মোল্লাবাড়ির একমাত্র জামাই ফজল। শ্বশুরবাড়ির আদর-আপ্যায়নের মাত্রাটা তাই একটু বেশিই জুটত তার ভাগ্যে। তার আগমনে উৎসব শুরু হয়ে যেত মোল্লাবাড়ি। শ্বশুর-শাশুড়ি ব্যস্ত হয়ে উঠত–মুরগি জবাই করোরে, গুঁড়ি কোটরে, পিঠা বানাওরে! সে যে কত পদের পিঠা। কখনো বানাত পাটিসাপটা, বুলবুলি, ভাপা, কখনো বানাত ধুপি, চন্দ্রপুলি, চিতই, কখনো বা পাকোয়ান, শিরবিরন, বিবিখানা। চালের গুঁড়ি কুটে পিঠা বানাতে বানাতে রাতদুপুর হয়ে যেত। সে পিঠা তৈরির আসর আনন্দমুখর হয়ে উঠত গীত-গানে, কেচ্ছা-শোলকে।

সাত-আট মাস আগেও একবার শ্বশুরবাড়ি এসেছিল ফজল। সেবারও উৎসব লেগে গিয়েছিল মোল্লাবাড়ি। জামাইয়ের আদর-যত্নের কোনো রকম ত্রুটিই হতে দেয়নি শ্বশুর-শাশুড়ি। ফজল দু’দিন ছিল সেখানে। শালা-শালীরা তাকে ঘিরে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ছিল দুদিন। ঠাট্টা-মশকরা, হাসি-হুল্লোড়ে তারা ভরে দিয়েছিল তার মন-প্রাণ।

আজও এ বাড়িতে পা দেয়ার পর শালা-শালীরা ছুটে এসেছিল। এসেছিল কলরব করতে করতে, ‘দুলাভাই আইছে, দুলাভাই আইছে!’

শালা-শালীরা হৈ-চৈ করতে করতে তাকে ভেতরবাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। বেঁকি বেড়ার কাছে পৌঁছতেই শোনা যায় শ্বশুরের গলা, ‘অ্যাই দেলা, অতিথরে কাছারি ঘরে নিয়া বইতে দে।’

অন্দর থেকে ছেলে-মেয়েদের লক্ষ্য করে ধমক ছাড়ে সে আবার, ‘অ্যাই পোলাপান, কিয়ের এত চিল্লাচিল্লি? বান্দরের খেইল আইছে, আঁ? যা, ঘরে যা শিগগির।’

ধমক খেয়ে সুড়সুড় করে চলে গিয়েছিল সবাই। তারপর আর একজনও আসেনি তার কাছে। যে দেলোয়ার এত আগ্রহভরে তাকে নিয়ে এল, তার মুখের হাসিও মিলিয়ে যায়। ফজল বুঝতে পারে, তার এ বাড়িতে আসায় খুশি হয়নি শ্বশুর। কিন্তু কেন? তার বাবা রূপজানের গয়না বন্ধক দিয়েছে সে জন্য? রূপজান তো চিঠিতে লিখেছিল, শ্বশুরের রাগ তার ওপরে নয়। কেন সে লিখেছিল এমন কথা? আর তাকে আসতেই বা লিখেছিল কেন এত মিনতি করে? কেন দেলোয়ারকে পাঠিয়েছিল হাটে-বাজারে তাকে খুঁজতে?

রূপজানকে দেখার জন্য ব্যাকুল বাসনা রয়েছে তারও মনে। রূপজানের আকুল আহ্বান না পেলে তার সে বাসনা পথ খুঁজে পেত না। আসত না সে এ বাড়ি। দেলোয়ার হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে যায় কাছারি ঘরে। রূপজান কোন ঘরে কি করছে জানতে ইচ্ছে হয়েছিল ফজলের। কিন্তু জিজ্ঞেস করা আর হয়ে ওঠে না। সে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে।

মোরগের ক্ব-ক্ব চিৎকার শোনা যায়। খোপ থেকে মোরগ টেনে বার করছে কেউ।

মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুৎ চমকের মতো আনন্দ খেলে যায় ফজলের মনে। সে ভাবে, মোরগ জবাই করার আয়োজন হচ্ছে যখন তখন তার অনাদর হবে না নিশ্চয়।

অন্দরে শ্বশুরের গলা শোনা যায় আবার, ‘মোরগ ধরছে ক্যাডারে?’

কেউ উত্তর দিল কিনা শোনা গেল না।

শ্বশুর আবার বলে, ‘রাইতের বেলা ঘুমের মোরগ লইয়া টানাটানি শুরু করছে কাঁ? আল্লা রাইত দিছে ঘুমানের লেইগ্যা। ঘুমের পশু-পক্ষীরে কষ্ট দিলে আল্লার গজব পড়ে।’

মোরগের ক্ব-ক্ব আর শোনা যায় না। খোপের মোরগ খোপেই চলে গেছে, বুঝতে পারে ফজল।

আবার মেঘ জমে তার মনে। বাড়ি চলে যাওয়ার কথা ভাবে সে। কিন্তু এত রাত্রে নৌকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে অবাঞ্ছিত মুসাফিরের মতো একা বসে থাকে কাছারি ঘরে।

এর আগে যতবার সে এ বাড়িতে এসেছে প্রত্যেক বারই শ্বশুর-শাশুড়ি হাসিমুখে এগিয়ে এসেছে। সেও তাজিমের সাথে তাদের কদমবুসি করেছে। তাকে ভেতরবাড়ি নিয়ে গিয়ে তারা জিজ্ঞেস করেছে সকলের কুশল-বার্তা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছে জমাজমি আর ফসলাদির খবরাখবর। আজ তাদের আলাঝিলাও দেখতে পায়নি সে। তাই কদমবুসি করার সুযোগও হয়নি। দেলোয়ার হারিকেন দিয়ে সেই যে গেছে আর একবারও আসেনি তার কাছে। সে এলে তাকে সাথে করে সে অন্দরে গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির কদমবুসি করে আসতে পারত।

ঢুকুর-ঢুক্ আওয়াজ আসছে ঢেঁকির। ধান ভানার শব্দ। দ্রুততালের মৃদু শব্দ হলে বোঝা যেত পিঠের জন্য চালের গুঁড়ি কোটা হচ্ছে। ঢেঁকিটা যে রকম বিলম্বিত তালে ওঠা-নামা করছে তা থেকে সহজেই বুঝতে পারে ফজল, ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে শুধু একজন। রূপজান নয় তো!

ফজল উঠে অন্দরমুখী দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার চোখ দুটো খুঁজে বেড়ায় একটি মুখ। কিন্তু কোনো ঘরের খিড়কি-জানালা দিয়েই সে মুখ দেখা যায় না। ঢেঁকিঘরে কোনো খিড়কি নেই। সেখানে আছে কিনা কে জানে? পশ্চিমভিটি ঘরের বারান্দায় শুধু দেলোয়ারকে দেখা যায়। সে স্কুলের পড়া তৈরি করছে বোধ হয়।

নিঃশব্দ পায়ে ফজল সেদিকে এগিয়ে যায়। জানালার পাশে গিয়ে নিচু গলায় ডাকে, ‘দেলু।’

‘জ্বী।’

‘তোমার বু’ আছে এই ঘরে?’

‘না।’

‘ঢেঁকিঘরে আছে?’

‘উঁহু, সে পাকের ঘরে, মা-র লগে রানতে লাগছে।’

‘মিয়াজি কোন ঘরে?’

‘উত্তরের ঘরে।’

‘আমারে নিয়া চলো দেখি, মিয়াজিরে সেলাম কইর‍্যা আসি।’

দেলোয়ারের পেছনে পেছনে উত্তরভিটি ঘরে ঢোকে ফজল।

আরশেদ মোল্লা বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিল। শব্দ পেয়ে সে মাথা তুলে তাকায়।

‘আস্‌লামু আলাইকুম।’ ফজলের সশ্রদ্ধ সালাম।

আরশেদ মোল্লা সালামের জবাব দেয় না।

কদমবুসি করার জন্য ফজল তার পায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই সে পা গুটিয়ে বসে পড়ে। হাত নেড়ে বলে, ‘উঁহু উঁহু দরকার নাই। এই পাও ধরলে লাভ অইব না। যাও নিকারি-কৈবর্তের পায়ে ধর গিয়া। দুইডা পয়সা উৎপন্ন অইব।’

ধক করে ওঠে ফজলের বুক। তার মুখ কালো হয়ে যায়। সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সেখানে। কাছারি ঘরে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে চৌকির ওপর।

এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে কুয়াশা। তার মাছ বেচার কথা জেনে ফেলেছে শ্বশুর। আর এ জন্যই এ বাড়িতে উল্টো হাওয়া বইছে আজ।

আর একদণ্ড এ বাড়িতে থাকা চলে না। ফজল বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে। নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালে হয় তো ধরতে পারবে কোনো নৌকা।

কাছারি ঘর থেকে বেরিয়ে কিছু দূর গিয়েই সে থমকে দাঁড়ায়। তার কুঁকড়ে-যাওয়া মন হঠাৎ চিড়বিড়িয়ে ওঠে–এভাবে চুপিচুপি চোরের মতো কেন যাবে সে? এটা তো মরদের কাজ নয়। সে কি চুরি-ছ্যাচড়ামি করেছে, না ডাকাতি বাটপাড়ি করেছে। সে করছে হালাল রুজি। এতে শ্বশুরের রাগ হওয়ার কি আছে? তার রাগের মাখা তামুক কে খেতে চায়? শুধু একজন রাগ না হলেই হয়। সে যদি বাধ্য থাকে তবে কারো তোয়াক্কা সে করে না। আজই–এই রাতেই রূপজানের সাথে বোঝাপড়া করবে সে।

সে কাছারি ঘরে ফিরে এসে দেখে দেলোয়ার খাবার আনতে শুরু করেছে।

আগে ভেতর বাড়িতেই তার খাবার দেয়া হতো। সামনে বসে পরিবেশন করত শাশুড়ি, নয় তো রূপজান। আজকের অবস্থা বিবেচনা করে এ ব্যবস্থায় আশ্চর্য হয় না সে।

তার খিদে নেই তেমন। বেশি মিষ্টি খেয়ে তার মুখটা কেমন বাই-বাইতা করে। পেটের ভেতরেও কেমন বেতাল ভাব। ঝাল তরকারি দিয়ে দুটো ভাত খেলে হয়তো সে ভাবটা কেটে যেত। কিন্তু এ বাড়ির তেতো আবহাওয়ায় তার খাবার ইচ্ছে একেবারেই মরে গেছে। তবুও সে খেতে বসে। কিছু না খেলে আবহাওয়াটা হয়তো আরো তেতো, আরো বিষাক্ত হয়ে উঠবে।

কৃষক পরিবারের নিত্যকার খাবার ডাল, ভাত, মাছের সালুন। কোনো বিশেষ পদ তৈরি হয়নি জামাইয়ের জন্য। ফজল নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুটো মুখে দিয়ে খাওয়া শেষ করে।

দেলোয়ার মিষ্টিও নিয়ে আসে। তারই আনা মিষ্টি। ফজল বলে, ‘মিষ্টি এত খাইছি আইজ! প্যাডের মইদ্যে মিষ্টির চর পইড়া গেছে। ওগুলা লইয়া যাও।’

মিষ্টি খেয়ে দেলোয়ারেরও একই অবস্থা। তাই আর সাধাসাধি না করে সে মিষ্টির থালা নিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই সে কথা-বালিশ এনে ধপাৎ করে ফেলে চৌকির ওপর।

শব্দটার প্রতিশব্দ হয় ফজলের বুকের ভেতর।

দেলোয়ার বিছানা পেতে দিয়ে চলে যায়। ফজল কাঁথা আর বালিশটার দিকে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে।

আগে শ্বশুরবাড়ি এলে তার শোয়ার ব্যবস্থা হতো অন্দরের কোনো নিরালা ঘরে। সেখানে থাকত পাশাপাশি দুটো বালিশ। দোসরহীন বালিশটা যেন মুখ লুকিয়ে কাঁদছে আজ।

ফজল বসে বসে বিড়ি টানে। তার নাক আর মুখ দিয়ে গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরোয়। তার বুকের ভেতর জ্বলছে যে ক্ষোভের আগুন, এ যেন তারই ধোয়া।

সে উঠে পায়চারি করে এদিক-ওদিক। ঢেঁকিঘর থেকে এখনও ধানভানার শব্দ আসছে।

হারিকেনের আলো যথাসম্ভব কমিয়ে দিয়ে অন্দরমুখি দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় ফজল। উত্তর ও পশ্চিমভিটি ঘরে বাতি জ্বলছে।

কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে দুটো বাতিই নিবে গেল। তাকে উপহাস করে যেন মুখ লুকাল অন্ধকারে।

ফজল দরজা দুটোয় খিল লাগিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। হাত বাড়িয়ে হারিকেনটা নিবিয়ে দেয়।

একটা সম্ভাবনা হঠাৎ উঁকি দেয় তার মনে। সে উঠে পড়ে। অন্ধকার ঘর অন্ধের মতো হাতড়াতে হাতড়াতে গিয়ে সে অন্দরমুখি দরজাটার খিল খুলে রেখে আসে।

সম্ভাবনাটা তার অন্তরের উমে রূপান্তরিত হয় নিশ্চিত বিশ্বাসে। আর সে বিশ্বাসের ওপর ভর দিয়েই চলে তার প্রতীক্ষা।

কিন্তু আসছে না কেন রূপজান? এখনো কি সবাই ঘুমোয়নি? ভারাভানুনি এখনো ধান ভানছে ঢেঁকি ঘরে। বোধহয় তার জন্যই আসতে পারছে না।

ঢেঁকিটা যেন কিছু বলছে। কি বলছে? ফজল শুনতে পায়–ওটা বলছে, ‘আসি গো আসি, আসি গো আসি।’

রাত অনেক হয়েছে। ঢেঁকির শব্দ আর শোনা যায় না। ফজল অধীর প্রতীক্ষায় এ-পাশ ও-পাশ করে।

এখনও দেরি করছে কেন রূপজান? ঘুমিয়ে পড়েনি তো?

‘উঁহু কিছুতেই না।’ মনে মনে বলে সে। ‘চউখের দেখা দেখনের লেইগ্যা পরান যার ছটফট করে, তার চউখে কি ঘুম আইতে পারে?’

তার মনে হয়, রূপজান জেগেই আছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না বেরুবার।

সে বিছানা ছেড়ে খালি পায়ে ঘর থেকে বেরোয়। পা টিপে টিপে পশ্চিম ভিটি ঘরের দক্ষিণ পাশের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে হয়তো এ ঘরেই শুয়ে আছে রূপজান।

আধ-ভেজানো জানালার ফাঁক দিয়ে সে তাকায় ভেতর। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে সব একাকার। তার দৃষ্টি হারিয়ে যায় সে অন্ধকারে। সে মৃদু শিস দেয় বারকয়েক। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।

ফজলের মনে হয় রূপজান এ ঘরে নেই। থাকলে জেগেই থাকত সে। এ অন্ধকারেও তার নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যেত। আর হয়তো পাওয়া যেত রেশমি চুড়ির মিষ্টি রিনিঠিনি আওয়াজ।

উত্তরভিটি ঘরেই তাহলে শুয়েছে রূপজান। কিন্তু সে ঘরের বারান্দায় থাকে শ্বশুর। সে-দিকে যেতে তাই সাহস হয় না তার। নিরাশ মনে কাছারি ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য সে পা বাড়ায়। এমন সময় শোনা যায় হালকা আওয়াজ—টুক-টুক-টুক। কাঠ বা অন্য কিছুর ওপর টোকা দেয়ার শব্দ।

আনন্দ-শিহরণে কেঁপে ওঠে তার সমস্ত শরীর। সে তাড়াতাড়ি টিনের বেড়ায় আঙুলের টোকা দেয় তিনবার। কোনো সাড়া না পেয়ে সে আবার টোকা দেয়। কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কিন্তু প্রত্যাশিত ঠকঠক আওয়াজ আর শোনা যায় না।

তার মনে সন্দেহ জাগে–এ কি রূপজানের সঙ্কেত? না আর কিছু শব্দ? টিকটিকির শিকার ধরে আছাড় মারার শব্দ নয়তো?

জানালাটা আরো একটু ফাঁক করার জন্য সে একটা পাট ভেতরের দিকে ঠেলে দেয় আর অমনি ক্রুদ্ধ আওয়াজ শোনা যায়, ‘কোঁ-ওঁ-ওঁ।’

সে লাফ দিয়ে পিছিয়ে যায় ভয়ে। তার এক পায়ে কাঁটা ফুটে যায় কয়েকটা। কাঁটাযুক্ত শুকনো ডালটা সে টান দিয়ে খুলে ফেলে। একটা কাঁটা বোধহয় ভেঙে রয়েই গেল।

আচমকা ভয়ে পিছিয়ে গেলেও সাথে সাথেই ফজল বুঝতে পেরেছিল, ক্রুদ্ধ আওয়াজটা একটা উমে-বসা মুরগির। সে আবার জানালার কাছে ফিরে যায়। দৃষ্টি ফেলে ঘরের ভেতর। এবারেও কিছুই ধরা দেয় না চোখে।

তাকে চমকে দিয়ে আবার সেই আওয়াজ হয়–ঠুকঠুকঠুক। কিন্তু সেই সাথে শোনা যায় চিঁও চিঁও ডাক। ডিম ফুটে মুরগির বাচ্চা বেরুচ্ছে।

ঠুক-ঠুক শব্দটা কিসের এতক্ষণে ধরতে পেরেছে ফজল। হতাশায় ভারাক্রান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে সে ফিরে যায় কাছারি ঘরে। কলসিতে রাখা অজুর পানি দিয়ে পা ধুয়ে সে শুয়ে পড়ে।

কাঁটাটা বড় যন্ত্রণা দিচ্ছে পায়ে। বরই কাঁটা বোধ হয়। তাই এত ব্যথা করছে। এটা খুলতে না পারলে ঘুম আসবে না আজ। ফজল উঠে হারিকেন ধরায়। কিন্তু কি দিয়ে খুলবে কাটা? নখ দিয়ে সরু করা ম্যাচবাতির কাঠি দিয়ে সে খোঁচায় চামড়ার ওপর। কিন্তু চার পাঁচটা কাঠি ধ্বংস করেও কাঁটার নাগাল পাওয়া যায় না।

কিসের সামান্য একটু শব্দ শুনে মাথা তোলে ফজল। একটা পাটশলা পুবদিকের জানালা দিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। বাঁ হাতে পাটশলাটা ধরে সে জানালার দিকে তাকায়। একটা হাত আবছায়ার মতো সরে গেল।

ফজলের মনের বীণায় আনন্দের সুর বেজে ওঠে। আর সেই সুরের সাথে নেচে ওঠে তার দেহের সমস্ত অণু-পরমাণু।

মনের উল্লাস গোপন করে সে হাসিমাখা মুখে চেয়ে থাকে জানালার দিকে। অনুচ্ছ স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলে, ‘এত রাইতে আর রংটং করণ লাগব না। আসনের ইচ্ছা থাকলে আইসা পড় শিগগির। দেরি করলে কিন্তু কপাটে খিল লাগাইয়া থুইমু।’

জানালা থেকে দরজার দিকে চোখ ফেরাবার সময় তার নজর পড়ে হাতের পাটশলার দিকে। ওটার আগায় একটা সাদা বেলোয়ারি পুঁতি। পুঁতিটা ধরতেই পাটশলাটার ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসে একটা খোঁপার বেলকুঁড়ি কাঁটা।

আনন্দের সুর ছাপিয়ে হঠাৎ বেজে ওঠে করুণ সুর। তার মনের গহনে সমাহিত একটা পুরাতন স্মৃতি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ঠিক এমনি একটা খোঁপার কাঁটা দিয়ে তার পায়ের কাঁটা তুলে দিয়েছিল জরিনা।

সারদা আইনের বছর। বাংলা ১৩৩৬ সাল। সবার মুখে এক কথা–আইন পাশ হয়ে গেলে ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদি দেয়া মুশকিল হবে। তাই বিয়ের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল দেশে। সদ্যোভূমিষ্ঠ অনেক ছেলে-মেয়েরও বিয়ে হয়েছিল সে সময়। দুই পেটের অজাতশিশুর বিয়ের ঘটকালির নজিরও নাকি আছে প্রচুর। সেই সময়ে ফজলের সাথে বিয়ে হয়েছিল জরিনার। ফজলের বয়স তখন এগারো আর জরিনার দশ। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই জরিনা হাতে-পায়ে বেড়ে উঠল। তার সারাদেহে নেমে এল যৌবনের ঢল। আর ফজলের তখন গোঁফের রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তারপর একদিন। ফজল তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র কয়েকদিন বাকি। রাত জেগে পড়া তৈরি করছিল সে। জরিনা ঐ সময়ে ঢুকে পড়েছিল তার পড়ার ঘরে। তার খোঁপা থেকে বেলকুঁড়ি খুলে সে ফজলের পায়ের কাঁটা তুলে দিয়েছিল। কাঁটা তোলার সময় তার পা-টা ছিল জরিনার কোলের ওপর। আর ঐ অবস্থায় তাদের দেখে ফেলেছিল ফজলের বাবা।

গুরুতর ভাবনায় পড়ে যায় এরফান মাতব্বর। তার মনে হয় সেয়ানা বউটা নষ্ট করে ফেলবে তার আবাত্তি ছেলেটাকে। ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবে। আর ওকে দূর না করলে ছেলের পড়াশুনা একেবারেই হবে না। ছেলে বই সামলাবে, না বউ সামলাবে?

কয়েকদিনের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করে ফেলে এরফান মাতব্বর। জরিনাকে আবার বিয়ে দিতে যে খরচ লাগবে সে বাবদ কিছু টাকা সে জরিনার ভাইয়ের হতে গুঁজে দেয়। তারপর একদিন ফজলকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে খেজুরগাছ-কাটা চকচকে ধারালো দা হাতে নিয়ে মাতব্বর গর্জে ওঠে, ‘অ্যাদে ফউজ্যা, ছ্যান দেখছস? তালাক দে, কইয়া ফ্যাল–তিন তালাক বায়েন। তেড়েংবেড়েং করলে তিরখণ্ড কইর‍্যা ফালাইমু।’

নিতান্ত নিরুপায় ফজল উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়েছিল, ‘তিন তালাক বায়েন।’

সেদিনই রাগে দুঃখে ফজল বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। নিরুদ্দেশ হয়ে ছিল তিন মাস। সেই থেকে তার লেখা-পড়ারও ইতি ঘটেছিল।

স্মৃতিটাকে নির্মম শক্তিতে দাবিয়ে দেয় ফজল। আজকের এ আনন্দঘন মুহূর্তে একে কোনো রকম প্রশ্রয় দিতে রাজি নয় তার মন। মৃত অতীত মনের গহ্বরে চাপা পড়ে থাক। পড়ে থাক গহন অন্ধকারে।

খোঁপার কাঁটাটা দিয়ে ফজল পায়ের কাঁটাটা তুলে ফেলে। আর ওটা তুলবার সময় ছলছল করে তার চোখ দুটো।

খোঁপার কাঁটাটা দিয়ে পালালো কোথায় রূপজান? সে নিশ্চয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে আলো জ্বলছে, তাই বোধ হয় সে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।

ফজল হারিকেনটা নিবিয়ে দেয়। ঘুমের ভান করে সে পড়ে থাকে বিছানায় আর মাঝে মাঝে বালিশে চিবুক রেখে দৃষ্টি ফেলে অন্ধকারে অদৃশ্য ভেজানো দরজার ওপর।

সময় এগিয়ে চলছে। চলছে ফজলের মনের ওপর দিয়ে আশা-নিরাশার মই টেনে। বারবার মাথা তুলতে গিয়ে তার ঘাড়ে ব্যথা ধরে গেছে। ক্লান্ত হয়েছে চোখ দুটো।

ফজল অস্থির হয়ে ওঠে। চঞ্চল হয় রক্তস্রোত শিরা-উপশিরায়। নিজেকে সে আর বিছানায় ধরে রাখতে পারে না। সে উঠে বসে। মনে মনে ভাবে–রূপজান তো এমনিতেই লজ্জাবতী লতা। এতদিনের অসাক্ষাতে লজ্জার মাত্রাটা হয়তো আরো বেড়ে গেছে। তাকে দেখলে লজ্জায় দৌড় মারবে নাতো সে? নাহ, তাকে কোনো মতেই পালাবার সুযোগ দেয়া যায় না। সে বাইরমুখি দরজার খিল নিঃশব্দে খুলে নিশ্চুপে বেরিয়ে যায়। কাছারি ঘরের পশ্চিম পাশ দিয়ে গিয়ে বেঁকিবেড়ার আড়াল থেকে সে উঁকি মারে। নাহ! রূপজানের আলাঝিলাও দেখা যায় না উঠানে। তবে কি সে কাছারি ঘরের পুবপাশে আছে? পুবদিকের জানালা দিয়েই তো সে পাটশলাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।

ফজল উঠান পার হয়ে ঢেঁকিঘরের উত্তরপাশ ঘুরে পুবপাশ দিয়ে আলগোছে পা ফেলে এগিয়ে যায়।

একটু দূরেই কাছারি ঘরের পুব পাশে ঘন অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তির আভাস পাওয়া যায়।

হ্যাঁ, ঐ তো রূপজান বসে রয়েছে। তাকে দেখে পালিয়ে যাবে নাতো আবার! এত চোখপলানি খেলা ভালো লাগে না তার।

ফজল পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়। কিন্তু রূপজান নড়ছে না তো একটুও! নড়লে আন্দোলিত হতো কালো অন্ধকার। বোধ হয় কাছারি ঘরের দিকে চোখ তার। তাকে ঘর থেকে বেরুতে দেখেনি তো? দেখলে সে এরকম নিশ্চুপ বসে থাকত না। উঠে দাঁড়াত অন্তত।

ফজল নিঃশব্দে এগিয়ে যায়, পেছন থেকে বেঁধে ফেলে তাকে দুই বাহুর আবেষ্টনীতে।

মূর্তিটি গা মোচড়ামুচড়ি করে। দুহাত দিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করে নিজেকে।

‘আরে এমুন করতেছ ক্যান্?’

ফজল তাকে পাজাকোলা করে নেয়। চুমোয় চুমোয় ভরে দেয় তার ঠোঁট, দুটি গাল। নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করছে না আর সে এখন।

ফজল তাকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। নিবিড় করে বুকে টেনে নিতে নিতে ফিসফিস করে সে বলে, ‘বাপের বাড়ির ভাতে রস নাই? কেমুন হুগাইয়া গ্যাছ মনে অইতাছে!’

‘এই কি! কাঁপতে আছ ক্যান্ তুমি?’ কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে ফজল।

প্রেমিকের বুকের সাথে আরো নিবিড় হয়ে মিশে যায় প্রেমিকা। নরম হাত দিয়ে গলা জাপটে ধরে তার। কিন্তু তবুও তার কাঁপুনি থামে না, কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে।

ফজল তার গালে চুমো এঁকে দিয়ে বলে, ‘কথা কওনা ক্যান, আঁ? তোমারে কি ডরে ধরছে? কিসের ডর আঁ? এত রাইতে আর কেও জাগব না। আর জাগলেই বা কি। আমি কি অন্য মাইনষের বউ লইয়া হুইয়া রইছি?’

একটু থেমে আবার সে বলে, ‘আইজ ভারি কষ্ট দিছ। খোঁপার কাঁটাডা দিয়া আবার পলাইয়া রইছিলা ক্যান, আঁগো? কি, মুখ বুইজ্যা রইছ যে! একবারও তো জিগাইলা না, কেমুন আছি?’

এবারও কোনো জবাব পায় না ফজল। বুকের সাথে এক হয়ে মিশে যেতে চাইছে যেন তার প্রিয়া। তার গলায় মুখে সে চুমো দিচ্ছে বারবার।

ফজলের চঞ্চল রক্ত আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে। সারা দেহে জাগে পুলক-শিহরণ। তার ডান হাত কাপড়ের জঞ্জাল সরিয়ে অবতরণ করে প্রিয়ার দেহভূমিতে।

কিন্তু এরকম লাগছে কেন? এ কোন চরে নেমেছে সে? তাকে কি কানাভুলায় পেয়েছে? পথ ভুলিয়ে নিয়ে এসেছে অন্য চরে?

সন্দেহ জাগতেই হাতের পাঁচটি খুদে অনুচর একজোট হয়ে জরিপ করতে লেগে যার চরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।

তাইতো! এ চরটা তো তার পরিচিতি নয়! এর আকার-আয়তন চড়াই-উত্রাই, হালট ঢালট, খাঁজ-ভাঁজ তার অচেনা।

ফজল এবার স্পষ্ট বুঝতে পারে এ রূপজান নয়। সে বলে ওঠে, ‘কে? কে তুমি?’

কোন জবাব পাওয়া যায় না। তার মুখের ভাষা যখন মুক, তখন তার দেহের ভাষা মুখর হয়ে উঠেছে। তার অঙ্গে অঙ্গে সার্বজৈবিক ভাষার কলরব।

ফজলের ব্যস্ত হাতটি বালিশের তলা থেকে ম্যাচবাতি বের করে। সে কাঠি খুলে ধরাতে যাবে অমনি একটা হাতের ঝটকা খেয়ে তার হাত থেকে ম্যাচবাতিটা ছিটকে পড়ে যায়। কাঠিগুলো শব্দ করে ছড়িয়ে যায় মেঝের ওপর। তার হতভম্ব হাতটি অন্য একটি হাতের আমন্ত্রণে ফিরে যায় কিছুক্ষণ আগের পরিত্যক্ত জায়গায়।

দুটি কবোষ্ণ ঠোঁট ফজলের ঠোঁটে গালে সাদর স্পর্শ বুলায় বার-বার। তার সারা দেহে সঞ্চারিত হয় বাসনা-বিদ্যুৎ। রক্তে জাগে পরম পিপাসা।

শয্যাসঙ্গিনী তাকে অনাবৃত বুকের ওপর টেনে নেয়। ফজল বাধা দেয় না বরং এগিয়ে দেয় নিজেকে। সে ভুলে যায় ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়। ভুলে যায় নিজের নাম পরিচয়। এ মুহূর্তে তার কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই। এখন সে শুধু একটি পুরুষ। তার দেহ অতিথি হয়েছে যে দেহের, তা শুধুই একটি রমণীর। তারও কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই। এ মুহূর্তে পরিচয়ের কোনো প্রয়োজনও বোধ করে না তারা। দুটি নর-নারী। আদিম রক্তবাহী দুটি দেহ। রক্ত-মাংসের অমোঘ দাবির কাছে তারা পরাজয় মানে। এক দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সাথী খুঁজে পায় অন্য দেহে। তারা মগ্ন হয় উচ্ছল আলাপনে, এক হয়ে দোলে তরঙ্গের দোলায়।

কালো রাত্রি তখন চোখ বুঁজে প্রহর গুনছে।

ফজল লুঙ্গিটা খুঁজে নিয়ে কোমরে জড়ায়। শুয়ে থাকে বিছানার এক পাশে। কি রকম একটা অশুচিতায় ছেয়ে গেছে তার আপাদমস্তক। পাপ-চিন্তায় বিব্রত তার মন।

সে সন্তর্পণে চৌকি থেকে নামে। নিঃশব্দে মেঝে হাতড়িয়ে বেড়ায় অন্ধকারে। কিছুক্ষণ খোঁজার পর ম্যাচবাক্সটা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় একটা কাঠিও। সে শিয়রের কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঠিটা ধরায়।

চিৎ অবস্থায় শায়িত তিমির-সঙ্গিনী হকচকিয়ে ওঠে। সে মুখ ঢেকে ফেলে এক হাতের দাবনায়। অন্য হাতে আঁচল টেনে বুক ঢাকে, ঠিকঠাক করে বেশবাস।

এক হাতে জ্বলন্ত কাঠিটা ধরে ফজল অন্য হাত দিয়ে তার মুখের ওপর থেকে জোর করে হাতটা সরিয়ে দেয়।

‘কে! কে!! জরিনা! জরু! জরু!!’

পলাতক অতীত ফিরে আসে। সাত বছরের বিচ্ছেদ-প্রাচীর ডিঙিয়ে সে অতীত আশ্রয় খোঁজে বর্তমানের বুকে। ফজল নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সে জ্বলন্ত কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বিছানায় উঠে সে নিবিড় করে জরিনাকে বুকে টেনে নেয়। সে বুকের ভেতর তোলপাড় করছে আবেগ ও বেদনার বাষ্প।

পুঞ্জীভূত বেদনা গুমরে মরছে জরিনারও বুকের ভেতর। সেই বুকের দ্রুত ওঠা-নামা অনুভব করতে পারে ফজল। রুদ্ধ কান্না বক্ষপঞ্জর ভেদ করে বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইছে।

সে পরম স্নেহে জরিনার পিঠে, মাথায় হাত বুলায়। বেদনার্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, ‘জরিনা–জরু–জরু, তুমি এই বাড়িতে কবে আইছ? ক্যান আইছ?’

জরিনা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার চোখের পানিতে ফজলের কাঁধ ভিজে যায়।

ফজল শঙ্কিত হয়। এখনই হয় তো গলা ছেড়ে কেঁদে উঠবে জরিনা। সে শাড়ির এক অংশ টেনে নিয়ে তার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘জরিনা, লক্ষ্মীসোনা কাইন্দ না। চলো তোমারে আউগ্যাইয়া দিয়া আসি।’

জরিনা আরো নিবিড় করে ফজলের গলা জড়িয়ে ধরে। তার ফোঁপানির শব্দ আরো স্পষ্টতর হয়।

‘জরু, জরু, অবুঝের মতো কইর‍্য না। কেও টের পাইলে কেলেঙ্কারি অইয়া যাইব।’

ফজল তাকে টেনে তোলে। বাহুবেষ্টনীতে বেঁধে, মাথায় মুখে সস্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে তাকে সে সামনের দরজায় নিয়ে যায়। তারপর দরজা খুলে একরকম জোর করেই তাকে বের করে দেয় সে।

জরিনা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ফজল দাঁড়িয়ে থাকে খোলা দরজার মুখে। তার এক হাতে ছিল স্নেহ-প্রীতির স্নিগ্ধ পরশ। আর অন্য হাতে? অন্য হাতে ছিল নিরেট নিষ্ঠুরতা। সে নিষ্ঠুরতা এখন শত হাতে তার বুকে আঘাত হানছে। আঘাতে আঘাতে বেদনার বাষ্প গলে দরদর ধারায় তার দুগাল বেয়ে পড়তে থাকে।

নিকষ কালো অন্ধকার। জরিনা পা টিপে টিপে ফিরে আসে ঢেঁকিঘরে। বলতে গেলে গেরস্তের ঢেঁকিঘরই তার আশ্রয় আজকাল। ঢেঁকিই তার অন্নদাতা।

মেঝেতে মাদুর একটা বিছানোই ছিল। সে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। সে চোখের পাতা বন্ধ করে। আর সাথে সাথেই সক্রিয় হয়ে ওঠে তার মনের চোখ। সে চোখের পাতা নেই। সে চোখ বন্ধ করা যায় না। সে চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতীতের দৃশ্যপট। পটের নিশ্চল ছবিগুলো আবার চলতে শুরু করে একের পর এক।

একটি মেয়ে। বয়স তার দশ হবে কি হবে না। তাকে ঘিরে বসে গীত গাইছে বোন বেয়ান-ভাবির দল, ‘এমন সোন্দর বইনডি আমার পরে লইয়া যায়।’

নতুন বাক্স ভরে আসে নতুন শাড়ি-সেমিজ, সোনা-রূপার নতুন গয়না। চাচি-ফুফু খালারাও আসে। তাকে তারা সাজায় মনের মতো করে। আসে সাক্ষী-উকিল। তারা কবুল আদায় করে, শরবত দেয়।

পরের দিন ভোর বেলা। পালকি আসে উঠানে। মেয়েটিকে কোলের ওপর নিয়ে বসে আছে তার দাদি। কারা সব বলে, ‘যাও, কোলে কইরা লইয়া যাও দেহি কেমনতরো জুয়ান। যাও, নিজের জিনিস, শরম কি?’

কৌতূহলী মেয়েটি টান দিয়ে সরিয়ে ফেলে বিরক্তিকর লম্বা ঘোমটাটা। একটা ছেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ছেলেটি তারই বয়সী বা তার চেয়ে বড়জোর বছর খানেকের বড় হবে। রেশমি আচকান তার পরনে। মাথায় ঝলমলে জরির টুপি।

দাদির কোল থেকে তাকে তুলবার চেষ্টা করে ছেলেটি। মেয়েটি তাকে হাতের ঝটকায় সরিয়ে দেয়।

হো-হো-করে হেসে ওঠে উঠানভর্তি লোকজন।

আবার আসে ছেলেটি। আবার তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সে। দাদি তার কানে কানে বলে, ‘যাও সোনাবইন। আল্লার নাম লইয়া পালকিতে গিয়া ওড।’

‘পালকিতে! এতক্ষণ কও নাই ক্যান্। বারে কি মজা!’

মেয়েটি দাদির কোল থেকে ঝটকা মেরে বেরিয়ে এক দৌড়ে গিয়ে ওঠে পালকিতে। হাসি আর হাততালির হট্টগোল ওঠে চারদিক থেকে।

ছেলেটি পালকিতে ওঠে। বসে মেয়েটির মুখোমুখি হয়ে। পালকি চলে। সুর করে সারি গাইতে গাইতে চলছে বেহারারা—

আল্লা—হা ব-লো

জোরে—হে চ-লো,

বিয়া খাইয়া বল অইছে

জোরে—হে চ-লো,

ইনাম মিলব দশ টাকা

হুঁশে—হে চ-লো,

সামনে আছে কলই খেত

কোনা—হা কা-টো।

পায়ের তলে মান্দার কাঁটা

দেইখ্যা হাঁ-টো।

বিয়েটা যে কী ব্যাপার, স্পষ্ট কোনো ধারণাই ছিল না জরিনার। বিয়ের দিনের ঘটনা নিয়ে কতজনে কত ঠাট্টা করত তাকে।

আর স্বামী কাকে বলে তা-ও কি সে জানত তখন! একটা ছবি মনে ভাসতেই হাসি পায় তার।

ঈদের দিন। ফজল আসে তাদের বাড়িতে। আসে ঠিক নয়। নতুন বাচ্চা জামাইকে সাথে করে নিয়ে আসে তার বাবা। পাশাপাশি খেতে বসে সে ও ফজল। পরিবেশন করে তার মা। ফজলের পাতের দিকে আড়চোখে চেয়ে গাল ফুলিয়ে উঠে পড়ে জরিনা। বলে, ‘আর এক বাড়ির এক ছ্যামড়া আইছে। তারেই কেবুল বেশি বেশি দিতে আছে।’

জরিনার মা চোখ রাঙায়, ‘এই জরিনা, চুপ।’

‘চুপ করমু ক্যান্? ওরে আমার রাঙা মোরগার কল্লাডা দিছ, রান দিছ। আর আমারে দিছ দুইডা আড্‌ডি।’

‘এই মাইয়া! ছি! ছি!’ চোখ রাঙায় তার মা।

ফজল নিজের থালা থেকে রানটা তুলে দেয় জরিনার থালায়।

জরিনা আবার ফুঁসে ওঠে, ‘ইস! আর একজনের পাতের জুডা খাইতে বুঝিন আক্ কইর‍্যা রইছি আমি।’

রাতে শয্যাগত বুড়ি দাদি পাশের ঘর থেকে টিপ্পনি কাটে, ‘বিয়ার দিনতো আ কইর‍্যা আছিলি। আধা গেলাশ শরবত হেঁচার মতন এক চুমুকে গিল্যা ফালাইছিলি! নিজের পুরুষের জুডা খাইতে ঘিন্না কিলো আঁ?’

পরে দাদি তাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে অনেক কথা বলেছিল, অনেক উপদেশ দিয়েছিল। কি যে সব বলেছিল তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি তখন। তারপরেও তারা দু’জন একসাথে খেলেছে—চোখপলানি, নলডুবি, ঝগড়া করেছে, মারামারি করেছে। তাদের কাণ্ড দেখে হেসেছে বাড়ির লোকজন, আত্মীয়-প্রতিবেশী।

ফজল ও জরিনা বেড়ে ওঠে। সেই সাথে বেড়ে ওঠে তাদের লজ্জা আর সঙ্কোচ। শেষ হয় একসাথে খেলাধূলা। ফজলকে দেখলেই জরিনার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে সলাজ হাসি। সে দৌড়ে পালায়। ফজলের হাস্যোজ্জ্বল চোখ দুটো পিছু ধাওয়া করে তার।

কিন্তু লজ্জা ও সঙ্কোচ যত বাড়তে থাকে তত বাড়তে থাকে একজনের প্রতি আর একজনের আকর্ষণ।

পনেরোয় পা দিয়ে জরিনা গায়ে-গতরে বেড়ে ওঠে লকলকিয়ে। জরিনার শ্বশুর এরফান মাতব্বর চিন্তিত হয়। কারণ মেয়ের অনুপাতে ছেলে বড় হয়নি। আর ফজল তখন স্কুলে পড়ে। এ সময়ে বউয়ের আঁচলের বাও যদি ছেলের গায়ে লাগে একবার, তবে কি আর উপায় আছে? লেখাপড়া একেবারে শিকেয় উঠে যাবে।

জরিনার বাবা-মা তখন মারা গেছে। তার ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে এরফান মাতব্বর। ঠিক হয়–ফজল ম্যাট্রিক পাশ না করা পর্যন্ত জরিনা ভাইয়ের বাড়িতে থাকবে। সেখানে ফজলও যেতে পারবে না। শুধু উৎসব-পরবে তারা দু-একদিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসা করতে পারবে। ফজল দিঘিরপাড় স্কুলে পড়ত। তার স্কুলে যাওয়ার পথে পড়ত শ্বশুরবাড়ি। তাকে সে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো আট মাইল দূরের নড়িয়া হাই স্কুলে। তার জন্য জায়গিরও ঠিক হলো সেখানের এক বাড়িতে।

কিছু ফুল যখন পাপড়ি মেলে তখন মধুকর টের পায়। দীর্ঘ পথের বাধা-বিঘ্ন তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। তুচ্ছ মনে হয় কাটার ভয়।

জরিনা পাশ ফিরে শোয়। স্মৃতি-কোঠার দরজা খুলে যায় আবার। দুপুর বেলা। দাওয়ায় বসে একটি তরুণী ফুল-সুপারি কাটছে। হঠাৎ শোনা যায় হট্টিটির ডাক–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট, টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট।

বাড়ির পেছনে লটাবন নদীর কিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডাকটা আসছে সেদিক থেকে। সে ছাঁচতলা গিয়ে দাঁড়ায়। আবার শোনা যায়–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট। এ ডাকের অর্থ জানে একমাত্র সে-ই। সে বোঝে–একটা হট্টিটি ডাকোছে তার হট্টিটিনীকে।

সে উঠানে আসে। ভাবি সরষে ঝাড়ছে। ওজন করছে ভাই। সরষে বেচতে হাটে যাবে সে। তাদের চোখের সামনে থেকে জরিনা একটা ভরা বদনা তুলে নেয়। ইচ্ছে করেই একটু পানি ফেলে দেয় ছলাৎ করে। তারপর ছাঁচতলা দিয়ে সে চলে যায় লটাবনে।

অনেকক্ষণ পরে সে ফিরে আসে। আঁচলের তলায় লুকিয়ে নিয়ে আসে ঝকঝকে নতুন এক ডজন বেলকুঁড়ি কাঁটা।

জরিনা তার খোঁপায় হাত দেয়। সেই খোঁপার কাঁটার চার-পাঁচটা এখনও টিকে আছে। টিকে আছে এক রাতের এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে।

ঘটনা নয়, দুর্ঘটনা। আর তার জন্য দায়ী তার দুঃসাহস।

ফজল পরীক্ষায় পড়া নিয়ে ব্যস্ত। সে সময়ে তার পড়ার ঘরে ঢুকেছিল সে। অত রাত্রে শ্বশুর যে আবার দেখে ফেলবে, কে জানত? কিন্তু কি অন্যায় দেখেছিল সে? কাঁটা তুলতে দেখেছিল ফজলের পা থেকে। এই টুকুইতো!

জরিনা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে। তার মুদিত চোখের পাতা বেঁধে রাখতে পারে না অশ্রুর প্লাবন।

অনেক আলোর আশীর্বাদ নিয়ে, শিশিরের স্নেহ নিয়ে বেড়ে উঠেছিল একটি লতা। তাতে ফুটেছিল ফুল যার বুকে ছিল আশার পরাগ, পাপড়ি-পাতায় রঙিন স্বপ্ন। ঐ রাতের দুর্ঘটনায় উৎপাটিত হলো সে লতা। তারপর যে মাটিতে পুঁতে দেয়া হলো তার শিকড়, তাতে না আছে সার না আছে রস।

হেকমতের চেহারা চোখে ভাসতেই তার সমস্ত সত্তা বিতৃষ্ণায় ভরে যায়। ঘৃণায় কুঁচকে যায় সারা শরীর। হেকমত চোর। সে সিঁদ কেটে চুরি করে। বিয়ের মাস খানেক পরেই চুরির মালসহ ধরা পড়ে সে। তার জেল হয় তিনবছর। খালাস হয়ে আসার কিছু দিন পরেই আবার তার খোঁজ পড়ে। তারপর থেকেই সে ফেরার। চৌকিদার-দফাদারের চোখ এড়িয়ে সে ক্বচিৎ কখনো আসে। একদিনের বেশি থাকে না। কিন্তু তার আসা না আসা সমান কথা জরিনার কাছে। শীতের মেঘের কাছে কে প্রত্যাশা করে বৃষ্টি?

বৃষ্টি নেই, ছায়া নেই এমনি এক মরুভূমি যেন জরিনার জীবন। উদগ্র পিপাসা বুকে নিয়ে ছটফট করছিল সে বছরের পর বছর। আজ মরুর আকাশে হঠাৎ মেঘ দেখে আকুলি-বিকুলি করছিল তার চাতক-মন। সে আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে। এ মেঘ যে তার পরিচিত।

জীবনে একমাত্র ফজলের সাথেই হয়েছিল তার অন্তরঙ্গ পরিচয়। সে-ই তার জীবনের প্রথম পুরুষ। বিকাশোম্মুখ সে পুরুষটি এখন পূর্ণবিকশিত। সে লাভ করেছে পূর্ণ যৌবন। যেমন হয়েছে সে দেখতে সুন্দর, তেমনি হয়েছে বলিষ্ঠ। তার অঙ্গে প্রত্যঙ্গে শক্তির সজীবতা। আজকের সান্নিধ্যের অপূর্বতায় তা স্পষ্ট অনুভূত। এর কাছে হেকমত কি? সে একটা অপদার্থ পুরুষ। তার যৌবন নেই, আছে শুধু যৌবনের পায়তারা যা শুধু হাস্যকর নয়, অসহ্য। তার কোমরে লুঙ্গির প্যাঁচে গোঁজা থাকে একটা সোডার পুটলি সব সময়। পিত্তশূলের ব্যথা উঠলেই এক খাবলা মুখে দিয়ে সে মরার মতো পড়ে থাকে বিছানায়।

জরিনা চোখ মেলে। ফিকে জোছনায় জমাট অন্ধকার তরল হয়েছে কিছুটা। বিছানায় পড়ে থাকতে আর ভাল লাগে না তার। সে উঠে টেঁকির ওপর গিয়ে বসে কাতলা হেলান দিয়ে।

এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক পানি ঝরিয়েছে তার চোখ। এখন কিছুটা শান্ত হয়ে সে অনুভব করতে পারে, তার অন্তরের বেদনার সাথে মিশে আছে আজকের সফল অভিসারের আনন্দ। তখনই তার সারা দেহ-মনে নতুন করে সঞ্চারিত হয় তৃপ্তির অনুভূতি। সুখের আবেশে ঢেঁকির কাতলা দুটোকে সে জড়িয়ে ধরে দুহাতে। এই মুহূর্তে সব কিছুই তার কাছে আপন মনে হয়। এই নিঝ্‌ঝুম রাত্রিকেও মনে হয় একান্ত আপন।

মনের আঁধারে বাসনার চামচিকেটা আবার পাখা মেলতে চায়। তাকে আর আটকে রাখতে পারছে না জরিনা। সে ঝাঁপ সরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়।

কৃষ্ণা নবমীর চাঁদ পূর্বদিগন্ত ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেকদূর। ক্ষয়িষ্ণু প্রতিবেশীর আগমনে সচকিত হয়ে উঠেছে আকাশের লক্ষ কোটি তারা। হয়ত বা বিদ্রুপের হাসি হাসছে। ঝিরঝিরিয়ে বইছে শরতের স্নিগ্ধ বাতাস। যেন ঘুমন্ত পৃথিবীর নিশ্বাস-প্রশ্বাস।

মোহময়ী এ রাত। এমন লজ্জাহারিণী আশ্রয়দায়িনী রাতটা পলে পলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এমন প্রীতিময়ী রাত তার জীবনে আর আসবে না কোনো দিন। এ রাতের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।

জরিনা সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে উঠানের দিকে পা বাড়ায়। এ রাতের একটি মুহূর্তকণাও সে বিফলে যেতে দেবে না।

উঠানে পা দিয়েই তার দৃষ্টি হঠাৎ থমকে যায়। একটা ছায়ামূর্তি–নারীমূর্তি ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে কাছারি ঘরের দিকে। ভেজানো দরজা ঠেলে মূর্তিটা ঢুকে পড়ে ঘরে। তার খিল এঁটে দেয়ার অস্পষ্ট শব্দ বিকট আঘাত হানে জরিনার বুকে। তার আহত আশা আক্রোশে কাঁপে, ফণা বিস্তার করে।

সে ঢেঁকিঘরের বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর একপা-দু’পা করে এগিয়ে যায় কাছারি ঘরের দিকে। পশ্চিম পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পুব দিকের জানালা দিয়ে চাঁদের ক্ষীণ আলোর রেশ এসে পড়ছে ঘরের ভেতর। ঘরের ঘন অন্ধকার তাতে হালকা হয়েছে কিছুটা।

জরিনা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নিশ্চুপে। ফিকে অন্ধকার ভেদ করে দৃষ্টি চলে তার। স্পষ্ট দেখা যায় না কিছুই শুধু রেখাচিত্র, ছায়া-অভিনয়। অস্পষ্ট ছবিগুলো তার কল্পনার তুলিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার শিরা-উপশিরায় দ্রুত আনাগোনা করে একটা উষ্ণ প্রবাহ। রোমাঞ্চিত হয় তার সারা অঙ্গ। তার চোখ নেমে আসে আপনা থেকেই।

জরিনা ঢেঁকিঘরে ফিরে আসে। তার বুকের মধ্যে অশান্ত চামচিকের পাখা ঝাঁপটানি। কিছুতেই ওটা থামছে না। সে রান্নাঘরে গিয়ে ঢকঢক করে পানি খায়। পানি দিয়ে যেন ভিজিয়ে দিতে চায় চামচিকের অস্থির ডানা দুটো। কিন্তু থামাতে পারছে না।

সে বিছানায় শুয়ে ছটফট করে। আবার উঠে গিয়ে মাথায় পানি দেয়। সারা দেহে অসহ্য দাবদাহ। এ দাহ কিসে শান্ত হবে?

অনেকক্ষণ কেটে গেছে। রাত আর বেশি নেই। নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ায় জরিনা । এগিয়ে চলে যন্ত্রচালিতের মত। কাছারি ঘরে গিয়ে বসে চৌকির পাশে।

ফজল বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। অন্ধকারের আবরণে ঢাকা তার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জরিনা। হাত বুলায় তার কপালে, মাথায়। ঘুমের ঘোরে ফজল হাত বাড়ায় তার দিকে। হাতটা তুলে নেয় জরিনা। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ফজল ডাকে, ‘রূপজান, রূপজান।’

জরিনা তার মাথা রাখে ফজলের বুকে। হঠাৎ ফজলের ঘুম ভেঙে যায়।

‘আমার রূপজান!’

জরিনা সাড়া দেয় না। ফজল ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। অনুচ্চ স্বরে বলে, ‘ও তুমি! আবার আইছ! তুমি নিজে তে জাহান্নামে যাইবাই, আমারেও নিয়া ছাড়বা।’

একটু থেমে আবার বলে, ‘জরিনা, তুমি অন্যের বউ। তোমার গায়ে আমার আঙুলের একটু ছোঁয়া লাগলেও পাপ অইব।’

জরিনা তার পায়ে মাথা কুটতে থাকে। ফজল পা সরিয়ে নেয়। সে উঠে দাঁড়ায়, জরিনাকে টেনে তোলে। বলে, ‘জরিনা যাও। আর কোনো দিন আইও না। তুমি আর আমার কেউ না।’

‘কেউ না!’ অস্ফুট কথা জরিনার আর্তনাদের মতো শোনায়। সে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

জরিনা চলে গেছে। সে আর কেউ নয় ফজলের। তবুও এমন হাহাকার করে উঠছে কেন, ব্যথায় ভরে উঠছে কেন তার বুকের ভেতরটা?

এ হাহাকার, এ ব্যথা কখন থামবে, কিসে থামবে?

ফজল ভাবে, রূপজান কাছে থাকলে এ হাহাকার উঠবে না আর। দূর হবে মনের সব দুঃখ-ব্যথা।

ভোর হতে না হতেই ফজল কাদিরকে ডেকে আনে পাশের বাড়ি থেকে। বলে, ‘তোমার বু’রে লইয়া যাইতে চাই। মিয়াজিরে গিয়া কও।’

‘দুদু কি রাজি অইব?’

‘রাজি অইব না ক্যান্? তোমার বু’তো আমার লগে যাওনের লেইগ্যা তৈয়ার।’

কাদির বাড়ির ভেতর যায়। ফিরে আসে অল্পক্ষণ পরেই। আরশেদ মোল্লা যা বলেছে, কাদির এসে কোনো রকম ঢাকা-চাপা না দিয়ে তাই বলে, ‘দুদু কয়, মাইয়ার গয়নাগুলা তো বেইচ্যা খাইছে বেবাক। আবার শুরু করছে মাছ-বেচা। এই জাউল্যা বাড়ি আমার মাইয়া দিমু না।’

‘দিব না কি করব? মাইয়াখান সিন্দুকে ভইরা রাখব? তোমার দুদুরে কইও, একদিন এই জাউল্যা ভাগাইয়া লইয়া যাইব ভদ্রলোকের মাইয়ার। তখন ইজ্জত লইয়া টান পড়ব, কইয়া রাখলাম আমি। এখন চলাম। তোমার ডিঙি দিয়া আমারে দাত্রার চরে নামাইয়া দিয়া আসো।’

‘দেরি করেন দুলাভাই, নাশতা খাইয়া–’

‘উঁহু। তুমি জলদি ডিঙি লইয়া ঘাটে আসো।’