পান্সি তৈরি শেষ হয়েছে। ওটায় গাবও লাগানো হয়েছে তিন পোচ। এখন পানিতে ভাসিয়ে এতে পাটাতন বসাতে হবে, ছই লাগাতে হবে।
বুধবার জোহরের নামাজ পড়ে নৌকা ভাসানো হবে। শুভ দিন-ক্ষণ ঠিক করে রেখেছে এরফান মাতব্বর। কিন্তু বুধবার আসার তিন দিন আগেই তার জ্বর হয়। বাড়ি গিয়ে সে বিছানা নেয়।
শুভ দিন-ক্ষণ যখন ধার্য করা হয়েছে তখন ঐ দিন ঐ ক্ষণেই নৌকা ভাসানো হবে– ফজলকে খবর পাঠায় এরফান মাতব্বর। গাবুর একাব্বর খবরের সাথে নিয়ে আসে তিনটে ধামা ভরে খই আর সের কয়েক বাতাসা।
পাহারারত কয়েকজন ছাড়া আর সবাই জমায়েত হয়েছে নৌকা ঠেলবার জন্য।
নৌকার বুকের সামনে মাটিতে পাতালি করে রাখা হয়েছে চারখণ্ড কলাগাছ। একবার কলাগাছের ওপর চড়িয়ে দিতে পারলে নৌকাটা সহজেই গড়িয়ে নেয়া যাবে নদীর দিকে। গায়ে গায়ে মেশামেশি হয়ে নৌকা ধরেছে অনেকে। সবার ধরবার মতো জায়গা নেই। ফজল মাথার ওপর রুমাল নেড়ে হাঁক দেয়, ‘জো-র আ…ছে…এ…এ…?’
সকলে : ‘আ….ছে…এ…এ…।’
ফজল : ‘এই জোর থাকতে যে জোর না দিব তার জোর নিব ট্যাংরা মাছে…এ…এ… হেঁইও…’
সকলে : ‘হেঁইও।’
ফজল : ‘মারুক ঠেলা।’
সকলে : ‘হেইয়ো।’
ফজল : ‘মারুক ঠেলা।’
সকলে : ‘হেঁইও…ও…ও…’
ফজল : ‘অ্যাই কলাগাছ ফ্যাল সামনে…এ…এ… মোরো ঠেলারে… এ…এ…।’
সকলে : ‘হেঁইও, নামছে, নামছে নামছেরে– হেঁইও।’
নৌকা নেমে গেছে নদীতে। ফজল ও আরো কয়েকজন বসেছে নৌকায়। পাঁচখানা বৈঠা এগিয়ে দেয় একাব্বর।
সকলে চিলিবিলি করে খই আর বাতাসা ভরে নিজ নিজ গামছায়। একটা ধামায় করে কিছু খই-বাতাসা তুলে দেয়া হয় পানসিতে।
ফজল হাল ধরেছে। চারজন টানছে বৈঠা। নতুন পানসি তরতর করে চলছে পানি কেটে। কিনারায় দাঁড়িয়ে খই-বাতাসা খাচ্ছে সবাই, আর চেয়ে দেখছে নতুন নৌকার চলন দোলন। গড়নে কোনো খুঁত আছে কিনা তাও দেখছে মনোযোগ দিয়ে।
‘ও মিয়ারা?’
ডাক শুনে বাঁ দিকে মাথা ঘোরায় সবাই। উত্তর দিক থেকে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে একজন অপরিচিত লোক।
‘কি কও মিয়া? দৌড়াইতেছ ক্যান?’ একজন জিজ্ঞেস করে।
‘দারোগা-পুলিস আইতাছে।’ লোকটি বলে। ‘অ্যাঁ দারোগা-পুলিস! কই?’
ভীত ও বিস্মিত প্রশ্ন সকলের। কারোটা উচ্চারিত হয়, কারোটা ভয়ে লুকিয়ে থাকে মুখের গহ্বরে।
‘ঐ চাইয়া দ্যাহো।’
সবাই উত্তর দিকে তাকায়। সত্যি থানার নৌকা। আরো দুটি নৌকা আসছে ওটার পেছনে পেছনে।
লোকটিকে ছুটে আসতে দেখেই পাড়ের দিকে পানসি ঘুরিয়েছিল ফজল। তাড়াতাড়ি বৈঠা মেরে ফিরে আসে সে। নৌকার থেকে লাফ দিয়ে নেমেই জিজ্ঞেস করে, ‘কি ও, কি কি?’
‘দারোগা-পুলিস আইতাছে, ঐ দ্যাহো চাইয়া।’
একই সঙ্গে অনেকগুলো সন্ত্রস্ত কণ্ঠের কোলাহলে শঙ্কিত হয় ফজল। সে থানার নৌকার দিকে চেয়ে অপরিচিত লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিয়ের লেইগ্যা আইতে আছে?’
‘কাইল বোলে ডাকাতি অইছে কোনখানে?’
‘হ অইছে এই চরের পশ্চিম দিগে।’
গত রাত্রে এশার নামাজের পর ফজল ও তার মাছ ধরার সঙ্গীরা বেড়ের মাছ ধরতে গিয়েছিল। চাকরিয়াদের খাওয়াবার জন্যই শুধু পৌষ মাসের হাড়-কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে মাছ ধরতে যেতে হয় আজকাল। ভাটার সময় তিরতিরে পানির মধ্যে আছাড়-পাছাড় খেয়ে মাছ ধরছিল তারা। এমন সময় শোনা যায় ডাক-চিৎকার, ‘আমারে মাইর্যা ফালাইছে রে। ডাকাইত–ডাকাইত।’ পরে জানা যায় পুব্যের চরের এক গেরস্ত পাট বিক্রি করে লৌহজং থেকে বাড়ি ফিরছিল নৌকায়। একদল ডাকাত তাকে মারধর করে তার পাট-বেচা পাঁচশ’ টাকা নিয়ে গেছে।
অপরিচিত লোকটি বলে, ‘ঐ ডাকাতির আসামি ধরতে আইতে আছে।’
‘আসামি! আসামির খোঁজ পাইছে?’ ফজল জিজ্ঞেস করে।
‘হ আপনের নামও আছে। আর কদম শিকারি কার নাম? আরো চৌদ্দ-পনেরো জন।’
ফজল স্তব্দ, বিমূঢ়। চোখে তার শূন্য দৃষ্টি।
মেহের মুনশি লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কে ভাই? কই হোন্ছ এই কথা?’
‘আরে মিয়া আমার বাড়ি বাঁশগাও। ফজল মিয়া তো চিনে না। ওনার বাপ চিনে। তার লগে আমার বাপের গলায় গলায় খাতির আছিল। আইজ চুরির ইজাহার দিতে গেছিলাম থানায়। ফজল মিয়ারে আসামি দেওনের কথা হুইন্যা চিল-সত্বর আইছি দারোগার নাওরে পিছনে ফালাইয়া।’
সংবিৎ ফিরে পেতেই ফজল দেখে তার লোকজন এমন কি চাকরিয়ারা পর্যন্ত ভেগে যাচ্ছে। কেউ ভাওর ঘরের দিকে ছুটছে। কেউ ছুটছে কিনারায় বাধা ডিঙিগুলোর দিকে।
রমিজ মিরধা বলে, ‘কি মিয়া খাড়াইয়া রইছ কাঁ? ঐ দ্যাহো আইয়া পড়ল। সে এক রকম ঠেলে নিয়ে চলে ফজলকে। শিগগির নায় ওড।’
ভাওর ঘর থেকে হাতিয়ার, বিছানাপত্র নিয়ে দৌড়ে আসে চাকরিয়াদের কেউ কেউ। ফজলের আগেই তারা নতুন পানসিটায় চড়ে বসে।
ফজল বলে, ‘তোমরা ক্যান পলাইতেছ? তোমায় তো ধরতে আসে না।’
‘তোমরা যেমুন পলাইতে শুরু করছ, মনে অয় তোমরাই ডাকাতি করছ।’ মেহের মুনশি বলে।
‘আমরা ডাকাতি করছি, কয় কোন হুমুন্দির পুত।’ ঝাঁঝি মেরে ওঠে আলেফ সরদার।
‘এই চাকরা, মোখ সামলাইয়া কথা কইস।’
‘দ্যাখ, মোখ দিয়া না, এই শড়কি দিয়া কইমু।’ আলেফ শড়কি উঁচু করে।
ফজল ধমকি দেয়, ‘এইডা কি শুরু করলেন আপনেরা।’
‘আরে আইয়া পড়ল! শিগগির ওড নায়।’ রমিজ মিরধা তাড়া দেয়।
ফজল : ‘কেও বাকি নাইতো?’
জাবেদ লশকর : ‘আরে না–না। ঐ চাইয়া দ্যাহ্, জমিরদ্দির নায় ওঠছে দশ-বারোজন আর ঐ যে ধলাইর নাও।’
মেঘু পালোয়ান : ‘মিয়ারা তোমরা পুলিসের লগে দোস্তালি কর। আমরা নাও ছাইড়া দিলাম।’
ফজল ও বাকি আর সবাই পানসিতে ওঠে। পাঁচ বৈঠার টানে ছুটে চলে পানসি।
দূরে মান্দ্রার খড়ির মুখে জড় হয় সব ক’টা নৌকা। গুনতি করে দেখা যায় সবাই পালাতে পেরেছে।
লালুর বাপ বলে, ‘পুলিস আইজ একটা ঠক খাইব। একটা পোনাও পাইব না করে।’
একাব্বর ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল। পুলিসের কথা শুনেই নৌকার ডওরার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আল্লা-আল্লা করছিল সে। এতক্ষণে তার প্রাণে পানি আসে। সে বলে, ‘নাওডা আরো দূরে লইয়া যাও। পুলিস বন্দুক ছাইড়া দিব।’
হো-হো হেসে ওঠে সবাই।
ফজল বলে, ‘ব্যাডা কেমন নিমকহারাম। আমরা ভালরে বুইল্যা আউগাইয়া গেলাম। আর আমাগ দিল আসামি!’
মেঘু পালোয়ান : ‘ঐ যে মাইনষে কয় না, উপকাইরারে বাঘে খায়।’
মেহের মুনশি : ‘আমার মনে অয় কেও পরামিশ দিয়া আমাগ নাম লাগাইয়া দিছে। না অইলে ঐ অচিনা ব্যায় নাম পাইল কই?’
আলেফ সরদার : ‘দুশমনের কি আকাল আছে? তোমায় চরের কাছে ডাকাতি অইছে, তাই সন্দ করছে, তোমরা ছাড়া আর কে করব এই কাম।’
ফজল : ‘আমাগ না অয় সন্দ করছে, আমরা পালাইছি। কিন্তু আপনেরা ক্যান্ পলাইছেন চর খালি থুইয়া?’
আলেফ : ‘মিয়া, তোমার একগাছ চুলও পাকে নাই। তাই বোঝতে পার না। দারোগা যহন জিগাইত–ও মিয়া তোমার বাড়ি কই? তহন কি মিছা কথা কইতে পারতাম? ট্যাংরামারির কথা হুইন্যা এক্কেরে তক্ষণ তক্ষণ মাজায় দড়ি লাগাইত। কইত এত দূর তন কি করতে আইছ এইখানে? তোমরাই ডাকাতি করছ।’
নৌকার সবাই সায় দেয় তার কথায়। ফজলকেও মেনে নিতে হয় তার যুক্তি।
শীতকালের বেলা তাড়াতাড়ি পালায় শীতের তাড়া খেয়ে। দারোগা-পুলিস চর থেকে চলে যায়। তাদের নৌকা দৃষ্টির আড়াল হতেই মান্দ্রার খাড়ি থেকে বেরোয় সবকটি নৌকা।
মেহের মুনশি বলে, ‘আস্তে আস্তে চালাও। আন্ধার অউক।’
‘চইল্যাতত গেছে। আবার আস্তে আস্তে ক্যান?’ মেঘু পালোয়ান বলে। ‘দুফরের খাওনডা মাইর গেছে। জলদি চালাও।’
‘হ জলদি চালাও।’ আলেফ সরদার বলে। ‘প্যাটার মইদ্যে শোল মাছের পোনা কিলবিলাইতে আছে।’
তবু ধীরে ধীরে চলছে নৌকা। চরের কাছে পৌঁছতে সন্ধ্যা উতরে যায়।
‘এই ক্যাডারে? আর আউগ্গাইস্ না, খবরদার!’
‘খাইছেরে! সব্বনাশতো অইয়া গেছে!’
‘হায় আল্লা, জঙ্গুরুল্লা চর দখল কইর্যা ফালাইছে।’
ফজল ও তার লোকজন হতভম্ভ। তাদের নৌকা থেমে গেছে। পানিতে টুপটাপ পড়ছে কিছু। গুলেল বাঁশের গুলি বুঝতে পারে তারা। দু-একটি গুলি তাদের গায়েও এসে লেগেছে।
আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে ফজল হাঁক দেয়, ‘কারারে তোরা? ভাইগ্যা যা ভাল থাকতে। নইলে জবাই কইর্যা ফালাইমু।’
‘আইয়া দ্যাখ কে কারে জবাই করে।’
তারপর দুই দলে চলতে থাকে অশ্রাব্য গালাগাল।
ফজল ও মেহের মুনশি জিজ্ঞেস করে আলেফ ও মেঘুকে, ‘কি মিয়ারা, পারবানি লড়তে?’
‘লড়তে পারমু না ক্যান্। কিন্তুক এই রাইতের আন্ধারে কে দুশমন কে আপন চিনা যাইব না। আউলাপাতালি লড়াই করতে গিয়া খামাখা জান খোয়াইতে অইব।’
একজন লাঠিয়াল : ‘আমার ঢাল-শড়কি আনতে পারি নাই।’
মেঘু : ‘অনেকের কাছেই আতিয়ার নাই। আতিয়ার থুইয়া পলাইছে আহাম্মকরা।’
জাবেদ লশকর : ‘তয়তো ওগো মজাই। আমাগ শড়কি দিয়াই আমাগ পেডের ঝুলি বাইর করতে পারব।’
প্রত্যেকেই কাঁথা-বালিশ, ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি, মাছ ধরার সরঞ্জাম ইত্যাদি কিছু না কিছু হারিয়ে হায়-আফসোস করতে থাকে।
মেহের মুনশি বলে, ‘জঙ্গুরুল্লাতো জবর ফেরেববাজ। দ্যাখছনি ক্যামনে ডাকাতি মামলা দিয়া আমাগ ছাপ্পরছাড়া কইর্যা দিল!’
‘হায় হায়রে! এত কষ্ট কইরা ধান রুইছি।’ লালুর বাপ বলে।
মেঘু পালোয়ান : ‘জঙ্গুরুল্লা কি মরদের মতো কাম করছে নি? হিম্মত থাকলে আইত সামনাসামনি।’
জাবেদ : ‘আহ্-হারে কতগুলা জমির ধান। এত কষ্ট কইর্যা–’
আলেফ : ‘আর হায়-হুঁতাশ কইর্যা কি অইব? চলো, মাতবরের কাছে যাই। দেহি উনি কি করতে বুদ্ধি দ্যান্।’
রমিজ মিরধা: ‘কাইল রাইত পোয়াইলে আহন লাগব। কাইল যদি ওগ তাড়াইতে না পারো তয় ধানের আশা মাডি দিয়া থোও।’
ফজল : ‘দেহি, বাজান কি করতে কয়।’
নতুন পানসি এরফান মাতব্বরের বাড়ির দিকে রওনা হয়। তার পেছনে সারি বেঁধে চলে ছোট-বড় বাইশখানা ডিঙি।