জোর যার মুল্লুক তার–সর্বজনবিদিত এ প্রবচনটি পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে চর অঞ্চলে যে রূপ নিয়েছে তা হচ্ছে—
জোর যার চর তার।
জোর কার, চর কার?
হাতিয়ার সাথী যার।
ঢাল, কাতরা, লাঠি, শড়কি, লেজা, চ্যাঙ্গা, গুলের বাঁশ ইত্যাদি হাতিয়ারগুলো চরবাসীদের সাথী। পুলিসের ভয়ে চর ছেড়ে পালাবার সময় ফজলদের দলের অনেকেই তাদের সাথী হারিয়ে বিপাকে পড়ে গিয়েছিল। হাতিয়ার ছাড়া চরে বসত করা যায় না। তাই কয়েক মাসের মধ্যে কষ্টেসৃষ্টে তারা তাদের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে আবার।
ফজলও জানে দলের সবাই হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে ছিল ফেরার, তারপর আবার জেলে। তাই হাতিয়ারগুলো দেখার সুযোগ পায়নি সে এতদিন। প্রত্যেকের হাতিয়ার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। তার নির্দেশ মতো বিকেল বেলা নৌকার ডওরায় লুকিয়ে সবাই নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে আসে ফজলের কাছে। হাতিয়ারগুলো মোটামুটি ভালই বানিয়েছে বলে মনে হয় ফজলের। তবে কয়েকটা শড়কি ও লেজার হাতলে এর মধ্যেই ঘুণ লেগে গেছে। বাবাত্তি বাঁশ দিয়ে বানিয়েছে বলেই এ অবস্থা। হাতলগুলো বদলাতে হবে। দুটো গুলেল বাঁশের টঙ্কার কানে বাজে না তেমন। এগুলো বাতিল করে তিন দিনের মধ্যে নতুন বানিয়ে নিতে হবে। ঢাল অতি আবশ্যকীয় বস্তু। আস্ত বেত দিয়ে প্রত্যেকেই তৈরি করেছে নিজ নিজ ঢাল। ছোট বড় মিলিয়ে সংখ্যায় একশ’ চৌত্রিশটা। বারোটা বাদে সবগুলোয় কষ-কুঁড়োর মাজন লাগানো হয়েছে ঠিক মত। গাব বা উইর্যাম গোটার কষের সাথে পরিমাণ মতো চালের কুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি হয় এ মাজন। এ মাজন কয়েক পোচ দিতে পারলে ঢাল খুব শক্ত-পোক্ত হয়, ঘুণ বাসা বাঁধতে পারে না। মাজন লাগাবার জন্য বারোটা ঢালের মালিকদের তিনদিনের সময় দেয় ফজল। ঘন গিঁঠযুক্ত চিকন পাকাঁপোক্ত বাঁশ দিয়ে তৈরি করতে হয় যার যার নিজের হাতের পাঁচ-হাতি লাঠি। ফজল এক একটা লাঠির দু’দিক ধরে হাঁটুর সাথে চাপ দিয়ে পরীক্ষা করে। চারটে লাঠি মটমটাৎ করে ভেঙেই গেল পরীক্ষার সময়। এ লাঠিয়ালদের নতুন লাঠি বানাবার জন্য সময় দেয়া হয় দুদিন। রামদা পাওয়া গেল মাত্র ছয়খানা। রামদা নিয়ে ডাকাতি করে ডাকাতরা। তাই পরিচিত লোহারু ছাড়া কেউ এ অস্ত্র বানিয়ে দিতে রাজি হয় না। ফজল বুড়ো আঙুলের মাথা দিয়ে ধার পরীক্ষা করে রামদাগুলোর। সবগুলোতেই পাইন দেয়া দরকার। কিন্তু দিঘিরপাড় বা হাশাইলের লোহারুর দোকানে এগুলো নিয়ে যাওয়া যাবে না। গেলেই সাথে সাথে রটে যাবে তাদের প্রস্তুতির খবর। এগুলো বালিগচার ওপর ‘করাইত্যা’ বালিতে ঘষে ধার উঠাবার চেষ্টা করতে হবে। ধার না উঠলেও চিন্তা নেই। কারণ রামদা দিয়ে তো মানুষ কাটতে যাচ্ছে না তারা। দাগুলোকে ঘষে চকচকে ঝকঝকে বানাতে হবে। দেখলেই যেন বিপক্ষীয় লড়িয়েদের পিলে চমকে যায়। রামদা কম থাকলেও ফজলের ভাবনার কিছু নেই। সে তো রামদাওয়ালা চাকরিয়া আনতেই যাচ্ছে দক্ষিণপাড়।
গুলেল বাঁশের জন্য প্রচুর গুলির প্রয়োজন। হিসেব করে দেখা যায় পয়তাল্লিশটা গুলেল বাঁশের জন্য মাত্র আটশ’ মাটির গুলি তৈরি আছে। রোদে শুকানো গুলিগুলো পুড়িয়ে নিতে হবে। আরো অন্ততঃ দেড় হাজার গুলির দরকার। দশসের টাডি সুপারি আর দশসের ঝাঁকিজালের কাঠি কিনে নিলেই দেড় হাজার গুলির অভাব পূরণ হবে।
ফজল এবার কাগজ-কলম নিয়ে লড়াইয়ের লায়েক মানুষের হিসেব করতে শুরু করে। কোলশরিকের সংখ্যা ছাপ্পান্ন। এদের মধ্যে দু’জন বুড়োকে বাদ দিলে থাকে চুয়ান্ন জন। তাদের জোয়ান মরদ ছেলের সংখ্যা বিয়াল্লিশ। উঠতি বয়সের কিশোরের সংখ্যা ছত্রিশ। চাকরিয়া অন্তত পঁচিশ জন। মোট একশ’ সাতান্ন জন।
এবার নৌকার হিসেব। এগারো-হাতি ডিঙি আঠারোটা। প্রত্যেকটায় চারজন করে চার আঠারং বাহাত্তর জনের জায়গা হবে। তেরোহাতি ডিঙি পাঁচখানা। প্রত্যেকটায় পাঁচজন করে পাঁচ-পাঁচে পঁচিশ। দু’খানা বড় ঢুশা নৌকা। কুড়ি জন করে কুড়ি দ্বিগুণে চল্লিশ। একটা ধূরী। এতে জায়গা হবে পনেরো জনের। ফজলের ঘাসি নৌকায় ধরবে কমপক্ষে তিরশি জন।
ছোট বড় মিলিয়ে মোট নৌকার সংখ্যা সাতাশ। তাতে তোক ধরবে কমপক্ষে একশ’ বিরাশি জন।
যথেষ্ট! যথেষ্ট! ফজল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মাথা তুলে তাকায় তার লোকজনের দিকে।
‘কি মিয়া, কি যথেষ্ট?’ জিজ্ঞেস করে কদম শিকারি।
‘নাও যা আছে, যথেষ্ট। সাতাশটা নাও আছে। আমাগ বেবাক মানুষ ফারাগত মতন। বসতে পারব নায়। শোনেন শিকারির পো। সামনের ভোর রাত্রে ঘাসিটা লইয়া রওনা দিমু দক্ষিণপাড়া। চাকইর্যা আনতে যাইমু পালং থানার বাসুদেবপুর। ঘাসি বাইতে পাঁচজন বাইছা ঠিক করেন।’
কদম শিকারি জোয়ান দেখে পাঁচ জনকে যাচাই করে। অনেকেই ফজলের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরে। কিন্তু ফেরার সময় চাকরিয়া বোঝাই করে আনতে হবে বলে তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে নিরস্ত করতে হয়।
বেলা ডোবার আর বেশি দেরি নেই। সবাইকে চুপেচাপে হাতিয়ার ঠিকঠাক করতে হবে, তাদের প্রস্তুতির ব্যাপারটা কাকপক্ষীও জানতে পারবে না। ফজলের এসব নির্দেশ নিয়ে কদম শিকারি ও জাবেদ লশকর ছাড়া সবাই যার যার বাড়ি চলে যায়।
কদম শিকারি ও জাবেদ লশকরকে কাছারি ঘরে বসিয়ে ফজল ভেতর বাড়ি যায়। উঠানে পা দিয়েই দেখে তার মা উত্তরভিটি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ থমথমে, মেঘাচ্ছন্ন।
‘অ্যাই ফজু, এই দিগে আয়।’ বরুবিবি ডাকে।
‘কি মা?’
‘কি হুনতে আছি আঁ? তোরা আবার কাইজ্যা করণের লেইগ্যা হাজাহাজি করতে আছস?’
‘আমাগ হকের চর অন্যে দখল কইর্যা লইয়া গেছে। সেই চর রাহেলিল্লাহ ছাইড়া দিমু?’
‘ছাইড়া দে বা’জান। চর বড়, না জান বড়? জানে বাঁইচ্যা থাকলে–’
‘মা তুমি চুপ করো দেহি। বা’জান মনে এত কষ্ট লইয়া মরছে। আমারে ওরা জেলের ভাত খাওয়াইছে। ওগ এমনে এমনে ছাইড়্যা দিমু।’
‘কি করবি বা’জান? অদিষ্টে যা আছিল তা অইছে। আর মারামারি কাড়াকাডির মইদ্যে যাইস না।’
‘মা এতগুলা মানুষ, এতগুলা কোলশরিক আমারে মাতবর বানাইছে। আমার মুখের দিকে চাইয়া আছে। হকের জমি যদি এমনে এমনে ছাইড়া দেই তয়তো চরে আর বসত করণ যাইব না।’
‘চরে আর বসত করণের কাম নাই, বা’জান। তোর বাজানের আগে তোর বড় চাচা আছিল মাতবর। আমাগ ঘর-বাড়ি আছিল লটাবইন্যায়। এই খুনের চরেরই নাম আছিল লটাবইন্যা। এই লটাবইন্যা ভাঙ্গনের পর বউ-পোলা-মাইয়া লইয়া হেই যে ছাব্বিশ সনের বন্যার পরের বচ্ছর আসুলিতে চইল্যা গেল, হউর বাড়িতে গিয়া ওঠল, আর চরের মাড়িতে ফির্যা আইল না। উনিতো কত শান্তির মইদ্যে দিয়া গুঁজাইরা গেছে। তুই জেলে থাকতে তোর চাচি আইছিল তার ছোড পোলা লইয়া। তাগো কাছে হুনছি, তাগো ঐ জাগায় মারামারি নাই, কাড়াকাডি নাই। কত শান্তি! বা’জান ফজু, চল আমরাও আসুলিতে চইল্যা যাই।’
‘আসুলিতে কই যাইমু? সেইখানে কি আমাগ মামুর বাড়ি আছে নি? তোমার বাপের বাড়িতে আছিল ভূকৈলাশ। সেই চরও ভাইঙ্গা গেছে। মামুরা এখন পাতনা দিয়া আছে মিত্রের চরে। যাইবা সেইখানে?’
‘বেবাক বেইচ্যা কিন্যা চল পাইকপাড়া যাই। তোর চাচাতো ভাইরা তো আছে।’
‘বা’জান বাঁইচ্যা থাকতে চাচায়ই কোনো দিন জিগায় নাই। এহন চাচাতো ভাইরা কি আর জিগাইব? শোন মা, এই চর ছাইড়্যা আর যাওনের কোনো জায়গা নাই আমাগো।’
বরুবিবির চোখের কোলে পানি চকচক করছিল এতক্ষণ। এবার দু’গাল বেয়ে দরদর ধারায় শুরু হয় অশ্রুর প্লাবন।
ফজল শঙ্কিত হয়। মা হয়ত এখনি বিলাপ করতে শুরু করবে। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য সে বলে, ‘মা তুমি চিন্তা কইর্য না। আমিতো মাতবর। আমিতো মারামারি করতে যাইতে আছি না। চাকইর্যা আনতে যাইতে আছি। চাকইর্যারাই মাইর করব। তুমি একটুও চিন্তা কইর্য না।’
বরুবিবি আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভেতর চলে যায়। ফজল ফিরে আসে কাছারি ঘরে।
সন্ধ্যার পর মেহের মুনশি ও রমিজ মিরধা আসে।
মেহের মুনশি তার কোমরে পেঁচিয়ে বাঁধা খুতি বের করে। ফজলের সামনে সেটা উপুড় করে ঢালতে ঢালতে বলে, ‘অনেক কইয়া-বুইল্লা দেড় হাজার টাকাই আনছি। পোদ্দারের পো কি রাজি অইতে চায়!’
‘সুদ কি হারে নিব?’ ফজর জিজ্ঞেস করে।
‘শ’ তে মাসিক পাঁচটাকা।’
‘তার মানে পনেরোশ’ টাকার সুদ এক মাসে পঁচাত্তর টাকা! ওরে আল্লারে!’
‘সুদের হার তো বড় বেশি!’ কদম শিকারি বলে।
‘হ সুদের হার বেশিই।’ রজিম মিরধা বলে। ‘শোন ফজল মিয়া, ত্বরাত্বরিই ট্যাহা শোধ দিতে অইব। সুদের পোলা-মাইয়া নাতি-পুতি বিয়ানের সময় দেওন যাইব না। ওগুলা বিয়াইতে শুরু করলে কিন্তুক উফায় নাই। তহন গয়নাগুলা বেবাক খুয়াইতে অইব।’
‘হ তাড়াতাড়িই টাকা শোধ দিয়া গয়না ছাড়াইয়া আনতে অইব। দেরি করণ যাইব না।’
মেহের মুনশির কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা গুনে নিয়ে ফজল অন্দরে যায়। সিন্দুকে টাকাগুলো রেখে আবার কাছারি ঘরে ফিরে আসে।
অনেকক্ষণ ধরে তারা সলা-পরামর্শ করে। মেহের মুনশি, রমিজ মিরধা ও কদম শিকারি হামলা করার যে সব কায়দা-কৌশলের কথা বলে তা সবই পুরানো, বহুল ব্যবহৃত দাদা-পরদাদার আমলের পদ্ধতি। ওতে খুন-জখম এড়ানো সম্ভব নয়। খুন-জখম না করে বিপক্ষ দলকে কিভাবে নাস্তানাবুদ করে চর থেকে হটিয়ে দেয়া যায় তার ফন্দি-ফিকিরের জন্য ফজল অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছে। জেলে থাকতে অনেকের সাথে আলোচনা করেছে। অনেক ভেবে-চিন্তে পরিকল্পনা একটা করে রেখেছে সে, গেঁথে রেখেছে মনের মধ্যে। কিন্তু এখনি, এত আগে তা প্রকাশ করা সমীচীন নয়। কারণ সে মনে করে, এদের কানাকানি থেকে বাইরে জানাজানি হবে আর জানাজানি হলেই সব আয়োজন হবে বিলকুল বরবাদ। সে শুধু বলে দুইজন বুড়া বাদে সবাইকে হাতিয়ার হাতে নিতে অইব। আমাগ মোট মানুষের সংখ্যা উঠন্তি চ্যাংড়া লইয়া একশ বত্রিশ জন। এই সব মানুষের লিস্টি তৈরি করতে অইব। পয়লা পরথম বাছাই করেন ল্যাগবেগা হ্যাংম্যাইঙ্গা গুলারে। তারপর বাছাই করেন চ্যাংড়া লেদুফেদু গুলারে। ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি লইয়া ওরা মুখামুখি লড়তে পারব না। ওগ হাতে দিতে অইব গুলাইল বাঁশ। দূরের তন ওরা গুলাইল মারব। যারা গুলাইল মারতে জানে না, এই কয় দিনের মইদ্যে তাগো শিখাইয়া লইতে অইব। কলাগাছের মাজায় চান্দের মতো গোল দাগ দিয়া চানমারির ব্যবস্থা করবেন। মাটির গুলি মাইর্যা মাইর্যা ওরা মারতে শিখব।’
একটু থেমে ফজল আবার বলে, ‘তুরফানের কাছে যারা লাঠি খেলা শিখছিল, আলেফ সরদার আর মেঘু পালোয়ানের কাছে যারা শড়কি চালান শিখছিল, তারা এই কয়দিন খুব কইর্যা অভ্যাস করব। চাকইর্যা আইলে চাকইর্যাগ লগে পরামিশ কইর্যা ঠিক করণ লাগব। কোন ভাবে হামলা করলে কাম ফতে অইব। আপনারা—’
‘ক্যাডারে?’ বাইরে মানুষের চলাফেরার শব্দ পেয়ে হাঁক দেয় মেহের মুনশি।
‘আমরা।’
‘আমরা ক্যাডা?’
‘চান্দু, বক্কর–আমরা ঘাসি লইয়া ফজল ভাইর লগে যাইমু।’
‘তোমরা এই রাইতে আইয়া পড়ছ?’ ফজল জিজ্ঞেস করে।
‘হ, ঘুমাইয়া গেলে যদি জাগন না পাই।’
‘ভাল করছ। দাঁড়, বাদাম, গুন, লগি সব ঠিকঠাক মতো নায়ে উডাও। তোমরাও নায়ের মইদ্যে ঘুমাইয়া থাক গিয়া। পোয়াত্যা তারা ওডনের আগে রওনা দিতে অইব। আর তিনজন কই?’
‘তারা এহনই আইয়া পড়ব।’
‘আইচ্ছা যাও।’
ফজল তার আগের কথার জের টেনে বলে, ‘আপনারা লিস্টিগুলা কইর্যা রাইখেন। আইজ আর আলোচনার দরকার নাই। চাকইর্যারা আইলেই ‘ফাইনাল’ আলোচনা অইব।’
সবাইকে বিদায় দিয়ে ফজল অন্দরে গিয়ে দেখে তার মা বারান্দায় তার জন্য খাবার সাজিয়ে বসে বসে তসবি গুনছে।