জরিনার বাড়িতে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। তার শাশুড়ি বা স্বামী যে কোনো সময়ে এসে যেতে পারে। চৌকিদার-দফাদার বা পুলিসও হঠাৎ হানা দিতে পারে হেকমতকে ধরবার জন্য।
নিরাপদ আশ্রয় আছে অনেক। কিন্তু এখানকার বাতাসে যে স্নেহ-প্রীতি, পরিবেশে যে অন্তরঙ্গতা, তা কোথায় গেলে পাওয়া যাবে? হয়ত পাওয়া যাবে কোথাও–ফজল ভাবে। কিন্তু সকলের স্নেহ-প্রীতিতে কি আন্তরিকতা আছে? অন্তরঙ্গ পরিবেশও হয়ত পাওয়া যাবে। কিন্তু সব অন্তরঙ্গতার অন্তকরণ নাও থাকতে পারে।
ফজলের হাতে অনেক কাজ। দূরের কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আর ধারেকাছের কোনো বাড়িতে থাকতেও সাহস পায় না সে। কখন কে পুলিসের কাছে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেবে তার কি কোনো ঠিক আছে? নিজের বউয়ের বাপই যখন এমন কাজটা করতে পারল, তখন আর সে কাকে বিশ্বাস করতে পারে?
জরিনাদের বাড়ির পুবদিকে একটা ধানখেত। সেটা পেরিয়ে আরো পুবদিকে বহুদূর বিস্তৃত পাটখেত। এই পাটের অরণ্যে আস্তানা গাড়ে ফজল, লুকোবার একটা জায়গা করে নেয়। একটা ছোট চৌকির আয়তনের সমান জায়গার পাট সে উপড়ে ফেলে, বিছিয়ে দেয় সেগুলো মাটির ওপর। পাটগুলোর কয়েকটা নখ দিয়ে চিকিয়ে সে কোষ্টা বের করে! এ কোষ্টা দিয়ে দুপাশের পাটগুলোকে ধনুকের মতো বাঁকা করে জোড়ায় জোড়ায় বাঁধে। এভাবে ছই এর একটা কাঠামো তৈরি করে ফেলে সে। এবার কাঠামোর ওপর কয়েকটা আস্ত কলার ডাউগ্গা বিছিয়ে কোষ্টা দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। ছইটা মুষলধার বৃষ্টি ঠেকাতে না পারলেও দুপুরের রোদ আর গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি ঠেকাতে পারবে বলেই মনে হয় ফজলের। সে বিছানার জন্য একটা ছেঁড়া মাদুর, শিথানের জন্য তুষভরা ছোট্ট একটা থলে আর একটা মাথাল নিয়ে এসেছিল জরিনার কাছ থেকে। প্রবর বর্ষণের সময় মাথালটা দরকার হবে। তখন মাদুরটা গুটিয়ে থলেটা বগলে নিয়ে, মাথালটা মাথায় চড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে বসলে ভিজতে হবে না তেমন, আর বিছানাটাও জবজবে হবে না ভিজে।
তুষের বালিশে মাথা রেখে মাদুরের ওপর শোয় ফজল। খুব একটা খারাপ লাগছে না। ছেঁড়া কলাপাতার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায়। সাদা মেঘ, কালো মেঘ উড়ে যাচ্ছে। মেঘ সরে গেলে উঁকি দেয় রোদ। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাঁপটায় ফেটে যাচ্ছে ছই-এর কলাপাতা।
দক্ষিণ দিক থেকে চিট-চিট-চিট পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ফজল মাথা উঁচু করে। পাটগাছের ভেতর দিয়ে দৃষ্টি চলে তার। সে দেখতে পায়–কিছু দূরে পাটগাছের সাথে বাসা বুনছে বাবুই পাখি। এ পাটখেতের পরেই ধানখেত। আউশ ধান পাকার সময় হয়েছে– বুঝতে পারে ফজল।
আউশ ধান পাকার সময় হলে আসুলি এলাকার তাল-বাবলা গাছের বাসা ছেড়ে ঝাঁক বেঁধে এগুলো আসে। দূর থেকে আসা-যাওয়ার সময় নষ্ট হয়, ডানায় ব্যথা ধরে, পেটের দানাও যায় হজম হয়ে। তাই ধানখেতের কাছাকাছি কোনো পাটখেতে এরা অস্থায়ী বাসা তৈরি করে। শুধু চর অঞ্চলেই নয়, আসুলির বিল অঞ্চলেও এরা ধান পাকার সময় এ রকম অস্থায়ী বাসা তৈরি করে।
ফজল ভাবে, সময়ের মূল্য এ ছোট পাখিগুলোও বোঝে। তাই ওরা তাদের মতোই তৈরি করছে ভাওর ঘর।
শুক্লা সপ্তমীর চাঁদ ডুবে গেছে। ফজল পাটখেত থেকে বেরোয়। এগিয়ে যায় নদীর দিকে। নদীর পাড়ের ধানখেতে ডুবিয়ে রাখা ডিঙিটা তুলে সে চরাটের ওপর বৈঠা নিয়ে বসে। চারদিকটা ভাল করে দেখে নেয়। টহলদার কলের নৌকার সন্ধানী আলো দেখা যায় না কোথাও। এ কলের নৌকার ভয়ে রাতে নৌকা চলাচল প্রায় বন্ধ। জেলেরাও সন্ধ্যার আগেই জাল গুটিয়ে কোনো নিরাপদ ঘেঁজায় পাড়া গেড়ে বিশ্রাম নেয়।
ফজল নলতার খাড়ি ধরে বেয়ে নিয়ে যায় ডিঙিটাকে।
টুকরো টুকরো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। যেন ধোপার কাপড় শুকোবার মাঠ। মেঘের ফাঁক দিয়ে তারা উঁকি মারছে। দিনের দুপুর থেকে রাতের দুপুর পর্যন্ত দাপাদাপি করে বাতাসের ডানা এখন ক্লান্ত। ক্রান্তি নেই শুধু পানির। গা দুলিয়ে নেচে নেচে কুলকুল গান গেয়ে অবিরাম বয়ে যাচ্ছে পানি। রুপালি পানির আভাস পাওয়া যাচ্ছে অন্ধকারেও।
উজান ঠেলে ধীরগতিতে চলছে ডিঙি। নিজের বৈঠার শব্দের সাথে তাল রেখে চলছে ফজলের হৃদস্পন্দন।
যে কাজের জন্য সে বেরিয়েছে, তার পরিকল্পনা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। এখন ডিঙিটাকে পেছনে ফেলে তার মন পৌঁছে গেছে ঘটনাস্থলে।…উত্তর ভিটির এ ঘরে থাকে আরশেদ মোল্লা। ব্যাটা জানোয়ার! কোনো দয়ামায়া নেই তোর জন্য। বাইরে থেকে দে শিকল এঁটে দুটো দরজায়। জানোয়ারটা বেরুতে পারবে না আর। চারদিকের বেড়ায় দে কেরোসিন ছিটিয়ে। ভয় কিসের? ম্যাচবাতির কাঠি জ্বালিয়ে দে আগুন!
ফজলের মনে দাউদাউ করে জ্বলছে ক্রোধের আগুন।
আগুন! আগুন! বাঁচাও! বাঁচাও!!
হঠাৎ অনেক মানুষের আর্তচিৎকার ফজল শুনতে পায় তার নিজের মনে।
বাঁচাও! বাঁচাও!!
এ চিৎকার শুধু আরশেদ মোল্লার নয়। রূপজানের চিৎকারও যে শোনা যাচ্ছে। আগুন কি ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমভিটি ঘরেও? হ্যাঁ তাইতো! ঘরের লাগোয়া ঘর। শ-শ করে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন।
রূপজান!
একটা অস্ফুট চিৎকার দিয়ে চেতনা ফিরে পায় ফজল। তার বৈঠা টানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হাল ছেড়ে দেয়ায় ঘুরে যাচ্ছিল ডিঙিটা।
ফজল ডিঙিটাকে ডানদিকে ঘুরিয়ে নেয়। কিছুদূর গিয়ে আরেকটা খাড়ির মধ্যে ঢোকে। ভাটির টানে এবার দ্রুত এগিয়ে যায় ডিঙি।
সব চক্রান্তের মূলে আছে পা-না-ধোয়া জানোয়ারটা। ওকেই খতম করতে হবে আগে। ওর সাথে পুড়ে মরবে ওর বউ-ছেলে-মেয়ে সব। যাক, পুড়ে ছাই হয়ে যাক, কালসাপের বংশ নির্বংশ হোক।
ডিঙিটাকে লটাঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রেখে সে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়। চার ভিটিতে চারখানা ঘর। ঢেউটিনের চালা, পাতটিনের বেড়া। এ ঘরে আগুন লাগানো সহজ নয়। কপাট, চৌকাঠ, রুয়া-বাগা কাঠের। দরজা আর জানালার কপাটে লাগাতে হবে আগুন। গত বছর পাটের দাম কম ছিল। পাট নিশ্চয়ই বেচেনি জঙ্গুরুল্লা। ঘরে পাট থাকলে তো কথাই নেই। ফরফর করে জ্বলে উঠবে আগুন।
জঙ্গুরুল্লা কোন ঘরে থাকে–ফজলের জানা নেই। ঘরগুলোর সবকটা দরজা বাইরে থেকে শিকল এঁটে বন্ধ করে দেয় সে। বোতল থেকে হাতের তেলোয় কেরোসিন ঢেলে ছিটিয়ে দেয় কপাট-চৌকাঠগুলোয়। তারপর ম্যাচবাতির কাঠি জ্বালায় সে। জ্বলন্ত কাঠি-ধরা হাতটা তার এগিয়ে যায় কপাটের দিকে।
ওয়াঁ-আঁ–ওঁয়া-আঁ-আঁ।
শিশুর কান্না। ফজলের হাতটা থেমে যায়। বুকটা কেঁপে ওঠে। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস এসে নিবিয়ে দেয় কাঠির আগুন।
ওয়াঁ-আঁ–ওঁয়া-আঁ-আঁ।
অসংখ্য নিষ্পাপ শিশুর কান্না প্রতিধ্বনি তোলে তার বুকের ভেতর। সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই একটা জানালা।
ঘরের ভেতর হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে। সে কুপির আলোয় দেখতে পায় একটি তরুণী মা শিশুর ভিজে কাঁথা বদলে দিচ্ছে।
ওয়াঁ-আঁ–ওঁয়া-আঁ-আঁ।
আবার সেই কান্না। ফজলের অভিভূত দৃষ্টির সামনে মা ও শিশু। মা কোলে তুলে নিয়েছে শিশুকে। বুকের কাপড় সরিয়ে স্তনের বোঁটা শিশুর মুখে দিতেই তার কান্না থেমে যায়। নিষ্পাপ শিশু নিশ্চিন্ত আরামে স্তন চুষছে আর হাত-পা নাড়ছে।
ফজল আর দেরি করে না। সে সব কটা দরজার শিকল খুলে দিয়ে নিঃশব্দে ফিরে যায় নদীর ধারে। তারপর লটা ঝোঁপের আড়াল থেকে ডিঙিটা বের করে সে বৈঠায় টান মারে।
আক্রোশের আগুন নিবে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। এবার সে আগুন দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে ওঠে তার মনে। প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে, কিন্তু কাপুরুষের মতো নয়।
জোরে বৈঠায় টান মারে ফজল। তাকে অনেক উজান পানি ভাঙতে হবে। সময়টা পূর্ণিমা-অমাবস্যার মাঝামাঝি। তাই স্রোতের বেগ এখন অনেক কম। তবুও উজান ঠেলে যেতে ফজলের কষ্ট হচ্ছে খুব। স্রোত কেটে ছলচ্ছল আওয়াজ তুলে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলছে ডিঙি।
নিঃসীম অন্ধকার। ইচাণ্ডা খাড়ির মুখে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে।
ক্ষীণ ভটভট শব্দ আসছে পশ্চিম দিক থেকে। দুরের ফুলে ছাওয়া কাশবন আর নদীর রুপালি পানি মাঝে মাঝেই ঝলমলিয়ে উঠছে সার্চ লাইটের ফোয়ারায়।
ফজল বুঝতে পারে টহলরত গোরা সৈন্যের লঞ্চ আসছে। সে প্রাণপণ বৈঠা টেনে চর বগাদিয়ার কিনারায় চলে যায়, লটা বনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ডিঙিটা। ওটাকে লটাবনের আঁড়ালে বেঁধে সে নেমে পড়ে ডাঙায়।
তিন বছর আগের পয়স্তি চর এই বগাদিয়া। জঙ্গুরুল্লার বড় ছেলে জাফর ও তাদের কয়েক ঘর কোলশরিক ও বর্গাদারের বসত এ চরে। তারা টের পেলে জান-পরান হারিয়ে ভেসে যেতে হবে গাঙের স্রোতে।
ফজল চুইন্যা ঘাসের ঝোঁপের ভেতর গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকে।
ভটভট আওয়াজ এখন আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সার্চলাইটের আলোও এসে পড়ছে তার ডিঙি বরাবর নদীর মাঝখানে।
কিন্তু হঠাৎ ভটভট আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। সার্চলাইটের আলোও আর দেখা যায় না। ফজলের মনে বিস্ময় জাগে–বিকল হয়ে গেল নাকি কলের নৌকা!
ফজল চুপচাপ বসে থাকে ঝোঁপের ভেতর। অনেকক্ষণ পরে সে দেখতে পায় লঞ্চটা স্রোতের টানে ভেসে আসছে। বন্ধ কেবিনের জানালার খড়খড়ি গলে আলোর রশ্মি এসে পড়ছে বাইরে। সেই আবছা আলোয় দেখা যায় দু’জন গোরা সৈন্য বৈঠার খেচ মেরে লঞ্চটা পাড়ের দিকে ঠেলছে। তাদের একজন লঞ্চের ডানপাশে এসে বৈঠা দিয়ে পানির গভীরতা মেপে চলে যায় কেবিনের ভেতর। অল্পক্ষণ পরেই একটা মেয়েলোককে পাঁজাকোলা করে এনে সে নামিয়ে দেয় কোমর পানিতে। মেয়েলোকটি হুমড়ি খেয়ে পানির ওপর পড়তে পড়তে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পানি ভেঙে কোনো মতে পা টেনে টেনে তীরে উঠে সে বসে পড়ে মাটিতে।
ফজল ফেরারি আসামি। আর এলাকাটাও শত্রু পক্ষের। তাই রাগে ঠোঁট কামড়ানো ছাড়া ঐ বর্বরদের বিরুদ্ধে আর কিছুই করার কথা চিন্তা করতে পারে না সে।
লঞ্চটা বৈঠার ঠেলায় ও ভাটির টানে কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ চালু হয়ে যায়। ভটভট আওয়াজ তুলে সার্চলাইট জ্বেলে দ্রুতগতিতে চলে যায় পুব দিকে।
ফজল ঠায় বসে থাকে। ভয়ে তার বুক দুরু দুরু করে। মেয়েলোকটা হয়ত কেঁদে চিৎকার দিয়ে উঠবে। আর সাথে সাথে বগাদিয়ার সব মানুষ হৈ-চৈ করে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু অন্ধকারে তার নড়াচড়ার কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। সে বোধ হয় বসেই আছে মাটির ওপর।
ফজল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে ডিঙিটা লটা ঝোঁপ থেকে বের করে সে জোরে টান মারে বৈঠায়।
পাটখেতে যখন ফজল ফিরে আসে তখন রাত প্রায় শেষ।
আক্রোশের আগুনে যেন ঝলসে গেছে তার শরীর ও মন। সে মাদুরের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শরীরটা ঢেলে দেয়। নির্ঘুম ক্লান্ত চোখ দুটো ঘুমের আক্রমণ রোধ করতে পারে না বেশিক্ষণ।
রাতের বেলা কেন এল না ফজল বুঝতে পারে না জরিনা। তার জন্য রান্না করে অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল সে। একবার চেষ্টাও করেছিল তাকে খুঁজে বের করবার। বাড়ির পুবদিকে ধানখেত। ধান পাতার আঁচড় খেয়ে কিছুদূর গিয়েছিল সে। ফজলের অনুকরণে অপটু কণ্ঠে টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ হট্ ডাকও দিয়েছিল কয়েকবার। কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে সে আর এগুতে সাহস করেনি অন্ধকারে।
ফজরের নামাজ পড়েই জরিনা রান্নাঘরে যায়। গত রাতের রান্না বেলেমাছের চচ্চড়ি গরম করে। হলুদ-লবণ দিয়ে সাঁতলানো আণ্ডালু চিংড়ি ভর্তা করে পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা ও সরষের তেল সহযোগে। তারপর একটা মেটে বাসনে পান্তা বাড়ে। তার ওপর চচ্চড়ি ও ভরতা বসিয়ে দিয়ে বাসনটাকে গামছায় বেঁধে নেয়।
ধানখেত পেরিয়ে পাটখেতের আলে গিয়ে দাঁড়ায় জরিনা।
গতকাল আকাশে ছিল টুকরো টুকরো মেঘের উড়ন্ত মিছিল। কখনো চোখ বুজে, কখনো চোখ মেলে সারাদিন কর্তব্য পালন করছিল সূর্য। রাতেও বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আজ ভোর থেকেই আকাশে জমতে শুরু করছে কালো মেঘ। উত্তর-পশ্চিম দিগন্তে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার অস্পষ্ট গর্জন শোনা যায় কি যায় না। আকাশের দিক থেকে চোখ নামিয়ে সে এদিক ওদিক তাকায়। আলের পাশে খুঁজে পায় সে একটা মাথাভাঙা পাটগাছ। ওটায় বসান রয়েছে একটা ম্যাচবাতির খোসা–ফজলের রাখা নিশানা। নিশানা ধরে সোজা পুব দিকে এগিয়ে যায় সে। মাথা নুইয়ে যেতে হয়, কারণ পাটগাছ এখনো মাথাসমান লম্বা হয়নি। নল চারেক যেতেই পাটগাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ফজলের তৈরি ছই-টা।
জরিনা কাছে গিয়ে দেখে ছই-এর নিচে মাদুরের ওপর খালি গায়ে পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে ঘুমুচ্ছে ফজল।
দিনের আলোয় জোয়ারে ভরা ফজলের জোয়ান শরীর দেখাবার সুযোগ পায় জরিনা এই প্রথম। গামছায় বাধা খাবার নামিয়ে রেখে সে নিঃশব্দে বসে পড়ে ফজলের পাশে।
ঈষৎ ফাঁক ঠোঁট দুটির আড়ালে ওপরের পাটির দুটি দাঁত দেখা যায়। আলুথালু চুলের এক গোছা কপালের ওপর এসে পড়েছে। দাড়ি-গোঁফ চাচা হয়নি অনেক দিন। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি বিষণ্ণ মুখকে বিষণ্ণতর করে তুলেছে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জরিনা।
গভীর ঘুমে অচেতন ফজল। তার প্রশস্ত রোমশ বুক ওঠা-নামা করছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে। লুঙ্গির গেরো শিথিল হয়ে নেমে গেছে নাভির নিচে। দুটি উরুর অনেকটা উদলা লুঙ্গি ওপরে উঠে যাওয়ায়। জরিনা লক্ষ্য করে মুখের রঙের চেয়ে অনেক ফরসা উরুর রঙ। সর্বক্ষণ কাপড়ে ঢাকা থাকার ফলে রোদে পুড়ে উরুর রঙ তামাটে হতে পারেনি। টেকির কাতলার মতো মোটা মজবুত দুই উরু।
কপালের চুলের গোছাটি ঘুরিয়ে মাথার ওপর তুলবার জন্য জরিনার আঙুল নিশপিশ করে। কিন্তু সে সংযত করে নিজেকে।
জরিনা একটা কাঁপুনি অনুভব করে তার বুকের মধ্যে। কাঁপুনিটা ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে। তার মনের বন্য বাসনা পলিমাটির বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে যেতে চায়।
জরিনা চোখ বোজে, মনে মনে কি যেন আওড়ায়। সে বুকে ফুঁ দেয়, ডানে বায়ে ফুঁ দেয়।
ঢেউ থামে। দিশেহারা বাসনা ধীরে ধীরে উৎসে ফিরে যায়।
কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে জরিনা। ফজল একই অবস্থায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে।
পাটগাছের আগায় আঁশ বাঁধিয়ে ঝুলছে একটা শুয়াপোকা। নিজের শরীর থেকে নির্গত আঁশের সাথে ওটা ঝুলছে, দুলছে বাতাসে আর নেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
কি বিশ্রী কদাকার জীব। জরিনার শরীরের রোম খাড়া হয়ে ওঠে। হলদে বিছাটা মাটিতে পড়েই শুয়াভরা শরীর দুলিয়ে চলতে শুরু করে ফজলের দিকে।
‘ইস্! খুশির আর সীমা নাই!’ জরিনা মনে মনে বলে। ‘অমন সোন্দর শরীলে উঠতে দিমু তোমারে!’
তারই দেয়া কেরোসিন তেলের বোতলটা হাতের কাছেই রয়েছে। ওটার তলা দিয়ে সে পোকটাকে পিষে দেয় মাটির সাথে।
পাটগাছের পাতায় পাতায় অসংখ্য শুঁয়াপোকা। প্রজাপতি ডিম পাড়ে পাটপাতার ওপর। ডিম থেকে ফুটে বেরোয় শুঁয়াপোকা। পাটের কচিপাতা খেয়ে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে ওরা। কয়েকটা পোকা নিজের শরীর থেকে নিঃসৃত আঁশ দিয়ে পাটপাতা মুড়িয়ে গুটি তৈরি করছে।
স্বেচ্ছাবন্দি বয়োজ্যেষ্ঠ শুঁয়াপোকারা মুক্তির সাধনায় ধ্যানমগ্ন গুটির ভেতর। একটার মুক্তিলাভ ঘটে জরিনার চোখের সামনেই। গুটি ভেঙে একটা হলদে প্রজাপতি বেরিয়ে আসে। পাতা আঁকড়ে ধরে ওটা পাখা দোলাচ্ছে। জরিনা চেয়ে থাকে ওটার দিকে।
আহা কি সুন্দর!
এমনি হলদে রঙের একটা শাড়ি দেখেছিল সে রূপজানের পরনে। শাড়ির আঁচলটা বাতাসে ফুরফুর করে উড়ছিল প্রজাপতির পাখার মতোই। তার মনে হয় এই হলদে প্রজাপতিটার মতোই সুন্দরী রূপজান।
ফজলের দিকে আবার চোখ নেমে আসে জরিনার। ঘুম তার এত গভীর যে একবারও পাশ ফিরে শোয়নি সে এতক্ষণের মধ্যে।
তার মাথার কাছেই পিড়পিড়িয়ে হাঁটছে একটা কদাকার শুঁয়াপোকা।
জরিনা বোতলের তলা দিয়ে এটাকেও পিষে ফেলে।
এ পোকার শুঁয়ায় নাকি বিষ আছে। শুঁয়া শরীরের কোথাও লেগে গেলে ফুলে যায়, শেষে পেকে পুঁজ হয়।
জরিনা একটা পাটগাছের আগা ভাঙে। মাথার পাতাগুলো রেখে বাকিগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এবার এটাকে বোতলের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। কেরোসিন-ভেজা পাতাগুলো সে এবার বুলিয়ে দেয় মাদুরের কিনারায়। বারবার কেরোসিনে ডুবিয়ে সে মাদুরের চারপাশটা ভিজিয়ে দেয়। কেরোসিনের দুর্গন্ধে ফজলের কাছে এগুতে পারবে না কদাকার পোকাগুলো।
স্বস্তি বোধ করে জরিনা। কিন্তু নবজাত প্রজাপতির একটা উড়ে এসে বসে ফজলের ঊরুর ওপর। ওটাকে তাড়াবার জন্য সে হাত বাড়ায়। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হয়, রূপজানই বুঝি প্রজাপতির রূপধরে এসে বসেছে ফজলের গায়ে। সে হাত টেনে নেয়, পলকহীন চোখ মেলে চেয়ে থাকে প্রজাপতিটার দিকে। কি সুন্দর! ওটার তুলনায় নিজেকে মনে হয় একটা শুঁয়াপোকা। ফজলের গায়ে বসবার অধিকার নেই শুঁয়াপোকার।
কদাকার শুঁয়াপোকা গুটির কবরে গিয়ে সুন্দর প্রজাপতির রূপ লাভ করে। সে যদি কবরে যায় তার কি দশা হবে? সে কি এমন সুন্দর রূপ নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে? আসতে পারবে এ সুন্দর পৃথিবীতে যেখানে চাঁদ আছে, সূর্য আছে, বাতাস আছে, পানি আছে, আর আছে ফজল?
অসম্ভব। কবর থেকে কোনো মানুষই ফিরে আসে না এ মাটির পৃথিবীতে। কবরে মাটিচাপা দেয়ার পরেই আসবে দুই ফেরেশতা মনকির আর নকির। গুনাগারের আজাব চলতে থাকবে কবরের ভেতর। তারপর আল্লার বিচার। বিচারের পর গুনাগারকে ফেলবে হাবিয়া দোজখে, জাহান্নামে।
জরিনা আরো ভাবে, সে সবচেয়ে বড় গুনাগার। শরীরের গুনা, মনের গুনা, চোখের গুনা সে করেছে। অন্য সব গুনা মাফ হলেও হতে পারে, কিন্তু শরীরের গুনা কবিরা গুনা। এ গুনার মাফ নেই। সে শুনেছে, সারা জীবনভর আল্লার নাম জপ করলেও শরীরের গুনার শাস্তি থেকে কেউ রেহাই পাবে না। আর কি সাংঘাতিক সে শাস্তি। দুই সাপ এসে কামড়ে ধরবে দুই স্তন। ফেরেশতারা গুর্জু মারবে কুচকির ওপর।
জরিনা আর ভাবতে পারে না। সে ফজলের দিকে তাকায়। শরীরের গুনা করেছে। ফজলও। তারও নিস্তার নেই। একই হাবিয়া দোজখে যেতে হবে দু’জনকে।
হঠাৎ জরিনার বেদনাভারাক্রান্ত মনটা হালকা মনে হয়। ফজল হবে তার দোজখের সাথী। রূপজান সতী-সাধ্বী, নিষ্পাপ। সে যাবে বেহেশতে। আখেরাতে সে সাথী হতে পারবে ফজলের। এ দুনিয়াতেও ফজলকে আর সাথী হিসেবে পাবে না সে। তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।
প্রজাপতিটা এখনো বসে আছে ফজলের ঊরুর ওপর।
নাহ, ওটার বসবার অধিকার নেই ফজলের গায়ে।
জরিনা আঙুলের টোকা দিতেই প্রজাপতিটা নরম অপটু পাখা নেড়ে টলতে টলতে উড়ে চলে যায়।
জরিনার মনের মেঘে উষার অরুণিমা। ফজল হবে তার দোজখের সাথী। কিন্তু এ দুনিয়ায়?
এ দুনিয়ায় ফজল একা। তার সাথী নেই। তার নিজেরও কি সাথী আছে?
ফজলের জন্য তার মনে রয়েছে মমতার এক গভীর সরোবর। তাতে এবার জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। মমতা-সরোবর থেকে নির্গত হচ্ছে মোহগঙ্গা। সমস্ত বাঁধ-বাধা ভেঙে, ডিঙিয়ে দুর্বার স্রোতের অধঃপতন ঘটছে এক অন্ধকার কুহরে।
জরিনা চেয়ে থাকে ফজলের মুখের দিকে। সে মুখমণ্ডল জুড়ে থমথমে বিষাদের ছায়া। জরিনার চোখ ছলছল করে। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ফজলের আরো কাছে গিয়ে বসে। তার কপালের ওপর থেকে সে চুলের গোছাটি আঙুল দিয়ে তুলে দেয় মাথার ওপর। কপালে হাত বুলায়।
ফজলের ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ মেলে। জরিনার মাথা ঈষৎ ঝুঁকে আছে তার মুখের ওপর। চেয়ে আছে নির্নিমেষ। মমতামাখা দুটি চোখ। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।
ফজলের চোখও ছলছল করে ওঠে। তার পিপাসাজর্জর মন মরীচিৎকার পেছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। হঠাৎ সে দেখতে পায় স্নেহ-ভালবাসার এক বিশাল সরোবর। তার পানি স্বচ্ছ কি পঙ্কিল যাচিয়ে দেখে না সে। দেখবার প্রয়োজনও বোধ করে না। সে হাত বাড়িয়ে জরিনাকে কাছে টেনে নেয়। জরিনা বাধা দেয় না।