» » একুশ

বর্ণাকার

জেল থেকে খালাস পেয়ে ফজল বাড়ি আসে। তাকে নিয়ে এক মাল্লাই কেরায়া নৌকা যখন বাড়ির ঘাটে পৌঁছে তখন সন্ধ্যার আর বেশি দেরি নেই।

নৌকা থেকে নেমেই সে পিতার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নূরু ও আমিনা তাকে নৌকা থেকে নামতে দেখে ছুটে এসে তার পেছনে দাঁড়ায়। খবর পেয়ে বরুবিবি বিলাপ করতে শুরু করে। ফজল বাপের মরণ দেখতে পায়নি আবার বাপও মরণকালে ছেলেকে দেখতে পায়নি–এ দুঃখ এখনো তার বুকের ভেতর আছাড়ি-পিছাড়ি খায়।

ফজল কবর জিয়ারত শেষ করে মৃত পিতার উদ্দেশে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘বা’জান, আপনের অকালে মরার জন্য জঙ্গুরুল্লা আর আরশেদ মোল্লা দায়ী। আমাগ চর, আমাগ হক-হালালের জমি জঙ্গুরুল্লা অন্যায়ভাবে দখল করছে। এই চর আমি দখল করমুই করমু। আপনে দোয়া কইরেন। আরশেদ মোল্লা মিথ্যা মামলায় আমারে পুলিস দিয়া ধরাইয়া দিছে। এর উপযুক্ত শাস্তি তারে দিমুই দিমু। আপনে দোয়া কইরেন।’

নূরুর দিকে তাকিয়ে ফজল বলে, ‘নূরু, তুই মেহের মুনশির কানে কানে কইয়া আয়–আমি আইছি। সে যেন রমিজ মিরধা ও কোলশরিকগ লইয়া মাগরেবের পর চুপচাপ আইসা পড়ে।’

সন্ধ্যার পর পুলকি-মাতব্বর মেহের মুনশি, রমিজ মিরধা, কদম শিকারি ও কোলশরিক আহাদালী, ধনু শিকদার ও আরো কয়েকজন আসে ফজলের সাথে দেখা করতে। তারা চরের অনেক খবর দেয় ফজলকে : জঙ্গুরুল্লার কোলশরিক আর বর্গাদাররা নতুন ভাওর ঘর তৈরি করেনি একটাও। তাদের তৈরি উনষাটটা ভাওর ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে বসত করছে ওরা। হালের গরু নিয়ে গেছে চরে। সেগুলোর জন্য একচালা বানিয়েছে ষোলটা। তাদের রোপা ধানের ফলন খুব ভাল হয়েছিল। ধানের অর্ধেকটা নিয়েছে জঙ্গুরুল্লা। বাকিটা ভাগ করে দিয়েছে কোলশরিকদের মধ্যে। জমি ভাগ করে এরফান মাতব্বরের কোলশরিকরা যেভাবে আল বেঁধেছিল সে সব আল ঠিক রেখে কোলশরিকদের মধ্যে জমি বণ্টন করে দিয়েছে জঙ্গুরুল্লা। প্রতি নল জমির জন্য সেলামি নিয়েছে চল্লিশ টাকা করে। শ্রাবণ মাসে রোপা আমন লাগিয়েছে সারাটা চর জুড়ে। ফসলের খুব জোর দেখা যায়।

চাকরিয়া প্রথমদিকে ছিল পঞ্চাশজন। ফজলকে পুলিস দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার পরও ছিল জনতিরিশেক। এরফান মাতব্বরের মৃত্যুর পর সব চাকরিয়া বিদায় করে দিয়েছিল জঙ্গুরুল্লা। ফজল জেল থেকে পালিয়ে আসার পর তিরিশ জনকে এনে রেখেছিল কিছুদিন। ফজলের জেল হওয়ার পর আবার তাদের বিদায় দিয়েছে। ফজল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছে শুনলে আবার চাকরিয়াদের ডাক পড়বে।

ফজলদের তৈরি বানার বেড় দিয়ে মাছ ধরছে জঙ্গুরুল্লার কোলশরিকরা। অনেক মাছ। সেগুলো নিকারির টেঁকে নিয়ে বিক্রি করে রোজ কমসে কম কুড়ি টাকা পায়। ঐ টাকার চার আনা ভাগ দিতে হয় জহরুল্লাকে।

টাকা আয়ের একটা নতুন পথ বার করেছে জঙ্গুরুল্লা। খুনের চরের উত্তর-পূর্ব কোণে। বিস্তৃত জায়গা জুড়ে যে ঘোঁজাটা, সেখানে সন্ধ্যার পর বিভিন্ন জায়গার ছোট, বড়, খালি, মালবোঝাই নৌকা এসে পাড়া গাড়ে বিশ্রাম ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। জঙ্গুরুল্লা খুঁটিগাড়ি আদায়ের জন্য সে ঘোঁজা বন্দোবস্ত দিয়েছে রউজ্যা ডাকাতের কাছে। সে একশ থেকে দুশ মনি নৌকার জন্য আটআনা, দুশ থেকে চারশ-মনি নৌকার জন্য এক টাকা, চারশ-মনির ওপর হলে দুটাকা করে খুঁটিগাড়ি আদায় করে। জঙ্গুরুল্লাকে সে প্রতিমাসে দেয় তিনশ টাকা।

‘এত পয়সার আমদানি! এত নৌকা আসে কইতন? নৌকাতো বেশিভাগ আটক করছে সরকার।’ ফজল অবাক হয়ে বলে।

‘কিছু কিছু নৌকা লম্বর দিয়া ছাইড়া দিছে।’ রমিজ মিরধা বলে।

‘সে আর কয়ডা? ধান-চাউলের নৌকাও তো চলে না। নতুন আইন অইছে–এক জেলার ধান-চাউল অন্য জেলায় যাইতে পারব না।’

‘ধান-চাউলের নৌকা ছাড়া আরো তো নৌকা আছে।’ মেহের মুনশি বলে। ‘বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস ভইর‍্যা চলছে আমের নাও আর কাঁডালের নাও। বাজে মালের নাও চলে বারোমাস। মওসুমের কতকত জিনিস—রশুন, পেঁয়াজ, হলদি, মরিচ, তেজপাতা, নারকেল, সুপারি, হাজারো মাল এক জেলারতন আরেক জেলায় যায় এই নদী দিয়া।’

‘আগের দিন অইলেতো টাকা দিয়া সিন্দুক বোঝাই কইর‍্যা ফেলাইত জঙ্গুরুল্লা।’

‘হ ঠিক কথাই কইছ।’ রমিজ মিরধা বলে। ‘আগের দিন অইলে রোজ আদায় অইত কমসে কম একশ ট্যাহা।’

‘কিন্তু নৌকাওয়ালারা ঐ ঘোঁজায় নৌকা বান্দে ক্যান্। আরো তো কত ঘোঁজা আছে। সেখানে বিনে পয়সায় নৌকা রাখতে পারে।’

‘অন্য ঘোঁজায় গেলে ডাকাতি অইতে পারে।‘ কদম শিকারি বলে। ‘এই আট-নয় মাসের মইদ্যে ছয়-সাতটা নৌকায় ডাকাতি অইছে! তারা পয়সা বাঁচাইতে গিয়া নাও রাখছিল অন্য ঘোঁজায়।’

‘আসলে রউজ্যাই ডাকাতি করায় ওর লোকজন দিয়া।’ রমিজ মিরধা বলে। ‘ডাকাতির ভয়ে বেবাক নৌকা খুনের চরের ঘোঁজায় আইস্যা খুঁটগাড়ি দিয়া খুঁডা গাড়ে।’

‘ধান-চাউলের দাম কি বাজারে?’

‘দাম অনেক বাইড়া গেছে। সোয়া দুই ট্যাহা মনের ধানের দাম চাইর ট্যাহা আর তিন ট্যাহা মনের চাউল ছয় ট্যাহা।’

‘এই বছর বাচন কষ্ট আছে।’ কদম শিকারি বলে।

‘ধান বেশি অয় ভাটি অঞ্চল খুলনা বরিশালে আর উজান দেশ সিলেট ময়মনসিংয়ে। উত্তর বঙ্গের দিনাজপুরেও ধান বেশি অয়। ঐ সব জেলারতন ধান-চাউল আইতে দেয় না বুইল্যাইতো দাম এত বাড়তে আছে।’

‘ধান-চাউল আইতে দেয় না ক্যান?’

‘কি জানি, ব্রিটিশ সরকারের কি মতলব। জাপান বর্মা মুলুক দখল করছে। আসামের দিগে আগাইয়া যাইতেছে। ব্রিটিশ এইবার যুদ্ধের ঘাঁটি বানাইব এই দেশে। তারা সৈন্য আর যুদ্ধের সরঞ্জাম নিয়া আসছে। আরো অনেক আসব। এই সব লক্ষ লক্ষ সৈন্যদের খাওয়ান লাগব তো! তাই মিলিটারির জন্য ধান-চাউল মজুত করতেছে ব্রিটিশ সরকার।’

‘হ আমিও হুনছি।’ মেহের মুনশি বলে। ‘দিঘিরপাড়ের কেরাসিন তেলের পাইকার বলাই কুণ্ডু মাল আনতে গেছিল নারায়ণগঞ্জ। মাল পায় নাই। কেরাসিন তেল বোলে আর পাওয়া যাইব না। সে দেইখ্যা আইছে–শীতলক্ষাপাড়ের আর চারগোপের পাটের গুদাম–ডেভিড কোম্পানীর ঐ সব বড় বড় পাটের গুদাম মিলিটারি দখল করছে। গাধাবোট, সুলুপ, ফেলাট, মাডুয়া নাও বোঝাই অইয়া ধান-চাউল আইতে আছে বিভিন্ন জেলারতন। মালগাড়ি ভইরা চাউল আহে দিনাজপুরতন। ওইগুলা জমা করতে আছে ঐ সব গুদামে।’

‘বিদেশতন গমও নাকি আসতেছে জাহাজ বোঝাই কইরা।’ ফজল বলে। ‘এইবার যে মাইনষের কপালে কি আছে, বলা যায় না। বর্মা মুলুকতন আগে চাউল আসত। মোটা পেগু চাউল। বর্মা এখন জাপানের দখলে। তাই ওইখানতন আর চাউল আসব না। সাংঘাতিক মুসিবত সামনে।’

‘একটা কতা জিগাই মাতবরের পো।’ ধনু শিকদার বলে। ‘আমরা হগল বচ্ছর ভাটি মুলুকে না অয় উজান দ্যাশে যাই ধান দাইতে। এইবারও মহাজন ঠিক করছি। কাতি মাসের এই কয়দিন পর ভাটি মুলুকে যাত্রা করতে চাই। দাওয়ালি নাও যাইতে দিব তো?’

‘খালি নাও লইয়া যাইতে পারবেন। কিন্তু আসার সময় ধান লইয়া আইতে পারবেন না।’

‘কষ্ট কইর‍্যা ধান কাটমু, মাড়াই করমু। হেই মিন্নতের ধানের ভাগ যদি না আনতে পারি, তয় মিন্নত কইর‍্যা লাভ কি?’ ক্ষোভ ও হতাশা ধনু শিকদারের কণ্ঠে।

‘আমরা ঢাকা-ফরিদপুরের দাওয়ালরা যদি না যাই তয়তো ভাটি আর উজান মুলুকের খেতের ধান খেতেই নষ্ট অইব।’ বলে আহাদালী।

‘তাতে অইবই। ব্রিটিশ সরকারের কি এখন এই দিগে খেয়াল আছে? তারা এখন যুদ্ধ লইয়া পেরেশান। ক্যামনে জাপানরে হটাইয়া নিজেগ রাজ্য উদ্ধার করব। ভারত ছাড় আন্দোলনের অনেক নেতা এখন জেলে। তারা আলোচনা করতে আছিল : আমাগ প্রধানমন্ত্রী হক সায়েবরে না জিগাইয়া ছোট লাট মিলিটারিগ লগে যুক্তি কইর‍্যা কয়েকটা জেলার ধান চাউল সরাইয়া দিছে বাংলার বাইরে, জাপান আইয়া পড়লে খাদ্যের অভাবে যাতে মুশকিলে পড়ে, লড়াই করতে না পারে। এই নিয়া হক সায়েবের সাথে ছোট লাটের বিরোধ চলতে আছে। রাজবন্দিরা আরো কইতেছিল–গুদামে গুদামে মিলিটারিরা ধান-চাউল জমা করতে আছে খালি তাগ খাওয়ার লেইগ্যা না। জাপান আইয়া পড়লে ওনারা বেবাক পোড়াইয়া দিয়া ভাইগ্যা যাইব। জাপানিরা খাদ্যের অভাবে আর লড়াই করতে পারব না।

‘কিন্তু হেই লগে আমরাও তো খাওন না পাইয়া মইরা যাইমু। আমাগ তিন-চাইর মাসের খোরাক আছে ভাটি না অয় উজান মুলুকতন। আমাগো তো বাঁচনের কোনো পথ দ্যাখতে আছি না।’

‘হ, বড় খারাপ দিন আইতে আছে। এখন যদি আমন ধান পাকার আগে চরটা দখল করা যায়, তয় কিছুটা বাঁচার আশা আছে।’

‘হ ঠিকই কইছ।’ রমিজ মিরধা বলে। ‘কিন্তু জঙ্গুরুল্লার দলরে ক্যামনে হটান যায়? আপনেরাই বুদ্ধি দ্যান, কেমন কইর‍্যা—’

‘আমরা তো কোনো কূলকিনারা পাইতেছি না।’ বলে মেহের মুনশি।

‘শোনেন, আমারে মুনশিগঞ্জ জেলেরতন পাঠাইছিল ঢাকা জেলে। আমি ঢাকা জেলেরতন খালাস পাইয়া আইছি। জঙ্গুরুল্লার দল আমার ছাড়া পাওয়ার কথা তাড়াতাড়ি জানতে পারব না। সেই জন্যই আপনেগ চুপে-চাপে আইতে কইছি। তারা তো তিনমাস হিসাব কইর‍্যা রাখছে। তাগ হিসাব মতন অগ্রাণ মাসের পাঁচ-ছয় তারিখে আমি ছাড়া পাইমু। কিন্তু আমি চব্বিশদিন আগেই ছাড়া পাইয়া আইছি। জেলখানায় ভাল মতন চললে, হুকুম মতন কাম করলে জেল মাফ পাওয়া যায়। জঙ্গুরুল্লারা তো এই খবর রাখে না। তাই চাকইর‍্যা এখন একটাও নাই চরে।’

‘হ, তোমার ছাড়া পাওয়ার খবর পাইলে আবার চাকইরা আইন্যা রাখব চরে।’

‘তখন কিন্তু চর দখল করা মুশকিল অইয়া পড়ব। আমি কাইল একটা দিন বাড়িতে আছি। পরশু দূরে একখানে চইল্যা যাইমু। জেলখানায় পালং থানার একজনের কাছে ভাল চাকইর‍্যার সন্ধান পাইছি। মেঘু আর আলেফের মতো চাকইর‍্যা দিয়া কাম ফতে অইব না। আমি দুই-তিন দিনের মইদ্য ঐ চাকইর‍্যা লইয়া আইমু। আমি যে ছাড়া পাইয়া আইছি এই কথা যেন একটা কাউয়ায়ও জানতে না পারে।’

‘ও মিয়ারা হোনলা নি? খবরদার! এই কথা জানাজানি অইলে কিন্তু কোনো কাম অইব না।’

‘বোঝ্‌লা তো মিয়ারা?’ রমিজ মিরধা বলে। ‘নিজের কপালের লগে বেবাকের কপাল পোড়াইও না। যার মোখ দিয়া এই কতা বাইর অইব সে তার বাপের জর্মের না। সে একটা জারুয়া। এই কইয়া দিলাম।’

‘শোনেন, অনেক টাকার দরকার।’ ফজল বলে। ‘আমি আমাগ বেবাক গয়না বন্ধক দিমু। আপনারা নিজেগ সাধ্যমত টাকা জোগাড় কইর‍্যা কাইলই নিয়া আসেন। নগদ টাকা না থাকলে গয়না বন্ধক দেওন লাগব। চর ফতে অইলে সব আবার ফিরত পাইবেন।’

‘হ, চরের জমি খাইতে অইলে টাকা খরচ করন লাগব।’ মেহের মুনশি বলে। ‘আপনারা সবাই রাজি তো?’

ফজল তার কাজে-কর্মে, ব্যবহারে এদের আস্থা অর্জন করেছে। সকলের অগাধ বিশ্বাস তার ওপর। মাছ ধরার ব্যবস্থা করে গরিব কোলশরিকদের যেভাবে সে সাহায্য করেছিল তা কেউ ভোলেনি। তাই তার প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়।

ফজল বলে, ‘আপনারা বাড়ি যান। মুনশি ভাই, আর মির ভাই এই রাত্রের মইদ্যে টাকা অথবা গয়না যোগাড় করেন। ঐগুলা লইয়া কাইল ভোরে আমার এইখানে চইল্যা আসবেন।’

একে একে সবাই নিজ নিজ বাড়ির দিকে রওনা হয়।

পরের দিন। ভোরবেলা বরুবিবি রসুইঘরে চালের গুঁড়োয় পানি মিশিয়ে চিতই পিঠার গোলা তৈরি করছিল।

ফজল দরজার মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি করতে আছ, মা?’

‘কয়ডা চিতই পিডা বানাইমু। তুই আবার বাইরে চইল্যা যাইস না।’

‘না, যাইমু না। তুমি আত ধুইয়া গয়নার পোটলাডা নামাইয়া দ্যাও তো মা।’

‘গয়নার পোটলা! বউর গয়নার?’

‘হ।’

‘ঐ পোটলা দিয়া তুই কি করবি?’

‘কাম আছে। অনেক টাকার দরকার।’

‘উঁহু! এই গয়না তো রূপজানের। উনি মরার সময় কইয়া গেছেন–ঐ গয়না রূপজানের মহরানার হক।’

‘শোন মা, আমারতন জবরদস্তি কইর‍্যা তালাক নিছে। ঐ সময় আরশেদ মোল্লা মহরানার দাবি ছাইড়্যা দিছে।’

‘আরশেদ মোল্লা দাবি ছাইড়া দেউক। কিন্তু উনি তো কইয়া গেছেন–গয়নাগুলা রূপজানের মহরানার হক।’

‘ঠিক আছে, ঐগুলো রূপজানেরই থাকব। এখন টাকার বড় দরকার। ঐগুলা বন্ধক দিয়া কিছু টাকা আনতে অইব।’

‘না রে বাজান, হেষে যদি ছাড়াইতে না পারস?’

‘ছাড়াইতে পারমু না ক্যান্? তোমারে কথা দিলাম, চাইর মাসের মইদ্যে ওগুলা ছাড়াইয়া আইন্যা যারডা তারে ফিরাইয়া দিমু।’

‘অনেক পীড়াপীড়ির পর বরুবিবি রাজি হয়। সে হাত ধুয়ে ঘরে যায়। সিন্দুক খুলে গয়নার পুটলি বের করে। ফজলের হাতে ওটা দিয়ে সে বলে, ‘দ্যাখরে বাজান, এইগুলা খুয়াইয়া ফেলাইলে কিন্তুক দায়িকের তলে থাকবি। মহরানার দেনা আর শোধ করতে পারবি না।’

গয়নার পুটলি নিয়ে ফজল নিজের ঘরে যায়। চৌকির ওপর বসে সে পুটলি খোলে, একটা-একটা করে দেখে গয়নাগুলো। ওগুলো নাড়াচাড়া করার সময় গয়না পরিহিতা রূপজানের ছবি বারবার ভেসে ওঠে তার মনে।

ফজলের মনে প্রশ্ন জাগে, রূপজান গয়নাগুলো কেন ফেরত দিয়েছিল। তবে কি সে জোর-জবরদস্তির তালাক মেনে নিয়েছে? না, অসম্ভব। এ তালাক সে মেনে নিতে পারে না। গয়না বিক্রি করে তার মামলার তদবির করার জন্য সে কাদিরকে দিয়ে ওগুলো ফেরত পাঠিয়েছিল। কাদির তো তাই বলেছিল ওগুলো ফেরত দেয়ার সময়। সে তো বানিয়ে বলেনি কিছু। রূপজান যা বলে দিয়েছিল তা-ই সে বলেছে।

গয়নাগুলোয় হাত বুলাতে বুলাতে সে মনে মনে বলে, ‘হায় রে অভাব! এই অভাবের তাড়নায় রূপজানের শরীল খালি কইর‍্যা একবার বন্ধক দিতে অইছিল এই গয়নাগুলা। এখন আবার বন্ধক দিতে অইব।’

কেমনে যেন সর্বস্ব হারানোর আশঙ্কায় ব্যথিয়ে ওঠে তার বুকের ভেতরটা।

‘মিয়া ভাই।’

আমিনার ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় ফজল, ‘কে রে আমিনা? আয়।’

একটা থালায় করে চিতই পিঠা, নারকেল কোরা ও ঝোলা গুড় নিয়ে আসে আমিনা।

‘কিরে, তাল নাই? তালের মওসুম কি শেষ?’

‘এইডাতো কাতি মাস। এহন কি আর তাল পাওয়া যাইব? হাশাইলের হাটে পাওয়া যাইতে পারে দুই একটা।’

এই বচ্ছর তাল চোখে দেখি নাই। গুড় ও নারকেল সহযোগে চিতই পিঠায় এক কামড় দিয়ে ফজল বলে, ‘চিতই পিঠার লগে তালের পায়েস! ওহ্ যা মজা!’

‘ভাবি তো নাই। তাল গোলাইব কে?’

‘ক্যান্ তুই? পারবিনা গোলাইতে?’

‘উঁহু। তাল গোলান কি যেমুন-তেমুন কষ্ট।’ আমিনা গান গাইত গাইতে রসুইঘরের দিকে চলে যায়–

তাল গোলাগোল যেমুন তেমুন,

আঁইট্যা দ্যাখলে ভয় করে,

তার চুল-দাড়িরে ভয় করে,

অ ভাইজান, আমি তাল খাইনা ডরে।

ফজলের মনের চোখে ভেসে ওঠে, রূপজান সবল সুডৌল হাত দিয়ে তালের আঁটি দলাইমলাই করে ঘন গোলা বের করছে আর গুনগুন করে গান গাইছে–

তাল গোলাগোল যেমুন তেমুন,

আঁইট্যা দ্যাখলে ভয় করে,

তার চুল-দাড়িরে ভয় করে,

অ বু’জান, আমি তাল খাইনা ডরে গো,

তাল খাইনা ডরে।

তালের আঁইটায় চুল-দাড়ি

খামচা দ্যাও আর দ্যাও বাড়ি

ডলা দিয়া বাইর করগো রস

অ বউ, বেতাইল্লারে এমনে করো বশ গো,

এমনে করো বশ।

হাতে-ধরা চিতই পিঠা মুখে দিতে ভুলে যায় ফজল। তার কল্পনা রূপজানকে নিয়ে আসে তার চোখের সামনে। তাল গোলাতে গোলাতে রূপজান তার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে আর গান গাইছে–

তালের গোলা বেতাল করে,

জ্বাল দিলে যে উতরে পড়ে,

অ বু’জান, হইল কি কারবার গো,

হইল কি কারবার।

তাল পড়লে উত্‌রাইয়া,

পড়িস না গো চিত্‌তরাইয়া,

অ বউ, নিভু জ্বালে তালে তালে

নাড়া দে বারবার গো,

নাড়া দে বারবার।

‘অ দুদু।’

নূরুর ডাকে কল্পনার ছবি মুছে যায় হঠাৎ।

‘কি রে নূরু, ডাক দিলি ক্যান্?’

রমিজ মিরধা আর মেহের মুনশি আইছে।

‘কাছারি ঘরে বইতে দে। পান-তামুক দে। আমি আইতে আছি।’

পিঠা খাওয়া শেষ করে গয়নার পুঁটলি নিয়ে ফজল কাছারি ঘরে যায়।

সালাম বিনিময়ের পর মেহের মুনশি বলে নগদ টাকা অনেকেই দিতে পারে নাই। বারোজনের কাছে পাইছি দুইশ’ পঞ্চাশ টাকা। পনেরো জন দিছে গয়না। বাকি কোলশরিকরা কিছু দিতে পারে নাই।

‘দিব কইতন?’ রমিজ মিরধা বলে। ‘বউ-পোলাপান লইয়া ওরা বড় কষ্টে আছে।’

‘তাতো বুঝলাম।’ ফজল বলে, ‘কিন্তু অনেক টাকার দরকার। গয়না বন্ধক দিয়া কি অত, টাকা জোগাড় করন যাইব?’

‘কত টাকা লাগব, আন্দাজ করছনি?’ মেহের মুনশি জিজ্ঞেস করে।

‘তা প্রায় দুই হাজার টাকা লাগব।’

‘তা বেবাক গয়না বন্দক দিলে অইয়া যাইব মনে অয়।’ বলে রমিজ মিরধা।

‘কি কি গয়না আনছেন, দেখি? কারতন কোন কোন গয়না আনছেন, তার ফর্দ বানাইছেন তো?’

‘হ বানাইছি।’ মেহের মুনশি বলে।

মেহের মুনশি নগদ দুশ’ পঞ্চাশ টাকা দেয় ফজলের হাতে। তারপর পুটলিবাঁধা গয়না ও ফর্দ রাখে ফজলের সামনে।

ফজল পুটলি খুলে গয়নাগুলো ফর্দের সাথে মিলিয়ে নেয়। গয়নার মধ্যে রয়েছে করণফুল, কানপাশা, মাকড়ি, মুড়কি, চুড়ি, বাজু, দানাকবচ। সবগুলো গয়না ও রূপজানের গয়নার পুটলি মেহের মুনশির হাতে তুলে দিয়ে ফজল বলে, ‘এইগুলা লইয়া আপনারা দুইজন হাশাইল বাজারে চইল্যা যান। জগু পোদ্দারের দোকানে বন্ধক রাইখ্যা টাকা লইয়া আসেন। আমিই যাইতাম, কিন্তু জঙ্গুরুল্লার কোনো লোক দেইখ্যা ফালাইলে বেবাক গোলমাল অইয়া যাইব।’

‘ঠিক আছে। তোমার যাওনের দরকার নাই।’ রমিজ মিরধা বলে। ‘আমরাই ঠিকঠাক মত ওজন করাইয়া ট্যাহা লইয়া আইতে আছি।’

‘হ, ঠিক মতন আলাদা আলাদা ওজন করাইয়া কার গয়নার কত ওজন তা ফর্দে লেইখ্যা রাইখেন। দেড় হাজার টাকা কমে রাজি অইবেন না।’

‘গয়না অইব চল্লিশ ভরির কাছাকাছি।’ মেহের মুনশি বলে। ‘দেড় হাজার টাকা দিব না ক্যান?’

‘না দিলে বিষ্ণু পাল আছে, ছিদাম কুণ্ডু আছে। ওনাদের কাছে যাইবেন।’

‘ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কইর‍্য না।’

‘আইজ সন্ধ্যার পর আপনাগ দুইজনরে লইয়া একটু বসতে অইব। মাইরটা কেমনে কি ভাবে চালাইতে অইব তা আপনাগ সাথে পরামিশ কইর‍্যা ঠিক করণ লাগব।’

‘সের দশেক মরিচের গুড়া লইয়া আইমু, কি কও?’ রমিজ মিরধা বলে। ‘ছাইয়ের লগে মিশাইয়া—’

‘এখনতো কার্তিক মাস। বাতাসের জোর নাই। এখন ছাই উড়াইয়া কাম অইব না।’

‘হ, ঠিকই।‘ মেহের মুনশি বলে। ‘মরিচের গুঁড়ায় পয়সা নষ্ট করণের দরকার নাই।’

তাদের বিদায় দিয়ে ফজল নিজের ঘরে যায়। নূরুর হাতের-লেখার খাতা থেকে এক টুকরা সাদা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে সে খুনের চরের নক্সা আঁকে। কোন দিক থেকে কখন কিভাবে আক্রমণ করলে জঞ্জুরুল্লার দলকে তাড়িয়ে দেয়া যাবে তার পরিকল্পনা ঘুরতে থাকে তার মগজের মধ্যে।