পুর্বের আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে। টুকরো টুকরো মেঘের ওপর লাল হলুদের পোঁচ। দপদপ করে জ্বলছে শুকতারা। ঐদিকে তাকিয়ে ফজল বলে, ‘ধলপহর দিছেরে নূরু, পোয়াত্যা তারা ওঠেছে। আরো জলদি করণ লাগব।’
দুজনেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সূর্য ওঠার আগেই কাঁকড়ামারির মুখে পৌঁছতে হবে তাদের। আলো দেখার সাথে সাথে মাছ তাদের রাতের আস্তানা ঢালু কিনারা ছেড়ে সরে যাবে গভীর পানিতে।
নদীর ঢালে জাল দিয়ে মাছ ধরছে চাচা। দশ বছরের ভাইপো ডুলা নিয়ে ফিরছে তার পিছু পিছু। চাচা জাল ঝেড়ে মাছ ফেলে। ভাইপো কুড়িয়ে নিয়ে রাখে ডুলার ভেতর। চিংড়ি আর বেলে মাছই বেশির ভাগ।
ফজল আবার জালটাকে গোছগাছ করে তার একাংশ কনুইর ওপর চড়ায়। বাকিটা দু’ভাগ করে দু’হাতের মুঠোয় তুলে নেয়। তারপর পানির দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝাঁকি মেলে ছুঁড়ে দেয় নদীর পানিতে। দূরে গিয়ে অনেকটা জায়গার ওপর ওটা ঝপ করে ছড়িয়ে পড়ে।
ঝাঁকি জাল। কড়া পাক দেয়া সরু সুতোয় তৈরি। পানিতে ভিজে ভিজে সুতো পচে না যায় সেজন্য লাগানো হয়েছে গাবের কষ। কষ খেয়ে খেয়ে ওটা কালো মিশমিশে হয়েছে। জালের নিচের দিকে পুরোটা ঘের জুড়ে রয়েছে ‘ঘাইল’–মাছ ঘায়েল করার ফাঁদ। ঘাইলগুলোর সাথে লাগান হয়েছে লোহার কাঁঠি।
এ লোহার কাঠির কাজ অনেক। কাঠির ভারে ভারী হয় বলেই জালটাকে দূরে ছুঁড়ে মারা সম্ভব হয়। আর ওটা তাড়াতাড়ি পানির তলায় গিয়ে মাটির ওপর চেপে বসতে পারে। জাল টেনে তুলবার সময় আবার কাঠির ভারের জন্য ফাঁদগুলো মাটির ওপর দিয়ে ঘষড়াতে ঘষড়াতে গুটিয়ে আসে। গুটিয়ে আসে চারদিক থেকে মুখ ব্যাদান করে। জালের তলায় আটকে পড়া মাছ পালাবার পথ পায় না।
জালটা স্রোতের টানে কিছুটা ভাটিতে গিয়ে মাটির ওপর পড়েছে। ফজল তার কবজিতে বাঁধা রাশি ধরে ওটা আস্তে আস্তে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে টেনে তোলে। যেন কোনো জলরাক্ষসীর উপড়ে তোলা একমাথা চুল।
জালের মধ্যে ছড়ছড় আওয়াজ। চকচকে সাদা মাছগুলো অন্ধকারেও চেনা যায়। কয়েকটা টাটকিনি। নূরু খুশি হয়ে ওঠে।
ফজল মাছগুলো জাল থেকে ঝেড়ে ফেলে। নূরু চটপট হাত চালিয়ে ডুলায় তোলে গুনে গুনে, এক-দুই-তিন—। বড় একটা টাটকিনি তার হাত থেকে পিছলে লাফ দিয়ে গিয়ে পানিতে পড়ে। ওটা ধরবার ব্যর্থ চেষ্টায় ওর কাপড় ভিজে যায়। কাদা মেখে যায় শরীরে।
জাল ফেলতে ফেলতে তারা উজানের দিকে এগিয়ে যায়। রাত তিন প্রহরের সময় তারা মাছ ধরতে এসেছে। ডুলাটা মাছে ভরে গিয়েছিল একবার। ফজল সেগুলো গামছায় বেঁধে নিয়েছে। ডুলাটা আবারও ভরভর হয়েছে। ওটা বয়ে নিতে নূরুর কষ্ট হচ্ছে খুব।
পশু-পাখির ঘুম ভেঙেছে। জেগে উঠেছে কাজের মানুষেরা। গস্তি নৌকার হালে গুঁড়ি মারার শব্দ আসছে কেড়োত-কোড়োত। ঝপ্পত্ঝপ্ দাঁড় ফেলছে মাঝিরা। অনুকূল বাতাস পেয়ে নৌকায় পাল তুলে দিয়েছে কেউ বা। রাত্রির জন্য কোনো নিরাপদ ঘোঁজায় তারা পাড়া গেড়ে ছিল। বিশ্রামের পর আবার শুরু হয়েছে যাত্রা। অন্ধকার মিলিয়ে যেতে না যেতে অনেক পানি ভাঙতে হবে তাদের।
আলো আর আঁধারের বোঝাপড়া শেষ হয়ে এসেছে। আঁচল টেনে আঁধার ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে। চরের লটা আর কাশবন মাথা বের করেছে। স্পষ্ট হয়ে উঠছে ঘোলাটে পানি।
আশ্বিন মাস। পদ্মা এখন বিগতযৌবনা। তার ভরা যৌবনের তেজ আর দুরন্তপনা থেমেছে। দুর্দম কাটালের কলকলানি আর নেই। পাড়ের দেয়ালে নিয়ন্ত্রিত তার গতি। শ্রান্ত শিথিল স্রোত কুলুকুলু ধ্বনি তুলে বয়ে যাচ্ছে এখন।
‘দুদু, অ দুদু!’
‘কি রে?’
‘শিগগির আহো। ঐখানে একটা বড় মাছে ডাফ দিছে।’
‘দুও বোকা! ডাফ দিয়া ও কি আর অইখানে আছে!’
ফজল তবুও জাল ফেলে। পায় দুটো বড় বেলে মাছ। বেশ মোটাসোটা। সে নিজেই এ দুটো ডুলায় তুলে দেয়। নূরুর ছোট হাতের মুঠোয় এ দুটোকে সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
ফজল চারদিকে চোখ বুলায়। তরতর করে উজিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। মাঝনদীতে চেরা চিচিঙ্গের মতো লম্বা জেলে নৌকা মৃদু ঢেউয়ের দোলায় দুলছে এদিক ওদিক। জগতবেড় জাল ফেলে রাতভর প্রহর গুনছিল জেলেরা। রাতের অন্ধকার মিলিয়ে যাওয়ার আগেই জাল টানতে শুরু করেছে তারা।
পুব আকাশে সোনালি সূর্য উঁকি দিয়েছে। কালো রেখার মতো দিগন্তে গাছের সারির আভাস ফুটে উঠেছে।
ফজল এগিয়ে গেছে কিছু দূর। চটপট পা চালিয়ে নূরু ধরে ফেলে চাচাকে। সে সামনের দিকে তাকায়। কাঁকড়ামারির মুখ এখনো দেখা যায় না। তাদের ডিঙিটা কাঁকড়ামারির খাড়িতে লটাখেতের আড়ালে বেঁধে রেখে এসেছে তারা। সামনের বাঁকটা পার হলেই সেই খাড়ির মুখ দেখা যাবে। নদীর এ সরু প্রশাখাটি উত্তর-পশ্চিম থেকে চরের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে নদীর দক্ষিণ শাখায় গিয়ে মিশেছে।
‘ও-ও-ও-দুদু, দুদু…!’
‘কিরে কি…কি?’
ফজল জালের মাছ ঝেড়ে রেখে কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিল। নূরুর ভীত কণ্ঠের ডাক শুনে ছুটে আসে সে।
মাছ কুড়াবার সময় নূরুর ডান হাতে একটা কাঁকড়া লেগেছে। দুই দাঁড়া দিয়ে চেঙ্গি দিয়েছে ওর বুড়ো আর কড়ে আঙুলে।
ফজল দাঁড়া দুটো ছিঁড়ে ফেলে কাঁকড়াটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাড়ের দিকে। দাঁড়া দুটো খসে পড়ে আঙুল থেকে।
‘ইস্, রক্ত ছুটছে রে! তুই নায় যা গিয়া নূরু। লটা চাবাইয়া ঘায়ে রস লাগাইয়া দেগা। আমি এডুক শেষ কইর্যা আইতে আছি।’
নূরু ডুলাটা রেখে রওনা হয়। ওর লুঙ্গি থেকে পানি ঝরছে। পানিতে ভিজে শিটে মেরে গেছে পা দুটো। ভোরের বাতাসে শীত-শীত করছে, খাড়া হয়ে উঠেছে শরীরের রোম। হাঁটতে হাঁটতে সে কাঁকড়ামারির মুখে চলে যায়। লটাখেতের ভেতর দিয়ে পানি ভেঙে নৌকায় গিয়ে ওঠে।
দূরে স্টিমারের সিটি শোনা যায়। চাটগাঁ মেল বহর এসে ভিড়ল।
নূরু একটা লটা ভেঙে দাঁতের তলায় ফেলে। চিবিয়ে রস দেয় ঘায়ে। রসটা মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। সে লটা চিবিয়ে চিবিয়ে রস চুষতে শুরু করে দেয়।
জালের খেপ শেষ করেছে ফজল। দূর থেকে সে দেখতে পায়, নূরু লটা চিবোচ্ছে। তার হাসি পায়। সে ডেকে বলতে যাচ্ছিল, ‘কিরে নূরু, গ্যাণ্ডারি পালি কই?’ কিন্তু বলতে পারে না সে। লটা চিবোতে দেখে হাসি পায় বটে, আবার একই সঙ্গে মায়াও লাগে। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে ওর। ভোর হয়েছে। ভোরের নাশতা চিড়ে-মুড়ি নিয়ে এতক্ষণে বসে গেছে সব বাড়ির ছেলে-মেয়েরা।
ফজল নৌকার দিকে আসছে। শব্দ পেয়ে নূরু চট করে লটাটা ফেলে দেয় পানিতে। চাচা দেখে ফেলেনি তো!
মুখ থেকে লটার রস নিয়ে সে ঘায়ে লাগাতে থাকে। চাচাকে বোঝাতে চায়, ঘায়ে রস লাগাবার জন্যই সে লটা চিবুচ্ছিল।
ফজলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। হাসি গোপন করার জন্য সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘এই নূরু, আরো পাঁচটা ছাডা ইচা পাইছি রে! মুগুরের মতন মোট্টা এক-একটা।’
ফজল নৌকায় ওঠে। ডুলায় আর গামছায় বাঁধা মাছগুলো সে ঢেলে দেয় নৌকার ডওরায়।
বেলে বা অন্য কোনো মাছ দেখে নয়, বড় বড় গলদা চিংড়ি দেখে খুশি হয় নূরু। সে একটা একটা করে গুনতে শুরু করে।
গলদা চিংড়ি আঠারোটা, বেলে মাছ ছোট-বড় মিলিয়ে তিন কুড়ি চারটা আর কিছু টাটকিনি আর গুড়োগাড়া মাছ।
‘নাও ছাইড়্যা দে নূরু। এইবার দাউন কয়ডা উড়াইয়া ফালাই।’
দু’জনেই বৈঠা হাতে নেয়। নূরু পাছায়, ফজল গলুইয়ে। কিছুদূর উজিয়ে তারা দাউন বড়শি তুলতে শুরু করে। লম্বা ডোরের সাথে খাটো খাটো ডোরে পরপর বাঁধা অনেকগুলো বড়শি। টোপ গেঁথে তিন জায়গায় পাতা হয়েছে এ বড়শি।
ফজল একটা একটা করে দাউন তিনটে তুলে নেয়। প্রথমটায় বেঁধেছে একটা শিলন। আর একটা ছোট পাঙাশ মাছ। দ্বিতীয়টা একদম খালি। তৃতীয়টায় বেঁধেছে বড় একটা পাঙাশ মাছ। তেলতেলে মাছটা চকচক করছে ভোরের রোদে।
ফজল বলে, ‘মাছটা খুব বুড়ারে। তেল অইছে খুব। এইডার পেডির মাছ যে গালে দিব, বুঝব মাছ কয় কারে! মাইনষে কি আর খামাখা কয়–পক্ষীর গুড়া আর মাছের বুড়া, খায় রাজা আঁটকুড়া।’
মাছ ধরা শেষ হয়েছে। এবার বেচবার পালা। নূরুকে বলতে হয় না। সে নৌকার মাথা ঘুরিয়ে দেয় নিকারির টেকের দিকে। ভাটির টানে ছুটছে নৌকা। নূরু হালটা চেপে ধরে বসে থাকে মাথিতে। ফজল তার হাতের বৈঠা রেখে মাছগুলো বাছতে শুরু করে। আকার অনুযায়ী সে হালি ঠিক করে রাখে। গোটা দশেক টাটকিনি আর ছ’টা গলদা চিংড়ি বাদে সবগুলোই বেচে দিতে হবে। বড় পাঙাশ মাছটা নিজেদের জন্য রাখবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা হলে বাকিগুলোয় আর কটা পয়সাই আসবে। সের চারেক ওজনের পাঙাশ মাছটায় কমসে কম বারো গণ্ডা পয়সা পাওয়া যাবে। ঘরে চাল নেই। তেল-নুন আরো অনেক কিছুই কিনতে হবে। শুধু মাছ খেয়ে তো আর পেট ভরবে না। মাছটার দামে কেনা যাবে দশসের চাল– সংসারের চারদিনের খোরাক।
গত তিন বছর ধরেই টানাটানি চলছে সংসারে। ডিঙ্গাখোলা আর লক্ষ্মীচর ভেঙে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে এ দুর্দিন। এই দুই চরে অনেক জমি ছিল তাদের। বছরের খোরাক রেখে অন্তত পাঁচশ টাকার ধান বেচতে পারত তারা। প্রতি বছর পাট আর লটা ঘাসে আসত কম করে হলেও হাজার টাকা। পদ্মার অজগরস্রোত গিলে খেয়েছে, উদরে টেনে নিয়েছে সব জমি। গুণগার নমকান্দি থেকে শুরু হয়েছিল ভাঙা। তারপর বিদগাঁও কোনা কেটে, দিঘলির আধাটা গিলে, কাউনিয়াকান্দা, ডিঙ্গাখোলা, লক্ষ্মীচর আর মূলভাওরকে বুকে টেনে চররাজাবাড়ির পাশ কেটে উন্মাদিনী পদ্মা গা দোলাতে দোলাতে চলে গেছে পুব দিকে। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এঁকেবেঁকে চলেছে ডানে আর বাঁয়ে।
চরের বসত আজ আছে, কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে চরের আয়ু। তার খুশিতে চর জাগে। তারই খেয়ালে ভেঙে যায় আবার। এ যেন পানি আর মাটির চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ, দশ, বিশ বছরের মেয়াদে বুকের ওপর ঠাই দেয় পানি। মেয়াদ ফুরালেই আবার ভেঙেচুরে নিজের জঠরে টেনে নেয়। চরবাসীরা তাই স্থায়ী হয়ে বসতে পারে না কোনো দিন। তাদের বাপ-দাদার ভিটে বলতে কিছু নেই। বাপ-দাদার কবরে চেরাগ জ্বালবার প্রয়োজন হয় না তাদের কোনো দিন। ফজলের বাবা এরফান মাতব্বর প্রায়ই একটা কথা বলে থাকে, চরের বাড়ি মাটির হাঁড়ি, আয়ু তার দিন চারি।
এরফান মাতব্বরের বাড়ি ছিল লক্ষ্মীচরে। এগারো বছর কেটেছিল সেখানে। এ এগারো বছরের আয়ু নিয়েই জেগেছিল চরটা। মেয়াদের শেষে পদ্মা গ্রাস করেছে। এই নিয়ে কতবার যে লক্ষ্মীচর জেগেছে আর ভেঙেছে তার হিসেব রাখেনি এরফান মাতব্বর। সে ঘর-দোর ভেঙে, পরিবার-পরিজন, গরু-বাছুর নিয়ে ভাটিকান্দি গিয়ে ওঠে। দুটো করে টিনের চালা মাটির ওপর কোনাকুনি দাঁড় করিয়ে খুঁটিহীন কয়েকটা দোচালা তৈরি হয় মামাতো ভাইয়ের বাড়ির পাশে। মাতব্বরের সংসার এভাবে ‘পাতনা’ দিয়ে ছিল বছর খানেক। তারপর ঐ চরেই জায়গা কিনে বছর দুয়েক হলো সে আবার বাড়ি করেছে।
ফজল আগে শখ করে মাছ ধরতে যেত। মাছ ধরাটা ছিল তখন নেশার মতো। এখন অনেকটা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ উপজীবিকার আশ্রয় না নিয়ে উপায় ছিল না। সংসারে খাবার লোক অনেক। সে তুলনায় এখন জমির পরিমাণ সামান্য। চরদিঘলিতে মাত্র কয়েক নল জমি আছে তাতে যে ধান হয় তাতে টেনেটুনে বছরের চারমাস চলে। বাকি আটমাসের পেটের দায় ছাড়াও খাজনা রয়েছে। চর থাকুক আর না থাকুক জমিদারের নায়েবরা খাজনার টাকা গুনবেই। নয়তো তাদের কোনো দাবিই থাকবে না যদি আবার কখনো চর জেগে ওঠে সে এলাকায়।
ফজল লুকিয়ে-চুরিয়ে মাছ বেচে। গেরস্তের ছেলের পক্ষে মাছ-বেচা নিন্দার ব্যাপার। আত্মীয়-কুটুম্বরা জানতে পারলে ছি-ছি করবে। হাসাহাসি করবে গাঁয়ের লোক। দুষ্ট লোকের মুখে মুখে হয়তো একদিন মালো বা নিকারি খেতাব চালু হয়ে যাবে।
দিনের পর দিন অভাব অনটনের ভেতর দিয়ে সংসার চলছিল। মাছ বেচার কথা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেনি ফজল। শখ করে একদিন সে লেদ বড়শি নিয়ে নদীতে গিয়েছিল। বড়শিতে উঠেছিল একটা মস্ত বড় আড় মাছ। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল নিকারি-নৌকা। মাছ দেখে ডাক দেয় মাছের ব্যাপারি, ‘ও ভাই মাছটা বেচ্বানি?’
ফজল কৌতুক বোধ করে। মজা করবার জন্য উত্তর দেয় সে, ‘হ বেচুম। কত দিবা?’
‘তুমি কত চাও?’
‘এক টাকা।’
‘এক টা–কা! মাছখানের লগে নাওখান দিবা তো?’
‘উঁহু, বৈডাখান দিমু।’
‘বোঝলাম, বেচনের মত নাই তোমার। বেচতে চাও তো উচিত দাম কইয়্যা দ্যাও।’
‘তুমিই কও।’
‘আটআনা দিমু।’
‘আট আনা!’
পয়সার অঙ্কটা মধুর লাগে ফজলের কানে। লোভ হয় তার। পয়সার অভাবে তিনদিন ধরে একটা বিড়ির মুখ দেখেনি সে।
সে এদিক ওদিক তাকায়। না, ধারে কাছে কেউ নেই। নিকারি-নৌকাটা ভাটিয়ে গিয়েছিল কিছুদূর। ফজল ডাক দেয়, ‘ও ভাই, আইও লইয়া যাও।’
নিকারি নৌকায় মাছটা তুলে দিয়ে আট আনা গুনে নেয় ফজল। তার মাছ বেচার বউনি হয় এভাবে।
সেদিন কয়েকটা ছোট ছোট শিলন, ট্যাংরা মাছও পেয়েছিল ফজল। সেগুলো নিয়ে যখন সে বাড়ি আসে তখন মা চেঁচিয়ে ওঠে, মাছ খাইলেই দিন যাইব আঁ? এতদিন বীজ-ধান ভাইন্যা খাওয়াইছি। দেহি আইজ খাওয়ন আহে কইতন।
মাছগুলোকে ধপাৎ করে মাটিতে ফেলে ফজল ডিঙিতে উঠেছিল আবার ডিঙি ছুটিয়ে হাশাইলের বাজার থেকে মাছ-বেচা পয়সায় কিনে এনেছিল ছয় সের চাল।
তারপর থেকে মাছ বেচা পয়সায় সংসারের আংশিক খরচ চলছে। ফজলের বাবা-মা প্রথম দিকে আপত্তির ঝড় তুলেছিল। অভাবের তাড়নায় সে ঝড় এখন শান্ত হয়ে গেছে।
মাছের গোনা-বাছা শেষ করে ফজল। মাছের গায়ের লালায় তার হাত দুটো চটচট করে। হাত ধুয়ে সে গামছায় মোছে। তারপর গলুইয়ে গিয়ে মাথির চরাট সরিয়ে বের করে বিড়ি আর ম্যাচবাতি।
‘অত কিনার চাপাইয়া ধরছস ক্যান্ নূরু? সামনে ফিরা আওড়। আরো মাঝ দিয়া যা।’
নুরুকে সাবধান করে দেয় ফজল। কিনার ঘেষে কিছুদুর গেলেই আবর্ত। সেখানে স্রোত বইছে উল্টোদিকে। ওখানে গিয়ে পড়লে নৌকা সামলানো সম্ভব হবে না ছোট ছেলেটির পক্ষে। এক ঝটকায় তাদের নৌকা বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাবে অনেক দূর।
নূরু নৌকা সরিয়ে নিয়ে যায় কিনারা থেকে দূরে। মাঝের দিকে সোতের টান বেশি তরতর করে এগিয়ে যায় নৌকা।
ফজল এবার বিড়ি ধরিয়ে মাথিতে চেপে বসে। সে বিড়িতে লম্বা টান দেয় আর মুখ ভরে ধোয়া ছাড়ে।
দূরে নদীর মাঝে সাদা সাদা দেখা যায়, কি ওগুলো?
ফজল চেয়ে থাকে। তার চোখে পলক পড়ে না। ঐখানেই বা ওর আশেপাশে কোথাও ছিল তাদের খুনের চর।
নূরুকে সরিয়ে বৈঠা হাতে নেয় ফজল। জোর টানে সে নৌকা ছোটায় পুব-উত্তর কোণের দিকে।
কিছুদূর গেলেই সাদা বস্তুগুলো স্পষ্ট দেখা যায়।
কি আশ্চর্য! নদীর মাঝে হেঁটে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো বক।
ফজল বৈঠা হাতে দাঁড়িয়ে যায়। কিছু দেখবার জন্য সে উত্তর দিকে তাকায়। হ্যাঁ ঐ তো, ঐ-তো বানরির জোড়া তালগাছ!
উল্লসিত হয়ে ওঠে ফজল। বলে, ‘চর জাগছেরে নূরু, চর জাগছে!’
‘কই, কই?’
‘ঐ দ্যাখ, ঐ যে ঐ।’
বকগুলো আঙুল দিয়ে দেখায় ফজল।
আনন্দে লাফিয়ে ওঠে নূরু। সে দেখতে পায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে বকগুলো। মাছ ধরার জন্য গলা বাড়িয়ে আছে। লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মারছে মাঝে মাঝে।
‘এইডা কি আমাগ চর, দুদু?’
‘হরে হ। আমাগ খুনের চর। ঐ দ্যাখ, ঐযে দ্যাখা যায় বানরির জোড়া তালগাছ। ছোডকালে আমরা যখন ঐ চরে যাইতাম তখন সোজা উত্তরমুখি চাইলে দ্যাখা যাইত আসুলির ঐ উঁচা তালগাছ দুইডা।’
ফজল বকগুলোর দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ‘নূরু, তুই বৈঠা আতে ল। টান দে জোরে, বকগুলোরে খেদাইয়া দেই।’
‘ক্যান্ দুদু?’
‘এখনো কেও টের পায় নাই। বক দেখলেই মাইনষে টের পাইয়া যাইব, চর জাগছে।’
চাচা-ভাইপো বৈঠা টেনে এগিয়ে যায়। কিছুদূর গেলেই বৈঠা ঠেকে মাটির সাথে।
‘আর আউগান যাইবনারে নূরু, চড়ায় ঠেইক্যা যাইব নাও। মাডিতে নাও কামড় দিয়া ধরলে মুশকিল আছে। তখন দুইজনের জোরে ঠেইল্যা নামান যাইব না।’
বৈঠাটানা বন্ধ করে দুজনেই। বকগুলো এখনো বেশ দূরে। ফজল পানির ওপর বৈঠার বাড়ি মারে ঠপাস-ঠপাস। কিন্তু বকগুলো একটুও নড়ে না। ওরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, এত দূরের শত্রুকে ভয় করবার কিছু নেই।
ফজল আরো কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যায় নৌকা। কিন্তু কিভাবে তাড়াবে বক? মারবার মতো একটা কিছু পেলে কাজ হত।
হঠাৎ ফজলের নজর পড়ে বেলে মাছগুলোর ওপর। সে ডওরা থেকে একটা বেলে মাছ নিয়ে জোরে বকগুলোর দিকে ছুঁড়ে মারে। বকগুলো এবার উড়াল দেয়। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই আবার নেমে পড়ে চরে।
‘বকগুলোতো বড় বজ্জাতরে। এইখানে মাছ খাইয়া জুত পাইয়া গেছে। অত সহজে যাইব না।’
‘দুদু, পানি তো এটটু খানিক, আমি নাইম্যা গিয়ে খেদাইয়া দিয়া আহি?’
‘নারে, তুই পারবি না। কাফালের মইদ্যে পইড়া যাবি।’
‘ফুঁৎ-ফুঁৎ।’
স্টিমারের ফুঁ শুনে ফজল ও নূরু তাকায়। চাটগাঁ মেল আসছে। সামনে নৌকা পড়েছে বোধ হয়। তাই ফুঁৎ-ফুঁৎ শব্দ করল দু’বার।
ফজল বলে, ‘খাডো চুঙ্গার জাহাজ। শুয়োরের মতোন ‘গ’ দিয়া আইতে আছেরে! শিগগির টান দে নূরু। নাওডা সরাইয়া লইয়া যাই। চড়ার উপর ঢেউয়ে আছাড় মারব।’
নৌকা নিয়ে সরে যায় তারা। তাদের অনেক দূর দিয়ে নতুন চরেরও উত্তর পাশ দিয়ে স্টিমার চলে যায়। তার চলার পথের আন্দোলিত পানি ঢেউ হয়ে ছুটে আসছে। ফজল ঢেউ বরাবর লম্বিয়ে দেয় নৌকা, শক্ত হাতে হাল ধরে। নূরুকে বলে, ‘তুই বৈডা থুইয়া দে নূরু। শক্ত কইর্যা পাডাতন ধইর্যা থাক। উজান জাহাজে ঢেউ উঠব খুব।’
ডলে-মুচড়ে উঁচু হয়ে ঢেউ আসছে। বিপদ বুঝে বকগুলো এবার উড়াল দেয়।
‘দ্যাখ দ্যাখ নূরু। ঐ দ্যাখ, বকগুলো উড়াল দিছে।’
বকগুলোর অবস্থা দেখে নূরুর হাসি পায়। সে বলে, ‘এইবার। এইবার যাও ক্যান্? ঢেউয়ের মইদ্যে ডুবাইয়া ডুবাইয়া মাছ খাও এইবার।’
বকগুলো ওপরে উঠে দু-একবার এলোমেলো চক্কর দেয়। নিচে ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখে নামবার আশা ছেড়ে দেয় ওরা। তারপর ঝাক বেঁধে পশ্চিম দিকে উড়ে চলে যায়।
ঢেউয়ের বাড়িতে ওঠানামা করছে নৌকার দুই মাথি। এক মাথিতে ফজল, অন্য মাথির ঠিক নিচেই পাটাতন ধরে বসে আছে নূরু। ফজল বলে, ‘নূরু, সী-সঅ, সী-সঅ, কিরে ডর লাগছে নি? সী-সঅ, সী-সঅ।’
ঢেউ থামলে নূরু বলে, ‘সী-সঅ কি দুদু?’
‘সী-সঅ একটা খেইল। বাচ্চারা খেলে। নারাণপুর চৌধুরী বাড়ি খাজনা দিতে গেছিলাম। সেইখানে দেইখ্যা আইছি।’
একটু থেমে সে আবার বলে, ‘আইজ আর নিকারির টেঁকে যাইমু নারে।’
‘ক্যান?’
‘ক্যান্ আবার! বাড়িতে খবর দিতে অইব না! মাছ বেচতে গেলে দেরি অইয়া যাইব অনেক। তুই বৈডা নে শিগগির। টান দে।’
দু’জনের বৈঠার টান, তার ওপর অনুকূল স্রোত। নৌকা ছুটছে তীরের মতো।
ফজল নলতার খাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় নৌকা। নতুন চর দখলের এলোমেলা ভাবনায় আচ্ছন্ন তার মন।
খাঁড়ির পুবপাড়ে ঢোনের মধ্যে বাঁধা একটা নৌকা। ওটার ওপর চোখ পড়তেই ফজলের চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যায়। নৌকাটা তার চেনা।
নূরু সামনের দিকে চেয়ে বৈঠা টেনে যাচ্ছে। ফজল একবার দেখে নেয় তাকে। তারপর সে চরাটের ওপর নিঃশব্দে দাঁড়ায়, তাকায় পুবদিকে।
কিছুদূরে কলাগাছে ঘেরা একটা বাড়ি। কলাগাছের ফাঁক দিয়ে বাড়ির উঠানের একাংশ দেখা যায়। আর দেখা যায় একখানা লাল শাড়ি হাওয়ায় দুলছে।
ফজলের বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। সে বসে পড়ে। নূরুকে বলে, ‘মোল্লাবাড়ি চিন্যা যাইতে পারবি নূরু?’
‘হ্যাঁ, নূরু ঘাড় কাত করে।’
‘কোনমুখি ক দেখি?’
নূরু দাঁড়ায়। পুবদিকে তাকিয়ে বলে, ‘ও-ই তো দ্যাখা যায়।’
‘ঠিক আছে। কয়েকটা মাছ দিয়া আয় গিয়া। এতগুলো মাছ আমরা খাইয়া ছাড়াইতে পারমু না।’
ফজল পুবপাড়ে নৌকা ভিড়ায়। ডওরায় রাখা মাছগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে সে জিজ্ঞেস করে, ‘কোনডা দিমুরে নূরু? ইচা, না পাঙাশ?’
‘বড় পাঙাশটা দ্যাও।’
‘আইচ্ছা, পাঙাশ মাছটাই লইয়া যা। আর তোর নানাজানরে আমাগ বাড়ি জলদি কইর্যা আইতে কইস। জরুরি কাম আছে। আমার কথা কইলে কিন্তু আইব না। তোর দাদাজানের কথা কইস।’
‘আইচ্ছা।’
নূরু চরাটের নিচে দলা-মুচড়ি করে রাখা জামাটা পরে নেয়।
ফজল একখণ্ড রশি মাছটার কানকোর ভেতর ঢোকায়। মুখ দিয়ে সেটা বের করে এনে দু’মাথায় গিঠ দিয়ে ঝুলনা বাঁধে।
মাছটা হাতে ঝুলিয়ে পাড়ে নেমে যায় নূরু। ফজল নৌকা ছেড়ে দেয়। বৈঠায় টান দিতে দিতে সে ডেকে বলে, ‘শোন্ নূরু, চর জাগছে–এই কথা কই না কারোরে, খবদ্দার! তোর নানার লগে আইয়া পড়িস। ইস্কুলে যাইতে অইব কিন্তু।’
‘আইচ্ছা।’
বড় মাছ। হাতে বুঝিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে নূরুর। সে হাতটা উঁচু করে নিয়েছে। তবুও মাছের লেজের দিকটা মাটির ওপর দিয়ে ঘষড়াতে ঘষড়াতে যাচ্ছে।
বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়ায় ফজল। শব্দ পেয়ে ছোট বোন আমিনা ছুটে আসে।
‘নূরু কই, মিয়াভাই?’
‘ও মোল্লাবাড়ি গেছে। তুই মাছগুলোরে ডুলার মইদ্যে ভইরা লইয়া আয়।’
ফজল লাফ দিয়ে নৌকা থেকে নামে। থালা-বাসন নিয়ে বরুবিবি ঘাটের দিকে আসছিল। ফজল জিজ্ঞেস করে, ‘বাজান কই, মা?’
‘ঘরে হুইয়া রইছে। শরীলডা ভালো না।’
ঘরের দরজায় পা দিয়ে ফজল ডাকে, ‘বাজান।’
‘কিরে?’ শুয়ে শুয়ে সাড়া দেয় এরফান মাতব্বর।
‘চর জাগছে।’
‘চর জাগছে!’
‘হ, আমাগ খুনের চর।’
‘খুনের চর!’
এরফান মাতব্বর বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। ‘কার কাছে হুনলি?’
‘হুনি নাই। দেইখ্যা আইছি। এক ঝাঁক বক বইছিল চরে।’
‘খুনের চর ক্যামনে বুঝলি?’
‘উত্তরমুখি চাইয়া দ্যাখলাম, বানরির জোড়া তালগাছ।’
এরফান মাতব্বর চৌকি থেকে নেমে বেরিয়ে আসে। কিছুদিন থেকেই ভালো যাচ্ছিল না তার শরীর। মাঝে মাঝে জ্বর হয়। আজও ভোর বেলায় শীত-শীত করছিল। কাঁপুনি শুরু হয়েছিল শরীরে। জ্বর আসার পূর্বলক্ষণ। তাই সে বিছানায় বসে বসে কোনো রকমে ফজরের নামাজ পড়েই আবার শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু এ মুহূর্তে খবর শুনে শীত আর কাঁপুনি কোথায় পালিয়ে গেছে! বার্ধক্যে নুয়ে পড়া শরীরটা সোজা হয়ে উঠেছে। পাকা জ্বর নিচে বড় বড় হয়ে উঠেছে ঘোলাটে চোখদুটো। মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে শিথিল হাত।
‘ফজু, শিগগির মানুষজনরে খবর দে। দ্যাখ, জমিরদ্দি, লালুর বাপ, রুস্তম, আহাদালী, মেহের মুনশি কে কুনখানে আছে। মান্দ্রায় আর শিলপারনে কারুরে পাডাইয়া দে। কদম শিকারি, ধলাই সরদার, জাবেদ লশকর আর রমিজ মিরধারে খবর দে। নাশতা খাইছস?’
‘না, পরে খাইমু।’
‘আইচ্ছা, পরেই খাইস। তুই বাইর অইয়া পড়। ঢোলে বাড়ি দিস না কিন্তু। চর জাগনের কথা কানে কানে কইয়া আহিস। দুফরের মইদ্যে বেবাক মানুষ আজির অওয়ন চাই। যার যার আতিয়ার যে লগে লইয়া আহে।’
ফজল রওনা হয়।
‘ফজু, হোন। ভাওর ঘরের বাঁশ-খুঁড়া নাও ভইরা লইয়া আইতে কইস যার যার।’
একটু দম নিয়ে হাঁক দেয় মাতব্বর, ‘নূরু…নুরু কইরে? তামুক ভইর্যা আন।’
‘নূরুরে মোল্লাবাড়ি পাডাইছি। মোল্লার পো-রে আইতে খবর কইয়া আইব।’ ফজল বলে।
‘আইচ্ছা যা তুই, আর দেরি করিস না।’
মাতব্বর মনে মনে বলে, ‘মোল্লা কি আর আইব? মাইয়া আটকাইছে। চোরামদ্দি এহন কোন মোখ লইয়া আইব আমার বাড়ি।’
ফজল চলে গেলে বিড়বিড় করে বলতে থাকে মাতব্বর, ‘আইব না ক্যান্? আইব– আইব। চর জাগনের কথা হুনলে শোশাইয়া আইব, হুহ। না আইয়া যাইব কই? কলকাডি বেবাক এই বান্দার আতে। দেহি, এইবার আমার পুতের বউ ক্যামনে আটকাইয়া রাহে।’
মাতব্বর ঘরে যায়। আফার থেকে ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি নামিয়ে উঠানে নিয়ে আসে।
থালা-বাসন মেজে ঘাট থেকে ফিরে আসে বরুবিবি। স্বামীকে হাতিয়ার নাড়াচাড়া করতে দেখে সে অবাক হয়। কিছুক্ষণ আগেই যে মানুষটিকে সে শুয়ে শুয়ে কাঁপতে দেখে গেছে, সে মানুষটিই কিনা এখন বাইরে বসে ঢাল-কাতরা-শড়কি নাড়াচাড়া করছে। সে বলে, ‘এই দেইখ্যা গেলাম ওনারে বিছানে। কোনসুম আবার এগুলা লইয়া বইছে? ওনারে কি পাগলে পাইল নি?’
‘হ, পাগলেই পাইছে। তুমি হোন নাই, ফজু কয় নাই কিছু?’
‘কই, না তো!’
‘আরে, আমাগ চর জাগছে।’
‘চর জাগছে! কোন চর?’
‘খুনের চর!’
‘খুনের চর?’
বরুবিবির বুকের ভেতর কে যেন চেঁকির পাড় দিতে শুরু করেছে। তার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। কোনো রকমে রান্নাঘরে গিয়ে সে বসে পড়ে। তার মনের আবেগ, তার বুকের ঝড় বিলাপ হয়ে বেরোয়, ‘ও আমার রশুরে, বাজান। কত বচ্ছর না যে পার অইয়া গে-ল, রশু-রে-আ-মা-র। তোরে না-যে ভোলতে না-যে পা-রি, মানিকরে-আ-মা-র।’
দশ বছরের পুরাতন শোক। সংসারের পলিমাটিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সে মাটি এখন কাঁপতে শুরু করেছে। মাতব্বরের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তার দুচোখের কোলে পানি জমে। ঝাঁপসা দৃষ্টি মেলে সে চেয়ে থাকে হাতিয়ারগুলোর দিকে।