পদ্মার পলিদ্বীপ1
পদ্মার পলিদ্বীপ কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের দ্বিতীয় উপন্যাস এবং চতুর্থ প্রকাশিত গ্রন্থ। ‘মুক্তধারা’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে। এই সংস্করণে প্রদত্ত ছোট্ট ভূমিকা থেকে জানা যায় লেখক এটি লিখতে শুরু করেছিলেন ১৯৬০ সালে, আর লেখা সমাপ্ত করেন ১৯৮৫ সালে। এর মাঝে উপন্যাসের ষোলটি অধ্যায় মুখর মাটি নামে বাংলা একাডেমীর ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। দীর্ঘ বিরতির পর শেষ হয়েছে এই উপন্যাস এবং প্রকাশিত হয়েছে পদ্মার পলিদ্বীপ নামে।
উপন্যাসে যে সময়ের কথা বিধৃত হয়েছে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময়। জাপানী বাহিনী সিঙ্গাপুর দখল করে বার্মা দখল করেছে। ব্রিটিশরা আতঙ্কিত ভারতে দখল বজায় রাখা নিয়ে। ব্রিটিশ-বিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন চলছে দেশজুড়ে। উপন্যাসে সমকালীন বিশ্বের প্রসঙ্গ বলতে গেলে এটুকুই। বাকি পুরো উপন্যাস শুধুমাত্র পদ্মার পলিদ্বীপে বসবাসরত মানুষদের নিয়ে। বাইরের দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই জনপদগুলি যুদ্ধের অভিঘাতে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্যে ও কেরোসিন-নুনের দুস্প্রাপ্রাপ্যতায় হতচকিত হয় বটে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এর বেশি যোগাযোগ তারা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। কেননা নিজেদের নিতান্ত জৈবিক অস্তিত্ত্বটুকু টিকিয়ে রাখার জন্য তারা শুধুমাত্র কৃষিকেই উপায় বলে জানে। কৃষি মানে জমি। জমি মানে তাদের কাছে পদ্মার পলিদ্বীপ। জেগে ওঠা ও তলিয়ে যাওয়ার অবিরাম অনিশ্চয়তার মধ্যে এই পলিদ্বীপ নিয়েই তাদের চিন্তা। পলিদ্বীপে চাষ-বাস করা, দ্বীপ তলিয়ে গেলে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া, নতুন জেগে ওঠা চর দখলে জন্য যুথবদ্ধ পশুর মতো লড়াই করা—এই নিয়েই তাদের জীবন।
এই সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় কিছু প্রকাশিত সংবাদের কারণে হয়তো দেশের অন্য অঞ্চলের শিক্ষিত পাঠক এদের কথা কিছুটা জানতে পান, কিন্তু তাদের বা আমাদের সার্বিক ধারণাটাই যে কতটা অস্বচ্ছ ও অসম্পূর্ণ তা পদ্মার পলিদ্বীপ পাঠের আগে অনেকেরই বোধগম্য হবে না। উপন্যাসের এরফান মাতব্বর, তার পরিবার , তার পুলকী-মাতব্বর, কোলশরীকদের নিয়ে নিজেদের হারানো চর খুঁজে বেড়ায়। তাদের সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ার কারণও এই পদ্মা। কারণ- “পদ্মার অজগর স্রোত গিলে খেয়েছে, উদরে টেনে নিয়েছে সব জমি। গুণগাঁর নমকান্দি থেকে শুরু হয়েছিল ভাঙা। তারপর বিদগাঁর কোণা কেটে, দীলির আধাটা গিলে, কাউনিয়াকান্দা, ডিঙ্গাখোলা, লক্ষীচর আর মূলভাওরকে বুকে টেনে চররাজাবাড়ির পাশ কেটে উন্মাসিনী পদ্মা গা দোলাতে দোলাতে চলে গেছে পূব দিকে। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এঁকেবেঁকে চলেছে ডানে আর বাঁয়ে।”
এরফান মাতব্বর কথায় কথায় বলে “চরের বাড়ি মাটির হাড়ি, আয়ু তার দিন চারি”। বলে বটে, কিন্তু চর ছাড়া অন্য কোনো ভূগোল বোঝে না সে। বুঝতেও চায় না। সে অপেক্ষা করে, কবে ফের জেগে উঠবে তাদের খুনের চর। আসল নাম লটাবনিয়ার চর। সেই চরের দখল নিতে নিজের প্রথম পুত্র রশীদসহ পাঁচ পাঁচজন মানুষ খুন হয়ে যাওয়ায় চরের নাম হয়েছে খুনের চর। এরফান মাতব্বরের প্রতীক্ষার চরের জেগে ওঠা প্রথম অবিষ্কার করে তার দ্বিতীয় পুত্র ফজল। তখনই শুরু হয় উপন্যাসের সকল পাত্র-পাত্রীর সচল হয়ে ওঠা।
তারা চরে গিয়ে ওঠে, ভাওর ঘর তোলে, নিজেদের মধ্যে জমি ভাগ করে নেয়, সালামি আদান-প্রদান করে, জমিদারের কাছারিতে গিয়ে নায়েবকে সালামি দেয়, খাজনা দেয়, চরের মাটিতে রোপা ধান রুইতে শুরু করে। তাদের পুরনো শত্রু চেরাগ সরদার এবার চর দখল করতে আসবে না, এটা জানা ছিল। এই বিপদের আশংকাও কারো মনে ছিল না। কিন্তু বিপদ এলো। এলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। জঙ্গুরুল্লা দাঁড়াল তাদের পথের কাঁটা হয়ে। পঁয়তাল্লিশ বছরের জঙ্গুরুল্লার জীবনে চল্লিশ বছরই কেটেছে অবর্ণনীয় কষ্টে। সারা জীবন কাজ করতে হয়েছে। ফলে কখনো শুকায়নি শরীরের ঘাম। অথচ পেটে জ্বলছে খিধের আগুন। গরীব কৃষক গরীবুল্লার সন্তান জঙ্গুরুল্লা সাত বছর বয়সে মাতৃহারা। পদ্মা অববাহিকার প্রচলিত প্রবাদ—মা মরলে বাপ অয় তালই।’ বাবার দ্বিতীয় বিয়ে, সৎমায়ের নির্যাতন। জঙ্গুরুল্লার বয়স দশ বছর হতে না হতেই কাজ নিতে হয় হোগলাচরের এক চাষীগেরস্তের বাড়িতে। সেখানে পেটে-ভাতে রাখালি পাঁচ ছয় বছর। তারপর দুইটাকা বেতনে ঐ চরেরই আরেক বড় গেরস্তের বাড়িতে চাষের কাজ। বছর চারেক পরে বাপের মৃত্যু। সৎ মা তার ছয় বছর বয়স্কা মেয়েকে নিয়ে ‘নিকে বসে’ অন্য জায়গায়। জঙ্গু ঘোপচরে বাপের ভিটেতে ফিরে আসে। গাঁয়ের দশজনের চেষ্টায় তার বিয়েটাও হয়ে যায়। বউ আসমানী গরীব ঘরের মেয়ে। গোবরের খুঁট দেওয়া থেকে শুরু করে ধানভানা, চাল ঝাড়া, মুড়ি ভাজা, ঘর লেপা, কাঁথা সেলাই, দুধ দোয়ানোসহ সব কাজেই তার হাত চলে। আবার অভাব-অনটনে দুই-এক বেলা উপোস দিতেও কাতর হয় না।
এর মধ্যে একটি কাণ্ড ঘটে যায়। ঘোপচরের মাতব্বর সোহরাব মোড়লের ছেলের বিয়ের বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিল জঙ্গুরুল্লা। কনে পক্ষের বাড়ি চরে নয়। তারা ভদ্র গেরস্ত। বরযাত্রীদের বসার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল ধবধবে ফরাসের। সেই ফরাসের উপর জঙ্গুরুল্লা তার থ্যাবড়া পায়ের কয়েক জোড়া কাদার ছাপ ফেলেছিল। তা দেখে চোখটিপে হেসেছিল কনেপক্ষের লোকেরা। লজ্জার কান কাটা গিয়েছিল সোহরাব মোড়লের। বাড়ি ফিরে জুতো খুলে মারতে গিয়েছিল জঙ্গুরুল্লাকে। ডেকেছিল পা-না-ধোয়া শয়তান বলে। ব্যাস তখন থেকেই জঙ্গুরুল্লার নামের আগে যোগ হয়ে যায় অমোচনীয় বিশেষণ—পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা। নামের আগে এই বিশেষণ যোগ না করলে তাকে আর চিনতে পারে না পদ্মা অববাহিকার মানুষ। খড়িশার কাছারির নায়েব শশীভূষণ দাসকে ঘটনাক্রমে পাগলা শেয়ালের হাত থেকে বাঁচিয়ে তার কৃপা লাভ করে জঙ্গুরুল্লা। নায়েব তাকে পেয়াদার চাকরিতে বহাল করে নেন। মাসিক বেতন তিন টাকা। পেয়াদার চাকরিতে বেতন বেতনই। আসল উপার্জন হচ্ছে উপরি। তার সঙ্গে ক্ষমতার সংযোগ। নায়েবের হুকুমে সে বকেয়া খাজনা জন্য প্রজাদের ধরে নিয়ে যেত কাছারিতে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ব্যবহার করত সাড়ে তিন হাত লাঠি। কখনও তাদের হাত-পা বেঁধে চিৎ করে রেখে শুইয়ে রাখত, কখনও কানমলা , বাঁশডলা দিয়ে ছেড়ে দিত। পাঁচ বছর পরে তার চাকরী চলে যায়। ততদিনে জমি-জমা সংক্রান্ত ফন্দি-ফিকির, প্যাঁচ-ঘোচ শিখে গেছে জঙ্গুরুল্লা। বাংলা ১৩৪৬ সালে বর্ষা শেষে আশ্বিন মাসে মাঝ নদীতে একটার পর একটা চর ভাসতে শুরু করে। জঙ্গুরুল্লা সবগুলি চরই দখল করে নেয়। কুণ্ডু আর মিত্র জমিদারদের কাচারি থেকে বন্দোবস্ত এনে বসিয়ে দেয় কোলশরীক। তাদের কাছ থেকে মোটা হারে সেলামি নিয়ে সে নিজের অবস্থা ঘুরিয়ে ফেলে।
চরপাঙ্গাশিয়ায় নতুন বাড়ি ওঠে তার। “উত্তর, পূব আর পশ্চিম ভিটিতে চৌচালা ঘর ওঠে। দক্ষিণ ভিটিতে ওঠে আটচালা কাচারি ঘর। নতুন ঢেউটিনের চালা আর পাতটিনের জোড়া দিয়ে ঘরগুলো দিনের রোদে চোখ ঝলসায়। রাতে চাঁদের আলোয় বা চলন্ত স্টিমারের সার্চলাইটের আলোয় ঝলমল করে।”
টাকার জোর, মাটির জোর আর লাঠির জোরের সঙ্গে এখন তার চাই সম্মানের জোর। সেই সম্মানের জোর অর্থাৎ মান-সম্মান বাড়ানোর জন্য জঙ্গুরুল্লা টাকা খরচ করতেও কম করছে না। গত বছর সে মৌলানা তানবীর হাসান ফুলপুরীকে বাড়িতে এনে মস্তবড় এক জেয়াফতের আয়োজন করেছিল। যে জেয়াফতে গরুই জবাই হয়েছিল আঠারোটা। দাওয়াতী-বেদাওয়াতী মিলে অন্তত তিন হাজার লোক হয়েছিল। সে জনসমাবেশে মৌলানা সাহেব তাকে চৌধুরী পদবীতে অভিষিক্ত করে যান। সেদিন থেকেই সে চৌধুরী হয়েছে। নতুন দলিলপত্রে এই নামই চালু হচ্ছে আজকাল। চরপাঙ্গশিয়ার নামও বদলে হয়েছে চৌধুরীর চর। কিন্তু এত কিছু করেও তার নামের আগেরে পা-না-ধোয়া খেতাব ঘুচল না।
সব কথাই জঙ্গুরুল্লার কানে যায়। রাগের চোটে সে দাঁতে দাঁত ঘষে। নিন্দিত পা দুটোকে মেঝের ওপর ঠুকতে থাকে বারবার। তার ইচ্ছা হয় এই পা দুটি দিয়ে সে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু, পদানত করে চারদিকের মাটি আর মানুষ। এমনি করে এক ধরনের দিগ্বিজয়ের আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয় তার মনে। আশেপাশে কোনো নতুন চর জাগলেই লাঠির জোরে সে তা দখল করে নেয়। এভাবে তার দৃষ্টি পড়ে যথারীতি খুনের চরের উপর। একসময় কটুবুদ্ধি ও লাঠির জোরে দখলও করে নেয় খুনের চর।
উপন্যাসের বাকি অংশ এরফান মাতব্বরের জীবিত পুত্র ফজলের সেই চর পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের বর্ণনা। ফজল সত্যিকারের নায়ক। নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া জানা ছেলে, অনেকগুলি মানবীয় গুণের সমাবেশ ঘটেছে তার মধ্যে। নিজের ব্যক্তি জীবনও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। তার স্ত্রী ফুলজানকে আটকে রেখেছে তার শ্বশুর আরশেদ মোল্লা। ঘটনাচক্রে মেয়েকে তার সাথে দিয়ে দিলেও পদে পদে ফজলের জন্য বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে চলে সে। জঙ্গুরুল্লার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফজলের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে থাকে সে। জঙ্গুরুল্রার দৃষ্টি পড়েছে ফুলজানের উপর। নিজের জন্য নয়। ফুলজানকে তার চাই তার বৃদ্ধ পীরের সঙ্গে শাদী দেওয়ার জন্য। তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। পীর সাহেব বিয়ে করলে এখানেই থাকবেন। তার মৃত্যু হবে এখানেই। চরের মাটিতেই দাফন হবে তাঁর। জঙ্গুরুল্লাদের বিশ্বাস—তাহলে আর কখনোই ডুবে যাবে না তাদের ঘর। তার পীরের উছিলায় আল্লাহ রক্ষা করবেন এই চরকে। সম্পূর্ণ জাগতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার ব্যবহার।
অবশেষে অনেক দ্বন্দ্ব-বিরোধ, দুঃখ-কষ্ট, ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ফজল ও তার লোকেরা নিজেদের খুনের চর পুনর্দখল করতে পারে। ফিরে পায় ফুলজানকেও। মধুরেণ সমাপয়েৎ…।
অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে পদ্মার পলিদ্বীপ উপন্যাসে। কেউ চকিতে নিজের ভূমিকা পালন করে দৃশ্যপট থেকে সরে যায়, কারও স্থায়ীত্ব একটু বেশি। কিন্তু সব চরিত্রই যেন তৈরি হয়েছে ফজলকে পরিস্ফুটিত করা জন্যই। একরৈখিক উপন্যাসের এটিই সমস্যা। তবু পার্শ্ব চরিত্রগুলির মধ্যেও নিজের অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশি জানান দিতে পেরেছে জরিনা।
ভাগ্য বিড়ম্বিতা নারীর সবচেয়ে করুণ এক উদাহরণ জরিনা। ভারতবর্ষে ‘সারদা আইন’ পাশের বছরে বাল্যবিবাহেরে হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। ‘সারদা আইন’ প্রচলিত হলে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ হয়। সেই কারণে ঐ আইন হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত যেখানে যেকটি সম্ভব, বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করা হয়েছে। সেই সময়েই দশ বছরের জরিনার সঙ্গে বিয়ে হয় এগারো বছরের ফজলের। কিন্তু পুত্রের তুলনায় পুত্রবধূকে দ্রুত বেড়ে উঠতে দেখে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে এরফান মাতব্বর। তার অনেক উচ্চাশা ফজলকে নিয়ে। তার মনে হয় বউয়ের সঙ্গে থাকলে ফজলের লেখাপড়া হবে না। সে তাই অনেক দূরের স্কুলে পাঠিয়ে দেয় নবম শ্রেণীতে পড়া ফজলকে। আর জরিনার ভাইয়ের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে জরিনাকে তালাক গ্রহণে বাধ্য করে। পরে জরিনার বিয়ে হয় দাগী চোর হেকমতের সঙ্গে, হেকমত যে কিনা বছরের অধিকাংশ সময়ই জেল হাজতে কাটায়। ফলে জরিনাকে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে ধান ভেনে নিজের পেট চালাতে হয়। সেভাবেই সে কাজ নেয় ফুলজানের বাড়িতে। সেই বাড়িতেই ঘটনাক্রমে তার শারীরিক মিলন ঘটে ফজলের সঙ্গে। পরবর্তীতে ফজল যখন থানা-পুলিশ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তখনো তাকে আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রাখে জরিনাই। সে বোঝে সে এখন পরস্ত্রী, ফজলের সঙ্গে মেলামেশা উচিত নয়। কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা তাকে বার বার বাধ্য করে ফজলের সংস্পর্শে আসতে। সত্যিকার অর্থে এই উপন্যাসের সবচেয়ে জীবন-রক্ত-মাংসের সার্থক চরিত্র জরিনা।
উপন্যাস হিসাবে কোন শ্রেণীতে ফেলা যায় পদ্মার পলিদ্বীপকেকে? এ যেন একটি ডকুমেন্টরি ছবি। আবু ইসহাকের প্রথম উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ী সম্পর্কে অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, “যদি অনুভূতি আবেগের আন্তরিকতা সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড হয়, তবে সূর্য দীঘল বাড়ী সার্থক উপন্যাসরূপে স্বীকৃতি লাভের যোগ্য।” একই মন্তব্য এই উপন্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আবার সূর্য দীঘল বাড়ী সম্পর্কে যে বিরূপ মন্তব্য করেছেন হাসান আজিজুল হক, সেটিও হয়ত এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হাসান লিখেছেন,
“কিন্তু উপন্যাস যে একটি শিল্প তা কি সূর্য দীঘল বাড়ীর বেলায় স্বীকার করে নেয়া যায়? উপন্যাসটি পড়বার সময় মনে হয় যেন একটি ক্যামেরা অতি ধীরে আমাদের গ্রাম সমাজের ভেতরে, গরিব মানুষের উঠানে, শোবার ঘরে, গোয়ালে, রান্নাঘরে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। উপন্যাসের সমস্ত উপাদান, জীবনের সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য ও খবর শিল্পীর কল্পনা ও সৃষ্টিনৈপুণ্য কদাচ জারিত হয়ে অনন্য হয়ে উঠতে পারছে না—কোনো একটা দৃষ্টি গড়ে উঠতে পারছে না, উপন্যাস একটি জীবন্ত সত্তায় পরিণত হচ্ছে না।”
হাসান আজিজুল হক যেসব সর্তকে সার্থক উপন্যাসের জন্য আবশ্যকীয় বলে মনে করেন, তা কোনো উপন্যাসেই পাওয়া যায় না। এমনকি হাসান-লিখিত উপন্যাসেও না। বৈয়াকরণিক সব শর্ত পূরণ না করেও অনেক উপন্যাস সত্যিকারের উপন্যাস হিসাবে চিহ্নিত হতে পেরেছে। পদ্মার পলিদ্বীপ ও এই ধরনের একটি উপন্যাস।
হয়তো ডকুমেন্টেশনই আবু ইসহাকের আরাধ্য। তাই দেখা যায় উপন্যাসের শেষে ফুটনোট হিসেবে ১৩ পৃষ্ঠাব্যাপী উপন্যাসে ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দগুলির প্রমিত অর্থ তুলে ধরা হয়েছে। বৈয়াকরণগণ ‘আঞ্চলিক উপন্যাস’ নামক একটি বর্গ চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে বিশেষ ভৌগলিক অঞ্চলের প্রকৃতি ও মানবচরিত যখন উপন্যাসিকের শিল্প-অভিপ্রায়ে স্বতন্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে. তখনই একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাসের জন্ম হয়। সেই অর্থে অনেকেই পদ্মার পলিদ্বীপ-কে আঞ্চলিক উপন্যাসের অভিধা দিতে চান। কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে পৃথিবীর সকল উপন্যাসই একটি নির্দিষ্ট ভূগোল ও কালখণ্ডকে আত্মস্থ করে রচিত। উপন্যাসের পটভূমি বলতে যা বোঝানো হয়, তা সবসময়ই স্থানীক ও আঞ্চলিক। কখনোই সর্বব্যাপী নয়। তবে তার আবেদন হতে পারে সর্বব্যাপী। তখনই তা ক্লাসিক। সেগুলিই সবচেয়ে সার্থক রচনা হিসাবে বিবেচিত। পদ্মার পলিদ্বীপ বাংলাদেশের পথিকৃৎ উপন্যাসগুলির একটি হিসাবে আমাদের কাছে অবশ্যই প্রাসঙ্গিক।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- জাকির তালুকদার লিখিত পদ্মার পলিদ্বীপ : পুরো ব-দ্বীপের মানচিত্র প্রবন্ধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিচ্ছেদ থেকে। মূল প্রবন্ধ বাংলা ট্রিবিউনে