দু’সপ্তাহ হাজতবাসের পর আদালতে হাজির করা হয়েছিল ফজলকে। সেখানেই সে তার পিতার মৃত্যুর খবর পায়।

মামলার তদবিরের জন্য মেহের মুনশি আদালতে এসেছিল। তার নিযুক্ত উকিল ফজলকে জামিনে খালাস করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন অনেক। আসামির পিতার মৃত্যু হয়েছে–এ কারণ দেখিয়েও তিনি জামিন মঞ্জুর করাতে পারেননি।

বুকভরা কান্না নিয়ে আবার ফজল জেলে ঢোকে। কান্না চাপতে গিয়ে ফুলে ফুলে ওঠে তার বুক। ফুলে যায় চোখ-মুখ । অন্যান্য আসামিরা কাছে এসে দু-একটা সহানুভূতির কথা বলতেই তার রুদ্ধ কান্না বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসে।

অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে ফজল। বুকের পুঞ্জীভূত মেঘ অনেক পানি ঝরিয়ে হালকা হয় কিছুটা। কান্নার তাণ্ডব কমে এলে প্রথমেই যে ছবিটি তার কল্পনায় ভাসে তা একটি কবরের। কবরের পাশে বসে কাঁদছে তার মা। পরিধানে তার সাদা থান। তার গা ঘেষে বসে আছে আমিনা আর নূরু। তারাও কাঁদছে।

রূপজানও কি কাঁদছে? হ্যাঁ, এতো সে। সে-ও কাঁদছে। না-না-না, ভুল দেখছে সে।

ফজল তার মনের পর্দা থেকে মুছে ফেলতে চায় রূপজানের ছবি। কিন্তু পারে না। তার মনে হয় রূপজান কাঁদছে না, কাঁদার ভান করছে। সে কাঁদতে পারে না। কেন কাদবে সে? কার জন্য কাঁদবে? ফজলের বাপ তার কে? ফজলই তো তার কিছু নয়। সে ডাকাত। ডাকাতের ঘর করবে না বলে সে তালাক নিয়েছে।

রূপজান কি সত্যিই বলেছিল–সে ডাকাতের ঘর করবে না? এখনো সন্দেহ জাগে ফজলের মনে। কিন্তু সে যদি এ কথা না-ই বলে থাকে, তবে দু-দুটো লোক কেন সাক্ষী দিল এসে? এমন ডাহা মিথ্যে কথা বলে তাদের লাভ? কিন্তু রূপজান তো সেদিন তার কাছে বলেছিল–সে বিশ্বাস করে না ডাকাতির কথা। কি জানি, হয়ত মনে করেছে যার কপালের ভোগ সে একাই ভোগ করুক। সে কেন এমন পুরুষের অদৃষ্টের সাথে নিজেরটা জড়িয়ে নিজের ভবিষ্যত নষ্ট করবে?

ফজল আবার ভাবে, ঠিকই করেছে রূপজান। ঐদিন যদি সে এট্টুকু বুঝত, তবে আর তাকে অতটা লাঞ্ছনা ভোগ করতে হতো না। তালাকনামায় একটা দস্তখত মেরে দিলেই সে জঙ্গুরুল্লা ও হাবিলদারের অকথ্য নির্যাতন থেকে রেহাই পেত। তার বুড়ো আঙুলে কালি মাখিয়ে জোর করে তার টিপসই নেয়ার দরকার ছিল না তাদের।

দু’মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেক আসামি ছাড়া পেয়ে চলে গেছে। অনেক নতুন আসামি এসেছে। নতুনের মধ্যে দুজন তার পরিচিত। তারা বিক্রমপুরের নামকরা হা-ডু-ডু খেলোয়ার বাদল আর আক্‌লাস। দিঘিরপাড়ের জেদাজিদির খেলায় ষাঁড়ের মতো জোরোয়ার এই বাদলকেই সে মাজায় ধরে রেখে দিয়েছিল।

বাদল আর আক্‌লাস জেলে ঢুকতেই ফজল ম্লান হেসে এগিয়ে যায় তাদের কাছে।

বাদল চিনতে পেরে বলে, ‘কিহে বাহাদুর, তুমি এখানে কেন? কবে এলে?’

‘এই দুই মাসের কিছু বেশি।’ জবাব দেয় ফজল।

‘অ্যাঁ, দু’মাস!’

একজন আসামি বলে, ‘ওনারে মিথ্যা ডাকাতি মামলায় ফাঁসাইয়া দিছে। বাপ মারা গেছে তবুও বেচারা জামিন পাইতেছে না।’

শুনে বাদল আর আক্‌লাস দু’জনই ব্যথিত হয়।

কয়েক দিনের মধ্যেই ওদের সাথে ফজলের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

ওরা নাকি কোন ষড়যন্ত্র মামলার আসামি। ইংরেজ শাসকদের দেশ থেকে তাড়াবার জন্য ওরা এক গুপ্ত রাজনৈতিক দল গঠন করেছিল। দলের নেতাসহ সাতজন ধরা পড়েছে।

দলের নেতা মতির বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি হবে। এর আগে নাকি তিন বারে বছর দশেক জেল খেটেছে সে। তার পাতলা ছিপিছিপে শরীরে মেদের নামগন্ধ নেই। গাল দুটা বসে গেছে। চোখে পুরু চশমা। চোখেমুখে মেঘলা দিনের গম্ভীর্য। কথা বলার সময় চোখের তারায় বিদ্যুত জ্বলে, ঠোঁটের কোণে চিকচিক করে কেমন এক অদ্ভুত হাসি।

তার দিকে তাকালেই শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে ফজলের। সে ভাবে দেশের স্বাধীনতার জন্য জেল খাটতে খাটতে মতিভাইয়ের স্বাস্থ্যের এ দশা হয়েছে।

মতি তার দলের সবার সাথে কি সব আলোচনা করে। ফজল বুঝতে পারে না সব। তাদের আলোচনা থেকে সে এট্টুকু জানতে পারে–জাপানিরা রেঙ্গুন দখল করেছে। এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে। চাটগাঁ ও আরো অনেক জায়গায় বোমা ফেলে ছারখার করে দিয়েছে।

কয়েকদিন পরে আবার ফজলকে আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু এবারেও তার উকিল জামিন মঞ্জুর করাতে পারেননি। মেহের মুনশির কাছে বাড়ির খবরাখবরের সাথে এক দুঃসংবাদ পায় ফজল। পুলিস আর মিলিটারি মিলে তাদের এলাকার শতশত নৌকা ফতেগঞ্জ নিয়ে আটক করেছে। ফজলদের নতুন পানসি আর ঘাসি নৌকাটাও নিয়ে গেছে। অনেকে ফতেগঞ্জ গিয়ে তাদের নৌকায় নম্বর লাগিয়ে ফেরত নিয়ে এসেছে। এর জন্য নাকি অনেক টাকা ঘুস দিতে হয়। মেহের মুনশি ফতেগঞ্জ গিয়েছিল। দেশের সব জায়গা থেকেই নৌকা আটক করা হয়েছে। হাজার হাজার নৌকার ভেতর থেকে সে ফজলদের পানসিটা খুঁজে বার করতে পারেনি। ঘাসিটা সরকার কিনে নিতে চেয়েছিল। দাম ধার্য হয়েছিল মাত্র একশ’ টাকা। তিরিশ টাকা বোট ইন্সপেক্টরকে ঘুস দিয়ে ওটায় নম্বর লাগিয়ে ফেরত আনা হয়েছে।

ফজলের মনে হয়, নতুন পানসিটা দেখে কারো লোভ লেগেছিল। সে-ই নিজের বলে দাবি করে ঘুস দিয়ে ওটা নিয়ে গেছে।

বিপদ কখনো একা আসে না। কথাটা একেবারে খাঁটি–ভাবে ফজল। যে পানসিটা গেল তা আর সারা জীবনেও সে গড়াতে পারবে না।

এত নৌকা জমা করছে কেন সরকার? আবার কতগুলোয় নম্বর লাগিয়ে ছেড়েই বা দিচ্ছে কেন?–ফজল বুঝতে পারে না। বাদল বুঝিয়ে দেয় ব্যাপারটা : এই নদী-নালার দেশে নৌকা ছাড়া যুদ্ধ করা অসম্ভব। সৈন্য-সামন্ত, যুদ্ধের সরঞ্জাম ইত্যাদি পারাপার আনা-নেয়ার জন্য নৌকার দরকার। জাপানিরা এগিয়ে আসছে। দরকারের সময় যাতে নৌকার অভাব না ঘটে, আবার বেগতিক দেখলে সমস্ত নৌকা পুড়িয়ে ডুবিয়ে কৃতিত্বের সাথে পালানো যায় তাই নৌ-শুমারি করে রাখছে ইংরেজ সরকার। তারা বেছে বেছে কিছু নৌকা কিনেও রাখছে যুদ্ধের কাজে ব্যবহারের জন্য।

ফজল অবাক হয়ে ভাবে–এত খবর রাখে এ রাজনৈতিক বন্দিরা! তারা খবরের কাগজ পড়ে। তাই দুনিয়ার খবর তাদের পেটে। এক-একজন যেন খবরের গুদাম।

খবরের কাগজ পড়বার জন্য এরা অস্থির হয়ে পড়ে। জেলখানায় খবরের কাগজ আসার সাথে সাথে রাজনৈতিক বন্দিরা এক-একজন এক-এক পাতা নিয়ে পড়তে শুরু করে। একজন পড়া আরম্ভ করলে তিন-চারজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে পাতার ওপর। স্বাধীনতা আন্দোলন আর যুদ্ধের খবর জানার জন্য এরা সব উদগ্রীব। এদের দেখাদেখি ফজলও কাগজ পড়া শুরু করেছে। সবার পড়া হয়ে গেলে সে কাগজের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলে। মোহামেডান স্পোর্টিং-এর খেলা থাকলে সে এদের মতো অস্থির হয়ে যেত কাগজ পড়ার জন্য। লেখাপড়া ছেড়ে দেয়ার পর সে আর কাগজ পড়ার সুযোগই পায় নি। এখন অন্যান্যদের মতো সে-ও খবরের কাগজ আসার প্রতীক্ষায় সময় গোনে।

এতদিন দুনিয়ার কোনো খবরই রাখত না ফজল। এখন খবরের কাগজ পড়ে সে বুঝতে পারে–দুনিয়ার হালচাল বদলে যাচ্ছে, যুদ্ধের কারণে দ্রুত বদলে যাচ্ছে দুনিয়ার চেহারা।

কাগজ পড়ে সে আরো জানতে পারে, সারা দেশব্যাপী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। দুটি রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিরোধ বেড়েই চলেছে। কংগ্রেস চায় অখণ্ড ভারত আর মুসলিম লীগ চায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলিমদের জন্য আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র–পাকিস্তান।