খুনের চর থেকে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেই বিছানা নিয়েছিল আরশেদ মোল্লা। অপমানের গ্লানির চেয়ে ভবিষ্যতের ভাবনা তাকে আরো বেশি মুসড়ে দিয়েছিল।
বেচকচরে বিঘা সাতেক জমি ছিল তার। গত বর্ষার আগের বর্ষায় বিঘা তিনেক পদ্মার জঠরে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি চার বিঘা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে গত বর্ষায়। খুনের চরে জঙ্গুরুল্লা তাকে কুড়ি নল–প্রায় এগারো বিঘা জমি দিয়েছিল। অনেক আশা নিয়ে সে রুয়েছিল কনকতারা ধান। সেই চরও বেদখল হয়ে গেছে। বসতভিটা ছাড়া আর এক কড়া জমিও তার নেই। এদিকে চালের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে সে যে কোথায় যাবে, কি করবে, কি খাবে তার কুল-কিনারা করতে পারছিল না, বাঁচবার কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
সোনাইবিবিই শেষে তাকে একটা পথের সন্ধান দেয়। তার সাবেক মনিব ল্যাম্বার্ট সায়েব হয়ত এখনো আছেন নারায়ণগঞ্জে। তাঁর কাছে গেলে তিনি হয়ত তাঁর কুঠিরে বা পাটের গুদামে কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন।
আশা-নিরাশায় দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে আরশেদ মোল্লা নারায়ণগঞ্জ চলে গেছে আজ দশ দিন। এখনো সে ফিরে আসছে না কেন বুঝতে পারে না সোনাইবিবি।
সন্দেহের দোলায় দুলছে তারও মন। সায়েব কি তাদের এ দুর্দিনে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন? কোনো সাহায্যই কি করবেন না?
সায়েব ও মেমসায়েব দু’জনই তাকে খুব স্নেহ করতেন। মালীর মেয়ে বলে এতটুকু ঘৃণা বা অবজ্ঞা করতেন না। তাঁদের চোখের সামনেই সে বড় হয়ে উঠছিল। খঞ্জন পাখির মতো সে লাফিয়ে বেড়াত সারা বাড়ি। দোলনায় দোল খেত। তাদের পোষা ময়নার সাথে কথা বলত। ফুল-পাতা ছিঁড়ে ফুলদানি সাজাত। কলের গান বাজাত। তার বিয়েতে তাঁরা অনেক টাকা খরচ করেছিলেন। বরকে যৌতুক দিয়েছিলেন নগদ দু’হাজার টাকা।
সোনাইবিবির স্পষ্ট মনে আছে, চাঁদ রায়-কেদার রায়ের কীর্তি রাজবাড়ির মঠ যেদিন পদ্মার উদরে বিলীন হয়ে যায়, তার ঠিক চারদিন আগে আরশেদ মোল্লা তাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল বেহেরপাড়া। তার চোখের সামনেই সে মঠটা কাত হয়ে নদীতে পড়তে দেখেছে। পড়ার সাথে সাথে বিশাল উত্তাল ঢেউ উঠেছিল। মঠবাসী হাজার হাজার পাখি উড়ছিল আর আর্তচিৎকার করছিল।
তার বছর তিনেক পর তার মা চন্দ্রভানের মৃত্যুর খবর পেয়ে সে স্বামীর সাথে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে শুনতে পায় ল্যাম্বার্টদের একমাত্র সন্তান স্টিফেন বাপ মায়ের সাথে রাগ করে উড়োজাহাজে চাকরি নিয়েছিল। উড়োজাহাজ চালিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার সময় সে সাগরে ডুবে মারা গেছে। একটা অব্যক্ত বেদনায় সোনাভানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল।
দুবছরের রূপজানকে কোলে নিয়ে সোনাভান মেমসায়েবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তিনি শিশুটির দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর ওকে সস্নেহে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তক্ষুনি ড্রাইভার পাঠিয়ে ওর জন্য দোকান থেকে দামি কাপড় ও খেলনা আনিয়েছিলেন। ওর মুখে শরীরে পাউডার লাগিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন। নতুন ফ্রক পরিয়ে তাকে কোলে নিয়ে গিয়েছিলেন সায়েবের ঘরে। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘মা, সোনাই, তোর মেইয়াটা আমাকে দিয়া দে। আমি পালবো। আমার তো আর কেউ নাইরে, মা!’
সোনাভান চুপ করে ছিল। শোকার্ত মায়ের অন্তরের আকুতিকে সে মুখের ওপর ‘না’ বলে রূঢ় আঘাত হানতে পারেনি। মেমসায়েব তার মুখ দেখে ঠিকই বুঝেছিলেন, তার মৌনতা সম্মতির বিপরীত লক্ষণ। তাই এ সম্বন্ধে আর কিছু না বলে তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘তোর সোয়ামিরে লইয়া কাল ভোরে আমার সঙ্গে দেখা করিস।’
সোনাভান আশঙ্কা করেছিল, আগামীকালও এই একই প্রস্তাব আসতে পারে। প্রস্তাবের সাথে আসতে পারে অনেক টাকার প্রলোভনও। আরশেদ মোল্লা যে রকম টাকার লোভী, সে কিছুতেই এ সুযোগ পায়ে ঠেলে দেবে বলে তার মনে হয়নি। তাই সে স্বামীর কাছে কিছুই বলেনি। তাকে তাড়া দিয়ে সেদিনই রাতের স্টিমারে রওনা দিয়ে পরের দিন তারা রাজবাড়ি স্টেশনে এসে নেমেছিল।
মেমসায়েব তার এ অবাধ্য আচরণে নিশ্চয়ই খুব রুষ্ট হয়েছিলেন, বুঝতে পেরেছিল সোনাভান। তার মনে পুষে রাখা সে রাগ কি এতদিনেও মরে যায়নি।
তারও সাত-আট বছর পর আর একবার সে স্বামীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিল তার বাপের মৃত্যুর সময়। সেবার সে রূপজানকে সাথে নিয়ে যায়নি। এমন কি সায়েবের কুঠিতেও যায়নি। যেমন চুপিচুপি গিয়েছিল তেমনি চুপিচুপি তারা আবার ফিরে এসেছিল। তার মনে সব সময় একটা ভয় ছিল–মেমসায়েব হয় তো রূপজানকে নিজের কাছে রাখার জন্য জোরাজুরি করবেন।
তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। সেদিনের সোনাভান বয়সের ভারে এখন সোনাইবিবি হয়েছে। সে হিসেব করে দেখে রূপজানকে নিয়ে মেম সায়েবের কাছ থেকে চলে আসার পর ষোল বছর পার হয়ে গেছে। সায়েব-মেম বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন, নারায়ণগঞ্জে আছেন, না বিলেত চলে গেছেন–কোনো খবরই তারা রাখে না।
স্বামীর ফিরে আসতে দেরি দেখে সোনাইবিবিরি মনে হয়, সায়েব ও মেম দু’জনই বা তাদের একজন অন্তত বেঁচে আছেন এবং নারায়ণগঞ্জেই আছেন। তাঁদের কেউ না থাকলে আরশেদ মোল্লার এত দেরি হওয়ার কথা নয়। সে তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে আসত।
এদিকে জঙ্গুরুল্লা রোজ দু’বার সকালে ও বিকেলে তোক পাঠিয়ে খবর নিচ্ছে, আরশেদ মোল্লা ফিরে এসেছে কিনা। প্রথম দিন কোরবান ঢালী এসেছিল চার-পাঁচজন লোক নিয়ে। তাদের সে কি হম্বি-তম্বি। তারা আরশেদ মোল্লাকে না পেয়ে জঙ্গুরুল্লার হুকুমে তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সোনাইবিবি ঘোমটার আড়াল থেকে কথার আঘাত মেরে তাদের এমন ধুনে দিয়েছিল যে তারা মা-বোনদের মর্যাদাহানিকর কোনো কথা বলতে আর সাহস পায়নি তারপর।
জঙ্গুরুল্লার লোক রোজই জানতে চায়, আরশেদ মোল্লা কোথায় গেছে। একমাত্র সোনাইবিবিই জানে সে কোথায় গেছে। কিন্তু সে একই কথা বলে তাদের বিদেয় করে, ‘কই গেছে বাড়িতে কিছু কইয়া যায় নাই।’
দুদিন আগে এদের কাছেই সোনাইবিবি শুনেছে–জঙ্গুরুল্লা ভাগ্যকূল গেছে। সেখান থেকে পীরবাবাকে নিয়ে সে দু-এক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। পীরবাবা এসে গেলেই রূপজানের সাথে তার বিয়ের শুভকাজটা সম্পন্ন করার জন্য জঙ্গুরুল্লা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে।
কিন্তু পীরবাবার জাদু-টোনায় কোনো কাজই যে হয়নি, কোনো আছরই যে পড়েনি রূপজানের ওপর! পীরের কথা সে শুনতেই পারে না। ফজল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছে এবং খুনের চর আবার দখল করেছে শুনে সে যে কী খুশি হয়েছে, তা তার চলনে বলনে স্পষ্ট বোঝা যায়। সে আজকাল বিনা সাধাসাধিতেই খায়-দায়-ঘুমায়, মাথা আঁচড়ায়, সাজগোজ করে।
বারো দিন পর বাড়ি ফিরে আসে আরশেদ মোল্লা। আসে সারা মুখে খুশির জোছনা মেখে। সায়েব-মেম দুজনেই বেঁচে আছেন এবং ভাল আছেন, কিন্তু বেশ বুড়িয়ে গেছেন। সে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে শোনে, সায়েব-মেম দুজনেই কলকাতা গেছেন। তাদের আসার অপেক্ষায় ছিল বলেই তার বাড়ি ফিরতে এত দেরি হয়েছে। কুঠিতে আগেকার বাবুর্চি-খানসামারাই কাজ করছে এখনো। তাদের সাথেই সে ছিল এ কদিন। নিতাইগঞ্জের দুটো গুদাম ছাড়া ল্যাম্ব্যার্ট জুট কোম্পানীর সবগুলো গুদাম এখন মিলিটারির দখলে। তারা সেগুলোর মধ্যে যুদ্ধের রসদ মজুদ করেছে। সোডা-ওয়াটার কারখানাটা দেড় বছর ধরে বন্ধ। ম্যানেজার নাকি অনেক টাকা মেরে নিয়ে উধাও হয়েছে।
‘আমারে দেইখ্যা, সায়েব-মেম পরথর চিনতেই পারে নাই।’ আরশেদ মোল্লা বলে।
‘চিনব ক্যামনে?’ সোনাইবিবি বলে। ‘তহনতো ওনার দাড়ি আছিল না। দাড়ির লেইগ্যা চিনতে পারে নাই।’
‘হ ঠিকই। নাম বললাম পর তারা এত খুশি অইছে যে কি কইমু! জানো, আমাগ বিচরাইতে সায়েব মানুষ পাডাইছিল বেহেরপাড়া। তারা ফিরত গিয়া সায়েবরে কইছে, বেহেরপাড়া নামে একটা গেরাম আছিল। হেই গেরাম এহন পদ্মার প্যাডের মইদ্যে। গেরামের মানুষ কে যে কুনখানে গেছে কেউ কইতে পারে না।’
‘হ, ঠিক অইত, বেহেরপাড়ারতন গেলাম চাঁচরতলা, হেইখানতন চাকমখোলা। তারপর আইলাম এই নলতা। এতবার গাঙ্গে ভাঙলে মাইনষে বিচরাইয়া পাইব ক্যামনে?’
‘তারা রূপুর কথা বারবার জিগাইছে। রূপু কত বড় অইছে। যহন বললাম, ওর বিয়া দিয়া দিছি, তহন দুইজনের কী রাগ! মেমসাহ কয়–আমারে এই খবরও দিলি না, নিমকহারাম। কার লগে বিয়া দিছস? যহন কইলাম, বড় একজন মাতবরের পোলার লগে বিয়া দিছি। জামাই নিজেই এহন মাতবর, তহন রাগটা এট্টু কমছে। মেমসাব আরো কইছে– বিয়ার খবর পাইলে ওর বিয়ার খরচ-পাত্তি সোনা-গয়না আমিই দিতাম। রূপুরে আর জামাইরে বেড়াইতে যাইতে কইছে। ওগ যাওনের ভাড়া দুইশ ট্যাহা দিয়া দিছে। ওরা গেলে মনে অয় অনেক ট্যাহা-পয়সা দিব, সোনা-গয়না দিব।’
‘ইস। মাইনষের কী লোভ। কিন্তুক মিথ্যা কতা কইয়া আইছে ক্যান? মাইয়ার তালাক লইছে, হেই কতা ক্যান্ কয় নাই?’
‘হোন রূপুর মা, তোমারে তো কই নাই। রূপুরে মাতবর বাড়ি দিয়া আইমু–এই ওয়াদা কইর্যা আইছিলাম খুনের চর ছাইড়া দিয়া আহনের সময়। তুমি কাইল ওরে লইয়া যাইও মাতবর বাড়ি। বিয়াই বাইচ্যা থাকলে আমিই যাইতাম।’
‘কিন্তুক তালাক লওয়া মাইয়া ক্যামনে আবার দিয়া আইমু?’
‘হোন, জোর কইর্যা তালাক নিছিলাম। ঐ তালাক জায়েজ অয় নাই। আমি মুনশি মৌলবিগ জিগাইছিলাম।’
‘কিন্তু পা-না-ধোয়া গোঁয়ারডা কি এমনে এমনে ছাইড়া দিব! হে পীরবাবারে আনতে গেছে। লইয়াও আইছে মনে অয়। দিনের মইদ্যে দুইবার ওনার খবর লইতে আছে তার মানুষজন। আরেটু পরেই আবার আইয়া পড়ব।’
‘হোন, আমি ঘরের মইদ্যে পলাইয়া থাকমু। ওরা আইলে কইও উনি এহনো আহে নাই। তারপর কাইল রাইত থাকতে তুমি রূপুরে সাথে লইয়া দিয়া আইও মাতবর বাড়ি। তুমি ফির্যা আইলে ঘরে তালা দিয়া আমরা কাইলই চইল্যা যাইমু নারায়ণগঞ্জ। জঙ্গুরুল্লা আর আমাগ কিছু করতে পারব না।’
‘নারায়ণগঞ্জ যাইব, কিন্তুক কাম-কাইজের কতাত কিছু হুনলাম না।’
‘কাম ঠিক অইয়া গেছে। ঐ সোডা-ওয়াটার কারখানা আমারে চালু করতে কইছে সায়েব। উনিই টাকা-পয়সা দিব। এহন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বিদেশী সৈন্যে ভইরা গেছে। তাগো সরাব খাইতে সোডার পানি লাগে, সায়েব কইছে সোডারপানি এহন খুব চলব। সায়েব কইছে লাভের অর্ধেক আমার। আমাগ থাকনের লেইগ্যা ঘরও ঠিক কইরা দিছে। যাওনের খরচ দিছে তিনশ ট্যাহা। আরো দুইশ দিছে রূপু আর জামাইর যাওনের খরচ।’
‘তয় আর দেরি করণের কাম নাই। ঐ দিগে খবর হুনছে? মোখে কাঁপোড় বাইন্দা তিনডা ব্যাডা হেকমইত্যা চোরার বউরে বাড়িরতন জোর কইরা ধইর্যা লইয়া গেছে। বউডার আর কোনো খোঁজ-খবর নাই। মাইনষে কয় জঙ্গুরুল্লার লোক বউডারে কাইট্যা গাঙ্গে ফালাইয়া দিছে।’
‘ক্যাঁ?’
‘ও, উনিতে হুইন্যা যায় নাই! হেকমইত্যা চোরা আতাইয়া বাইল্যা মাছ ধরতে গেছিল। গদে আত দিয়া আত আর টাইন্যা বাইর করতে পারে নাই। মইর্যা রইছিল পানি তলে। জঙ্গুরুল্লা ঐ লাশ দ্যাহাইয়া খুনের মামলা দিতে চাইছিল ফজলের বিরুদ্ধে। কিন্তু বউডা সত্য কতা কইছে। জঙ্গুরুল্লার কতা মতন দারোগা-পুলিসের কাছে সাক্ষী দেয় নাই বুইল্যা মামলা টিকাইতে পারে নাই। এই রাগে।’
‘এই কয়দিনের মইদ্যে এত কিছু অইয়া গেছে! হোন রূপুর মা, আর দেরি করণ যাইব না। রূপুরে মাতবর বাড়ি দিয়া কাইলই আমরা নারায়ণগঞ্জ চাইল্যা যাইমু।’
‘হ, কাইলই যাওন লাগব। উনি এহন আফারে উইট্যা পলাইয়া থাকুক গিয়া।’
সন্ধ্যার একটু পরেই সাতজন গাট্টাগোট্টা লোক নিঃশব্দে গিয়ে হাজির হয় আরশেদ মোল্লার বাড়ি। তাদের মাথার ফেটা ভুরু পর্যন্ত নামানো। চোখ বাদ দিয়ে সারা মুখ গামছা দিয়া বাঁধা। একজনের মুখমণ্ডল গামছার বদলে সাদা রূমাল দিয়ে বাঁধা। তাদের তিনজনের হাতে ঢাল-শড়কি, দুজনের হাতে ঢাল-রামদা আর দুজনের হাতে লাঠি ও টর্চলাইট। তারা পা টিপে টিপে উত্তর ভিটি ঘরের সামনের দরজার কাছে গিয়ে হাতিয়ারগুলো ঘরের পিড়ার নিচে নামিয়ে রাখে আলগোছে।
ঘরের দরজা বন্ধ। লাল গামছায় মুখ-বাঁধা দলের একজন ডাক দেয়, ‘মোল্লার পো ঘরে আছেন নি?’
‘ক্যাডা?’ ভেতর থেকে সাড়া দেয় সোনাইবিবি।
‘জঙ্গুরুল্লা চদরী সাব আমাগ পাডাইছে।’
‘উনিতো এহনো বাড়িত আহে নাই।’
‘কই গেছে?’
‘কই গেছে, কিছু কইয়া যায় নাই।’
‘হোনেন, আমাগ পাইছে আপনেগ নেওনের লেইগ্যা। পীরবাবা আইয়া পড়ছে। আইজ বোলে ভাল দিন আছে। আইজই কলমা পড়ান লাগব।’
‘উনিতো বাড়ি নাই।’
‘উনি বাড়ি নাই, আপনে তো আছেন। আমাগ কইয়া দিছে, মোল্লার পো না থাকলে আপনেরে লইয়া যাইতে। মাইয়া লইয়া, পোলাপান লইয়া চলেন শিগগির।’
‘না, আমরা যাইতে পারমু না।’
‘হোনেন চাচি, আমরা হুকুমের গোলাম। আমাগ কইছে ভালয় ভালয় না গেলে ধইর্যা উকাইয়া লইয়া যাইতে।’
‘গোলামের ঘরের গোলামরা কয় কি। তোগ ঘরে কি মা-বইন নাই?’
‘দ্যাহেন, গালাগালি দিয়েন না। ভাল অইব না।’
‘এক শত্ বার দিমু। তোগ মা-বইনের নিয়া নিকা দে পীরের লগে। আরেক জনের বিয়াতো বউরে ক্যামনে আবার বিয়া দিতে চায় পা-না-ধোয়া শয়তান।’
‘আরেকজন তো তালাক দিয়া দিছে।’
‘না, জোর কইর্যা তালাক লইছে। ঐডা তালাক অয় নাই।’
‘আমরা কিছু হুনতে চাই না। মাইয়া বাইর কইর্যা দ্যান। আপনেও চলেন পোলাপান লইয়া। পীরবাবা বিয়ার পাগড়ি মাতায় দিয়া বইয়া রইছে।’
‘না, আমরা যাইমু না।’
‘শিগগির দরজা খোলেন। নাইলে লাইথ্যাইয়া দরজা ভাইঙ্গা ফালাইমু।’
লাল গামছাধারীর নির্দেশে নিজ নিজ হাতিয়ার হাতে নেয় সবাই।
পশ্চিম ভিটি ঘরের বাতি নিবে যায় হঠাৎ—
সবুজ গামছাধারী একজন দরজায় লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে। কয়েকটি ছোট ছেলে-মেয়ে কেঁদে ওঠে ভয়ে।
একজন টর্চ হাতে আর একজন রামদা হাতে ঘরে ঢোকে। টর্চ মেরে তারা রূপজানের খোঁজ করে।
সোনাইবিবি বলে, ‘মাইয়া নাই। জামাই আইয়া লইয়া গেছে।’
‘মিছা কথা কওনের আর জায়গা পাওনা বেডি!’
‘মিছা কতা কিরে।’ রামদা দেখেও সে ঘাবড়ায় না এতটুকু। তার ঘোমটার ভেতর থেকে গালাগালের ভিমরুল ছুটে আসে। কিন্তু লোকগুলো তা গ্রাহ্যের মধ্যেই নেয় না। তারা টর্চ মেরে চৌকির তলা, ধানের ডোল ইত্যাদি খুঁজতে থাকে।
হৈ-চৈ শুনে ডাকাত পড়েছে মনে করে আশপাশের লোক এগিয়ে আসছে এদিকে। যারা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তারা চারদিকে টর্চের আলো ফেলে। একজন চিৎকার দিয়ে বলে, ‘খবরদার! এই দিগে আইলে গুলি মাইরা দিমু। যার যার বাড়ি যাও। দরজা বন্দ কইর্যা হুইয়া পড় গিয়া।’
আফারে উঠবার ফাঁকা জায়গা দিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই আরশেদ মোল্লা বুঝতে পারে, আর লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। সে আফার থেকে বলে, ‘খবরদার মাইয়া লোকের গায় আত দিও না। আমি আইতে আছি।’
সে নিচে নেমে বলে, ‘মাইয়া বাড়িত নাই। জামাই আইয়া লইয়া গেছে। আইছেন যহন বিচরাইয়া দ্যাহেন।’
সবুজ গামছাধারী টর্চ মেরে তন্নতন্ন করে খোঁজে। আফারে উঠে তালাশ করে, কিন্তু রূপজানকে পাওয়া যায় না।
বাইরে থেকে লাল গামছাধারী বলে, ‘আরে তোরা আইয়া পড়। কুনখানে আছে বোঝতে পারছি।’
তারা পশ্চিমভিটি ঘর ঘিরে ফেলে। ঘরের দুটো দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ। ‘ঘরে কে আছে, দরজা খোলো।’
কেউ দরজা খুলছে না দেখে লাল গামছাধারী দমাদম লাথি মারে দরজার ওপর। অর্গল ভেঙ্গে দরজা খুলে যায় আর অমনি ভেতর থেকে শিশি, বোতল, খোঁড়া, বাটি ছুটে আসে লোকগুলোর দিকে। তারা ঢাল দিয়ে সেগুলো ফিরিয়ে আত্মরক্ষা করে। টর্চের আলোয় দেখা যায় রূপজান মরিয়া হয়ে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে মারছে।
‘আরে বোবা মিয়াভাই, ধরেন শিগগির।’ লাল গামছাধারী বলে। ‘আমাগো মাথা ভাইঙ্গা ফালাইব।’
মুখে সাদা রুমাল-বাঁধা লোকটা ঢাল দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে এগিয়ে যায়।
রূপজান চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘খবরদার আউগ্গাইস্ না। দাও দ্যাখছস্, জবাই কইরা ফালাইমু।’
বোবা লোকটি এগিয়ে যায়। অন্য একজন লাঠির বাড়ি দিয়ে রূপজানের হাত থেকে দাটা ফেলে দেয়। সে এবার পেছনের দরজা খুলে নদীর দিকে দৌড় দেয়।
টর্চের আলো অনুসরণ করছে রূপজানকে। সাতজনই এবার তার পেছনে ধাওয়া করে।
শাড়ির আঁচলে পা আটকে রূপজান মাটিতে পড়ে যায়। তার ওপর টর্চের আলো ফেলে। সবুজ গামছাধারী বলে, ‘ও বোবা মিয়াভাই, ধরেন জলদি। আমাগ তো আবার ধরন মানা।’
বোবা লোকটি রূপজানকে ধরে ফেলে।
‘অ্যাই গোলামের ঘরের গোলাম, খবরদার আমার গায়ে আত দিস না।’
‘আরে বাবা মিয়াভাই, পাতালি কোলে কইর্যা উড়াইয়া ফালান।’
বোবা লোকটা রূপজানকে পাঁজাকোলা করে নদীর দিকে এগিয়ে যায়।
রূপজান হাত-পা ছুঁড়ছে, গালাগাল দিচ্ছে, আর দুহাত দিয়ে খামচে দিচ্ছে বোবা লোকটার শরীর। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সে এগিয়েই যাচ্ছে। যেতে যেতে সে আঁ-আঁ আঁ শব্দ করে মাথা নেড়ে কিছু একটা ইশারা দেয়।
ইশারার ভাষা বুঝতে পেরে লাল গামছাধারী বলে, ‘আপনেরা নায় উইট্যা বহেন। আমি আরশেদ মোল্লারে দাওয়াত দিয়া আহি।’
রূপজানকে কোলে নিয়ে বোবা লোকটা নৌকায় ওঠে। কিন্তু রূপজানের আর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না এখন। সে মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছে।
লোকটা তাকে শুইয়ে দেয় পাটাতনের ওপর। স্খলিত আঁচল টেনে শরীর ঢেকে দেয়।
কিছুক্ষণ পর লাল গামছাধারী ফিরে এলে দুটো ডিঙি তাদের নিয়ে রওনা হয়।
অন্ধকারের মধ্যে কে একজন বলে ওঠে, ‘অ্যাই তোরা এইবার মোখের কাপড় খুইল্যা ফ্যাল। আন্ধারে আর কেও দ্যাখব না। তারা তো ঢাল নিতে চাস্ নাই। ঢাল না নিলে আইজ উপায় আছিল না।’
‘হ, শিশি-বোতল যেমনে উদ্দ মারতে আছিল, মাথা একজনেরও আস্ত থাকত না।’ আর একজন বলে।
‘হ মাথা ফাঁইট্টা চৌচির অইয়া যাইত।’ অন্য একজন বলে।
অন্ধকার কেটে ডিঙি দুটো এগিয়ে যায়। বোবা লোকটা সস্নেহে হাত বুলায় রূপজানের গালে, ‘কপালে, মাথায়।’
অল্প সময়ের মধ্যেই ডিঙি দুটো গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যায়। বোবা লোকটা রূপজানকে কোলে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে এগিয়ে যায় একটি বাড়ির দিকে। ঘরের কাছে গিয়ে বোবাটা হঠাৎ কথা বলে ওঠে, ‘ও মা, কই তুমি? শিগগির দরজা খোল। তোমার গয়নার মানুষটারে লইয়া আইছি।’
বরুবিবি দরজা খুলে দেয়। ফজল রূপজানকে শুইয়ে দেয় চৌকির বিছানায়।
‘আরে, এক্কেরে মাইরা লইয়া আইছস দেহি।’ ভীত কণ্ঠ বরুবিবির।
‘ও কিছু না। বেশ অইয়া গেছে। মোখে পানির ছিডা দ্যাও।’
‘ও আমিনা, জলদি পানি আন, দাঁত লাইগ্যা গেছে। ও আমার সোনার চানরে, তোর কি অইলরে!’
‘কোনো চিন্তা কইর্য না। আমরা অ্যাকটা ফুলের টোকাও দেই নাই। ও-ই আমাগ মারছে।’
‘ক্যান, আইতে চায় নাই?’
‘জঙ্গুরুল্লার বাড়ি যাইতে চায় নাই। আমরাতো পা-না-ধোয়ার বাড়ি লইয়া যাইতে চাইছিলাম।’
নূরুর দিকে ফিরে সে বলে, ‘কয়েকটা লটার ডাণ্ডি লইয়া আয় গরুর বাথান তন।’
নূরু বেরিয়ে গেলে গলা খাদে নামিয়ে সে আমিনাকে বলে, ‘তুই লটা হেঁইচ্যা রস বাইর কর। ঘায়ে লাগইতে অইব। তোর ভাবিসাব আমারে খামচাইয়া কিছু রাখে নাই।’
বেশ কিছুক্ষণ পর রূপজানের জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ খুলেই তার মাথার কাছে উবু হয়ে বসা বরুবিবিকে দেখে সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মাথা উঠিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে সে জড়িয়ে ধরে শাশুড়িকে।
রাত অনেক হয়েছে। ফজলের শিথিল বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে রূপজান বিছানা ছেড়ে ওঠে। বেশ-বাস ঠিক করে। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দেয়।
‘আমি বাইরে গেলাম।’ রূপজান বলে। ‘দরজা কিন্তুক খোলা রইল।’
‘যাও, আমি চাইয়া রইছি।’ ফজল বলে। ‘গাঙ্গের ঘাটে কিন্তু যাইও না, জিনে ধইর্যা লইয়া যাইব।’
কিছুক্ষণ পর রূপজান ফিরে এসে দেখে, ফজল চিত হয়ে শুয়ে আছে।
‘ঐ তাকের উপরে দ্যাখো বাটির মইদ্যে লটার রস আছে।’ ফজল বলে। ‘ঐ রস ঘায়ে লাগাইয়া দ্যাও দেখি।’
রূপজান বকের পালক ভিজিয়ে ফজলের হাত ও গলার নখের আঁচড়গুলোয় রস লাগাতে লাগাতে বলে, ‘ইস! খামচি লাইগ্যা কি অইছে! তোমারে যদি চিনতে পারতাম, তয় কি এমুন কইর্যা খামচাইতাম!’
‘খামচিতো আমারে দ্যাও নাই। খামচি দিছ জঙ্গুরুল্লার মানুষরে। তোমার খামচি খাইতে তখন এমুন মজা লাগতে আছিল, কি কইমু তোমারে। তোমার গালাগালিগুলাও বড়ই মিঠা লাগতে আছিল।’
‘খামচি বোলে আবার মজা লাগে! গালাগালি বোলে আবার মিঠা লাগে!’
‘হ, আমিতো তখন জঙ্গুরুল্লার মানুষ। তখন মনে অইতে আছিল, আরো জোরে খামচি দ্যায় না ক্যান, কামড় দ্যায় না ক্যান? আরে গালাগালি দ্যায় না ক্যান?’
একটু থেমে ফজল আবার বলে, ‘জোরজবরদস্তি কইর্যা তালাক নেওনের সময় তোমার বাপ, জঙ্গুরুল্লা, পুলিসের হাওয়ালদার আর ঐ সাক্ষী হারামজাদারা কইছিল–তুমি আমার ঘর করতে রাজি না। সেই কথা যাচাই করণের লেইগ্যা জঙ্গুরুল্লার মানুষ সাইজ্যা গেছিলাম। তুমি যদি বুইড়্যা পীরের লগে বিয়া বইতে রাজি অইয়া আমাগ নায় উঠতা, তয় কি করতাম জানো?’
‘কি করতা?’
‘মাঝ গাঙ্গে নিয়া ঝুপপুত কইর্যা ফালাইয়া দিতাম পানিতে।’
রূপজান ফজলের বুকের ওপর ঢলে পড়ে। ফজল তার দুই সবল বাহু দিয়ে তাকে অপার স্নেহে, পরম প্রীতিতে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমরা জোড়াবান্দা কইতর-কইতরি। এই দুনিয়া জাহানের কেও আমাগো জোড়া ভাঙতে পারব না, কোনো দিন পারব না।’