ফজল বাড়ি যায় না। বাড়ি গেলেই তার বাবা হয়ত জেরা শুরু করবে, ‘রাত্রে কোথায় আছিলি? কাইল নায়েবের লগে অমুন কইর্যা কথা কইতে গেলি ক্যান্?’
সোজা খুনের চর চলে যায় ফজল। তাকে দেখে পুলকি-মাতব্বর আর কোলশরিকেরা কোলাহল করে ওঠে। যার যার ভাওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তারা। রমিজ মিরধা বলে, ‘কাইল আসুলিগ একখান খেইল দ্যাহাইয়া আইছ হোনলাম?’
জাবেদ লশকর : ‘এই মিয়া মাতবরের পো না খেললে কাইল চরের ইজ্জত থাকত না।’
ধলাই সরদার : ‘হোন্লাম আসুলিগ কোন বড় খেলুরে তুমি এমুন চিবি দিছিলা, চিবির চোডে হের জিব্বাডা বোলে সোয়া আত বাইর অইয়া গেছিল?’
ফজল : ‘আরে না মিয়া। এমন কথা কার কাছে শোনলেন?’
ধলাই সরদার : ‘যারা খেইল দ্যাখতে গেছিল তাগ কাছেই হুনছি।’
গতদিনের হা-ডু-ডু খেলার আলোচনায় মেতে উঠে সবাই। তাদের মুখে ফজল আর সোলেমানের খেলার তারিফ।
সবাই চলে গেলে ফজল নিজেদের ভাওর ঘরে গিয়ে ঘরের ঝাঁপ খোলে। তাদের গাবুর একাব্বর তার অনুপস্থিতিতে বেড়ের মাছ ধরে অন্যান্যদের সাথে তারপাশা গেছে মাছ বেচতে।
মাচানের ওপর হোগলা বিছানো রয়েছে। একপাশে রয়েছে ভাঁজকরা একটা কাঁথা। রাত্রে বারবার তাড়া খেয়েছে যে ঘুম, তা এসে বিছানাটার কোথাও লুকিয়ে রয়েছে যেন। তার অদৃশ্য হাতের আলতো পরশ অনুভব করে ফজল। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। সে কাঁথার তলা থেকে বালিশ টেনে নেয়। তারপর বিছানার ওপর ঢেলে দেয় সে তার ঘুমকাতর শরীরটাকে। কিন্তু বালিশের ওপর মাথা রাখতেই হঠাৎ চমকে ওঠে সে। লাফিয়ে ওঠে তড়াক করে।
হায়, হায়, হায়! কি সর্বনাশের মাথার বাড়ি! এখন উপায়? ফিরে যাবে নাকি সে শ্বশুরবাড়ি?
কিন্তু এখন গিয়ে কোনো লাভ নেই, ফজল ভাবে। এতক্ষণে কাছারি ঘরের বিছানাটা তোলা হয়ে গেছে। বালিশের তলায় রাখা খোঁপার কাঁটাটা নিশ্চয় পেয়ে গেছে রূপজান। কি কেলেঙ্কারিটা ঘটে গেল তার ভুলের জন্য।
রূপজান কি কিছু বুঝতে পারবে? বুঝতে না পারার কোনোই হেতু নেই। একটা মাত্র কাঁটা। কয়েকটা হলেও রূপজানকে ফাঁকি দেয়া যেত। সে নিজেই ভেবে আশ্বস্ত হতো, কাঁটাগুলো তারই জন্য এনে রেখেছিল ফজল দিতে ভুলে গেছে। এখন ওই কাঁটা বালিশের নিচে রাখার যে কোনো কৈফিয়তই নেই। তাছাড়া কাঁটাটা যার খোঁপার, সে ঐ বাড়িতেই রাত্রে ছিল। তার খোঁপায় নিশ্চয় রয়েছে ওটার মতো আরো কাঁটা।
ফজলের শিরা-উপশিরায় ঠাণ্ডা স্রোত ওঠা-নামা করছে।
খোঁপার কাঁটাটা সম্ভবত তারই পয়সায় কেনা। জরিনাকে এ রকম এক ডজন কাঁটা দিয়েছিল সে।
নিজের পয়সার কেনা কাঁটাটা এমন নিমকহারামি করল! দুশমনি করল! নাহ্, প্রাণহীন এ কাঁটাটার আর কী দোষ? দুশমনি করেছে জরিনা, সেই জাহান্নামের লাকড়িটা।
ফজল ভাবে, এ ঠিক পাপের শাস্তি। পাপ খাতির করে না পাপের বাপকেও। সে কবিরা গুনা করেছে। তার জন্য এখন কড়ায়-গণ্ডায় সুদে-আসলে জরিমানা দিতে হবে।
জরিনার জন্য ফজলের মনের কোটরে বাসা বেঁধেছিল অনেক স্নেহ-মততা, অনেক সহানুভূতি। কিন্তু এ মুহূর্তে রাগ ও বিতৃষ্ণার ঘূর্ণিঝড় উড়িয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে সে সব কোমল অনুভূতি। জরিনাকে সে মনে মনে গাল দেয়, বেহায়া ঢেম্নি মাগিডাই তো তারে ঠেইল্যা নামাইছে পাপের আঠাই দরিয়ায়। এখন কত যে চুবানি খাইতে অইব তার শুমার নাই।’
ফজল তার মনশ্চক্ষে দেখতে পায়–রূপজান ঝাঁটা মেরে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে জরিনাকে।
জরিনার জন্য আবার কেমন করে ওঠে ফজলের মন। তাড়া-খাওয়া মমতা আর সহানুভূতি মনের আশ্রয়ে ফিরে আসার জন্য পথ খোঁজে।
ফজল রূপকথার বইয়ে পড়েছিল— রাজপুত্র আর রাজকন্যার পেছনে ধাওয়া করছে এক দৈত্য। তার গতিরোধ করার জন্য রাজকন্যা ছুঁড়ে ফেলে দেয় তার মাথার চিরুনি। সেই চিরুনি থেকে সৃষ্টি হয় কাঁটার এক দুর্ভেদ্য জঙ্গল। জরিনার খোঁপার কাঁটাটাও বুঝি তার শ্বশুরবাড়ির চারদিকে সৃষ্টি করছে দুর্ভেদ্য কাঁটার বেড়া। সে বেড়া ভেদ করে সে কি রূপজানের কাছে যেতে পারবে আর?
‘ফজু কইরে?’
ফজলের চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যায়। পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে সে ঝুপড়ি থেকে বেরোয়। তার পিতার সাথে রয়েছে মেহের মুনশি, ধলাই সরদার আর জমিরদ্দি।
‘হোন্ ফজু, কোলশরিকগ খবর দিছি। এহনই আইয়া পড়ব। তুই ঘরের আড়ালে ছায়ার মইদ্যে হোগলা বিছাইয়া দে। বৈডক আছে আইজ।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই মাতব্বরের দলের লোকজন এসে হাজির হয় বৈঠকে।
এরফান মাতব্বর বলে, ‘হোন মিয়ারা, আল্লার ফজলে কাম পাকা-পোক্ত অইয়া গেছে। জমিদারের সেলামি দিয়া খাজনাপাতি দিয়া পরিষ্কার অইয়া আইছি। এহন এমুন কোনো ব্যাডা নাই যে চরের তিরিসীমানায় আউগ্গায়।’
আহাদালী বলে, ‘কত ট্যাহা খাজনা দিলেন, মাতবরচাচা?’
‘দেদার টাকা ঢাল্ছিরে বাপু। তোমার মতো মাইনষে গইন্যা শুমার করতে পারব না। এহন কও দেহি তোমরা, ক্যামনে ভাগ করতে চাও জমি?’
জমির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা চলে অনেকক্ষণ। অবশেষে মাতব্বরের প্রস্তাবই মেনে নেয় সকলে। চরটাকে মাঝ বরাবর লম্বালম্বি দু’টুকরো করে আটহাতি নল দিয়ে মেপে ভাগ করতে হবে। চরের মাঝখান থেকে নদীর পানি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে এক এক জনের জমি। অবস্থানের দিক দিয়ে সকলের জমিই এক ধরনের হবে। তাই উৎকর্ষের দিক দিয়েও জমিতে জমিতে বড় বেশি পার্থক্য থাকবে না।
ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা শেষ হলে এরফান মাতব্বর বলে, ‘আমি তো ফতুর অইয়া গেছি সেলামি আর খাজনা দিয়া। এইবার আমার সেলামির যোগাড় করো।’
‘নল পিছে কত কইর্যা সেলামি নিবেন মাতব্বরের পো?’ ধলাই সরদার জিজ্ঞেস করে।
‘আর সব মাতবররা যেই রহম নেয়।’
রুস্তম বলে, ‘আর সব মাতবররা তো ডাকাইত। তাগ মতন ধরলে আমরা গরিব মানুষ বাচমু ক্যামনে?’
কদম শিকারি সায় দিয়ে বলে, ‘মাতবরভাই, এট্টু কমাইয়া ধরেন।’
‘তাইলে তোমরাই কও, কত কইর্যা দিবা।’
রমিজ মিরধা বলে, ‘নল পিছে বিশ ট্যাহা করেন।’
‘বিশ টাকা! তোমাগ খায়েশ খানতো কম না! গত ছয় বচ্ছর খাজনা চালাইছি এই নাই চরের। তহন একটা আধা-পয়সা দিয়াও তো কেও সাহায্য করো নাই। এহন কোন আক্কেলে এমুন আবদার করো তোমরা?’
‘উপরে আল্লা আর নিচে আপনে আমাগ বাপের সমান। আপনের কাছে আবদার করমু তো কার কাছে করমু?’
‘তোমরা বিবেচনা কইর্যা কইও। চাইরশ বিশ আত দীঘল এক এক নল জমি। এক নলে কততুক জমি অয় ইসাব করছনি মেহের?’
‘হ, করছি। এই ধরেন সাড়ে দশ কাঠার মতন। কানির ইসাবে অয় দুই গণ্ডার কিছু বেশি। একরের ইসাবে সাড়ে সতেরো শতাংশ।’ মেহের মুনশি বলে।
‘এহন তোমরাই কও। সাড়ে দশ কাঠা জমির লেইগ্যা তিরিশ টাকাও দিবা না কেমুন কথা?’
জমিরদ্দি : ‘দিতাম মাতবরের পো। কিন্তুক চরের জমি, আইজ আছে কাইল নাই।’
ধলাই সরদার : ‘হ, হ, গাঙ্গে ভাঙ্গনের ডর না থাকলে তিরিশ ক্যান্, একশ ট্যাহাই দিতাম।’
এরফান মাতব্বর : ‘অইচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা পঁচিশ টাকা কইর্যা দিও। সবাই রাজি?’
সবাই রাজি হয়।
মাতব্বর আবার বলে, ‘হোন মিয়ারা, যারা আগে সেলামির টাকা দিতে পারব, তাগ ইচ্ছামতো, পছন্দমতো জমি দিয়া দিমু।’
ভাল সরেস জমি পাওয়ার আশায় সে-দিনই সেলামির টাকা নিয়ে এরফান মাতব্বরের বাড়ি হাজির হয় অনেকে। একদিনেই আদায় হয় সাত হাজার টাকা।
বহুদিন পরে এক সাথে অনেকগুলো টাকা হাতে পেয়ে মাতব্বরের মন খুশিতে ভরে ওঠে। তার বয়সের বোঝা হালকা মনে হয়। ভাটাধরা রক্তে অনুভূত হয় জোয়ারের পূর্বাভাস।
টাকা অনেকগুলো। কিন্তু টাকার কাজও রয়েছে অনেক। প্রথমেই ঋণ সালিশি বোর্ডের মীমাংসা অনুযায়ী দুই মহাজনের দেনার কিস্তি শোধ করতে হবে। তারপর যেতে হবে জণ্ড পোদ্দারের দোকানে। পুতের বউর বন্ধক-দেয়া গয়নাগুলো ছাড়িয়ে আনতে হবে। ফজুর মা’র দু’গাছা গয়নাও বন্ধক পড়ে আছে আজ দু’বছর। বাড়ির সবার জন্য কাপড়চোপড় কিনতে হবে। ঘাসি নৌকাটা মেরামত করা দরকার। পানসি গড়াতে হবে একটা। মাতব্বরির মান মর্যাদা বজায় রাখতে হলে পানসি একটা রাখতেই হয়। আগেও একটা পানসি ছিল মাতব্বরের। চর ভাঙার পর অভাবের সময় সেটা বেঁচে ফেলতে হয়েছিল।
পরের দিন। এরফান মাতব্বর হাশাইল বাজারে যায়। জগু পোদ্দারের দোকানে গিয়ে ছাড়িয়ে নেয় বন্ধক-দেয়া সবগুলো গয়না। পুতের বউর গলার হার, কানের মাকড়ি, হাতের চুড়ি আর অনন্ত। ফজুর মা’র গলার দানাকবচ আর কানের কর্ণফুল। এগুলো বন্ধক দিয়ে পাঁচশ টাকা নিয়েছিল সে। এখন সুদে আসলে দিতে হলো আটশ টাকা।
সুদ যে কেমন করে ব্যাঙের বাচ্চার মতো পয়দা হতে থাকে বুঝে উঠতে পারে না মাতব্বর। সে মনে মনে বলে, ব্যাডা পোদারের পুত কি দিয়া যে কি ইসাব করল, বোঝতেই পারলাম না। ফজলরে সঙ্গে আনা উচিত আছিল। ও ইসাবপত্র বোঝে ভাল।
কাপড়চোপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা শেষ করে এরফান মাতব্বর নৌকায় গিয়ে ওঠে। তাদের গাবুর একাব্বর নৌকা ছেড়ে দেয়।
মাতব্বর বলে, ‘সোজা নলতা মোল্লাবাড়ি চইল্যা যা। আইজ বউ না লইয়া বাড়িত যাইমু না।’
ভাটি পানি। তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। গয়নার পুটলিটার ওপর হাত বুলাতে বুলাতে এরফান মাতব্বর মনে মনে বলে, ‘আইজ দ্যাহাইয়া দিমু আরশেদ মোল্লারে। ও বিশ্বেস করে নাই আমার কথা। মনে করছে ওর মাইয়ার গয়না আর ছাড়াইতে পারমু না। আইজ দশটা চউখ উধার কইর্যা আইন্যা দেখবি, যেই গয়না বন্দক দিছিলাম, তা বেবাক ছাড়াইয়া আনছি। দেহি, এইবার তুই আমার পুতের বউ কোন ছুতায় আটকাইয়া রাখস।’
আরশেদ মোল্লা নিজের ও গরুর গা ধোয়ার জন্য নদীতে নেমেছিল। দুটো বলদ ও একটা গাইকে গলাপানিতে দাঁড় করিয়ে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে সে ওদের গা ঘষামাজা করছিল। হঠাৎ একটা উদলা নৌকার ওপর তার চোখ পড়ে। নৌকাটা তার বাড়ির দিকে আসছে আর ওতে বসে আছে এরফান মাতব্বর।
আরশেদ মোল্লা তাড়াতড়ি একটা ডুব দিয়ে আধা নাওয়া গরুগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে যায় বাড়ির দিকে।
ভেজা কাপড়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মোল্লা তার স্ত্রীকে ডাকে, ‘কইগো রূপির মা, আমার লুঙ্গি আর নিমাডা দ্যাও দেহি জলদি।’
‘এত জলদি কিয়ের লেইগ্যা? মাইর করতে যাইব নি?’
‘আগো চুপ করো। রূপজান কই?’
‘নাইতে গেছে।’
‘হোন, এরফান মাতব্বর আইতে আছে।’
‘কুড়ুম আইতে আছে ভাল কথা। পুরান কুড়ুমের কাছে যাইতে আবার সাজান-গোছন লাগবনি?’
‘দুত্তোরি যা!’ বিরক্ত হয়ে মোল্লা ভিজা কাপড়েই ঘরে যায়। লুঙ্গি বদলে নিমাটা গায়ে চড়িয়ে সে বেরিয়ে আসে। স্ত্রীকে বলে, ‘হোন, মাতবর আমার কথা জিগাইলে কইও, দিঘিরপাড় হাটে গেছে।’
‘ক্যান্? কুড়ুমের ডরে উনি পলাইতে আছে নি?’
‘পলাইতে আছি তোমারে কে কইল? হোন, আমার মনে অয় মাতবর আইতে আছে তোমার মাইয়া নিতে। আমি থাকলেই তক্কাতক্কি অইব। জোরাজুরি করব মাইয়া নেওনের লেইগ্যা। আমি বাড়ি না থাকলে আর জোরাজুরি করতে পারব না। তুমি কইও, উনি বাড়ি নাই। খালি বাড়িরতন মাইয়া দেই ক্যামনে?’
‘কই গেলেন বেয়াইসাব?’ এরফান মাতব্বরের গলা।
আরশেদ মোল্লা খাটো গলায় বলে, ‘ঐ যে আইয়া পড়ছে! আমি গেলাম।’
আরশোদ মোল্লা বাড়ির পেছন দিক দিয়ে সটকে পড়ে।
‘বেয়াইসাব কই?’ আবার হাঁক দেয় এরফান মাতব্বর। ‘আরে–আরে–আরে! গরুতে ক্যালার ড্যামগুলা খাইয়া ফালাইল। কই গেলেন মোল্লাসাব?’
এরফান মাতব্বর তার হাতের লাঠি উঁচিয়ে ‘হেঁই হাঁট-হাঁট’ করে গরুগুলোকে তাড়া দেয়।
রূপজানের মা সোনাভান ওরফে সোনাইবিবি মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে আসে গরু বাঁধবার জন্য।
‘আসলামালেকুম বেয়ানসাব। কেমন আছেন?’
‘আল্লায় ভালই রাখছে।’
‘মোল্লাসব কই?’
‘উনি হাট করতে গেছে দিঘিরপাড়।’
‘হাট করতে গেছে! তয় এই মাত্র গরু নাওয়াইতে দ্যাখলাম কারে?’
‘হ উনিই। ঐ পুবের বাড়ির তারা হাটে যাইতে আছিল। তাই ত্বরাত্বরি গিয়া ওঠছে তাগো নায়। গরু বান্ধনেরও অবসর পায় নাই।’
সোনাইবিবি গরু বাঁধবার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু গরুর শিং নাড়া দেখে সে ভয়ে পিছিয়ে আসে। তার মাথার ঘোমটা পড়ে যায়, নাকের দোলায়মান সোনার চাঁদবালিটা চিকমিকিয়ে ওঠে।
মাতব্বর বলে, ‘আপনে পারবেন না। আমি আমার গাবুররে ডাক দিতে আছি। ওরে একাব্বর, এই দিগে আয়। গরুগুলারে গোয়ালে বাইন্দা রাখ।’
মাতব্বর বেঠকখানায় গিয়ে চৌকির ওপর বসে। তার প্রশ্ন এড়িয়ে অন্দরে চলে যেতে পারে না সোনাইবিবি। সে অন্দরমুখি দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে মাতব্বরের সাথে কথা বলছে।
‘বউমা কই, বেয়ান সাব?’
‘নাইতে গেছে।’
‘আইজ বউমারে নিতে আইছি। একটা মাত্র পুতের বউ আমার। বউ বাড়িতে না থাকায় বাড়ি-ঘর আমার আন্দার অইয়া রইছে।’
‘আপনেরা আমাগ মাইয়ার মোখ্খান যে আন্দার কইর্যা থুইছেন হেই কথাতো কন্ না। মাইয়ার গয়নাগুলারে বেবাক–’
‘গয়নার কথা কেন? এই দ্যাহেন, বেবাক গয়না ছাড়াইয়া আনছি।’
গয়নার পুটলিটা উঁচু করে দেখায় মাতব্বর। তারপর আবার বলে, ‘বউমারে ডাক দ্যান। তার গয়না তার আতে বুঝাইয়া দিমু আইজ।’
কিছুক্ষণ পর রূপজান আসে। শ্বশুরের কদমবুসি করে সে দাঁড়ায় তার কাছে।
মাতব্বর বলে, ‘তোমার এই বুড়া পোলার উপরে রাগ অইয়া রইছ মা? এই দ্যাহো।’ মাতব্বর গয়নার পুটলি খোলে। ‘এই নেও মা, তোমার গলার হার। নেও, গলায় দ্যাও। শরম কিয়ের?’
হারটা গলায় পরে রূপজান।
‘আর এই ধরো কানের মাড়িজোড়া। কানে দ্যাও মা, কানে দ্যাও। তুমি তো জানো মা, কেমুন বিপাকে পইড়া গেছিলাম। তা না অইলে কি আমার মা-র গয়না বন্দক দেই আমি? কানে দিছ মা? হ্যাঁ এইতো এহন কেমুন সোন্দর দেহা যায় আমার মা-লক্ষ্মীরে।’
একজোড়া অনন্ত ও ছয়গাছা চুড়িসহ পুটলিটা রূপজানের দিকে এগিয়ে দিয়ে মাতব্বর আবার বলে, ‘এই নেও মা। কিছু থুইয়া আহি নাই। বেবাক ছাড়াইয়া আনছি। আর দ্যাহো, কেমুন চকমক-ঝকমক করতে আছে। সবগুলারে পালিশ করাইয়া আনছি।’
রূপজানের গয়না পরা হলে মাতব্বর বলে, ‘এইতো এহন আমার মা-র মোখ্খান হাসি খুশি দ্যাহা যায়। আর এই নেও শাড়ি। দ্যাহো কী সোন্দর গুলবদন শাড়ি। যাও মা শাড়ি পিন্দা তোমার মা-র কদমবুসি করো গিয়া। আর জলদি কইর্যা তৈয়ার অইয়া নেও।’
সোনাইবিবি দরজার আবডালে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলে, ‘কর্তা বাড়িতে নাই। খালি বাড়িরতন মাইয়া দেই ক্যামনে?’
‘কর্তা নাই, কর্তানি তো আছে। যান বেয়ানসাব, বউমারে সাজাইয়া-গোজাইয়া দ্যান।’
‘উনি বাড়ি না আইলে তো মাইয়া দিতে পারমু না।’
‘উনি কোন সুম আইব, তার তো কোনো ঠিক নাই!’
‘হ, হাটে গেছে, আইতে দেরি অইব। আপনে আর একদিন আইয়েন।’
‘আর একদিন আর আইতে পারমু না। আইজই বউ লইয়া বাড়িত যাওন চাই। এইখানে এই পাড়া গাইড়া বইলাম আমি। যান, খাওনের যোগাড় করেন। পালের বড় মোরগাড়া জবাই করেন গিয়া।’
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা। কিন্তু এখনো বাড়ি ফিরে এল না আরশেদ মোল্লা। চৌকির ওপর শুয়ে বসে বিরক্তি ধরে গেছে এরফান মাতব্বরের। অস্বস্তিতে ছটফট করে সে। এর মধ্যে রূপজান তামাক সাজিয়ে দিয়ে গেছে বার কয়েক। প্রত্যেক বারই তাকে জিজ্ঞেস করেছে মাতব্বর, ‘কি মা, তোমার বাজান আইছে?’
অধৈর্য হয়ে ওঠে রূপজানও। সে বার বার ছাঁচতলায় গিয়ে নদীর দিকে তাকায়। কিন্তু তার বাজানকে দেখা যায় না কোনো নৌকায়। তার ব্যাকুলতার কাছে হার মানে লজ্জা সঙ্কোচ। সে মা-কে বলে, ‘মা, বাজান এহনো আহেনা ক্যান?’
‘উনির আহন দিয়া তোর কাম কি?’
‘দ্যাহো না, মিয়াজি যাওনের লেইগ্যা কেমুন উতলা অইয়া গেছে।’
‘তোর মিয়াজি উতলা অইছে, না তুই উতলা অইছস?’
লজ্জায় মাথা নত করে রূপজান। মেয়ের দিকে চেয়ে মায়ের মন ব্যথায় ভরে ওঠে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে।
রূপজানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে বলে, ‘আমি আর কী করতে পারি, মা। তোর বাপ বেবুঝ, গোঁয়ার। আমার কোনো কথা কানে লয় না।’
‘যেই গয়নার লেইগ্যা আমারে আটকাইছে, হেই গয়না তো বেবাকই দিছে আবার। বাজান বাড়িত থাকলে যাইতে মানা করত না। তুমি মিয়াজিরে কও আমারে লইয়া যাইতে।’
‘কোন্ ডাকাইত্যা কথা কস, মা। উনির হুকুম ছাড়া তোরে যদি এহন যাইতে দেই, তয় কি আমারে আস্ত রাখব! কাইট্যা কুচিকুচি কইর্যা গাঙে ভাসাইয়া দিব না!’
‘যদি যাইতে না দ্যাও, তয় গয়নাগুলা রাখবা কোন মোখে? এগুলা ফিরাইয়া দেই?’
‘ফিরাইয়া দিবি ক্যান্? উনি বাড়িত আহুক। ওনারে বুঝাইয়া-সুজাইয়া তোরে পাড়াইয়া দিমু একদিন।’
এরফান মাতব্বর মাগরেবের নামাজ পড়েও অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু আরশেদ মোল্লার আসার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না তার। মনের এ সন্দেহ তার আরো দৃঢ় হয়। সে বুঝতে পারে, আরশেদ মোল্লা তাকে দেখে পালিয়েছে। সুতরাং সে যতক্ষণ এ বাড়িতে আছে ততক্ষণ মোল্লা কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না।
মাতব্বর এশার নামাজ পড়ে বাড়ি রওনা হয়। যাওয়ার সময় বেয়ানকে বলে যায়, ‘গয়নার লেইগ্যা মাইয়া আটকাইছিল। সবগুলো গয়না বুঝাইয়া দিছি। এইবার ভালমাইনষের মতন আমার পুতের বউরে যে আমার বাড়ি দিয়া আহে।’