» » চৌদ্দ

বর্ণাকার

এরফান মাতব্বরের জ্বর সেরে গিয়েছিল। লাঠি ভর দিয়ে সে হাঁটাচলাও করছিল একটু আধটু। কিন্তু চর বেদখল হওয়ার কথা শুনেই সে আবার নেতিয়ে পড়েছে বিছানায়।

চর গেছে, চরের ফসল গেছে। খাজনা আর সেলামির এতগুলো টাকাও গেছে বরবাদ হয়ে। তাদের তৈরি ভাওর ঘরে তালেবর হয়ে বসে গেছে জঙ্গুরুল্লার দল। হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, কাঁথা-বালিশ, লড়াইর হাতিয়ার–অনেক কিছুই মুফতে পেয়ে গেছে তারা। এসবের ওপরে গেছে মান-ইজ্জত। এর জন্যই বেশি মুসড়ে পড়েছে এরফান মাতব্বর।

সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গালাগাল দেয় দলের লোকদের, ‘হারামজাদারা, চর ছাইড়া পলালি ক্যান্ তোরা? ডাকাতি মামলায় আর কয়জনরে ধরত?’

‘ধরা পইড়্যা হেষে কি জেল খাটতামনি আমরা।’ একজন কোলশরিক বলে।

‘চাকইর‍্যা হারামজাদারা পলাইল ক্যান। ওই নিমকহারামগুলোরে খেদাইয়া দে।’

‘ওগ খেদাইয়া দিমু! কিন্তু আমরা যে চরদখল করতে চাই আবার।’ রমিজ মিরধা বলে।

‘উঁহু। পারবি না, পারবি না। কঁকাতে কঁকাতে মাতব্বর বলে। ঐ চাকইর‍্যা দিয়া কাম অইব না। আমি ভাল অইয়া লই।’

‘কিন্তুক বেশি দেরি অইলে ধানগুলাতে কাইট্যা লইয়া যাইব।’

‘লইয়া গেলে আর কি করমু।’

জমিরদ্দি : ‘কি করমু! এতগুলা ট্যাহা দিছি আপনের সেলামি।’

এরফান : ‘সেলামি নিয়া জমি দিছি। হেই জমি রাখতে না পারলে কি আমার দোষ? আমিও তো নায়েবরে সেলামি দিছি।’

আহাদালী : ‘আপনে কারে দিছেন, কি দিছেন, আমরা তার কি জানি?’

মেহের মুনশি : ‘অ্যাই তোরা বাইরে যা দেহি। মেহের মুনশি সবাইকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।’

জমিরদ্দি : ‘ও মিয়া মুনশির পো, আমরা সেলামি দিছি ওনারে। আমরা ওনার কাছে জমি চাই।’

মেহের মুনশি : ‘কি শুরু করলা তোমরা? মাতবরের পো-র শরীল ভাল নাই। তোমরা। চুপ অও দেহি।’

জমিরদ্দি : ‘ক্যান্ চুপ অইমু? আমাগ সেলামির ট্যাহা ফিরত চাই।’

রমিজ মিরধা : ‘ক্যান ফিরত চাও। তোমারে, আমাগ বেবাকরে জমি তো দিছিলই। আমরাই তো রাখতে পারলাম না।’

আহাদালী : ‘এমুন কাইজ্যার চরের জমির লেইগ্যা সেলামি নিল ক্যান?’

মেহের মুনশি : ‘সেলামি না নিলে চাকইর‍্যা রাখত কি দিয়া। ওগ রোজানা দিতে, ওগ খাইয়াইতে কি কমগুলা ট্যাহা খরচ অইছে?’

রমিজ মিরধা : ‘তোমরা যার যার বাড়িত যাও। মাতবরের পো ভাল অইয়া উড়ুক, তারপর–’

মেহের মুনশি : ‘হ, তারপর একটা কিছু করন যাইব। তোমরা যাও। খবরদার, রাইতের বেলা নিজের ঘরে শুইও না। পুলিস কিন্তু ধরতে আইব।’

সেদিনের মতো সবাই চলে যায়।

রোজই দু-চারজন কোলশরিক আসে এরফান মাতব্বরকে দেখতে। রুগী দেখতে এসেও তারা রুগীর বিছানার পাশে বসে ঘ্যানরঘ্যানর করে। কেউ সেলামির টাকা ফেরত চায়। এরা অনেকেই ধারকর্জ করে সেলামির টাকা যোগাড় করেছিল। কেউ বুক থাপড়ে কাঁদে। ঘরে তাদের এক দানা খাবার নেই।

এদের সকলের অবস্থাই জানে মাতব্বর। নানা ঘাত-প্রতিঘাত সওয়া বুড়ো মন তার। সে মনে আবেগ-উচ্ছ্বাস বড় বেশি ঠাঁই পায় না। তবুও এদের দুরবস্থার কথা ভেবে ব্যথিত হয় সে। তার চোখ ছলছল করে ওঠে। কখনো বালিশের তলা থেকে পাঁচ-দশ টাকা তুলে ওদের হাতে দিয়ে বলে, ‘নে, কারো কাছে কইস না। আর কিছুদিন সবুর কর। আমার ব্যারামডা সারুক। জঙ্গুরুল্লারে আমাবস্যা দ্যাহাইয়া ছাইড়া দিমু।’

কিন্তু মাতব্বরে ব্যারাম আর সারছে না। শরীরের ব্যারামের চেয়ে মনের ব্যারামেই সে বেশি কাহিল হয়ে পড়েছে। সে বিছানায়ই পড়ে থাকে রাতদিন। মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে বেরোয় গালাগালের তুবড়ি। সে সময়ে রাগ ও ঘৃণায় বিকৃত হয় তার মুখ। কখনো উত্তেজনায় সে হাত-পা ছোড়ে, মাথা উঁচু করে বসতে চায়। তার গালাগালের পাত্র জমিদার, নায়েব, জঙ্গুরুল্লা, দারোগা-পুলিস, আরশেদ মোল্লা, এমন কি তার কোলশরিকরাও। তুবড়ির বারুদ পুড়ে শেষ হয়ে গেলে অনেকক্ষণ ধরে সে হাঁপায়। তারপর মরার মতো পড়ে থাকে। এ সময়ে একটু একটু করে বারুদ জমা হয়। তারপর আবার হঠাৎ তুবড়ি ছোটে।

ফজল দিনের বেলা বাপের বিছানার পাশেই বসে থাকে ডাক্তারের ব্যবস্থামত ওষুধ পথ্য দেয়। রাত্রে পুলিসের ভয়ে সে বাড়িতে ঘুমায় না, চলে যায় দূরের কোনো আত্মীয়বাড়ি।

একদিন আরশেদ মোল্লাকে গালাগাল দিতে দিতে মাতব্বরের রাগ গিয়ে পড়ে ফজলের ওপর। সে মুখ বিকৃত করে বলে, ‘এই একটা ভ্যাদা মাছ। আমার ঘরে ক্যান্ এইডা পয়দা অইছিল–ক্যান্ অইছিল? এত দিনের মধ্যে—আরে এতদিনের মইদ্যে পারল না আহ্ আহ–পারল না নিজের পরিবার পোষ মানাইতে। যা, আইজই যা–আহ-আহ্ বউ আনতে না পারলে––আমার বাড়িতে তোর জা’গা নাই—জাগা নাই কইয়া দিলাম।’

বরুবিবি কাছেই ছিল। বলে, ‘হ, আইজই যা। তোর হউর-হাউরিরে কইস ওনার ব্যারামের কথা। বুঝাইয়া কইস, বউমারে দ্যাহনের লেইগ্যা ওনার পরান ছটফট করতে আছে। ওনারাও তো মানুষ। ওনাগো অন্তরে কি আর দয়া-মায়া নাই?’

আরশেদ মোল্লার অন্তরে সত্যিই বুঝি দয়া-মায়া নেই।

সেদিনই বিকেলবেলা ফজল শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। সাথে নিয়ে গিয়েছিল হাশমতকে।

ফজল কাছারি ঘরে বসে থাকে। হাশমত চলে যায় অন্দরে।

আরশেদ মোল্লাকে সালাম দিয়ে সে বলে, ফুফাজির সাংঘাতিক অসুখ, যখন-তখন অবস্থা। মাতব্বরের অসুখের কথাটা একটু বাড়িয়ে বলবার জন্য শিখিয়ে দিয়েছিল ফজল।

আরশেদ মোল্লা শুধু ‘হু’ বলে চেয়ে থাকে হাশমতের দিকে।

‘ফুফাজি অস্থির অইয়া গেছে ভাবিসাবেরে দেহনের লেইগ্যা।’

‘হুঁ।’

‘বউমা-বউমা কইর‍্যা খালি কান্দে।’

‘পরের মাইয়া দেহনের এত আহেঙ্কাত ক্যান্? নিজের বউ-মাইয়া-পোলা দেইখ্যা পরান জুড়াইতে পারে না?’

‘কী যেন কন তালুইজি। নিজের মাইয়াত বিয়া দিলে চইল্যা যায় পরের বাড়ি। পুতের বউ থাকে নিজের বাড়ি, নিজের মাইয়ার মতন।’

‘হ-হ দেছি, মাইয়ার মতন কইও না মিয়া, কও বান্দির মতন।’

‘তালুইজি, ভাবিরে এহনই লইয়া যাইতে কইছে। আপনেরেও যাইতে কইছে। ফুফাজির অবস্থা খুব খারাপ। এইবার যে বাইচ্যা ওড়, মনে অয় না।’

আরশেদ মোল্লা কোনো কথা বলে না।

‘কি কইলেন তালুইজি?’

‘উঁহু। আমার মাইয়া আর ঐ বাড়ি দিমু না। এতদিন বেচছে মাছ। এহন আবার ডাকাতি শুরু করছে।’

‘ডাকাতি! ওইডাতো জঙ্গুরুল্লার কারসাজি। চর দখলের লেইগ্যা মিথ্যামিথ্যি ডাকাতি মামলা সাজাইছে।’

আরশেদ মোল্লা উঠে নদীর ঘাটের দিকে চলতে থাকে। অনুনয় বিনয় করতে করতে তার পেছনে চলে হাশমত। কিন্তু তার অনুরোধের কোনো উত্তরই দেয় না সে।

আরশেদ মোল্লা তার ডিঙি বেয়ে পুবদিকে চলে যায়।

হাশমত কাছারি ঘরে ফিরে আসে।

ফজল দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তার চোখে।

‘উঁহু, কোনো কাম অইল না।’ হাশমত বলে। ‘এত কইর‍্যা কইলাম। কাকুতি-মিনতি করলাম। কোনো কথাই কানে নিল না। ব্যাডা এক্কেরে অমাইনষের পয়দা।’

‘হ, আমি জানতাম, লাথির ঢেঁকি আঙুলের টোকায় ওড্‌ব না।’

হাশমতের কানের কাছে মুখ নিয়ে সে আবার বলে, ‘তুই চইল্যা যা। লালুগ বাড়িতে গিয়া থাক্। কাইল গেছে পূর্ণিমা। চান মাথার উপরে ওডনের আগেই নাও লইয়া আইয়া পড়বি। লালুরেও সঙ্গে আনিস।’

হাশমত চলে যায়।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্ধকার কাছারি ঘরে চৌকির ওপর বসে আছে ফজল।

রূপজান জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে যায় তাকে। সে ঘরে গিয়ে হারিকেন ধরায়। ওটা দেলোয়ারের হাতে দিয়ে বলে, ‘যা কাছারি ঘরে দিয়া আয়।’

‘উঁহু, না–না–না। আমি যাইমু না।’

‘ক্যান?’

‘ওরে মা-রে, ডাকাইত! আমার ডর করে।’

‘দুও বোকা।’

‘ও, তুমি হোন নাই? ওরে আর আমি দুলাভাই কইমু না। ও বোলে মারু ডাকাইত। রামদা লইয়া ডাকাতি করে।’

রূপজানের চোখ ফেটে পানি আসতে চায়। সে-ও শুনেছে, ফজল ডাকাতি করে। তার বাবা কয়েকদিন আগে উঠানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলছিল, ‘হোনছ রূপির মা, মাতবরের পোলাডা আর ইজ্জত রাখল না। মাছ-বেচা থুইয়া এইবার ডাকাতিতে নামছে। রামদা দ্যাহাইয়া মাইরপিট কইর‍্যা এক গিরস্তের পাঁচশ ট্যাহা লইয়া গেছে।’

রূপজান ধরা গলায় বলে, ‘যা না দাদা, দিয়া আয়।’

‘উঁহু, আমি পারমু না।’

রূপজান নিজেই শেষে কাছারি ঘরে যায়। হারিকেনটা চৌকির ওপর রেখেই সে চলে যাচ্ছিল। ফজল খপ করে তার আঁচল ধরে ফেলে। হাসিমুখে সে তাঁকায় রূপজানের দিকে। কিন্তু তার চোখে পানি দেখে ফজলের হাসি মিলিয়ে যায়। তার চোখও ঝাঁপসা হয়ে আসে।

কারো মুখ দিয়েই কোনো কথা বেরোয় না। দুজনে চেয়ে থাকে দুজনের মুখের দিকে। একজনের মনের পুঞ্জীভূত বেদনা বুঝতে চেষ্টা করে আর একজনের চোখ।

ফজল তাকে কাছে টানে। রূপজান হারিকেনটা নিবিয়ে দিয়ে মুখ লুকায় ফজলের বুকে।

‘তুমি বোলে ডাকাইত?’ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে রূপজান।

‘কে কইছে তোমারে?’ ফজল উত্তেজিত স্বরে বলে।

‘দুনিয়ার মাইনষে কয়।’

‘তুমিও কও? তুমিও বিশ্বাস করো এই কথা?’

‘উঁহু।’

ফজল আরো নিবিড় করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘সব জঙ্গুরুল্লার কারসাজি। মিথ্যা মামলা সাজাইয়া আমায় খুনের চর দখল কইরা লইয়া গেছে। আল্লার কসম, আমরা কেও ডাকাতি করি নাই।’

রূপজান একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

‘শোন রূপজান, ডাকাতি কোনো দিন করি নাই। তবে আইজ কিন্তু ডাকাতি করমু।’

রূপজান কোনো কথা বলে না।

ফজল আবার বলে, ‘শোন, বাড়ির সবাই ঘুমাইয়া পড়লে তুমি আমার কাছে আইসা পড়বা।’

‘উঁহু, আমি আইতে পারমু না।’

‘ক্যান?’

‘সোন্দর সোন্দর কড়া দিয়া যে খোঁপা বান্দে, তারে যে বোলাইয়া লয়।’

ফজলের বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘কি কইলা বোঝলাম না।’

‘অহনতো বোঝবাই না। তোমার বালিশের তলায় মাইয়ালোকের খোঁপার কড়া আহে ক্যামনে?’

‘আরে, ও-হ্-হো-হো। ঐ দিন রাইতে তোমার দেরি দেইখ্যা মনে করলাম তুমি ঘুমাইয়া পড়ছ। তোমাগ পশ্চিমের ঘরের পিছনে গিয়া আন্দাকুন্দি যেই জানালা ঠেলা দিছি অমনি কো-ও কইর‍্যা ওঠছে তোমাগ উমের মুরগি। আমি তো মনে করছি কি না জানি কি? ডরে দিছি লাফ। আর পট্‌টত্ কইর‍্যা ঢুকলো একটা কাঁডা। টান দিয়া খুইল্যা দেখি খোঁপার কাঁডা। ঐডা তোমার না?’

‘ঐ রহম কাঁডা কিন্যা দিছিলা কোনো দিন?’

‘তবে কার খোঁপার ঐডা?’

‘আছে একজনের।’

‘দ্যাখো তো! তোমার মনে কইর‍্যাই আমি বালিশের নিচে রাখছিলাম। ঐডার খোঁচায় অনেকগুলো রক্ত ঝরছিল। পায়ে এহনো দাগ আছে দ্যাখবা?’

ফজলের গলা জড়িয়ে ধরে রূপজান একটা দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন এঁকে দেয় তার ঠোঁটে।

‘আমি যাই, কেও আইয়া পড়ব।’

‘তোমারে ছাড়তে কি অখন মন চায়।’ রূপজানের হাতে গলায় হাত বুলিয়ে ফজল বলে, ‘তোমার গা খালি ক্যান? গয়নাগুলা কই?’

‘বা’জানে উড়াইয়া থুইছে চোরের ডরে।’

‘আইজ আমি আইছি। একটু সাজ-গোজ কইর‍্যা আইও। গয়না ছাড়া কেমুন বিধবা বিধবা দ্যাহা যায়।’

‘ছি! অমুন কথা কইও না। আল্লায় যে কোনো দিন অমুন না করে।’

‘রূপজান, ও রূপজান, কই গেলি?’

‘ঐ মায় বোলাইতে আছে। ছাড়ো, আমি যাই।’

ফজলের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে চলে যায় রূপজান।

কালো রাত সারা গায়ে জোছনা মেখে কেমন মনোহারিণী হয়েছে। বসন্তের ফুরফুরে হাওয়ায় দুলছে তার ঝলমলে আঁচল।

রাতের বয়স যত বাড়ছে, ততোই উতলা হচ্ছে ফজল। এতক্ষণে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়। কিন্তু কেন আসছে না রূপজান?

কাছারি ঘরে চৌকির ওপর শুয়ে শুয়ে সে এপাশ-ওপাশ করে।

হুঁকো টানার গুড়ক-গুড়ক আওয়াজ আসছে।

তার শ্বশুর এখনো জেগে আছে তা হলে!

রাতের খাবার সেরে ফজল দরজায় দাঁড়িয়ে কুলকুচা করছিল। সে সময়ে শ্বশুরকে বাইরে থেকে আসতে দেখেছে সে।

ফজলের বিরক্তি ধরে। এত রাত্রে আবার তামুকের নেশা ধরল ব্যাটার!

ঝপ্‌পড়-ঝপ্‌পড় শব্দ তুলে স্টিমার চলছে। তার সার্চলাইটের আরো পশ্চিম দিকের জানালা গলিয়ে কাছারি ঘরে ঢোকে। ঘরটাকে দিনের মতো ফর্সা করে দিয়ে যায় কিছুক্ষণ পর পর।

পশ্চিম থেকে পুবদিকে যাচ্ছে–কোন্ জাহাজ এটা? এ সময়ে তো কোনো জাহাজ নেই। নিশ্চয়ই সৈন্য বোঝাই করে যাচ্ছে।

‘হ্যাঁ, মেহেরবানি কইর‍্যা রাইতের আন্ধারেই যাইস। দিনে দুফরে যাইস না কোনো দিন।’ মনে মনে বলে ফজল।

কয়েকদিন আগে দুপুরবেলা একটা বড় স্টিমার পশ্চিম থেকে পুবদিকে যাচ্ছিল। ওটায় বোঝাই ছিল বিদেশী সৈন্য। দশ বারোটা গোরা সৈন্য উদাম-উবস্তর হয়ে গোলস করছিল খোলা পাটাতনের ওপর।

চাঁদ প্রায় মাথার ওপর এসে গেছে। হাশমতের আসার সময় হলো।

বাইরে পায়ের শব্দ শোনা যায়। পুনপুনু করে কথাও বলেছে যেন কারা। বোধ হয় হাশমত আর লালু এসেছে। কিন্তু ওরা শব্দ করছে কোন সাহসে!

ফজল তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে সামনের দরজার খিল খোলে। একটা পাট খুলতেই জোরালো টর্চের আলো তার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।

‘ধরো, এই–এই যে আসামি।’

ফজল অন্দরমুখি দরজার দিকে দৌড় দেয়। কিন্তু সেখানেও দাঁড়িয়ে আছে লোক।

ফজল হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

এলাকার দফাদার সামেদ আলীকে সাথে নিয়ে দুজন কনস্টেবল ঘরে ঢোকে। তাদের একজন হাতকড়া নিয়ে এগুতেই ফজল বলে, ‘ঐডা থুইয়া দ্যান। আমি পলাইমু না।’

‘পলানির জন্যিতো দৌড় মারছিলা। চোর-ডাকাইতেরে বিশ্বেস আছে।’ বলতে বলতে হাতকড়া লাগায় কনস্টেবল।

অন্য দরজা দিয়ে হাবিলদার, জঙ্গুরুলা চৌধুরী ও আর একজন লোক ঘরে ঢোকে।

‘মোল্লা, বাড়ি আছ নি, ও মোল্লা?’ জঙ্গুরুল্লা চেঁচিয়ে ডাক দেয়।

‘কে? কারা?’ বাড়ির ভেতর থেকে প্রশ্ন করে আরশেদ মোল্লা।

‘আরে আসো এদিগে। দেইখ্যা যাও।’

ফজল দফাদারকে অনুরোধ করে, ‘আপনে একটু কইয়া দ্যা না! আপনে কইলে হাতকড়াডা খুইল্যা দিব।’

‘খুলব নারে বাপু। তারা আইনের মানুষ। আইনের বাইরে কিছু করতে পারব না।’

হারিকেন নিয়ে আরশেদ মোল্লা আসে। সকলের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে সে এক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিস দেখে সে যেন ভেবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কথা সরছে না তার।

‘চাইয়া দ্যাখ্‌ছ কি?’ জঙ্গুরুল্লা বলে। ‘জামাইরে বুঝিন একলাই সমাদর করবা। আমরা বুঝি সমাদর করতে জানি না।’

‘সমাদর এই রাইত দুফরের সময়?’

‘এমুন সময় না আইলে কি জামাইমিয়ার দরশন পাওয়া যাইত?’

ডুকরে কেঁদে উঠছে কেউ। আওয়াজ আসছে অন্দর থেকে।

দ্রুতপায়ে আরশেদ মোল্লা অন্দরে চলে যায়। কাছারি ঘর থেকে শোনা যায় এ রকম নিচু গলায় সে ধমক ছাড়ে, ‘চুপ কর, চুপ কর হারামজাদি। মান-ইজ্জত আর রাখল না।’ একটু থেমে সে স্ত্রীকে বলে, ‘তুমি কি কর গো। ওরে কাঁথা দিয়া ঠাইস্যা ধরো না ক্যান্?’

‘উঁহু-হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ।’ চাপা কান্নার গুমরানিতে যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে জোছনা-রাতের ফিকে অন্ধকার।

‘থাম্‌ বেহায়া শয়তান! আরে তোমারে কইলাম কি? ওর মোখের মইদ্যে টিপ্‌লা দিয়া থোও।’

‘কই গেলা মোল্লা?’ কাছারি ঘর থেকে ডাক দেয় জঙ্গুরুল্লা। ‘আমরা গেলাম গিয়া।’

আরশেদ মোল্লা ছুটে আসে কাছারি ঘরে। অনুনয়ের সুরে বলে, ‘চী সাব, ওরে ছাইড়া দ্যান। আমি জামিন রইলাম।’

‘আমি কি জামিনের মালিক? জিগাও হাওয়ালদার সাবরে।’

‘নেহি নেহি, হাওয়ালদার সাব কুছু করতে পারবে না।’ হাবিলদার বলে গম্ভীর স্বরে।

আরশেদ মোল্লা হাতজোড় করে, ‘হাওয়ালদার সাব। ওরে জামিনে ছাইড়া দ্যান। আমি জামিন রইলাম।’

‘নেহি জ্বী। এ ডাকইতি মামলার এক নম্বর আছামি আছে। হামি জামিন মঞ্জুর করতে পারবে না।’

‘হ, ঠিক কথাই তো। থানার বড় দারোগাও পারব না।’ জঙ্গুরুল্লা বলে। ‘যাউক বেড়াইয়া আসুক। এত চিন্তার কি আছে? এক শ্বশুরবাড়িরতন যাইতে আছে আর এক শ্বশুরবাড়ি।’

‘আপনে আর কাডা ঘায়ে নুনের ছিড়া দিয়েন না, চদরী সাব।’ ক্ষুণ্ণ কণ্ঠ আরশেদ মোল্লার।

‘আরে মিয়া, তোমার তো খরচ বাঁচল। জামাইর লেইগ্যা পিডা-পায়েস তৈয়ার করতে লাগব না কমসে কম সাতটা বছর।’

‘সাত বচ্ছর!’ আরশেদ মোল্লা যেন আঁতকে ওঠে।

‘সাত বচ্ছর না-তো কি সাতদিন! ডাকাতি অইল ‘মাডারের’ মানে খুনের ছোড ভাই।’ দফাদার বলে।

‘কিন্তুক—কিন্তুক–‘ অরশেদ মোল্লার মুখে কথা জড়িয়ে যায়। ‘কিন্তুক আমার–আমার মাইয়ার কি অইব চদ্‌রী সাব?’

‘কি অইব তা তুমি জানো আর জানে তোমার গুণের জামাই।’

‘চদরী সার, ওরে কন আমার মাইয়া ছাইড়া দিয়া যাইতে।’

‘কিরে?’ ফজলের দিকে জঙ্গুরুল্লা বলে। ‘তোর শ্বশুর কি কয় শোনছস?’

ফজল কোনো কথা বলে না।

‘কিরে কথা কস না ক্যান্? তুই আকাম করছস, তুই একলা তার সাজা ভোগ কর। এই বেচারার মাইয়াডারে ক্যান খামাখা কষ্ট দিবি?’

‘হাঁ, ইয়ে ছহি বাত কইছেন চৌধুরী সাহাব।’ জঙ্গুরুল্লার কথার সায় দেয় হাবিলদার। ‘তোম উহার বেটি কো তালাক দিয়ে দোও। বিলকুল সাফ হোয়ে যাও।’

‘না।’ দৃঢ়স্বরে বলে ফজল।

‘ওরে বাবা! ঢোঁড়া সাপের তেজ আছে দেখি।’ দফাদার বলে।

অন্দর থেকে চাপা কান্নার ফোঁপানি ভেসে আসছে।

ফজল কান খাড়া করে। তার দিকে তাকিয়ে তাড়া দেয় জঙ্গুরুল্লা, ‘আর দেরি করণ যায় না। চলো এই বার।’

কাছারি ঘর থেকে বেরিয়ে রওনা হয় সবাই। যেতে যেতে জঙ্গুরুল্লা বলে, ‘ও মোল্লা, তোমার কোনো কথা থাকলে আমার নৌকায় চলো।’

বাড়ির থেকে বেশ খানিকটা দূরে নদীর ঘাটে ভিড়ে রয়েছে জঙ্গুরুল্লার পানসি। আসামি নিয়ে সেটায় চড়ে বসে সবাই। তাদের সাথে ওঠে আরশেদ মোল্লাও।

ফজল এদিক-ওদিক তাকায়। জোছনার আলোয় দৃষ্টি চলে অনেকদূর। কিন্তু ধারে-কাছে কোনো নৌকা দেখা যায় না। ফজল ভাবে, হাশমত আসেনি। হয়ত এসেছিল, পালিয়ে গেছে। ভালই করেছে। তাকে পেলেও ছাড়ত না এরা।

জঙ্গুরুল্লা আবার বলে, ‘কিরে ব্যাডা, কইলাম কি? তোর কাছে তো আর দেনমহরের টাকা দাবি করতে আছে না। কি ও মোল্লা, আছে দাবি?’

‘উঁহু, আমার মাইয়ার দেনমহরের ট্যাহা চাই না।’

‘এইতো। এখন মোখেরতন তিনডা কথা বাইর কইর‍্যা ফ্যাল্–তিন তালাক বায়েন। আমরা বেবাক সাক্ষী।’

‘না আমি কইমু না।’

‘ব্যাডা কইবি না। তোর গলায় পাড়া দিয়া কথা বাইর করমু।’ জঙ্গুরুল্লার সাথের লাঠিধারী লোকটি বলে।

ফজল হাবিলদারকে বলে, ‘হাওয়ালদার সাব, আমার একটা হাত ছাইড়া দ্যান তো, দেখি কে কার গলায় পাড়া দিতে পারে।’

‘এই দবির, আমি থাকতে তোরা ক্যান কথা কস?’ ধমক দেয় জঙ্গুরুল্লা। তারপর সুর নরম করে বলে, ‘শোন ফজল, আমি তোর বাপের বয়সী। যা কই ভালর লেইগ্যা কই। এই বেচারার মাইয়াডারে ঠেকাইয়া রাখলে তোর কী ফয়দা অইব?’

‘আমার ফয়দা আমি বুঝি।’

‘কিন্তু আমি শুনছি মাইয়া তোরে চায় না।’

‘মিছা কথা, একদম মিছা কথা।’

‘কি মোল্লা, তুমি কি কও?’

‘হ ঠিক কইছেন, আমার মাইয়া ওর ঘর করতে রাজি না।’

‘রাজি না, তয় তারেই তালাক দিতে কন। আমি দিমু না’, ফজল বলে।

‘আরে মাইয়ালোকে তালাক দিতে পারলে কি আর তোরে জিগাইতাম!’ জঙ্গুরুল্লা বলে। ‘মাইয়া যখন তোরে চায় না তখন–’

‘আমি বিশ্বাস করি না।’

‘আইচ্ছা, এই কথা? যাও তো দফাদার। আর কে যাইব? দবির যাও। মাইয়ারে জিগাইয়া আমার কাছে আইসা সাক্ষী দিবা।’

দফাদার ও দবির গোরাপিকে নিয়ে আরশেদ মোল্লা বাড়ি যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলে, ‘মাইয়া কইছে, সে ডাকাইতের ঘর করব না।’

‘ছারেছার মিথ্যা কথা। আমি আমার নিজের কানে শুনতে চাই।’ ফজল বলে।

‘নিজের কানে শোননের কি আছেরে ব্যাডা ঘাড়ুয়া? এতগুলো মাইনষে সাক্ষী দিতে আছে।’ জঙ্গুরুল্লা খেঁকিয়ে ওঠে।

‘না, সিধা আঙ্গুলে ঘি উঠব না।’ দফাদার বলে।

‘ঠিক কথা কইছ। কাগজ-কলম বাইর কর। লেখ, অমুকের মাইয়া অমুকেরে আমি তিন তালাক বায়েন দিলাম।’

দফাদার একটা কাগজে লিখে জঙ্গুরুল্লার দিকে এগিয়ে দেয়। জঙ্গুরুল্লা সেটা হাবিলদারের হাতে দিয়ে বলে, ‘নেন হাওয়ালদার সাব। এইবার সই আদায় করণের ভার আপনের উপর দিলাম।’

হাবিলদার ফজলের ডানহাত থেকে হাতকড়া খুলে নিয়ে বলে, ‘করো দস্তখত, কর্ দোও।’

‘না করুম না।’

গালে থাপ্পড় মেরে হাবিলদার বলে, ‘কর্ দস্তখত।’

‘করমু না।’ আরো জোরে চেঁচিয়ে বলে ফজল।

আবার থাপ্পড় পড়ে ফজলের গালে।

‘জলদি দস্তখত কর।’

‘না–না–না।’

জঙ্গুরুল্লা আরশেদ মোল্লাকে বলে, ‘তুমি বাড়ি যাও। চিন্তা কইর‍্য না। দস্তখত আদায় না কইর‍্যা ছাড়মু মনে করছ? ও মাঝিরা নৌকা ছাড়ো।’

আরশেদ মোল্লা পানসি থেকে নেমে বাড়ির দিকে পথ নেয়।