ভোর রাত্রেই পাঁচজন বাইছা নিয়ে নৌকায় চড়ে রওনা হয়েছিল ফজল। বাদাম উড়িয়ে, দাঁড় মেরে, গুন টেনে, পদ্মা উজিয়ে, কীর্তিনাশা ভাটিয়ে তারা যখন পালং পৌঁছে তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। লোকের কাছ থেকে বাসুদেবপুরের পথের খবর নিয়ে তারা নৌকাটাকে একটা বড় খালের ভেতর দিয়ে বেয়ে নিয়ে যায়। মাইল দুয়েক গিয়ে একটা শুকনো সরু খালের মুখে নৌকাটাকে বাঁধে।
চলতি নৌকায় রান্নার ঝামেলা অনেক। তাই গুড় আর কলা দিয়ে মুড়ি খেয়ে কোনো রকমে পেটকে বুঝ দিয়ে এতদূর এসেছে তারা। এসব চাকুমচুকুম আর গছানো যাবে না পেটকে। চাল, ডাল, মুরগি আলু, তেল, নুন, পেঁয়াজ, মরিচ ইত্যাদি বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল ফজল। তিনজনের ওপর রান্নার ভার দিয়ে বক্কর আর টিটুকে নিয়ে ফজল নৌকা থেকে নামে। ফজলের হাতে রশির ঝুলনায় একটা সন্দেশের হাঁড়ি।
ফজল জেল থেকেই শুনে এসেছিল রামদয়াল সরদার খুব মেজাজি লোক। তাই তাকে খুশি করার জন্য পথে নৌকা থামিয়ে সে নড়িয়ার সুপ্রসিদ্ধ সন্দেশ কিনে নিয়ে এসেছে।
লোকের কাছ জিজ্ঞেস করে খাল পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা রামদয়াল সরদারের বাড়ি পৌঁছে।
লুঙ্গি-পরা অপরিচিত লোক এসেছে শুনে বিরক্তির সাথে রামদয়াল ঘর থেকে উঠানে নামে। আগন্তুকদের দিকে তাকিয়ে তার বিরক্তিভরা গম্ভীর দৃষ্টি হঠাৎ প্রসন্ন হয়ে ওঠে। ফজলের হাত থেকে সন্দেশের হাঁড়িটা নিতে নিতে সে বলে, ‘এগুলা আবার ক্যান্ আনছ, বাবা? হাঁড়িটা পর্শ করো নাই তো?’
‘না, না দড়ির ঝুলনা ধইর্যা আনছি।’
উঠানে মাদুর বিছিয়ে তাদের বসতে দেয়া হয়।
রামদয়াল সরদারের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। তার দোহারা পেশিবহুল মজবুত শরীরে ভাটার টান লাগলেও গায়ের কুচকুচে কষ্টিকালো রংয়ের জন্যই বোধ হয় তা চোখে পড়ে না।
রামদয়াল সরদার তার আসল নাম নয়। তার আসল নাম পাঁচকড়ি মণ্ডল। জমি দখলের ‘কাইজ্যায়’ তার দল রামদা নিয়ে লড়াই করত। রামদাওয়ালা সরদারই লোকের মুখে মুখে বিবর্তিত হয়ে রামদয়াল সরদার হয়েছে। এই নামেই সে পরিচিত আজকাল। আসল নামে আর কেউ চিনে না তাকে। সে নিজেও বোধ হয় ভুলে গেছে তার আসল নাম।
খুনের চরের বৃত্তান্ত শেষ করে ফজল তার এখানে আসার উদ্দেশ্য রামদয়ালকে জানায়। রামদয়ালের মুখ সমবেদনায় বিষণ্ণ। আফসোসসূচক শ্চ-শ্চ শব্দ করে সে বলে, ‘বড় অদিনে আইছ বাবা। আমার দল তো আর নাই। দল তো কবে ভাইঙ্গা গেছে।’
ফজলের মাথায় যেন হঠাৎ বাজ পড়ে। সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে রামদয়ালের মুখের দিকে।
ফজলের অসহায় বিহ্বল দৃষ্টি লক্ষ্য করে রামদয়াল আবার বলে, ‘আমাগ আর কেও জিগায় না আইজকাইল। আগে বরিশাল, ভোলা, চানপুর, মেন্দীগঞ্জে, হিজলা আরো কত জায়গা থিকা লইয়া যাইত আমাগ। আড়িয়াল খাঁ আর মেঘনার কত কত চর দখল কইর্যা দিয়া আইছি। তোমাগ পদ্মার চরে যাই নাই কোনোদিন। এহন চরুয়ারা নিজেরা নিজেরাই লড়াই করে, দশ-পাঁচটা খুন-জখম অয়, হাজতে যায়, জেল খাডে। আমাগ আতে খুন-জখম বড় একটা অইত না।’
একটু থেমে আবার বলে, ‘আগে আশ্বিন-কাতি মাসে বাড়ির ভাত খাইতে পারতাম না। আইজ এই চর, কাইল অই চর দখলের লেইগ্যা মাইনষে আতে-পায়ে ধরত। গেল কয়েক বচ্ছর ধইর্যা আর কেও নিতে আহে না। দুই একটা যা আইত, উচিত পয়সা দিত না। এমনে কি আর সংসার চলে? আমাগ অনেকেরই জমাজমি নাই। দলের মানুষ প্যাডের ধান্দায় নানান জা’গায়, নানান কাজে চইল্যা গেছে। বারো-তেরো জন তো বউ-পোলা-মাইয়া লইয়া গেছে আসাম মুলুকে। ওরা আর ফিরা আইব না কোনো দিন। চার-পাঁচ জন গেছে করাত কামে। তিনজন সইন কইর্যা যুদ্দে গেছে। কয়েকজন হাটে হাটে তরি-তরকারি বেচে। দুইজন এক মাল্লাই বায়। কয়েকজন করে কুড়ালের কাম। তারা গাছ কাডে, চলা ফাড়ে। কয়েকজন ওড়া-কোদাল লইয়া কই যে গেছে ভগমান জানে।’
‘দশ-বারো জন তো পাওয়া যাইব?’ হতাশার ধকল কাটিয়ে ফজল বলে।
‘নারে বাপু, তাও নাই। দুই-তিনজন যারাও আছে, তারা কেও জ্বরে কাহিল, কেও বদনা লইয়া দৌড়াদৌড়ি করে।’
ফজল হেসে ওঠে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো সে হাসি। সে বলে, ‘দলের মানুষ তো নাই, কিন্তু রামদাওগুলাতো আছে?’
‘রামদাও দিয়া কি করবা?’
‘আমাগ রামদাও নাই। আপনাগ রামদাওগুলা বেইচ্যা ফালান আমার কাছে।’
‘রামদাও লইয়া পারবা না বাপু তোমরা লাড়াই করতে। খামাখা—’
‘আপনে যদি দেখাইয়া দ্যান, এট্টু শিখাইয়া দ্যান তয় পারমু আপনের আশীর্বাদে।’
রামদয়াল বিস্মিত চোখে তাকায় ফজলের দিকে। তার চোখ খুঁটে খুঁটে দেখে ফজলের সিনা, বাহু, আঙুল। সে ফজলের সাথী দুজনকেও দেখে খুঁটে খুঁটে। তারাও হাতে-পায়ে গায়ে-গতরে প্রায় ফজলের মতই বলিষ্ঠ।
রামদয়াল হঠাৎ খপ করে ফজলের ডান হাত ধরে ফেলে বলে, ‘আসো দেখি পাঞ্জা লড়ি। দেখি কেমুন জোর আছে শরীলে।’
দু’জনে দু’জনের কব্জী ধরে মাটিতে কবজি রেখে পাঞ্জার লড়াই শুরু করে। যদিও শেষ পর্যন্ত রামদয়ালই জিতে, তবুও ফজলের হাত মাটিতে নোয়াতে তাকে গায়েব সব কুয়ত ঢালতে হয়।
আপনেরে ওস্তাদ মানলাম, গুরু মানলাম। ফজল অনুনয় করে বলে। ‘শিখাইয়া দ্যান আমাগো।’
‘গুরু মানলে দক্ষিণা দিতে অয়। দক্ষিণা কই?’
ফজল জামার পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বাড়িয়ে দেয় রামদয়ালের দিকে।
দশ টাকা! দেড় মণ চালের দাম! যুদ্ধের জন্য হঠাৎ দাম না বাড়লে তো তিন মণই পাওয়া যেত।
রামদয়াল নোটটা ট্র্যাঁকে গুঁজে উঠে দাঁড়ায়। উত্তর দিকে কিছুদূর গিয়ে সে একটা জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরে রামদয়াল জঙ্গল থেকে ফিরে আসে। তার একহাতে একটা লম্বা রামদা, অন্যহাতে সদ্য-কাটা একটা তল্লা বাঁশ।
‘এই জুয়ান, কি যেন নাম তোমার?’ রামদয়াল জিজ্ঞেস করে।
‘ফজল।’
রামদয়াল রামদাটা ফজলের হাতে দিয়ে বলে, ‘এই বাঁশটা এক কোপে দুইখণ্ড করতে অইব।’
ফজল রামদাটা নিয়ে ওটার ধার পরীক্ষা করে বলে, ‘ধার তো তেমন নাই।’
‘ঠিক আছে, তুমি কোপ মারো। আমি ঠিকই বোঝতে পারব।’
রামদয়াল বাঁশটার গোড়ার দিক এগিয়ে দেয় ফজলের দিকে।
সে লাফ মেরে ‘ইয়া আলী’ হুঙ্কার দিয়ে কোপ মারে। বাঁশটা দু’টুকরো হয়ে যায়। রামদয়ালের চোখে-মুখে বিস্ময়। সে বলে, ‘সাবাস, তুমি পারবা হে। গুরুর নাম রাখতে পারবা।’
রামদয়াল ফজলের সাথী বকর আর টিটুরও পরীক্ষা নেয়। তারা এক কোপে বাঁশটার বারো আনারও বেশি কাটতে সক্ষম হয়।
রামদয়াল বলে, ‘তোমরাও চেষ্টা করলে পারবা।’
সে ঘরে গিয়ে দুটো ঢাল ও একটা শড়কি নামিয়ে নিয়ে আসে।
একটা ঢাল ও শড়কি ফজলের হাতে দিয়ে বলে, ‘তুমি ঢাল ও শড়কি লইয়া আমারে আক্রমণ করবা। আমি ঢাল আর রামদা দিয়া তোমারে ফিরাইমু।’
রামদয়াল ও ফজল যার যার হাতিয়ার নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়।
রামদয়াল ইশারা দিতেই ফজল শড়কি নিয়ে আক্রমণ করে। রামদয়াল ঢাল দিয়ে শড়কির আঘাত প্রতিহত করেই ডান দিকে সরে বাঁদিকে সামান্য ঘুরে লাফ দিয়ে ‘জয় মা কালী’ বলে কোপ মারে শড়কির হাতলে। বাঁশের শুকনো হাতল পুরোপুরি দু’টুকরো হয় না। কোপ খাওয়া হাতলের নিচের অংশের সাথে শড়কির ফলাটা লল্লুড় করে। এতেই বেশি অসুবিধেয় পড়ে ফজল। তার হাতের অস্ত্রটা এখন না-শড়কি, না-লাঠি। কোনো ভাবেই সে ওটাকে চালাতে পারে না। ওদিকে রামদয়াল রামদা উঁচিয়ে মার মার করে তেড়ে আসে। ফজল পিছু হটে দৌড় দিয়ে পালাতে বাধ্য হয়।
রামদয়াল হাসতে হাসতে বলে, ‘এইডা অইল রামদার লাড়াই। শড়কির আতল পুরাপুরি না কাটলেই বেশি ভাল। শড়কিডা দিয়া তহন শড়কির কাম তো না-ই, লাডির কামও চলব না।’
এবার রামদয়াল ঢাল আর শড়কি এবং ফজল ঢাল আর রামদা নিয়ে মহড়া শুরু করে।
ফজলের সাহস শক্তি ও ক্ষিপ্রতায় মুগ্ধ হয় রামদয়াল। এমন ভাল শাগরেদ সে কখনো পায়নি। সে মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে সে বুড়ো হয়ে গেছে। মরে যাবে আর কদিন পর। ফজল তার গুরুর নাম রাখতে পারবে।
ফজলের সাথী দু’জন–বক্কর আর টিটুও একে একে যোগ দেয় মহড়ায়। তারাও মোটামুটি ভালই দেখিয়েছে ‘রামদা’র লড়াই। রামদয়াল লড়াইয়ের আরো কিছু কায়দা কৌশল সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে বলে, ‘তোমরা মাংস বেশি খাও, তাই শক্তি আছে তোমাগ গায়ে, পেঁয়াজ-রশুন খাও, তার তেজ আছে শরীলে। তোমরা অভ্যাস করলে আমাগতন ভাল লাড়াই করতে পারবা।’
‘কয়টা রামদাও দিতে পারবেন?’ জিজ্ঞেস করে ফজল। ‘ঢালও লাগব ঐ কয়টা। আপনাগ ঢালগুলা বড় আর মজবুত।’
‘রামদাও কুড়ি খানেকের বেশি দেওয়ন যাইব না। ঢালও কুড়িডা দেওয়ন যাইব। কিন্তু কত টাকা দিবা?’
‘আপনে কইয়া দ্যান?’
‘কুড়িখান রামদা’র দাম চাইর টাকা কইর্যা আশি টাকা আর কুড়িখান ঢাল তিন টাকা কইর্যা ষাট টাকা।’
‘গুরুজি, এট্টু কমাইয়া ধরেন। একটা রামদাও দুই টাকায় বানান যায়।’
‘হেই জিনিস আর এই জিনিসে তফাত আছে। এই জিনিস চাইর টাকার কমে বানাইতে পারবা না।’
‘ঠিক আছে, আপনার কথাই রাখলাম। তয় সব মিলাইয়া একশ কুড়ি টাকা দিমু।’
রামদয়ালের দল ভেঙে গেছে। রামদা’র প্রয়োজন তাই শেষ হয়ে গেছে। তার বিশেষ প্রয়োজন এখন টাকার। সে একশ কুড়ি টাকায় জিনিসগুলো দিতে রাজি হয়ে যায়। এ টাকায় মহাজনের কাছে বন্ধক দেয়া দেড় বিঘা জমি ছাড়িয়ে নেয়া যাবে।
ফজল আর তার সাথী দুজনকে নিয়ে রামদয়াল উত্তর দিকের জঙ্গলে ঢোকে। একটা বাঁশঝাড়ের পাশে এলোমেলো করে রাখা কঞ্চির স্তূপ। রামদয়াল কঞ্চিগুলোকে সরিয়ে একটা আয়তাকার গর্ত থেকে কাঠের একটা বাক্স উঠিয়ে আনে। বাক্সের ডালা খুলতে খুলতে সে বলে, ‘এগুলা ঘরে রাখলে বিপদ। পুলিস খানাতল্লাশি কইর্যা এগুলা পাইলে কি আর বাঁচনের উপায় আছে? মাজায় দড়ি লাগাইয়া হান্দাইয়া দিব জেলে। ঐ ডরে কব্বরের মইদ্যে গুঁজাইয়া রাখছি। নেও, গইন্যা দ্যাহো কয়ডা আছে।’
ফজল গুনে দেখে কুড়িটা আছে রামদা।
‘বাক্সডা শুদ্দা লইয়া যাও। বাক্সডা দিয়া আর কি করমু? বাক্সের দাম দশটাকা দিও।’
‘ঠিক আছে। দিমু দশ টাকা।’
‘দাওগুলায় পাইন দেওয়া আছে। বালিগচার উপরে বালি দিয়া ধারাইয়া লইও।’
সন্ধ্যার পর বাক্সটা নিয়ে নৌকায় ওঠে ফজল ও তার সাথীরা।
রামদয়াল এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে কুড়িটা ঢাল যোগাড় করে নৌকায় দিয়ে যায়। ফজল একশ’ তিরিশ টাকা তার হাতে দিয়ে তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।
রামদয়াল তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে, ‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুক, তোমার জয় হোক।’
রামদয়াল চলে যাওয়ার পর বাক্সটা ও ঢালগুলো তারা ধানখেতের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আসে। চৌকিদার-দফাদার বা পুলিস খবর পেয়ে বা বিদেশী নৌকা দেখে সন্দেহ করে নৌকায় তল্লাশি চালালে মুসিবতে পড়তে হবে। সুতরাং সাবধান হওয়া ভাল।
রান্না অনেক আগেই শেষ হয়েছিল। সবাই খেতে শুয়ে পড়ে। ভোর হওয়ার আগে রওনা দিলেই চলবে।
শুয়ে শুয়ে ফজর চিন্তার জাল বুনতে শুরু করে। যাদের জন্য এত পরিশ্রম করে তারা এই দূর দেশে এসেছিল তাদের পাওয়া গেল না। তাদের হাতিয়ার নিয়ে কাম ফতে করা কি সম্ভব হবে? কেন হবে না? নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।
সন্দেহের দোলায় নুয়ে পড়া সংকল্প তার আত্মবিশ্বাসের মেরুদণ্ডে ভর দিয়ে এবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
খুনের চর বেদখল হওয়ার পর থেকে, বিশেষ করে জেলে থাকতে ফজল শুধু ভেবেছে আর ভেবেছে। চর দখলের নতুন কায়দা-কৌশল ফন্দি-ফিকির মনে আসতেই তার চোখে ভাসে দুই দলের মারামারির দৃশ্য। অনেকগুলোর মধ্যে তিনটা কৌশল তার মনে সাফল্যের আশা জাগায়। এগুলো নিয়ে সে বাদল আর আক্লাসের সাথে আলোচনাও করেছিল। তারাও কৌশলগুলোর প্রশংসা করে বলেছিল, ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে জয় নিশ্চিত।
চাকরিয়া যোগাড়ের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তার উদ্ভাবিত কায়দা-কৌশলগুলো এবার তার মাথার ভেতর জটলা পাকাতে শুরু করে। শুয়ে শুয়ে সে স্থির করে, ফিরে যাওয়ার পথে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো অবশ্যই সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে হবে।
ফজলের মনের ভাবনা ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসে। সে ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়ে।
একদল লোক লাঠি-শড়কি নিয়ে তাড়া করছে রূপজানকে। সে প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে নদীর পাড় ধরে। এক পাশ থেকে সে নিজেও দৌড়াচ্ছে শড়কি হাতে। কিন্তু এগুতে পারছে না। হঠাৎ পাড় ভেঙে রূপজান নদীতে পড়ে গেল আর অমনি ঘুমটা ভেঙে গেল তার। সে কাঁপতে থাকে থরথর করে।
একটু পরেই মোরগ বাক দিয়ে ওঠে, ‘কুউ-ক্কুরু-উ-উ–ৎ-কু-উ-উ।’
ফজল উঠে সবাইকে জাগিয়ে দেয়। তারা তাড়াতাড়ি ধানখেত থেকে রামদা’র বাক্স ও ঢালগুলো নিয়ে আসে, রেখে দেয় ডওরায় পাটাতনের নিচে।
আর একটুও দেরি না করে তারা পাড়া উঠিয়ে নৌকা ছেড়ে দেয়।
খাল উজিয়ে কীর্তিনাশায় পৌঁছতে ভোর হয়ে যায়। উজান পানি। বাতাসও নেই যে পাল তুলে দেবে। দু’জন গুন নিয়ে নেমে যায় ডাঙায়। কাঁধে বেরুয়া ঠেকিয়ে তারা গুন টেনে এগিয়ে যায় নদীর পাড় ধরে।
একটা বাঁক ঘুরতেই ফজল উত্তর দিকে তাকায়। একটা ছোট স্টিমার আসছে উত্তর দিক থেকে। ওটার পেছনে চাক্কি। পানি কমে গেছে, তাই পেছনে চাক্কিওয়ালা জাহাজ চালু হয়েছে।
অনেক দূরে দেখা যায় একটা উঁচু তালগাছ। আশপাশের উঁচু গাছগুলোর মাথা তালগাছটার হাঁটু-বরাবর।
‘এই বক্কর, এই টিটু, ঐ চাইয়া দ্যাখ ভোজেশ্বরের আসমাইন্যা তালগাছটা। এমুন উঁচা তালগাছ আর দেখি নাই কোনো মুলুকে। দুফরের আগে কিন্তু ঐখানে যাওন লাগব। আইজ সোমবার, ভোজেশ্বরের হাট।’
‘হাটেরতন কিছু কিনবেন নি?’ জিজ্ঞেস করে বক্কর।
‘হ, অনেক কিছু কিনতে অইব।’
পথে চান্দনী গ্রাম বরাবর নদীর ঢোনে নৌকা বাধে তারা। তিনজনকে নিয়ে ফজল নৌকা থেকে নামে। একটা কাটারি, একটা চাঙারি ও কিছু রশি নেয় সাথে।
গ্রামের সরু পথ ধরে তারা হাঁটে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ফজল বলে, ‘তোরা চোত্রা গাছ চিনস? গুঁড়িচোত্রা? রামচোত্রা?’
তিনজনের কেউ চেনে না চোত্রা গাছ।
‘চিনবি কইতন? চরে এই গাছ অয়না। তোরা নামও শোনস নাই কোনো দিন?’
‘হ, হুনছি।’ টিটু বলে। ‘ঐ পাতা গায়ে লাগলে চুটমুট করে, জ্বালা করে, খাউজ্যায়।’
‘হ, বইয়ের ভাষায় এগুলার নাম বিছুটি।’
গ্রামের দুটো বেতঝোপ থেকে গুনে গুনে দুইশ আঁকড়ি যোগাড় করে ফজল। বেতঝোঁপের মালিককে আঁকড়ি পিছু এক পয়সা করে দিতে হয়। ওগুলোকে একখানে সাজিয়ে তারা রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে।
খুঁজতে খুঁজতে রাস্তার পাশের এক জঙ্গলে রামচোত্রাও পাওয়া যায়। হাতে রুমাল বেঁধে ফজল অনেকগুলো গাছ উপড়ে তোলে শিকড়ের মাটিসহ। চাঙারির ভেতর ওগুলো খাড়া করে সাজিয়ে চাঙাড়িটা তুলে দেয় একজনের মাথায়।
নদীর ঢোনে ফিরে এসেই তারা নৌকা ছেড়ে দেয়। ভোজেশ্বর পৌঁছে তারা নদীর পাড়ের বাঁশহাটা থেকে সরু লম্বা ও শুকনো দেখে পঁচিশটা তল্লা বাঁশ কেনে। বাঁশগুলোকে নৌকার দুধারে পানিতরাশ বরাবর তারা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেয়। তারপর টিটুকে নৌকায় রেখে ফজল বাকি চারজনকে নিয়ে হাটের বিভিন্ন পট্টিতে ঘোরে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য। তিন ব্যাটারীর চারটে টর্চলাইট; দশসের টাডি সুপারি; দশসের ঝাঁকিজালের কাঠি; তিনসের মাথা তামাক, কুড়ি প্যাকেট বিড়ি ও একসের সুতলি কিনে হাটের ভিড় ঠেলে তারা তাড়াতাড়ি নৌকায় ফিরে আসে। টিটুকে নৌকায় না দেখে ফজল হাঁক দেয়, ‘টিটু গেলি কইরে?’
টিটুর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
চান্দু থলে-ভরা জালের কাঠি নিয়ে নৌকায় ওঠে সকলের আগে।
‘ও মাগো!’
থলে ফেলে লাফ দিয়ে নেমে যায় চান্দু।
ফ্যাঁক-ফ্যাঁক করে হাসতে হাসতে দৈত্যের মুখোশ-পরা টিটু ছই-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে।
সবাই এবার জোরে হেসে ওঠে–কেউ খলখলিয়ে কেউ ফ্যাঁকফেঁকিয়ে। ভয়ঙ্কর বিকট চেহারার দৈত্য ভেঙচি দিয়ে রয়েছে। দাঁতাল শুয়োরের দাঁতের মতো দুটো বড় দাঁত বেরিয়ে আছে। রক্ত লেগে আছে সে দাঁতে। নওল ষাড়ের শিংএয়ের মতো দুটো খাড়া শিং-এও রক্তের দাগ।
মুখোশটা দেখেই ফজলের মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি খেলে যায়। সে বলে, ‘মোখাড়া পালি কই, এই টিটু?’
টিটু মুখ থেকে শক্ত কাগজে তৈরি মুখোশটা খুলে বলে, ‘অ্যাক ব্যাডা বেচতে আনছিল। অ্যাক আনা দিয়া কিনছি।’
‘ও ব্যাডা গেল কই?’
‘হাটের কোন দিয়ে গেছে কে জানে?’
‘অ্যাই, তোরা পাঁচজনে পাঁচ দিকে যা ব্যাডারে হাঁটের তন বিচরাইয়া আনন চাই। ওরে কইস, পঞ্চাশটা কিনমু।’
ফজল ভাবে, ‘মুখোশটা খুবই কাজের জিনিস। হঠাৎ দেখলে ভয় পাওয়ার কথা। মুখোশ দেখে ভয় না পেলেও মুখোশের আড়ালের মানুষকে নিশ্চয়ই ভয় পাবে। চিনতে না পেরে মনে করবে ওস্তাদ লাঠিয়ালরাই মুখোশ পরেছে তাদের পরিচয় গোপন করার জন্য। মুখোশ না থাকলে বিপক্ষদল দেখবে পাকা লাঠিয়াল একজনও নেই। সব হাঙাল-বাঙাল আর চ্যাংড়ার দল। ওদের মনের জোর বেড়ে যাবে। তখন লড়াই জেতা মুশকিল হয়ে যেতে পারে।
কিছুক্ষণ পর মুখোশ-পরা ফেরিওয়ালাকে ওরা নিয়ে আসে। দর কষাকষি করে ফজল পাইকারী দরে ভয়াল চেহারার দৈত্য-দানবের পঞ্চাশটা মুখোশ কেনে আড়াই টাকায়।
আর কোনো কাজ বাকি নেই পথে। তারা পাল তুলে নৌকা ছেড়ে দেয়। হাল ধরে বসে থাকে বক্কর।
দূর থেকে একটা গানের সুর ভেসে আসে ফজলের কানে। গানের কথা কিছুই বোঝা যায় না। তবুও সুরের স্পর্শে বিহ্বল হয় তার মন।
তাদের সামনে অনেক দূরে একটা দো-মাল্লাই নৌকা। নৌকাটা ভাটিয়ে তাদের দিকে আসছে। মনে হয়, ওটাতেই বাজছে কলের গান। দুটো নৌকার মাঝের দূরত্ব কমে আসতেই গানের কথা স্পষ্ট শোনা যায়।
‘ঐ যে ভরা নদীর বাঁকে,
কাশের বনের ফাঁকে ফাঁকে,
দেখা যায় যে ঘরখানি।
সেথায় বধূ থাকে গো,
সেথায় বধূ থাকে।’
গানের কথা ও সুর গুঞ্জরণ তোলে তার মনে। তার চোখ বুজে আসে। কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে তার মন উড়ে চলে যায় ভরা নদীর বাঁকে। মনের চোখ খুঁজে বেড়ায় তার প্রিয় মুখ।
নৌকাটা তাদের পাশ দিয়ে ভাটির টানে অনেক দূর চলে গেছে। গান আর শোনা যায় না এখন। কিন্তু ফজলের মনে গানটা তখনো বেজে চলেছে। তার মনের চোখ তখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে–কখনো রূপজানের, কখনো জরিনার মুখ।
‘ও মিয়াভাই, বড় গাঙ্গে আইয়া পড়ছি।’
বক্করের ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় ফজল। সে চোখ খোলে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। সামনের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘আল্লার নাম লইয়া পাড়ি দে।’
সন্ধ্যার মৃতপ্রায় আলোর দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, খুব ভাল সময়েই পৌঁছেছে তারা। রাতের অন্ধকারে কেউ দেখতে পাবে না, আর দেখলেও চিনতে পারবে না তাদের।
‘আল্লা-রসুল বলে ভাইরে মোমিন। আল্লা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।’ বক্কর ও অন্যান্য বাইছারা জাকইর দেয়।
অনুকূল স্রোত। ভাটির টানে নৌকাটা যাতে পুবদিকে জঙ্গুরুল্লার এলাকায় চলে না যায় সেজন্য পালটাকে একই অবস্থায় রেখে তারা উত্তরমুখি পাড়ি ধরে।
পাল আর দাঁড়ের টানে উত্তর দিকে চলতে চলতে, ভাটির টানে পুবদিকে সরতে সরতে নৌকাটা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফজলদের বাড়ির ঘাটে পৌঁছে যায়।