সে দিনের সে গানটি ফজলের মনে গেঁথে রয়েছে। সে একাকী বসে থাকলে বা শুয়ে জেগে থাকলে সমস্ত ভাবনা-চিন্তা ছাপিয়ে গানটির গুঞ্জরণ শুরু হয় তার মনের মধ্যে। দেহের সমস্ত তন্ত্রী নেচে ওঠে সুরের ঝঙ্কারে। সে নিজেও গুনগুন করে গায় গানের কয়েকটা কলি। কখনো কলাগাছের ফাঁক দিয়ে রূপজানের বিষণ্ণ মুখ, কখনো কাশবনের ফাঁক দিয়ে জরিনার অশ্রুসজল চোখ ধরা পড়ে তার মনের চোখে। দুজনই তাকে ভালবাসে। দুজনই তার চোখে এক ও অভিন্ন, যেন এক দেহে লীন হয়ে গেছে দুটি নারী।
ভাওর ঘরে শুয়ে আছে ফজল। তার পাশে ঘুমিয়ে আছে নূরু। পাশের আরেকটা ভাওর ঘরে বরুবিবি ও আমিনা ঘুমিয়ে আছে।
সারাটা দিন খুবই খাটুনি গেছে। ভাটিকান্দি থেকে ঘর-দরজা ভেঙে সে নিয়ে এসেছে খুনের চর। কাল ভোরেই আবার শুরু হবে ঘর তৈরির কাজ। এক দিনের মধ্যে ঘরগুলো খাড়া করতে হবে। এজন্য তিনজন মিস্ত্রি ঠিক করেছে সে। জন চল্লিশেক কোলশরিকও কাজ করবে মিস্ত্রিদের সাথে।
রাত অনেক হয়েছে। গতদিনের খাটা-খাটুনিতে ফজল ক্লান্ত, অবসন্ন। ঘুমে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। কিন্তু তবুও তার মনের ভেতর চলছে গানের গুঞ্জরন, ‘—সেথায় বধূ থাকে।’
এক সময়ে গানের গুঞ্জরণ থেমে যায়। ফজল ঘুমিয়ে পড়ে।
…কাশবনের ভেতর দিয়ে কলসি কাঁখে এক যুবতী নারী ললিতগতিতে এগিয়ে আসছে নদীর পাড়ে। তার পরিধানে কমলা রঙের শাড়ি। কে এ নারী? রূপজান, না জরিনা? দূর থেকে চিনতে পারছে না ফজল। সে ডিঙির মাথিতে বসে বৈঠা টানছে। কলসিটা পাড়ে রেখে যুবতীটি কোমরে জড়িয়ে নেয় শাড়ির আঁচল। কলসিটা বাঁহাতে তুলে সে পানিতে নামে। কলসিটায় বুকের ভর দিয়ে সে এবার পা ছড়িয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করে। হঠাৎ তার চিৎকার শুনতে পায় ফজল। সে দেখতে পায়, যুবতীটি কলসির গলা জড়িয়ে ধরে ভেসে থাকবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিসে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। নিশ্চয়ই কুমির টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ফজল জোরে জোরে বেঠা টেনে এগিয়ে যায়। কলসিটা একদিকে কাত হয়ে ছুটছে মাঝনদীর দিকে। মাঝে মাঝে ওটা ডুবে যাচ্ছে। যখন ভেসে উঠছে তখন ওটার গলা জড়িয়ে ধরা কনুই ও একগোছা চুল শুধু দেখতে পায় ফজল। সে বৈঠাটা দু’হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে কুমিরের সম্ভাব্য অবস্থানের দিকে তাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি লাগে ফজলের সারা দেহে। তার মাথাটা ধপ করে পড়ে বালিশের ওপর।
‘আল্লাহু আল্লাহ! কী দ্যাখলাম!’ ঘাড়টা ব্যথা করছে ফজলের। বালিশের ওপর ঘাড়টা এ-কাত ও-কাত করে সে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ফজল বিছানা ছেড়ে ওঠে। অন্ধকারে হাতড়ে সে খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে রাখা টর্চলাইটটা হাতে নেয়। ওটা জ্বালিয়ে ঘরের এক কোণে রাখা মাটির কলসি থেকে ঢেলে পুরো এক গ্লাস পানি খায়।
রাত আর কতক্ষণ আছে, কে জানে? বেড়ায় সাথে ঝোলানো আছে ঘড়িটা। ফজল টর্চের আলো ফেলে ঘড়ি দেখে। বারোটা বেজে ওটা বন্ধ হয়ে আছে। গত পরশুর পর নানা ঝামেলার জন্য ওটায় আর দম দেয়ার কথা মনে হয়নি।
ফজল ঝাঁপ সরিয়ে খালি পায়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। পায়ের নিচে ভিজে মাটি। মাথার ওপর খোলা আকাশ। লক্ষ কোটি তারা মিটিমিটি জ্বলছে। সন্ধ্যায় দেখা শুক্লপক্ষের আধখানা চাঁদ আর আকাশে নেই। সে আদমসুরত খুঁজে বের করে। আদমসুরতের অবস্থান দেখে সে বুঝতে পারে, রাত পোহাতে ঘণ্টা তিনেক বাকি আছে।
‘কী একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম!’ ফজল মনে মনে বলে। রূপজানের কোনো বিপদ হয় নাই তো! জরিনা কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে নাই তো!
ওরা কেমন আছে, জানতে প্রবল ইচ্ছে জাগে তার মনে। জেলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের কোনো খবরাখবর সে পায়নি। চোখ দুটো তার আপনা থেকেই একবার উত্তর পুবমুখি নলতার দিকে আর একবার দক্ষিণ-পুব বরাবর নয়াকান্দির দিকে দৃষ্টি ফেলে। ঘন কালো অন্ধকার। কয়েকটা বাতি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। জেলেরা মাছ ধরছে নদীতে। বাতি জ্বলছে তাদের নৌকায়।
ফজল দুদিকেই টর্চের আলো ফেলে। সে আলো চরের সীমানা ছাড়িয়ে খুব বেশি দূর এগোয় না। সে জানে টর্চের আলো নলতা বা নয়াকান্দির অর্ধেকের অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে না। তবুও অযথাই সে ঐ দুদিকে টর্চের আলো ফেলে বারবার। ফজলের দিকে টর্চের আলো আসছে পুবদিকে থেকে। চরের পাহারায়রত তারই লোক তার আলোর জবাবে আলো ফেলছে।
ফজল চরের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকেও টর্চের আলো ফেলে। সেদিক থেকেও টর্চ মেরে জবাব দেয় পাহারাদাররা।
ফজল ধানখেতের আল ধরে এগিয়ে যায় পুবদিকে। পায়ের নিচে প্যাঁচপেচে কাদা। কিছুদূর কাদা মাড়িয়ে, তারপর তিরতিরে পানি ভেঙে সে পুব কিনারায় চলে যায়। অনেকক্ষণ নদীতে ভাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু জোয়ারের পানি এখনো পুরোপুরি নেমে যায়নি।
‘এখানে কারা আছে পাহারায়?’ ফজল জিজ্ঞেস করে।
‘আমি লালু আর সাবু।’ উত্তর দেয় একজন পাহারাদার। অনেক লটাঘাস বিছিয়ে একটা ঢিবির মতো করা হয়েছে। তারই ওপর দাঁড়িয়ে আছে দু’জন পাহারাদার।
‘তোরা সাবধানে থাকিস। গাঙ্গে কিন্তু কুমির আছে।’
‘আমাগ কাছে কুমির আইব কি মরতে? ট্যাটা দিয়া এক্কেরে গাঁইথ্যা ফালাইমু।’
‘টিপির উপরে তোগ টঙ বানাইয়া দিতে অইবরে। শীতকাল আইসা পড়তেছে। ছই না থাকলে মাথায় ওস পড়ব। আমাগ বেড়য়ালারা কই? ফাঁকগুলা বানা দিয়া বন্ধ করছে?’
‘হ, ভাটার টান লাগনের আগেই জাগাইয়া দিছিলাম।’ সাবু বলে। ‘তারা ফাঁক বুজাইয়া ঘুমাইয়া রইছে ডিঙির মইদ্যে।’
জোয়ারের সময় মাছ যাতে কিনারায় আসতে পারে সেজন্য বেড়ের কিছু বানা তুলে দেয়া হয়। ভাটার টান শুরু হওয়ার আগেই সে ফাঁক গুলো আবার বানা দিয়ে বন্ধ করতে হয়। যাতে পানি কমার সাথে সাথে মাছ বেরিয়ে যেতে না পারে।
‘মোরগের বাকের আগে পানি নামব না। ফজল বলে। পানি বেবাক সইর্যা যাওনের আগেই ওগ জাগাইয়া দিস আবার।’
‘আইচ্ছা।’
‘আর শোন, মাছ বেচতে যারা তারপাশা যাইব, তাগো মনে করাইয়া দিস, তারা যেন খবরের কাগজ আনতে ভোলে না।’
ফজল টর্চের আলো ফেলে কিনারা ধরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যায়। কোথাও পায়ের পাতা সমান, কোথাও আধহাঁটু পানি। সে পুরোটা চরে ঘোরে। পাহারাদাররা সবাই সজাগ, সতর্ক।
সে তাদের সাবধান করে দেয়, ‘কুমির আছে কিন্তু গাঙ্গে। সাবধান!’
ফজল ভাওর ঘরে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর শোনা যায় ভোরের আজান।
বসত ভিটা উঁচু করা প্রয়োজন। উঁচু না করলে ভরা বর্ষার সময় জোয়ারের পানি ঢুকবে ঘরের মধ্যে। তাই চল্লিশ জন কোলশরিক অন্ধকার থাকতেই ওড়া-কোদাল নিয়ে কাজে লেগে গেছে। ফজলের বাড়ির জন্য নির্ধারিত চৌহদ্দির দক্ষিণ পাশে পুকুর কেটে তারা বসত ভিটায় মাটি ফেলছে। কিন্তু পুকুরটা বেশি গভীর করা যাচ্ছে না। পানি উঠছে নিচে থেকে।
আকু মিস্ত্রি ভোরেই এসে কাজ করতে শুরু করেছে। তার তদারকিতে কাজ করছে। আরো দু’জন মিস্ত্রি।
দক্ষিণ ভিটিতে উঠবে তিরিশের বন্দের কাছারি ঘর। উত্তর ভিটিতে সাতাশের বন্দের ও পশ্চিম ভিটিতে পঁচিশের বন্দের দুটো থাকবার ঘর উঠবে। ঘরগুলোর ঢেউটিনের চালা, পাতটিনের বেড়া আর খুঁটি-খাম্বা সবই তৈরি। এখন মাপ-জোখ নিয়ে, বন্দ ঠিক করে, খুঁটি খাম্বা পুঁততে হবে। খুঁটির ওপর চালা বসিয়ে বেড়াগুলো গজাল মেরে আটকে দিতে হবে। পুবের ভিটিতে চাড়ার দো-চালা ঘর উঠবে। ওটার একদিকে চেঁকিঘর আর একদিকে রসুইঘর হবে।
ফজল বসে বসে মিস্ত্রিদের কাজ দেখছে আর নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে পুলকি মাতব্বরদের সাথে।
‘ওরা কি থানায় গেছে?’ জিজ্ঞেস করে ফজল।
‘গেছে, এডুক খবর পাইছি।’ মেহের মুনশি বলে। ‘কারে কারে আসামি দিছে, খবর পাই নাই।’
‘আপনারা খবর নেন। যাদের এই চরে আসার কথা, তারা কি সবাই আইস্যা পড়ছে?’
‘হ, সবাই বউ-পোলাপান লইয়া আইছে।’ বলে জাবেদ লশকর। ‘গরু-বাছুর, হাঁস মুরগি সব লইয়া আইছে।’
ফুঁত-ফুঁত।
চাটগাঁ মেল আসছে। সকলেই সেদিকে তাকায়। স্টিমারটা এ চরের উত্তর দিক দিয়ে চলে যায়। তারপাশা, ভাগ্যকুল, টেপাখোলা ধরে যায় গোয়ালন্দ।
‘জাহাজটা অনেক দেরিতে যাইতে আছে আইজ।’ কদম শিকারি বলে।
‘চর মাথাভাঙ্গার উত্তর চর পড়তে আছে।’ জাবেদ লশকর বলে। ‘তার লেইগ্যা ঘুইর্যা আইতে জাহাজের দেরি অইয়া যায়।’
‘শোনেন, একটা প্রাইমারি ইস্কুল খুলতে অইব।’ ফজল বলে। ‘শুরুতে নিজেগই মাস্টারি করণ লাগব।’
‘তা করণ যাইব।’ মেহের মুনশি বলে।
‘বাজারের বেইল অইয়া গেছে।’ রমিজ মিরধা বলে। ‘ট্যাহা লইয়া আহো। আমি আর মুনশি হাশাইল যাইমু। গয়নাগুলা বেবাক ছাড়াইয়া লইয়া আইমু।’
‘লাগবতো আসল দেড় হাজার আর এক মাসের সুদ পঁচাত্তর টাকা। তাই না?’ ফজল বলে।
‘হ। এই কয়দিনের লেইগ্যা পুরা এক মাসের সুদ চাইতে পারে।’
ফজল উঠে ভাওর ঘরে যায়। লোহার সিন্দুক এনে সেখানেই রাখা হয়েছে। সিন্দুক খুলে টাকা নিয়ে সে কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে। মেহের মুনশি টাকা গুণে নিয়ে রমিজ মিরধার সাথে হাশাইল রওনা হয়।
রোদের তেজ বাড়তে শুরু করেছে। ফজল সবাইকে নিয়ে তাদের ভাওর ঘরের ছায়ায় গিয়ে বসে।
ঘোঁজার দিক থেকে চারজন লোক আসছে। তাদের সাথে করে নিয়ে আসছে উত্তর দিকের একজন পাহারাদার।
‘এই লোকগুলা আইছে আপনের লগে দ্যাহা করতে।’ ফজলকে বলে পাহারাদার বাচ্চু।
‘হ, মাতবরের পো, আপনের কাছে একটা আরজু লইয়া আইছি। আমরা আছিলাম ধানকুনিয়ার চরে। আমাগ চর ভাইঙ্গা গেছে। আমার নাম তোবারক। অনেকদিন ধইর্যা পাতনা দিয়া আছি ডাইনগাঁয়। আর ওনারা চর ভাঙনের পর আসাম মুলুকে চইল্যা গেছিল। আবার ফিরত আইছে। আমাগ কিছু জমি দ্যান।’
‘জমি দিব কইত্যন?’ কদম শিকারি বলে। ‘জমিতে বেবাক ভাগ-বণ্টন অইয়া গেছে।’
‘এই মিয়া মাতবরের পো ইচ্ছা করলে দিতে পারে। আমাগ বাঁচনের একটা রাস্তা কইর্যা দিলে আমরা না খাইয়া মইরা যাইমু।’
‘না মিয়ারা, জমি দেওনের কোনো উপায় নাই।’
‘দয়া কইর্যা আমাগ বাচনের একটা পথ কইরা দ্যান।’ তোবারকের সাথের একজন বলে। ‘আমরা এই তিনজন চর ভাঙ্গনের পর গেছিলাম আসাম মুলুক।’
‘আসামে তো অনেক মানুষ যায়।’ ফজল বলে। ‘গেলেই কি জমি পাওয়া যায়?’
‘পাওয়া যাইব কইতন? জমিতো কেও দ্যায় না। বন-জঙ্গল সাফ কইরা জমি বানাইতে অয়। আমরাও জমি আবাদ করছিলাম। কিন্তু কালাজ্বরে থাকতে দিল না। কালাজ্বরে আমার মা, দুইডা লায়েক পোলা মরছে। ওনাগ পোলাপানও মরছে। হেষে মরণের মোখেরতন আমরা পলাইয়া আইছি।’ হঠাৎ লোকটির গলা ধরে যায়। তার চোখ ছলছল করে।
ফজলের মনে সহানুভূতি জাগে। সে জাবেদ লশকর ও কদম শিকারির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনারা কি কন?’
‘কী আর কইমু।’ জাবেদ লশকর বলে। ‘এতে কষ্ট কইর্যা আমরা চর দখল করলাম। আর ওনারা আসমানতন আইয়া কয়, জমি দ্যান।’
‘না মিয়ারা, জমি দেওন যাইব না।’ কদম শিকারি দৃঢ় কণ্ঠে বলে।
‘আমাগ বাঁচনের একটা রাস্তা কইর্যা না দিলে বউ-পোলাপান লইয়া দপাইয়া মইর্যা যাইমু।’ তোবারক বলে। ‘সাড়ে তিন ট্যাহা মনের চাউল দশ ট্যাহা অইয়া গেছে।’
আকু মিস্ত্রি হুঁকো টানতে টানতে এসে দাঁড়িয়ে শুনছিল এদের কথা। সে বলে, ‘হ, কাইল ট্যাহায় চাইর সের ভাও গেছে দিঘিরপাড়। হোন মাতবরের পো, আমাগ কিন্তু এহন আষ্ট আনা রোজ দিয়া পারবা না। আমাগ এহন অ্যাক ট্যাহা কইর্যা দিতে অইব।’
‘ওরে আমার আল্লারে, আষ্ট আনারতন এই লাফে অ্যাক টাকা!’
‘চাউলের দামও তো লাফ দিয়া তিন দুনা অইছে, কি কও, দিবা, না দিবা না? না দিলে থাকুক পইড়া তোমার কাম। আমরা বাড়িত্ চল্লাম।’
‘না, না, কাম করতে থাকেন। বিবেচনা কইরা দিমু আপনাগ।’
আকু মিস্ত্রি গিয়ে আবার কাজে লেগে যায়।
লোকগুলো আবার অনুনয় করে।
‘জমি দিতে পারমু না।’ ফজল বলে। ‘তয় তোমাগ বাঁচনের একটা পথ কইর্যা দিতে পারি।’
‘হ, একটা পথ কইরা দ্যান।’ তোবারক বলে। ‘আল্লায় আপনের ভাল করব।’
‘শোন, বাড়ির কাছে এত বড় গাঙ থাকতে তোমরা না খাইয়া মরবা ক্যান? এই গাঙ আমাগ যেমন ভোগায়, তার চেয়ে বেশি খাওন যোগায়। আমাগ কোলশরিকরা বেড় দিয়া মাছ ধরে। সেই মাছ বেইচ্যা তারা সংসার চালায়। পারবা তোমরা মাছ ধরতে?’
‘পারমু, মাতবরের পো। তোমরা কি কও, পারবা?’
‘হ, পারমু।’ আসাম-ফেরত তিনজন বলে।
‘যদি পার, চইল্যা আসো এই চরে। থাকনের লেইগ্যা ঘর উঠানের জায়গা আমি দিমু। তোমরা বাঁশ, বেত, নারকেলের কাতা কিন্যা আনো। চাঁই বানাও, দোয়াইর বানাও, চালি বুনাও। দাউন বড়শি বাইন্দা লও। অবসর সময়ে জাল বোন ইলশা জাল, মই জাল, টানা জাল, ধর্মজাল, ঝাঁকি জাল। আমাগ কোলশরিকরা পুব-দক্ষিণ আর পশ্চিমের ঢালে বেড় পাতছে। বেড় পাতনের আর জায়গা নাই। উত্তর দিকটা ঢালু না, খাই বেশি। ঐ দিগে তোমরা চাই পাতো, দোয়াইর পাতো, দাউন বড়শি পাতো। আরে, ইচ্ছা থাকলে মানুষ পারে না কোন কাম? না খাইয়া মরে কারা? যারা আত-পাও থাকতে হায়-হুঁতাশ করে। বাঁশ, বেত, সূতা কিনতে টাকা লাগলে কর্জ নিও আমারতন।’
ফজলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে তারা চলে যায়।
জাবেদ লশকর বলে, ‘বড় খারাপ দিন আইতে আছে। মানুষ চেষ্টা করলেও কি বাইচ্যা থাকতে পারব?’
‘চেষ্টাতো করতে অইব। ইতিহাসে পড়ছি ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে এই দেশের তিনভাগের এক ভাগ মানুষ মইর্যা গেছিল। সেই সময়েও ব্রিটিশ আছিল। দেশের ফসল মাইর গেছিল। মানুষের টাকা থাকলেও চাউল পাওয়া যায় নাই। সেই সময় তো জাহাজ আছিল না, রেলগাড়ি আছিল না। অন্য দেশের সাথে যোগাযোগ আছিল না। এখন তো একখানের ফসল মাইর গেলে আরেকখানতন আনতে পারা যায়। সরকার কী করতে আছে? এক জেলারতন আরেক জেলায় ধান-চাউল আনতে দেয় না। জাপানিরা বর্মা দখল করছে। ওই খানের পেগু চাউল আর আসব না। আবার মিলিটারির লেইগ্যা ধান-চাউল গুদামে ভরতে আছে। সরকার যদি দেশের মানইনষের দিগে না চায় তয় সেই সরকার থাকন না থাকন সমান। শোনেন, এই বিদেশী সরকার খেদান লাগব। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু অইছে। ব্রিটিশ আর বেশিদিন এই দেশে থাকতে পারব না। শোনেন বিদেশী সরকারের উপর ভরসা কইর্যা থাকন যাইব না। এই চরের ধানে কিন্তু বেবাকের সাত-আট মাসের বেশি চলব না। আপনারা চীনা আর কাউনের বীজ যোগাড় করেন। উঁচা জায়গায় ঐ লতা লাগাইয়া দিবেন। যার যার বাড়িত লপ্তে।’
গুড়গুড় আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে। সবাই মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকায়। পাঁচটা উড়োজাহাজ আসছে দূর থেকে। তার পেছনে আসছে আরো পাঁচটা।
‘যুদ্ধ এইবার লাগছে জবর।‘ জাবেদ লশকর বলে। ‘ওগুলা কই যাইতাছে?’
‘ওগুলা যাইব আসামের কোনো ঘাঁটিতে।’ ফজল বলে। ‘সেইখানতন পেট্টল ভইর্যা যাইব বর্মা মুলুকে, জাপানিগ উপরে বোমা মারতে।’
ভয়ঙ্কর বিদঘুঁটে শব্দ করে উড়োজাহাজগুলো মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় উত্তর পুবদিকে।
ফজল তার অসমাপ্ত কথার জের টেনে বলে, ‘আপনারা যার যার বাড়ির লপ্তে কদু, কুমড়া, বেগুন, মরিচ, নানান জাতের তরিতরকারির গাছ লাগাইতে শুরু করেন। বাড়ির চুতর্দিগে বেশি কইর্যা, ঘন কইর্যা কলাগাছ লাগান। এতে বাড়ির পর্দাও অইব, কলাও খাওয়ন যাইব। যদি আকাল লাগে, তয় চীনা-কাউনের ভাত, মিষ্টি আলু, কলার বারালি পেটের জামিন দিয়াও বাঁচন যাইব।’
‘ও মিয়া মাতবরের পো।’ আকু মিস্ত্রি ডাকে ফজলকে। ‘দ্যাহো দেহি ভাল কইর্যা। ব্যাকাত্যাড়া অইয়া গেলনি আবার।’
জাবেদ লশকর, কদম শিকারি ও আহাদালীকে নিয়ে ফজল ঘরের কাজ দেখে। খুঁটি খাম্বা ঠিকমত বসানো হয়েছে। মিস্ত্রিদের কাজে কোনো খুঁত পাওয়া যায় না। বসত ভিটায় ও ঘরের ভিটির মাটি ফেলা শেষ হয়েছে। তক্তা দিয়ে পিটিয়ে দুরমুশ করে সমতল ও মজবুত করে মাটি বসাচ্ছে কয়েকজন কোলশরিক।
‘মিস্ত্রি চাচা, সব ঠিক আছে। এইবার চালগুলা উড়াইয়া খিলাইয়া ফেলেন। বেড়াগুলা লাগাইয়া ফেলেন। চাল উড়াইতে আমাগ ধরন লাগব?’
‘না, বহুত মানুষ আছে। তোমাগ ধরন লাগব না।’
পুলকি-মাতব্বরদের নিয়ে ফজল আবার এসে বসে ভাওর ঘরের ছায়ায়।
‘গতকাল দারোগা-পুলিস আসার কথা ছিল। আসে নাই ক্যান্, কে জানে! আজ কিন্তু আসতে পারে। পাহারাদাররা সতর্ক আছে তো?’
‘হ আছে।’ আহাদালী বলে।
যারা মাছ নিয়ে তারপাশা গিয়েছিল তারা ফিরে আসে। ফজলের জন্য খবরের কাগজ নিয়ে এসেছে তারা।
আনন্দবাজার পত্রিকাটা হাতে নিতে নিতে ফজল বলে, ‘আজাদ পাইলা না?’
‘না, এইডাই শুধু পাওয়া গেল।’ কোলশরিক জমিরদ্দি জবাব দেয়।
‘কত পাওয়া গেছে আইজ?’
‘বড় মাছে আঠারো ট্যাকা। আর গুড়া মাছে আট টাকা।’
‘ভালইতো পাইছ।’
‘হ, মাছের দাম কিছু বাড়ছে।’
‘কিন্তু চাউলের দামের মতন তো বাড়ে নাই।’
‘তারপাশায় চাউলের দামের খোঁজ নিছিলা?’
‘হ, ট্যাহায় চাইর সের। মাইনষে কওয়া-কওয়ি করছিল–দর আরো বাড়ব। হেষে পাওয়াই যাইব না।’
জেল থেকে খালাস পেয়ে আসার পর ফজল খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ পায়নি। আর খবরের কাগজ হাতে পেয়েই তার পিপাসার্ত চোখ খবরের শিরোনামগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়ে।
‘কি লেখছে মিয়া?’ জাবেদ লশকর উন্মুখ হয়ে জিজ্ঞেস করে। ‘জোরে জোরে পড়লে আমরাও কিছু জানতে পারি।’
‘উত্তর আফ্রিকায় মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশী আক্রমণ। রোমেলের দুর্ধর্ষ বাহিনীর পশ্চাদপসরণ।’ ‘ব্রিটিশ বিমান হামলায় আকিয়াবের জাপানি ঘাটি বিধ্বস্ত।’ ‘স্তালিনগ্রাডে প্রচণ্ড যুদ্ধ।’
ফজল জোরে জোরে শিরোনামগুলো পড়তে থাকে।
দুপুরের কিছু পরে রমিজ মিরধা ও মেহের মুনশি হাশাইল থেকে ফিরে আসে। তারা গয়নাগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে।
‘একটা কামের মতো কাম অইছে।’ জাবেদ লশকর বলে। ‘এহন ছাড়াইয়া না আনলে গয়নাগুলা আর কোনোদিন ছাড়ান যাইত না।’
‘এই গয়নাগুলা নেওনের সময় কত বউ-ঝিরে কান্দাইছি।’ রমিজ মিরধা বলে। ‘আইজ তাগ মোখে আবার হাসি ঝলমল করব।’
‘ফর্দের সঙ্গে মিলাইয়া গয়নাগুলা আলাদা আলাদা সাজাইয়া নেন।’ ফজল বলে। ‘তারপর একজন একজন কইর্যা বোলাইয়া যার যার গয়না ফিরত দিয়া দ্যান। পয়লা আমারে দিয়াই শুরু করেন।’
রূপজানের গয়নাগুলো বুঝে নিয়ে ফজল সেগুলোকে রুমালে বাঁধে। রুমালের পুটলিটা বুকের সাথে চেপে ধরে সে ভাওর ঘরে যায়। তার মা সেখানে আলগা চুলোয় রান্না করছে।
‘মা এই নেও গয়না। আইজই মহাজনের ঘরতন টাকা দিয়া ছাড়াইয়া লইয়া আইছি।’
‘গয়নাতো আনছস। কিন্তু গয়নার মানুষটারে তো আনতে পারলি না।’ গয়নার পুটলিটা হাতে নিয়ে বলে বরুবিবি।
ফজল মাথা নিচু করে সরে যায় সেখান থেকে।
দুপুরের খাওয়া সেরে ফজল মিস্ত্রিদের কাজ দেখতে চলে আসে। পুলকি-মাতব্বররা বাড়ি চলে গেছে যার যার। শেষ বিকেলের আগে তারা আর আসবে না।
ফজল খবরের কাগজের মধ্যে ডুবে যায়।
‘ফজল।’
ফজল মুখ তুলে তাকায়। ‘আরে জাহিদ ভাই! তুমি কইতন আইলা?’
‘আইলাম বাড়িত্ন। গেছিলাম ভাটিকান্দি। শোনলাম, তোমরা ঘর-দরজা ভাইঙ্গা এই নতুন চরে আইসা পড়ছ।’
‘বাড়ির সব কেমন আছে? চাচি, শহিদ-ভাই, তওহিদ, সেতারা?’
‘সব্বাই ভাল আছে। আমিই খালি ভাল নাই।’
‘ক্যান্, কি অইছে?’
‘এই নানান ঝামেলা। চাচি কই?’
‘ঐ খানে ভাওর ঘরে। চলো যাই। তোমার তো খাওয়া হয় নাই।’
‘না।’
জাহিদকে ভাওর ঘরে নিয়ে যায় ফজল। তাকে দেখে খুশি হয় বরুবিবি। তার খাওয়ার ব্যবস্থা করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে তাদের বাড়ির সকলের কথা।
এরফান মাতব্বরের বড় ভাই এমরান মাতব্বর। সে-ই ছিল এ এলাকার বড় মাতব্বর। বাংলা ১৩২৬ সনের বন্যার পরের বছর যখন লটাবুনিয়া ভেঙে যায় তখন সে তার সব কিছু নিয়ে চলে যায় তার শ্বশুরবাড়ি–দক্ষিণপাড়ের পাইকপাড়া গ্রামে। তার স্ত্রী শরিফ ঘরের মেয়ে। সে বেঁকে বসেছিল, সে আর কোনো দিন চর অঞ্চলে যাবে না। উপায়ান্তর না দেখে সেখানেই সে জমাজমি কিনে বাড়ি-ঘর করে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। তারপর লটাবুনিয়া কয়েকবারই জেগেছে, আবার ভেঙেছে। নাম বদলে হয়েছে খুনের চর। কিন্তু এমরান মাতব্বর আর চরে ফিরে আসেনি কোনো দিন। স্ত্রীর জেদের কাছে তাকে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল। বছর সাতেক আগে সে কলেরায় মারা যায়। জাহিদ তারই মেজো ছেলে।
জাহিদকে নিয়ে ফজল আবার চলে আসে মিস্ত্রিদের কাজের জায়গায়।
‘জাহিদ ভাই, তুমি না মিলিটারিতে গেছিলা?’
‘হ, না জাইন্যা ঢুকছিলাম পায়োনিয়ার ফোর্সে। আমাগ নিয়া গেছিল চাটগাঁর অনেক দক্ষিণে জঙ্গল সাফ কইর্যা রাস্তা বানাইতে। এমুন সব কাম করতে হুকুম দেয় যা গুষ্ঠীর কেউ কোনোদিন করে নাই। অইসব জাগায় জাপানিরা বোমা মারতে পারে। আমি আইয়া পড়ছি, আর যাইমু না।’
‘পলাইয়া আইছ?’
‘না পলাইমু ক্যান্। ছুটি লইয়া আইছিলাম। আর যাইমু না।’
‘আমাগ কোলশরিক কিতাবালীর পোলা বোরহান পড়ত ক্লাস এইটে। মিলিটারিতে ‘টপ্যাস’ অইয়া ঢুকছিল। সে মনে করছিল রাইফেল-বন্দুক হাতে লইয়া লড়াই করব। আমরা যেমন লড়াই করি ঢাল-শড়কি লইয়া। ও গিয়া দেখে, টপ্যাসের কাজ ঝাড়ু দেওয়া। সে-ও পলাইয়া আইছে। তারে নাকি পলাতক ঘোষণা করছে। তার নামে ওয়ারেন্ট বাইর অইছে।’
জাহিদ গলা খাদে নামিয়ে বলে, ‘শোন ফজল, আমার নামেও ওয়ারেন্ট অইছে। সেই জন্যই আইছি তোমাগ বাড়ি। এইখানে তো আমারে কেও চিনে না। আমি এইখানেই থাকমু কিছুদিন।’
‘থাকো, যদ্দিন তোমার মনে লয়। কিন্তু পুলিস আমাগ ধরতে আইব। আইজও আইতে পারে, কাইলও আইতে পারে। আমাগ বিরুদ্ধে ঘর পোড়ানের মামলা আছে।’
‘তয় তো বড় মুসিবত। আমি তাইলে এখনি চইল্যা যাই।’
‘না, যাইবা ক্যান্। পুলিস আইলে আগেই খবর পাইমু। আমি ধরা দিমু না। সইর্যা যাইমু। নাও-বাইছা সব তৈয়ার। তুমিও আমার লগে সইর্যা পড়বা।’
জাহিদ আশ্বস্ত হয়। কিছুক্ষণ পরে সে বলে, ‘আইচ্ছা, এই চরের অর্ধেক মালিকানা তো আমার বাজানের আছিল। তার অবর্তমানে এখন আমরা মালিক। দূরে আছিলাম বুইল্লা দাবি করি নাই। এহন দাবি করলে আমাগ অংশের জমি দিবা?’
‘নেও না। আমার ভাগের অর্ধেক জমি দিমু তোমারে। চাচিরে, ভাবিসাবরে লইয়া আহো গিয়া।’
‘মা তো আইব না। তোমার ভাবিসাবরে লইয়া আইমু।’ একটু থেমে সে আবার বলে, ‘আইজ হাঁটতে হাঁটতে জান সারা। আমি ভাওর ঘরে গিয়া একটু বিশ্রাম নেই।’
সবগুলো ঘর উঠে গেছে। কাজ আর বেশি বাকি নেই। দিনের শেষে কাজেরও শেষ হবে বলে মনে হয় ফজলের।
আজও পুলিস আসেনি। ফজল মনে মনে ভাবে, খুবই ভাল হলো। কাল এসে পুলিস প্রমাণ পাবে, এ চরের সত্যিকার মালিক কে?
আকু মিস্ত্রি চালার ওপর উঠে চালার জোড়ায় টুয়া লাগাচ্ছে। এক সময়ে সে গানে টান দেয়:
যেই ঘর আমি বানাইলাম
মনের মতন সাজাইলাম
সেই ঘরেতে হবে না মোর ঠাঁই রে,
হবে না মোর ঠাঁই।
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে
থাকতে হবে চিরতরে
সেই ঘরেতে আলো বাতাস নাই রে,
আলো বাতাস নাই।