মান্দ্রা আর শিলপারনে ‘খবরিয়া’ পাঠিয়ে আশপাশের লোকজনকে খবর দিয়ে ফজল বাড়ি ফিরে আসে। এসেই সে নূরুর খোঁজ করে।
তার মনটা চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে রয়েছে। নূরু ফিরে এলে শোনা যাবে মোল্লাবাড়ির খবরাখবর। ওকে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কথার জাল পাতলে রূপজানের কথাও কিছু বের করা যাবে।
স্কুলের বেলা হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও তার ফেরবার নাম নেই। সে আন্দাজ করে, নূরু ঠিক রূপজানের পাল্লায় পড়েছে। আদর দিয়ে দিয়ে সে ছেলেটার মাথা খেয়ে ফেলবে।
এজন্য রূপজানের ওপর কিন্তু রাগ হয় না ফজলের। বরং প্রসন্নই হয় তার মন। বাপ মার স্নেহ বঞ্চিত ছেলেটাকে সে নিজেও বড় কম আদর করে না। পড়াশুনার জন্য মাঝে মাঝে সে একটু তয়-তম্বি করে। ব্যস, ঐ পর্যন্তই। ওর দাদা-দাদির জন্য ওর গায়ে একটা ফুলের টোকা দেয়ার যো নেই।
নূরুর বয়স যখন পাঁচমাস তখন তার বাবা রশিদ চরের কাইজ্যায় খুন হয়। কোলের শিশু নিয়ে বিধবা হাজেরা তিন বছর ছিল মাতব্বর বাড়ি। দু’মাস-তিন মাস পরে সে বাপের বাড়ি মুলতগঞ্জে বেড়াতে যেত। দশ-বারো দিন পার হতে না হতেই এরফান মাতব্বর নিজে গিয়ে তাকে নিয়ে আসত আবার। বলত, ‘নাতিডা চউখের কাছে না থাকলে ভালো ঠেকে না। পরানডা ছনিবনি করে।’
এমনি একবার বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল হাজেরা। তার বাবা শরাফত দেওয়ান। জোর করে আবার তার নিকে দিয়ে দেয়। মেয়ের কোনো রকম আপত্তিই সে শোনেনি। নূরুর কি হবে ভেবে সে অনেক কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ-মুখ। স্বামীর বাড়ি গিয়েও তার চোখের পানি শুকোয়নি। অবস্থা দেখে পরের দিনই তার স্বামী জালাল মিরধা দেওয়ানবাড়ি থেকে নূরুকে নিয়ে যায়। তাকে হাতুয়া পোলা হিসেবে রাখতে রাজি হয় সে।
এ নিকেতে এরফান মাতব্বরকে দাওয়াত দেয়া দূরে থাক, একটু যোগ-জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি শরাফত দেওয়ান। সম্বন্ধের যোগাড়যন্ত্র সবই খুব গোপনে সেরেছিলো সে। তার ভয় ছিল, খবরটা কোনো রকমে মাতব্বরের কানে গেলে সে হয়তো গোলমাল বাঁধাবে।
তিন দিন পর এরফান মাতব্বরের কাছে খবর পৌঁছে। শুনেই সে রাগে ফেটে পড়ে।
অনেক আরজু নিয়ে দেশ-কুলের এ মেয়েকে ছেলের বউ করে ঘরে নিয়েছিল মাতব্বর। আসুলির ‘ভাল মাইনষে’র সাথে একটা প্যাঁচ দেয়ার জন্য সে পানির মতো টাকা খরচ করেছিল। মেয়ের বাপকে রাজি করাবার জন্য তিনশ একটাকা শাচক দিতে হয়েছিল। মেয়েকে সোনা দিতে হয়েছিল পাঁচ ভরি।
হাজেরার নিকে দিয়েছে, মাতব্বরের রাগ সে জন্য নয়। ছেলের মৃত্যুর পরই সে বুঝতে পেরেছিল, এ মেয়ের ওপর তার আর কোনো দাবি নেই। কাঁচা বয়সের এ মেয়েকে বেশি দিন ঘরে রাখা যাবে না, আর রাখা উচিতও নয়। তবু তিন-তিনটে বছর শ্বশুরবাড়ির মাটি কামড়ে পড়েছিল হাজেরা। দুধের শিশুকে সাড়ে তিন বছরেরটি করেছে। তার কাছে এর বেশি আর কি আশা করা যায়?
কিন্তু রাগ হয়েছিল তার অন্য কারণে। শরাফত দেওয়ান তার মেয়ের নিকে দিয়েছে। দিক, তাকে যোগ-জিজ্ঞাসা করেনি, না করুক। কিন্তু তার নাতিকে তার হাতে সোপর্দ করে দিয়ে যায়নি কেন সে? সে কি মনে করেছে মাতব্বরকে?
রাগের চোটে তার মনের স্থৈর্য লোপ পায়। বিড়বিড় করে সে বলে, ‘আসুলির হুগ্না ভাল্ মানুষ। হালার লাগুর পাইলে দুইডা কানডলা দিয়া জিগাইতাম, কোন আক্কেলে ও আমার নাতিরে আউত্যা বানাইয়া মাইনষের বাড়ি পাডাইছে।’
একবার সে ভাবে, যাবে নাকি লাঠিয়াল-লশকর নিয়ে মিরধা বাড়ি? পয়লা মুখের কথা, কাজ না হলে লাঠির গুতা। তার বিশ্বাস, লাঠির গুতা না পড়লে নাতিকে বের করে আনা যাবে না। কিন্তু ফৌজদারির ভয়ে শেষ পর্যন্ত সে নিরস্ত হয়।
ফজলের বয়স তখন সতেরো বছর। সে এক বাড়িতে জায়গীর থেকে নড়িয়া হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। মাতব্বর তাকে গোপনে খবর পাঠায়, ভুলিয়ে-ভালিয়ে, চুরি করে বা যেভাবেই হোক নূরুকে যেন সে বাড়ি নিয়ে আসে।
মুলফতগঞ্জ ও নড়িয়া পাশাপাশি গ্রাম। ফজল সুযোগ খুঁজতে থাকে। হাজেরা বাপের বাড়ি নাইয়র এলে সে একদিন দেওয়ানবাড়ি বেড়াতে যায়। নূরুকে জামা কিনে দেয়ার নাম করে মুলতগঞ্জের হাটে নিয়ে যায় সে। সেখান থেকে নৌকা করে দে পাড়ি! নূরুকে বুকের সাথে জাপটে ধরে সে বাড়ি গিয়ে হাজির হয়।
সেদিন থেকেই সে দাদার আবদার, দাদির আহ্লাদ আর চাচার আদর পেয়ে বড় হয়ে উঠছে। বাপ-মার অভাব কোনোদিন বুঝতে পারেনি। সে এতখানি বড় হয়েছে, এখন পর্যন্ত দাদির আঁচল ধরে না শুলে তার ঘুম হয় না। দাদার পাতে না খেলে পেট ভরে না। আর চাচার সাথে হুড়োকুস্তি না করলে হজম হয় না পেটে ভাত।
ফজল ঘরের ছাঁচতলা গিয়ে পুবদিকে তাকায়। না, নূরুর টিকিটিও দেখা যায় না।
সে তামাক মাখতে বসে যায়। এত লোকের কল্কে সাজাতে অল্প-স্বল্প তামাকে হবে না। সে দেশী তামাকের মোড়া মুগুরের ওপর রেখে কুচিকুচি করে কাটে। তলক হওয়ার জন্য কিছু মতিহারি তামাক মিশিয়ে নেয় তার সাথে। শেষে মিঠাম করার জন্য রাব মিশিয়ে হাতের দাবনা দিয়ে ডলাই-মলাই করে।
লোকজন মাতব্বর বাড়ি এসে জমায়েত হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। প্রত্যেকেই ভাওর ঘরের জন্য বাঁশ-খোটা, দড়াদড়ি যে যা পেরেছে নৌকা ভরে নিয়ে এসেছে। নিজ নিজ হাতিয়ারও নিয়ে এসেছে সবাই।
ধারে-কাছের কিছু লোক আগেই এসেছিল। এরফান মাতব্বর তাদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। দুজন গেছে চুলার ধারে তাদের চাচিকে সাহায্য করতে। তিন-চারজন জং ধরা শড়কি আর কাতরা ঘষতে লেগে গেছে পাথরের ওপর। একজন বালিগচার ওপর কোপা দা আর কাটারিতে ধার দিচ্ছে।
কয়েকজন গেছে কাশ আর চুইন্যা ঘাস কাটতে। ভাওর ঘর তুলতে দরকার হবে এসব ঘাস-পাতার। এগুলোর গোড়ার দিকটা দিয়ে হবে বেড়া আর আগার দিকটা দিয়ে ছাউনি। খুঁটির বাঁশে টান পড়বে। তাই কয়েকজন চলে গেছে নদীর উত্তর পাড়। বানরি ও হাশাইল গ্রাম থেকে বাঁশ কিনে তারা সোজা গিয়ে চরে উঠবে।
লোক এসেছে একশরও বেশি। এত লোকের জন্য থালা-বাসন যোগাড় করা সোজা কথা নয়। ফজল কলাপাতা কাটতে লেগে যায়। কঞ্চির মাথায় কাস্তে বেঁধে সে কলাগাছের আগা থেকে ডাউগ্গা কাটে। তারপর এক একটাকে খণ্ড করে চার-পাঁচটা।
খেতের আল ধরে নূরু আসছে। ধানগাছের মাথার ওপর দিয়ে ওর মাথা দেখা যায়।
ওকে দেখেই ফজলের পাতা কাটা বন্ধ হয়ে যায়। তার বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে।
‘ইস, আবার টেরি কাটছে মিয়াসাব।’ নূরুর দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ফজল।
কাছে এলে সে আবার লক্ষ্য করে, শুধু পরিপাটি করে চুলই আঁচড়ায়নি নূরু, তেলে চকচক করছে চুল। চোখে সুরমাও লাগিয়েছে আবার। গায়ের জামা আর লুঙ্গিটাও তত বেশ পরিষ্কার মনে হচ্ছে। তার বুঝতে বাকি থাকে না, এসব কাজে কার হাত লেগেছে।
বাড়ির কাছে আসতেই ফজল ডাক দেয়, ‘এই নূরু, এই দিগে আয়।’
কাছে এলে সে কপট রাগ দেখায়, ‘কিরে তোরে না বারহায় বারহায় কইয়া দিছিলাম জল্দি কইর্যা আইয়া পড়িস। ইস্কুলে যাইতে অইব।’
‘চাচি আইতে দিল না যে।’
ফজলের অনুমান ঠিকই হয়েছে। সে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আইতে দিল না ক্যান্?’
‘চাচি কয়, এদ্দিন পরে আইছস, না খাইয়া যাবি কই?’
‘ও তুমি প্যাট তাজা কইর্যা আইছ?’
‘না খাইয়া আইতে দিল না যে! আবার কইছিল, আইজ থাইক্যা কাইল যাইস।’
‘ইস্ আদরের আর সীমা নাই। কি খাওয়াইলরে?’
‘বেহানে গিয়া খাইছি কাউনের জাউ আর আন্তেশা পিডা। দুফরে পাঙাশ মাছ ভাজা, পাঙাশ মাছের সালুন, ডাইল। হেষে দুধ আর ক্যালা।’
‘ক্যালা কস ক্যারে? ইস্কুলে পড়স, কলা কইতে পারস না?’ মুচকি হেসে আবার বলে সে, ‘কলা কইতে পারে না, জাদু আমার ট্যাড়া সিঁথি কাটছে, হুঁহ!’
নূরু লজ্জা পেয়ে হাতের এক ঝটকায় চুলগুলো এলোথেলো করে দিয়ে বলে, ‘আমি বুঝি কাটছি, চাচি আঁচড়াইয়া দিছে।’
ফজল নূরুকে হাত ধরে পরম স্নেহে কাছে টেনে নেয়। আঙুলের মাথা দিয়ে বিস্রস্ত চুল দু’দিকে সরিয়ে সিঁথিটা ঠিক করতে করতে বলে, ‘তোর চোখে সুরমা লাগাইয়া দিছে কে রে?’
‘চাচি।’
‘লুঙ্গি আর জামাডাও বুঝি তোর চাচি ধুইয়া দিছে?’
‘হ।’
‘তোর চাচি কিছু জিগায় নাই?’
‘হ জিগাইছে, তোর দাদা কেমুন আছে? তোর দাদি কেমুন আছে?’
‘আর কারো কথা জিগায় নাই?’
‘হ জিগাইছে, তোর চাচা কেমুন আছে?’
‘তুই কি কইছস?’
‘কইছি বেবাক ভালো আছে।’
‘আর কি কইছে?’
‘আর কইছে তোগ লাল গাইডা বিয়াইছে নি?’
‘আর …?’
নূরু তার পকেট থেকে একটা ছোট মোড়ক বের করে। কাগজের মোড়কটা ফজলের হাতে দিয়ে সে বলে, ‘চাচি কইছে, এইডার মইদ্যে একখান তাবিজ আছে। পীরসাবের তাবিজ।’
‘হ তোমারে এইডা মাজায় বাইন্দা রাখতে কইছে।’
‘ক্যান?’
‘চাচি কইছে, বালা-মসিবত আইতে পারব না। আর অজু না কইর্যা এইডা খুলতে মানা করছে চাচি।’
‘ক্যান, খুললে কি অইব?’
‘খুললে বোলে চউখ কানা অইয়া যাইব।’
ফজল মনে মনে হাসে। রূপজানের চাল ধরে ফেলে সে। নূরু যাতে খুলে না দেখে, সে-জন্যই সে চোখ কানা হওয়ার ভয় দেখিয়েছে।
ফজল মোড়কটা পকেটে পুরে বলে, ‘আইচ্ছা যা তুই।’
নূরু কিছুদূর যেতেই ফজল ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে তোর নানাজান আইল না?’
‘হে বাড়িতে নাই, গরু কিনতে মুনশিরহাট গেছে।’
নূরু চোখের আড়াল হতেই ফজল কলাগাছের ঝাড়ের মধ্যে গিয়ে ঢোকে। পকেট থেকে বের করে মোড়কটা। সুতা দিয়ে ওটাকে আচ্ছামতো পেঁচিয়ে দিয়েছে রূপজান। সুতার প্যাঁচ খুলে সে মোড়কটার ভেতরে পায় একটা সাদা রুমাল আর ভাঁজ করা একটা কাগজ। রুমালটার এক কোণে এমব্রয়ডারি করা ফুল ও পাতা। তার নিচে সুচের ফোর দিয়ে লেখা, ‘ভুলনা আমায়।’
ফজল রুমালটা গালের সাথে চেপে ধরে। তারপর ওটাকে পকেটে রেখে সে ভাঁজ করা কাগজটা খুলে পড়ে।
প্রাণাধিক,
হাজার হাজার বহুত বহুত সেলাম পর সমাচার এই যে আমার শত কোটি ভালবাসা নিও। অনেক দিন গুজারিয়া গেল তোমারে দেখি না। তোমারে একটু চউখের দেখা দেখনের লেইগ্যা পরানটা খালি ছটফট করে। তুমি এত নিষ্ঠুর। একবার আসিয়া আমার খবরও নিলা না। বাজান তোমার উপরে রাগ হয় নাই। সে রাগ হইছে মিয়াজির উপরে। সে আমার গয়না বেচিয়া খাইছে। সেই জন্যই বাজান রাগ হইছে। কিন্তু আমি গয়না চাই না। তুমিই আমার গয়না, তুমিই আমার গলার হার। তুমিই আমার পরানের পরান। যদি তোমার পরানের মধ্যে আমারে জায়গা দিয়া থাক তবে একবার আসিয়া চউখের দেখা দিয়া যাইও। তোমার লেইগ্যা পথের দিগে চাহিয়া থাকিব।
নূরুর কাছে শোনলাম, খুনের চর জাগছে। তোমার আল্লার কিরা, চরের কাইজ্যায় যাইও না। ইতি।
অভাগিনী
রূপজান
ফজল কাগজটা উল্টে দেখে, সেখানে একটা পাখি আঁকা। তার নিচে লেখা রয়েছে, ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে।’
তারও নিচে লেখা আছে একটা পরিচিত গানের কয়েকটা লাইন–
যদি আমার পাখারে থাকত,
কে আমারে ধরিয়া রাখত,
উইড়া যাইতাম পরান বন্ধুর দ্যাশেরে ॥
ফজল চিঠিটা আবার প্রথম থেকে পড়তে শুরু করে।
‘ফজু কই রে? অ ফজু…’
‘জ্বী আইতে আছি। পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে ফজল তাড়াতাড়ি চিঠিটা পকেটে পোরে। সে আরো কিছু কলাপাতা কেটে বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলছে এরফান মাতব্বর।’
খিচুড়ি রান্না শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।
মাতব্বর বলে, ‘এই হানে খাওনের হেঙ্গামা করলে দেরি অইয়া যাইব। এক কাম করো, খিচুড়ির ডেগটা নায় উড়াইয়া লও। নাও চলতে চলতে যার যার নায়ের মইদ্যে বইয়া খাইয়া লইও।’
রমিজ মিরধা বলে, ‘হ এইডাই ভালো। খাইতে খাইতে যদি দিন কাবার অইয়া যায় তয় কোনো কাম অইব না।’
লোকজন খিচুড়ির ডেগটা ধরাধরি করে মাতব্বরের ছই-বিহীন ঘাসি নৌকায় তোলে। কলাপাতাগুলো লোক অনুসারে প্রত্যেক নৌকায় ভাগ করে দেয় ফজল। বাঁশ-খোঁটা, লাঠি শড়কি, ঢাল-কাতরা আগেই নৌকায় উঠে গেছে। এবার লোকজনও যার যার নৌকায় উঠে যায়।
নূরু এসে ফজলকে ডাকে, ‘ও দুদু, দাদি তোমারে বোলায়।’
ফজল উঠানে গিয়ে দেখে, ‘তার বাবা আর মা ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে।’
মাতব্বর বলে, ‘জুয়ান পোলা দশজনের লগে যাইব না, এইডা কেমুন কথা! মাইনষে হুনলে কইব কি? বাঘের ঘরে মেকুর পয়দা অইছে।’
‘কইলে কউক। আমার পোলা আমি যাইতে দিমু না।’
‘যাইতে দিবা না, তয় কি মুরগির মতন খাঁচায় বাইন্দা রাখতে চাও?’
‘মাইনষের কি আকাল পড়ছে নি? দুইডা না, তিনডা না, একটা পোলা আমার। ও না গেলে কি অইব?’
‘কি অইব, তুমি বোঝ্বা না। আমার দিন তো ফুরাইয়া আইল, আমি চউখ বুজলে ও-ই অইব মাতব্বর। আপদে-বিপদে মাইনষের আগে আগে চলতে না হিগলে মাতবরি-সরদারি করব কেমন কইর্যা?’
‘থাউক, আমার পোলার মাতবরি-হরদারি করণ লাগব না।’
ফজল এগিয়ে গিয়ে মা-কে বাধা দেয়, ‘তুমি চুপ অওতো মা। কি শুরু করছ?’
তারপর সে তার পিতার দিকে চেয়ে বলে, ‘বাজান, বেবাক জিনিস নায়ে উইট্যা গেছে। আপনে ওঠলেই এখন রওনা দিতে পারি।’
বরুবিবি এবার ফজলকে বলে, ‘অ ফজু, বাজানরে তুই যাইস না।’
‘ক্যান যাইমু না?’
‘ক্যান্ যাইমু না, হায় হায়রে আবার উল্ডা জিগায় ক্যান্ যাইমু না। তয় যা-যা তোরা বাপে পুতে দুইজনে মিল্যা আমার কল্ডাডা কাইট্যা থুইয়া হেষে যা।’
মাতব্বর কাছে এসে ধীরভাবে বলে, ‘ও ফজুর মা, হোন। আমরা তো কাইজ্যা করতে যাইতে আছি না। এইবার আর কাইজ্যা অইব না। চেরাগ আলী ঐ বচ্ছর যেই চুবানি খাইছে, এই বচ্ছর আর চরের ধারে কাছে আইতে সাহস করব না।’
‘তয় ফজুরে নেওনের কাম কি?’
‘ও না গেলে মানুষ-জনেরে খাওয়াইব কে? আর হোন, কাইজ্যা লাগলে ওরে কাইজ্যার কাছে যাইতে দিমু না। তুমি আর ভাবনা কইর্য না। চলরে ফজু, আর দেরি করণ যায় না।’
বাপের পেছনে পেছনে ছেলে রওনা হয়। নূরু বরুবিবির কাছেই দাঁড়ানো ছিল। তাম্শা দেখবার জন্য সে-ও নৌকাঘাটার দিকে রওনা হয়। বরুবিবি খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। তারপর তাকে কোলের মধ্যে নিয়ে সে বিলাপ করতে শুরু করে দেয়, ‘ও আমার রশুরে, বাজান তোরে না যে ভোলতে না যে-পা-আ-আ-রি, সোনার চান ঘরে থুইয়া কেমনে চইল্যা গে-এ-এ-লি, বাজানরে-এ-এ-এ, আ-মা–র।’
এরফান মাতব্বর নৌকায় উঠেই তাড়া দেয়, ‘আর দেরি কইর্য না। এইবার আল্লার নাম লইয়া রওনা দ্যাও।’
লোকজন যার যার নৌকা খুলে রওনা হয়। মেহের মুনশি হাঁক দেয়, ‘আল্লা-রসুল বলো ভাইরে ম-মী-ঈ-ঈ-ন…’
‘আল্লা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুনশির কথার শেষ ধরে বাকি সবাই ‘জাক্কইর’ দেয়।
মাতব্বরের ঘাসি নৌকার আগে-পিছে তেইশখানা নৌকা চলছে। কোনোটায় চারজন, কোনোটায় বা পাঁচজন করে লোক। কিছুদূর গিয়েই ফজল খিচুড়ি পরিবেশন করতে লেগে যায়। সে ইযারি হাতে ডেগের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। চলতে চলতে এক একটা ডিঙি এসে নৌকার সাথে ভিড়ে। ফজল লম্বা হাতলওয়ালা কাঠের ইযারি দিয়ে ডেগ থেকে খিচুড়ি তুলে কলাপাতার ওপর ঢেলে দেয়।
এরফান মাতব্বর লোকজনদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে, ‘যার যার প্যাট ভইরা খাইও মিয়ারা। রাইতে কিন্তু খাওয়ার যোগাড় করণ যাইব না।’
এরফান মাতব্বর সকলের ওপর দিয়ে গাছ-মাতব্বর। তার সাথে ঘাসি নৌকায় বসে আলাপ-আলোচনা করছে পুলকি-মাতব্বর রমিজ মিরধা, জাবেদ লশকর, মেহের মুনশি আর কদম শিকারি। পুলকি অর্থাৎ সদ্য উদ্গত গাছের শাখার মতোই তারা কচি মাতব্বর। তাদের চারপাশে বসেছে সাত-আটজন কোলশরিক।
তারা পরামর্শ করে ঠিক করে, চরের উত্তর দিকটা পাহারা দেয়ার জন্য জাবেদ লশকর ও তার লোকজন ভাওর ঘর তুলবে। এভাবে দক্ষিণদিকে কদম শিকারি, পশ্চিমদিকে রমিজ মিরধা আর পুবদিকে মেহের মুনশি তাদের লোকজন নিয়ে পাহারা দেবে। যদি কেউ চর দখল করতে আসে তবে পুবদিক দিয়ে আসার সম্ভাবনাই বেশি। তাই এরফান মাতব্বর ও তার আত্মীয়-স্বজন পুবদিকটায় ভাওর ঘর তুলবার মনস্থ করে।
সবগুলো ডিঙির লোকজন খাওয়া শেষ করেছে। এবার মাতব্বর ঘাসি নৌকার সবার সাথে খেতে বসে। খেতে খেতে সবাই তারিফ করে খিচুড়ির। রমিজ মিরধা বলে, ‘চাচির আতের খিচুড়ি যে খাইছে, হে আর ভেলতে পারব না কোনোদিন।’
রান্নার প্রশংসা শুনে মাতব্বর খুশি হয়। কিন্তু সবার অজান্তে সে একটা দীর্ঘশ্বাসও ছাড়ে। আর মনে মনে ভাবে, ‘এ তারিফ যার প্রাপ্য সে আর মাতব্বর বাড়ি নেই এখন।’
আসুলির ভাল মাইনষের ঘরের মেয়ে ক’টা বছরের জন্য এসে মাতব্বর বাড়ির রান্নার ধরনটাই বদলে দিয়ে গেছে। হাজেরা এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর বরুবিবি তার হাতেই রসুইঘরের ভার ছেড়ে দিয়েছিল। হাজেরা বাপের বাড়ি নাইয়র গেলে মুশকিল বেঁধে যেত। স্ত্রীর হাতের রান্না খেয়ে মাতব্বর মুখ বিকৃত করে বলত, ‘নাগো, ভাল্ মাইনষের মাইয়ার রান্দা খাইতে খাইতে জিব্বাডাও ভাল মানুষ অইয়া গেছে। তোমাগ আতের ফ্যাজাগোজা আর ভাল লাগে না।’
নিরুপায় হয়ে বরুবিবিকে শেষে পুতের বউর কাছে রান্না শিখতে হয়েছিল।
এরফান মাতব্বর তার লোকজন নিয়ে যখন নতুন চরে পৌঁছে, তখন রোদের তেজ কমে গেছে।
মাতব্বর সবাইকে নির্দেশ দেয়, যার যার জাগায় ডিঙ্গা লইয়া চইল্যা যাও। আমরা ‘আল্লাহু আকবর’ কইলে তোমরা ঐলগে আওয়াজ দিও। এই রহম তিনবার আওয়াজ দেওনের পর ‘বিছমিল্লা’ বুইল্যা বাঁশগাড়ি করবা।
একটু থেমে সে আবার বলে, ‘তোমরা হুঁশিয়ার অইয়া থাইক্য। রাইতে পালা কইর্যা পাহারা দিও এক একজন।’
লোকজন নিজ নিজ নির্ধারিত স্থানে ডিঙি নিয়ে চলে যায়।
আছরের নামাজ পড়ে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মাতব্বর। তারপর লোকজন নিয়ে নৌকা থেকে নামে। বাঁশের খোটা হাতে এক একজন হাঁটু পানি ভেঙে মাতব্বরের নির্দেশ মতো দূরে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।
ফজলকে ডেকে মাতব্বর বলে, ‘অ ফজু, এইবার আল্লাহু আকবর আওয়াজ দে।’
ফজল গলার সবটুকু জোর দিয়ে হাঁক দেয়, ‘আল্লাহু আকবর।’
চরের চারদিক থেকে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আওয়াজ ওঠে, ‘আল্লাহু আকবর।’
তিনবার তকবির ধ্বনির পর একসাথে অনেকগুলো বাঁশ গেড়ে বসে চরের চারদিকে। দখলের নিশান হয়ে সেগুলো দাঁড়িয়ে থাকে পলিমাটির বুকে।