» » এগার

বর্ণাকার

ফজল পরের দিনই তুরফানকে নিয়ে আসে। এসেই তুরফান পুলকি-মাতব্বর আর কোলশরিকদের জোয়ান তরুণ ছেলেগুলোকে লাঠি খেলার সবক দিয়ে শুরু করেছে। ফজল নিজেও নিচ্ছে খেলার তালিম।

আলেফ সরদার এসেছে তার তিরিশজন সারগেদ নিয়ে। মেঘু পালোয়ান নিয়ে এসেছে ঊনিশজন। মাতব্বরের দলের আশিজনও হাজির। যার যার হাতিয়ার–ঢাল-কাতরা, লাঠি শড়কি, গুলেল-গুলি সব তৈরি।

দূর থেকে কেমনে গম্‌গম্ আওয়াজ শোনা যায়, যেমন শোনা যায় হাটের হট্টগোল। সত্যি যেন হাট বসে গেছে খুনের চরে।

চাকরিয়াদের সাথে নিয়ে পালা অনুসারে পাহারা দিচ্ছে কোলশরিকেরা। যাদের অবসর তারা বয়স ও প্রকৃতি-প্রবণতা অনুসারে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আড্ডা দেয়। একদল মাটিতে দাগ কেটে ষোলগুটি খেলে তো আর একদল কেচ্ছা-শোলকের আসর জমিয়ে তোলে। কোনো ভাওর ঘরে বসে যায় পুঁথি-পাঠের মজলিস। সুর করে পড়ে গাজী-কালু আর সোনাভানের পুঁথি। যেখানে পানসি নৌকা তৈরি হচ্ছে, সেখানকার আসর সবচেয়ে বেশি জমজমাট। বুড়ো আকু মিস্ত্রি টান দিয়েছে গানে–

ও-ও জীর্ণ কাষ্ঠের একখান তরী,

তার উপরে এক সওয়ারি,

পাড়ি ধরছে অকুল দরিয়ায়॥

ওরে ডওরায় পানি টুবুটুবু,

তাইতে তরী ডুবুডুবু

এখন ঢেউ উঠিলে হইব অনুপায়॥

আছরের নামাজের সময় হয়নি তখনও। এরফান মাতব্বর ভাওর ঘরে বসে কোরানশরীফ পড়ছিল। গানের আওয়াজ কানে আসতেই তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়, বিরক্তি ধরে। গানের আওয়াজ যাতে কানে না আসে সেজন্য গলার স্বর উঁচু পর্দায় চড়িয়ে কোরান তেলাওয়াতে মন দেয় সে। কিন্তু পাক কোরানের পাতা ছেড়ে তার মনমাঝি এক সময়ে চড়ে বসে জীর্ণ কাষ্ঠের তরীতে।

ও-ও জীর্ণ কাষ্ঠের একখান তরী,

তার উপরে এক সওয়ারি,

পাড়ি ধরছে অকুল দরিয়ায়॥

ওরে ডওরায় পানি টুবুটুবু,

তাইতে তরী ডুবুডুবু

এখন ঢেউ উঠিলে হইব অনুপায়॥

ওরে কালা মেঘে আসমান ছাওয়া

খাড়াঝিলিক করে ধাওয়া

এখন তুফান ছাড়লে হবে কি উপায়?

ওরে ও মন-মাঝি–

সাবধানে ধরিও হাল,

কৌশলে বান্ধিও পাল,

উজান গাঙে পাড়ি পাওয়া দায়॥

গান শেষ হলে এরফান মাতব্বরের সংবিৎ ফিরে আসে। নিজেকে সে তিরস্কার করে বারবার। কোরান-মজিদের পাক কালামের ওপর কেন সে তার মনকে নিবিষ্ট রাখতে পারেনি। আল্লার কালাম সে অশেষ ভক্তি নিয়ে পড়ে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না বলে কি তার মন উড়াল দেবে ঐ গানের কথা আর সুরের পেছনে পেছনে!

মাতব্বর আলোয়ানের কয়েক প্যাঁচে ঢেকে নেয় তার মাথা আর কান দুটো। তারপর আবার শুরু করে কোরানশরিফ তেলাওয়াত।

আছরের নামাজ পড়ে মাতব্বর আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। শীতে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার সারা শরীর।

আবার শোনা যায় গান। দোতারা বাজিয়ে এবার গাইছে বোধহয় পাঞ্জু বয়াতি।

দয়ালরে তোর দয়ার অন্ত নাই,

এই আসমান জমিন

আর সাগর গহিন।

সবখানে তার পরমান পাই॥

মাতব্বরের মন গানের পাখায় ভর দিয়ে আবার উড়ে চলে। তাকেও টানে গানের আসরের দিকে। সে ঝুপড়ি থেকে বেরোয়। একপা-দু’পা করে এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে। তাকে দেখে সচকিত হয়ে ওঠে সবাই। বন্ধ হয়ে যায় গান। মাতব্বরের ইচ্ছে হয় চেঁচিয়ে বলে, ‘ওরে গানে ক্ষ্যান্ত দিলি ক্যান্? চলুক, চলতে দে।’

মাতব্বর নিজেকে সামলে নেয়। সে সকলের মুরব্বি মাতব্বর। তার উচিত নয় এদের সাথে হৈ-হুঁল্লোড় করার। এছাড়া একবার যদি এরা প্রশ্রয় পেয়ে যায় তবে গান-বাজনায় মেতে যাবে সবাই। আর ওদিক দিয়ে বিনা বাধায় জঙ্গুরুল্লা দখল করে নেবে চর।

মাতব্বর ডাকে আকু মিস্ত্রিকে, ‘কিও মিস্ত্রি, আর কদ্দিন লাগাইবা?’

‘এই ধরেন কুড়ি-বাইশ দিন।’

‘অনেক দিন লাগাইতে আছ। জলদি করো। এরপর আবার ছই লাগাইতে অইব।’

একটু থেমে সে ডাক দেয়, ‘ফজল কইরে?’

‘জ্বী।’ ভিড় থেকে বেরিয়ে আসে ফজল।

‘তোর লাডির খেইল কেমুন চলতে আছে?’

‘খুব ভাল চলতে আছে।’

‘উন্নতি অইছে কিছু? না খালি খালি–’

‘না অনেক উন্নতি অইছে।’

‘আরো ভাল কইর‍্যা শিখতে অইব। আর হোন, তুই, হাশমত, লালু, ফেলু, বক্কর, টিটু, একাব্বর শড়কি চালানও শিখ্যা রাখ। আর কে কে শিখতে চায়?’

‘আমি, আমি,’ বলে আরো দশ-বারোজন এগিয়ে আসে।

মাতব্বর বলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সাবাস! তোমরা আলেফ সরদার আর মেঘু পালোয়ানের শাগরেদ অইয়া যাও। শড়কি চালান শিখ। খামাখা সময় নষ্ট কইর না। কি ভাই আলেফ সরদার, কই মেঘু, পারবা না আমাগ এই হাংগাল-বাংগালগোরে এট্টু লায়েক বানাইতো?’

‘পারমু না ক্যান্,’ মেঘু পালোয়ান বলে।

‘মেঘু রাজি অইয়া গেল নি ও?’ হাসতে হাসতে বলে আলেফ সরদার। ‘এই জমিনওলাগো এই বিদ্যা হিগাইলে হেষে আমাগ ভাত জুটব না কিন্তু কইয়া দিলাম। কি কন মাতবর-ভাই?’

‘আরে না-না। ভাত দেওনের মালিক আল্লা। আমরা চাইলেও কি আর তোমাগ ভাত মারতে পারমু?’

‘তা ঠিক কইছেন। লইয়া আহেন মণ্ডা-মিডাই। মোখ মিষ্টি কইর‍্যা তয় না পয়লা সবক দিমু।’

পরের দিন মিষ্টিমুখ করে আলেফ সরদার আর মেঘু পালোয়ান নতুন নতুন সাগরেদদের শড়কি চালনা শেখাতে আরম্ভ করে। এরফান মাতব্বর নিজে দাঁড়িয়ে দেখে। সেও এক কালে ভাল শড়কি চালাতে পারত।

এরফান মাতব্বর নতুন সাগরেদদের উপদেশ দেয়, মাইনষে কইতেই কয়, বাঙ্গালের মাইর, দুনিয়ার বাইর। তোমরা হেই রকম বাঙ্গাল। তোমরা কাবু পাইলে এক্কেবারে মাইরা ফালাইবা, আবার বেকাদায় পড়লে নিজেরা মরবা। এর লেইগ্যা তোমাগ তালিম দিতাছি। চরের কাইজ্যা কিন্তু রাজা-বাদশাগ লড়াই না যে যারে পাইলাম তারে খুন করলাম। চরের কাইজ্যা অইল বিপক্ষরে খেদানের লেইগ্যা। তাই নিজেরে বাঁচাইতে শিখ একদম পয়লা। তারপর শড়কি দিয়া খোঁচা দিতে শিখ। খোঁচা কিন্তু বুকে মাথায় দিবা না। খোঁচা দিবা আতে, পায়ে। খোঁচা খাইয়া যে লাঠি-শড়কি ফালাইয়া ভাইগ্যা যায়।

রোজ ভোর বেলা তিন-চার ঘণ্টা চলে শড়কি চালনা শিক্ষা। আর বিকেল বেলা আলেফ সরদারও মেঘু পালোয়ান তাদের দল নিয়ে লাঠি-শড়কি খেলার প্রতিযোগিতায় নামে। কখনও জঙ্গুরুল্লার দল সেজে একদল আক্রমণ করে, অন্য দল এরফান মাতব্বরের পক্ষ নিয়ে তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে এগিয়ে যায়। মহড়ার সময় ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে দেয়া হয় শড়কির ফলা।

চাকরিয়ারা মাথাপিছু এক টাকা হিসেবে রোজানা পায়। তাদের সরদার দু’জন পায় দু’টাকা করে। এর ওপর আবার মাগনা খোরাক দুবেলা। কম করে খেলেও আধা সের চালের ভাত খায় এক-এক জনে এক-এক বেলা।

চাকরিয়া এসেছে আজ বিশ দিন। এ ক’দিনে দেড় হাজার টাকার ওপর খরচ হয়ে গেছে এরফান মাতব্বরের। আরো কতদিন রাখতে হবে চাকরিয়াদের কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। কিন্তু এই হারে খরচ হলে কিছুদিনের মধ্যেই সে ফতুর হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে যা আদায় হয়েছিল সেলামি বাবদ। কোলশরিকদের কাছ থেকেও কিছু আদায় করা যাবে না এখন, আর তা উচিতও নয়। সেলামির টাকাই বহু কষ্টে যোগাড় করেছিল তারা। সে ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি অনেকে।

এই জমিদার আর জমিদারের নায়েবরাই যত নষ্টের গোড়া। মনে মনে গর্জে ওঠে এরফান মাতব্বর। যে এগারো পয়সার মালিকানা দেখায় রায়চৌধুরীরা, সেই জাগাতো আরো অনেক দক্ষিণে, এখনো পানির তলে। ছয়-সাত বচ্ছর আগে ঐখানে চর আছিল্‌।

নিজেগ জাগার নাম-নিশান নাই, এখন আমার চরের বন্দোবস্ত দিছে জঙ্গুরুল্লারে। জমিদার আর ওর নায়েবের পেডের ঝুলি বাইর করন দরকার। যত কাইজ্যা-ফ্যাসাদের মূলে এই জানোয়ারের পয়দারা।

মনের আক্রোশ মনেই চাপা দিয়ে এরফান মাতব্বর জঙ্গুরুল্লার হামলা প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে, কিন্তু এ পর্যন্ত একবারও হানা দেয়ার চেষ্টা করেনি বিপক্ষ দল। দিন দশেক আগে একবার, দিন দুই আগে আরো একবার রাত দুপুরে হৈ-চৈ করে উঠেছিল পাহারারত চাকরিয়ারা, ‘ঐ আইতে আছে, আউগ্‌গারে, আউগ্‌গা…আউগ্‌গা…’

মারমার করে এগিয়ে গিয়েছিল দলের সবাই। ফজল নদীর কিনারায় গিয়ে পাহারাওলাদের কাছে শোনে–অনেকগুলো নৌকা এদিকে আসছিল। এদিকের হাঁক-ডাক কুদা-কুদি শুনে ভেগে গেছে।

ফজল টর্চের আলো ফেলে।

চাকরিয়াদের একজন বলে, ‘এহন কি আর দেহা যাইব? এতক্ষণে চইল্যা গেছে কোন মুলুকে!’

মাতব্বর পুরানো ঘাগু। সে জানে, এ সব কিছু নয়। চাকরিয়াদের চাকরি বজায় রাখার ফন্দি আর কি। কিন্তু জেনেও সে বলে না এ কথা কাউকে। বললে শেষে হয়তো যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসবে সেদিন রাখালকে বাঁচাবার জন্য আর এগিয়ে আসবে না কেউ।

হুড়মুড় করে চলে যাচ্ছে টাকা। প্রায় শ’খানেক টাকা খরচ হয় রোজ। দিন যত যাচ্ছে, তহবিলের টাকাও কমে আসছে তত। আর এ ভাবে খরচ করা উচিত নয়, ভাবে এরফান মাতব্বর। আলেফ সরদার ও মেঘু পালোয়ানের সাথে পরামর্শ করে সে দুই দল থেকে বেছে মাত্র দশজন রেখে বাকি সবাইকে বিদেয় করে দেয়। আলেফ ও মেঘুর ‘রোজানা’ দুটাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় তিন টাকা।