খুনের চর।

দশ বছর আগে একবার জেগেছিল এ চর। তখন নাম ছিল লটাবনিয়া। এ চরের দখল নিয়ে মারামারি হয়েছিল দুই দলে। দুই দলের দুই প্রধান ছিল এরফান মাতব্বর আর চেরাগ আলী সরদার। দুই দলের পাঁচজন খুন হয়েছিল। এরফান মাতব্বরের দলের দু’জন আর চেরাগ আলীর দলের তিনজন। এরপর থেকেই লোকের মুখে মুখে লটাবনিয়ার নাম হয়ে যায় খুনের চর।

এরফান মাতব্বরের বড় ছেলে রশিদ চরের এ মারামারিতে খুন হয়েছিল।

বাইশ বছরের জোয়ান রশিদ। গায়ে-পায়ে বেড়ে উঠেছিল খোদাই ষাঁড়ের মতো। মাত্র বিশজন লোক নিয়ে সে চেরাগ সরদারের শ’খানেক লোকের মোকাবেলা করেছিল।

সেদিন ছিল হাটবার। চরের পাহারায় যারা ছিল তাদের অনেকেই সেদিন দিঘিরপাড় গিয়েছিল হাট-সওদা করতে। সত্তরটা ভাওর ঘরের অর্ধেকের বেশি ছিল সেদিন ঝাঁপবন্ধ। একটানা দুমাস ধরে পাহারা দিতে দিতে তাদের মধ্যে একটা অবহেলার ভাব এসে গিয়েছিল। তাদের কাছে ফুরিয়ে এসেছিল পাহারা দেয়ার প্রয়োজন। বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই ভেবে কেউ কেউ আবার ভাওর ঘরে বউ ছেলে-মেয়ে এনে ঘর-সংসারও পেতে বসেছিল। চেরাগ সরদার যে এমনি একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তারা।

দুপুর তখন গড়িয়ে গেছে। ভাওর ঘরের ছায়ায় বসে ইলশা জাল বুনছিল রশিদ। আর পাশে বসে গল্প করছিল তার দোস্ত রফি। হঠাৎ তাদের নজর পড়ে নদীর দিকে।

ষোলটা নৌকা বোঝাই লোক এ চরের দিকে আসছে।

তারা দুজনেই লাফ দিয়ে দাঁড়ায়, রশিদ গলার সবটুকু জোর দিয়ে হাঁক দেয়, ‘আইছে রে-এ-এ, আইছে, শিগগির বাইর-অ-আউগ গা…আউগ গা-আ-আ-আ…’

রফিও গলা ফাটিয়ে হাঁক দেয়, ‘তোরা কইরে—? আউগ্ গা–শিগগির আউগগা।’

এদিকে-ওদিকে যারা ছিল তারা যার যার ভাওর ঘর থেকে বেরোয়। চারদিকে চিৎকার আর শোরগোল।

রশিদ আর রফি গুলেল বাঁশ আর লুঙ্গির টোপর ভরে মাটির গুলি নিয়ে নদীর দিকে দৌড় দেয়। তাদের পেছনে আসে বাকি আর সবাই। কারো হাতে ঢাল-কাতরা, কারো হাতে শুধু শড়কি, কারো হাতে লম্বা লাঠি।

রশিদ আর রফি গুলির পর গুলি মারে নৌকার লোকদের ওপর। কিন্তু তারা বেতের ঢাল দিয়ে ফিরিয়ে দেয় সে গুলি। দুই বন্ধু বুঝতে পারে, এভাবে ওদের ঠেকানো যাবে না। তারা দৌড়ে গিয়ে ভাওর ঘর থেকে নিজেদের ঢাল-শড়কি নিয়ে আসে।

নৌকাগুলোর দশটা কিনারায় এসে ঠেকে। বাকি ছয়টা বড় নৌকা। ভাটা-পানিতে এগোতে না পেরে সেগুলো মাথা ঘোরায় পাশের চলপানির দিকে।

আধ-হাঁটু পানিতে নামে চেরাগ সরদারের লোকজন। ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি নিয়ে তারা মার-মার করতে করতে এগিয়ে আসে।

চরের কাইজ্যায় একদল চায় অন্য দলকে হটিয়ে তাড়িয়ে দিতে। বেকায়দায় না পড়লে খুন-খারাবির মধ্যে কেউ যেতে চায় না। খুন-জখম হলেই থানা-পুলিসের হাঙ্গামা আছে, মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলা আছে, জেল-হাজতের ভয় আছে।

চেরাগ সরদারও তাই খুনাখুনি এড়াবার জন্য হাটের দিনটি বেছে নিয়েছিল। সে ভেবেছিল, তাদের এত লোকজন ও মারমার হামাহামি শুনে এরফান মাতব্বরের গুটিকয়েক লোক চর ছেড়ে ভেগে যাবে। তখন সহজেই দখল করা যাবে চর।

কিন্তু অত সহজে চরটা দখল করা যায়নি।

রশিদ তার লোকজন নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। চেরাগ সরদারের দল ডাঙায় উঠতে না উঠতেই শুরু হয়ে যায় মারামারি।

দলের একজনকে খুন হতে দেখেই রশিদ খেপে যায়। মারমার ডাক দিয়ে এগিয়ে যায় সে। তার শড়কির ঘায়ে একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে তিরতিরে পানির মধ্যে।

প্রথম দশটা নৌকা থেকে দলটি নেমেছিল, রশিদ ও তার দল তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায়। আরো একটা লাশ ফেলে তাদের অনেকেই পিছু হটে নৌকার দিকে। কিন্তু আরো ছ’খানা নৌকায় করে যারা এসেছিল তারা অন্য দিক দিয়ে নেমে এসে রশিদ ও তার লোকদের ঘিরে ফেলে। আর সকলের মতো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে রশিদও বাঁচতে পারত। সাঁতার দিয়ে নাগরারচরে গিয়ে উঠতে পারত। কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়ায়। আরো একজনের জান নিয়ে নিজের জান দেয় সে।

তারপর থানা-পুলিস, তদন্ত-তল্লাশ, ধর-পাকড়, হাজত। আদালতে দুই দলের বিরুদ্ধেই মামলা ওঠে খুন আর হাঙ্গামার। এক মামলায় আসামি চেরাগ সরদার ও তার দলের বিশজন; অন্য মামলায় এরফান মাতব্বরের দলের তেরো জন।

আসামিরা সবাই দিশেহারা। তারা বুঝতে পারে, ফাঁসির দড়ি না হোক, ঘানির জোয়াল ঝুলে আছে সবারই ঘাড়ের ওপর।

এখন কি করা যায়?

চেরাগ সরদার নিজেই এক মামলার আসামি। তাই প্রথমে সে-ই আপোসের প্রস্তাব পাঠায় এরফান মাতব্বরের কাছে।

আপোসের কথা শুনেই রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে মাতব্বরের। তার জানের টুকরো ছেলেকে যারা খুন করেছে, তাদের সাথে আপোস!

প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল এলাকার দফাদার সামেদ আলী। মাতব্বরের দলেরও জনকয়েক এসেছিল তার পিছু পিছু।

ক্রোধে মাতব্বরের মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথা বেরোয় না। শেষে নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তেজিত স্বরে সে বলে, ‘না, কিছুতেই না। ওর সাথে কোনো আপোস নাই। ওরে জেলের ভাত না খাওয়াইয়া ছাড়মু না–ছাড়মু না, কইয়া দিলাম। তুমি যাও, কও গিয়া তারে।’

মাতব্বরের দলের আহাদালী বলে, ‘হে অইলে জেলের ভাত তো আমাগ কপালেও লেখা আছে, মাতব্বরের পো।’

তার কথায় সায় দিয়ে জমিরদ্দি বলে, ‘মিটমাট কইর‍্যা ফালানডাই ভালো। কেবুল ওগই জেলের ভাত খাইয়াতে পারতাম তয় এক কথা আছিল। ওগ সাথ সাথ যে আমাগও জেলে যাইতে অইব।’

মাতব্বর এ কথা ভাবেনি তা নয়। কিন্তু আপোসের কথা ভাবলেই তার প্রতিশোধকামী মনে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। ক্রোধে ফুলে ওঠে সারা শরীর। তার কাছে আপোস মানেই পরাজয়, মৃত ছেলের স্মৃতির অবমাননা।

শেষ পর্যন্ত দলের লোকজনের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না এরফান মাতব্বর। চেরাগ সরদার আর চরের দাবি করবে না, এই শর্তে আপোস করতে রাজি হয় সে। এ সিদ্ধান্ত নিতে দশ দিন লেগেছিল তার।

কিন্তু আপোস করলেই তো আর চুকে গেল না সব। মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়? খুনের মামলা। এ তো ছেলেখেলা নয় যে, চায় মন খেলোম, না চায় মন চলোম।

দফাদার সে বুদ্ধিও দেয়, তার লেইগ্যা চিন্তা নাই। আদালতে উল্ট-পাল্ডা, আবোল তাবোল সাক্ষী দিলেই মামলা ঢিশমিশ অইয়া যাইব। কোন সওয়ালের পিডে কি জওয়াব দিতে অইব তা উকিলরাই ঠিক কইর‍্যা দিব।

শেষে সে রকম ব্যবস্থাই হয়েছিল। দুই বিবাদী পক্ষের দুই উকিল মিলে সাক্ষীদের ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে দেন। সরকার পক্ষের উকিলের প্রশ্নের জবাবে সাক্ষীরা সেই শেখানো বুলি ছেড়ে দেয়। একজনের জবানবন্দির সাথে আর একজনেরটার মিল হয় না। ঘটনা চোখে দেখেছে এমন সাক্ষীরাও বিনা দ্বিধায়, কোনো রকম লজ্জা-শরমের ধার না ধেরে বলে যায়, তারা নিজের চোখে দেখেনি, অমুকের কাছে শুনেছে। সাক্ষীদের কয়েকজনকে বিরুদ্ধাচারী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোনো ভাবেই সরকারবাদি মামলা টেকে না। যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে দুটো খুনের মামলার আসামিরাই খালাস পেয়ে যায়।

খুনাখুনির পরই চরটাকে ক্রোক করে সাময়িকভাবে সরকারি দখলে রাখার হুকুম দিয়েছিল আদালত। ভবিষ্যতে যাতে আবার শান্তিভঙ্গ না হয় সে জন্যই থানার পুলিস এ ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করেছিল। পরে যে পক্ষ মামলায় জিতবে, সে-ই হবে চরের মালিক।

আপোসের শর্ত অনুসারে চেরাগ সরদার আর চরের দাবি করেনি। তাই আদালতের রায়ে এরফান মাতব্বরই চরটা ফিরে পায় আবার।

খবর পেয়ে আটিগাঁর পাঞ্জু বয়াতি বখশিশের লোভে এরফান মাতব্বরের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। দোতারা বাজিয়ে সে নিজের বাধা পুরাতন একটা গান জুড়ে দেয়–

লাঠির জোরে মাটিরে ভাই

লাঠির জোরে মাটি,

লাঠালাঠি কাটাকাটি,

আদালতে হাঁটাহাঁটি,

এই না হলে চরের মাটি

হয় কবে খাঁটি…রে।

পাঞ্জু বয়াতির এ গান এখন চরবাসীদের কাছে আপ্ত বাক্যের মর্যাদা লাভ করেছে। তাদের মুখে মুখে ফেরে এ গান। তাদের অভিজ্ঞতার থেকেও তারা বুঝতে পেরেছে, নতুন চর জাগলে এসব ঘটনা ঘটবেই। লটাবনিয়ার বেলায়ও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। লাঠালাঠি হলো, কাটাকাটি হলো। আদালতে হাঁটাহাঁটিও হলো প্রায় দু’বছর। তারপর ফিরে এল শান্তি। খাঁটি হলো চরের মাটি।

এরফান মাতব্বর তার বর্গাদার ও কোলশরিকদের মধ্যে চরের জমি ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়। চরের বুকে গড়ে ওঠে নতুন বসতি। শুরু হয় নতুন জীবন।

কিন্তু এত কাণ্ডের পর খাঁটি হলো যে মাটি, তা আর মাত্র তিনটি বছর পার হতে না হতেই ফাঁকি হয়ে গেল। পদ্মার জঠরে বিলীন হয়ে গেল খুনের চর।

সেই খুনের চর আবার জেগেছে।

এরফান মাতব্বর গামছায় চোখ মোছে। বরুবিবির বিলাপ থেমেছে কিন্তু হায়-মাতম থামেনি। থেকে থেকে তার বক্ষপঞ্জর ভেদ করে হাহাকার উঠছে–‘আহ্ বাজান, আহ সোনা-মানিক!’

এরফান মাতব্বর উঠে দাঁড়ায়। রান্নাঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে নিজে নিজেই বলে, ‘আর কাইন্দা কি করমু! কান্দলেই যদি পুত পাইতাম তয় চউখের পানি দিয়া দুইন্যাই ভাসাইয়া দিতাম।’

তারপর রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে সে বলে, ‘অ্যাদে ফজুর মা, আর কাইন্দ না। আল্লার বেসাত আল্লায় লইয়া গেছে। কাইন্দা আর কি করমু। ওডো এইবার। মানুষজন আইয়া পড়ল বুইল্যা। তুমি চাইলে-ডাইলে বড় ডেগটার এক ডেগ চড়াইয়া দ্যাও শিগগির।’

বরু বিবি কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘কাইজ্যা করতে ওনরাই যে যায়। আমার ফজুরে চরের ধারেকাছেও যাইতে দিমু না।’

‘আইচ্ছা না দ্যাও, না দিবা। অখন যা কইলাম তার আয়োজন কর। আমি মাডি খুইদ্যা চুলা বানাইয়া দিতে আছি উডানে।’

বরুবিবির বুকের ঝড় থামতে অনেক সময় লাগে। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সে মসলা বাটে, চুলো ধরায়। তারপর চাল-ডাল ধুয়ে এনে খিচুড়ি বসিয়ে দেয় এক ডেগ। চুলোর মধ্যে শুকনো লটা গুঁজতে গুঁজতে তার কেবলই দীর্ঘশ্বাস পড়ে।