দিঘিরপাড় কাছারির নায়েব সীতানাথ ভৌমিককে দেখে ভদ্র বলেই মনে হয়েছিল ফজলের। কিন্তু তার কথা-বার্তার ধরন দেখে সে বুঝতে পারে, লোকটা ভদ্র শুধু কাপড়-চোপড়ে। সে তার পিতার সাথে তুমি-তুমি করে কথা বলছে, যদিও বয়সে সে তার চেয়ে কম করে হলেও পনেরো বছরের ছোট।

ফজলের রাগ ধরে যায়। রাগটাকে কোনো রকমে বাগ মানিয়ে সে ধীরভাবে বলে নায়েব মশাই, আপনাদের বয়স ষাট পার হইয়া গেছে না?

নায়েবের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। প্রশ্নকারীকে দেখে নিয়ে সে এরফান মাতব্বরকে বলে, ‘ছেলেটা তোমার না মাতবর?’

‘হ বাবু।’

‘বলিহারি ছোঁড়ার আন্দাজ।’ ফজলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তারপর বলে, ‘আমার বয়স দিয়ে তোর দরকার কিরে অ্যাঁ।’

‘না, এমনিই জিজ্ঞাস করলাম। বাজানের বয়স পঞ্চান্ন। তার সাথে যখন ‘তুমি তুমি’ কইর‍্যা কথা কইতে আছেন, তখন আন্দাজ করলাম আপনের বয়স ষাট পার হইয়া গেছে।’

এরফান মাতব্বর ধমকে ওঠে, ‘অ্যাই ফজু, শতয়তা–ন, চো-প।’

ধমক তো নয়, যেন একটা বাঘ গর্জে উঠেছে। নায়েবের কলজে পর্যন্ত কেঁপে ওঠে সে ধমক শুনে। মাতব্বরের গম্ভীর মুখ আর ক্রোধরক্তিম চোখের দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে সে।

মুখ-চোখের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনে মাতব্বর অনুনয়ের সুরে বলে, ‘নায়েব বাবু, রাগ কইরেন না। পোলাডার বুদ্ধি-বিবেচনা এহনো পাকে নাই। কার লগে ক্যামনে কথা কইতে অয়, এহনো হিগে নাই। আপনে ওরে মাপ কইরা দ্যান। অ্যাই ফজু? বাবুর কাছে মাপ চা।’ মাতব্বর পেছন দিকে মুখ ঘোরায়।

ফজল নেই।

মাতব্বর উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেখে ফজল অনেক দূর চলে গেছে, হেঁটে যাচ্ছে হনহন করে।

ফিরে এসে সে বলে, ‘বাড়িতে গিয়া লই। ওরে আচ্ছা মতন মালামত করমু। আপনে রাগ অইয়েন না।’

‘ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখান হয়েছে বোধহয়?’ নায়েব বলে। আগের মতো তুমি উচ্চারণ করতে আর উৎসাহ পায় না তার মুখ।

‘হ, এই কেলাস নাইন পর্যন্ত পড়ছে। সংসারের কাজ-কামের লেইগ্যা আর পড়াইতে পারলাম না।’

‘যতটুকু পড়েছে তার জন্য অনেক ভোগান্তি আছে। শেখের ছেলে একটু লেখাপড়া শিখলেই জাত-গোত্রের কথা ভুলে যায়। মনে করে নওয়াব সিরাজদ্দৌলা হয়ে গেছে। ছেলেটা কাজ-কর্ম কিছু করে, না খালি আলফেট কেটে ঘুরে বেড়ায়?’

‘না কাম-কাজ করে। আমি তো বুড়া অইয়া গেছি সংসারের বেবাক কাম এহন ও-ই করে।’

‘করলেই ভালো। দেখি, পুরান চেক-দাখিলা কি আছে।’

এরফান মাতব্বরের হাত থেকে খাজনার পুরানো চেক নিয়ে সে কাছারির খাতাপত্র দেখে। দু’বছরের খাজনা বাকি।

নায়েব বলে, ‘জমি তো ভগবানের ইচ্ছায়, গঙ্গার কৃপায় পয়স্তি হয়েছে। সেলামি দিতে হবে এবার।’

‘তা দিমু।’

‘দিমু তো বুঝলাম, কিন্তু কবে?’

‘আইজই দিমু। আপনে খাজনার চেক কাডেন। একসাথে দিতে আছি।’

‘উঁহু আগে সেলামির টাকা, তারপর খাজনা।’

এরফান মাতব্বর এক হাজার টাকা নায়েবের হাতে তুলে দেয়।

‘কত?’

‘পুরা হাজার টাকাই দিলাম।’

‘উঁহু। আরো এক হাজার লাগবে।’

এরফান মাতব্বর হাতজোড় করে বলে, ‘আর দাবি কইরেন না, বাবু। চরডা লায়েক অউক। তখন আপনেরে খুশি করমু।’

‘কিন্তু খুশি করার সময়ই তো এখন। কই, আর কি আছে দেখি?’

‘আর দুই সনের খাজনার টাকা আনছি।’

কই দেখি।

নায়েব হাত পেতে আরো চারশ’ টাকা নিয়ে মাতব্বরের কাছ থেকে। বাংলা ১৩৪৭ সালের চেক কেটে মাতব্বরের হাতে দেয়।

‘এক সনের চেক দিলেন নি বাবু?’

‘হ্যাঁ, গত সনের চেক দিলাম। এই সনের খাজনা পরে দিলেই চলবে।’

মাতব্বর কাছারি থেকে বেরোয়। তার মনে আফসোস–এক থোকে অনেকগুলো টাকা নেমে গেল। জমিদারের সেলামি দিতেই গেল বারো শ টাকা। মাতব্বর জানে–জমিদারের না, নায়েবের কাম। সেলামির টাকা সবটাই উঠবে নায়েবের সিন্দুকে। সে মনে মনে বলে, যত কাড়ি সুতা, সব নেয় বামনের পৈতা।

মাতব্বর নৌকাঘাটে আসে। নৌকায় কেউ নেই। ‘হাঁক দেয়, কই গেলিরে তোরা?’

মেরামতের জন্য ডাঙার ওপর কাত করে রাখা ঢুশা নৌকার আবডালে ছায়ায় বসে ষোলঘুটি খেলছিল ‘বাইছা’ দু’জন। ডাক শুনে তারা গামছা ঝাড়তে ঝাড়তে ছুটে আসে। দু’জনই কোলশরিক। নৌকা বাইতে তাদের নিয়ে এসেছে মাতব্বর।

‘ফজল কইরে? সে নায় আহে নাই?’

‘আইছিল। সে আমাগ লগে যাইব না। পরে যাইব।’

‘পরে যাইব! ক্যান?’

‘হে কইছে, আইজ দিঘিরপাড় খেলা আছে। তারিখের খেলা। হেই খেলা দেইখ্যা যাইব।’

‘কিয়ের খেলা?’

‘কপাটি খেলা।’

‘তারিখ দিছে কারা?’

‘তারিখ দিছে। মাঝেরচরের আক্কেল হালদার আসুলিগ লগে। গেল হাটবার চর আর আসুলিগ মইদ্যে জিদাজিদি অইছে।’

‘তারিখ তো দিছে। পারব আসুলিগ লগে?’

‘পারব না ক্যান্। আক্কেল হালদার দক্ষিণপাড় গেছে। পালং আর ভোজেশ্বর তন বড় বড় খেলোয়াড় লইয়া আইব।’

‘তোরা আল্লার নাম লইয়া নাও ছাড়। ফজু থাউক পইড়া। খেলা দ্যাখলেই প্যাড ভরব। জোরে বৈডা চালা। বাড়িতে গিয়া যে আছরের নামাজ পড়তে পারি।’

উজান পানি। স্রোত ভেঙে ছলচ্ছল আওয়াজ তুলে নৌকা চলছে দুলতে দুলতে।

নৌকায় ছই নেই। মাতব্বর ছাতা মাথায় দিয়ে বসে। তার মনে নানা ভাবনা-চিন্তার জটলা লেগেই থাকে সব সময়। আজ আবার সেখানে যোগ দিয়েছে আর এক ভাবনা।

ভাবনা হয়েছে ফজলের আজকের ব্যবহারে। নায়েব না হয় বেতমিজের মতো তুমি তুমি করে কথা বলছিল। সে জন্য ওভাবে ঠেস দিয়ে কথা বলার কী দরকার ছিল ওর? সে হলো নায়েব। জমির মালিক যে জমিদার, তার নায়েব। এদের সঙ্গে কথা বলতে হয় তোয়াজ-তাজিমের সাথে। কটু কথা বললেও গায়ে মাখতে হয় না তা। এদের সাথে আড়ি দিয়ে, মেজাজ দেখিয়ে কি চরে বসত করা যায়? একটু নারাজ হলেই এরা এদের মেহেরবানির ঝাঁপি তুলে দেবে অন্যের হাতে। দিনকে বানিয়ে ফেলবে রাত। তার বয়স উমরেই সে কত দেখেছে–আসল হকদারকে ভোজবাজি দেখিয়ে কেমন করে এরা নতুন চরের আলমদারি দেয় অন্য লোককে। তারপর আর কি! চরের দখল নিয়ে বেঁধে যায় মারামারি খুনাখুনি। মামলা-মোকদ্দমার অতল গহ্বরে নেমে যায় বেশুমার টাকা। এভাবে সে নিজেও বড় কম ভোগেনি।

মাতব্বর বুঝতে পারে, এরকম মেজাজ নিয়ে ফজল কোনো দিনই চরে বসত করতে পারবে না। তাই তাকে নসিহত করার কথা চিন্তা করে সে। কিন্তু ছেলেকে নসিহত করার মতো মনের জোর নেই তার।

অভাবের সময়ে সে পুতের বউর গয়না বন্ধক দিয়েছে। সে ছুতোয় ছেলের শ্বশুর আরশেদ মোল্লা তার মেয়ে আটকে রেখেছে। বউ আনবার জন্য দুবার লোক পাঠিয়েছিল মাতব্বর। মোল্লা বলে পাঠিয়েছে, মাইয়ার শরীলের গয়না পুরা না লইয়া যেন আর মাইয়া নেওনের কথা মোখ দিয়া কয় না।

তারপর সাত মাস পার হয়ে গেছে, ছেলে আর বউর দেখাসাক্ষাৎ একদম বন্ধ। যদিও এর জন্য বেয়াইকেই দায়ী করে, তবুও নিজের দোষটাও মাতব্বর অস্বীকার করে না। তার মনেও ঢুকেছে কেমন একটা সঙ্কোচ যার ফলে সে ছেলেকে আগের মতো কড়া কথায় ভর্ৎসনা করতে পারে না আজকাল।

মনের পর্দায় আরশেদ মোল্লার ছায়া পড়তেই তার রাগ ফণা বিস্তার করে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে মনে মনে বলে, ‘সোনাদানা আমি দিছিলাম। আমিই বন্দক দিছি। আল্লায় দিন দিলে আবার আমিই ছাড়াইয়া আনমু। তুই ত আধা পয়সার গয়নাও দেস নাই। তুই ক্যান্ মাইয়া আটকাবি? মাইয়া আকটাইয়া করবি কি তুই?’

তার মনের অনুচ্চারিত প্রশ্ন থামে। যেন উত্তর চায় প্রতিপক্ষের। তারপর আবার তার ক্ষুব্ধ মন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মাইয়া আটকাইয়া ঘরে খাম্বা দিবি? দে খাম্বা। দেহি কদ্দিন ঘরে রাখতে পারস মাইয়াডা। আমি আবার আমার পোলারে বিয়া করাই।’

বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়ে। মাতব্বরের মনের ঝগড়াও থামে তখনকার মতো।

রাত্রে খেতে বসে সে স্ত্রী-কে বলে, ‘হোন ফজুর মা, আরশেদ মোল্লারে এমুন একটা ঠাসা দিমু–’

‘ক্যান?’

‘ক্যান্ আবার! মাইয়া আটকানের মজা দেহাইয়া দিমু। ওর মাইয়া আননেরও দরকার নাই, ছাড়নেরও দরকার নাই। ওর মাইয়া ওর বাড়িতেই পচুক, বুড়ি অউক। ফজুরে আবার আমি বিয়া করাইমু।’

‘যা করে যেন্ চিন্তা-ভাবনা কইর‍্যা করে।’

‘এর মইধ্যে চিন্তা-ভাবনার কি আছে?’

‘চিন্তা-ভাবনার কিছু নাই? অইবার সারদা আইনের বচ্ছর ‘ওঠ ছ্যামড়া তোর বিয়া’ কইয়া ফজুরে বিয়া করাইল। কয়ডা বচ্ছর পরেই আবার ভাইঙ্গা দিল বিয়া। এতে আল্লা বেজার অয় না?’

অতীতের ভুলের কথা তুলতেই চুপ হয়ে যায় মাতব্বর।

অনেকক্ষণ পর সে বলে, ‘আমার দোষ দিলে কি অইব। আসলে তোমার পোলাডারই বউর ভাগ্য নাই।’