» » সতের

বর্ণাকার

মহকুমার জেলখানা। পাশাপাশি দুটো মাত্র ব্যারাক। একটায় রাখা হয় বিচারধীন আসামি, অন্যটায় স্বল্প মেয়াদের দণ্ডিত অপরাধী। ব্যারাক দুটোর শিকের দরজা একই দিকে অবস্থিত। দরজার সামনে খোলা লম্বা বারান্দা। একজন রাইফেলধারী সেপাই বারান্দার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত টহল দিয়ে ফেরে।

আলো-বাতাসের জন্য কয়েদিরা দরজার কাছ ঘেঁষে জটলা করে সব সময়। অনন্ত আকাশ আর সবুজ গাছপালার দিকে তাকিয়ে ক্লান্তি আসে না তাদের চোখে। মনের আনন্দে উড়ে যাওয়া মুক্ত পাখির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অনেকে।

রাত আটটার ঘণ্টা পিটিয়ে এক পাহারাদার তার চার ঘণ্টার কাজের পালা শেষ করে। নতুন পাহারাদার আসে তার জায়গায়।

ষড়যন্ত্র মামলার আসামিরা দরজার কাছে বসে গল্পগুজব করে। শুধু মতি জানালার গরাদের ওপর দুই কনুই রেখে চুপচাপ বসে আছে। তার দৃষ্টি পাঁচিলের বাইরের একটা আমগাছের ওপর। ঘন অন্ধকারে গা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। এক লহমার জন্য হঠাৎ গাছের টিকির কয়েকটা পাতা চিকমিকিয়ে ওঠে যেমন চিকমিক করে শেষ বিকেলের রোদে। কিছুক্ষণ পর পর আরো দু’বার দেখা যায় সে ক্ষীণ আলোর চিকিমিকি।

মতি উঠে দাঁড়ায়। দলের লোকদের বলে, কিরে তোরা চুপচাপ বসে আছিস কেন? একটু গান-টান কর।

দ্বিতীয়বার আর বলতে হয় না। একজন গানে টান দিতেই দলের সবাই গাইতে শুরু করে দেয়–

ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,

তাহার মাঝে আছে দেশ এক–সকল দেশের সেরা;

ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা;

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি,

সকল দেশের রাণী সে যে–আমার জন্মভূমি,

সে যে আমার জন্মভূমি,

সে যে আমার জন্মভূমি।

ফজল ও বাকি সাত-আটজন আসামি দূরে বসেছিল। গানের আকর্ষণে ফজল গিয়ে বাদলের পাশে বসে। গানের কথা ও সুর গুনগুন করে তার মনের ভেতর।

গান শেষ হয়। ফজলকে দেখে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে সকলে। বাদল মতির দিকে চেয়ে বলে, ‘ঠিক আছে, কোনো অসুবিধে হবে না।’

কী ঠিক আছে, বুঝতে পারে না ফজল। কিছুক্ষণ পরই সে দেখে আক্‌লাস বিঘত দেড়েক লম্বা কালোমত কি একটা জিনিস তার জামার ভেতর থেকে বার করে রানের নিচে রাখল।

মতি বলে, ‘মোহন, এবার তোর সেই গানটা ধর। আর তোরা সবাই কবির সাথে সাথে দোহার ধরিস আর তালে তালে তালি দিস।’

মোহন :
ও ভাই কোথা থেকে উড়ে এল লালমুখো বাদুড়,
ও ভাই কোথা থেকে ………
একজন :
কোথা থেকে?
মোহন :
পার হয়ে তেরো নদী সাত সমুদ্দুর,
সকলে :
ও ভাই জাগো…জাগোরে ভাই জাগো,
ও ভাই ওঠো…ওঠোরে ভাই ওঠো,
করো তারে দূর।

তালির তালে তাল মিলিয়ে লোহা-কাটা করাত চলে দরজার শিকের ওপর। গান আর হাততালির শব্দে ঢাকা পড়ে করাতের আওয়াজ। পাহারাদার টহল দিয়ে এদিকে মুখ ঘোরাবার আগেই কারো রানের নিচে চলে যায় করাতটা।

মোহন :
ও ভাই উড়ে এসে জুড়ে বসে বড় সে চতুর,
ও ভাই উড়ে এসে…এ…এ…
একজন :
তারপর?
মোহন :
তার সাথে যোগ দি’ছে–(প্রহরীর দিকে তাকিয়ে) কে বলো তো?
প্রহরী :
কে?
মোহন :
তার সাথে যোগ দিছে ছুঁচো আর ইঁদুর,
সকলে :
ও ভাই মারো–মারো রে ভাই মারো,
ও ভাই কাটো–কাটোরে ভাই কাটো,
করো তারে দূর।

বারবার গাওয়া হচ্ছে একই চরণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই গানের কথা আর সুর রপ্ত হয়ে যায় ফজলের। সে-ও তালি বাজিয়ে গান গায় সকলের সাথে।

মোহন :
ও তোর বুকে বসে খুন চুষে পেট করে সে পুর,
ও তোর বুকে বসে…এ..এ…
একজন :
তারপর?
মোহন :
লুটে নেয় নিজ দেশে সাত-সমুদ্দূর।
সকলে :
ও ভাই ধরো, ধরোরে ভাই ধরো,
ও ভাই লড়ো, লড়োরে ভাই লড়ো
করো তারে দূর।

দুটো শিকের বেশ কিছুটা কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু করাতের আওয়াজ যেন বেশি হচ্ছে এখন। গান আর তালির শব্দ ছাপিয়ে রাখতে পারছে না করাতের কুড়ুৎ-কুড়ুৎ আওয়াজ। মতি শঙ্কিত হয়। সে করাত চালানো বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে মোহনকে বলে, ওরে কবি, তোর গানের জারিজুরি আর চলবে না এখন। নতুন গান তৈরি কর।

কিছুক্ষণ পর মোহন আবার নতুন গানে টান দেয় :

আমার দেশের কৃষাণ-মজুর,
মাঝি-মাল্লা, কামার-কুমোর,
ওরাই যে খাঁটি মানুষরে–
ঐ যে দেখ মাঝি ভাই,
বাড়িতে তার খাবার নাই,
তবু তার বৈঠা চরে কুডুৎ-কুড়ুৎ
সকলে :
কুড়ুৎ-কুড়ুৎ-কুড়ুৎ-কুড়ুৎ

হাততালি আর কুড়ুৎ-কুড়ুৎ শব্দ এবার করাতের আওয়াজকে বেমালুম ঢেকে দেয়।

মোহন :
ঐ যে দেখ কারিগর,
নাইক তার চালে খড়,
তার কুঁদ-বাটালি চলে তবু খুড়ুৎ-খুড়ুৎ
সকলে :
খুড়ৎ-খুড়ৎ-ঋড়ৎ-খুড়ুৎ
মোহন:
গোয়াল ভাইরে দেখ চেয়ে,
দেখছে কি সে ঘি খেয়ে?
তবু সে মাখন টানে ঘুড়ুৎ-ঘুড়ুৎ।
সকলে :
ঘুড়ৎ-ঘুড়ৎ-ঘুড়ৎ-ঘুড়ৎ
মোহন :
তাঁতি ভাইয়া কাপড় বোনে,
ছেঁড়া কাপড় তার পরনে,
তবু সে মাকু চালায় ঠুড়ুৎ-ঠুড়ুৎ
সকলে :
ঠুড়ুৎ-ঠুড়ুৎ-ঠুড়ুৎ-ঠুড়ুৎ
মোহন :
আমরা যে ভাই খাঁচার পাখি,
চোখের জলে ভাসে আঁখি,
খাঁচা ভেঙে কেমনে পালাই ফুড়ুৎ-ফুড়ৎ
সকলে :
ফুড়ৎ-ফুড়ৎ-ফুড়ৎ-ফুড়ৎ

রাত বারোটায় নতুন পাহারাদার আসার আগেই দুটো শিক কাটা হয়ে গেছে। এক একটার দু’জায়াগায় করাত চালানো হয়েছে দু’হাত অন্তর। অল্প আঁশের ওপর যথাস্থানে রেখে দেয়া হয়েছে ওগুলোকে। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না।

মতি, বাদল ও আরো একজন দরজার কাছে বিছানা পেতে শুয়ে আছে।

পেটাঘড়ি রাত একটা ঘোষণা করে।

মতি শুয়ে শুয়েই দৃষ্টি ফেলে আমগাছটার টিকিতে। পাতার ওপর আলোর চিকিমিকি দেখে সে টোকা দেয় বাদলের গায়ে। বাদল কাশি দিয়ে সঙ্কেত জানায় আর সবাইকে!

ঠক-ঠক আওয়াজ তুলে টহল দিচ্ছে প্রহরী। এ দরজা থেকে ঘুরে সে এগিয়ে যাচ্ছে অন্য প্রান্তে। তার বুটের আওয়াজ ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। বাদল আলগোছে মোড় দিয়ে শিকের টুকরো দুটো খসিয়ে ফেলে। সে আর আক্‌লাস চুপিসারে বেরিয়ে বারান্দার থামের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকে।

প্রহরী এগিয়ে আসছে অন্য প্রান্ত থেকে। দরজার কাছে পৌঁছবার আগেই পেছন থেকে বাদল শক্ত হাতে তার মুখ চেপে ধরে রুমাল দিয়ে। আর আক্‌লাস তাকে জাপটে ধরে রাইফেলটা সরিয়ে নেয়।

দু’জনে তাকে মাটিতে পেড়ে তার মুখের ভেতর রুমাল গুঁজে দেয়। মুখ থেকে সামান্য আওয়াজ বের করবারও সুযোগ পায় না প্রহরী। তার লাল পাগড়িটাকে তারা দুটুকরো করে তার হাতে পায়ে বেঁধে উপুড় করে চেপে ধরে রাখে।

মতি দলের আর সবাইকে নিয়ে নিঃশব্দ পায়ে ছুটে যায় পেছনের পাঁচিলের দিকে। বাইরে থেকে একটা দড়ির মই নেমে আসে। মই বেয়ে চটপট তারা পাঁচিলের বাইরে চলে যায়। বাদল আর আক্‌লাস এসে দেখে, ফজলও উঠছে মই বেয়ে।

বাদল ফিস ফিস করে বলে, ‘এই ফজল, তুমি কেন পালাচ্ছ? কেন নিজের বিপদ বাড়াচ্ছ?’

আক্‌লাস বলে, ‘আরে যেতে দাও। জলদি করো।’

বাইরে বেরিয়ে সটকে পড়ে যে যেদিকে পারে, মিশে যায় কালো রাত্রির অন্ধকারে।

অল্পক্ষণ পরেই বেজে ওঠে পাগলা ঘণ্টা। রাত্রির নিস্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে ঘণ্টা বাজতে থাকে অবিরাম।

ফজল ছুটছে। অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে, কাঁটার আঁচড় খেয়ে সে ছুটছে। একটা শুকনো খাল পেরিয়ে সে পাটখেতের ভেতর ঢোকে। চুপটি মেরে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়া দরকার।

খালের ভেতর কিছু একটা গড়িয়ে পড়ার শব্দ হলো।

ফজল দাঁড়ায়। অন্ধকারে সাদামতো কিছু একটা নড়ছে, কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়।

মানুষ! দলের কেউ নয় তো?

ফজল ভয়ে ভয়ে নামে খালের ভেতর। কাছে গিয়ে টেনে তোলে মানুষটিকে।

‘কে? কেরে তুই? উহ্–উহ্।’

এ যে মতিভাই! গলার স্বরে চিনতে পারে ফজল। সে বলে, ‘আমি ফজল। শিগ্‌গির ওঠেন।’

মতিকে কাঁধে তুলে সে পাটখেতে নিয়ে বসিয়ে দেয়। হাঁপাতে থাকে তারা দুজনেই। ‘ব্যথা পাইছেননি মতিভাই?’

‘হ্যাঁ, পায়ে চোট লেগেছে। ছাল উঠে গেছে অনেক জায়গায়।’

‘হাঁটতে পারবেন?’

‘দেখি পারি কিনা।’ টলতে টলতে দাঁড়ায় মতি। কয়েক কদম ফেলে বলে, ‘পারব।’

‘তবে জলদি চলেন। কিন্তু কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। চশমাটা পড়ে গেছে পাঁচিল ডিঙোবার সময়।’

‘আমার হাতে ধরেন। চলেন শিগগির। কোন দিগে যাইবেন? নিয়ে চলো তোমার যেদিকে ইচ্ছে। তুমিতো দক্ষিণ দিকে যাবে?’

‘হ।’

‘তাই চলো। রাস্তা দিয়ে যেয়ো না কিন্তু।’

‘না। ধানখেতের আইল দিয়া, পাটখেতের আড়ালে আড়ালে যাইতে পারমু। আন্ধার রাইতে কেও-দেখতে পাইব না।’

মানুষের আনাগোনার শব্দ পেলে পাটখেত ঢুকে চুপটি মেরে থাকতে হবে, ‘বুঝলে?’

ফজল একটা ধঞ্চে গাছ টেনে তোলে। ওটা ভেঙে হাত দু’য়েক লম্বা একটা লাঠি বানিয়ে নেয়। লাঠিটার এক মাথা মতির হাতে দিয়ে অন্য মাথা ধরে ফজল নিয়ে চলে তাকে অন্ধের মতো। তাড়াতাড়ি হাঁটলে তার অসুবিধা হবে ভেবে ফজল আস্তে ধীরে পা চালাচ্ছিল। মতি তাড়া দেয়, ‘আরো জোরে হাঁটো, নইলে ধরা পড়ে যাব।’

ফজল এবার জোরে পা চালায়। মতি লাঠি ধরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় তার পিছু পিছু। পথে কোনো অসুবিধা থাকলে, উঁচু-নিচু থাকলে তাকে আগেই সাবধান করে দেয় ফজল।

পূর্ব দিগন্তে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের এক ফালি সরু চাঁদ। চাঁদের আকার দেখে ফজল বুঝতে পারে, বড়জোর দু’তিন দিন বাকি আছে অমাবস্যার। সে আরো বুঝতে পারে, ধলপহরের সময় হয়ে আসছে। সে বলে, ‘মতি ভাই, রাইত কিন্তু আর বেশি নাই।’

‘আস্তে কথা বলো।’ ফিসফিসিয়ে বলে মতি। ‘কোথায় এসেছ?’

‘সেরাজাবাদের খালের কিনারে আসছি। এখন কোনমুখি যাইবেন?’

‘খালে পানি আছে?’

‘না।’

‘খালের ভেতর দিয়ে পুব দিকে নদীর পাড়ে চলে যাও। নদীর কিনারা ধরে চলতে চলতে দেখো নৌকা পাওয়া যায় কিনা। নৌকা একটা চুরি না করে উপায় নেই।’

খালের ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণ চলার পর তারা নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছে।

ছোট শাখানদী। নাম রজতরেখা। ক্ষীণ ঘোলাটে জোছনায় নদীটাকে রুপালি চাঁদরের মতো মনে হয়।

তারা চলতে থাকে নদীর কিনারা ধরে। কিছুদূর গিয়েই একটা ছইওলা এক-মাল্লাই নৌকা দেখতে পায় ফজল। একটা বাড়ির নিচে নদীর ঘাটে বাঁধা নৌকাটা।

‘মতিভাই, একটা নৌকা পাইছি। কিন্তু নৌকার মাঝির বাড়ি বোধ করি নদীর পাড়েই। টের পাইয়া গেলে—’

‘না টের পাইব না। রাতের এ সময়ে কেউ জেগে নেই। চলো, উঠে পড়ি নৌকায়।’

দু’জনেই নৌকায় ওঠে। ফজল রশি খুলে পাড়া উঠিয়ে নৌকা ছেড়ে দেয়।

পুব পাড়ে লোকজনের বসতি কম। ওপাড়ে চলে যাও। ‘আমাকেও একটা বৈঠা দাও। চোখে ভাল না দেখলেও টানতে পারব।’

দু’জনে বৈঠা টেনে যখন দিঘিরপাড় বরাবর পৌঁছে তখন সূর্য উঠে গেছে। দিঘিরপাড় ডানে রেখে আরো কিছুক্ষণ বৈঠা টানার পর তারা বড় নদীতে গিয়ে পড়ে।

‘এইবার কোনমুখি যাইবেন, মতিভাই?’

‘চলো দক্ষিণপাড় চলে যাই। পাড়ি দিয়ে যেতে পারবে তো?’

‘তা পারব। কিন্তু অনেকদূর উজাইয়া পাড়ি দিতে অইব।’

‘কেন?’

‘পানির তেজ খুব বেশি। সোজা পাড়ি দিলে দক্ষিণপাড় যাওয়া যাইব না। নৌকা ঠেইল্যা লইয়া যাইব মেঘনায়।’

প্রাণপণ বৈঠা টানে দু’জনে। বাঁ-দিকে একের পর এক বাহেরক, সাতকচর আর চাকমখোলা পেছনে ফেলে ধীর গতিতে উজিয়ে চলছে নৌকা। আরো কিছুদূর গিয়ে ফজর দাত্রার খাঁড়ির মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে দেয়।

‘এইবার আপনে বৈঠা রাখেন, মতিভাই। আমি একলাই বাইয়া যাইতে পারমু।’

অনভ্যস্ত মতি বৈঠা টেনে খুবই ক্লান্ত। সে বৈঠা রেখে সটান শুয়ে পড়ে ছই-এর নিচে পাটাতনের ওপর।

দক্ষিণ দিকে নৌকা চলছে। কিছুদূর যাওয়ার পর ফজল বলে, ‘মতিভাই আমি তো প্রায় বাড়ির কাছে আইসা পড়লাম।’

‘উঁহু, এখন বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না তোমার।’

‘কিন্তু পেটে কিছু না দিলে এতটা পথ—’

‘তা ঠিকই বলেছ। তবে চলো। বাড়ি গিয়ে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা চলবে না। দেরি হলে বিপদ হবে।’

বৈঠা টানতে টানতে ফজলের হঠাৎ মনে হয়, ‘বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না। বাবা মারা যাওয়ার পর মা, বোন, আত্মীয়-স্বজন শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে। তাকে দেখে কান্নার রোল পড়ে যাবে বাড়িতে। মা বিলাপ করতে শুরু করবে। তার নিজের বুকের কান্নাও বাঁধ মানবে না তখন।’

ফজলের চোখ ঝাঁপসা হয়ে ওঠে।

ভোরের রোদের ছোঁয়া লাগছে পিঠে। ফজল সুমুখে ডানে বাঁয়ে তাকায়। পরিচিত পরিবেশ তার চোখ জুড়িয়ে দেয়।

অসংখ্য ডিঙি। ডিঙির মালিকেরা ইলিশ মাছের জাল ফেলে খোট ধরে বসে আছে। সাথের লোক গলুইয়ে বসে আছে হাল ধরে। স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে ডিঙি একটার পর একটা। যেন ডিঙির মিছিল। দ্রুত ধাবমান ইলিশ মাছ জালে ধাক্কা খেলে খোট-ধরা হাত টের পায়, ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে সারা শরীর। আর অমনি টান মেরে জালের ছড়িয়ে থাকা প্রান্ত দুটি একসাথে মিলিয়ে বন্ধ করে দেয়। মাছ আটকা পড়ে যায় জালের ভেতর। ফজল জানে, এ এক অদ্ভুত শিহরণ, অদম্য নেশা। কোনো এক ইলিশ শিকারি নাকি স্বপ্নে খোট পেয়ে জোরে মেরেছিল এক টান। তার আঙুল ঢুকে গিয়েছিল বউর নাকের চাঁদবালির মধ্যে। টানের চোটে আঙুলে আটকানো চাঁদবালি নাক কেটে বেরিয়ে গিয়েছিল।

কয়েকটা সরু লম্বা জেলে নৌকা নিকারির টেকের দিকে যাচ্ছে। সারা রাত জেগে মইজাল, টানাজাল, জগৎবেড় জাল দিয়ে জেলেরা ধরেছে যে মাছ তা বিক্রি করবে দাদনদার মাছের ব্যবসায়ীদের কাছে।

বাঁদিকে একটা সোতা জুড়ে ভ্যাশাল পেতেছে এক জেলে। বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার সাথে আড়াআড়ি লম্বালম্বি কোনাকুনি বাঁশ বেঁধে সাঁকোর মতো বানানো হয়েছে। এর সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে জাল। সাঁকোর সাথে ঠেকিয়ে ওটার এক কোণে শরীরের ভার চাপিয়ে পাড় দিলে পানি থেকে মাছ নিয়ে ওপরে উঠে যায় জাল। অদ্ভুত এক ফাঁদ। ফাঁদের মালিক ফাঁদ পেতে মাকড়শার মতো চুপচাপ বসে আছে সাঁকোর ওপর।

বড় বড় নৌকা গুনের টানে উজিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিকে। কাঁধে বেরুয়া ঠেকিয়ে গুন টানছে মাল্লারা। বছরের এ সময়ে ওদিকে কোথায় যাচ্ছে নৌকাগুলো—জানে ফজল। এগুলো ফজলি আম কিনতে যাচ্ছে মালদহ জেলায়। হালমাচার ওপর দাঁড়িয়ে তোতাশলা আর মুইন্যাশলা ধরে মাঝি হালে গুঁড়ি দিচ্ছে কেডোৎ-কোড়োৎ।

পশ্চিমদিক থেকেও আসছে বড় বড় নৌকা। প্রায় পানিতরাস পর্যন্ত বোঝাই করা হয়েছে নৌকাগুলো। এগুলোতে গুটি আম আসছে রাজশাহী ও মালদহ জেলা থেকে। যাবে বড় বড় বন্দরে। তাড়াতাড়ি বন্দরে পৌঁছতে না পারলে আম পচে যাওয়ার ভয় আছে। তাই অনুকূল স্রোত থাকা সত্ত্বেও মাল্লারা প্রাণপণ দাঁড় টেনে চলেছে।

অনেকদিন পর ফজল ফিরে এসেছে পদ্মায়। পদ্মার পানি, পদ্মার তরঙ্গ তার অন্তরঙ্গ। পদ্মার পলিমাটি তার আশ্রয়। সে আঁজলা ভরে পানি খায়। বুকভরে টানে মুক্ত বাতাস।

ফজল ডানদিকে তাকায়। দূরে পশ্চিম দিকে একটা বাড়ি। কলাগাছের ঘন ঝাড় আড়াল করে রেখেছে ঘরগুলো। এতদূর থেকে একটা শাড়ির আঁচলও দেখা যাচ্ছে না। রূপজান কি তার কথা ভাবছে এখন?

‘ফজল।’

‘জী।’

‘বাদলের কাছে শুনেছি, তোমাকে মিথ্যে ডাকাতি মামলায় জড়িয়েছে। ব্যাপারটা কি বলো তো?’

‘ফজলের মুখে সব ঘটনা শুনে শক্ত হয়ে ওঠে তার চোয়াল।’ সে রাগে ঠোঁট কামড়ায়।

‘ঐ যে দ্যাখেন মতিভাই, ডানদিকে দূরে ধু ধু দেখা যায় সেই খুনের চর।’

মতি ডান দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ ঝাঁপসা দেখতে পাচ্ছি। ইংরেজদের চাই জমিদারগুলো হচ্ছে এই সব ঝগড়া-ফ্যাসাদের মূল। ওদের খতম করা দরকার সকলের আগে।’

কিছুক্ষণ পর আবার সে বলে, ‘জানো ফজল, আগে এখানে নদী ছিল না। এখানে ছিল একটা খাল। লোকে বলতো ওটাকে রথখোলার খাল। চাঁদরায়-কেদার রায়দের রথটানা হতো ওখান দিয়ে। আগের দিনে পদ্মা ফরিদপুরের মাঝ দিয়ে বরিশালের কন্দর্পপুরের কাছে মেঘনায় মিশেছিল। এখন যেটা আড়িয়াল খাঁ সেটাই ছিল তখন আসল পদ্মা।

‘আইচ্ছা! আমরা তা হইলে চরুয়া ছিলাম না, আসুলি ছিলাম!’

‘হয়ত ছিলে। আগে বাঙলার মাটিতে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা ছিল এক সাথে। ব্রহ্মপুত্র গতি বদলে পশ্চিম দিকে গিয়ে যমুনার সাথে মিশে। এই দুটি নদীর স্রোত গোয়ালন্দের কাছে পদ্মার সাথে মিলে যায়। তার পরেই রথখোলার খাল ভাঙতে ভাঙতে নদী হয়ে যায়। চাঁদ রায় কেদার রায়ের কীর্তি, রাজ রাজবল্লভের কীর্তি ধ্বংস করে। তাই পদ্মার আর এক নাম কীর্তিনাশা।’

‘ভাল একটা ইতিহাসের কথা শুনাইলেন মতিভাই। আমরা তো কিছুই জানি না। জানলে কি আর আসুলিরা আমাগো নিন্দা করতে পারে? কথায় কথায় চরুয়া ভূত কইয়া ঠেশ দিতে পারে?’

‘এই যে নদী, এই যে তোমাদের চর–এখানে বিক্রমপুরের অনেক গ্রাম ছিল। পদ্মা বিক্রমপুরকে দু’ভাগ করে গিয়েছে। আগে বিক্রমপুরের দক্ষিণ সীমা ছিল ফরিদপুর জেলার ইদিলপুর। নদীর ভাঙনের ফলে আমার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীদের কেউ উত্তরপাড় রয়ে গেছে। কেউ চলে গেছে দক্ষিণপাড়।’

‘আমরাও তা হইলে বিক্রমপুরের লোক। এইবার আসুলিরা কেউ টিটকারি দিলেই শুনাইয়া দিমু।’

‘তুমি চরের লোক বলে নিজেকে ছোট মনে করো নাকি ফজল?’

‘আসুলিরা যে তাই কয়।’

‘একদম বাজে কথা। দেশ, কুল, জাতি, ধর্ম দিয়ে কি ছোট-বড় বিচার হয়? মানুষের বিচার হয় তার কাজ দিয়ে–একথা মনে রেখো। তোমার বড় পরিচয় তুমি মানুষ–পৃথিবীর আর সবার মতো মানুষ। তোমার কাজে, কথায়, অবহেলায়, উদাসীনতায় কোনো লোকের সামান্য ক্ষতিও না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে সব সময়। যারা মানুষকে ভালবাসে, মানুষের ভাল করে তারাই বড়, তারাই মহৎ। যারা মানুষকে ভালবাসে না, মানুষের ভাল চায় না। তারাই ছোট, তারাই অধার্মিক।’

ফজল কথাগুলোর কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। বলে, ‘আপনারাও তো মানুষরে ভালবাসেন না। শুনছি, আপনারা ডাকাতি করেন, মানুষ খুন করেন।’

‘হ্যাঁ, ডাকাতি করি, দরকার হলে খুনও করি। যারা অমানুষ, যারা দিনের পর দিন মানুষের রক্ত শোষণ করে, অত্যাচার করে, যারা বিদেশী শাসকদের সাথে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে, বার বার সতর্ক করার পরেও যারা পথে আসে না, তুমি কি মনে করো তাদের বাঁচবার অধিকার আছে? বেঁচে থাকার চেয়ে তারা পচে গলে দেশের মাটির উর্বরতা বাড়াক। এদের অন্যায়-অত্যাচার আর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিকার না করে উদাসীন হয়ে বসে থাকা অন্যায়। এদের ক্ষমা করা মহাপাপ।’

‘কিন্তু অন্যান্য-অত্যাচারের বিচারের জন্য তো আইন-আদালত আছে।’

‘আইন-আদলাত!’ মতির মুখে বিদ্রুপের হাসি। একটা কাটারি যেন চিকমিকিয়ে ওঠে তার ঠোঁটের ফাঁকে। ‘আইন-আদালত তো পয়সার গোলাম। পয়সাওলা শোষক গোষ্ঠীর কথায় ওঠে বসে।’

‘আইচ্ছা, এই যে গরিব মাঝির নৌকাটা চুরি করলাম। এইটা কি অন্যায় হয় নাই, আমাদের?’

‘নিশ্চয়ই অন্যায় হয়েছে। এর প্রতিকার অবিশ্যি করতে হবে।’

‘কিভাবে করবেন?’

‘সেটা পরে দেখা যাবে। আগে তো পালিয়ে বাঁচি। কতদূর এলে ফজল?’

‘উল্টা বাতাস। নাওটা জোরে চলতেছে না। যতদূর আসছি আরো দুই এতখানি গেলে পাড়ি শেষ হইব। আমি কিন্তু বাড়ি যাইতেছি না।’

‘কোথায় যাচ্ছ তাহলে?’

‘সোজা দক্ষিণ পাড়, আপনে যেইখানে যাইতে চান।’

‘না খেয়ে বৈঠা বাইতে পারবে তো?’

‘তা পারব। কিন্তু আপনার বোধ হয় খিদা লাগব।’

‘না, লাগবে না। তুমি বুঝেশুনে যাও। দেখো কেউ যেন চিনতে না পারে।’

‘না, দাড়ি-মোচে যা একখান চেহারা হইছে, সহজে কেউ চিনতে পারব না।’

একটা ছেঁড়া গামছা পড়ে আছে পাটাতনের ওপর। বোধ হয় মাঝি ওটা পা মোছর জন্য রেখেছে। ফজল ওটাই মাথায় বেঁধে নেয়। এবার আর তাকে চেনার সাধ্যি নেই কারো।

একটা ছোট লঞ্চ আসছে পুব দিক থেকে।

‘কিসের আওয়াজ?’ জিজ্ঞেস করে মতি। ‘লঞ্চ বোধ হয়?’

‘হ্যাঁ, ছোট্ট একটা লঞ্চ। কিন্তু চলতি বড় জবর।’

কিছুদূর দিয়ে লঞ্চটা চলে যায়।

ফজল বলে, ‘কয়েকটা ধলা সাহেব যাইতেছে।’

‘আচ্ছা! লঞ্চটার গায়ে কিছু লেখা আছে?’

‘হ্যাঁ, ইংরেজীতে লেখা আছে, আর্মি বোট নম্বর পি-২৬৮। একটা সাহেব চোখে দূরবিন লাগাইয়া দেখতে আছে।’

‘হুঁ, নদীতে টহল দিতে শুরু করেছে। আমাদের নৌকার নম্বর আছে তো?’

মাথির একপাশে আলকাতরা দিয়ে লেখা নম্বর পড়ে ফজল বলে, ‘হ্যাঁ আছে, ১৭৩৫ নম্বর।’

‘নম্বর আছে বলেই বোধ হয় কিছু বলল না। নম্বর না থাকলে কি জানি হয় তো এখনই বিপদ ঘটত।’

ভোর থেকেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছিল। বেলা এক প্রহরের কিছু পরেই সারা আকাশ ছেয়ে যায় কালো মেঘে। যেন ছানি পড়েছে পৃথিবীর চোখে। ফজল বলে, ‘দিনের অবস্থা বড় ভাল না। মেঘ করছে খুব।’

‘ঝড় উঠবে না তো?’

‘মনে হয় না। এখন তো জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ। ঝড়-তুফান না-ও আসতে পারে। উত্তরের আসমানে খাড়াঝিল্‌কি মারতে আছে খুব।’

‘বৈঠাটা আমার হাতে দাও। তুমি জিরিয়ে নাও কিছুক্ষণ।’

আরো কয়েকবার বৈঠা চেয়েছিল মতি। কিন্তু ফজল দেয়নি। এবার আর সে মানা করে না। খিদেয় চেঁ-চোঁ করছে পেট। শ্রান্ত হাত দুটো বিদ্রোহ করতে চাইছে।

মতির হাতে বৈঠা দিয়ে বলে ফজল, ‘ডাইন কোনাকুনি রাইখেন নৌকার মাথা। তা না হইলে কিন্তু ভাটির টানে জঙ্গুরুল্লার চরের দিগে লইয়া যাইব।’

মতির হাতে বৈঠা দেয়ার আর এক উদ্দেশ্য ছিল ফজলের। সে মাঝির কাঁথার গাঁটরি তন্নতন্ন করে খোঁজে। চোঙা-চুঙি উপুড় করে ঢেলে দেখে, হাতিয়ে দেখে নৌকার উত্তরা। কিন্তু একটা আধলাও খুঁজে পায় না সে। তার আশা ছিল দু-চার আনার পয়সা পেলে চরের কোনো ছুটকো দোকান থেকে চিড়েমুড়ি কিনে নেবে। শান্ত করবে উদরের ভোক্ষসটাকে। ওটা বড় বেশি খাই-খাই শুরু করে দিয়েছে।

ফজল আবার বৈঠা হাতে নেয়। একটা খাড়ি উজিয়ে দক্ষিণের প্রধান স্রোতে পৌঁছবার আগেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করে।

‘কি করি মতিভাই এখন? বিষ্টি তো শুরু হইল।’

‘কোনো চরের কিনারায় নিয়ে যাও।’

ফজল একটা ঘোঁজার ভেতর চলে যায়। পুরো নৌকাটা ঢুকিয়ে দেয় কাশবনের ভেতর। দুটো লগি পুঁতে শক্ত করে বাঁধে দুই মাথি। তারপর সে ছই-এর ভেতর ঢুকে দু’দিকের ঝাঁপ নামিয়ে দেয়।

বৃষ্টি পড়ছে ঝরঝর। ছই-এর ওপর যেন দাপাদাপি করছে দূরন্ত ছেলেরা। ঝড়ো বাতাসে নৌকাটা দুলছে এদিক-ওদিক। ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির ঝাঁপটা আসছে।

কাঁথার ওপর মতি শুয়ে পড়েছিল। মাঝির তেলচিটে বালিশটা তার মাথার নিচে খুঁজে দেয় ফজল।

বালিশের অর্ধেকটা ছেড়ে দিয়ে মতিভাই বলে, ‘তুমিও শুয়ে পড় ফজল, জিরিয়ে নাও। বিষ্টি যেন কখন থামে ঠিক নেই।’

মতিভাই মাথার পাশে মাথা রেখে ফজল বলে, ‘খিদা লাগছে না মতিভাই?’

‘খিদে তো লেগেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই তো আমি করিনি। কাজ না করে বসে বসে খাওয়ার কথা চিন্তা করাও অন্যায়। কাজ করেছ তুমি, খিদে পাওয়া উচিত তোমার।’

‘আমার তো দারুণ খিদা লাগছে।’

‘চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করো। যে পরিশ্রম করেছ—’

দু’জনেই চোখ বুজে পড়ে থাকে।

খাবার সময় পেরিয়ে খিদে যখন ধীরে ধীরে মরে যায় তখন ক্লান্ত অবসন্ন শরীর ঘুমে ঢলে পড়ে।

তারা কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল, কিছু খেয়াল নেই তাদের। ঝম্‌ঝম্ বৃষ্টি পড়ছে এখনো। এখনো ঢাকা পৃথিবীর চোখ। তাই সময়ের আন্দাজ করতে পারে না তারা। তবে পেটের ভোক্ষসটা নাড়ি-ভুঁড়িগুলোকে যে রকম খুবলাতে শুরু করেছে তাতে সহজেই বোঝা যায়– খাবার সময় হয়েছে আবার। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়েছে।

বৃষ্টির পানিতে প্রায় টুবুটুবু হয়েছে নৌকার ডওরা। ফজল তাড়াতাড়ি কয়েকটা পাটাতন সরায়, সেঁউতি বের করে পানি সেচে।

গলুইয়ের ঝাঁপ ফাঁক করে আকাশের দিকে তাকায় ফজল। বলে, ‘বিষ্টি ছেক দেয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, মতিভাই।’

‘কিন্তু সন্ধ্যার আগে বিষ্টি না থামলে সারা রাত এখানেই পড়ে থাকতে হবে।’

‘কেন? রাত্রেই পাড়ি দিয়া ওপার যাইতে পারব।’

‘কিন্তু রাতের বেলা ওপার গিয়ে কোনো লাভ নেই। পথ চিনে যেতে পারব না।’

‘ওপারে কোনে গ্রামে যাইবেন? কার বাড়ি?’

‘নয়নপুরে–আমার বোনের বাড়ি।’

‘নয়নপুর আবার কোনখানে?’

‘পণ্ডিতসার যেতে পথে পড়ে। বছর দশেক আগে এসেছিলাম একবার। বোমার মামলায় পড়ে লুকিয়ে ছিলাম অনেক দিন। এত বছর পরে পথ চিনে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।’

‘কোনো চিন্তা কইরেন না মতিভাই। মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে বিলাত যাওয়া যায়।’

‘আজ যদি যেতে পারতাম, গিয়েই বোনকে বলতাম—শিগগির খিচুড়ি রান্না কর, ডিম ভেজে দে। আর যদি ইলিশ মাছ ভাজা থাকে তো কথাই নেই।’

‘আর কইয়েন না মতিভাই। জিহ্বায় পানি আইসা গেল। এই ঘন ডাওরে গরম গরম খিঁচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা আর নয়তো আণ্ডা বিরান–ওরে মাবুদের পেটের মধ্যে খাম খাম শুরু হইয়া গেছে।’

ফজল ঢোক গিলে। তার চোখের সামনেই যেন সে দেখতে পায় গামলা ভরা খিচুড়ি। গরম গরম খিচুড়ি থেকে ধোঁয়া উঠছে। ভাজা ইলিশ মাছের খিদে-চেতানো গন্ধ এসে লাগছে নাকে।

নাহ, আজ খিচুড়ি না পেলে পেটের ভোক্ষসটা কিছুতেই শান্ত হবে না।–ভাবে ফজল। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? কার বাড়ি গেলে এখন খিচুড়ি খাওয়া যায়? নিজেদের বাড়ি সে বহুদুর পেছনে ফেলে এসেছে। সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার ভাইয়ের দোস্ত রফি শিকদারের বাড়ি ধুলচর। পশ্চিম দিকে মাইল খানেক উজান ঠেলে যাওয়া যায় সেখানে। কিন্তু বৃষ্টি মাথায় করে অতটা পানি ভাঙবার শক্তি নেই শরীরে। আর এ অবস্থায় সেখানে গিয়ে বেশরমের মতো খিচুড়ির ফরমাশইবা দেবে সে কেমন করে? এ খাড়িটা ধরে বেশ কিছুদূর পিছিয়ে গেলে তাদের কোলশরিক কেরামতের বাড়ি। সেখানে গিয়েও খিচুড়ির ফরমাশ দেয়া যাবে না। আর কোথায় যাওয়া যায়?

হ্যাঁ, অল্প কিছুদূরেই আর একটা বাড়ি আছে। বাড়িটার কথা মনে পড়তেই কেমন একটা আনন্দ তার বিধ্বস্ত মনের ধ্বংস স্থূপ সরিয়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এ যেন ঠিক আনন্দ নয়, আনন্দের কালো বিষণ্ণ ছায়া।

জরিনা তার কেউ নয়। কোনো সম্পর্ক নেই আর তার সাথে। কোনো দাবি নেই তার ওপর।

রূপজানও আর কেউ নয় তার।

জীবনের ভিত ধসে গেছে। ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে সব। ভগ্নস্তূপের নিচে মৃতপ্রায় মনটা তার কিছু একটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়াতে চায়।

অধিকার ও অনধিকারের সীমান্তে এসে দাঁড়ায় ফজলের অভিলাষ। মমতা মাখানো এক পলক চাহনি, সমবেদনার দুটি কথা, স্নেহের একটুখানি পরশের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে তার বিপর্যস্ত মন। মনের এই আকুতিই তাকে তার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করতে প্ররোচিত করে। এ মুহূর্তে পেটের খিদেকে ছাপিয়ে উঠেছে মনের পিপাসা।

বৃষ্টির তোড় আর নেই। শুধু টিপটিপানি আছে এখন। তাড়াতাড়ি নৌকার বাঁধন খুলে লগি দুটো তুলে ফেলে ফজল। তারপর কাশবন থেকে বের করে নৌকাটাকে সে স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। বৃষ্টি থেকে বাঁচবার জন্য সে ছই-এর ভেতর গিয়ে বসে।

‘কি করছ ফজল? নৌকা ছেড়ে দিলে কেন?’

‘কাছেই একটা বাড়ি আছে জানা শোনা।’

‘আচ্ছা, তবে এতক্ষণ যাওনি কেন?’

‘মনে ছিল না।’

হালবিহীন নৌকা ভাটির টানে ভেসে যায় ঘুরপাক খেয়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর নৌকাটাকে ফজল আর একটা খাড়ির ভেতর বেয়ে নিয়ে যায়। কিনারায় ভিড়িয়ে বাঁধে লগি পুঁতে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনো বৃষ্টি পড়ছে টিপিরটিপির।

ফজল নেমে যায় নৌকা থেকে।

মতিভাই বলে, ‘বেশি করে খাবার নিয়ে এসো। দেরি কোরো না কিন্তু।’

ফজল কোনো জবাব না দিয়ে এগিয়ে যায়। কাশ আর লটাবনের ভেতর দিয়ে পথ। অন্ধকারে পথ চলতে চলতে সে ভাবে–জরিনার বুড়ি শাশুড়ি আছে বাড়িতে। তার চোখ এড়িয়ে কেমন করে দেখা করবে সে জরিনার সাথে? ধারে কাছে আর কোনো বাড়ি নেই–এই যা রক্ষে।

এ তল্লাটে কোথাও চুরি হলেই হেকমতকে ধরার জন্য পুলিস আসে। জ্ঞাতিদের ঘরেও খানাতল্লাশি হয়। এজন্য বিরক্ত হয়ে তার জ্ঞাতিরা তাকে তাদের পাড়া থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারাই তার ঘরদোর তুলে এনে চরের এক কোণে আলাদা বাড়ি করে দিয়েছে।

ফজল ডাক দিয়ে উঠে, টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট্‌। না, হট্টিটির ডাক এখানো ভোলেনি সে। কিন্তু এত বছর পরে জরিনা যদি বুঝতে না পারে এ সঙ্কেত? হেকমত আজ বাড়ি আছে কি না, তাই-বা কে জানে?

ফজল নিঃশব্দে এগিয়ে যায়। পা টিপে টিপে গিয়ে দাঁড়ায় ঘরের পেছনে।

ঘরে কুপি জ্বলছে তরজার বেড়ার ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পায়, জরিনা ছেঁড়া কাপড় সেলাই করছে, তার শাশুড়ি শুয়ে আছে মেঝের একপাশে হোগলার বিছানায়।

ফজল সরে যায় কিছুদূরে কাশবনের কাছে। ডেকে ওঠে, টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট্‌।

জরিনা কান খাড়া করে। বড় মধুর হট্টিটির ডাক। তার দুআঙুলে ধরা সুইটি পড়ে যায়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সুইটাকে কুড়িয়ে নিয়ে আবার ফেঁড় তোলে সে।

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হটু…

আবার সেই ডাক। কিছুক্ষণ পরে আবার, তারপর আরো কয়েক বার।

জরিনা দাঁড়ায়। দরজার কাছ থেকে বদনা নিয়ে সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট…

ডাকটা আসছে কাশবনের দিক থেকে। জরিনা বদনাটা উঠানে রেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। ওদিক থেকে ফজলও এগিয়ে আসে। কিন্তু অন্ধকারে একটা মানুষের মূর্তি ছাড়া আর কিছুই ঠাওর করতে পারে না জরিনা। মূর্তিটার মুখোমুখি এসে দাঁড়াতেই সে নিঃশঙ্ক বিশ্বাসে মাথা নোয়ায় কদমবুসি করার জন্য।

ফজল তার দুই বাহু ধরে টেনে তোলে। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘না না জরু, আমার পায়ে হাত দিও না। আমি–আমি পাপী, আমি ডাকাইত।’ তার কণ্ঠে কান্নার রেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে।

‘না–না, মিছা কথা–মিছা কথা।’

জরিনা তার হাত ধরে কাশবনের দিকে যেতে যেতে বলে, ‘আমার হাউড়ি আছে ঘরে। টের পাইয়া যাইব।’

‘জরু, তুমি তো কইলা মিছা কথা। কিন্তু মাইনষে কয় আমারে ডাকাইত। রূপজান– সেও কয় আমারে ডাকাইত।’ ফজলের কথায় কান্না ঝরে পড়ে।

জরিনার চোখে পানি আসে। ধরা গরায় সে বলে, ‘আমি বেবাক হুনছি। আরশেদ মোল্লা যোগ দিছে জঙ্গু শয়তানডার লগে। ওরাই তোমারে ধরাইয়া দিছে।’

‘হ, এর শোধ না নিয়া ছাইড়া দিমু। শোধ নেওনের লেইগ্যাই পলাইয়া আইছি জেলেরতন।’

‘জেলেরতন! কবে পলাইছ?’

‘কাইল রাইতে। পলাইয়া যাইতে আছিলাম দক্ষিণপাড়। বিষ্টির লেইগ্যা পাড়ি দিতে পারি নাই।’

‘বাড়ি গেছিলা?’

‘না।’

‘খাইছ কনুখানে?’

‘খাই নাই। কোথায় খাইমু? সাথে একটা পয়সাও নাই।’

‘এতক্ষণ কও নাই ক্যান্। জলদি বাড়িত্ লও।’

‘তুমি কি ভাত রাইন্দা থুইছ নি?’

‘না, দুইডা চাউল ফুডাইতে বেশি দেরি লাগব না। কিন্তু খাইবা কি দিয়া? মাছ-তরকারি কিছু নাই।’

‘ডাইল আছে?’

‘আছে।’

‘তবে খিচুড়ি পাকাইতে পারবা?’

‘তা পারমু।’

‘বেশি কইর‍্যা খিচুড়ি পাকাও। সাথে নৌকায় মানুষ আছে আর একজন। আর আণ্ডা থাকলে ভাইজ্যা দিও।’

‘কে আছে নায়?’

‘তুমি চিনবা না তারে। মস্ত বড় একজন বিদ্বান মানুষ।’

ফজলের হাত ধরে বাড়ি নিয়ে যায় জরিনা। তাকে রান্নাঘরে বসিয়ে সে ঘরে যায়। মাটির ঘড়া থেকে চলে বের করে, শিকেয় তোলা ডিবা থেকে বের করে ডাল।

‘কি ঘুডুঘুডু করতে আছস বউ?’ পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করে শাশুড়ি।

‘এই ডাওরের মইদ্যে খিচুড়ি খাইতে মন চাইতে আছে। অল্প দুগা ভাত আছে। পানি দিয়া থুই। পান্তা খাইমু।’

শাশুড়ি বলে, ‘হ, বিষ্টি-বাদলের দিনে গরম গরম খিচুড়ি ভালই লাগে। আমি উঠমু?’

‘না, আপনি আন্ধারে হুইয়া থাকেন। রাইন্দা বাইড়া আপনেরে ডাক দিমু।’

জরিনা এক হাতে কুপি অন্য হাতে হাঁড়ি নিয়ে রান্নাঘরে যায়।

কুপির মৃদু আলোয় এতক্ষণ পরে সে প্রথম দেখতে পায় ফজলের মুখ। দাড়ি-গোঁফে বদলে গেছে চেহারা। খিদেয় শুকিয়ে গেছে মুখ। চোখ বসে গেছে। গায়ের উজ্জ্বল রঙ গেছে ফ্যাকাশে হয়ে। মাথায় এলোথেলো চুল। বহুদিন তেল-পানি না পড়ায় জট পাকিয়ে গেছে।

জরিনা নির্বাক চেয়ে থাকে ফজলের মুখের দিকে। পলকহীন দৃষ্টি মেলে ফজলও তাকায়। গোধূলির বিষণ্ণ ছায়া জরিনার মুখে। মমতা-মাখা দুটি চোখের কোণে চিকচিক করে পানি।

জরিনা চোখ নামায়। চাল-ডাল ধুয়ে বাটনা বেটে সে তাড়াতাড়ি রান্না চড়িয়ে দেয়।

জরিনা চুলোর মুখে লাকড়ি গোঁজে। তার পাশে পিড়েতে বসে চাল চিবোয় ফজল।

অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙে জরিনা। সে নিচু গলায় বলে, ‘মিয়াজির মরণের পর গেছিলাম তোমাগ বাড়ি। আম্মার কান্দন দেইখ্যা কইলজা ফাইট্যা যায়। মরণের দিন মিয়াজি তোমারে দ্যাখতে চাইছিল। মরার আগক্ষণে দুই-তিন বার তোমার নাম ধইর‍্যা বোলাইছিল।’

ফজল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

জরিনা এক সময়ে ঘরে গিয়ে নারকেল তেল আর চিরুনি নিয়ে আসে। চিরুনি চালিয়ে সে ফজলের চুলের জট ছাড়ায়, তারপর তেল মাখিয়ে আঁচড়ে দেয়, সিঁথি কেটে দেয় পরিপাটি করে।

‘হেকমত কই?’ জিজ্ঞেস করে ফজল।

‘কোনো খবর নাই। মাসখানেক আগে আইছিল একদিন রাইতে। আবার রাইতের আন্ধারেই চইল্যা গেছে।’

‘মোল্লাবাড়ি গেছিলা?’

‘গেছিলাম একদিন। তোমারে যেদিন ধরাইয়া দেয় তার কয়েকদিন আগে।’

‘কাইল-পরশু একবার যাইতে পারবা?’

‘উঁহু।’

‘ক্যান?’

জরিনা কোনো উত্তর দেয় না।

আগে রূপজান তাকে বড় গলায় বু’জান বলে ডাকত, হাসি-মশকরা করত কথায় কথায়। সে তার চুল আঁচড়ে খোঁপা বেঁধে দিত। রূপজানকে সুন্দর করে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরতে শিখিয়েছিল সে-ই। রূপজানের বিয়ের পর জরিনা ধান ভানতে গিয়েছিল মোল্লাবাড়ি। রূপজান তার কানে কানে বলেছিল, ‘বু’জান লো, তোমার ছোডকালের পুরুষটা জ্বালাইয়া মারে আমারে। রাইতে এট্টুও ঘুমাইতে দেয় না।’ সেই রূপজান বদলে গেছে এখন। সেদিন কাজের খোঁজে গিয়ে কাজ তো জোটেইনি, ভাল ব্যবহারও পায়নি সে। রূপজান তাকে সোজা বলে দিয়েছে, ‘আমাগ ধান ভান লাগব না। আর কোনোদিন আইও না আমাগ বাড়ি।’ তারপর জরিনা আর যায়নি সে বাড়ি, আর যেতেও চায় না। তার বিশ্বাস, রূপজান কিছু টের পেয়েছিল।

‘কইলা না, ক্যান যাইতে পারবা না?’ ফজল আবার জিজ্ঞেস করে।

‘কি করতে যাইমু?’

‘গিয়া রূপজানরে খালি জিগাইবা—সে ডাকাইতের ঘর করব না–এমুন কথা ক্যান্ কইল? সত্য সত্যই কি সে বিশ্বাস করে আমি ডাকাইত?’

‘এহন আর এই কথা জিগাইয়া লাভ কি?’

‘লাভ নাই। খালি মনরে বুঝ দিতে চাই। রূপজান আমারে ডাকাইত মনে করে, ঘিন্না করে–এই কথা ভাবলেই মনে অয় কে যেন অন্তরডারে ট্যাঁটা দিয়া খোঁচায়।’

‘আইচ্ছা যাইমু একদিন।’ উড়কি দিয়ে খিচুড়ি নাড়তে নাড়তে বলে জরিনা।

কিছুক্ষণ পরে খিচুড়ি নামিয়ে সে ডিম ভাজে। খাবার পরিবেশন করার আয়োজন দেখে ফজল বলে, ‘নায়ের মইদ্যে আমার মতো ভুখা আছে আর একজন। তারে থুইয়া খাইতে একটুও মজা লাগব না।’

‘তোমার কাছে বইয়া তোমারে কোনো দিন খাওয়াইতে পারি নাই। আশা করছিলাম–’

জরিনার কথা শেষ না হতেই মুচকি হেসে ফজল বলে, ‘হ, শেষে কইতে পারবা, আর এক বাড়ির ছ্যামড়াডা বেশি বেশি খাইয়া ফালাইল।’

হাসি ফোটে জরিনার মেঘাচ্ছন্ন মুখে। ফজল বলে, ‘সামনে বহুত দিন পইড়া রইছে। খাওয়ানের অনেক সুযোগ পাইবা।’

‘সত্য কও তো? আইবা তো আবার?’

‘হ, আইমু।’

‘কবে আইবা?’

‘আইমু একদিন।’

‘না, কইয়া যাইতে অইব।’

‘তিন-চার দিন পর।’

‘আমার মাথা ছুঁইয়া কও।’

মাথা ছুঁয়ে ফজল বলে, ‘এই কইলাম। এইবার বিদায় দ্যাও। মতিভাই খিদায় মরতে আছে।’

জরিনা কিছুটা খিচুড়ি রেখে বাকিটা হাঁড়িশুদ্ধ তুলে দেয় ফজলের হাতে। ডিম ভাজা রাখে শরার ওপর। তারপর বলে, ‘পাতিলডা গাঙের পাড়ে কাশঝোঁপের মইদ্যে থুইয়া যাইও। কাইল বিচরাইয়া লইয়া আইমু।’

ফজল রওনা হয়। জরিনা তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, হাত রাখে তার পায়ে। ফজল তার মাথায় হাত বুলায়।

রাত্রে জোর বৃষ্টি হয়েছিল আর এক ঢলক। ভোররাত্রে নৌকার পানি সেচে পাড়ি দেয় ফজল। ভোর হওয়ার আগেই তারা দক্ষিণপাড় পৌঁছে যায়। ফজল তীরে নামে। তার হাত ধরে নামে মতি।

‘নৌকাটা বাঁধবার দরকার নেই।’ মতি বলে।

‘ভাসাইয়া লইয়া যাইব তো!’

‘যাকগে। নৌকার দামটা দূরের কোনো পোস্টাপিস থেকে বেনামিতে মানি অর্ডার করে দিলেই হবে।’

‘কার নামে মানি অর্ডার করবেন? মাঝির নামতো জানি না?’

‘থানার দারোগার কাছে পাঠালেই মাঝি পেয়ে যাবে টাকাটা। নৌকার নম্বরটা লিখে দেব। নৌকা চুরির পর মাঝি নিশ্চয়ই থানায় গিয়ে এজাহার দিয়েছে।’

‘আইচ্ছা! এখন কোন দিগে যাইবেন?’

‘গাঁয়ের পথ ধরে সোজা দক্ষিণ দিকে চলতে থাকো। কিছুদূর গেলেই একটা চক পড়বে।’

মতির হাত ধরে এগিয়ে যায় ফজল। চকে পৌঁছতে পৌঁছতে ফরসা হয়ে যায়।

চকের জায়গায় জায়গায় জমে আছে বৃষ্টির পানি। তারা ধান আর পাটখেতের আল ধরে পা চালায়। ধান আর পাট গাছের ঝরা পানিতে ভিজে যায় তাদের জামা-কাপড়।

ছড়ছড় আওয়াজ শুনে পাশের দিকে তাকায় ফজল।

‘আরে কই মাছ! বিষ্টিতে কই মাছ উজাইছে মতিভাই!’

‘ধরো।’

ফজল তিনটে কইমাছ পায় ধানখেতের মাঝে। মাছের কানকোর ভেতর পাটের কোষ্টা ঢুকিয়ে সে ঝুলিয়ে নেয় হাতে। চকের শেষ মাথায় পৌঁছতে পৌঁছতে গোটা পনেরো কইমাছ কুড়িয়ে পাওয়া যায়। এক হালটের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে পাওয়া যায় আরো সাতটা। সবগুলোকে সে কোষ্টায় গেঁথে নেয় মালার মতো করে।

মতি বলে, ‘আজ খাওয়াটা খুব জমবেরে ফজল।’

‘হ, আল্লা খুব মেহেরবান।’

‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। মতি হাসে। কিন্তু এই মেহেরবানিটা গতকাল জাহির করলেই ভাল করত আল্লা। কাল খিদের জ্বালায় যখন কষ্ট পাচ্ছিলাম তখন অত বিষ্টি না ছিটিয়ে আমাদের নৌকায় কিছু চিড়ে-মুড়ি ছিটিয়ে দিলে বুঝতাম আল্লা খুব মেহেরবান। তাহলে কি আর খিচুড়ি মেগে খেতে হতো কাল?’

পথের লোকের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা গন্তব্যস্থানে গিয়ে পৌঁছে।

বহু বছর পরে ভাইকে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলে বোন।