আগুন দেখে ফজলের দল ঠিকই অনুমান করেছিল–ওটা জঙ্গুরুল্লার কারসাজি। খুনের চর থেকে বিতাড়িত হয়ে কোলশরিকরা জঙ্গুরুল্লার বাড়ি গিয়ে হাজির হয় সন্ধ্যার পর। ওদের দেখে কিছু বলার আগেই সে বুঝতে পারে, খুনের চর বেদখল হয়ে গেছে। রাগের তীব্রতায় তার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। তার ক্রুদ্ধ ঘূর্ণায়মান চোখ দুটোয় আগুন জ্বলছে। সে চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে মিইয়ে যায় সবাই। তাদের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে খেঁকিয়ে ওঠে জঙ্গুরুল্লা, ‘হারামজাদা শুয়রের বাচ্চারা, চরের দখল ছাইড়া দিয়া আইছস? খুন কই? জখম কই? একটা হারামজাদার গায়েও তো একটা কোপের দাগ নাই। কিরে লাশ ফালাইয়া থুইয়া আইছস?’
দবির গোরাপি ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘না হুজুর, কেও খুন অয় নাই।’
‘খুন অয় নাই! তয় তোরা মাইর করস নাই? ওগ দেইখ্যা ডরে চর ছাইড়্যা পলাইয়া আইছস?’
‘না, হুজুর, মাইর করছি।’
‘মাইর করলে খুন-জখম তো অইত? তার আলামত কই? দুই চাইডারে খুন কইর্যা, লাশ লইয়া থানায় গিয়া ইজাহার দেই।’
সাহস সঞ্চয় করে দবির গোরাপি ও মজিদ খালাসি মারামারির বিস্তারিত বিবরণ দেয়। জঙ্গুরুল্লা প্রথমে শুনতে চায় না তাদের কথা। প্রতিপক্ষের অভিনব কায়দা-কৌশলের কথা শুনেই সে মনোযোগ দেয়। তাদের বিবরণ শেষ হলে জঙ্গুরুল্লা বলে, ‘হুনছি রামদাওয়ালা চাকইর্যা আছে দক্ষিণে, ভাটির মুলুকে। কিন্তু আঁউকড়া আর চোর্তাপাতা দিয়া এম্বায় লবজান করার কথা তো শুনি নাই কোনো কালে। চাকইর্যাগ চিনতে পারছনি?’
‘না, ক্যামনে চিনমু।’ মজিদ খালাসি বলে। ‘কইলামতো, চাকইর্যারা আর দলের অনেকেই মোখা লাগাইয়া আইছিল।’
‘ফউজ্যারে দ্যাখছ নি? ওকি জেলের তন ছাড়া পাইয়া আইছে?’
‘তারে দেহি নাই।’ দবির গোরাপি বলে।
‘তোমরা কেও দ্যাখছ নি মিয়ারা?’ কোলশরিকদের দিকে চেয়ে বলে মজিদ খালাসি।
ফজলকে কেউ দেখেনি। তবে দু’-তিন জন নাকি তার গলার আওয়াজ শুনেছে।
‘তোমরা খোঁজ খবর নেও।’ জঙ্গুরুল্লা বলে। ‘গোরাপি আর খালাসি এইখানে থাইক্য, কথা আছে। তোমরা কয়েকজনরে পাড়াইয়া দ্যাও খবর আনতে–ফউজ্যা জেলেরতন আইছে, না আহে নাই? রাইত দুফরের আগে পাক্কা খবর চাই। আর বাকি সবাই বাড়িত যাও। চর দখলের ব্যবস্থা কইর্যা তোমাগ খবর দিমু।’
দবির গোরাপি ও মজিদ খালাসি ফজলের খবর সংগ্রহের জন্য দুখানা নৌকায় ছ’জনকে পাঠিয়ে দেয় দুদিকে। তারা বুঝতে পারে প্রতিপক্ষের জোয়ান পুরুষরা আজ বাড়িতে নেই কেউ। সবাই গেছে খুনের চরে। একদল ঘটক সেজে ফজলের বোনের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে সোজা চলে যাবে ভাটিকান্দি–ফজলদের বাড়ি। কথায় বের করে আনবে ফজলের খবর। অন্য দলটি যাবে জাবেদ লশকরের বাড়ি। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কোনো অছিলায় ফজলের খবর বের করে আনবার চেষ্টা করবে।
দবির গোরাপি ও মজিদ খালাসি ফিরে এসে দেখে জঙ্গুরুল্লা হুঁকোর নল মুখে দিয়ে চোখ বুজে কি যেন ভাবছে। তার পা টিপছে চাকর। তার থমথমে গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস হয় না তাদের।
জঙ্গুরুল্লা হুঁকোয় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। চোখ মেলে গোরাপি আর খালাসিকে দেখতে পেয়ে বলে, ‘ফউজ্যার খবর আনতে মানুষ পাডাইছ?’
‘হ, দুইদল দুইখানে পাডাইছি।’ দবির গোরাপি বলে।
‘শোন, তোমরা আমার ইজ্জতটা এক্কেরে গরবাদ কইর্যা দিছ। চর দখলের মাইরে আমার দল কোনোদিন হারে নাই। আমার দখল করা চরে কোনো ব্যাডা আইতে সাহস করে নাই। আর এইবার কি কারবারডা অইয়া গেল!’
‘এহন কি করতে চান হুজুর?’ মজিদ খালাসি বলে ।
‘ওরা মনে অয় বাছাবাছা চাকইর্যা আনছে ভাটি মুলুকতন। আমরা আর মাইর দাঙ্গার মইদ্যে যাইমু না। কলে কলে চাবি দিয়া কল ঘুরাইতে অইব। শোন, ওগ বিরুদ্ধে ঘর পোড়নের মামলা দিমু।’
‘ঘর পোড়নের মামলা!’
‘হ, ঘর পোড়নের মামলা। দশ-বারো জনরে দিমু আসামি। ফউজ্যা জেলেতন আইলে ওরে দিমু এক লম্বর আসামি। তোমরা একটা ঘর ঠিক কর। ঐ ঘরে আগুন দিয়া ঘরের মালিক ডাকচিক্কইর দিব। ঐ ডাক-চিক্কইর শুইন্যা তোমরা এই চর ওই চরের কয়েকজন দেখবা– ঘরে আগুন দিয়া নাও বাইয়া পলাইয়া যাইতেছে ওগ দশ-বারো জন। ইজাহারে আরো কইতে অইব, ঘরে পাট আছিল।’
জঙ্গুরুল্লার পরামর্শে তারই কুমিরডাঙার কোলশরিক তালেবালী নিজের কুড়েঘরে আগুন দেয়।
ফজল জেল থেকে খালাস পেয়ে এসেছে, খবরটা পেলেই জঙ্গরুল্লা রাত দুপুরের পর তালেবালীর সাথে তার বড় ছেলে জাফর ও দবির গোরাপিকে পাঠিয়ে দেয় থানায়।
তারা থানায় পৌঁছে বেলা ন’টারও পরে। থানার বড় দারোগা জাফরকে দেখেই চিনতে পারেন। বলেন, ‘কি মিয়া নতুন চর জেগেছে বুঝি? কারা দখল করেছে? নাম বলো। সব ক’টার মাজায় রশি বেঁধে নিয়ে আসি।’
‘না হুজুর, চর দখলের ঘটনা না।’
‘তবে ঘটনাটা কি?’
‘হুজুর, এই তালেবালীর ঘরে আগুন লাগাইছে।’
‘আগুন লাগিয়েছে! কারা লাগিয়েছে, দেখেছ তোমরা?’
‘হ, হুজুর।’
‘আচ্ছা।’
বড় দারোগা দু’জন সেপাই ডাকেন। দবির গোরাপি ও জাফরকে দেখিয়ে বলেন, ‘তোমরা দুজন এদের নিয়ে যাও। একজন যাও পুকুরের উত্তর পাড় আর একজন যাও দক্ষিণ দিকে পুলের ওপর। এদের সাথে গপ্সপ্ করো গিয়ে। আমি একজন একজন করে ডাকব।’
বড় দারোগা ঘটনার বিবরণ শোনেন তালেবালীর কাছ থেকে। তাকে জেরা করেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর জাফর ও দবির গোরাপিকে এক এক করে জেরা করেন। জেরা শেষ হলে তিনি বলেন, ‘কি মিয়ারা, মামলাটা ঠিকমত সাজিয়ে আনতে পারোনি? বাদী বলছে তার পশ্চিম-ভিটি ঘরে বগি পাট ছিল পাঁচমন। ঘর আর সব পাট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে ফজল ও আরো চারজন আসামির নাম বলেছে। আরো চার-পাঁচ জন ছিল, তাদের চিনতে পারেনি। সে দুটো নৌকায় আসামিদের পালিয়ে যেতে দেখেছে। তার কাছে টর্চলাইট ছিল না। রাতের অন্ধকারে সে আসামিদের চিনল কেমন করে? দবির গোরাপি বলছে–তালেবালীর ঘরে দশমন নালতে পাট ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ডাক চিৎকার শুনে সে টর্চ নিয়ে বেরিয়েছিল। সে একটা নৌকায় আসামিদের পালিয়ে যেতে দেখেছে। সে ফজল ও আরো চারজন আসামির নাম বলেছে। কি তাজ্জবের কথা! তালেবালী যাদের দেখেছে দবির গোরাপিও ঠিক তাদেরই দেখেছে। আর কাউকে চিনতে পারেনি। দুজনের চোখ যেন পরামর্শ করেই ঐ কয়জন আসামিদের ওপর দৃষ্টি ফেলেছিল। তালেবালী বলছে–নয়-দশ জন আসামির মধ্যে দু’জনের দাড়ি ছিল। অথচ দবির গোরাপি বলছে–চারজনের দাড়ি ছিল। তালেবালী যে আউশ ধান পেয়েছিল তা ভাদ্র মাসেই খেয়ে শেষ করেছে। ভাদ্রমাস থেকেই সে চাল কিনে খাচ্ছে। আর দবির গোরাপি যে আউশ ধান পেয়েছিল তা এখনও খেয়ে শেষ করতে পারেনি। অথচ দবির গোরাপি পাট বেচে দিয়েছে ভাদ্র মাসেই। তার ঘরে পাট নেই। অন্য দিকে তালেবালীর টানাটানির সংসার। সে পাট মজুদ রেখেছে বেশি দাম পাওয়ার জন্য। ব্যাপারটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারপর জাফর বলছে ঘটনার বিবরণ ও সাতজন আসামির নাম সে তালেবালীর কাছে শুনেছে। বাড়তি দু’জনের নাম জাফর পেল কোথায়? তালেবালী তো কুল্লে চিনেছে পাঁচজনকে। কী মিয়া জাফর, দু’জনের নাম পেলে কোথায়?’
‘হুজুর, তালেবালী আমার কাছে সাতজনের নামই কইছিল। ভয়ে জাফরের গলা কাঁপছে। তার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে।’
বড় দারোগা হাঁক দেন, ‘অ্যাই কে আছ?’
দু’জন সেপাই এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ায়।
বড় দারোগা নির্দেশ দেন, ‘এই তিনজনকে হাজতে ঢুকাও। মিথ্যা এজাহার দিতে আসার মজাটা দেখাচ্ছি।’
জাফর হাতজোড় করে, ‘হুজুর, কী কইতে কী কইয়া ফালাইছি–’
‘আমিও কী করতে কী করে ফেলি, টের পাবে এবার। মিথ্যাকে খোলস পরিয়ে সত্য বানানো যায় না। অ্যাই, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? নিয়ে যাও এদের হাজতে।’
জাফর ও দবির গোরাপি হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা ভয়ে কাঁপছে থরথর করে।
তালেবালী বড় দারোগার পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘হুজুর মাপ কইরা দ্যান। মাইনষের কথায় আর কান দিমু না, আর কোনো দিন থানায় আইমু না।’
পা ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য বড় দারোগা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, ‘আরে ছাড়ো, ছাড়ো, পা ছাড়ো। এই সেপাইরা, দাঁড়িয়ে দেখছ কি?’
সেপাই দু’জন তালেবালীর হাত ধরে টেনে তোলে।
‘যাও, এই শয়তানের বাচ্চা তিনটাকে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও। গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দাও থানা থেকে।’
গলাধাক্কা দেয়ার আর প্রয়োজন হয় না। তিনজনই দ্রুত থানা থেকে বেরিয়ে যায়।