসরে প্রভাকরের নৌকা হইতে পণ্যসামগ্রী সকল পরিদর্শনের জন্য ঘাটে নামানো হইতেছিল। সওদাগরেরা ভিড় করিয়া তাহাই দেখিতেছিলেন। মির্জা দাউদও সেই সঙ্গে যোগ দিলেন। অন্য দিক হইতে ভাস্কো-ডা-গামাও আসিয়া মিলিত হইল।
মলমলের নমুনা দেখিয়া মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘অতি উৎকৃষ্ট মলমল। প্রভাকর, এ জিনিস কত আনিয়াছ?’
প্রভাকর সগর্বে বলিল, ‘পুরা এক জাহাজ।’
দাউদ কহিলেন, ‘ভালো, আমি এক জাহাজই লইলাম। দর-দামের কথা আজ রাত্রে স্থির হইবে।’
ভাস্কো-ডা-গামা এরূপ অপূর্ব সূক্ষ্ম মলমল পূর্বে কখনও দেখে নাই। বস্তুত, এত মহার্ঘ মলমল পারস্য দেশ ভিন্ন অন্য কোথাও যাইত না। পোর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স প্রভৃতি পাশ্চাত্যদেশে যাহা যাইত, তাহা অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট শ্রেণীর মলমল। ডা-গামার অন্তর লুব্ধ হইয়া উঠিল। পোপ এবং রাজা ইম্যানুয়েলকে নজর দিতে হইলে ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বস্তু আর কি আছে? সে বলিল, ‘এ মলমল আমি কিনিব।’
মির্জা দাউদ হাসিয়া বলিলেন, ‘আর উপায় নাই। এই মলমল আমি কিনিয়াছি।’
ডা-গামা প্রভাকরের দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘আমি অধিক মূল্য দিব।’
মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘অধিক মূল্য দিলেও পাইবে না— এ মলমল এখন আমার।’
ডা-গামা সেদিকে কর্ণপাত না করিয়া প্রভাকরকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, ‘আমি দ্বিগুণ মূল্য দিব।’
মির্জা দাউদ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ‘শতগুণ দিলেও আর পাইবে না।’
ডা-গামা বিদ্যুদ্বেগে মির্জা দাউদের দিকে ফিরিল। কর্কশকণ্ঠে কহিল, ‘মূর, চুপ কর্— আমি মালের মালিকের সহিত কথা কহিতেছি।’
প্রভাকর বুদ্ধিমান, মির্জা দাউদ তাহার পুরাতন খরিদ্দার, অথচ এই ব্যক্তিকে সে চেনেও না। সে বলিল, ‘উনিই এখন মালের মালিক, আমি কেহ নই। উনি যদি আপনাকে বিক্রয় করিতে ইচ্ছা করেন, করিতে পারেন।’
ডা-গামার অশিষ্ট কথায় কিন্তু মির্জা দাউদের মুখ ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি তিক্তকণ্ঠে কহিলেন, ‘ডা-গামা, পূর্বেও বুঝিয়াছিলাম, কিন্তু আজ তোর প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়িল। ব্যবসায় তোর ভান মাত্র, তুই তস্কর। নচেৎ অনুচিত মূল্য দিয়া বাণিজ্য নষ্ট করিবি কেন?’
আহত ব্যাঘ্রের মতো গর্জন করিয়া ভাস্কো-ডা-গামা নিজ কটি হইতে তরবারি বাহির করিল। দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া ক্রোধকষায়িত নেত্রে কহিল, ‘স্পর্ধিত মূর, আজ তোর রক্তে তরবারির কলঙ্ক ধৌত করিব।’
মির্জা দাউদও তরবারি নিষ্কোষিত করিয়া কহিলেন, ‘বর্বর ফিরিঙ্গী, আজ তোকে জাহান্নামে পাঠাইব।’
মুহূর্তমধ্যে ব্যগ্র জনতা চতুর্দিকে সরিয়া গিয়া মধ্যে বৃত্তাকৃতি স্থান যুযুৎসুদের জন্য ছাড়িয়া দিল। শান্তিপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হইলেও এরূপ ব্যাপার কালিকটে একান্ত বিরল নহে। কলহ যখন তরবারি পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন তাহা ভঞ্জন করিবার প্রয়াস যে শুধু নিষ্ফল নহে, অত্যন্ত বিপজ্জনক, তাহা কাহারও অবিদিত ছিল না। তাই সকলে সরিয়া দাঁড়াইয়া অস্ত্রদ্বারা উভয়পক্ষকে বিবাদের মীমাংসা করিবার সুবিধা করিয়া দিল।
ভাস্কো-ডা-গামা ও মির্জা দাউদ প্রথম দৃষ্টি-বিনিময়েই পরস্পরকে যে বিষদৃষ্টিতে দেখিয়াছিলেন, সেই বিষ উভয়ের অন্তরে সঞ্চিত হইয়া আজ সামান্য সূত্র ধরিয়া দুর্নিবার বিরোধরূপে আত্মপ্রকাশ করিল। এ কলহ যে একজন না মরিলে নিবৃত্ত হইবে না, তাহা উভয়েই মনে মনে বুঝিলেন।
নিস্তব্ধ জনতার কেন্দ্রস্থলে অসিধারী দুই জন দাঁড়াইলেন। ভাস্কো-ডা-গামা বিশালকায়, প্রস্তরের মতো কঠিন, হস্তীর মতো বলশালী। মির্জা দাউদ অপেক্ষাকৃত কৃশ ও খর্ব; কিন্তু বিষধর কালসর্পের মতো ক্ষিপ্র, তেজস্বী ও প্রাণসার। ভাস্কো-ডা-গামার তরবারি বেত্রবৎ ঋজু, তীক্ষ্ণাগ্র; মির্জা দাউদের তরবারি ঈষৎ বক্র ও ক্ষুরধার। নগ্ন কৃপাণহস্তে ক্ষণকালের জন্য দুই জন পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিয়া লইলেন। তারপর ঝড়ের মতো তরবারিকে অগ্রবর্তী করিয়া ভাস্কো-ডা-গামা আক্রমণ করিল।
কিন্তু ডা-গামার তরবারি মির্জা দাউদের অঙ্গ স্পর্শ করিবার পূর্বেই তিনি ক্ষিপ্রহস্তে নিজ তরবারি দ্বারা তাহা অপসারিত করিয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন এবং পরক্ষণেই তাঁহার বক্র অসি বিদ্যুতের মতো একবার ডা-গামার জানু দংশন করিয়া ফিরিয়া আসিল। ডা-গামা পিছু হটিয়া আত্মরক্ষা করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। তাহার জানুর চর্মাবরণ ধীরে ধীরে রক্তে ভিজিয়া উঠিল।
ডা-গামা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করিল না; কিন্তু সাবধান হইল। সংযত ও সতর্কভাবে অসিচালনা করিতে লাগিল। সে বুঝিল যে, বিপক্ষকে অবজ্ঞা করিলে চলিবে না। মির্জা দাউদের অসি-কৌশল অসাধারণ, তাঁহার সম্মুখে দ্বিতীয়বার ভুল করিলে আর তাহা সংশোধনের অবকাশ থাকিবে না।
এদিকে মির্জা দাউদও বুঝিলেন যে, ডা-গামা অসি-কৌশলে তাঁহার সমতুল্য, কিন্তু তাঁহার অপেক্ষা দ্বিগুণ বলশালী। আবার সে তাঁহার মতো ক্ষিপ্রগামী ও লঘুদেহ নয় বটে, কিন্তু তরবারি ঋজু এবং দীর্ঘ— মির্জা দাউদের তরবারি বক্র এবং খর্ব। তাঁহাদের যুদ্ধরীতিও সম্পূর্ণ পৃথক। এ ক্ষেত্রে, মির্জা দাউদ দেখিলেন, ডা-গামার জয়ের সম্ভাবনাই অধিক। মির্জা দাউদ অত্যন্ত সাবধানে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।
সর্প ও নকুলের যুদ্ধে যেমন উভয়ে উভয়ের চক্ষুতে চক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করিতে থাকে এবং সুযোগ পাইবামাত্র তীরবেগে আক্রমণ করিয়া আবার স্বস্থানে ফিরিয়া আসে, ডা-গামা ও মির্জা দাউদও সেইরূপে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। অস্ত্রে অস্ত্রে প্রতিরুদ্ধ হইয়া মুহুর্মুহুঃ ঝনৎকার উঠিতে লাগিল, চঞ্চল অসিফলকে সূর্যকিরণ পড়িয়া তড়িৎরেখার মতো জ্বলিয়া উঠিতে লাগিল। নিস্পন্দ জনব্যূহ সহস্রচক্ষু হইয়া এই অদ্ভুত যুদ্ধ দেখিতে লাগিল।
যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে মির্জা দাউদ বাক্যশূলে ডা-গামাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন, ‘ফিরিঙ্গী দস্যু, চাহিয়া দেখ, তোর রক্ত মানুষের রক্তের মতো লাল নয়, শয়তানের মতো নীল! খ্রীস্টান কুত্তা, এখনও ক্ষমা প্রার্থনা কর্— তোর প্রাণ ভিক্ষা দিব।’
ডা-গামা কোনও উত্তর না দিয়া নিঃশব্দে যুদ্ধ করিতে লাগিল। শ্লেষ করিয়া মির্জা দাউদ যে তাহার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাইবার চেষ্টা করিতেছেন, চতুর ডা-গামা তাহা বুঝিয়াছিল।
যুদ্ধ ক্রমে আরও প্রখর ও তীব্র হইয়া উঠিল। দুই যোদ্ধারই ঘন ঘন শ্বাস বহিল। সর্বাঙ্গে ঘাম ঝরিতে লাগিল; কিন্তু উভয়েই যেন এক অদৃশ্য বর্মে আচ্ছাদিত। ডা-গামার তরবারি বার বার মির্জা দাউদের কণ্ঠের নিকট হইতে, বক্ষের নিকট হইতে ব্যর্থ হইয়া ফিরিয়া গেল, মির্জা দাউদের অসি ডা-গামাকে ঘিরিয়া এক ঝাঁক ক্রুদ্ধ মৌমাছির মতো গুঞ্জন করিয়া ফিরিতে লাগিল, কিন্তু কোথাও হুল ফুটাইতে পারিল না।
সহসা এক সময় ডা-গামা সভয়ে দেখিল যে, সে ঘুরিতে ঘুরিতে একেবারে ঘাটের কিনারায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, আর এক পা পিছাইলেই সমুদ্রের জলে পড়িয়া যাইবে। মির্জা দাউদ তাহার মুখের ভাব দেখিয়া উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। বিদ্রূপ-বিষাক্ত কণ্ঠে কহিলেন, ‘ফিরিঙ্গী, আজ তোকে ঐ সমুদ্রের জলে চুবাইব। তারপর মরা ইঁদুরের মতো তোর রাজা ইম্যানুয়েলের কাছে তোকে বকশিশ পাঠাইয়া দিব।’
এতক্ষণে মির্জা দাউদ যাহা চাহিতেছিলেন তাহাই হইল— ভাস্কো-ডা-গামা ধৈর্য হারাইল। উন্মত্ত বন্যমহিষের মতো গর্জন করিয়া অসি ঊর্ধ্বে উত্তোলন করিয়া সে মির্জা দাউদকে আক্রমণ করিল। ইচ্ছা করিলে মির্জা দাউদ অনায়াসে ডা-গামাকে বধ করইতে পারিতেন; কিন্তু তাহা না করিয়া তিনি উল্টা পিঠ দিয়া ডা-গামার দক্ষিণ মুস্তিতে দারুণ আঘাত সঙ্গে সঙ্গে তাহার তরবারি হস্তমুক্ত হইয়া ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হইয়া দূরে গিয়া পড়িল। অকস্মাৎ অস্ত্রহীন হইয়া ডা-গামা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।
ডা-গামার দুই জন সহচর এতক্ষণ সকলের সঙ্গে দাঁড়াইয়া যুদ্ধ দেখিতেছিল। প্রভুর অপ্রত্যাশিত বিপৎপাতে তাহারা সাহায্য করিতে অগ্রসর হইল। কিন্তু দুই পদ অগ্রসর হইবার পূর্বেই, অতি বিশাল-কলেবর নিকষকৃষ্ণ হাবসী জাম্বো মাস্তুলের ন্যায় দুই হস্ত বাহির করিয়া তাহাদের কেশ ধরিয়া ফিরাইয়া আনিল এবং নিরতিশয় শুভ্র দুইপাটি দন্ত বিনিষ্ক্রান্ত করিয়া যাহা বলিল, তাহার একটি বর্ণও তাহারা বুঝিতে না পারিলেও জাম্বোর মনোগত অভিপ্রায় অনুধাবন করিতে তাহাদের বিন্দুমাত্র ক্লেশ হইল না।
মির্জা দাউদ তরবারির ধার ডা-গামার কণ্ঠে স্থাপন করিয়া কহিলেন, ‘ডা-গামা, নতজানু হ, নহিলে তোকে বধ করিব।’
ডা-গামা নতজানু হইল না— বাহুদ্বয়ে বক্ষ নিবদ্ধ করিয়া বিকৃতমুখে হাস্য করিয়া কহিল, ‘মূর, নিরস্ত্রকে হত্যা করা তোদের স্বভাব বটে।’
মির্জা দাউদ কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, ‘ভালো, তোকে ছাড়িয়া দিব— কিন্তু প্রতিজ্ঞা কর্—’
ডা-গামা কহিল, ‘আমি কোনও প্রতিজ্ঞা করিব না, তোর যাহা ইচ্ছা কর্।’
মির্জা দাউদ বলিলেন, ‘শপথ কর্ যে, আজ হইতে সপ্তাহমধ্যে সদলবলে এ দেশ ছাড়িয়া যাইবি, আর কখনও ফিরিবি না।’
ডা-গামা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল, কহিল, ‘মূর, তুই অতি নির্বোধ! আমি শপথ করিব না, আমাকে বধ কর্। আমার রক্তে কালিকটের মাটি ভিজিলে হিন্দে ইম্যানুয়েলের জয়ধ্বজা সহজে রোপিত হইবে।’
মির্জা দাউদ হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘এতদিনে নিজ মুখে নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলি! কিন্তু তাহা হইতে দিব না। ইম্যানুয়েলের জয়ধ্বজা কালিকটে রোপিত হইবে না। কালিকট চিরদিন পৃথিবীর সমস্ত জাতির মিলনক্ষেত্র হইয়া থাকিবে। প্রতিজ্ঞা কর্, নচেৎ—’
ডা-গামা ভ্রূকুটি করিয়া কহিল, ‘নচেৎ?’
‘নচেৎ পোর্তুগালে ফিরিয়া যাইতে একটি প্রাণীও জীবিত রাখিব না। তোদের জাহাজ পুড়াইয়া এই একশত ত্রিশ জন লোককে কাটিয়া সমুদ্রের জলে ভাসাইয়া দিব।’
ডা-গামা স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কোনও উত্তর দিল না।
মির্জা দাউদ পুনশ্চ কহিলেন, ‘ডা-গামা, এখনও শপথ কর্— তোর ধর্মের উপর বিশ্বাস করিয়া ছাড়িয়া দিব। — ভাবিয়া দেখ, তোরা মরিলে কে তোর দেশবাসী ভিক্ষুকদের পথ দেখাইয়া লইয়া আসিবে?’
ডা-গামা অবরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, ‘শপথ করিতেছি—’
মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘তোদের যেশুর জননী মেরীর নামে শপথ কর্।’
ডা-গামা তখন কম্পিত ক্রোধ-জর্জরিত কণ্ঠে শপথ করিল যে, সপ্তাহমধ্যে এদেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে এবং আর কখনও ভারতভূমির উপর পদার্পণ করিবে না।
ডা-গামাকে ছাড়িয়া দিয়া মির্জা দাউদ ও আরও প্রধান প্রধান নাগরিকগণ সামরীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। সমস্ত বিবরণ আদ্যোপান্ত শুনিয়া সামরী কহিলেন, ‘যত দিন উহারা আমার রাজ্যের কোনও প্রকাশ্য অনিষ্ট না করিতেছে, ততদিন শুধু সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া আমি উহাদিগকে রাজ্য হইতে বিতাড়িত করিতে পারি না। তবে কেহ যদি তোমাদের ব্যক্তিগত অনিষ্ট করিয়া থাকে, তোমরা প্রতিশোধ লইতে পার, আমি বাধা দিব না।’
সকলে সামরীকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন যে, ইহারা অত্যন্ত কূটবুদ্ধি ও যুদ্ধনিপুণ, তাহাদের কামান, বন্দুক, গোলাগুলি আছে; সুযোগ পাইলেই তাহারা বাহুবলে এই সোনার রাজ্য অপূর্ব অমরাবতী গ্রাস করিবে।
সামরী হাসিয়া উত্তর করিলেন, ‘আমার সৈন্যবল নাই সত্য, কিন্তু সামরীবংশ পঞ্চদশ শতাব্দী ধরিয়া এই মসলন্দে রাজত্ব করিতেছে— কেহ তাহাকে রাজ্যভ্রষ্ট করে নাই। আমার সিংহাসন সুশাসন ও জনপ্রিয়তার উপর প্রতিষ্ঠিত। উহারা আমার কি করিতে পারে?’
সকলে নিরাশ হইয়া ফিরিয়া গেলেন।
সপ্তাহ পরে স্বর্ণপত্রে লিখিত সামরীর সন্ধিলিপি মস্তকে ধারণ করিয়া ভাস্কো-ডা-গামা অনুচরসহ জাহাজে উঠিল।
মির্জা দাউদ বন্দর হইতে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ডা-গামা, শপথ স্মরণ রাখিও।’
একটা ক্রূর হাস্য ডা-গামার মুখের উপর খেলিয়া গেল, মির্জা দাউদের প্রতি স্থিরদৃষ্টি রাখিয়া সে বলিল, ‘মির্জা দাউদ, আবার আমাদের সাক্ষাৎ হইবে।’
মির্জা দাউদ হাসিয়া উত্তর দিলেন, ‘সম্ভব নয়। আমি মুসলমান— বেহেস্তে যাইব।’
ডা-গামা দুই চক্ষুতে অগ্নিবর্ষণ করিয়া কহিল, ‘ইহজন্মেই আবার আমাদের সাক্ষাৎ হইবে।’
তারপর ধীরে ধীরে তাহার তিনটি জাহাজ বন্দরের বাহির হইয়া গেল।
চারি বৎসর অতীত হইয়াছে। এই চারি বৎসরে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তাহা এই কাহিনীর অন্তর্গত না হইলেও সংক্ষেপে বর্ণিত হইল। ভাস্কো-ডা-গামা কালিকট ত্যাগ করিবার দুই বৎসর পরে আবার পোর্তুগীজ জাহাজ ভারতবর্ষে আসিল। এবার পোর্তুগীজদের অধিনায়ক আল্ভারেজ কেব্লার নামক একজন পাদ্রী এবং তাঁহার অধীনে নয়খানি জাহাজ। পাদ্রী আল্ভারেজ কালিকট বন্দরে প্রবেশ করিয়াই জাহাজ হইতে নগরের উপর গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিলেন। ফলে বহু নাগরিকের প্রাণনাশ হইল, অনেকে আহত হইল এবং কয়েকটি অট্টালিকা চূর্ণ হইয়া গেল। এইরূপে রাজা-প্রজার মনে ভীতি ও কর্তব্যজ্ঞান সঞ্চারিত করিয়া পোর্তুগীজরা আবার ভারতভূমিতে পদার্পণ করিল। রাজা সামরী আগন্তুকদিগকে সম্মান দেখাইলেন ও তাহাদের বাসের জন্য নগরের বাহিরে ভূমিদান করিয়া কুঠি-নির্মাণের অনুমতি দিলেন। কিন্তু পোর্তুগীজদিগের এই অহেতুক জিঘাংসা ও নিষ্ঠুরতায় কালিকটের জনসাধারণের মন তাহাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষে পূর্ণ হইয়া উঠিল।
তারপর কলহ বাধিতে বিলম্ব হইল না। দাম্ভিক বিদেশীদের প্রতি যাহাদের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ জন্মিয়াছিল, তাহারা ঝগড়া বাধাইয়া রক্তপাত করিতে লাগিল। পোর্তুগীজরাও জবাব দিল। ক্রমে ভিতরে বাহিরে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। একদিন নাগরিকগণ পোর্তুগীজদের কুঠিতে অগ্নিসংযোগ করিয়া সত্তর জন্য ফিরিঙ্গীকে হত্যা করিল। অবশিষ্ট পলাইয়া জাহাজে উঠিল এবং জাহাজ হইতে গোলা মারিয়া নগরের এক অংশে আগুন লাগাইয়া দিল। তারপর সেই যে তাহারা কালিকট ছাড়িয়া গেল, দুই বৎসরের মধ্যে আর ফিরিয়া আসিল না।
কালিকটের রাজা-প্রজা নিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল— আপদ দূর হইয়াছে, আর ফিরিবে না।
শেষোক্ত ঘটনার বৎসরেক পরে মির্জা দাউদ স্ত্রী-কন্যা লইয়া তাঁহার জন্মভূমি মরক্কো দেশে গেলেন। সেখানে কিছু দিন অবস্থানের পর বৃদ্ধ পিতাকে সঙ্গে লইয়া মক্কাশরীফ দর্শন করিলেন। তারপর তীর্থ-দর্শন শেষ করিয়া সকলে মিলিয়া কালিকটে প্রত্যাবর্তন করিতেছিলেন।
কথা ছিল, মক্কাশরীফ হইতে মির্জা দাউদ কালিকটে আসিবেন, তাঁহার পিতা মরক্কো দেশে ফিরিয়া যাইবেন। কিন্তু পিতা স্থবির ও জরাগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন— অধিক দিন পরমায়ু নাই। পুনরায় মরক্কো যাইবার সুযোগ হয়তো শীঘ্র হইবে না, ততদিন পিতা বাঁচবেন কি না, এই সকল বিবেচনা করিয়া মির্জা দাউদ তাঁহাকে ছাড়িলেন না, নিজের সঙ্গে কালিকটে লইয়া চলিলেন। বৃদ্ধও ঈদের চাঁদের মতো সুন্দর ক্ষুদ্র নাতিনীটিকে দেখিয়া ভুলিয়াছিলেন— তিনিও বিশেষ আপত্তি করিলেন না।
মক্কাশরীফ দর্শনের সময় কালিকটের কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সহিত মির্জা দাউদের সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তিনি তাঁহাদের বলিলেন, ‘আপনারাও কালিকটে ফিরিতেছেন— আমার জাহাজেই চলুন।’ তাঁহারা আনন্দিত হইয়া সপরিবারে মির্জা দাউদের জাহাজে আশ্রয় লইলেন।
মক্কা হইতে কালিকট তিন মাসের পথ। জাহাজ যথাসময়ে আরব উপকূল ছাড়িয়া লোহিত সাগর পার হইল। ক্রমে পারস্য উপসাগর উত্তীর্ণ হইয়া ভারত সমুদ্রে আসিয়া পড়িল।
মহাসাগরের বুকের উপর বায়ু-বর্তুলিত পালের ভরে মির্জা দাউদের তরণী দক্ষিণাভিমুখে চলিয়াছে। চারিদিকে অতল জল দুলিতেছে, ফুলিতেছে— লক্ষকোটিখণ্ডে বিচূর্ণিত দর্পণের মতো রবিকরে প্রতিফলিত হইতেছে। পূর্ণ দিগন্তরেখা অখণ্ডভাবে তরুণীকে চারিদিকে বেষ্টন করিয়া আছে। কেবল বহুদূরে পূর্বচক্রবালে মেঘের মতো কচ্ছভূমির তটবনানী ঈষন্মাত্র দেখা যাইতেছে।
জাহাজে যে অভিজ্ঞ আড়কাঠি আছে, সে বলিয়াছে যে বায়ুর দিক এবং গতি পরিবর্তিত না হইলে অষ্টাহমধ্যে কালিকটে পৌঁছানো যাইবে। আশু যাত্রাশেষ কল্পনা করিয়া আরোহীরা সকলেই হৃষ্ট হইয়া উঠিয়াছেন।
সেদিন শুক্রবার, সূর্য ক্রমে মধ্যগগন অতিক্রম করিয়া পশ্চিমে ঢলিয়া পড়িল। জাহাজের বিস্তৃত ছাদের উপর মির্জা দাউদ, তাঁহার পিতা ও আর আর পুরুষগণ দ্বিপ্রাহরিক নমাজ প্রায় শেষ করিয়াছেন। জাহাজের নিয়ামক সম্মুখে স্থিরদৃষ্টি করিয়া হালের নিকট নিশ্চলভাবে দাঁড়াইয়া আছে। চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু তরণীর বেগবিদীর্ণ জলরাশি ফেন-হাস্যে কল্কল্ করিতেছে।
এমন সময় আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করিয়া মেঘগর্জনের ন্যায় ভীষণ শব্দে সকলে চমকিত হইয়া দেখিলেন, পশ্চাৎ হইতে পাঁচখানা ফিরিঙ্গী জাহাজ সমস্ত পাল তুলিয়া দিয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে অগণ্য দাঁড় বাহিয়া যেন বহুপদবিশিষ্ট অতিকায় জলজন্তুর মতো ছুটিয়া আসিতেছে। অতর্কিতে এত নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে যে, জাহাজের মানুষগুলাকে পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। এই আকস্মিক দৃশ্য দেখিয়া সকলেই বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো সেই দিকে নিষ্পলকভাবে তাকাইয়া রহিলেন।
বিস্মিত হইবার মতো দৃশ্য বটে! দুই দণ্ড পূর্বেও চতুর্দিকে কোথাও একটা ভেলা পর্যন্ত ছিল না। সহসা সমুদ্রের কোন্ অতল গুহা হইতে এই পাঁচটা ভীষণ দৈত্য বাহির হইয়া আসিল? মির্জা দাউদের মন বলিল, আজ আর রক্ষা নাই। কামান দাগিয়া ইহারা নিজ আগমনবার্তা ঘোষণা করিয়াছে— আজ তাহারা দয়ামায়া দেখাইবে না। মূরের রক্তে হিংসা চরিতার্থ করিবার আজ তাহাদের সুযোগ মিলিয়াছে।
এরূপ ঘটনা প্রতীচ্যখণ্ডের সমুদ্রবক্ষে পূর্বে কখনও ঘটে নাই। স্মরণাতীত কাল হইতে এইপথে শত শত তরণী অবাধে যাতায়াত করিয়াছে। চীন হইতে কাস্পীয় হ্রদ পর্যন্ত কেহ কখনও হিংস্রিকা বা বোম্বেটের নাম পর্যন্ত শুনে নাই। স্থলপথ অপেক্ষা জলপথ অধিক নিরাপদ ছিল বলিয়াই জলবাণিজ্য এত প্রসার লাভ করিয়াছিল। কিন্তু আজ যুগযুগান্তরের বাহিতপণ্য অব্যাহত পথে স্বার্থান্ধ ফিরিঙ্গী তাহার অগ্নি-অস্ত্র লইয়া পথরুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইল।
কিন্তু যুদ্ধদান করা মির্জা দাউদের পক্ষে অসম্ভব। তাঁহার জাহাজ তীর্থযাত্রীর জাহাজ, তাহাতে বারুদ-গোলা কিছুই নাই। আছে কেবল কতকগুলি অসহায় যুদ্ধানভিজ্ঞ ধর্মপরায়ণ তীর্থযাত্রী এবং তদপেক্ষাও অসহায় কতকগুলি নারী ও শিশু। এরূপ অবস্থায় পাঁচখানা রণপোতের সঙ্গে যুদ্ধ করা বাতুলতা ভিন্ন আর কিছুই নহে। এক উপায় পলায়ন; কিন্তু মির্জা দাউদের জাহাজ কেবল পালের ভরে চলে— বিপক্ষের পাল দাঁড় দুই আছে; এ ক্ষেত্রে পলায়নও সাধ্যাতীত।
মির্জা দাউদ ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে চিন্তা করিলেন। একবার আকাশের দিকে দৃষ্টি করিলেন। আকাশ নির্মেঘ— বেলা প্রায় তৃতীয় প্রহর। রাত্রি হইতে বিলম্ব আছে। তিনি নাবিককে ডাকিয়া সমস্ত পাল তুলিয়া প্রাণপণে জাহাজ ছুটাইতে আজ্ঞা দিলেন।
কিন্তু এ আজ্ঞা পালিত হইতে না হইতে জলদস্যুদিগের পাঁচখানা জাহাজ হইতে একসঙ্গে কামান ডাকিল। একটা গোলা বড় পালের ভিতর ছিদ্র করিয়া জাহাজের পরপারে গিয়া সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করিল, অন্যগুলা জাহাজের চারিদিকে জলের উপর পড়িল। কোনটাই কিন্তু জাহাজকে গুরুতর জখম করিতে পারিল না।
জাহাজের পুরুষযাত্রীদের মুখ শুকাইল। নিম্ন হইতে ভীত শিশু ও নারীগণের আর্তস্বর ও ক্রন্দন উঠিল। দন্তে দন্ত চাপিয়া মির্জা দাউদ নাবিকদের হুকুম দিলেন, ‘যতক্ষণ পার, জাহাজ চালাও, ফিরিঙ্গী দস্যু্র হাতে ধরা দিব না।’
এমন সময় মির্জা দাউদের চারি বৎসরের কন্যা হাঁপাইতে হাঁপাইতে উপরে উঠিয়া আসিয়া পিতার জানু জড়াইয়া ধরিল। বলিল, ‘বাবা, মা তোমাকে ডাকছেন।’— বলিয়া পিতার মুখের দিকে চোখ তুলিয়াই উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল, ‘বাবা, আমার বড় ভয় করছে।’
মির্জা দাউদ কন্যাকে দুই হাতে তুলিয়া বুকে চাপিয়া ধরিলেন। তাহার কানে কানে বলিলেন, ‘হারুণা, কাঁদিস না। তুই মূরের কন্যা— তোর কিসের ভয়? আজ আমরা সকলে একসঙ্গে বেহেস্তে যাইব।’
কন্যাকে পিতার ক্রোড়ে দিয়া মির্জা দাউদ নীচে নামিয়া গেলেন। সম্মুখেই আকুলনয়না স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ হইল।
নিজ কটি হইতে ক্ষুদ্র মাণিক্যখচিত ছুরিকা পত্নীর হস্তে দিয়া সংযত কণ্ঠে কহিলেন, ‘শালেহা, বোধ হয় আজ অন্তিমকাল উপস্থিত হইয়াছে। বোম্বেটে জাহাজ পিছু লইয়াছে। যদি উহারা এ জাহাজে পদার্পণ করে, এ ছুরি নিজের উপর ব্যবহার করিও। তার পূর্বে কিছু করিও না। আর অন্যান্য স্ত্রীলোকদের আশ্বাস দিও, অকারণে ভয় না পায়। চলিলাম।’— এই বলিয়া মুহূর্তকালের জন্য পত্নীর মস্তক বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া মির্জা দাউদ উপরে ফিরিয়া গেলেন।
উপরে উঠিয়া দেখিলেন, এই অল্পকাল মধ্যে দস্যুজাহাজগুলি অর্ধচন্দ্রাকারে তাঁহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলিয়াছে। এত নিকটে আসিয়া পডিয়াছে যে, তাহাদের কণ্ঠস্বর পর্যন্ত স্পষ্ট শুনা যাইতেছে। মির্জা দাউদ দেখিলেন, প্রত্যেক জাহাজ হইতে কামানের মুখ তাঁহাদের প্রতি লক্ষ্য করিয়া আছে। এত নিকট হইতে এবার আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হইবে না।
মির্জা দাউদের পিতা আসিয়া বলিলেন, ‘দাউদ, আর উপায় নাই। ধরা না দিলে জাহাজডুবি হইয়া মরিতে হইবে।’
মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘ধরা দিলেও নিশ্চয় মরিতে হইবে, তাহার অপেক্ষা ডুবিয়া মরাই শ্রেয়ঃ।’
পিতা বলিলেন, ‘সে কথা ঠিক। কিন্তু সঙ্গে শিশু ও স্ত্রীলোক রহিয়াছে। তাহাদের রক্ষা করিবার চেষ্টা করা উচিত নহে কি?’
মির্জা দাউদ কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, ‘কিন্তু দস্যুরা শিশু ও নারীদের দয়া করিবে কি? বরঞ্চ—’
পিতা কহিলেন, ‘ফিরিঙ্গী অর্থলোভী, অর্থের বিনিময়ে তাহাদের ছাড়িয়া দিতে পারে।’
অন্যান্য পুরুষগণও বৃদ্ধের বাক্য সমর্থন করিলেন। মির্জা দাউদ তখন কহিলেন, ‘ভালো, চেষ্টা করিয়া দেখা যাক্।’
ঠিক এই সময় একখানা জাহাজ হইতে আবার কামান দাগিল। এবার গোলার আঘাতে প্রকাণ্ড মাস্তুল পালসুদ্ধ মড়মড় শব্দে ভাঙিয়া পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে স্তূপীকৃত পালের কাপড়ে আগুন লাগিয়া গেল।
রমণীরা এতক্ষণ পর্যন্ত আব্রু রক্ষা করিয়া জাহাজের খোলের মধ্যেই ছিল, কিন্তু এবার আর লজ্জার বাধা মানিল না। সন্তানবতীরা সন্তান কোলে লইয়া, যাহাদের সন্তান নাই— তাহারা যে যেমনভাবে ছিল, উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে উপরে উঠিয়া আসিল। সকলেই ভয়বিহ্বলা। কেহ ঊর্ধ্বমুখী নতজানু হইয়া ঈশ্বরের নিকট প্রাণের আকুল আবেদন জানাইতে লাগিল, কেহ শিশু-সন্তানকে দুই হাতে উচ্চে তুলিয়া ধরিয়া জলদস্যুদিগকে দেখাইয়া তাহাদের কৃপা আকর্ষণের চেষ্টা করিতে লাগিল।
এদিকে পালের আগুন ক্রমে বাড়িয়া উঠিয়া জাহাজময় ব্যাপ্ত হইবার উপক্রম করিল। পুরুষগণ তখন সমুদ্র হইতে জল তুলিয়া অগ্নিনির্বাপণের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বহু কষ্টে অনেক জল ঢালিবার পর অগ্নি নির্বাপিত হইল। তখনকার মতো জাহাজ রক্ষা পাইল।
একখানা ফিরিঙ্গী জাহাজ মির্জা দাউদের জাহাজের একেবারে পাশে আসিয়া পড়িয়াছিল। মধ্যে মাত্র একশত গজের ব্যবধান। কামান ঘুরাইয়া তাহারা আবার গোলা ছুঁড়িবার উদ্যোগ করিতেছিল। তখন মির্জা দাউদ উচ্চকণ্ঠে তাহাদিগকে ডাকিয়া কহিলেন, ‘গোলা ছুঁড়িও না— আমরা আত্মসমর্পণ করিতেছি।’
কামান ছাড়িয়া তাহারা উল্লাসধ্বনি করিয়া উঠিল। তাহাদের মধ্যে একজন— বোধ হয়, সেই প্রধান নাবিক— কহিল, ‘তোমাদের জাহাজে যত অস্ত্র আছে, জলে ফেলিয়া দাও— নহিলে কামান ছুঁড়িব।’
মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কোনও অস্ত্র নাই। ইহা তীর্থযাত্রীর জাহাজ। যাহা কিছু ধনরত্ন সঙ্গে আছে, দিতেছি— আমাদের ছাড়িয়া দাও।’
এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় আক্রমণকারী জাহাজের ভিতর হইতে একজন পুরুষ উপরে উঠিয়া আসিল। অতি মহার্ঘ বেশভূষায় সজ্জিত বিশালদেহ এক পুরুষ। তাহাকে দেখিয়া মির্জা দাউদের বুকের রক্ত সহসা যেন স্তব্ধ হইয়া গেল। চিনিলেন— ভাস্কো-ডা-গামা। তাহার মুখের উপর কৃষ্ণ কাল-সর্পের মতো হিংসা যেন কুণ্ডলিত হইয়া আছে। মির্জা দাউদকে দেখিয়া ভাস্কো-ডা-গামা হাসিল। মাথার কঙ্কপত্রযুক্ত টুপি খুলিয়া তাহা আভূমি সঞ্চারিত করিয়া বলিল, ‘মির্জা দাউদ, আজ সুপ্রভাত! স্মরণ আছে, বলিয়াছিলাম আবার দেখা হইবে?’
মির্জা দাউদের মুখ দিয়া সহসা কথা বাহির হইল না। ভাস্কো-ডা-গামা তখন পূর্বোক্ত প্রধান নাবিকের দিকে ফিরিয়া কঠোর কণ্ঠে কহিল, ‘কাপ্তেন, কামান নীরব কেন? আমার হুকুম কি ভুলিয়া গিয়াছ?’
ভীত কাপ্তেন বলিল, ‘প্রভু, উহারা ধনরত্ন দিয়া পরিত্রাণের আর্জি করিতেছে।’
দুই জাহাজ ক্রমে আরও নিকটবর্তী হইতেছিল। ডা-গামা আবার মির্জা দাউদের দিকে ফিরিয়া শ্লেষতীক্ষ্ণ কণ্ঠে কহিল, ‘মূর, ধনরত্ন দিয়া প্রাণভিক্ষা চাও?’
মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘নিজের প্রাণভিক্ষা চাহি না। আমাদের সর্বস্ব লইয়া বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের ছাড়িয়া দাও।’
ডা-গামা শত্রুর লাঞ্ছনার রস অল্প অল্প করিয়া পান করিতে লাগিল, কহিল, ‘বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের ছাড়িয়া দিব? কিন্তু তাহাতে আমাদের লাভ? বরঞ্চ তোমরা যুবতী নারীদের আমাদের নিকট পাঠাইয়া দিয়া পুরুষগণ প্রাণ বাঁচাইতে পার। আমাদের জাহাজে স্ত্রীলোকের কিছু প্রয়োজন হইয়াছে। আমার নিজের জন্য নয়— খালাসীদের জন্য। আমার নারীতে রুচি নাই।’
ক্রোধে অপমানে মির্জা দাউদের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। বুঝিলেন, ডা-গামা তাঁহাকে লইয়া খেলা করিতেছে। অতি কষ্টে আত্মদমন করিয়া কহিলেন, ‘ডা-গামা, তোমার প্রস্তাবের উত্তর দিতে ঘৃণা হইতেছে। যদি অভিরুচি হয়, আমাদের সহিত যাহা মূল্যবান সামগ্রী ও স্বর্ণ রৌপ্য আছে, তাহা লইয়া আমাদের নিস্কৃতি দাও। নতুবা কিছুই পাইবে না।’
ডা-গামা ভ্রূকুটি করিয়া কহিল, ‘কিছুই পাইব না, তার অর্থ?’
মির্জা দাউদ কহিলেন, ‘তার অর্থ— জোর করিলে আমাদের মারিয়া ফেলিতে পরিবে, কিন্তু কিছু লাভ করিতে পরিবে না। যদি আমার জাহাজে চড়াও করিবার চেষ্টা কর, তক্তা খুলিয়া জাহাজ ডুবাইয়া দিব।’
মির্জা দাউদের কথা শুনিয়া ডা-গামার ভ্রূকুটি গভীরতর হইল, সে নতমুখে চিন্তা করিতে লাগিল।
এদিকে জাহাজের মাস্তুল ভাঙিয়া যাওয়ায় মির্জা দাউদ পঙ্কে নিবদ্ধ হস্তীর মতো চলচ্ছক্তিহীন। ফিরিঙ্গীর পাঁচখানা জাহাজ ধীরে ধীরে তিন দিক হইতে ঘিরিয়া আরও নিকটবর্তী হইতে লাগিল।
মির্জা দাউদ অধীর হইয়া কহিলেন, ‘ডা-গামা, যাহা করিবে, শীঘ্র কর। আমাদের সহিত বারশত তোলা সোনা আছে— আরও অন্যান্য মহার্য বস্তু আছে; যদি পাইতে ইচ্ছা কর, শীঘ্র বল। অধিক বিলম্ব করিলে সব হারাইবে।’
ডা-গামা বলিল, ‘রমণীদের দিবে না?’
মির্জা দাউদ গর্জিয়া উঠিলেন, ‘না, দিব না। আমরা স্ত্রী-কন্যার ব্যবসা করি না।’
ডা-গামা কহিল, ‘মূর, এখনও তোর স্পর্ধা কমিল না!— ভালো, অর্থই লইব। তোমার জাহাজে যাহা কিছু আছে, ভেলায় করিয়া আমাড় জাহাজে পাঠাও।’
‘যাহা কিছু আছে, পাইলে ছাড়িয়া দিবে?’
‘দিব।’
‘তোমাকে বিশ্বাস কি?’
‘আমি মিথ্যা কথা বলি না।’
‘মিথ্যাচারি, শপথ করিয়াছিলে কখনও হিন্দে পদার্পণ করিবে না, তাহার কি হইল?’
ডা-গামা হাসিয়া বলিল, ‘এখনও হিন্দে পদার্পণ করি নাই।’
মির্জা দাউদ তখন অন্যান্য সকলের সহিত পরামর্শ করিলেন। সকলেই কহিলেন, উহাদের কবলে যখন পড়িয়াছি, তখন উহাদের কথায় বিশ্বাস করা ভিন্ন উপায় নাই। অগত্যা মির্জা দাউদ সম্মত হইলেন।
তখন এক ভেলা প্রস্তুত করিয়া তাহারই উপর যাহা কিছু ছিল, এমন কি, নারীগণের অলংকার পর্যন্ত তুলিয়া ডা-গামার জাহাজে পৌঁছাইয়া দেওয়া হইল।
ডা-গামা জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমাদের আর কিছু নাই?’
‘না।’
‘আবার জিজ্ঞাসা করিতেছি— নারীদের দিবে না?’
অসহ্য ক্রোধে মির্জা দাউদের বাক্রুদ্ধ হইয়া গেল। শুধু তাঁহার চক্ষুর্দ্বয় অগ্নিশিখার মতো জ্বলিতে লাগিল।
ভাস্কো-ডা-গামা কালকূটের মতো হাসিল। বলিল, ‘ভালো, তোমাদের যেরূপ অভিরুচি।’ তারপর কাপ্তেনের দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘কাপ্তেন, গোলা মারিয়া উহাদের জাহাজে আগুন লাগাইয়া দাও। আজ মুসলমান কুকুরগুলোকে পুড়াইয়া মারিব।’
মির্জা দাউদ চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ‘শঠ! বিশ্বাসঘাতক! মিথ্যাবাদী শয়তান!’
ডা-গামা কহিল, ‘মির্জা দাউদ, তোর প্রাণরক্ষা করিতে পারে, এত অর্থ পৃথিবীতে নাই। তবে তুই তোর স্ত্রীর বিনিময়ে এখনও প্রানরক্ষা করিতে পারিস। তোর স্ত্রীকে আমি বাঁদি করিয়া রাখিব।’
মির্জা দাউদ উন্মত্তের মতো গর্জন করিতে লাগিলেন, ‘শয়তান! শয়তান!’
জাহাজে ভীষণ কোলাহল উঠিল। নর-নারী সকলে পাগলে মতো চারিদিকে ছুটাছুটি করিতে লাগিল। সকলেই যেন এই অভিশপ্ত জাহাজ হইতে পলাইবার চেষ্টা করিতেছে। চতুর্দিক হইতে আর্তরব উঠিল, ‘রক্ষা কর! দয়া কর! প্রাণ বাঁচাও!’
এই আকুল প্রার্থনার জবাব আসিল। সহসা শিলাবৃষ্টির মতো জাহাজের উপর বন্দুকের গুলি পড়িতে লাগিল। কেহ হত, কেহ আহত হইয়া পড়িতে লাগিল। মৃত্যুর বিভীষিকা যেন ভীষণতার রুপ ধরিয়া দেখা দিল।
মির্জা দাউদের পিতা ক্ষুদ্র হারুণাকে বক্ষে লইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে পুত্রের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। স্খলিত কণ্ঠে একবার শুধু ডাকিলেন, ‘দাউদ!’
দুর্দম আবেগে মির্জা দাউদ একসঙ্গে পিতা ও কন্যাকে জড়াইয়া ধরিলেন, এমন সময় লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়া শালেহা আসিয়া স্বামীর হস্ত ধরিয়া দাঁড়াইলেন।
মির্জা দাউদ বাষ্পাচ্ছন্ন চোখ একবার তিন জনের মুখের দিকে চাহিলেন। তারপর অবরুদ্ধ স্বরে কহিলেন, ‘পিতা, ঈশ্বর কি নাই?’
সহসা হারুণা ক্ষুদ্র একটি কাতরোক্তি করিয়া এলাইয়া পড়িল। দ্রুত কন্যাকে নিজের ক্রোড়ে লইয়া মির্জা দাউদ দেখিলেন, তাহার দেহে প্রাণ নাই। নিষ্ঠুর গুলি তাহার বক্ষে প্রবেশ কারিয়াছে।
তারপর দ্রুত অনুক্রমে স্ত্রী ও পিতা গুলির আঘাতে মাটিতে পড়িয়া গিয়া মরণ-যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন। ভাস্কো-ডা-গামা তখন স্বয়ং ধূমায়িত বন্দুক হাতে করিয়া পিশাচের মতো উচ্চ হাসি হাসিতেছে।
সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তরেখা স্পর্শ করিয়াছে। আকাশ এবং সমুদ্র তপ্ত রক্তের মতো রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। সাগরবক্ষে সূর্যাস্ত হইতেছে।
এইবার পাঁচখানা জাহাজ হইতে এককালে কামান ডাকিল। গোলার সংঘাতে শীতার্ত বৃদ্ধের মতো মির্জা দাউদের জাহাজখানা কাঁপিয়া উঠিল। পালের কামড়ে দপ করিয়া আবার আগুন জ্বলিয়া উঠিল। ধীরে ধীরে টলিতে টলিতে জাহাজ নিমজ্জিত হইতে লাগিল। আবার কামান গর্জিল। এবার জাহাজের সম্মুখ দিকটা ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। কল্কল্ শব্দে জল ঢুকিতে লাগিল।
তারপর নিমেষের মধ্যে সমস্ত শেষ হইয়া গেল। আরোহীদের মিলিত কণ্ঠ হইতে এক মহা হাহাকার-ধ্বনি উঠিল। জ্বলন্ত জাহাজ অকস্মাৎ জীবিতবৎ সোজা দাঁড়াইয়া উঠিল; তারপর সবেগে সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করিল। যাত্রীদের ঊর্ধ্বোর্ত্থিত কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হইয়া গেল। মুহূর্তপূর্বে যেখানে জাহাজ ছিল, সেখানে আবর্তিত তরঙ্গশীর্ষ জলরাশি ক্রীড়া করিতে লাগিল।
ফিরিঙ্গী জাহাজগুলি চিত্রার্পিতবৎ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। প্রায়ান্ধকারে তাহাদিগকে যেন অন্য জগতের কোনও ভৌতিক তরণীর মতো দেখাইতে লাগিল।
ক্ষণকাল পরে সান্ধ্য নীরবতা বিদীর্ণ করিয়া ভাস্কো-ডা-গামার জাহাজ হইতে দামামা ও তূর্য বাজিয়া উঠিল।
সূর্য তখন সমুদ্রপারে অস্তমিত হইয়া অন্য কোন্ নূতন গগনে উদিত হইয়াছে।
১৯৩০