আসাধারণ রূপ নিয়ে জন্মেছিল বলে নাম রাখা হয়েছে রূপজান। গাছপাকা শব্রি কলার মতো তার গায়ের রঙ। যৌবনে পা দেয়ার সাথে সাথে সে রঙের ওপর কে যেন মেখে দিয়েছে জোছনার স্নিগ্ধতা। তার ঈষৎ লম্বা মুখে টিকলো নাক। মমতা মাখানো টানা চোখ। চোখ দুটির যেন আলাদা সত্তা আছে। পাতলা ঠোঁট নেড়ে কথা বলার সময় প্রজাপতির ডানার মতো নড়ে তার চোখের পাপড়ি। ঝিলিক মেরে ওঠে ঘন নীল চোখের তারা। হাসবার সময় শশার বিচির মতো ছোট ছোট সুবিন্যস্ত দাঁত দেখা যায় কি যায় না।
শুধু রঙ-চেহারাই নয়। স্বাস্থ্যও তার ভাল। দোহারা গড়ন। দিঘল শরীর থেকে লাবণ্য যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। মজবুত ভিতের ওপর গঠিত তার পরিপুষ্ট বক্ষে যেন বাসা বেঁধেছে সারা দুনিয়ার লজ্জা। প্রতিবেশিনীদের বিবেচনায় শরীরটা রূপজানের আমুনে। বুড়িয়ে যাবে না তাড়াতাড়ি, পাকবে আমন ধানের মতো দেরিতে। শুধু একটা জিনিসের অভাব। তার চুল কালো নয়। দু-তিন দিন তেল না পড়লে তার চুলের লালচে রঙ বেরিয়ে পড়ে।
রঙ ও চেহারা-সুরত সবটাই রূপজান পেয়েছে তার মা সোনাভানের কাছ থেকে। সোনাভানের মা চন্দ্রভান ছিল ধলগাঁয়ের কলু বংশের মেয়ে। সে বংশের সব ছেলে-মেয়ের গায়ের রঙ শশার মতো। গ্রামের লোক তাই ঐ বংশকে বলত পাকনা শোশার ঝাড়। চন্দ্রভানের স্বামী আদালত শেখ ছিল নারায়ণগঞ্জের এক পাট-কোম্পানির মালিক জন ল্যাম্বার্টের কুঠির মালি। আর আরশেদ মোল্লা ছিল তার কুত্তার রাখাল। সায়েবের একমাত্র ছেলে স্টিফেন বিলেত থেকে এসেছিল বাপের কাছে। তার নজর পড়ে সোনাভানের ওপর। সায়েব টের পেয়ে সাত-তাড়াতাড়ি আরশেদ মোল্লার সাথে সোনাভানের বিয়ে ঘটিয়ে দু’হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে বিদেয় করেন কুঠি থেকে।
বিয়ের হাটে রূপসী মেয়ের জন্য গ্রাহকের ভিড় জমে। রূপজানের জন্যও ভিড় জমেছিল। নিলাম ডাকার মতো গয়না ও ‘শাচকে’র টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে রূপজানকে ছেলের বউ করে ঘরে নিতে পেরেছিল এরফান মাতব্বর।
রূপজানকে মাতব্বর পছন্দ করেছিল শুধু তার রূপ দেখে। ছেলের বিরহী ভাঙা মনকে জোড়া লাগাবার জন্যই দরকার ছিল জরিনার চেয়েও সুরলী মেয়ের। তাই মেয়ের বাপের কুল, মায়ের কুল দেখবার প্রয়োজন বোধ করেনি সে, গ্রাহ্য করেননি গায়ের প্রবাদ—
বউ আনো ঘর দেখে,
মেয়ে দাও বর দেখে।
প্রবাদটি যে শুধু কথার কথা নয়–পরে বুঝতে পেরেছিল সে আরশেদ মোল্লার শয়তানি দেখে। আর সে জন্য আফসোসও করেছে সে বড় কম নয়। অবশ্য নিজের কৃতকর্মের সমর্থনে সে বলে, ‘বিয়ার আসল জিনিস অইল বউ। বউডা তো রূপে-গুণে, চলা-চল্তিতে ভালই আছিল।’
রূপজানের তালাকের খবর শুনে আবার ঘটকের আনাগোনা শুরু হয়েছে মোল্লাবাড়ি। সম্বন্ধের প্রস্তাব এসেছে অনেক কয়টা। দরও বাড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। সবচেয়ে লোভনীয় প্রস্তাব একটা এসেছিল জঙ্গুরুল্লার কাছ থেকে তালাকের আগেই। তার পীর মৌলানা তানবীর হাসান ফুলপুরী বছরে দু’বার আসেন এ এলাকায়। একবার বর্ষাকালে, গেরস্তের পাট বেচার সময়। আর একবার শীতকালে, আমন ধান উঠবার পরে পরেই। তিনি বজরা নিয়ে ফেরেন মুরিদানের বাড়ি। জঙ্গুরুল্লা তার জন্য নিজের বাড়িতে মসজিদের পাশে খানকাশরিফ বানিয়ে রেখেছে। পীরসাহেবের বিবিরা থাকেন সুদূর ফুলপুরে। বাঙ্গাল মুলুকের পানির ভয়ে তাদের কেউ তার সাথে আসেন না। এই বিদেশে কে তার খেদমত করে?
তালাকের পর আবার মোল্লাবাড়ি আসে জঙ্গুরুল্লা। সে আরশেদ মোল্লাকে বলে, ‘শোনলাম অনেক সম্বন্ধ আইতে লাগছে?’
‘হ, আইছে কয়েকখান।’
‘আরে এত কায়দা-ফিকির কইর্যা তালাক দেওয়াইলাম আমি। আর মাইনষে বুঝি এহন তৈয়ার ললাটে চিড়া কোটতে চায়! খবরদার মিয়া, মোখের কথা যেন ঠিক থাকে।’
‘মোখের কথা তো ঠিক থাকব। কিন্তু একটা কথা।’
‘কি কথা আবার।’
‘জামাইর বয়স যে শ্বশুরেরতনও বেশি। ঐ যে মাইনষে কয়, তালুইর তন পুত্ৰা ভারী, হেই রহম অইয়া যাইব।’
‘আরে তুমি রাখো ঐ কথা। উনি অইলেন আল্লাওয়ালা মানুষ। উনারা এত ত্বরাত্বরি বুড়া অন না। দেখছ না কেমুন নুরানি চেহারা!’
‘হ, পীর-দরবেশরা তো আল্লার নিজের আতের তৈয়ারি। উনাগ চেহারাই আলাদা।’
‘হ শোন, ইদ্দতের কয়ডা মাস পার অউক। তারপর পীরসাব যখন শাওন মাসে আইবেন, তখন ইনশাল্লাহ্ কাজটা সমাধা করণ যাইব।’
‘আর জমির কথা যে কইছিলেন?’
‘আরে হ, তোমার লেইগ্যা তো দশনল জমি রাইখ্যা থুইছি খুনের চরে।’
‘দশনল না। আরো দশনল দিতে লাগব। মাইয়ার গয়না আপনেগ দেওনের দরকার নাই। গয়না আমিই দিমু।’
‘আইচ্ছা! গয়না যদি তুমি দেও, তবে নিও আরো দশ নল। কিন্তু মোখের কথা যেন্ উল্ডায় না।’
সব কথা পাকাপাকি করে চলে যায় জঙ্গুরুল্লা। আরশেদ মোল্লা ব্যাপারটা গোপন রাখে। এমন কি তার স্ত্রীর কাছেও বলে না কিছু। খুনের চরে গিয়ে সে মাপজোখ করে বুঝে নেয় বিশ নল জমি।
কিন্তু গোপন কথা বেরিয়ে পড়ে। একদিন আরশেদ মোল্লা আফার থেকে বাক্স নামিয়ে খুলে মাথায় হাত দেয়। রূপজানের একটা গয়নাও তার মধ্যে নেই। সে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয় স্ত্রীর সাথে, ‘কই গেল গয়না? তুই গুঁজাইয়া থুইছস?’
‘উনি কি কয়! আমি ক্যান্ গুঁজাইমু?’
‘হ, তুই না জাইলে যাইব কই? বুড়াকালে তোর গয়না পিন্দনের শখ্ অইছে।’
‘তোবা-তোবা! গয়না পিন্দনের শখ অইলে তো গায়ে দিয়া বইয়া থাকতাম। আর মাইয়ার শরীল খালি কইর্যা মাইয়ার গয়না গায় দেয় এমুন মা আছে দুইন্যায়?’
‘তয় গেল কই? রূপিতে সরায় নাই? রূপি, ও রূপি।’
রূপজান এসে দাঁড়ায়। তার চোখ-মুখ ফোলাফোলা। চুল উষ্কুখুষ্কু। তেল না পড়ায় নারকেলের ছোবড়ার মতো রঙ হয়েছে সে চুলের।
আরশেদ মোল্লা তার দিকে চেয়ে বলে, ‘গয়নাগুলা তুই সরাইয়া রাখছস?’
রূপজান কথার জবাব দেয় না।
‘কি জিগাইলাম? গয়নাগুলো তুই সরাইয়া রাখছস?’
‘হ।’
‘আমারে না জিগাইয়া নিছস্ এত সাহস তোর!’
রূপজান নিরুত্তর।
আরশেদ মোল্লা আবার বলে, ‘কই রাখছস, লইয়া আয়। চোরের যেই উৎপাত চাইরধারে–’
‘যাগো জিনিস তাগো কাছে পাড়াইয়া দিছি।’
‘কি কইলি হারামজাদি!’ মোল্লা মেঝেতে পড়ে থাকা বাক্সের তালাটা হাতে নিয়ে লাফিয়ে ওঠে। ছুঁড়ে মারে ওটা রূপজানের দিকে। তার মাথাটা কেমন করে যেন তার অজান্তেই একদিকে কাত হয়ে যায়। আর তালাটা তার কানের পাশ দিয়ে শাঁ করে গিয়ে ভেঙে দেয় একটা চালের মট্কি।
সোনাইবিবি ছুটে আসে। দু’হাত মেলে সে মারমুখি মোল্লার পথ রোধ করে দাঁড়ায়।
‘ছাড়ো ছাড়ো, ওরে আইজ মাইরা ফালাইমু। ধুইন্যা তুলা-তুলা কইর্যা ফালাইমু।’
‘ছিঃ—ছিঃ—ছিঃ–! জুয়ানমাইয়ার গায়ে আত তোলে, শরমও নাই। ওরে মাইর্যা তো ফালাইছেনই। ও কি আর জিন্দা আছে?’
আরশেদ মোল্লা থামে। সে কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলে, ‘হারামজাদি আমারে যে মাইরা ফালাইছে! এহন আমি গয়না পাই কই?’
‘গয়না দিয়া কি করব?’
‘আরে গয়না লাগব না মাইয়ার বিয়া দিতে? গয়না দিতে না পারলে দশ নল জমি ফিরত দেওন লাগব।’
‘জমি ফিরত দেওন লাগব! ক্যান?’
আরশেদ মোল্লা আর গোপন রাখতে পারে না ব্যাপারটা। জঙ্গুরুল্লার কাছে তার ওয়াদার কথা সে খুলে বলে স্ত্রীকে।
সোনাইবিবি শুনে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, ‘মাইয়ার পরানডারে তো এক্কেরে ঝাঁজ্রা কইর্যা ফালাইছে। কায়ামরা বানাইয়া ফালাইছে। এহন আবার কবর দেওনের কারসাজি শুরু করছে।’
মা বোঝে মেয়ের মন। সত্যিই ঝাঁজরা হয়ে গেছে রূপজানের বুকের ভেতরটা।
ফজলকে ধরে নেয়ার পর তিনদিন সে বিছানায় পড়ে ছিল। দানাপানি ছোঁয়নি। তারপর যখন তালাকের খবর তার কানে এল তখন তার দাঁতকপাটি লেগে গিয়েছিল। হুঁশ হওয়ার পর আত্মহত্যার স্পৃহা জেগেছিল তার মনে। একটা রশি সরীসৃপের মতো তার মনের দরজায় হানা দিয়েছে বারবার। কিন্তু সে জানে আত্মহত্যা মহাপাপ। তাই সে সরীসৃপ মনের দোরগোড়া থেকেই বিদায় হয়েছে।
রূপজান ভেবে পায় না–কেন ফজল তাকে তালাক দিয়ে গেল? সে হয়ত মনে করেছে–রূপজান জানত সব ষড়যন্ত্রের কথা। জেনেও তাকে হুঁশিয়ার করে দেয়নি কেন সে?
কিন্তু রূপজান যে কিছুই জানত না। সে অবশ্য তাদের বাড়ির নিচে নদীর ঘাটে জঙ্গুরুল্লার পানসি দেখেছিল একদিন। তার বাপকেও যেতে দেখেছিল পানসিতে। তারা যে এরকম একটা চক্রান্ত করতে পারে তা সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি।
ঐ দিন রাত্রে বাড়ির সবাই ঘুমিয়েছে মনে করে সে কাছারি ঘরে যাওয়ার জন্য নিশ্চুপে বিছানা ছেড়ে উঠেছিল। আলগোছে দরজার খিল খুলে কয়েক পা এগুতেই সে দেখে তার বাপ উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। সে যেমন বেরিয়েছিল তেমনি আবার ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছিল। বাপ দেখে ফেলেছে মনে করে তার লজ্জার সীমা-পরিসীমা ছিল না। সে যদি তখন বুঝতে পারত কেন তার বাপ জেগে রয়েছে, এতরাত্রে কোন বান্ধবের জন্য অপেক্ষা করছে, তাহলে কি আর ধরতে পারত ফজলকে? কাছারি ঘরে ছুটে গিয়ে, চিৎকার দিয়ে সে হুঁশিয়ার করতে পারত তাকে। লজ্জা-শরমের তোয়াক্কা সে করত না তখন।
রূপজানের মনে হয়–ফজল ইচ্ছে করে তালাক দেয়নি। যারা তাকে চক্রান্ত করে ধরিয়ে দিয়েছে তারাই জোর-জবরদস্তি করে বাধ্য করেছে তাকে তালাক দিতে। কিন্তু তার বাপ যে বলে, ফজল কাগজে লিখে তালাক দিয়ে গেছে। তবে কি সে সত্যি সত্যি নিজের ইচ্ছায় তালাক দিয়েছে?
কেন সে এ কাজ করল? কেন সে তাকে নিষ্কৃতি দিয়ে গেল? সে-তো চায়নি। এখনো তা চায় না তার মন। কোনো দিন চাইবেও না।
আবার প্রশ্ন জাগে রূপজানের মনে—বছরের পর বছর জেল খাটতে হবে বলেই কি সে এ কাজ করল? তাকে আবার বিয়ে করার সুযোগ দিয়ে গেল?
জেলের কথা মনে হতেই শিউরে উঠে রূপজান। সে শুনেছে–জেলে অনেক কষ্ট। সেখানে নাকি বেদম মারধর করে। পেট ভরে খেতে দেয় না। শুতে বিছানা দেয় না। গরু-মোষের মতো ঘানি টানতে হয়। চাকিতে পিষে ছাতু বানাতে হয়। কোনো কাজ না থাকলেও একদণ্ড জিরোতে দেয় না। ডালে চালে মিশিয়ে দিয়ে বলে, বাছো বসে বসে। বাছা শেষ হলে রান্না, তার পরে খাওয়া।
রূপজানের চোখ ফেটে পানি আসে। দু’গাল বেয়ে নামে অশ্রুবন্যা। চাপা কান্নার ঢেউয়ে। থরথরিয়ে কাঁপে তার সারা দেহ। সে অস্ফুটস্বরে বলে, ‘তুমি বিনা দোষে জেলে পইচ্যা মরবা। আর আমি আর একজনের ঘরে গিয়া সাধ-আহ্লাদ পুরা করমু? না, কিছুতেই না। কিছুতেই না।’
তাকে কি জেল থেকে খালাস করে আনা যাবে না?–ভাবে রূপজান।
কেন যাবে না? ঠিকমত মামলার তদবির করলে, টাকা খরচ করলে নিশ্চয় তাকে খালাস করে আনা যাবে। টাকায় কি না হয় তার শ্বশুর নিশ্চয় টাকা খরচ করবে।
কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে সন্দেহ জাগে–শ্বশুরের কাছে যদি এখন টাকা না থাকে? তার বন্ধক দেয়া গয়না ছাড়াতে যদি সব টাকা ফুরিয়ে গিয়ে থাকে?
এ কথা মনে হওয়ার পরেই একদিন সুযোগ বুঝে সে বাক্স খুলে তার সবকটা গয়না সরিয়ে ফেলেছিল। কি হবে গয়না দিয়ে। যার গয়না তারই কাজে লাগুক। বাপের কাছে সেদিন মিথ্যে করে বলেছিল–যাদের গয়না তাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আসলে গয়নাগুলো তখনো তার কাছেই ছিল। লুকিয়ে রেখেছিল কাঁথার গাঁটরির মধ্যে। সে সুযোগ খুঁজছিল, কেমন করে কাকে দিয়ে ওগুলো পাঠাবে শ্বশুরের কাছে।
অনেক ভেবে-চিন্তে রূপজান তার চাচাতো ভাই কাদিরকে ঠিক করে। সে জানে–এ পাড়ায় একমাত্র কাদিরেরই কিছুটা টান আছে ফজলের জন্য। আর তাকে বিশ্বাসও করা যায়।
কাদির যেদিন গয়নার পুটলি নিয়ে মাতব্বর বাড়ি পৌঁছে, সেদিন এরফান মাতব্বরের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। তার বিছানার চারপাশে বসে লোকজন দোয়া-দরূদ পড়ছে। বরুবিবি শিয়রের কাছে বসে চোখের পানি ফেলছে, চেয়ে আছে মাতব্বরের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পরে পরে চামচে করে পানি দিচ্ছে সে মাতব্বরের মুখে। ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছে বাড়ির মেয়েরা।
মসজিদের ইমাম সাহেব এসে তওবা পড়িয়ে চলে গেছেন।
বিছানা থেকে উঠবার শক্তি আগেই হারিয়েছিল এরফান মাতব্বর। আরশেদ মোল্লা জঙ্গুরুল্লার সাথে ষড়যন্ত্র করে পুলিস ফাঁড়ির পুলিস ডেকে ফজলকে ধরিয়ে দিয়েছে শুনে রাগে উত্তেজনায় সে চিৎকার করে উঠেছিল। ঝাড়া দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সে যেন প্রচণ্ড ঝড়ে উৎপাটিত বুড়ো বটগাছ। কাঁপতে কাঁপতে সে চৌকির থেকে নিচে পড়ে বেহুঁশ হয়ে যায়। তারপর থেকেই তার জবান বন্ধ। তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে দ্রুত। দিঘিরপাড় থেকে ডাক্তার এসেছিলেন। ঔষধ দিয়ে বলে গেছেন, ‘রুগীকে যদি কিছু খাওয়াতে মন চায়, তবে খাওয়ানো যেতে পারে।’
কাদির দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ, নির্বাক। সে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
রমিজ মিরধা কাদিরকে চিনতে পেরে বলে, ‘তুমি আরশেদ মোল্লার ভাইপুত না? তুমি আইছ কি করতে? তোমার চাচায় বুঝিন পাডাইয়া দিছে মাতবরের পো-র মরণকষ্ট দ্যাখতে?’
‘মাঐজীর লগে দুইডা কথা কইমু।’ কাদিরের মুখে কথা জড়িয়ে যায়।
‘কি কথা? কইয়া ফালাও।’ মেহের মুনশি বলে।
‘বু আমারে পাডাইছে। এই গয়নাগুলা দিছে। এগুলা বেইচ্যা দুলাভাইর মামলার তদবির করতে কইছে।’
কাদির গয়নার পুটলিটা বরুবিবির দিকে বাড়িয়ে দেয়।
বরুবিবি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
মেহের মুনশি পুটলিটা হাতে নেয়। গয়নাগুলো খুলে রাখে বরুবিবির সামনে।
বরুবিবি দু’হাত ভরে গয়নাগুলো তোলে। তার হাত কাঁপছে। মাতব্বরের মুদিত চোখের সামনে সেগুলো মেলে ধরে কাঁদে-কাঁদো স্বরে বলে, ‘ওগো হোনছে? বউ বেবাক গয়না পাড়াইয়া দিছে।’
‘ও দুদু, হোনছেন?’ কানের কাছে মুখ নিয়ে মেহের মুনশি ডাকে। মাতব্বর চোখ মেলে। মরা মাছের চোখের মতো ঘোলাটে সে চোখ।
‘ও দুদু, দ্যাহেন চাইয়া। বেবাক গয়না পাড়াইয়া দিছে বউ।’
বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে মাতব্বর। তার ঠোঁট নড়ে। কি যেন বলতে চায়, কিন্তু পারে না। সে মুখ হাঁ করে।
বরুবিবি চামচ ভরে পানি দেয় তার মুখে। সে আবার চোখ বোজে।
তারপর আর এক রাত বেঁচেছিল মাতব্বর। মরার আগে কিছুক্ষণের জন্য তার বাকশক্তি ফিরে এসেছিল। জিভে জড়ানো ছাড়াছাড়া অস্পষ্ট কতকগুলো শব্দে সে তার অন্তিম ইচ্ছা জানিয়ে গেছে। রূপজানের গয়না সম্বন্ধে সে শুধু বলে গেছে, ‘বউর মহরানার হক।’
কথা ক’টির ব্যাখ্যায় সকলেই একমত–রূপজানের কাছে ফজলের দেনমহরের দেনা এরফান মাতব্বর শোধ করে গেছে। রূপজান ছাড়া ও গয়নায় আর কারো হক নেই।