» » আঠার

বর্ণাকার

মতির বোনের বাড়ির তিনদিন ছিল ফজল। এমন একটি স্নেহের আশ্রয় ছেড়ে আসবার সময় চোখ তার ছলছল করে উঠেছিল। তার নিজের বড় বোন নেই। সে অভাব পূরণের জন্যই বোধ হয় মতিভাইয়ের সাথে এমন করে দেখা হয়েছিল তার।

চণ্ডীপুর থেকে নৌকা কেরায়া করে সে বাড়ি রওনা হয়। বাড়ির ঘাটে পৌঁছতে রাত হয়ে যায় বেশ। জেল থেকে পালাবার পর রাতের অন্ধকারে চলাফেরা করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে।

ফজল ছই-এর ভেতর থেকে বেরোয়।

বাড়িটা অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু অন্ধকারটা যেন বড় বেশি মনে হয় তার কাছে। বাড়ির সূর্য ডুবে গেছে, তাই বুঝি এত অন্ধকার।

ফজলের দুচোখ অশ্রুতে ভরে যায়। সে নৌকার ভাড়া মিটিয়ে ঘাটে নামে। দুঃসহ বেদনায় ভরাক্রান্ত দেহটা বয়ে নিয়ে চলে পা দুটো। কিন্তু পায়ের নিচের মাটিতে যে আশ্বাস নেই, ভরসা নেই।

চলতে চলতে তার মনে আবার সেই ভয় জাগে; তাকে দেখেই বাড়ির সবাই কান্না জুড়ে দেবে। ইনিয়ে-বিনিয়ে বিলাপ করতে শুরু করবে। তা শুনে তার বাড়ি আসার কথা জেনে ফেলবে আশপাশের লোকজন। জেনে ফেলবে জঙ্গুরুল্লা আর আইনের মানুষ চৌকিদার আর দফাদারও।

ফজল দাঁড়ায়। ম্যাচবাতি জ্বালিয়ে সে ডানে বায়ে দৃষ্টি ফেলে। কিছু দূরেই দেখতে পায় তার পিতার কবর।

সে হাঁটু গেড়ে বসে কবরের পাশে। তার বুকের কান্না রুদ্ধ কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চায়। বেরিয়েও যায় দু-একবার। কান্নার বেগ রোধ করা যখন কঠিন হয়ে পড়ে তখন সে মুখটাকে শক্তহাতে চেপে ধরে নদীর কিনারায় ফিরে আসে। সেখানে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলে অনেকক্ষণ। কিছুটা শান্ত হলে চরের কিনারা ধরে সে এগিয়ে যায় পশ্চিম দিকে মেহের মুনশির বাড়ি।

দু-তিনবার দরজায় খটখট দেয়ার পর মেহের মুনশির ঘুম ভাঙে। আচমকা ঘুম ভেঙে সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কে? কেডা ও?’

‘আমি। আমি ফজল।’

‘ফজল, আহারে ভাই, আইছ তুমি!’ কান্নাঝরা কণ্ঠে বলে মেহের মুনশি। থিতিয়ে আসা শোক আলোড়ন তোলে তার বুকের ভেতর। নিজেকে সামলে নিয়ে সে কুপি জ্বালায়। ঘর থেকে বেরিয়ে ফজলকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, ‘তোমার লেইগ্যা চিন্তায় জারাজারা অইয়া গেছি আমরা। চাচিজি কাইন্দা চউখ অন্ধ কইর‍্যা ফালাইছে।’

উদ্গত শোকাবেগ অনেক কষ্টে সংবরণ করে ফজল বলে, ‘মা-র কান্দাকাডির ডরে বাড়িতে যাই নাই। কান্দাকাডি শুনলে সব মানুষ টের পাইয়া যাইব।’

মেহের মুনশি তার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। চৌকির ওপর বসিয়ে বলে, ‘বাড়িত না গিয়া ভালই করছ। গেল রাইতের আগের রাইতে পুলিস ঘেরাও করছিল তোমায় বাড়ি। কিন্তুক আমি জিগাই, তোমারে এই অলক্ষ্মীতে পাইল ক্যান? জেলেরতন ক্যান্ পলাইয়া আইছ?’

‘পলাইয়া আইছি শোধ নিতে। জঙ্গুরুল্লার লগে দোস্তালি পাতাইছে আরশেদ মোল্লা।’

‘হ, পা-না-ধোয়ার পাও ধইর‍্যা আরশেদ মোল্লা বিশ নল জমি পাইছে খুনের চরে।’

‘জমিডা ভাল কইর‍্যা খাওয়াইয়া দিমু। সবুর করেন মিয়াভাই। এই দুইডারে জবাই করতে না পারলে আমার রক্ত ঠাণ্ডা অইব না।’

‘কিন্তুক খুনাখুনি কইর‍্যা কি ফয়দা অইব?’

‘এই দুই জানোয়ারের লাশ পচাইয়া সার বানাইমু চরের মাডির। ওগ হারামিহয়রানির লেইগ্যাই বা’জান মারা গেছে, না অইলে বা’জান এত তাড়াতাড়ি মরত না।’

‘হ ঠিক কথাই কইছ। কিন্তুক–’

‘আপনে আর ‘কিন্তুক কিন্তুক’ কইরেন না তো মিয়াভাই। আপনে বুড়া অইয়া গেছেন। আপনের রক্তে তেজ নাই। আমার রক্ত যে টগবগ করতে আছে রাইতদিন।’

‘আমার কথা হোন ফজল। খুন-জখমি কইর‍্যা আরো বিপদ অইব। মামলামকদ্দমা। জেল-ফাঁসি—’

‘জেল-ফাঁসিরে আর ডরাই না, মিয়াভাই। জাহান্নামি দুইডারে খুন না করতে পারলে আমার পরান ঠাণ্ডা অইব না। ওরা জাহান্নামি। ওগ মাপ করলে জাহান্নামে যাইতে অইব।’

‘চর দখলের কি করবা?’

‘চর দখল করতে অইব। আপনেরা একজন মাতবর ঠিক করেন। তারপর—’

‘মাতবর ত তুমি।’

‘আপনে একলা কইলে তো অইব না। সব্বাই যদি না মানে তবে আর কিসের মাতবর।’

‘মানব না ক্যান। বেবাকে মানব।’

‘কিন্তু আমি তো এখন ফেরার। ডুব দিয়া রইছি। যদি কোনোদিন ভাসতে পারি তখন না হয় আমারে মাতবর বানাইবেন। এখন কারোরে মাতবর ঠিক করেন। পলাইয়া পলাইয়া যতখানি পারি ততখানি সাহায্য আমি করমু। কিন্তু আমি চরে আইছি এই খবর যেন কেও না জানে।’

‘না, একটা কাউয়ার কানেও যাইব না এই কথা। কিন্তু একবার চাচির লগে দেহা করণ তোমার দরকার।’

‘মা যেই রহম কান্দাকাডি করে। বেবাক মানুষ টের পাইয়া যাইব। চৌকিদার-দফাদার টের পাইয়া খবর দিব পুলিসের কাছে।’

‘হোন, আমি ভোরে গিয়া চাচিজিরে বুঝাইমু। কান্দাকাডি করতে মানা করমু। আর যদি কান্দতে চায় তয় যে কাইল দিনের বেলায়ই কাইন্দা লয় কতক্ষণ। তারপর রাইতের বেলা তোমারে লইয়া যাইমু।’

‘হ তাই করেন।’

‘আরে খালি কথা আর কথাই কইতাছি। তোমার খাওনের কথা জিগাইতে মনে নাই।’

‘উঁহু, আমার খাওয়া লাগব না। নতুন বইন পাইছি একজন। পথে খাওনের লেইগ্যা মুড়ি, নারকেলের লাড়ু আর ফজলি আম দিছিল।’

‘কে এমুন বইনডা।’

‘আপনে চিনবেন না। মায়ের পেডের বইনের মতন।’

‘আইচ্ছা, আমি বিছান কইর‍্যা দিতাছি। ঘুমাইয়া পড় জলদি। রাইত দুফর কাবার অইয়া গেছে।’

মেহের মুনশির ঢেঁকিঘরের এক পাশে শুকনো লটাঘাসের স্তূপ। বর্ষার সময় এগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। স্তূপের আড়ালে হোগলার বিছানায় একটা পুরো দিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয় ফজল। তার মনের ভেতর পদ্মার স্রোতের মতো আঁকা-বাঁকা চিন্তা বয়ে চলে। বাবা, মা, আমিনা, নূরু, স্বার্থপর রূপজান, দুঃখিনী জরিনা সবাই এসে বারবার নোঙর ফেলে সেই স্রোতে। কখনো সে স্রোত ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি করে। তার মাঝে ঘুরপাক খায়। আরশেদ মোল্লা আর জঙ্গুরুল্লা। ফজলের মনের বিক্ষুব্ধ ঢেউ আছড়ে পড়ে তাদের ওপর।

সন্ধ্যার অনেক পরে মেহের মুনশির সাথে সে বেরোয়। বাড়ির উঠানে পৌঁছতেই নূরু ছুটে এসে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। বরুবিবি শব্দ পেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মেহের মুনশি ধমক দিয়ে তাকে বিপদের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে থামে। ফজলও অনেক কষ্টে সংবরণ করে নিজেকে।

সে মায়ের কাছে গিয়ে বসে। তাদের রুদ্ধ কান্না বুক ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। কখনো সে কান্না ফুঁপিয়ে বেরোয়। তাদের গাল বেয়ে নামে অশ্রুর প্রপাত।

বরুবিবি ফজলের মুখে মাথায় হাত বুলায়। মা ও ছেলে দুজনেই বড় বেশি অভিভূত হয়ে পড়েছে। কারো মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোয় না।

মেহের মুনশির তাড়া দেয়, ‘ও চাচি, বেশি দেরি করণ যাইব না। কিছু খাওয়াইতে মন চাইলে জলদি কইর‍্যা খাওয়াইয়া দ্যাও।’

ফজল বাড়ি আসবে খবর পেয়ে অনেক পদ রান্না করেছিল বরু বিবি। আমিনা খাবার পরিবেশন করে। কিন্তু ফজলের গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না। সে শুধু চিবোয়। কয়েক গ্রাস মুখে তুলে এক গ্লাস পানি খেয়ে সে উঠে পড়ে।

বরুবিবি ঝাঁপসা চোখ মেলে চেয়ে থাকে ছেলের দিকে, ধরা গলায় বলে, ‘কিছুই তো খাইলি না বা’জান?’

‘না মা, খিদা নাই একদম! এইখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। আমি যাই।’

বরুবিবি আবার ফোঁপাতে শুরু করে।

‘তুমি কাইন্দ না মা। আমি ধারে কাছেই কোনো জায়গায় থাকমু। কারো কাছে কইওনা কিন্তুক। ও আমিনা, ও নূরু খবরদার!’

আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে মেহের মুনশির সাথে বেরিয়ে পড়ে ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে।

জরিনাকে যখন কথা দিয়ে গেছে ফজল, তখন নিশ্চয়ই সে আসবে। সে জেল থেকে পালিয়েছে। তার এখন আশ্রয়ের প্রয়োজন। কিন্তু ঘরে রয়েছে শাশুড়ি। তাকে দূরে কোথাও পাঠাতে না পারলে কেমন করে তার ঘরে ফজলকে সে জায়গা দেবে? তাই সে একদিন একটা বাহানা তৈরি করে, ‘আম্মা আপনের শরীলডা খুব কাবু অইয়া গেছে।’

‘বুড়া মানুষ। কাবু অইলে আর কি করমু।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নাজুবিবি।

‘আমিতো আপনেরে প্যাড ভইরা দুইডা খাইতেও দিতে পারি না। আর যেই দিনকাল পড়ছে। ধান ভানতে বড় বেশি ডাক দেয় না কেও। চাউলের কল অওনে এই দশা। ঘর লেপন আর চিড়া কোডনের কামে আয় নাই।’

‘হগো মা। দিন-কাল বড় খারাপ পড়ছে। তুই আমার প্যাডের মাইয়ার তনও বেশি। যারে পেডে রাখছিলাম, হেই লক্ষ্মীছাড়াডা একটা পয়সাও দেয় না। তুই না থাকলে এতদিনে মইর‍্যা যাইতাম।’

‘আম্মাগো, এহন বুঝি না খাইয়া মরতেই অইব। আপনে এক কাম করেন–আপনের বইনের বাড়ি বেড়াইতে যান কয়ডা দিনের লেইগ্যা। ভাল্-ভালাই খাইয়া আহেন। আপনের শরীলডাও ভাল অইব আর এদিগে ঘরে কিছু চাউল-ডাইলও জমা অইব।’

বেড়াতে যাওয়ার নামে নাজুবিবির ঠ্যাঙ দুটো ডিলিক দিয়ে ওঠে সব সময়। বউ একা ঘরে থাকবে বলে বেড়াবার শখ চেপে রাখতে হয় তাকে। এখন বউয়ের কাছ থেকেই যখন প্রস্তাব এসেছে বেড়াতে যাওয়ার তখন সে মনে মনে খুশি হয়। মুখে বলে, ‘কিন্তু আমি গেলে তুই ঘরে একলা থাকবি ক্যামনে?’

‘আমার লেইগ্যা চিন্তা কইরেন না। যেই বাড়ি কাম করতে যাইমু, হেইখানেই থাকতে পারমু আমি।’

নাজুবিবি পরের দিনই তার বোনের বাড়ি চর-কানকাটা চলে যায়।

জেল-পালানো আসামি রাতের আঁধারেই আসবে–বুঝতে পারে জরিনা। তাই দিনের বেলা যেখানেই থাকুক, যে কাজেই থাকুক, বেলা ডোবার আগেই সে বাড়ি ফিরে আসে।

ফজল কাঁজির ভাত খুব শখ করে খায়। জরিনা তাই কাঁজি পেতে রেখেছে। পানিভরা মাটির হাঁড়িতে ফেলে রাখা হয় যে চাল তারই নাম কাঁজি। কাঁজির ভাত খেতে যে সব অনুপান উপকরণের দরকার তারও কিছু কিছু সে যোগাড় করে রেখেছে। লশকর বাড়ি থেকে চেয়ে এনেছে মুঠো খানের মেথি আর কালিজিরা। এগুলো খোলায় টেলে বাটা হবে। নদীতে গোসল করার সময় শাড়ির আঁচল দিয়ে ধরেছে ছোট ছোট মাছ–চেলা আর খরচান্দা। অল্প কয়েকটা মাছ এক দিনেই যা পেয়েছিল। পরের দিন এ মাছ ধরবার সময় ভটভট আওয়াজ তুলে যাচ্ছিল একটা কলের নৌকা। যাচ্ছিল বেশ কিছু দূর দিয়েই। হঠাৎ ওটা মোড় নেয় কিনারার দিকে। জরিনা জাবড়ি দেয় পানির ভেতর। গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দেয় শরীর। আঁচল ঠিক করে গায়ে জড়ায়, ঘোমটা টানে। দুটো ধলা মানুষ শিষ দিচ্ছিল। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সে দেখে পাঁচ কি দশ টাকার কয়েকটা নোট দেখিয়ে কুৎসিত ইশারা করছে একটা বাঁদরমুখো।

জরিনা পাড়ে উঠে একদৌড়ে এসে ঘরে ঢোকে। তারপর থেকে নদীর ঘাটে যাওয়ার আগে চারদিক ভাল করে দেখে নেয় সে।

সেই চেলা আর খরচান্দা মাছ কয়টা শুঁটকি দিয়ে রেখেছে জরিনা। শুঁটকি মাছের ভরতা কাঁজির ভাতের এক বিশেষ অনুপূরক।

পুরানো দুটো চাঁই ছিল ঘরের বেড়ায় টাঙানো। সে দুটোর পেটে সুতোয় গাঁথা ফড়িংয়ের টোপ ভরে সে লটা ঝোঁপের আড়ালে পেতে রাখে রোজ বিকেল বেলা। ভোরে উঠিয়ে তার ভেতর পায় পাঁচ-সাতটা করে ছোট আণ্ডালু চিংড়ি। তিন-চার দিনে অনেকগুলো হয়েছে। সবগুলোই সে জিইয়ে রেখেছে একটা পানিভরা বৌকার ভেতর। রান্নাঘরের চালে বিছিয়ে রয়েছে ফনফনে পুঁই লতা। পুঁই-চিংড়ির চচ্চড়ি ফজলের খুব প্রিয়।

খালাসিবাড়িতে ধান ভেনে সেদ্ধ চালের বদলে আতপ চাল চেয়ে এনেছে জরিনা। এ চাল পাটায় বেটে আর কিছু না হোক কয়েকটা চিতই পিঠা বানিয়ে ফজলের সামনে দিতে পারবে সে। ঘরে গুড় আছে। এখন একটা নারকেল যোগাড় করতে হবে যেভাবে হোক।

তিন-চার দিন পরে আসবে বলেছিল ফজল। কিন্তু সাত দিন পার হয়ে গেছে সে এল না। জরিনার একবার মনে হয়, সে আর আসবে না। পরক্ষণেই আবার মনে হয়–পুলিসের ভয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে হয়ত। সেখান থেকে বেরুতে পারছে না।

জরিনা চাঁই দুটো নিয়ে নদীর পাড়ে যায়।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। অস্তগামী সূর্যের গায়ে এক ফালি মেঘ বিধে রয়েছে বর্শার ফলার মত। সে আঘাতে সূর্যের রক্ত যেন ছড়িয়ে পড়েছে টুকরো টুকরো মেঘের ওপর।

শাড়িটাকে কোমরে গুঁজে হাঁটুর ওপর তুলে নেয় জরিনা। তারপর পানিতে নেমে চাইদুটো লটা ঝোঁপের ভেতর পেতে রাখে।

ডাঙায় উঠেই তার চোখে পড়ে একজোড়া বক। বকদুটো পাখা ঝাড়ছে, ঠোঁট দিয়ে একে অন্যের পালকে বিলি দিচ্ছে। আজকের মতো শেষ হয়েছে ওদের মাছ শিকার। এখন রাতের আস্তানায় ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বগা উড়ে এসে তাড়া করে জোড়ের বগাটাকে। ওটাকে অনেক দূর হটিয়ে দিয়ে সে বগির দিকে আসে এবং গলা বাড়িয়ে ঠোঁট নেড়ে সোহাগ জানায়। বগিটা উড়াল দিয়ে ওর ভীরু দুর্বল সঙ্গীর কাছে চলে যায়। শক্তিশালী বগাটা আবার আক্রমণ করার আগেই বগা আর বগি সোজা দক্ষিণ দিকে উড়ে চলে যায়।

পলকহীন চোখ মেলে জরিনা চেয়ে থাকে উড়ন্ত বক-জোড়ার দিকে। ওরা দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে সে ঘরের দিকে রওনা হয়।

আবার ফজলের চিন্তায় আচ্ছন্ন হয় তার মন। তাকে পুলিস ধরে নিয়ে যায়নি তো?

জরিনার বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। চোখের কোণে চকচক করে পানি।

হঠাৎ তার মনে হয়, বেগানা পুরুষের জন্য এমন করে চিন্তা করা তার অন্যায়। ঘোর অন্যায়। নিজের স্বামীর জন্য সে-তো এমন করে ভাবে না। তার স্বামী ফেরার। পুলিসের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। কি খায়, কোথায় থাকে, ঠিক-ঠিকানা নেই। তার জন্য তো একফোঁটা পানিও ঝরে না তার চোখ থেকে।

হঠাৎ দরদর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার দু’গাল বেয়ে।

এ অশ্রু কার উদ্দেশে তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন বোধ করে না জরিনা। তার মনের অপরাধবোধটাই এখন সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে।

আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে পাশের চর থেকে। শিথিল আঁচল টেনে মাথায় দেয় জরিনা। ঘরে গিয়ে কুপি জ্বালে। নামাজ সে কদাচিৎ পড়ে। কিন্তু আজ হঠাৎ নামাজ পড়ার তাগিদ অনুভব করে সে তার মনের ভেতর।

সে অজু করে নামাজের জন্য দাঁড়ায়। অজু করা সত্ত্বেও কেমন না-পাক মনে হয় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সারা শরীর ছেয়ে রয়েছে কেমন এক অশুচিতা।

একটা মাত্র ভাল শাড়ি আছে তার। গোলাপী রঙের সেই শাড়িটাই তার পরনে। আজই ওটা বাক্স থেকে নামিয়ে ধোয়া হয়েছিল। এ পরিষ্কার শাড়িটাই তার কাছে নাপাক মনে হয়।

জরিনা শাড়িটা খুলে তালিমারা একটা শাড়ি পরে। আবার অজু করতে বসে প্রথমেই সে চোখের কাজল পানি দিয়ে ঘষে মুছে ফেলে। নখ দিয়ে আঁচড়ে তোলে কপালের টিপ। যত্ন করে বাঁধা খোঁপাটাও খুলে ফেলে সে।

নামাজের শেষে সে মোনাজাত করে, ‘আল্লাহ তুমি রহিম, তুমি রহমান। আমার গুনা তুমি মাপ কাইর‍্যা দ্যাও আল্লা। আমার শরীলের গুনা, মনের গুনা, চউখের গুনা মাপ কইর‍্যা দিও আল্লাহ্। রাববানা আতেনা ফিদুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখেরাতে হাসানাতাও ওয়াকেনা আজাব আন্-নার। আমিন।’

অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে চরের বুকে। জরিনা বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। চলন্ত নৌকার পালগুলো অস্পষ্ট হতে হতে দূরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। চাঁদহীন আকাশে তারার মহোৎসব।

আজ আর রান্না-বান্নার প্রয়োজন নেই। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সে ধান ভেনেছে গাজিবাড়ি। দুপুরে সেখানেই খেয়েছে। আজ রাতে তার না খেলেও চলবে।

জরিনা ঘরে গিয়ে কুপি নিবিয়ে শুয়ে পড়ে। গত তিনচার দিন কুপি জ্বালিয়ে সে অনেক রাত পর্যন্ত বসে কাটিয়েছে। নষ্ট করেছে যুদ্ধের বাজারের দুষ্প্রাপ্য কেরোসিন। সে কয়দিনের উনা ঘুমের জন্য এখন দুনা ঘুমের প্রয়োজন। আজ আবার সারাদিন খুব খাটুনি গেছে। এ অবস্থায় শুতে না শুতেই চোখ বুজে আসার কথা। কিন্তু চোখ বুজেও ঘুম আনতে পারছে না জরিনা। সে নামাজে বসে মনের যেসব গুনা, অবাঞ্ছিত ভাবনা-চিন্তা, কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে এসেছিল, তাড়িয়ে দিয়েছিল উড়তে সক্ষম পাখির ছানার মতো, সেগুলো এখন ফিরে আসতে চাইছে মনের নীড়ে।

এশার নামাজের আজান শুনে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে জরিনা। কুপি জ্বালে। অজু করে নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ শেষ করে মোনাজাতের জন্য হাত উঠায়, ‘আল্লা, সব গুনা মাপ করো আল্লা। শরীলের গুনা মনের গুনা, চউখের গুনা–সব গুনা–’

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট্।

জরিনার প্রার্থনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। সে তাড়াতাড়ি কুপিটা নিবিয়ে আবার শুরু করে, ‘আল্লা আমার সব গুনা মাপ করো। রাব্বানা আতেনা ফিদদুনিয়া—’

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট‌….

‘রাব্বানা আতেনা ফিদ্দুনিয়া—’ মোনাজাতের পরেরটুকু আর মনে আসছে না তার। কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কোনো রকমে সে ‘আমিন’ বলে মোনাজাতের হাত বুলায় চোখে ও কপালে।

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট্।

জরিনা কানে আঙুল দেয়। কিন্তু তবুও সে স্পষ্ট শুনছে, বারবার শুনছে হট্টিটির ডাক। তার মনের তারে ঝঙ্কার দিয়ে উঠছে যে টি-টি ডাক, তাই বুঝি শুনছে সে।

জরিনা ঘর থেকে বেরোয়। ডাকটা অনেক কাছে শোনা যাচ্ছে এখন। সে তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরের পেছনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

টিঁ-টিঁ-টিঁ আর শোনা যাচ্ছে না এখন। তবে কি ফজল চলে গেল? ভাবে জরিনা। যাক চলে যাক। আল্লায় যেন তার মুখ আর না দেখায়।

অস্পষ্ট পায়ের শব্দ শোনা যায়। জরিনা রান্নাঘরের কোণের দিকে গিয়ে উঁকি মারে। একটা মূর্তি উঠানে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ঠায়।

কিছুক্ষণ পরে মূর্তিটা নড়েচড়ে ওঠে। এগিয়ে গিয়ে দরজার ওপর টোকা দেয় কয়েকবার। কোনো সাড়া না পেয়ে ভেজানো দরজাটা খোলে। ম্যাচবাতি জ্বালিয়ে দেখে ঘরে কেউ নেই। মেঝেতে বিছানা পাতা। বালিশের পাশে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়ে রয়েছে।

সে দরজাটা ভেজিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ায়। চারদিকে চোখ বুলিয়ে বিড়ি ধরায়। সে সময়ে দেশলাইর আলোয় এক লহমার জন্য ফজলের মুখ দেখতে পায় জরিনা। তার অন্তরের স্নেহ-মমতা শাসন-শৃঙ্খলা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফজল রওনা হয়। জরিনার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে সাথে বুকটা যেন তার রিক্ত হয়ে যায়।

কিছুদূর গিয়েই ফজল ফিরে আসে। তার পায়ের মৃদু শব্দে জরিনার বুকের হাহাকার থামে।

ফজল ঘরে গিয়ে ম্যাচবাতি জ্বালিয়ে কুপি ধরায়। ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে সে বুঝতে পারে, খাবার হাঁড়ি-পাতিল এ ঘরে রাখা হয় না।

কুপি হাতে সে রান্নাঘরে যায়। সব হাঁড়ি-পাতিল চুলোর পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। এক কোণে একটা পানির কলসি। তার পাশে একটা মাটির বৌকা বাঁশের চালুনি দিয়ে ঢাকা। ওটাও বোধহয় পানিভরা।

ফজল চালুনিটা সরিয়ে হাত দেয় বৌকার ভেতর। সাথে সাথেই ভয়ে সরিয়ে আনে হাতটা।

ব্যথায় উৎপীড়িত মুখেও হঠাৎ হাসি ফোটে জরিনার। রান্নাঘরের পেছন থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সে সব কিছুই দেখছিল।

ফজল কুপিটি বৌকার মুখের কাছে নিয়ে দেখতে পায় চিংড়ি মাছ গিজগিজ করছে পানির ভেতর। সে বোকার মত হেসে ওঠে। ভাগ্যিস পান্তাবুড়ির মতো শিং মাছ জিইয়ে রাখেনি জরিনা।

কুপিটা নিবিয়ে সে বেড়া হেলান দিয়ে বসে থাকে। আহাদালীর ছোট্ট ডিঙি বেয়ে সে এসেছে। কেউ না দেখে সেজন্য ধানখেতের ভেতর ওটাকে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। এখন ওটা তুলে এত রাত্রে কার বাড়ি গিয়ে সে আশ্রয় নেবে?

খিদেয় চোঁ-চোঁ করছে পেট। ফজল কুপিটা জ্বালায় আবার। সে বৌকার ভেতর থেকে কয়েকটা চিংড়ি মাছ তোলে। জীবন্ত মাছগুলো ছট্‌কা মেরে ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। সে ওগুলোর খোসা ছাড়ায়। চিত্রা একটা হাঁড়ির ভেতর পানি ঢেলে মাছগুলোকে ভাল করে ধুয়ে নেয়। খুঁজেপেতে একটা চিমটা পাওয়া যায় বেড়ার সাথে গোঁজা। সেটার সাহায্যে একটা মাছ পাটখড়ির আগুনে ঝলসিয়ে সে মুখে দেয়। চিবোতে চিবোতে লবণের খোঁজ করে।

জরিনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তার বুকের ঝড় ছিন্নভিন্ন করে দেয় সব বাধা-বন্ধন। চোখের প্লাবনে ভেসে যায় সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। সে চোখ মুছে ঘোমটা টেনে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় রান্নাঘরের দরজায়।

ফজল চমকে পেছন ফিরে তাকায়। তার মুখে মলিন হাসি ফুটতে ফুটতে মিলিয়ে যায় জরিনার চোখে পানি দেখে।

দু’জনেই দু’জনের মুখের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কারো মুখ দিয়েই কোনো কথা বেরোয় না। নিজেকে সামলে নিয়ে ফজল বলে, ‘ঘরে অতিথি আইলে মানুষ খুশি অয়। তোমার চউখে পানি দেইখ্যা মনে অয় তুমি খুশি অও নাই।’

জরিনা নিরুত্তর। তার চোখের পানির উৎস কোথায় ফজল জানে। তাই পরিবেশটা স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে সে আবার বলে, ‘তুমি খুশি অও নাই, কেমন?’

‘না।’

ফজল জানে এটা তার অন্তরের কথা নয়। সে খুশি হয়েছে এ কথা তার মুখ থেকে শুনবার জন্য সে আবার বলে, ‘সত্য কইর‍্যা কও, তুমি খুশি আছ?’

‘না।’

‘তবে আমি চইল্যা যাই।’

জরিনা কোনো উত্তর দেয় না। চুলোর পাশ থেকে সে ভাতের হাঁড়িটা তুলে নেয়। ঘর থেকে চাল এনে ধুয়ে বসিয়ে দেয় চুলোর উপর।

‘জানো জরিনা, চাউল বড় মাংগা অইয়া গেছে।’

‘হ, আমিও হুনছি। তিন ট্যাহা মনের চাউল পাঁচ ট্যাহা অইয়া গেছে।’ চুলো ধরাতে ধরাতে বলে জরিনা।

‘দাম আরো বাড়ছে। আইজ দর উঠছে সাড়ে পাঁচ টাকায়।’

‘মানুষ এইবার না খাইয়া দপাইয়া মইরা যাইব।’

‘হ, এইবার কী যে উপায় অইব মানুষের, কওন যায় না। দুনিয়াজোড়া লড়াই চলতে আছে। চিনি পাওয়া যায় না। কেরোসিন পাওয়া যায় না–’

জরিনা বৌকার ভেতর থেকে আরো কয়েকটা চিংড়ি মাছ তোলে। মাছ কুটতে কুটতে সে বলে, ‘খুব খিদা লাগছে, না?’

‘হ সাংঘাতিক–’

‘খিদার চোডে মাছ পোড়াইয়া খাইতে শুরু করছিলা। পোড়া মাছ তো ভূতের ভোগ লাগে।’

‘হ ভূতই অইয়া গেছি। আইজ পুলিস আইছিল। খুব তালাশ করছে। সারা দিন আছিলাম একটা পাটখেতের মইদ্যে।’

‘ভাত ফুটতে বেশি দেরি লাগব না। তুমি চালের উপরতন কয়েকটা পুঁই এর আগা কাইট্যা আনো।’

ফজল পুঁই-এর ডগা কেটে এনে দেয়।

রান্না শেষ হয়। চুলোর পাশে পিড়ি বিছিয়ে ফজলকে খেতে দেয় জরিনা। মাটির বাসনে ভাত বাড়তেই ফজল বলে, ‘আমি আসছি বুইল্যা তুমি তো খুশি অও নাই। নিজের মোখেই তখন না করছ। বেখুশি মাইনষের ভাত তো মোখে দিতে ইচ্ছা করে না।’

‘বেখুশি মাইনষেরে দিয়া ভাত তো রান্দাইয়া ছাড়ছ। এহন মোখে দিতে ইচ্ছা করব না ক্যান?’ জরিনা মাছের সালুন দিতে দিতে বলে।

‘সত্য কইর‍্যা কও জরিনা, তুমি খুশি অইছ? না কইলে এই উইঠ্যা গেলাম আমি।’ ফজল সত্যি সত্যি উঠবার উদ্যোগ করে।

‘হ, খুশি অইছি। এইবার বিছমিল্লাহ করো।’

‘তুমি খাইবা না?’

‘আমি খাইছি।’ মিছে কথা বলে জরিনা।

‘আবার অল্প কইর‍্যা খাও আমার লগে।’

‘যহন দিন আছিল, তহনই একসাথে খাওয়ার সুযোগ পাই না। এহন আর–’

পেটে খিদে নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করতে ভাল লাগে না ফজলের। সে গোগ্রাসে খেয়ে চলে আর জরিনা বেশি বেশি করে ভাত তরকারি তুলে দিতে থাকে তার পাতে।

মেঝেতে পাতা হোগলার ওপর একটা নকশি কাঁথা বিছিয়ে দেয় জরিনা। তেলচিটে বালিশের ওপর বিছিয়ে দেয় নিজের হাতের তৈরি গেলাপ। তারপর মশারি খাটাতে খাটাতে বলে, ‘এইবার শুইয়া পড়। রাইত দুফর পার অইয়া গেছে।’

‘তোমার বালিশ কই? তুমি শুইবা না?’

‘উঁহু, আমি বইয়া পাহারা দিমু। জানোই তো চোরের বাড়ি। চৌকিদার-পুলিস আইতে পারে যে কোনো সময়।’

‘পুলিস আইতে পারে!’ আঁতকে ওঠে ফজল। ‘তবে তো এইখানে থাকন ঠিক না!’

‘আগে আইতো ঘন ঘন চোরবক্সরে ধরতে। এহন ক্বচিৎ কোনোদিন আহে।’

‘কিন্তু আমি ঘুমাইমু আর তুমি সারা রাইত জাইগ্যা থাকবা? তার চাইতে দুই জনই জাইগ্যা থাকি না ক্যান্। কথা কইতে কইতে রাইত পোয়াইয়া যাইব।’

অতীতের গর্ভে ডুবে যাওয়া নানা কথা, নানা স্মৃতি ভেসে উঠছে জরিনার মনেও। কিন্তু জরিনা এদের বেরুবার সুযোগ না দিয়ে বলে, ‘উঁহু কথা কইও না আর। নিসাড় রাইতের কথা অনেক দূর থিকা হুনা যায়।’

ফজল আর কথা বলে না।

জরিনা আবার বলে, ‘হোন, পুলিস আইলে যদি পলাইতে না পার, তবে ঐ কোনায় খাড়াইয়া থাকবা। আমি তোমারে হোগলা দিয়া প্যাচাইয়া দিমু। কেও বুঝতেই পারব না।’

‘হেষে দম ফাপর অইয়া মইরা যাইমু না তো!’

‘উঁহু। মরবা না। চোরা ভাদাম্যারে এই রহম কইর‍্যা বাঁচাইয়া দিছিলাম একদিন।’

জরিনা দরজায় খিল লাগিয়ে নিজের জন্য নামাজের মাদুরটা বিছিয়ে নেয়। তারপর কুপটি ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে বসে পড়ে তার ওপর।

ফজল বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে। রূপজানের কোনো খবর এখনো দেয়নি জরিনা। আর দিবে বলেও মনে হয় না। জরিনার বোধ হয় ভাল লাগে না রূপজানের নাম শুনতে। ফজলেরও তাই কেমন বাধোবাধো ঠেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে। শেষে দ্বিধা কাটিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, ‘মোল্লাবাড়ি গেছিলা?’

‘না।’

‘কোনো খবর আছে?’

‘হোনলাম, রূপজানের নিকার কথা পাকা অইয়া গেছে।’

‘নিকা! কার লগে?’

‘ফুলপুরী মওলানার লগে।’

‘অ্যাঁ! উত্তেজনায় চিড়বিড়িয়ে উঠে বসে ফজল। ঐ বুইড়ার লগে! ঐ পাকনা দাড়িওয়ালার লগে। রূপজান রাজি অইছে?’

‘মাইয়ালোক রাজি অইলেই বা কি, না অইলেই বা কি।’

‘বোঝলাম জঙ্গুরুল্লা আছে এর মইদ্যে। নিজের পীররে খুশি করণের কারসাজি।’

ফজল দাঁতে দাঁত ঘষে। তীব্র ক্রোধে ফুলে ওঠে তার সারা শরীর। পেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে।

জরিনা চেয়ে আছে মশরির দিকে। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। শুধু শোনা যায় ফজলের ফুঁসে ওঠা শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।

জরিনা তিনবার আয়াতুলকুরসি পড়ে আঙুল দিয়ে কুণ্ডলী দেয় তার চারদিকে আর মনে মনে প্রার্থনা করে, এই কুণ্ডলী ডিঙিয়ে দাগাবাজ শয়তান যেন তার কাছে আসতে না পারে।

ফজল বিড়ি টানছে বসে বসে। বিড়ির আগুন আলেয়ার মতো জ্বলছে আর নিভছে। জরিনার মনে হয়, আলৈয়াদানা যেন দাগা দেয়ার চক্রান্ত করছে। আলোয় আকৃষ্ট পোকার মতো তাকে টানছে আর টানছে।

সে চোখ বন্ধ করে। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে বিছানো মাদুরটা।

অনেকক্ষণ পর চোখ খোলে জরিনা। নিঃসীম অন্ধকারে সে ডুবে আছে। সাদা মশারির অস্পষ্ট আভাস চোখে পড়ে কি পড়ে না। কিন্তু তার অন্তরালের মানুষটিকে সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায়, শুনতে পায় তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস।

জরিনার মনের কোটরে ঘুমিয়ে থাকা চামচিকেটা জেগে ওঠে। নিশির ডাকে নিশাচরী বেরিয়ে যেতে চায়। তার ডানার ঝাঁপটায় জরিনার আঁকা আয়তুল কুরসীর কুণ্ডলী দূরে সরে যাচ্ছে, ফিকে হয়ে যাচ্ছে বুঝি।

জরিনা উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখা তসবি ছড়া সে নামিয়ে আনে। মুসল্লি বাপের স্মৃতিচিহ্ন এ হাজার দানার তসবি। লক্ষ লক্ষ বার জপিত আল্লার নাম ওর প্রতিটি গুটিকায়।

মাথা ও শরীর গলিয়ে সে তসবির মালা নামিয়ে দেয় মাদুরের ওপর। তসবির নিরাপদ আবেষ্টনীর মাঝে সে এবার শক্ত হয়ে বসে।

ফজলও বসে আছে। রূপজানের নিকের খবর শুনে তার রক্ত টগবগ করে উঠেছিল। সে রক্তে এখন উত্তাল তরঙ্গ। সে কোথায় কোন পরিবেশে আছে সে দিকে এতটুকু খেয়াল নেই। প্রতিহিংসার পরিকল্পনায় নিবিষ্ট তার মন।

আরশেদ মোল্লা আর জঙ্গুরুল্লা মানুষ নয়। মানুষের সুরত ধরে পয়দা হয়েছে দুটো জানোয়ার। ওদের চেহারা বিকৃত বীভৎস হয়ে দেখা দেয় তার মনের চোখে। ওদের চুল দাড়ি যেন জড়াজড়ি করে ঝুলছে সুতানালি সাপের মতো।

জাহাজের ফুৎ-ফুৎ সিটি শুনে সংবিৎ ফিরে পায় ফজল। ঝপড় ঝপড় আওয়াজ তুলে জাহাজ চলছে। কাশি দিয়ে গলা সাফ করে সে ডাকে, ‘জরিনা ঘুমাইছ?’

‘না। তোমার কি ঘুম ভাইঙ্গা গেল?’

‘না, ঘুমাই নাই এহনো।’

‘ঘুমাও, রাইত দুফর কিন্তু পার অইয়া গেছে।’

‘ঘুম আর আইব না। তোমার ঘরে কেরোসিন তেল আছে?’

‘কেরোসিন দিয়া এত রাইতে কি করবা?’

‘আছে কোনো দরকার।’

‘কি দরকার?’

‘সাপের খোন্দলে আগুন লাগাইমু।’

‘এত রাইতে সাপের কথা মনে অইল ক্যান? সাপের ব্যথা দ্যাও নাই তো?’

‘সাপের জাত। ব্যথা না দিলেও তো কামড়াইতে পারে।’

‘আইচ্ছা, রাইত পোয়াইলে যোগাড় কইরা দিমু। তুমি ঘুমাও এইবার।’

জরিনা উঠে গিয়ে মশারির চারপাশ গুঁজে দেয় হোগলার তলা দিয়ে। তারপর বলে, ‘ভাল কইর‍্যা গুঁইজ্যা দিছি মশারি। সাপ-খোপ আর ঢুকতে পারব না। তুমি নির্ভাবনায় ঘুমাও এইবার।’

ফজল বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। জরিনা গিয়ে বসে তসবির নিরাপদ বেষ্টনীর মাঝে।