কার্তিক গেল, অগ্রহায়ণও প্রায় শেষ হয়ে এল। কিন্তু রূপজানকে দিয়ে গেল না আরশেদ মোল্লা। লোকটার মতলব খারাপ বলে মনে হচ্ছে এরফান মাতব্বরের। মোল্লার চেহারা মনে ভাসতেই তার রক্ত টগবগ করে ওঠে, ‘জাক্কইর’ দিয়ে ওঠে সারা শরীরের রোম। তার ইচ্ছে হয়–মোল্লাকে শড়কি দিয়ে গেঁথে কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে।

রাগ হয় তার নিজের ওপরেও। কেন সে আহাম্মকের মতো এতগুলো গয়না তুলে দিয়ে এল মোল্লার মেয়েকে? যে মোল্লা ফেরেববাজি করে নিজের নাবালক ভাইপোর দুই কানি জমি আত্মসাৎ করতে পারে, জমির লোভী সেই মোল্লা যখন নতুন চরের জমির জন্য তার কাছে এল না, তখনই সে বুঝতে পেরেছিল, লোকটার মনে খন্নাস’ভর করছে। এতটা বুঝেও কেন বোকামি করল সে! কেন দিয়ে এল গয়নাগুলো! ওগুলো থাকলে ও দিয়েই আবার সে ফজলের বিয়ে দিতে পারত।

হুঁকো টানতে টানতে উঠানে বেরোয় এরফান মাতব্বর। সেখানে বরুবিবি রোদে দেয়া ধান ঘাটছিল পা চালিয়ে।

মাতব্বর বলে, ‘হোন ফজুর মা, এত টাকার গয়না খামাখা দিয়া আইলাম। আমার মনে অয় গয়নাগুলা অজম করনের তালে আছে মোল্লা।’

‘আমারও মনে অয় গয়নাগুলো মাইরা দিব।’

‘কিন্তু অজম করতে দিমু না। আইজ মানুষজন খবর দিতে আছি।’

‘ক্যান, মানুষজন দিয়া কি অইব?’

‘কি অইব আবার! এত চর দখল করলাম এই জিন্দিগিতে, আর এহন নিজের পুতের বউ দখলে আনতে পারুম না!’

‘ওনার কি মাথা খারাপ অইল নি? কাইজ্যা-ফ্যাসাদ কইর‍্যা বউ ছিনাইয়া আনলে মাতবর বাড়ির ইজ্জত থাকব? মাইনষে–’

‘কি করতে কও তয়? পাজির লগে পাইজ্যামি না করলে দুইন্যায় বাঁইচ্যা থাকন যায় না।’

‘আবার মোল্লাবাড়ি গিয়া দেহুক না একবার।’

‘উঁহু! আমি আর যাইতে পারমু না। তোমার পোলারেই পাড়াইয়া দ্যাও।’

‘ও গেলে তো দিবইনা।’

‘হে অইলে ঐ মাইয়ার আশা ছাইড়া দ্যাও। গেছে গয়না যাইক। তুমি মাইয়া বিচরাও। ফজুরে আবার আমি বিয়া করাইমু।’

‘কিন্তুক ফজুরে রাজি করান যাইব না।’

‘ক্যান্ যাইব না? এমুন খুবসুরত আর ঢক-চেহারার মাইয়া যোগাড় করমু, মোল্লার মাইয়ার তন তিন ডফল সোন্দর।’

‘উঁহু। কত জায়গায় কত মাইয়া দ্যাখলাম। আমার রূপজানের মতন এমুন রূপে-গুণে কামে-কাইজে লক্ষ্মী মাইয়া আর পাওয়া যাইব না।’

‘মাইয়াডা তো লক্ষ্মী, কিন্তু বাপখান কেমুন? ওর মতো অলক্ষ্মী, পাজির পা-ঝাড়া আছে দুইন্যার মাঝে? ওর মাইয়া লক্ষ্মী অইলেই কি, আর না অইলেই কি! তুমি জিগাও তোমার পোলারে।’

‘উঁহু, ও রাজি অইব না কিছুতেই।’

‘ক্যামনে বোঝলা তুমি?’

‘আমি মা, আমি কি আর বুঝি না?’

‘তয় এমুন না-মরদের মতন চুপচাপ রইছে ক্যান্ তোমার পোলা? যায় না ক্যান্ হউর বাড়ি? আলগোছে ভাগাইয়া লইয়া আইলেই তো পারে।’

‘এই বুদ্ধিডাই ভাল। চুপে-চাপে কাম অইয়া গেলে কেও টের পাইব না।’

‘হ তোমার পোলারে এই পরামিশই দ্যাও। নেহাত যদি বউ স্ব-ইচ্ছায় না আইতে চায়, তয় জোর কইর‍্যা লইয়া আইব। তা না পারলে গয়নাগুলা যে কাইড়া লইয়া আহে।’

ফজলও এ রকমই ফন্দি এঁটেছিল। দ্বিধা-লজ্জার চাপে তা ছিল তার মনে মনেই এত দিন। বাপ-মায়ের প্ররোচনা ঝেটিয়ে দেয় তার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। সে তার মামাতো ভাই হাশমতের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে, তার শ্বশুর যেদিন দূরে কোথাও যাবে, রাত্রে বাড়ি ফিরবে না, সেদিন সে চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি। রাত্রে সে থাকবে সেখানে। রাত দুপুরের পর নৌকা নিয়ে সেই বাড়ির ঘাটে হাজির হবে হাশমত।

দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু সুযোগ আর আসে না। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত ফজল মিস্ত্রিদের কাজ দেখাশুনা করে। নতুন চরে পানসি তৈরি হচ্ছে তাদের। রাতের বেলাও ভাওর ঘর ছেড়ে সে কোথাও যায় না। বসে থাকে খবরের আশায়। গোপন খবরের জন্য সে তার চাচাতো শালা কাদিরকে লাগিয়েছে।

চুপচাপ বসে থাকলেই ফজলের মনে হানা দেয় জরিনার খোঁপার কাঁটাটা। রূপজান নিশ্চয় পেয়েছে কাঁটাটা। তার বুঝতে বাকি নেই কিছু।

‘বুঝুক, বুইঝ্যা জ্বইল্যা পুইড়া মরুক। ও-ই তো এর লেইগ্যা দায়ী। ঐ দিন রাইতে দেরি করল ক্যান্ ও?’ ফজলের মনে ক্ষুব্ধ গর্জন।

কিন্তু তবুও তার মনের দ্বিধা দূর হয় না। সে কেমন করে গিয়ে দাঁড়াবে রূপজানের সামনে? কাঁটাটার কথা জিজ্ঞেস করলে কি বলবে সে?

নাহ্, মিছে কথা ছাড়া উপায় নেই, ফজল ভাবে। এমন কিছু বানিয়ে রাখতে হবে যাতে জিজ্ঞেস করলেই ঝেড়ে দেয়া যায়।

কিন্তু রূপজানের সাথে দেখা করার সুযোগই যে পাওয়া যাচ্ছে না।

সুযোগের নাগাল পাওয়ার আগেই একদিন বাড়ি থেকে নূরু এসে বলে, ‘দুদু, পা-না ধোয়া জঙ্গুরুল্লা হুছি চর দখলের আয়োজন করতে আছে!’

‘কার কাছে শুন্‌লি?’

‘আইজ ইস্কুলতন আইতে লাগছি, একজন মাইয়ালোকে আমারে ডাক দিয়া নিয়া চুপে চুপে কইছে এই কথা।’

‘মাইয়া লোক! কে চিনস না?’

‘উঁহু। হে কইছে, আইজই তোর চাচার কাছে খবরডা দিস।’

‘মাইয়া লোকটা দ্যাখতে কেমন?’

‘শ্যামলা রঙ। নীলা রঙের শাড়ি পরনে।’

‘মোডা না চিকন?’

‘বেশি চিকন না। মোডাও না।’

‘বয়স কত অইব? বুড়ি, না জুয়ান?’

‘বুড়ি না। চাচির মতই বয়স অইব।’

ফজল চিনতে পারে না কে সে মেয়েলোকটি। কিন্তু সে যে-ই হোক, নিশ্চয়ই কোনো শুভাকাক্ষী আপন জন। তার খবরটা বেঠিক বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। জঙ্গুরুল্লা দাঙ্গাবাজ। তার তবে অনেক কোলশরিক, লাঠিয়াল-লশকর। ডাইনগাঁয়ের পুব দিকে অনেক কয়টা চর দখল করেছে সে। ফজল চিন্তিত হয়।

নূরু ও চার-পাঁচজন পুলকি-মাতব্বরকে সাথে করে ফজল বাড়ি যায়।

এরফান মাতব্বর শুনে বিশ্বাস করতে চায় না। সে বলে, ‘নিজের এলাকা ছাইড়া জঙ্গুরুল্লা এত দূরে আইব কি মরতে?’

মেহের মুনশি বলে, ‘কওন যায় না চাচাজান। জঙ্গুরুল্লার দলে অনেক মানুষজন।’

‘হ ব্যাডা ট্যাহার কুমির।’ সমর্থন করে বলে জাবেদ লশকর। ‘মাইনষে কয়, জঙ্গুরুল্লা পাল্লা-পাথর দিয়া ট্যাহা মাপে। গইন্যা বোলে শুমার করতে পারে না।’

‘হে অইলে তো তৈয়ার থাকতে অয়,’ এরফান মাতব্বর বলে। ‘চাকইর‍্যা ভাড়া করণ লাগব, না, তোমরাই ঠেকা দিতে পারবা?’

ফজল : ‘আমরাই পারুম।’

মেহের মুনশি : ‘এক কাম করলে অয়। আমাগ জমিরদ্দির মাইয়া বিয়া দিছে জঙ্গুরুল্লার কোলশরিক মজিদ খালাসির পোলার কাছে। জমিরদ্দিরে পাড়াইয়া দেই খালাসি বাড়ি। মাইয়ার কাছতন খবর লইয়া আইব গিয়া।’

যুক্তিটা পছন্দ হয় সকলের। সেদিনই জমিরদ্দিকে বেয়াই বাড়ি পাঠিয়ে এরফান মাতব্বর চলে যায় খুনের চর। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয়ার জন্য সে তার লোকদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে। এক এক দল পালা অনুসারে নদীর কিনারা দিয়ে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেবে। মাতব্বর নিজেও আস্তানা গাড়ে ভাওর ঘরে।

চর দখলের কিছুদিন পরেই বোরো ধানের রোয়া লাগানো হয়েছিল নদীর কিনারার কোনো কোনো জমিতে। নতুন মাটিতে ফসলের জোর দেয়া যায় খুব। কিছুদিন আগে আরো কিছু জমিতে লাগানো হয়েছে বোরা ধানের রোয়া। সেগুলোও সতেজ হয়ে উঠছে।

রোদ পোহাতে পোহাতে চরটার চারদিকে চোখ বোলায় এরফান মাতব্বর। সবুজের সমারোহ তার চোখ জুড়িয়ে দেয়। নতুন চর বলেই মনে হয় না তার কাছে। চর জাগার সাথে সাথে এমন ফসল ফলানো সম্ভব হয় না সব সময়। অপেক্ষা করতে হয় দু-এক বছর।

জমিরদ্দি খবর নিয়ে ফিরে আসে।

খবরটা সত্যি। বিশুগাঁওয়ের জমিদার রায়চৌধুরীরা এ তৌজির এগারো পয়সার মালিক। তাদের কাছ থেকে বন্দোবস্ত এনেছে জঙ্গুরুল্লা, তার লোকজন তৈরি হচ্ছে। জন পঞ্চাশেক চাকরিয়াও নাকি এনেছে সখিপুরার চর থেকে।

খবর শুনে মুখ শুকিয়ে যায় উপস্থিত পুলকি-মাতব্বর আর কোলশরিকদের। তাদের উদ্বেগভরা মুখের দিকে তাকিয়ে মাতব্বর বলে, ‘জমিতে ফসল দেইখ্যা চর দখলের লোভ অইছে। আহে যে চরের কাছে। আমারে চিনে না। আমি যখন থিকা মাতবর তখন জঙ্গুরুল্লার নাম-নিশানাও আছিল না।’

রুস্তম বলে, ‘হ, পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা এহন চদরী নাম ফুডাইছে।’

‘হ, মাইনষে যেমুন কয়–বাপ-বয়সে ঘোড়া না, লেজেতে লাগাম। তোমরা ঘাবড়াইও না। ওর চর দখলের খায়েশ মিডাইয়া দিমু।’

কিন্তু মুখে যত সাহসের কথাই বলুক, মাতব্বর মনে মনে শঙ্কিত হয়। মহাভাবনায় পড়ে সে। তার দলের বেশির ভাগ লোকই আনাড়ি। তারা লাঠিও ঘোরাতে পারে না ঠিকমত । ঘোরানোর চোটে যদি বো-বো আওয়াজই না ওঠে, তাকে কি লাঠি ঘোরানো বলে? মাত্র দশ বারোজন শড়কি চালাতে পারে, বেতের ঢাল দিয়ে নিজেদের বাঁচাবার কৌশল জানে। কিন্তু পেশাদার চাকরিয়াদের সামনে তারা ধরতে গেলে কুকুরের মোকাবেলায় মেকুর।

মাতব্বর বলে, ‘মেহের মুনশি চইল্যা যাও ট্যাংরামারি। ঐ জাগার আলেফ সরদার। আমার পুরান চাকইর‍্যা। বিশ-পঁচিশজন শাগরেদ লইয়া যেন তোমার লগেই আইয়া পড়ে। আর কদম চইল্যা যাও জাজিরার চর। গদু পালোয়নের পোলা মেঘু ওর বাপের মতোই মর্দ অইছে। ওরে আর ওর দলের পনেরো-বিশজন শড়কিদার লইয়া আইয়া পড়বা জলদি।’

একটু থেমে মাতব্বর আবার বলে, ‘আমাগ হাংগাল-বাংগালগুলারে লইয়া কি করি? এইগুলার আতে শড়কি দিতে ভস্‌সা পাই না। ওরা শড়কি আতে পাইলে বিপক্ষের মাইষের বুকের মইদ্যে হান্দাইয়া দিব। এই গুলার আতে দিতে অইব লাডি। কিন্তুক একজনও ঠিকমত লাডি চালাইতে পারে না।’

‘হ, ঠিকই কইছেন। একজনও ভাল কইর‍্যা লাডি চালাইতে হিগে নাই।’ বলে রমিজ মির।

‘ফজল, এক কাম কর। তুই লোনসিং চইল্যা যা। তুই না কইছিলি লোনসিংয়ের কে খুব ভাল লাডি খেইল শিখছে?’

‘হ, তুরফান।’ ফজল বলে। ‘আমার লগে নড়িয়া ইস্কুলে পড়তো। পুলিন দাসের এক শাগরেদের কাছে সে লাঠি খেলা শিখছে।’

‘পুলিন দাস আবার কে?’ আহাদালী জিজ্ঞেস করে।

‘পুলিনবিহারী দাস। বাড়ি লোনসিং। স্বদেশী আন্দোলনের বড় নেতা। এখন বোধ করি জেলে আছে।’

‘আমরা হুনছি, সে এত জোরে বোঁ-বোঁ কইর‍্যা লাডি ঘুরাইতে পারত, বন্দুকের ছা তার লাডির বাড়ি খাইয়া ছিট্যাভিট্যা যাইত, তার শরীলে লাগতে পারত না।’ মাতব্বর বলে। ‘ফজল গিয়া তুরফানরে লইয়া আয়। আমাগ হাংগাল-বাংগালগুলারে কয়ডা দিন লাডি খেলার তালিম দিয়া যাইব।’

‘আমি আইজই যাইতে আছি।’

‘হ, তোমরা কিছু মোখে দিয়া এহনই বাইর অইয়া পড়। যাইতে-আইতে পথে দেরি কইর‍্য না কিন্তুক।’

দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে তিনটা উড়োজাহাজ আসছে। বিকট আওয়াজ তুলে ওগুলো মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় উত্তর-পূর্ব কোণের দিকে।

এরফান মাতব্বর শুনেছে, সারা দুনিয়া জুড়ে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেছে। সে জিজ্ঞেস করে, ‘কোন মুলুকে যাইতে আছে এগুলা, জানোনি?’

‘মনে অয় আসাম মুলুকে যাইতে আছে।’ বলে জাবেদ লশকর।

উড়োজাহাজগুলো দূর-দিগন্তে মিলিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মাতব্বর তবুও চেয়ে আছে সেদিকে। ওগুলোর আওয়াজ যেন বাসা বেঁধেছে তার বুকের ভেতর। যেন লড়াইয়ের কাড়া নাকাড়া বেজে চলেছে সেখানে।

মাতব্বর শক্ত করে ধরে তার হাতের লাঠিটা। তার শিথিল বাহুর পেশি কঠিন হয়ে ওঠে। স্পষ্ট হয়ে ওঠে কোঁচকানো মুখের রেখাগুলো। ঘোলাটে চোখ দুটো ঝলকে ওঠে আক্রোশে।