হা-ডু-ডু খেলার প্রতিযোগিতা। খেলার ভেতর দিয়ে চর আসুলির শক্তি পরীক্ষা হবে আজ।
সামান্য কথার খোঁচা থেকে এ আড়াআড়ির সৃষ্টি হয়েছে। দিঘিরপাড়ের গুড়ের আড়তদার হাতেম শিকদার তার পাশের ধানের আড়তদার আক্কেল হালদারকে সেদিন কথায় কথায় বলেছিল, ‘আরে দ্যাখা আছে। তোমাগ চরে আবার খেলোয়াড় আছেনি! আছে সব—’
‘কি কইলা! খেলোয়াড় নাই!’
‘নাই-ইতো। তোমরা পার ঢাল-কাতরা লইয়া খুনাখুনি করতে।’
‘আমরা খুনাখুনি করতেও পারি, খেলতেও পারি।’
‘পার আমার ইয়ে। আমাগ মাকুহাটির ফরমানের খেলা দ্যাখছ? ও একবার ‘কপাইট’ কইয়া ‘ডু’ দিলে তোমায় খেলোয়াড়রা ছ্যাড়া খাইয়া ভাইগ্যা যাইব।’
‘আর ছাড়ান দ্যাও। ওই রহম খেলোয়াড় গণ্ডা গণ্ডা আছে আমাগ চরে।’
‘আছে! তবে খেইল্যা দ্যাহাও না একদিন।’
‘হ দ্যাহাইমু।’
‘কবে? তারিখ দ্যাও।’
‘তুমি দ্যাও তারিখ।’
‘পরশু মঙ্গলবার।’
‘না, তার পরের দিন বুধবার।’
আজ সেই খেলার তারিখ বুধবার।
খেলার মাঠ লোকে লোকারণ্য। জেদাজেদির খেলা। দর্শকের ভিড় তো হবেই। দুই অঞ্চলের উগ্র সমর্থকদের মনে উত্তেজনার বারুদ। শান্তিরক্ষার জন্য সশস্ত্র পুলিস এসে হাজির হয়েছে।
বড় ময়দানের মাঝখানে দাগকাটা খেলার কোট। ষোল হাত দীর্ঘ আর দশ হাত প্রস্থ কোটটিকে মাঝখানে দাগ কেটে সমান দু’ভাগ করা হয়েছে দুই দলের জন্য। কোটের চারপাশে বাঁশের খোটা পুঁতে তার সাথে মোটা রশির ঘের বাঁধা হয়েছে। সে ঘেরের বাইরে সারি সারি লোক বসে গেছে। তাদের পেছনে গায়ে গায়ে মেশামিশি হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশির ভাগ দর্শক।
বিকেল চারটায় খেলা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু চরের দল এখনো আসেনি। আসুলির খেলোয়াড়রা অনেক আগেই এসে গেছে। বিক্রমপুরের দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় সব। বজ্রযোগিনীর বাদল, মাকুআটির ওসমান আর ফরমান দুই ভাই, কামারখাড়ার ভজহরি, কলমার আল্লাস, সোনারং-এর কালীপদ আর পাঁচগাঁর শাসমু এসেছে। হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরে তারা কোটের এক অংশে তৈরি হয়ে বসে আছে।
দর্শকরা অধৈর্য হয়ে ওঠে। অধৈর্য হয়ে ওঠেন স্বয়ং রেফারিও। তার মুখের বাঁশির আওয়াজে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিছুক্ষণ পরে পরেই তিনি তাঁর হাতঘড়ি দেখছেন আর জোড়া ফুঁ দিচ্ছেন বাঁশিতে।
অতি উৎসাহী ছেলে-ছোকরার দল নৌকাঘাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চরের দিক থেকে লোক বোঝাই কোনো নৌকা দেখলেই তারা হৈ-হৈ করে ওঠে, ‘ঐ যে–ঐ ঐ আইতে আছে!’ তারপর ছড়া আবৃত্তি করতে থাকে সমস্বরে–
‘হেঁই কপাটি তুলা ধোন,
মশা করে ভোন্ ভোন্।
মাছির কপালে ফোঁটা,
মইষ মারি গোটা গোটা।’
কোলাহল শুনে দর্শকরা একটু আশান্বিত হয়। কিন্তু নৌকা কাছে এলে দেখা যায়– খেলোয়াড়দের কেউ আসেনি। এসেছে তাদের নৈরাশ্যের কয়েকজন ভাগীদার শুধু।
আসুলির লোকেরা ভুড় দিতে শুরু করে। তারা বলে, ‘চরুয়ারা আইব না। ওরা ডরাইয়া গেছে।’
চরাঞ্চল থেকেও বহু লোক খেলা দেখতে এসেছে। আসুলির লোকদের ঠেস-টিটকারি শুনে তাদের মুখ কালো হয়ে যায়। কচ্ছপের মতো সুবিধে থাকলে হয়ত তারা তাদের মাথা লুকিয়ে ফেলত লজ্জায়।
এক পক্ষ যখন আসেনি তখন অন্য পক্ষ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করবে। সেই জয় ঘোষণা করতে হবে রেফারিকে। তিনি বাঁশি বাজান, হাত নেড়ে প্রতিপক্ষের খালি কোটে ‘ডু’ দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন আসুলির দলকে।
হঠাৎ ভিড় ঠেলে খালি মাঠে নামে একজন লোক। লোকটিকে সবাই চেনে। সাতকচরের সোলেমান। সে এক কালের নামকরা খেলোয়াড়। এখন বয়স হয়েছে। মাথার কাঁচা-পাকা চুল দেখেই বোঝা যায়, বয়স তার চল্লিশ পার হয়ে গেছে। সাত-আট বছরের মধ্যে তাকে কোথাও খেলায় নামতে দেখা যায়নি।
রেফারির দিকে এগিয়ে সোলেমান বলে, ‘নগেন বাবু, চরের খেলোয়াড়রা আহে নাই। কিন্তু আমরা আছি চরের মানুষ। আমরা খেলুম বিনা খেলায় আসুলিগ জিত্যা যাইতে দিমু না।’
রেফারি বলেন, ‘কিন্তু তোমাদের আক্কেল হালদার কোথায়? খেলার তারিখ দিয়ে এমন–’
‘হুনছি, সে খেলোয়াড় আনতে গেছে দক্ষিণপাড়। মানুষটা এহনো আইল না ক্যান্ কে জানে?’
দর্শকদের ভেতর থেকে একজন বলে, ‘আইব কি, ডরের চোডে পথ ভুইল্যা গেছে।’
রেফারি সোলেমানকে বলেন, ‘তবে নেমে পড়। কোথায় তোমার খেলোয়াড়রা?’
‘এই আনতে আছি। দশটা মিনিট সময় দ্যান।’
সোলেমান চারদিকের দর্শকদের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে হাঁক দেয়, ‘কে আছস রে তোরা? চরের ইজ্জত না যাইতে শিগগির আয়।’
ভিড়ের মাঝ থেকে ফজল ও আরো তিনজন এসে যোগ দেয় সোলেমানের সাথে।
খেলা হবে না ভেবে দর্শকরা মনমরা হয়ে গিয়েছিল। এবার তারা আনন্দে কোলাহল করে ওঠে, হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়, উৎসাহ দেয় চরের খেলোয়াড়দের।
এখনো দু’জন খেলোয়াড়ের অভাব। সোলেমান ও ফজল দর্শকদের মধ্যে পরিচিত লোক খুঁজে বেড়ায়।
ফজলের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় একটি ছেলের। রূপজানের মুখের আভাস আনন্দ জাগায় তার মনে।
দশ বছরের ছেলেটি তার শ্যালক। সে রশির বেড়া ঘেঁষে বসে আছে। দুলাভাই মাঠে নামার পর থেকেই সে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বারবার হাত নাড়ছিল।
হাসি বিনিময় করে ফজল তার কাছে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে, ‘এই দেলু কার সাথে আসছ?’
‘কাদিরভাইর সাথে। আরো কত মানুষ আইছে!’
ফজল গায়ের জামা খুলে দেলোয়ারের হাতে দিয়ে তার কানে কানে বলে, ‘এইডার মধ্যে টাকা আছে সাবধানে রাইখ্য।’
‘আচ্ছা। জানেন দুলাভাই, কাদিরভাই কিন্তু খুব ভালো খেলে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ, খুব লেংড়ি দিতে পারে।’
‘তাই নাকি! কই সে?’
দেলোয়ার পেছন দিকে তাকায়। কাদিরকে খুঁজে পেয়ে সে বলে, ‘ওই যে দুলাভাই।’
ফজলের চোখে চোখ পড়তেই তার চাচাতো শ্যালক কাদির হেসে ওঠে।
ফজল তাকে ডাকে, ‘তাড়াতাড়ি নামো। সময় নাই।’
কাদির হাত নেড়ে খেলতে অসম্মতি জানায়। কিন্তু দর্শকরা তাকে ঠেলে মাঠে নামিয়ে দেয়।
অন্য দিক থেকে সোলেমানও একজনকে জোর করে মাঠে নামায়।
খেলার পোশাক নেই কারো। এভাবে খেলায় নামতে হবে কে জানত? খুঁজে-পেতে একটা প্যান্টও যোগাড় করতে পারে না কেউ। কি আর করা! খেলোয়াড়রা সবাই লুঙ্গিতে কাছা মেরে নেয়।
সোলেমান তার খেলোয়াড়দের কোটের এক কোণে জড় করে নিচু গলায় পরামর্শ দেয়, ‘দ্যাখো, তোমরা ওগ বড় বড় খেলোয়াড় দেইখ্যা ঘাবড়াইয়া যাইও না। খালি ঠ্যাকা দিয়া যাইবা। কোনো উপায়ে ‘ড্র’ রাখতে পারলেই আইজ ইজ্জত বাঁচে। তোমরা ধীরে-সুস্থিরে খেলবা। ওরা চেতলেও চেতবা না। আবার সুযোগ পাইলেও ছাড়বা না। ঐ যে বাদল ফরমান। দাঁতাল শুয়রের মতন শক্তি ওগ গায়। ওরা কিন্তু গোতলাইয়া লইব। কায়দা মতন না পাইলে ওগ ধরবা না। আর ঐ যে কালীপদ–ব্যাডা কুলুপের ওস্তাদ। ডু দেওয়ার সময় হুঁশিয়ার। ভজার পায়ে কিন্তু সাংঘাতিক জোর। ও পাও আউগাইয়া দিব, লেংড়িও দিব। কিন্তু কেও ধরবা না। ধরলেই কিন্তু ঘোড়ার মতন ছিটা লাথি মাইর্যা যাইব গা। শামসু ঢুশ দিয়া ধরে। আর ঐ যে আলাস–ওরে বেড় দিলেই লাফা মাইর্যা চইল্যা যাইব।’
রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে তৈরি হওয়ার জন্য তাড়া দেন।
সোলেমান রেফারিকে দুটো আঙুল দেখায়। আরো দুমিনিট সময়ের প্রার্থনা।
সে আবার শুরু করে, ‘তোমাগ মইদ্যে কুলুপ জানে কে?’
‘আমি জানি।’ ফজল বলে।
‘ঠিক আছে, তুমি ডান কিনারে থাকবা। আর আমি থাকমু বাঁ কিনারে।’
‘আচ্ছা, তবে আমার পাশে থাকব লখাই। ও কুলুপ দেওনের ভান করব, তা অইলে যে ডু দিতে আইব, তার নজর থাকব লখাইর উপরে। তখন পাশের তন কুলুপ দিমু আমি?’
‘হ দিও। কিন্তু যখন তখন কুলুপ দিও না। তুমিতো ডু দিতেও পারবা?’
‘হ পারমু।’
‘আর কার কি গুণ আছে কও দেহি শিগগির।’
নিজের মুখে নিজের গুণ জাহির করতে লজ্জা পায় সবাই।
ফজল বলে, ‘এই যে কাদির, ও পারে লেংড়ি দিতে।’
‘বেশ বেশ! সাবধানে ডু দিবা। কালীপদর দিগে কিন্তু ঠ্যাং বাড়াইও না।’
‘আর ঐ যে কোরবান। ও পারে হাতে কুলুপ দিতে।’
‘উঁহু। ওরা যেমুন জুয়ান, হাতে কুলুপ দিয়া জুত করতে পারবা না। ঠিক আছে, তুমি হাতে কুলুপ দেওনের ভান করবা আর আমি তখন সুবিধা পাইলে কুলুপ দিমু বাইয়া পায়ে।’
মধু আর তালেবের তেমন কোনো বিশেষ গুণ নেই। তারা মাঝে মাঝে ‘ডু’ দেবে আর বিপক্ষের খেলোয়াড় ধরার সময় সাহায্য করবে।
সোলেমান আরো বলে, ‘যে পয়লা ধরবা, হে যদি বোঝ ধরা ঠিক অইছে, তয় ‘ধর’ কইয়া আওয়াজ দিবা। তখন আর সবাই ঝাঁপাইয়া পড়ব। যাও আর সময় নাই। যার যার জায়গা লও গিয়া।’
খেলা শুরু হয়।
রেফারির বাঁশির নির্দেশ পেয়ে আসুলির দলের বাদল প্রথমে ‘ডু’ দেয়, ডিগিড্ডিগিড্ডি গিড্ডিগি–
তার উত্তরে সোলেমান ‘ডু’ দেয়, ‘কপাইচ—কপাইচ—কপাইচ—’
আলকাস : ‘ট্যাগাট্ট্যাগাট্ট্যাগা—’
ফজল : ‘ড্যাগাড্ড্যাগাড্ড্যাগাড্ড্যাগা—’
ফরমান : ‘কপাইট–কপাইট–কপাইট–’
উত্তেজনাহীন ‘ডু’-এর মহড়া চলে কিছুক্ষণ। তারপরই আসুলির দল মেতে ওঠে। বাদল, ফরমান আর আল্লাসের ‘ডু’-এর দাপটে বিব্রত বোধ করে চরের দল।
ছোট্ট সীমিত কোটের মধ্যে সাতজন খেলোয়াড়ের দাঁড়াবার জায়গা। এর মধ্যে থেকেই বিপক্ষের আক্রমণের মোকাবেলা করতে হবে। চরের দল তাড়া খেয়ে শেষ সীমারেখার কাছে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করে।
ফরমান ‘ডু’ দিয়ে এগিয়ে যায়, মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে থাবা মারে। কোরবান লোভ সামলাতে পারে না। সে ফরমানের হাতে কুলুপ দিয়ে বসে। কিন্তু তার হাতের ঝটকা টানে কোরবান উপুড় হয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়।
দলের একজন কমে গেল। সোলেমান ‘ডু’ দেয়। সময় কাটাবার জন্য মধ্য রেখার কাছ দিয়েই ঘুরে ঘুরে সে ‘কপাইচ–কপাইচ’ করে। সময় বেশি নিচ্ছে দেখে রেফারির সন্দেহ হয়, দম চুরি করছে বোধ হয় সোলেমান। তাইতো! তিনি বাঁশিতে ফুঁ দেন। কিন্তু কেউ ছুঁয়ে মারবার আগেই সোলেমান লাফিয়ে ভেগে আসে।
ভজহরি ‘ডু’ দিতে এগিয়ে আসে। ফজলের দিকে ডান পা এগিয়ে দেয় সে। চোখে তার অবজ্ঞার হাসি। ভাবটা এই–সাহস থাকলে ধরো না দেখি, কত মুরোদ। ফজল লখাইকে কনুইর গুঁতো মেরে ইশারা করতেই সে কুলুপ দেয়ার ভান করে। ভজহরি লেংড়ি দেয় লখাইকে। অমনি ফজল ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মাজার ওপর। জাপটে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ধর।’
সাথে সাথে আর তিনজনে ধরে রেখে দেয় ভজহরিকে।
সোলেমান ফজলকে বাহবা দেয় আবার চুপিচুপি সাবধানও করে, ওইভাবে ঝাঁপাইয়া পইড় না। বুকে চোট লাগতে পারে।’
ভজহরি মরে যাওয়ায় কোরবান তাজা হয়েছে। ফজল ‘ডু’ দেয়। সোলেমানের মতো সে-ও সময় ধ্বংস করে।
‘ট্যাগাট্টাগা’ করতে করতে আসে আক্লাস। সে বাঁ দিকের খেলোয়াড়দের সোজা তাড়িয়ে নিয়ে চলে। সোলেমান আর কোরবানের ‘জল্লা’ যাওয়ার মতো অবস্থা। ফজল দৌড়ে যায় আল্লাসকে ধরতে। কিন্তু সে সোলেমানকে ছুঁয়ে, লাফ মেরে ফজলকে ডিঙিয়ে পালিয়ে যায়।
আসুলির সমর্থকরা আনন্দে হাততালি দেয়।
দলের দুই প্রধান খেলোয়াড় মারা গেছে। এবার আর উপায় নেই।
কাদির ‘ডু’ দেয়ার জন্য মধ্যরেখার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সতেরো বছরের নব যুবক। সুপারি গাছের মতো ওর দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থ নেই। হাত-পা কাঠিকাঠি, যেন তালপাতার সেপাই। ওকে দেখে আসুলির খেলোয়াড়রা অবহেলার হাসি হাসে, হাতে তুড়ি মেরে ঠাট্টা করে। তাদের ঠাট্টার জবাবে সে ‘ডু’ দেয়–
‘হেঁই কপাটি কয় বাট্টি?
সাবু খাইছ কয় বাট্টি?’
রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দেন। হাত নেড়ে বলেন, এরকম ছড়া কেটে ‘ডু’ দেয়া চলবে না। আবার ‘ডু’ দাও।
কাদির ‘ডিগডিগ’ করতে করতে এগিয়ে যায়।
কালিপদ আর ওসমান মাটির ওপর থাবড়া মেরে ওকে ভয় দেখায়। কিন্তু ও ঘাবড়ায় না। ওর ‘ডু’ চলতে থাকে।
হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে কালীপদর পায়ে লেংড়ি মেরে সে চলে আসে।
চারদিক থেকে হাততালি পড়ে। কেউ কেউ বলে, পচা শামুকেও পা কাটে।
সোলেমান আনন্দের আতিশয্যে কাদিরকে কাঁধের ওপর নিয়ে নাচতে থাকে। কালীপদ মারা পড়ায় বেঁচে ওঠে সোলেমান ও ফজল। আবার পুরো হয় চরের দল।
কিন্তু একটু পরেই ফরমানের আক্রমণে মারা যায় কাদির আর মধু। তারও কিছুক্ষণ পরে তালেব ‘ডু’ দিতে গিয়ে ধরা পড়ে।
বিরতির বাঁশি বাজে। খেলার অর্ধেক সময় শেষ হলো। আসুলির দলের সবাই তাজা। চরের দলে বেঁচে আছে চারজন।
দশ মিনিট বিশ্রামের পর আবার খেলা শুরু হয়।
সোলেমান ‘ডু’ দিয়ে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে যায়। একটু এগিয়ে ওসমানের ওপর থাবা মারতেই শামসু ঢুস দিয়ে ধরবার জন্য ছুটে আসে। সোলেমান চক্কর মেরে শামসুকে ঘূর্ণা খাইয়ে চলে আসে।
আক্লাস ‘ডু’ দিয়ে সোলেমান ও তার পাশের খেলোয়াড়দের দাবড়ে নিয়ে যায়। লাফ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করাই তার উদ্দেশ্য। ফজল তাকে বেড় দেয়। আক্লাস লাফ দিতেই সে সটান খাড়া হয়ে যায়, দু’হাত বাড়িয়ে আক্লাসের ডান হাঁটুর কাছে জাপটে ধরে। আক্লাস ফজলের কাঁধের ওপর ঝুলতে থাকে। তার মাথা নিচের দিকে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে হাতদুটো তার মাটি ধরবার জন্য আকুলি-বিকুল করছে।
‘ডু’-এর আদান-প্রদান চলে কিছুক্ষণ। চরের খেলোয়াড়রা সব ধীর-স্থির। তারা ‘ডু’ দিয়েও বেশি দূর এগোয় না, ধরবার জন্যও বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে না। শামসু আর আক্লাস তাজা না হওয়া পর্যন্ত আসুলির দলও বেশি মাতে না। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর মধু ও লখাইকে মেরে তারা দল পুরো করে। কিন্তু সময় আর বেশি নেই। এ পর্যন্ত তারা এক পাট্টিও বানাতে পারেনি। কয়েকটা অখ্যাত অজ্ঞাত পুচকে খেলোয়াড় তাদের এভাবে ঠেকিয়ে রাখবে, এর চেয়ে লজ্জার ব্যাপার আর কি হতে পারে?
তারা বাদল আর ফরমানকে গোয়ার্তুমি করার জন্য ছেড়ে দেয়। মাতামাতি করে ‘ডু’ দিয়ে চেষ্টা করতে দোষ কি? ধরা পড়লে পড়ুক। আর বেঁচে আসতে পারলে তো কথাই নেই।
বাদল আর ফরমান খ্যাপার মতো ‘ডু’ দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে চরের দলকে।
সোলেমান সাবধান করে দেয় সবাইকে, ‘অ্যাকদিগে দাবড় লাগাইলে অন্য দিগ থিকা আউগ্গাইয়া আসবা। কিন্তু ধরবা না, খবদ্দার। করুক না ওরা গোলাগুলি যত পারে!’
সোলেমানের উদ্দেশ্য সময় নষ্ট করা। সময় কাবার করে কোনো রকমে ‘ডু’ রাখতে পারলেই চরের ইজ্জত বজায় থাকে। কিন্তু বাদল আর ফরমান ‘ডু’ দিয়ে শেষ সীমারেখার কাছে দাবড়িয়ে নিয়ে যায় তাদের। সীমারেখার বাইরে গেলেই জল্লা যেতে হবে। এ অবস্থায় সোলেমানের হুঁশিয়ারি ভেস্তে যায়। ঠিক থাকতে পারে না সোলেমান নিজেও। না-মরদের মতো জল্লা গিয়ে মরার চেয়ে ধরে মরা অনেক ভাল।
কিন্তু ধরতে গিয়েই শুরু হয় মড়ক। কোরবান আর তালেব ধরেছিল বাদলকে। কিন্তু সে দু’জনকেই হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যায়। তারপর ফরমানকে ধরতে গিয়ে মারা যায় সোলেমান। আর বাদলের দাবড় খেয়ে কাদির জল্লা যায়। টিকে থাকে শুধু ফজল।
উত্তেজনা টগবগ করছে দর্শকদের ভেতর। এবার আসুলির ভাগ্যে নিশ্চিত জয়লাভ।
মিনিট দুয়েক সময় আছে আর। ফজল ‘ডু’ দেয়। কিন্তু তাকে ধরবার আগ্রহ দেখায় না কেউ। সে দম শেষ করে ফিরে আসে।
বাদল ‘ডু’ দেয়, এগিয়ে যায় লম্বা হাত বাড়িয়ে। ফজল সরতে থাকে কোণের দিকে, ধরবার ভান করে। কিন্তু বাদল ওসব গ্রাহ্যের মধ্যেই নেয় না। আর নেবেই বা কেন? দিঘে পাশে কোনোটায়ই ফজল তার সমকক্ষ নয়। ফজল মাথা নুইয়ে কুলুপ দেয়ার ভান করে। আর সেই সময় তার মাথায় থাবা মারবার জন্য বাদল একটু বেশিই এগিয়ে যায়। অমনি ফজল তড়িৎগতিতে এগিয়ে গিয়ে বাদলের মাজায় ধরে ফেলে। বাদল কোস্তাকুস্তি করে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে ফজল তাকে শূন্যে তুলে ফেলেছে।
চারদিকে হৈচৈ কলরোল। হাততালির চোটে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়।
লখাই তাজা হয়ে ডু’ দিতে যায়। তার ‘ডু’ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রেফারি খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
চরের জনতা বেড়া গলিয়ে ছুটে আসে মাঠে। হৈ-হুঁল্লোড় করে তারা তাদের খেলোয়াড়দের ঘিরে ধরে। এক একজন খেলোয়াড়কে চার-পাঁচজনে মিলে মাথার ওপর তুলে নেয়।
আক্কেল হালদারের ছোট ভাই তোয়াক্কেল হালদার এতক্ষণ দর্শকদের ভিড়ের মাঝে চুপটি মেরে ছিল। সে এসে বলে, ‘খেলোয়াড়গ নিয়া চলো বাজারে। আইজ তারা আমাগ ইজ্জত বাঁচাইছে। তাগ এট্টু মিষ্টিমুখ করাইয়া দেই।’
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খেলোয়াড়দের নিয়ে জলধর ময়রার দোকানে ঢোকে তোয়াক্কেল। ফজল আর কাদিরের জামা বগলে নিয়ে দেলোয়ার জনতার পেছনে পেছনে আসছিল। সে ও ঢুকে পড়ে দোকানে। ফজল তাকে আদর করে পাশে বসায়। বাইরে দাঁড়িয়ে জটলা করে বিশ-পঁচিশ জন হুজুগমত্ত ছেলে-ছোকরা।
ময়রাকে তোয়াক্কেল বলে, ‘তোমার দোকানডা আইজ কিন্যা ফালাইমু আলইকর।’
‘তা কিন্যা ফলাওনা। আমারে শুদ্ধা কিন্যা ফালাও।’
‘হ কিনমু। এহন কও দেহি, কত ট্যাহার মিষ্টি আছে তোমার দোকানে।’
ময়রা হেসে বলে, ‘কত আর অইব! দ্যাও তিরিশ ট্যাহা।’
তোয়াক্কেল তিনটা দশ টাকার নোট ময়রার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, ‘নেও তিরিশ ট্যাহাই দিলাম। তুমি দিতে শুরু কর। আমাগ প্যাড ভরাইয়া বাইরের তাগও দিবা। দিয়া ফুরাইয়া ফালাইবা বেবাক।’
মিষ্টি খাওয়া শেষ করে রওনা হয় সবাই।
কাদির আগে আগে চলছে। তার পেছনে চলছে ফজল দেলোয়ারের হাত ধরে।
দেলোয়ার নিচু গলায় বলে, ‘দুলাভাই আপনেরে বহুত দিন বিচ্রাইছি।’
‘ক্যান?’
‘বু আপনেরে যাইতে কইছে। হাশাইলের হাটে, দিঘিরপাড় হাটে কত বিচরাইছি আপনেরে!’
‘হাটে আসি নাই বহুদিন। নতুন চর লইয়া বড় ঝামেলার মইদ্যে আছি। চল, আজই যাইমু তোমাগ বাড়ি।’
‘যাইবেন! ঠিক!’ দেলোয়ার খুশি হয়ে ওঠে।
‘হ যাই। তোমাগ নায় জায়গা অইব তো?’
‘হ্যাঁ।’
ফজল একটু চিন্তা করে কাদিরকে ডাকে, ‘ও কাদির।’
‘জ্বি।’
‘এত তাড়াতাড়ি যাইতে আছ ক্যান্? তোমায় বাড়ি যাইমু দেইখ্যা বুঝি পলাইতে আছ?’
‘না-না, কি যে কন!’ লজ্জা পেয়ে বলে কাদির। ‘চলেন না যাই। আপনে তো আমায় বাড়ির পথ ভুইল্যাই গেছেন।’
‘তবে চলো দেখি, কাপুড়িয়া দোকানে।’
‘কাপড় কিনবেন নি?’
‘হ।’
নিতাই কাপুড়ের দোকানে গিয়ে ফজল শ্যালকদের পছন্দমতো এক জোড়া নকশিপাড় শাড়ি কেনে। তার পরিধানের লুঙ্গিটা মাটিকাদা মেখে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। এটা পরে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। তাই নিজের জন্যও সে কেনে একটা মাদ্রাজি লুঙ্গি। তারপর গগন ময়রার দোকান থেকে এক পাতিল মিষ্টি কিনে তারা নৌকায় উঠে রওনা হয়।