চার-পাঁচ দিন আগে কাজের সন্ধানে চরদিঘলি গিয়েছিল জরিনা। সেখানেই সে খবর পায়, জঙ্গুরুল্লার দলকে বিতাড়িত করে এরফান মাতব্বরের দল খুনের চর আবার দখল করেছে।
জরিনার মন নেচে ওঠে আনন্দে। তবে কি ফজল জেল থেকে খালাস পেয়ে এসেছে? জরিনার মনে হয়, সে খালাস পেয়ে এসেছে। সে না হলে চর দখলের এত সাহস আর কার হবে?
কয়েকদিন ধরে জরিনা কাজের সন্ধান করছে। খেয়া নৌকায় পার হয়ে সে ঘুরছে এ চর থেকে সে চর। কিন্তু কোথাও কাজ পায়নি। অধিকাংশ গেরস্তের ঘরে খোরাকির ধান নেই। কেউ বেশি দামের আশায় ‘রাখি’ করা পাট বেচে, কেউ নিদানের পুঁজি ভেঙে ধান-চাল কিনছে। অনেকেই হাঁস-মুরগি, খাসি-বকরি বিক্রি করে চাল কিনে খাচ্ছে। চাল তো নয় যেন রূপার দানা। চারদিন কামলা খেটে এক টাকা পাওয়া যায়। সেই এক টাকা বেরিয়ে যায় তিন সের চাল কিনতে। যাদের ঘরে পুরো বছরের খোরাকির ধান আছে, তারাও টিপে টিপে হিসেব করে চলছে আজকাল। তাদের বউ-ঝিরাই এখন ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভানছে। ধান-ভানুনিদের আর প্রয়োজন হয় না তাদের। বেহুদা খরচের দিন আর নেই।
কাজ পাবে না জেনেও জরিনা আজ ভোরেই আবার বেরিয়েছিল। গিয়েছিল বিদগাঁও। বাড়ি বাড়ি ঘুরেও সে কাজ পায়নি। প্রায় সকলের মুখে ঐ এক কথা, ‘ধান পাইমু কই? এহন তো চাউল কিন্যা খাইতে আছি। তোমারে কাম দিমু কেম্বায়?’
বিদগাঁও থেকে ধু-ধু দেখা যায় খুনের চর। সেখানে বড় বড় কয়েকটা টিনের ঘরও দেখা যায়। একজনকে জিজ্ঞেস করে জরিনা জেনে নেয়, ‘ফজল মাতব্বর ভাটিকান্দি ছেড়ে খুনের চরে বাড়ি করেছে।’
ঠিকই অনুমান করছিল জরিনা, ফজল জেল থেকে খালাস পেয়ে এসেছে। সে-ই আবার দখল করেছে খুনের চর।
জরিনা বিদগাঁর উত্তর-পশ্চিম দিকে গিয়ে দাঁড়ায়। নদীর কিনারায় বসে থাকা এক জোড়া মানিকজোড় ভয় পেয়ে উড়ে যায়।
জরিনা পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে খুনের চরের দিকে। সেদিকে কোনো খেয়া নৌকা যায় না। খেয়া থাকলে একবার ঘুরে আসতে পারত সে। ফজলের মা এখনো আদর করে তাকে বসতে দেয়। এখনো তাকে বউ বলে ডাকে। ভাল-মন্দ কিছু তৈরি থাকলে খেতে দেয়। অনেক দুর বলে সে-ই যেতে পারে না। এরফান মাতব্বরের মৃত্যুর খবর পেয়ে গিয়েছিল সে। তারপর আর একবারও যাওয়া হয় নি।
মানিকজোড় দুটো সোজা খুনের চরের দিকে উড়ে যাচ্ছে।
আহা রে! তার যদি পাখা থাকতো পাখির মতো!
হঠাৎ জরিনার মনে হয়, আল্লার দুনিয়ায় পাখিই সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী। পাখি হাঁটতে পারে, উড়তেও পারে। কে বলে সব সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি মানুষ। মানুষ পাখির মতো উড়তে তো পারেই না, দৌড় দিয়ে ইঁদুরের সাথেও পারে না।
জরিনা বাড়ির দিকে রওনা হয়। খালি হাতে সে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন বিকেল হয়ে গেছে। শাশুড়ি উঠানে হোগলার ওপর শুয়ে আছে। তার মাথার পাশে পড়ে আছে একটা ছোট কাঁথা। তার ওপর সুই আর সুতা। সে কাঁথা সেলাই করছিল।
জরিনার ঠোঁটের কোণে কৌতুকের হাসি ফুটে ওঠার সাথে সাথেই আবার মিলিয়ে যায়। একটা নিঃশব্দ বেদনা ঘা দেয় তার বুকে। একটা বংশধরের জন্য শাশুড়ির কত যে আকুতি! তার বিয়ের পর থেকেই নাজুবিবি অধীর প্রতীক্ষায় দিন গুনছে। তার বহু দিনের আশা পূর্ণ হবে এবার। কিন্তু সে যদি জানত তার আশার বাসায় কোন পাখির ডিম!
জরিনার পায়ের শব্দ পেয়ে নাজুবিবি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। তার দিকে তাকিয়ে সে কিছুটা ক্ষোভের সাথে বলে, ‘দিন কাবার কইর্যা এহন ফিরছস আবাগীর বেডি! নিজের প্যাটটা বুঝিন তাজা কইর্যা আইছস?’
‘কী যে কন আম্মাজান! এই আকালের দিনে কে কার লেইগ্যা রাইন্দা থোয়?’ উষ্মা মেশানো জবাব দেয় জরিনা। সে বুঝতে পারে, খিদের জ্বালায় মেজাজ ঠিক নেই শাশুড়ির। খিদেয় পেট জ্বলছে তারও, মাথা ঘুরছে, ঝাঁপসা দেখছে চোখে।
কিন্তু ঘরে যে একটা দানাও নেই!
জরিনার কথায় রাগের আভাস পেয়ে নাজুবিবি একটু দমে যায়। সে আবার সুই-সুতা নিয়ে কাঁথা সেলাই করতে বসে যায়। জরিনা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে আছে দেখে সে বুঝতে পারে জরিনার রাগ পড়েনি। শেষে সে-ই যেচে কথা বলে, ‘ও মা, মাগো, রাগ অইছস? তুই রাগ অইলে আমি কই যাইমু? যেইডারে প্যাডে রাখলাম, বুকের দুধ খাওয়াইলাম, হেইডা তো গেছে অদস্থালে। হেইডায় না দেখল মা-র কষ্ট, না বুঝল বউর দুষ্ক। তোরে তো প্যাডে রাহি নাই, বুকের দুধ খাওয়াই নাই। তুই তো আমারে ফালাইয়া যাইতে পারস নাই। তুই কাম কইর্যা খাওয়াইতে আছস। তুই না থাকলে কোন দিন মইর্যা মাডির লগে মিশ্যা যাইতাম। নিজের মা-ও এতহানি করত না। তুই আমার মা-জননী। আমার কতায় রাগ অইস না, মা। প্যাডের জ্বালায় কি কইতে কি কইয়া ফালাইছি।’
নাজুবিবির কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। তাকে স্নেহময়ী মায়ের মতোই মনে হয় জরিনার। তাই এ নিঃসহায় শাশুড়িকে তার দেখতেই হয়। সে নিজেও নিঃসঙ্গ, নিঃসহায়। শাশুড়ির ওপর মাঝে মাঝে তার রাগ হয়। কিন্তু অসহায় বুড়ির জন্য তার হৃদয়ে যে মমতা সঞ্চিত হয়ে আছে, তার স্পর্শে সে রাগ পানি হয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই।
‘ও মা, মাগো, কতা কস না ক্যান?’ নাজুবিবি কাতর কণ্ঠে আবার বলে।
‘কী কইমু? আইজও কাম পাই নাই। না খাইয়া থাকতে অইব আইজ।’
হঠাৎ জরিনার মনে পড়ে, একটা ডিব্বার ভেতর কিছু খুদ আছে। মুরগির বাচ্চার জন্য সে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু বাচ্চা ফুটবে আর কার উমে? মোরগ-মুরগি যে একটাও নেই! খোপসহ সব ক’টা সে বিক্রি করে দিয়েছে অভাবের তাড়নায়।
জরিনা ঘরে গিয়ে ডিব্বাটা বের করে আনে। পোয়াখানেক খুদ আছে তাতে। কিন্তু ছাতকুরা পড়ে সেগুলো কালচে হয়ে গেছে।
ডিব্বা খোলার শব্দ পেয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায় নাজুবিবি। ব্যগ্রতার সঙ্গে সে জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু পাইছস, মা?’
‘হ, দুগ্গা খুদ আছে। জাউ রাইন্দা ফালাই।’
‘হ, যা রান্দনের ত্বরাত্বরি রাইন্দা ফ্যাল্। প্যাডের মইদ্যে খাবল খাবল শুরু অইয়া গেছে।’
জরিনা খুদ কটা ধুয়ে চুলো ধরায়। ঘরের চাল থেকে সে গোটা কয়েক লাউয়ের ডগা কেটে নেয়, গাছ থেকে ছিঁড়ে নেয় কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা। তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে সন্ধ্যার আগেই খেয়ে নিতে হবে। বেশ কিছুদিন ধরে কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কোনো বাড়িতেই বাতি জ্বলে না আজকাল। সন্ধ্যার পর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা, নয়তো বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়া–এ ছাড়া অন্ধকারে আর কিছুই করার উপায় নেই।
খাওয়া শেষ করে থালা-বাসন মাজা শেষ না হতেই বেলা ডুবে যায়। দোর-মুখে দাঁড়িয়ে দেশলাই জ্বালে জরিনা। কুপির শুকনো সলতেয় আগুন দিয়ে সে ঘরে সাঁঝ-বাতি দেয়। সন্ধ্যার পরই কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করে।
মাগরেবের নামাজ পড়ে বউ ও শাশুড়ি হোগলার বিছানায় বসে থাকে। কিন্তু অন্ধকারে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়। আবার মশার উৎপাত শুরু হয়েছে।
‘মশা গাঙ পাড়ি দিয়া আহে ক্যামনে?’ বিস্মিত প্রশ্ন নাজুবিবির। ‘আগেতো চর-চঞ্চালে এত মশা আছিল না!’
‘মশা আহে মাইনষের লগে লগে।’ জরিনা বলে। ‘পয়লা পরথম দুই-চাইড্ডা আহে গায়ে বইস্যা, নায়ে চইড়া। হেরপর চরেই পয়দা অয় হাজারে হাজার।’
‘না গো মা, মশার জ্বালায় আর বইস্যা থাকন যায় না। তুই ত্বরাত্বরি মশারি টাঙাইয়া দে, হুইয়া পড়ি।’
মশারির দুই কোনা টাঙানোই ছিল। অন্ধকারে হাতড়ে জরিনা বাকি দুই কোনা টাঙিয়ে ফেলে। তারপর কপাটে খিল লাগিয়ে সে মশারির ভেতর ঢোকে।
‘চাউলের খবর কি, অ্যা মা? দাম কি কমছে?’
‘না, দাম আর কমব না।’ বসে বসেই জবাব দেয় জরিনা। ‘যুদ্দ যদ্দিন আছে, দাম বাড়তেই থাকব। কয়দিন আগে আছিল ট্যাহায় চাইর সের। আইজ হুনলাম তিন সের ভাও।’
‘যুদ্দূর লগে চাউলের কোন এমুন দোস্তালি! চাউল ভইর্যা কি কামান দাগায় নি?’
‘হ কামানই দাগায়।’ জরিনা হাসতে হাসতে বলে। ‘কামান ফুডাইতে যদি চাউল লাগত আর চাউল ভইরা একটা কামান যদি মারত আমাগ বাড়ি, হে অইলে কী মজাই না অইত!’
‘হ, হে অইলে চাউল টোকাইয়া খাইয়া বাঁচতে পারতাম।’
‘হোনেন, চাউলের কাহাত পড়ছে ক্যান্। যুদ্দু অইলে অ্যাক দ্যাশের চাউল অন্য দেশে যাইতে পারে না। আগে দ্যাখছেন না পেগু চাউল? আমাগ দেশে চাউলের আকাল পড়লে বর্মা মুলুকতন ঐ চাউল আইতো।’
‘হ, খালি দেখমু ক্যান্, খাইছিও। ঐ চাউল ভাত অয় গাবের দানার মতন মোড়া মোডা।’
‘এ পেগু চাউল আর আইতে পারব না।’
‘ক্যান?’
‘বর্মা মুলুক হুনছি জাপান দখল করছে।’
জরিনা শাশুড়ির পাশে অন্য একটা বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
‘এই যুদ্দু কি আর থামব না! কী তাম্শা শুরু করছে মরার যুদ্দু। চাউল মাংগা, কেরাসিন পাওয়া যায় না।’
‘হুনছি, কয়দিন পর চাউলও পাওয়া যাইব না।’
‘তয়তো মানুষ মইর্যা সাফ অইয়া যাইব!’
‘হ বাঁচনের আর আশা ভস্সা দেহি না।’
‘আমাগ কি অইব? আরেকজন আইতে আছে। তারে ক্যামনে বাঁচইমু।’
জরিনা কোনো কথা বলে না।
‘অ্যা মা, চুপ কইর্যা আছস ক্যান্? কতা কস না ক্যান?’
‘কতা কইতে আর ভাল্লাগে না।’
‘তয় ঘুমাইয়া থাক। আমিও দেহি ঘুমাইতে পারি নি।’ নাজুবিবি চোখ বুজে ঘুমুবার চেষ্টা করে।
শরীর ভারী হওয়ার পর থেকেই একটা দুশ্চিন্তা জরিনার মনে বাসা বেঁধেছে। একা থাকলে, বিশেষ করে অন্ধকারে শুয়ে থাকলে দুশ্চিন্তাটা সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে। বিঁধতে থাকে তার হাড়-পাঁজরায়। শাশুড়ি তো আসমানের চাঁদ ধরবার জন্য ‘ডিলকি’ দিয়ে রয়েছে। কিন্তু আর একজন? তার ছেলে? সে-তো জানে, অমাবস্যা রাতে চাঁদ উঠতেই পারে না।
জরিনা কি করবে ভেবে পায় না। এ বিপদের কথা শুধুমাত্র একজনকেই বলা যায়। সে-ই দিতে পারে পরামর্শ। কিন্তু পরামর্শ দিয়ার আছেই বা কি? তবুও তার কাছে ভেঙে বললে সে হয়ত একটা কিছু বুদ্ধি দিতে পারে। এই সময়ে, এই মুহূর্তে যদি শোনা যেত হট্টিটির ডাক।
‘বাড়িডা দেহি আন্দার! বাড়ির মানুষ কি মইরা গেছে নি?’
হেকমতের গলা। জরিনা আঁতকে ওঠে। কাঁটা দিয়ে ওঠে তার সারা শরীর। তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যায় একটা ঠাণ্ডা কাঁপুনি। সে পায়ের কাছ থেকে কথাটা টেনে নিয়ে শরীরটা ঢেকে দেয়।
খট-খট-খ। কাঠের দরজায় ঘা দিচ্ছে হেকমত।
নাজুবিবি কাশি দিয়ে গলা সাফ করে বলে, ‘ক্যাডারে? হেকমত আইছস নি?’
‘হ, তোমরা হাউজ্যা বেলায় বাত্তি নিবাইয়া হুইয়া পড়ছ!’
‘কি করমু? বাত্তিতে তেল নাই।’ নাজুবিবি উঠে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে গিয়ে কপাট খুলে দেয়।
‘কে, মা? তুমি উঠছ ক্যান্, আরেকজন কই?’
‘হুইয়া রইছে। ও মা, ঘুমাইয়া পড়ছস নি?’
জরিনা চোখ বুজে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে।
‘ওঠতে কওনা ক্যান্? বাত্তি জ্বালাইতে কও।’ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হেকমত বলে।
‘বাত্তি জ্বালাইব ক্যামনে? কইলাম তো কুপিতে তেল নাই।’
‘তেল নাই!’
‘না, কেরাসিন যে পাওয়া যায় না!’
‘কিন্তুক রান্দন তো লাগব। চাউল আনছি।’
‘আর কি আনছস?’
‘আর কিছু তো আনি নাই।’
‘তয় খাবি কি দিয়া?’
‘ক্যান, ঘরে নাই কিছু? আণ্ডা তো আছে দুই-একটা।’
‘নারে বা’জান, আণ্ডা আইব কইত্তন? মোরগ-মুরগি তো বেবাক বেইচ্যা খাইছি।’
‘ডাইল নাই?’
‘ডাইলও বুঝিন নাই। অ বউ, ডাইল আছে নি?’
‘না। ডাইল তো অনেক দিন ধইর্যা নাই। পয়সা পাইমু কই?’ জরিনা শুয়ে শুয়েই জবাব দেয়।
‘এহনও হুইয়া রইছে! ওডে না ক্যান্? চাউলের মইদ্যে ধান আর আখালি। এগুলারে বাছতে অইব।’
‘আন্দারে ক্যামনে বাছমু?’
‘ক্যান্! আন্দারে চুলের জঙ্গল আতাইয়া উকুন বাছতে পারে, আর চাউলের আখালি বাছতে পারব না!’ দিনের বেলা হলে হেকমতের মুখ ভ্যাঙচানো দেখতে পেত জরিনা।
‘হ পারমু।‘ নাজুবিবি বলে। ‘কিন্তু ভাত খাবি কি দিয়া? কদুর ডোগা সিদ্দ কইর্যা দিলে খাইতে পারবি?’
‘দুৎ, দুৎ! খালি কদুর ডোগা কি খাওন যায়! ওরে উঠতে কও দেহি। আঁকিজালডা নামাইয়া দিতে কও। দুইডা খেও দিয়া আহি।’
‘জাল তো নাই।’ জরিনা বলে।
‘নাই! বাড়িত আইয়া খালি হুনতে আছি নাই আর নাই।’ হেকমত রেগে ওঠে। ‘জাল গেল কই?’
‘দফাদারে লইয়া গেছে। অ্যাকদিনের লেইগ্যা কইয়া নিছিল। অ্যাক মাস পার অইয়া গেছে। এহনও দিয়া যায় নাই।’
‘হায়রে আল্লাহ! কিয়ের লেইগ্যা বাড়িত আইলাম?’
একটু থেমে হেকমত বলে, ‘মাছ রাহনের জালিডা আছে তো? না হেইডাও নাই?’
‘হেইডা আছে।’
‘বাইর কইর্যা দে জলদি। দেহি, আতাইয়া কয়ডা গইদ্যা বাইল্যা ধরতে পারি নি।’
‘এই আন্দার রাইতে ক্যামনে যাবি, বা’জান?’
‘আমাগ আন্দারে চলনের আদত আছে। আন্দারে কি আমাগ আটকাইতে পারে? আর একটু পর চানও ওড্ব। দুই রাইত আগেইতো গেছে পূন্নিমা।’
জরিনা অন্ধের মতো হাতড়াতে মাছ রাখার জালটা খুঁজে পায়।
‘এই যে ধরুক।’ জরিনা হাত বাড়িয়ে জালটা হেকমতের হাতে দেয়।
জালের সাথে লাগানো লম্বা সুতলির অন্য প্রান্ত কোমরের তাগায় বাঁধতে বাঁধতে হেকমত বলে, ‘আমি গেলাম। চাউল বাইচ্ছা ভাত চড়াইয়া দে।’
‘ত্বরাত্বরিই আইয়া পড়িস, বা’জান।’ নাজুবিবি বলে।
কোনো কথা না বলে আবছায়ার মতো সরতে সরতে হেকমত আঁধারে মিশে যায়। থলে থেকে কুলায় অল্প অল্প করে চাল ঢেলে অন্ধকারে ধান আর কাঁকর বাছতে শুরু করে বউ আর শাশুড়ি।
‘ধানের খুইর মইদ্যে কি আখাইল ভইর্যা থুইছিল নি আল্লায়?’ নাজুবিবি বলে।
জরিনা অন্য কিছু ভাবছিল। শাশুড়ির কথার শেষটুকু শুধু তার কানে যায়। সে বলে, ‘আম্মাজান কি কইলেন?’
‘কইলাম, আল্লায় কি ধানের খুইর মইদ্যে আখালি ভইরা থুইছিল? হেইয়া না অইলে চাউলের লগে আখালি আইল কইত্তন?’
‘আল্লায় ভরব ক্যান? চাউলের দাম তো বেশি। হের লেইগ্যা ধান আর আখালি মিশাইয়া ওজন বাড়াইছে।’
‘দ্যাখ, মানুষ কেমুন জানোয়ার অইয়া গেছে।’
‘এক জানোয়ার কি আরেক জানোয়াররে এম্বায় ঠকাইতে পারে?’
‘উঁহু না তো! ঠিকই ধরছস। জানোয়ারের মইদ্যে ঠকাঠকির কারবার তো নাই! মানুষ তো দ্যাখতে আছি জানোয়ারেরও অধম অইয়া গেছে।’
‘আমার বা’জান কইত, ভাল মানুষ হগল জানোয়ারের থিকা ভাল। আর খারাপ মানুষ খারাপ জানোয়ারের থিকাও খারাপ।’
‘হ, কতাডা ঠিকই কইত তোর বাজান। নে মা, ত্বরাত্বরি আত চালা। ও আবার আইয়া পড়ব।’
জরিনা হাত চালাতে চালাতে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তার আজ মহাবিপদ। রাত পোহালে কি হবে? রাতের অন্ধকারে তাকে দেখতে পায়নি হেকমত। কিন্তু রাত পোহালেই তাকে দেখে সব বুঝতে পারবে সে।
‘ও বউ, ও মা, ও আইলেই কুন্তু সুখবরডা দিতে অইব। ও হুনলে যা খুশি অইব!’
দুশ্চিন্তার অথই দরিয়ায় ডুবে আছে জরিনা। শাশুড়ির কথা সে শুনতে পায় না।
‘ও বউ, চুপ মাইরা রইছস ক্যান?’ নাজুবিবি হাত দিয়ে ঠেলা দেয় জরিনার হাতে। ‘কী কইছি, হোনছস? ওরে সুখবর দিলে ও যা খুশি অইব!’
জরিনার দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যায়। সে বলে, ‘না, এত হবিরে কওনের দরকার নাই। চান ওঠলে দ্যাখতেই পাইব।’
‘উঁহু ওরে কইতেই অইব। তুই এহন আর ঢেঁকির কাম করতে পারবি না। তোরে আর ঐ কাম করতে দিমু না। ওরে কইমু বেশি কইর্যা ট্যাহা দিয়া যাইতে।’
‘কত ট্যাহাই দ্যায় আপনের পোলা! মনে করছেন ট্যাহার থলি বুঝিন লইয়া আইছে।’
নাজুবিবি লজ্জিত হয়। সে কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
জরিনা আবার বলে, ‘আপনের কওনের কোনো দরকার নাই। যা কওনের আমিই কইমু। আপনে গিয়া হুইয়া থাকেন। চাউল আর বাছন লাগব না। আমি রাইন্দা-বাইড়া আপনেরে ডাক দিমু।’
‘আবারও খাইতে ডাক দিবিনি? খাইছি তো অ্যাকবার।’
‘ঐ খাওন কি প্যাড ভরছে? আবারও খাইবেন আপনের পোলার লগে।’
‘আইচ্ছা, আমি তয় হুইয়া থাকি গিয়া। ভাত-সালুন রান্দা অইলে আমারে ডাক দিস।’
নাজুবিবি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। জরিনা চুলা ধরিয়ে তার ওপর পানি সমেত ভাতের পাতিল বসিয়ে দেয়। চুলার ভেতর ঘাস-পাতা জ্বলছে। সামান্য সে আলো তার কাছে ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়। সে দুজনের ভাতের চাল মেপে, সেগুলো তাড়াতাড়ি কলসির পানিতে ধুয়ে ঢেলে দেয় পাতিলের মধ্যে।
চুলার কাছে আলোয় বসে থাকতে তার কেমন ভয় ভয় লাগে। সে ঘরে গিয়ে একটা ছেঁড়া শাড়ি নিয়ে আসে। সেটাকে ভাল করে গায়ে জড়িয়ে সে আবার বসে চুলার ধারে। এবার সে অনেকটা স্বস্তি বোধ করে।
জরিনা ভাবে, ‘হেকমতকে কোনো রকমে খাইয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করা যেত!’
এই রাতের অন্ধকারেই তাকে যে করে হোক বিদায় করতে হবে। সঙ্কল্পের দৃঢ়তায় তার চোলায় শক্ত হয়, মুষ্টিবদ্ধ হয় দুটি হাত।
কৃষ্ণ তৃতীয়ার চাঁদ পূর্বদিগন্ত ছেড়ে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। ফিকে হয়ে এসেছে অন্ধকার।
জরিনা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘কে, কে, কেডা অইখানে? কতা কয় না ক্যান?’
‘কে, কেডাগো? ও বউ।’ নাজুবিবি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে।
জরিনা মশারির কাছে গিয়ে নিচু গলায় শাশুড়িকে বলে, ‘টচলাইট জ্বালাইয়া কারা যেন আইতে আছিল। আমি কে কে করছি পর টচ নিবাইয়া দিছে। চইল্যা গেছে না হুতি দিয়া আছে কইতে পারি না। টচের আলোতে দ্যাখলাম তিন-চার জোড়া ঠ্যাঙ। ঠ্যাঙ্গে বুটজুতা। আবছা মতন পাগড়িও দ্যাখলাম মাতায়।’
‘তয় কি পুলিস?’
‘পুলিস ছাড়া আর পাগড়ি মাতায় দিব কে? আপনের পোলা বাড়িত্ আইছে, এই খবর পাইছে। মনে অয় ধরতে আইছে।’
‘ও আল্লাহ্, কী অইব এহন! শান্তিতে দুইডা ভাতও খাইতে দিব না।’
‘এহনরি আইল না। আইলে কাইশ্যা বনে পলাইয়া থাকতে কইমু। রান্দা অইলে আমি গিয়া খাওয়াইয়া আইমু।’
‘হ, এইডাই ভাল বুদ্ধির কাম। ওইখানতনই চইল্যা যাইতে কইয়া দিস।’
‘হ কইয়া দিমু।’
ভাত রান্না হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নাজুবিবি লবণ আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে হেকমতের জন্য কিছুক্ষণ হা-হুঁতাশ করে আবার গিয়ে শুয়ে পড়ে।
হেকমত এখনো আসছে না কেন, বুঝতে পারে না জরিনা। সত্যিই কি পুলিস এসে গেছে খবর পেয়ে? ওত পেতে আছে কোথাও? তাই দেখেই কি পালিয়ে গেছে হেকমত?
সে আর আসবে না আজ—জরিনার মনে এ বিশ্বাস চাড়া দিয়ে উঠতেই তার দুশ্চিন্তা কেটে যায়, বন্য খুশিতে নেচে ওঠে মন।
ঈষৎ ক্ষয়ে যাওয়া গোলাকার চাঁদটা এখন ঠিক মাথার ওপর। রাত দুপুর পার হয়ে গেছে। নাজুবিবি এক ঘুম দিয়ে উঠে বাইরে আসে। চার দিকে তাকায়। জোছনার ঘোলাটে আলোয় দূরের গাছ-পালা বাড়ি-ঘর অস্পষ্ট দেখা যায়। সে ডাকে, ‘ও বউ, ও মা, কই তুমি?’
জরিনা রসুইঘরের বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছিল। শাশুড়ির ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে সে বলে, ‘এই তো আম্মাজান, আপনের পোলাতো এহনো আইল না।’
‘ওর কি অইল, আল্লা মালুম। মনে অয় পুলিস দেইখ্যা পলাইয়া গেছে।’
একটু থেমে সে আবার বলে, ‘ও মা, ওরে পুলিসে ধইরা লইয়া যায় নাই তো? তোর কি মনে অয়?’
‘কিছুই তো বোঝতে পারলাম না।’
‘আইচ্ছা, গাঙ্গে তো কুমির থাকে।’
হঠাৎ নাজুবিবি ডুকরে কেঁদে ওঠে। ইনিয়ে-বিনিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বিলাপ করতে শুরু করে, ‘ও আমার বা’জান রে। তোরে না জানি কুমিরে খাইয়া ফালাইছেরে। ও আমার বাজান রে, এ-এ!’
নাজুবিবির কান্নায় শেষ রাত্রির নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যায়। জরিনার বুকটাও হঠাৎ বোবা বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। বুকটায় তোলপাড় তুলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার দুচোখ থেকে অশ্রু ঝরে দরদর ধারায়।