পরের দিন ভোরে ফজল ঘুম থেকে উঠেই ঘাসিতে ঘুমিয়ে থাকা বক্কর ও চান্দুকে ডেকে তুলে পাঠিয়ে দেয় পুলকি মাতব্বরদের ডেকে আনতে। সে নিজে চাঙারিসহ রামচোত্রা গাছগুলো কলাগাছের ঝোঁপের মধ্যে ছায়ায় রেখে আসে। মাঝে মাঝে পানির ছিটে দিলে গাছগুলো তাজা থাকবে।
ফজল এবার হাট থেকে কিনে আনা তল্লা বাঁশগুলোর আইক্কা ছাড়ায় দা দিয়ে, গিঁঠগুলো চেঁচে পরিষ্কার করে। ফজলের বাঁশ চাঁচা শেষ না হতেই মেহের মুনশি, রমিজ মিরধা, জাবেদ লশকর ও কদম শিকারি চলে আসে।
খবরিয়াদের কাছেই তারা শুনেছিল, চাকরিয়া একজনও আসেনি। এসেই তারা বিষণ্ণ মুখে জানতে চায় চাকরিয়া না আসার কারণ।
‘দলটা ভাইঙ্গা গেছে।’ ফজল বলে। ‘দলের সরদার আছে। সে-ও বুড়া। দলের লোকজন এদিগে ওদিগে নানান কাজে চইল্যা গেছে।’
‘এহন কি করতে চাও?’ মেহের মুনশি জিজ্ঞেস করে। ‘মেঘু আর আলেফ সরদারের লেইগ্যা খবরিয়া পাঠান দরকার।’
‘কোনো দরকার নাই। আমরাই পারমু কাম ফতে করতে।’
চারজন পুলকি-মাতব্বর হাঁ করে চেয়ে থাকে ফজলের দিকে।
‘আপনারা ঘাবড়াইয়েন না। ওগ খবর নিছেন? ওরা আমাগ সাজাসাজির খবর পায় নাই তো?’
‘না।’
‘ওরা চাকইর্যা আনে নাই তো?’
‘না। ওরা জানেই না, তুমি জেলেরতন খালাস পাইয়া আইছ।’ রমিজ মিরধা বলে। ‘তোমার অবর্তমানে আমরা চরদখলের হামতাম করতে যাইমু না, ওরা জানে। তার লেইগ্যা, ওরা খুব নির্ভাবনায় আছে। চাকইর্যা অ্যাকটাও নাই ওগ দলে।’
‘শোনেন। কাইলই হামলা করণ লাগব। আর বেশি দেরি করলে ওরা সব জাইন্যা ফালাইব। লিস্টি করছেন?’
‘হ।’ মেহের মুনশি নিমার পকেট থেকে কাগজ বের করে ফজলের হাতে দেয়।
উত্তম, ভাল, মধ্যম, ল্যাগবেগা, চ্যাংড়া–এই পাঁচ শ্রেণীর ভাগ করা হয়েছে দলের একশ বত্রিশ জনকে।
‘উত্তম’ শ্রেণীতে আছে আঠারো জন। ফজলের সাথে ঘাসি বেয়ে গিয়েছিল যে পাঁচজন তারাও আছে এ তালিকায়।
ফজল ‘ভাল’দের তালিকা থেকে বেছে দু’জনকে তুলে নেয় ‘উত্তম’দের তালিকায়। এই কুড়ি জনকে সে ডাকতে পাঠিয়ে দেয়।
ভাল তেইশ জন আর মধ্যম চৌত্রিশ জন যাবে মেহের মুনশির বাড়ি। সেখানে তারা শড়কি আর লাঠি চালাবার কসরত করবে মেহের মুনশি আর জাবেদ লস্করের পরিচালনায়। গুলেল বাঁশের চাঁদমারির জন্য যাবে কদম শিকারির বাড়ি।
পুলকি-মাতব্বরদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দিয়ে ফজল বলে, ‘কাইল ভোরে সবাই—একশ বত্রিশ জন যার যার হাতিয়ার লইয়া এইখানে হাজির অইব। দ্যাখবেন কেও যেন্ ভয়ে না পলায়। আমাগ লাল বড় দামড়াডা জবাই করমু। বেলা এগারোটার মইদ্যে এইখানে খাওয়া-দাওয়া সইর্যা তৈরি অইব। ঘড়ি লাগব দুইটা। একটা তো আছে বাজানের পকেট ঘড়ি। আর একটা পাই কই?’
‘আমার পোলার আছে একটা টেবিল ঘড়ি।’ রমিজ মিরধা বলে।
‘ঠিক আছে। এইটা দিয়াই কাম চালান যাইব।’
‘এই চিক্কন লম্বা বাঁশগুলান দিয়া কি করবা?’ মেহের মুনশি জিজ্ঞেস করে।
‘এখন আর কইমু না। কাইলই দ্যাখতে পাইবেন।’
পুলকি মাতব্বররা চলে যাওয়ার পর ফজল নাশতা খেয়ে বাঁশের গিঠ চাঁচতে লেগে যায় আবার। তার হাতের কাজ শেষ হওয়ার আগেই উত্তম কুড়ি জন এসে হাজির হয়।
ফজলের নির্দেশে নৌকার ডওরা থেকে রামদার বাক্স আর ঢাল নিয়ে আসে চান্দু, বক্কর আর টিটু। ফজল কয়েকটা পুরানো লগি যোগাড় করে। চান্দুর হাতে লগি আর ঢাল দিয়ে বলে, ‘মনে কর এই লগিটা একটা শড়কি। আমি ইশারা দিলেই এইটা লইয়া তুই আমারে আক্রমণ করবি। আর সব্বাই তোরা মনোযোগ দিয়া দেখবি। তোগ সব্বাইর কিন্তু শিখতে অইব রামদার লড়াই।’
ফজল বাঁ হাতে ঢাল আর ডান হাতে রামদা নিয়ে চান্দুকে ইশারা করে আক্রমণের জন্য। চান্দু আক্রমণ করে। ফজল লগিটাকে ঢাল দিয়ে ফিরিয়ে রামদয়ালের কায়দায় লাফ দিয়ে ‘ইয়া আলী’ বলে কোপ মারে লগির ওপর। লগিটা দুটুকরো হয়ে যায়।
ফজল বলে, ‘এইডা অইল রামদার লড়াই। শড়কির হাতল দুই টুকরো না অইলেও ক্ষতি নাই। বারো আনা কাটলেই বরং ভাল। কোপ খাওয়া শড়কির হাতল দিয়া তখন শড়কির কামও চলব না, লাঠির কামও চলব না।’
দুপুর পর্যন্ত কুড়ি জনকে তালিম দেয় ফজল। তারা ঢাল দিয়ে কল্পিত শড়কির কোপ ফিরিয়ে রামদা দিয়ে হাওয়ায় কোপ মেরে মেরে অভ্যাস করে।
দুপুরের খাওয়া খেয়ে কিছুক্ষণ জিরোবার পর আবার শুরু হয় মহড়া। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ফজল পরীক্ষা নেয় সকলের। তার মূল্যায়ন অনুসারে ছয়জন প্রথম বিভাগে, দশ জন দ্বিতীয় বিভাগে, আর চারজন তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। তাদের প্রত্যেককে একটা করে রামদা বুঝিয়ে দেয় সে। সেই সাথে ঢালও দেয় একটা করে। রামদা বালিগচার ওপর কিভাবে ধার করে নিতে হবে, তাও সে বুঝিয়ে দেয়।
‘কাইল বেলা ওঠার আগে তোমরা সবাই চইল্যা আসবা।’ ফজল নির্দেশ দেয়। ‘বড় দামড়াটা জবাই কইর্যা, কুইট্যা-কাইট্যা তাড়াতাড়ি রান্নার ব্যবস্থা করতে অইব।’
পরের দিন ভোর বেলা। রোদ ওঠার আগেই লোকজন নৌকা আর হাতিয়ার নিয়ে হাজির হয় মাতব্বর বাড়ি। ফজলের নির্দেশে তারা বিভিন্ন কাজে লেগে যায়।
বাড়ির পুব পাশে গরু জবাই করে দশ-বারো জন গোশত কাটাকুটি করে। তিন জন পেঁয়াজ-রশুনের চোকলা ছাড়ায়। দু’জন পালা করে মসলা বাটে। কয়েকজন মাটিতে গর্ত করে চুলো বানায়।
কাছারি ঘরের সামনে একজন একজন করে বালিগচার ওপর বালি ছড়িয়ে যার যার রামদা ঘষছে ধার তোলার জন্য। একসাথে তিনজন একটা বড় পাথরের ওপর শড়কি, লেজা, কাতরা ঘষে চক্চকে ঝকমকে করে নিচ্ছে।
নূরু ও হাশমত লগির মাথায় কাস্তে বেঁধে কলার ডাউগ্গা কাটে। থালা বাসনের অভাবে আর বোয়া-পাখলার ঝকমারি এড়াতে বড়-ছোট সবাইকে কলার পাতে খাবার পরিবেশন করতে হবে। পশ্চিম পাশে তিনজন হাতে গামছা জড়িয়ে লম্বা ও সরু তল্লা বাঁশের আগায় রামচোত্রা গাছ বাঁধছে সুতলি দিয়ে। ফজল দাঁড়িয়ে তদারক করছে।
এগুলা বড়শি গিট্টু দিয়া শক্ত কইর্যা বাইন্দা ফ্যাল। ফজল নির্দেশ দেয়। ‘এগুলার উপরে আবার গইন্যা গইন্যা পাঁচটা কইর্যা আঁউকড়া বানতে অইব একেকটা বাঁশের লগে। আঁউকড়াগুলা কিন্তু একটু আলগা কইর্যা বানতে অইব। টান লাগলেই যেন খুইল্যা যায়।’
আঁকড়ির মসৃণ গোড়ার দিক বাঁশের আগায় রামচোত্রার ওপর আলগা করে বেঁধে দেয়া হয়।
রমিজ মিরধা ও জাবেদ লশকর দাঁড়িয়ে দেখছিল। জাবেদ লশকর হাসতে হাসতে বলে, ‘যত সব পোলাপাইন্যা কাণ্ড-কারখানা! তোমাগ এই চ্যাংড়ামি বুদ্ধিতে কি কাম অইব?’
‘আপনারা ঠাট্টা করেন আর যাই করেন, আপনাগ দাদার আমলের গোঁয়ারকিতে, সামনা-সামনি লড়াইয়ে বিপক্ষ দলেরে কাহিল করণ যাইব না। খুন-জখম অইয়া যাইতে পারে। দেখি, আমাগ চ্যাংড়ামি কায়দা-কৌশলে ওগ কাবু করতে পারি কিনা। বইতে পড়ছি–মারি অরি পারি যে কৌশলে। অরি মানে শত্রু। শত্রুরে যে কোনো কৌশলে নাস্তানাবুদ করা দরকার।’
একটু থেমে ফজল আবার বলে, ‘পঁয়তাল্লিশটা গুলাইল বাঁশ আছে। আপনারা মাটির গুলি, টাডি সুপারি আর জালের কাঠি গুলারে পঁয়তাল্লিশটা ভাগ কইর্যা ফেলেন। একেক ভাগ বুঝাইয়া দিতে অইব একেক জন গুলাইলওলার হাতে।’
সকলের খাওয়া শেষ হয়েছে। ফজল জামার পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখে, সোয়া এগারোটা বাজে। সে সবাইকে বলে, তোমরা পান-বিড়ি-তামুক খাইয়া জিরাইয়া লও কতক্ষণ।
সাড়ে বারোটার সময় ফজলের ডাকে নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে লাইন করে দাঁড়ায় সবাই। ফজল তালিকা অনুযায়ী পাঁচ দলে ভাগ করে সবাইকে।
ল্যাগবো উনিশজন আর চ্যাংড়া কিশোর ছত্রিশ জনের সবারই ঢাল আছে। ল্যাগবেগা সবার হাতে লেজা বা শড়কি আর চ্যাংড়াদের হাতে কোচের কুতু।
ফজলের নির্দেশে রমিজ মিরধা ও কদম শিকারি ওদের ভেতর থেকে কুড়িজনকে বাছাই করে কুড়িটা গুলেল বাঁশ ওদের হাতে দিয়ে দেয়। একেক জনের জন্য ভাগ করে রাখা গুলি ঢেলে দেয় প্রত্যেকের কোঁচড়ে।
এগারো-হাতি ডিঙি বারোখানা আর তেরো-হাতি ডিঙি দু’খানায় ওদের পঞ্চান্ন জনকে ভাল-মন্দয় মিলিয়ে চারজন পাঁচজন করে তুলে দেয়া হয়। ওদের পরিচালনার জন্য ঢাল শড়কি নিয়ে কদম শিকারি, আহাদালী ও ধলাই সরদার ওঠে ভিন্ন ভিন্ন নৌকায়।
কদম শিকারির হাতে পকেট ঘড়িটা দিয়ে ফজল নৌকার লোকদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘তোমরা মনোযোগ দিয়া শোন। পুবদিক তন তোমরা উজাইয়া যাইবা চরের দিকে। দূরে থাকতেই ঠিক দুইটার সময় মাইর ডাক দিবা। ওরা তখন চরের পুব কিনারে গিয়া গুলাইল মারব। তোমরাও গুলাইল মারবা। একবার উজাইয়া কিছু দূর আউগ্গাইবা, ঢাল দিয়া ওগ গুলি ফিরাইবা। আবার ভাইট্টাইয়া পাউছ্ছাইবা। এম্বায় আউগ্গাইবা আর পাউছ্ছাইবা–এই তোমাগ কাম। তোমরা বেশি গুলি খরচ করবা না। কিন্তু ওগ গুলি খরচ করাইবা। আমরা ঠিক তিনটার সময় পশ্চিম দিক দিয়া চরে নাইম্যা পড়মু। আমাগ মাইর ডাক হামাহামি শুইন্যা ওরা পশ্চিম দিগে ঘুরতেই ওগ পিঠে আর পাছার উপরে ফটাফট গুলি মারবা। ওরা যখন আমাগ মুখামুখি আউগ্গাইতে থাকব তখন তোমরা নাও লইয়া চরের উত্তর দিকে গিয়া নাইম্যা পড়বা। কিছু দূর আউগ্গাইয়া দূরেরতন ওগ সই কইর্যা গুলাইল মারবা। যা কইলাম মনে থাকে যেন। আর শোন, তোমাগ সব্বাইরে স্মরণ করাইয়া দিতেছি–বা’জান কি কইত, মনে আছে তো? এইডা কিন্তু রাজা-বাদশাগ লড়াই না যে যারে পাইলাম তারে খতম করলাম। এই লড়াই অইল বিপক্ষেরে খেদানের লেইগ্যা। নিজেরে বাঁচাইয়া চলবা। সুযোগ পাইলে আতে পায়ে বাড়ি দিবা, খোঁচা দিবা। প্যাট, বুক, আর মাথায় কিন্তু মারবা না, খবরদার! ব্যস এই কথা! যাও, বিছমিল্লা বুইল্যা, আল্লা-রাসুলের নাম লইয়া নাও ছাড়।’
চোদ্দখানা ডিঙি পাড়া উঠিয়ে রওনা হয়ে যায়।
উত্তম, ভাল ও মধ্যমদের নিয়ে ফজল ঘাসি, ঢুশা ও বাকি ডিঙিগুলোতে ওঠে। অনেক ঘুরে তারা নাগরার চর আর আটং-এর দক্ষিণ দিক দিয়ে বেশ কিছু দূর উজিয়ে খুনের চরের দিকে নৌকার মাথি ঘোরায়। ঘাসির হালমাচার সাথে বাধা টেবিল ঘড়িটা বারবার দেখছে ফজল।
ঠিক দুটোর সময় মাইর ডাক শোনা যায়—
‘ওয়া-হ্বা-হ্বা-হ্বা-হ্বা।’
বিপক্ষের শোরগোলও শোনা যায়—
‘আউগ্গারে, আউগ্গা। আইয়া পড়ছে। আউগ্গা, আউগ্গা।’
কিছুক্ষণ পর বিপক্ষ দলের মাইর ডাক শোনা যায়।
‘ওয়া-হ্বা-হ্বা-হ্বা-হ্বা–’
কাঁটায় কাঁটায় তিনটের সময় ফজল দলবল ও হাতিয়ার-সরঞ্জাম নিয়ে চরের পশ্চিম কিনারায় নামে। নামার আগে বাঁশের আগায় বাঁধা বিছুটি পাতা পানিতে ভিজিয়ে নেয়। কোনো শব্দ না করে ধানখেতের ভেতর দিয়ে পা চালিয়ে তারা পুবদিকে এগিয়ে যায় অনেক দূর।
প্রচণ্ড রোদ। আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। বিপক্ষের লোকজন সবাই পুব কিনারায়। তারা গুলেল বাঁশ থেকে হরদম গুলি ছুঁড়ছে পুব দিকে। পশ্চিম দিকে ওদের একটা লোকও নেই।
ফজল দশ-বারো জনকে অর্ধেক করে কাটা কতকগুলো আঁকড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দেয় গরুর বাথানে। তারা গরুর লেজের আগায় পশমের সাথে দুতিনটে করে আঁকড়ি আটকে দিয়ে গরুগুলোকে ছেড়ে দেয়। তাড়া খেয়ে সেগুলো পুবদিকে দৌড়াতে থাকে। পেছনের দু’পায়ে আঁকড়ির খোঁচা আর ফজলদের দাবড় খেয়ে সন্ত্রস্ত গরুগুলো লেজ উঁচিয়ে ‘ওম্বা—ওম্বা’ রব তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে।
ফজলের লোকজন তিন-চার হাত পরপর পাশাপাশি দাঁড়ায় এক সারিতে। তারা সবাই মাটির দিকে মুখ করে মুখের ওপর ডান হাত নেড়ে ডাক দেয়– ‘ওয়া-হ্বা-হ্বা-হ্বা-হ্বা-হ্বা–।’
ফজলের নির্দেশে এবার সবাই মুখোশ পরে নেয়।
এরফান মাতব্বর মারা গেছে, আর জঙ্গুরুল্লার দল জানে ফজল জেলে আছে। তাই তারা বেশ নিশ্চিন্ত আরামে দিন গুনছিল। আচম্বিতে এরকম হামলা করবে, তারা কল্পনাও করতে পারে নি। আজ তারা সংখ্যায় মাত্র উনসত্তর জন। পশ্চিম দিকের মাইর ডাক শুনে তাদের বুক ভয়ে কেঁপে ওঠে। শিউরে ওঠে শরীর, কাঁটা দিয়ে ওঠে গায়ের রোম।
তারা পশ্চিম দিকে ঘোরে। চোখ-ধাঁধানো রোদ। কপালে হাত রেখে সূর্য আড়াল করে তারা দেখে তাদের গরুগুলো লেজ উঁচিয়ে ছুটে আসছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। ‘উহ, উহ!’ করে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে কয়েক জন। তাদের অনেকের পিঠে, পাছায়, পায়ে এসে লাগছে গুলেল বাঁশের গুলি। ধাবমান মত্ত গরুগুলোর পদদলন থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে তারা দৌড়ে গুলির পাল্লা পেরিয়ে এক জায়গায় থামে। দাঁড়িয়ে দম নেয় কিছুক্ষণ। তারপর ঢাল, কাতলা, লাঠি, শড়কি নিয়ে মাইর ডাক দিয়ে তারা এগিয়ে যায় পশ্চিম দিকে।
সূর্যের কড়া আলো পড়ছে তাদের চোখে, কপালে। ভাল করে তারা দেখতে পায় না হামলাকারীদের। তবুও তারা ধানখেতের ভেতর দিয়ে পাশাপাশি এক সারিতে এগিয়ে যায়।
‘বাঁশগুলা আউগ্গাইয়া রাখ।’ ফজল হুকুম দেয়। জঙ্গুরুল্লার দল আরো এগিয়ে আসে। নাগালের মধ্যে এসে পড়ার সাথে সাথে ফজল হুকুম দেয়, ‘মা-র আঁউক্ড়া।’
বিপক্ষীয় লোকদের দু’পায়ের ফাঁকে রামচোত্রা আর আঁকড়ি বাঁধা বাঁশের আগা ঢুকিয়ে টান মারে ফজলের দল। আলগা করে বাঁধা আঁকড়ি ওদের কয়েকজনের কাছামারা লুঙ্গির সাথে আটকে যায়, কারো কাছা খুলেও যায়। ফজলের দল বিছুটিপাতা সমেত বাঁশের আগা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওদের রানে, হাতে, শরীরে ঝাঁপটা মারে। দু-একটা বাঁশের আগায় আঁকড়ি শক্ত করে বাঁধা ছিল বলেই বোধ হয় আঁকড়ির টানে দু’জনের লুঙ্গি কোমর থেকে খসে যায়। তারা শড়কি-ধরা হাত দিয়ে লুঙ্গি সামলায়, দিশে না পেয়ে পিছু হটে। শেষে হাতিয়ার ফেলে আঁকড়ি জড়ানো লুঙ্গি ধরে দৌড় দেয়।
যাদের লুঙ্গিতে আঁকড়ি আটকে গেছে তারা এগুবার চেষ্টা করে। কিন্তু আঁকড়ির আঁচড়ে ছড়ে যাচ্ছে দু’দিকের রান। ভীষণ জ্বলুনি শুরু হয়ে গেছে বিছুটিপাতার ঘষায়। এ সব অসুবিধে সত্ত্বেও কয়েকজন ঢাল-শড়কি নিয়ে এগিয়ে যায়। ফজলের রামদাওয়ালারা তাদের মুখোমুখি হয়। ওরা শড়কির কোপ মারতেই ফজলের দল ঢাল দিয়ে সে কোপ ফিরিয়ে রামদা দিয়ে কোপ মারে শড়কির হাতলে। দু’একটা হাতল দুটুকরো হয়ে যায়। বেশির ভাগ হাতল বারো আনা চৌদ্দ আনা কেটে গেছে। ওসব শড়কি দিয়ে আবার কোপ মারতেই ঢালের সাথে লেগে ফলাসহ হাতলের নিচের অংশ ভেঙে ওপরের অংশের সাথে দুলতে থাকে ললুড় করে। ফজলের দল এবার সারিবদ্ধভাবে কেউ রামদা উঁচিয়ে, কেউ শড়কি বাগিয়ে ধরে, কেউ গুলেল মারতে মারতে ‘মা-র–মা-র’ করে এগিয়ে যায়। বিপক্ষ দলের সবাই এবার পিছু হটে দৌড় দেয়। কারো কারো কাছামারা লুঙ্গিতে জড়ান আঁকড়ি লেজের মতো দুলছে, যেন লেজ নিচু করে তারা পালাচ্ছে। ফজলের পূর্বদিকের দল উত্তর দিক দিয়ে এসে গেছে। তারা জঙ্গুরুল্লার পলায়মান লোকদের লক্ষ্য করে গুলি মারে গুলেল বাঁশ থেকে।
জঙ্গুরুল্লার দল ছত্রভঙ্গ হয়ে কেউ ঢাল ফেলে, কেউ শড়কি ফেলে, কেউ-বা সব হাতিয়ার ফেলে প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে। ছুটতে ছুটতে কেউ লুঙ্গি থেকে আঁকড়ি ছাড়াবার চেষ্টা করছে, কেউ আঁকড়ির সামনের মাথা এক হাত দিয়ে, পেছনের মাথা আর এক হাত দিয়ে ধরে পাল্লাচ্ছে। ফজলের দল ‘মা-র–মা-র’ ছুটছে তাদের পিছু পিছু। জঙ্গুরুল্লার অধিকাংশ লোক দৌড়ে যাচ্ছে ঘোঁজার দিকে। তাদের নৌকাগুলো সেখানেই বাধা আছে। ফজলের দল ওদের পালাবার সুযোগ দেয়ার জন্য নিজেদের গতি কমিয়ে দেয়।
জঙ্গুরুল্লার লোক হুড়মুড় করে নৌকায় ওঠে–যে যেটা সামনে পায়। কয়েকজনের হুড়োহুড়ি-ঠেলাঠেলির চোটে একটা ডিঙি ডুবেই যায়। সেটা ছেড়ে পানি ভেঙে তারা উঠে পড়ে আরেকটায়। একেকটায় চার-পাঁচজন করে উঠে আর কারো জন্য দেরি না করে নৌকা ছেড়ে দেয়। লগির খোঁচ মেরে, বৈটা টেনে তারা চলে যায় নিরাপদ দূরত্বে। যারা ঘোঁজার দিকে যেতে পারেনি তারা পুবদিকে নদীর ধারে দৌড়ে চলে যায়। সেখানে তাদের গরুগুলো ছটফট করছে, কোনোটা লাফালাফি করছে। তারা পশ্চিমদিকে চেয়ে দেখে হামলাকারীরা অনেক পেছনে। কেউ কেউ নিজেদের লুঙ্গিতে আটকানো আঁকড়ি খোলে। কেউ গরুর লেজে জড়ানো আঁকড়ি ছাড়িয়ে নেয়।
‘মা-র মা-র’ করে এগিয়ে আসছে ফজলের দল। জঙ্গুরুল্লার পলায়মান কিছু লোক গরুগুলোকে তাড়া দিয়ে নদীতে নামায়। গরুগুলো সাঁতার দিলে ওগুলোর লেজ ধরে একেক জন ভাটির টানে ভেসে যায় চরমান্দ্রার দিকে।
ফজলের একটা দল ঘোঁজার কিনারায় এসে বিপক্ষ দলের নৌকা লক্ষ্য করে গুলের বাঁশ থেকে কয়েকটা গুলি মারে। আর একদল পুব কিনারায় গিয়ে দুয়েকটা গুলি মারে গরুর লেজ ধরা লোকগুলোর দিকে।
গুলি মারার উদ্দেশ্য ভয় দেখানো। তারা বোঝে, পরাজিত পলায়মান শত্রুর পেছনে বেশি গুলি খরচ করা নিরর্থক।
ফজলের দলের সবাই ঘোঁজার কাছে এসে জমায়েত হয়। ফজল হাঁক দেয়, ‘আল্লাহু আকবর।’
দলের সবাই গলা ফাটিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার দেয়, ‘আল্লাহু আকবর।’
ফজল দলের চল্লিশ জনকে পাহারার জন্য চরের চার কিনারায় পাঠিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ শোনা যায়, ‘ঐ গেল–গেল–গেল, ধর্–ধর্—ধর্।’
সবাই তাকিয়ে দেখে দক্ষিণ দিকে যারা পাহারা দিতে যাচ্ছিল তারা ধাওয়া করছে দুটো লোকের পেছনে। প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে লোক দুটো পুবদিকে।
জাবেদ লশকর প্রকৃতির তাগিদ সেরে ঐ দিক থেকেই আসছিল। সে দেখে, দু’জনের একজন আরশেদ মোল্লা। সে মোল্লাকে তাড়া করে দৌড়ে যায় তার পিছু পিছু। নদীতে নেমে কিছুটা পানি ভেঙে মোল্লা সাঁতার দেয়। লশকরও সাঁতার দিয়ে গলা পানিতে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। সে মোল্লাকে চুব দিয়ে আবার টেনে তোলে।
আরশেদ মোল্লা কাঁপছে থরথর করে। অন্য লোকটা সাঁতার কেটে ভাটি পানিতে ভেসে যাচ্ছে চরমান্দ্রার দিকে।
‘হালা, আমাগ বউ আটকাইছস। তোরে চুবাইয়া মাইরা ফালাইমু।’ জাবেদ লশকর আবার চুব দেয় আরশেদ মোল্লাকে। তাকে টেনে তুলে সে আবার বলে, ‘ফজলরে পুলিস দিয়ে ধরাইয়া দিছিলি, হা-লা। এহন দ্যাখ কেমুন মজা।’
‘ও চাচা।’ ফজলের গলা। সে তাকায় ফজলের দিকে। ফজল দূর থেকে হাত নেড়ে মানা করছে আর চুব দিতে, ছেড়ে দিতে বলছে হাতের ইশারায়।
ফজল ধরতে গেলে তার ছেলের বয়সী। সে তাকে চাচা বলে ডাকে। তবুও ফজল মাতব্বর। সে তার আদেশ অমান্য করতে সাহস করে না। সে বিরক্তির সাথে মনে মনে বলে, ‘যেই না হালার বউর বাপ! তার লেইগ্যা দরদ এক্করে বাইয়া পড়ে। এমুন হউররে একশ একটা চুব দেওন দরকার।’
আরশেদ মোল্লাকে টেনে তুলে সে বলে, ‘অ্যাই হালার ভাই হালা। দিমুনি আরেকটা চুব?’
অনেকক্ষণ চুব দিয়ে ঠেসে ধরায় দম ফাপড় হয়ে আসছে আরশেদ মোল্লার। হাঁসফাস করতে করতে সে বলে, ‘আপনের আতে ধরি। আর চুব দিয়েন না?’
‘তোর মাইয়াখান কানে আঁইট্যা দিয়া যাইতে পারবি? ক, শিগগির। নাইলে আবার চুব দিলাম।’
আরশেদ মোল্লা কাঁদো-কাঁদো স্বরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘হ, দিয়া যাইমু।’
‘ওয়াদা করলি তো?’
‘হ, ওয়াদা করলাম।’
‘দ্যাখ ওয়াদা যদি খেলাপ করসরে, তয় তোর পেডের ঝুলি বাইর কইরা দিমু যেইখানে পাই।’
‘ওয়াদা ঠিক থাকব বিয়াইসাব।’
‘ওরে আমার বিয়াইরে! হালা কমজাত কমিন। তোরে বিয়াই কইতেও ঘিন্না লাগে।’
‘আপনের দুইডা আতে ধরি। আমারে ছাইড়া দ্যান।’
‘ছাইড়া দিলে হাঁতরাইয়া যাইতে পারবি?’
ফজলের লোকজন নদীর কিনারায় এসে জড় হয়।
কদম শিকারি বলে, ‘হালারে লইয়া আহহ। গর্দানডার উপরে দুইডা চটকানা দিয়া জিগাই, হালায় এমুন আকামের কাম ক্যান্ করছিল? ক্যান্ মাইয়া আটকাইছিল? ক্যান্ পা না ধোয়ার লগে দোস্তালি পাতাইছিল? ক্যান্ ফজলরে পুলিস দিয়া ধরাইয়া দিছিল?’
জাবেদ লশকর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় আরশেদ মোল্লাকে।
‘হালার লুঙ্গিতে বুঝিন আঁউকড়া লাগে নাই।’ বলে কদম শিকারি। ‘মনে অয় চোত্রার ঘষাও লাগে নাই। এই বক্কর, দ্যাখতো চোত্রা পাতা আছেনি। হালার লুঙ্গি উড়াইয়া পাছায় আর কুচকিতে ঘইষ্যা দেই।’
একজন বলে, ‘মনে অয় এই দুই ব্যাডা আঁউকড়া লাগনে দৌড় দিয়া পলাইতে পারে নাই। ধানখেতের মইদ্যে হুতি দিয়া পলাইয়া আঁউকড়া ছাড়াইতে আছিল।’
‘হ, ওরা যেইখানে পলাইছিল, হেইখানে ধানখেতের মইদ্যে তিন-চাইড্ডা আঁউকড়া দেখছি আমি।’ আর একজন বলে।
আরশেদ মোল্লার রান পরীক্ষা করে দেখে কদম শিকারি ও জাবেদ লশকর। সত্যি রানটা আঁকড়ির আঁচড়ে সাংঘাতিকভাবে ছড়ে গেছে।
ফজল ছেড়ে দিতে বলেছে। সুতরাং আরশেদ মোল্লাকে আর আটকে রাখা ঠিক নয়। ওদের দলের যে নৌকাটা ডুবে গিয়েছিল সেটাকে পানি থেকে তুলে তাতে উঠিয়ে দেয়া হয় আরশেদ মোল্লাকে। নৌকার মাথি ধরে ধাক্কা দিতে দিতে জাবেদ লশকর বলে, ‘মাইয়া দিয়া যাবি, ওয়াদা করছস। ওয়াদা যেন ঠিক থাকে। নাইলে কিন্তু চউখ দুইডা ঘুইট্যা দিমু যেইহানে পাই।’