» » সাতাশ

বর্ণাকার

চর অঞ্চলের লোক যা কোনোদিন করেনি, করতে সাহস পায়নি, তাই করছে জঙ্গুরুল্লা চৌধুরী। সে চৌধুরীর চরে নিজের বাড়ি থেকে অল্প দূরে দক্ষিণ দিকে তার পীরবাবার জন্য দেয়াল ঘেরা তিন কামরার পাকা বাড়ি তৈরি করছে। দেয়ালের বাইরে তৈরি করছে খানকাশরিফ।

প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য সে কোনো দিনই ইটের বাড়ি বানাতে সাহস করেনি। সে প্রায়ই বলত, ‘ইট মানেই মাটি। এই মাটির ঘরেরতন টিনের ঘর অনেক ভাল। রাক্কইস্যা গাঙ থাবা দিলে টিনের ঘর ভাইঙ্গা-চুইর‍্যা আরেক খানে গিয়া আবার বসত করণ যায়। আর ইটের ঘর? ইটের ঘর ভাঙলেই বেবাক মাটি। ভাঙ্গন শুরু অইলে এই মাটির ঘর চিৎ-কাইত অইয়া রসাতল অইয়া যাইব।’

পীরবাবা বুজুর্গ আদমি, আল্লার খাস বান্দা, পিয়ারা দোস্ত। তার খানকাশরিফ, তার মহল খোদ আল্লাই হেফাজত করবেন–এই দৃঢ় বিশ্বাসই জঙ্গুরুল্লার বুকে হিম্মত দিয়েছে ইটের বাড়ি তৈরি করবার। পীরবাবাকে তো আর তাদের মতো টিনের ঘরে মাটির মেঝেতে বাস করার কথা বলা যায় না।

তার আরো বিশ্বাস-পীরবাবা এ চরে বসত করলে রাক্ষুসে নদী এ চরের ওপর তার সর্বনাশা থাবা দিতে সাহস করবে না।

বিকেল বেলা সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে জলচৌকির ওপর বসে জঙ্গুরুল্লা রাজমিস্ত্রিদের কাজ দেখাশুনা করছিল আর হুঁকো টানতে টানতে ভাবছিল অনেক কিছু।

খুনের চর হাতছাড়া হয়ে গেছে। এই কার্তিক মাসের পরেই অগ্রহায়ণ মাসের শেষ নাগাদ এই চরের ধান পাকবে। তার আগেই কলে-কৌশলে চরটা আবার দখল করতে হবে। যুদ্ধের দরুন ধান-চালের দাম লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ছে। গোলার ধান আরো কয়েক মাস রেখে দিলে ভাল দাম পাওয়া যাবে। আমনের মরশুমে দুই-তিন হাজার মণ চাল কিনে রাখলে অনেক মুনাফা হবে। চাল রাখার জন্য একটা গুদামঘর বানানো দরকার। কিন্তু টিন পাওয়া যাচ্ছে না। টাটা কোম্পানী এখন নাকি যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরি করতে ব্যস্ত। টিন আর তৈরি করছে না। অনেকে অভাবে পড়ে ঘর বিক্রি করছে। দু-চারটে ঘর কিনতে পারলে গুদামের জন্য প্রয়োজনীয় টিন পাওয়া যাবে। পীরবাবা আর মাসখানেক পরেই এসে পড়বেন। তাই বাড়ি তৈরির কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। আরশেদ মোল্লার মেয়ের সাথে পীরবাবার শাদিমোবারক সহি-সালামতে সম্পন্ন করতে পারলেই তার মনে লালিত অনেক দিনের আরজু পুরো হয়। কিন্তু তার আগে ফজলকে আবার জেলে ঢোকাতে হবে। গুলি-খাওয়া বাঘ খাঁচায় ঢুকাতে না পারলে স্বস্তি নেই। ও বাইরে থাকলে চর দখল করা কঠিন হবে। আর শুভ কাজের সময় সে কী যে করে বসে বলা যায় না।

হঠাৎ আরশেদ মোল্লা ও তার মেয়ের খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে জঙ্গুরুল্লা। মোল্লাকে সে দেখেনি অনেকদিন। খুনের চর থেকে বিতাড়িত কোলশরিকদের মাঝেও তাকে দেখেছে বলে মনে পড়ে না তার। কোরবান ঢালী তার সামনেই বসে ছিল। তাকেই জিজ্ঞেস করে সে, ‘মাইরের দিন আরশেদ মোল্লা কি চরে আছিল?’

‘হ আছিল। ভ্যাদাডা পলাইতে পারছিল না? ওরে চুবাইয়া এক্কেরে আধামরা কইর‍্যা ফালাইছিল।’

‘অ্যাঁ, কও কি! এই কথাডাতো আমারে কয় নাই কেও।’

আমি ও জানতাম না হুজুর, ‘আইজই হুনছি।’

‘কে চুবাইল? জামাই বুঝিন হউরের লাগুড় পাইয়া শোধ নিছে? চুবাইয়া হ্যাঁ-দফা ঘড়াইয়া দিছে?’

‘কে চুবাইছে, হুনি নাই।’

‘ভ্যাবলাডা কই এহন? বাইন্দা রাখে নাই তো?’

‘না ওগ আতে পায়ে ধইর‍্যা, মাইয়া দিয়া আহনের ওয়াদা কইর‍্যা ছাড়া পাইছে।’

‘অ্যাঁ, কও কি! ওয়াদা কইর‍্যা আইছে?’

‘হ, আমার কানে কানে কইছে। আপনের কাছে কইতে মানা করছে।’

‘ক্যান্? মানা করছে কিয়ের লেইগ্যা? মাইয়া কি দিয়া আইব নি?’

‘হেইডা কয় নাই। তয় ওয়াদা যহন করছে–’

‘ওয়াদা করছে তো জান বাঁচানের লেইগ্যা। তালাক দেওয়া মাইয়ারে দিয়া আইব ক্যামনে? তুমি শিগগির যাও। আরো পাঁজ-ছয়জন লইয়া যাও। মোল্লারে ধইর‍্যা উঁচ্‌কাইয়া লইয়া আইবা আমার কাছে। আর শোন, ওর মাইয়াডারেও লইয়া আহো।’

কোরবান ঢালী চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মজিদ খালাসি আসে।

‘কি ও খালাসি, কি খবর লইয়া আইছ?’

‘হুজুর, থানায় ইজাহার নেয় নাই।’

‘ইজাহার নেয় নাই!’ জঙ্গুরুল্লা রাগে ও উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়।

‘তুমি খবর পাইলা কই? তোমারে তো থানায় পাই নাই।’

‘ওনারা ডরে আপনের কাছে আহে নাই। আমারে খবর দিয়া পাডাইছে।’

‘ইজাহার নেয় নাই ক্যান?’

‘বড় দারোগা বিশ্বেস করে নাই।’

‘ক্যান বিশ্বেস করে নাই?’

‘তাতো কিছু ভাইঙ্গা কয় নাই। মনে অয় ঠিকমত মিল দিয়া কইতে পারে নাই।’

রাগান্বিত জঞ্জুরুল্লা দাঁতে দাঁত ঘষে। বলে, ‘এই হারামজাদারা কোনো কামের না। এই সামান্য কামডা ঠিক মতন কইর‍্যা আইতে পারল না। ইচ্ছা করে ওগ ভরতা বানাইয়া খাই। হারামজাদারা–’

মাগরেবের আজান শোনা যায়।

জঙ্গুরুল্লা রাগে গরগর করতে করতে বাড়ির দিকে রওনা হয়।

রাতের খাওয়া সেরে জঙ্গুরুল্লা যখন শোয়ার আয়োজন করছিল তখন বাইরে কোরবান ঢালীর গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। ‘হুজুর, ঘুমাইয়া পড়ছেন নি? আমরা আইছি।’

জঙ্গুরুল্লা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘মোল্লারে লইয়া আইছ?’

‘না হুজুর, আরশেদ মোল্লা বাড়ি নাই। কোথায় গেছে বাড়ির কেও কইতে পারে না।’

‘কবে আইব?’

‘তাও কেও কইতে পারে না।’

‘তার মাইয়া লইয়া আইছ?’

‘না হুজুর। আরশেদ মোল্লা নাই, এমুন অবস্থায় তার মাইয়া আনি ক্যামনে?’

‘আইচ্ছা বাড়ি যাও। কাইল সকাল বেলা আমার লগে দেখা কইর‍্য।’

জঙ্গুরুল্লা পালঙ্কের বিছানায় শুয়ে পড়ে।

‘আরশেদ মোল্লার মাইয়ারে আনতে কইছিল কিয়ের লেইগ্যা?’ পাশে শোয়া দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী শরিফন জিজ্ঞেস করে।

‘তুমি ওই সব বোঝবা না।’

‘বুঝমু না ক্যান্? সুখের গাঙ্গে বুঝিন রসের জোয়ার লাগছে, রঙ্গের ঢেউ উথালপাথাল করতে আছে?’

‘উঁহু, নাগো, দুখের গাঙ্গে এখন বড় তুফান। ঐ সব কথা বাদ দ্যাও। তুমি আমার রান দুইডারে টিপ্যা দ্যাও জোরে জোরে। রানের মইদ্যে বড় চাবাইতে শুরু করছে।’

শরিফন ওঠে। স্বামীর পা টিপতে টিপতে বলে, ‘মাইয়াডা বোলে পরীর মতন খবসুরত?’

শরিফনের কথা কানে যায় না জঙ্গুরুল্লার। তার মনে তখন নানা দুশ্চিন্তার ভিড় জমতে শুরু করেছে।

আরশেদ মোল্লা কি সত্যি ওয়াদা পালন করবে? ফজলের ঘরে দিয়ে আসবে তার মেয়েকে? তা কি করে হয়! তালাক দেয়া মেয়ে আগের স্বামীর ঘর করবে কেমন করে? এটা যে শরিয়তের বরখেলাপ।

পীরবাবার জাদু-টোনার কি কোনো আছর পড়েনি মেয়েটার ওপর? ফজলকে জেলে ঢুকাবার একটা বড় সুযোগ নষ্ট হয়ে গেল। ওকে কি ভাবে আবার জেলে ঢোকানো যায় ।