পাঁচদিন পর ফজল খবর পায় প্রতিপক্ষ ঘর পোড়ানোর এজাহার দিতে পারেনি, কারণ তাদের মিথ্যা কারসাজি বড় দারোগার জেরার চোটে ধরা পড়ে গিয়েছিল।
গত কয়েকদিন বড় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটিয়েছে ফজল ও তার দলের লোকজন। মস্ত বড় একটা বিপদ কেটে যাওয়ায় তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, আনন্দে উল্লসিত হয়। কারো মুখে গালাগালির তুবড়ি ছোটে জঙ্গুরুল্লার উদ্দেশে। দিঘিরপাড় ছিল ফজলের চিত্তবিনোদনের একমাত্র স্থান। সেখানে দেখা হত তার খেলার সাথী আর স্কুলের বন্ধুদের সাথে, পেত নানা ঘটনার, বিভিন্ন জন-স্বজনের খবরাখবর। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গল্প গুজব করে মনটাকে তাজা করে, হাট-সওদা নিয়ে সে বাড়ি ফিরত। অন্যদিন না হলেও হাটের দিন সেখানে না গিয়ে সে থাকতে পারত না। অথচ গত আট-নয় মাসের মধ্যে সে একদিনও সেখানে যায় নি, যাওয়ার সুযোগ পায়নি।
বিপদ কেটে যাওয়ার পর থেকেই তার মনটা ছটফট করতে থাকে দিঘিরপাড় যাওয়ার জন্য। কিন্তু জঙ্গুরুল্লার দল কখন যে হামলা করে, ঠিক নেই কিছু।
দুদিন পরে দিঘিরপাড়ের হাট। এ দুদিনের ভেতর জঙ্গুরুল্লার সম্ভাব্য হামলার সংবাদ সংগ্রহ করতেই হবে তাকে।
সংবাদ পেয়েও যায় ফজল। প্রতিপক্ষের প্রস্তুতির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। সে আরো খবর পায়, চালের দর বেড়ে যাওয়ায় চরের গরিব চাষীদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেছে। তারা সাহায্যের জন্য যাচ্ছে জঙ্গুরুল্লার কাছে। সাহায্য করার নামে জঙ্গুরুল্লা তাদের দাদন দিচ্ছে। আমন ধান উঠলেই পাঁচ টাকা মন দরে তাকে ধান দিতে হবে দাদনের বিনিময়ে।
আজ দিঘিরপাড়ের হাট। প্রয়োজনীয় সওদাপাতির ফর্দ তৈরি করে চান্দু ও বক্করকে ডেকে নিয়ে সে ডিঙিতে উঠে।
চান্দু পাছায় আর বক্কর গলুইয়ে বসে বৈঠা টানছে।
‘এই চান্দু, আমার হাতে বৈঠা দে।’ ফজল বলে। ‘অনেকদিন নৌকা বাইনা। মাঝে মইদ্যে না বাইলে নৌকা বাওয়া ভুইল্যা যাইমু।’
‘এইখান দিয়াতো উজান। এট্টু পরেই ভাটির জাগায় গিয়া আপনের আতে–।’
‘আরে না, তুই এখনি দে। ভাটি পানিতে তো বেশি টানতে অয় না। হাইল ধইরা বইস্যা থাকলেই অয়।’
চান্দুর হাত থেকে বৈঠা নিয়ে জোরে জোরে টানতে থাকে ফজল।
কিছুদূর গিয়েই সে বাঁ দিকের খাড়িতে ঢুকিয়ে দেয় ডিঙিটা।
‘ঐ দিগে যান কই?’ চান্দু বলে। ‘ঐডা দিয়া গেলে তো বহুত ঘোরন লাগব। দাত্রার খড়ি দিয়া যান।’
‘একটু ঘুইর্যাই যাই। নলতার খাড়িতে শুনছি কুমির আছে। খাঁড়ির পশ্চিম দিগের চরে দুইডা কুমির বোলে রউদ পোয়াইতে আছিল।’
‘আমরা তো কোনো দিন হুনি নাই।’ বক্করের কথার ভেতর ঘোলাটে সন্দেহ।
‘আরে সব খবর কি সবার কানে আসে। তোরা পশ্চিম দিগের চরটার দিগে চউখ রাখিস।’
‘এহন তো শীতকাল না। আর রউদের তেজও খুব। কুমির কি এহন এই ঠাডা রউদে বইয়া রইছে?’
‘তবুও চউখ রাখিস তোরা। দ্যাখ্যা যাইতেও পারে। যদি দ্যাখ্যা যায় রে! দ্যাখা গেলে কি করমু জানস?’
‘কি করবেন?’ চান্দু জিজ্ঞেস করে।
‘ফান্দে আটকাইমু। কুমিরের ফান্দা ক্যামনে পাতে, তোরা দ্যাখছস কোনো দিন?’
‘উঁহু দেহি নাই।’
‘যেইখান দিয়া কুমির রউদ পোয়াইতে উপরে ওডে, সেইখানে তিন কাঁটাওলা বড় বড় অনেকগুলা গ্যারাফি বড়শি শন সুতার মোটা দড়িতে বাইন্দা লাইন কইর্যা পাততে অয়। দড়িগুলারে মাটির তল দিয়া দূরে উপরের দিগে নিয়া শক্ত খুঁডার লগে বাইন্দা রাখতে অয়। তারপর যখন কুমির রউদ পোয়াইতে চরের উপরে ওডে, তখন উলটাদিক তন দাবড় দিলে কুমির হরহর কইর্যা বড়শির উপর দিয়া দৌড় মারে পানির দিগে। ব্যস কুমিরের ঠ্যাঙ্গে, প্যাডে বড়শি গাঁইথ্যা যায়। আমি কুট্টিকালে দেখছি, বা’জান একবার ফান্দা পাতছিল। একটা বড় আর একটা বাচ্চা কুমির বড়শিতে গাঁথছিল। বড়ডার ঠ্যাংঙ্গে আর ছোড্ডার প্যাডে।’
চান্দু ও বক্করের চোখ যখন পশ্চিম দিকের বালুচর, লটাবন, আর কাশবনে কুমিরের সন্ধানে ব্যস্ত তখন ফজলের চোখ জরিপ করছে সামনে পুবদিকের একটা বাড়ি। কলাগাছ ঘেরা বাড়িটা এখনো অনেক দূরে।
তার মনে আবার সেই গানের গুঞ্জরন শুরু হয়।
হলুদ শাড়ি-পরা এক তরুণী কলসি কাঁখে নদীর ঘাটে আসছে। দূর থেকে তাকে চেনা না গেলেও ফজল বুঝতে পারে, সে রূপজান ছাড়া আর কেউ নয়।
ফজল জোরে জোরে বৈঠায় টান মারে। কিন্তু ডিঙিটা অনেক দূরে থাকতেই তরুণীটি কলসিতে পানি ভরে বাড়ি চলে যায়। অদৃশ্য হয়ে যায় কলাগাছের আবডালে।
ইস্! আর কিছুক্ষণ আগে যদি সে রওনা দিত! ফজল নিজের ওপর বিরক্ত হয়। আর দশটা মিনিট আগে রওনা দিলেই ঐ বাড়ির ঘাটের কাছে পৌঁছতে পারত সে। দেখা হয়ে যেত রূপজানের সাথে।
কিন্তু দেখা হলেই বা কি করত ফজল? কি বলত রূপজানকে? রূপজানই বা তাকে কি বলত? ফজল বুঝতে পারে–শুধু চোখে চোখে কথা বলা যেত। চাতক-চোখের পিপাসা কি তাতে কমত, না বাড়ত?
ঠিকমত হাল না ধরায় ডিঙিটা হঠাৎ ঘুরে যাচ্ছিল। ফজল সংবিৎ ফিরে পেয়ে বৈঠার টানে ডিঙিটা সোজা করে। হাল ঠিক রেখে বেয়ে যায় সামনের দিকে।
‘তোরা কুমিরের সন্ধান পাইছসনিরে?’ ফজলের মনে কৌতুক, কিন্তু গলার স্বরে কপট গাম্ভীর্য।
‘না, এহন কি আর দ্যাহা যাইব।’ বক্কর বলে।
‘একটা হাঁস আইন্যা কিনারে বাইন্দা থুইলে কেমন অয়? হাঁসের প্যাক-প্যাক শোনলে কুমিরগুলা ভাইস্যা ওঠব খাওনের লেইগ্যা।’
ফজল আর বৈঠা টানছে না এখন। শুধু হাল ধরে বসে থাকে। তার আশা প্রবল বাসনা হয়ে রূপজানের প্রতীক্ষা করে। কিন্তু সে আর নদীর ঘাটে আসে না।
ডিঙিটা রূপজানদের ঘাট ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফজল বৈঠা না টানলে কি হবে। আগা গলুইয়ে বসে বক্করতো টেনেই চলেছে তার বৈঠা। তাকে তো আর বৈঠা টানতে মানা করা যায় না।
ফজল কিছুক্ষণ পর পর ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে দিকে তাকায়। তাকাতে গিয়ে তার ঘাড়ে ব্যথা ধরে যায়। কিন্তু রূপজানকে আর ঘাটে আসতে দেখা যায় না।
দিঘিরপাড় পৌঁছতেই পরিচিত লোকজন, বন্ধু-বান্ধব ফজলকে স্বাগত জানায়। কেউ কেউ তাকে আবেগভরে বুকে জড়িয়ে ধরে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ডাকাতি মামলার এজাহার দিয়ে তাকে হাজতে পাঠানো, জোর করে তালাকনামায় তার টিপ নেয়া, খুনের চরের দখল বেদখল-পুনর্দখলের ঘটনাবলি, তার বিরুদ্ধে ঘর-পোড়ানো মামলা সাজানোর কারসাজি সবই তারা শুনেছে। শুনে তাদের মনে সমবেদনা ও সহানুভূতি জেগেছে। কে একজন বলে, ‘পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা বড় বাইড়া গেছিল। মানুষেরে মানুষ বুইল্লা গিয়ান করে নাই। এইবার ফজল মিয়া ওর মিরদিনা ভাইঙ্গা দিছে। ঘোলাপানি খাওয়াইয়া ঠাণ্ডা করছে।’
দিঘিরপাড়ে চর আর আসুলির জেদাজেদির হা-ডু-ডু খেলার দিন দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে ছিল উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা। তার খেলা দেখে সেদিন তারা চমকৃত হয়েছিল। বহুলোক, বিশেষ করে চরের কিশোর-তরুণ-যুবকের দল তার ভক্ত। সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। কুচক্রী জঙ্গুরুল্লার হাত থেকে খুনের চর উদ্ধার করার জন্য সবাই তার ওপর খুশি। তারা তার বাহাদুরির প্রশংসা করে। উত্তরের প্রত্যাশা না করে নানা প্রশ্ন করে।
আক্কেল হালদার বাইরে কোথাও গিয়েছিল। এসে ফজলের পরিচয় পেয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, সমাদরের সাথে তার গদিতে নিয়ে যায়। থালা ভরে হরেক রকম মিষ্টি এনে তাকে আপ্যায়ন করে। খেলার তারিখ দিয়ে কেন সে অনুপস্থিত ছিল তার বৃত্তান্ত সে ফজলকে বলে : দক্ষিণপাড় থেকে পাঁচজন নামকরা খেলোয়াড় নিয়ে নৌকা করে ফিরছিল আক্কেল হালদার। পথে তারা গাঙডাকাতের হাতে পড়ে। ডাকাতের ছোরার আঘাতে সে নিজে ও তিনজন খেলোয়াড় আহত হয়।
বিকেল হয়ে গেছে। ফজল চান্দুকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সওদাপাতি কিনে নৌকাঘাটায় আসে।
তাদের ডিঙির কাছে দাঁড়িয়ে বক্করের সাথে কথা বলছে একটা লোক। তার মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। চুল উষ্কখুষ্ক বিমর্ষ মলিন মুখ। চোখে অসহায় দৃষ্টি। ফজলকে দেখেই লোকটা ডান হাত কপালে ঠেকায়, ‘আস্সালামালেকুম মিয়াভাই, আমারে চিনছেন নি?’
‘কে? তুমি হেকমত না?’
‘হ, মিয়াভাই। কেমুন আছেন?’
‘ভালই আছি। তুমি কেমন আছ? কইতন আইলা?’
‘আমাগ থাকন আর না থাকন হমান কথা। এহন তো আইলাম হাটেরতন। থাকি অনেক দূরে।’
‘কই যাইবা?’
‘বাড়ি যাইমু। বাড়ির কাছের একটা নাও-ও পাইলাম না। আমারে এট্টু লইয়া যাইবেন আপনাগ নায়?’
‘তোমার বাড়িতে অনেক দক্ষিণে। আমরা তো ঐ দিগ দিয়া যাইমু না।’
‘বেশি দূর যাওন লাগব না। আমারে ধলছত্রের কোণায় নামাইয়া দিলে যাইতে পারমু।’
‘আইচ্ছা ওঠ নায়।’
ফজল ও চান্দু নৌকায় ওঠে। তাদের পেছনে ওঠে হেকমত।
‘এই চান্দু, এই বক্কর, নাও ছাইড়া দে তাড়াতাড়ি।’ ফজল তাগিদ দেয়। ‘আইজ বাড়িত যাইতে রাইত অইয়া যাইব।’
‘হ, উজান বাইয়া যাইতে দেরি তো অইবই।’ চান্দু বলে।
উজান স্রোত ভেঙে ছলচ্ছল শব্দ করে ডিঙিটা এগিয়ে চলে।
‘মিয়াভাই, আইজ হাটে আপনের খুব তারিফ হোনলাম।’ হেকমত বলে। ‘মাইনষে কইতে আছিল–অ্যাকটা মর্দের মতো মর্দ। বাপের ব্যাডা। জঙ্গুরুল্লা ওনার বাপ-দাদার সম্পত্তি খাবলা দিয়া গিল্যা ফালাইছিল। কিন্তু ওরে ঐ সম্পত্তি আর অজম করতে দেয় নাই। প্যাডের মইদ্যেরতন টাইন্যা বাইর করছে।’
কেউ কোনো কথা বলে না অনেকক্ষণ।
নীরবতা ভেঙে এক সময়ে ফজল জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি করো এখন?’
‘কী আর করমু। হগলেই তো জানে আমি কী করি। আপনেওতো জানেন। জানেন না?’
‘হ, শুনছিলাম। কিন্তু এই কাম ছাইড়া দিতে পারো না? হালাল রুজি কইর্যা খাওনা ক্যান?’
‘হালাল রুজি করনের কি আর উপায় আছে? আমি এক মহাজনের কাছে বান্দা।’
‘মহাজন! কিসের আবার মহাজন?’
‘থইলতদার। কাপড়ে-চোপড়ে ভর্দ লোক, গেরামের সর্মানী লোক। তারেই আমরা কই মহাজন। বড় দাপটের মহাজন?’
‘তার কাছে বান্দা ক্যান্?’
‘সে অনেক বিত্তান্ত। আমাগ মালপত্র সে সামলাইয়া রাখে। বেইচ্যা যা পায় আমাগ কিছু দ্যায় আর বেবাক ওনার প্যাডে যায়। একবার ধরা পইড়া অনেকদিন হাজতে আছিলাম। উনি বলে ছয়শ ট্যাহা খরচ করছিল আমারে ছাড়াইয়া আনতে। আপনের কাছে গোপন করমু না। হেরপর কত কত চুরি করলাম, কত কত মাল-মাত্তা আইন্যা দিলাম। কিন্তু ঐ ট্যাহা বলে শোদই অয় না। দুই-দুই বার পলাইছিলাম। দুইবারই তার পোষা গুণ্ডা দিয়া ধইর্যা নিছে। নিয়া হেইযে কী যন্ত্রণা দিছে কি কইমু আপনেরে। পিঠমোড়া বান দিয়া শরীলে বিছা ছাইড়া দিছে, শুঁয়াসম্বল ডইল্যা দিছে, পিডের উপরে বিড়ি নিবাইছে। এই দ্যাহেন।’
হেকমত গেঞ্জি খুলে পিঠ দেখায় ফজলকে। সারা পিঠে কালো কালো পোড়া দাগ।
‘এই দিগে বাড়িত গিয়াও শান্তি নাই। চকিদার-দফাদার খবর পাইলেই দৌড়াইয়া আহে। কয়-ফলনা মারানির পুত, অমুক বাড়িত চুরি করছস। চল থানায়। আমি চর অঞ্চলে এহন চুরি করি না। অথচ কোনোহানে চুরি অইলেই মাইনষে কয়–আর কে করব? হেকমইত্যার কাম। হের লেইগ্যা বাড়িতেও যাইতে ইচ্ছা করে না। মহাজনও বাড়িত যাইতে দ্যায় না। যদি ফির্যা না যাই। চুরির খোঁজ-খবর আননের নাম কইর্যা মিছা কতা কইয়া অনেকদিন পরপর বাড়িত যাই। অ্যাকদিনের বেশি থাকি না।’
হেকমত কোমরে লুঙ্গির প্যাঁচে গোঁজা একটা পুটলি বের করতে করতে বলে, ‘আমার শরীলের অবস্থাও ভাল না। শুলবেদনায় বড় কষ্ট পাই। বেদনা উঠলেই প্যাডেরে ঘুস দিতে অয়।’
হেকমত পাঁচ আঙ্গুলের মাথা দিয়ে পুঁটলি থেকে এক খাবলা সোডা তুলে বলে, ‘এইডা অইল ঘুস। প্যাডেরে ঘুস না দিলে ছাড়াছাড়ি নাই। এক্কেরে কাবিজ কইর্যা ফালায়।’
সে সোডা মুখে দিয়ে নদী থেকে আঁজলা ভরে পানি খায়।
ফজল নিবিষ্ট মনে শুনছিল হেকমতের সব কথা। যে হেকমতের কথা মনে এলে ঘৃণায় তার সমস্ত শরীর কুঁচকে উঠত, সেই হেকমতের জন্য তার বুক ব্যথায় ভরে ওঠে, তার হৃদয়ে দরদ ও সহানুভূতি জাগে। সে বেদনা-বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে হেকমতের দিকে। কথা বলতে পারে না।
অনেকক্ষণ পরে সে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার মহাজন কোথায় থাকে? কী নাম তার?’
‘নাম দিয়া কি করবেন? উদ্দার করতে পারবেন আমারে?’
‘দেখি পারি কি না।’
‘কিন্তুক বাড়িত্ আইয়া করমু কি? অ্যাক নল জমিও তো নাই। পারবেন আমারে কিছু জমি দিতে?’
‘তুমি যদি ভাল অইয়া যাও, তয় আমি কথা দিলাম, এই পদ্মার উপরে বইস্যা কথা দিলাম, তোমারে আমি জমি দিমু। এইবার কও কী নাম তোমার মহাজনের।’
‘আইজ থাউক, মিয়াভাই। দুই-অ্যাক দিনের মইদ্যে আপনের বাড়িত গিয়া কানে কানে কইয়া আইমু।’
‘তোমার থলির মইদ্যে কী?’
‘কয় সের চাউল। চাউল এত মাংগা অইয়া গেল ক্যান, মিয়াভাই? ট্যাহায় তিন সের। তা-ও আবার চাউলের মইদ্যে ধান আর আখালি।’
‘ধলছত্রের কাছে আইয়া পড়ছি।’ বক্কর বলে। ‘আপনে কোহানে নামবেন?’
‘ঐ সামনের ঢোনে নামাইয়া দ্যান।’
‘আন্দারের মইদ্যে যাইতে পরবা তো?’ ফজল জিজ্ঞেস করে।
হেকমত হেসে উঠে বলে, ‘আমরাতো আন্দারেরই মানুষ। রাইতের আন্দারই আমাগ পথ দ্যাহায়।’
হেকমতকে নামিয়ে দিয়ে ডিঙিটা খুনের চরের দিকে এগিয়ে যায়। ফজল তাকিয়ে থাকে পেছনের দিকে, যেদিন দিয়ে যেতে যেতে হেকমত মিশে যায় রাতের অন্ধকারে।