উত্তরে মূলভাওড়, দক্ষিণে হোগলাচর, পুবে মিত্রের চর আর পশ্চিমে ডাইনগাঁও–এই চৌহদ্দির মধ্যে ছোট বড় অনেকগুলো চর। চারদিকে জলবেষ্টিত পলিদ্বীপ। এগুলোর উত্তর আর দক্ষিণদিক দিয়ে দ্বীপবতী পদ্মার দুটি প্রধান স্রোত পুব দিকে বয়ে চলেছে। উত্তর দিকের স্রোত থেকে অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা বেরিয়ে চরগুলোকে ছোট বড় গোল দিঘল নানা আকারে কেটে-হেঁটে মিশেছে গিয়ে দক্ষিণদিকের স্রোতের সঙ্গে।

চরগুলোর বয়স দুবছরও হয়নি। এগুলো জেগেছে আর জঙ্গুরুল্লার কপাল ফিরেছে। প্রায় সবগুলো চরই দখল করে নিয়েছে সে। আর এ চরের দৌলতে নানাদিক দিয়ে তার কাছে টাকা আসতে শুরু করেছে। কোলশরিকদের কাছ থেকে বাৎসরিক খাজনার টাকা আসে। বর্গা জমির ধান-বেচা টাকা আসে। আসে ঘাস-বেচা টাকা।

কোলশরিক আর কৃষাণ-কামলারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, ‘ট্যাহারা মানুষ চিনে। ওরা বোঝে, কোন মাইনষের ঘরে গেলে চিৎ অইয়া অনেকদিন জিরাইতে পারব।’

‘হ, ঠিক কথাই কইছ। আমরা তো আর ট্যাহা-পয়সারে এক মুহূর্তুক জিরানের ফরসত দেই না। আইতে না আইতেই খেদাইয়া দেই।’

টাকারা জঙ্গুরুল্লাকে চিনেছে মাত্র অল্প কয়েক বছর আগে। ভালো করে চিনেছে ধরতে গেলে চরগুলো দখলে আসার পর। আজকাল টাকা-পয়সা নাড়াচাড়া করার সময় বিগত জীবনের কথা প্রায়ই মনে পড়ে তার। জঙ্গুরুল্লার বয়স পয়তাল্লিশ পার হয়েছে। গত পাঁচটা বছর বাদ দিয়ে বাকি চল্লিশটা বছর কি দুঃখ কষ্টই না গেছে তার। জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়টাই কেটেছে অভাব-অনটনের মধ্যে। পেটের ভেতর জ্বলেছে খিদের আগুন। অথচ তার শরীরের ঘামও কখনো শুকোয়নি।

সাত বছর বয়সের সময় তার মা মারা যায়। বাপ গরিবুল্লা আবার শাদি করে। জঙ্গুর সৎমা ছিল আর সব সৎমাদেরর মতোই। বাপও কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। অতটুকু বয়সেই সে বুঝতে পেরেছিল–গাঁয়ের লোক শুধু শুধুই বলে না, মা মরলে বাপ অয় তালুই।

ঘোপচরে গরিবুল্লার সামান্য কিছু জমি ছিল। সেই জমি চাষ করে আর কামলা খেটে কোনো রকমে সে সংসার চালাত। জঙ্গুর বয়স দশ বছর হতে না হতেই সে তাকে হোগলাচরের এক চাষী গেরস্তের বাড়ি কাজে লাগিয়ে দেয়। সেখানে পাঁচ-ছবছর পেটে-ভাতে রাখালি করে সে। তারপর দুটাকা মাইনেয় ঐ চরেরই আর এক বড় গেরস্তের বাড়ি হাল চাষের কাজ জুটে যায়।

বছর চারেক পরে তার বাপ মারা যায়। সৎমা তার ছবছরের মেয়েকে নিয়ে নিকে বসে অন্য জায়গায়। জঙ্গু ঘোপচরে ফিরে আসে। গাঁয়ের দশজনের চেষ্টায় তার বিয়েটাও হয়ে যায় অল্পদিনের মধ্যেই। গরিব চাষীর মেয়ে আসমানি। গোবরের খুঁটে দেয়া থেকে শুরু করে ধান ভানা, চাল ঝাড়া, মুড়ি ভাজা, ঘর লেপা, কাঁথা সেলাই, দুধ দোয়া ইত্যাদি যাবতীয় কাজে তার হাত চলে। আর অভাব-অনটনের সময় দু-এক বেলা উপোস দিতেও কাতর হয় না সে। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে গুছিয়ে নেয় সে গরিবের সংসার।

জঙ্গুরুল্লা বাপের লাঙ্গল-গরু নিয়ে চাষ-বাস শুরু করে। মাঝে মাঝে কামলা খাটে অন্যের জমিতে। সারাদিন সে কি খাটুনি! পুরো পাঁচটা দিন কামলা খেটে পাওয়া যেত একটিমাত্র টাকা। টাকাটা নিয়ে সে মুলফতগঞ্জের হাটে যেত। দশ আনায় কিনত সাত সের চাল আর বাকি ছ’আনার ডাল-তেল-নুন-মরিচ ও আরো অনেক কিছু।

এ সময়ের একটা ঘটনার কথা মনে পড়লেই তার কপাল কুঁচকে ওঠে। চোখদুটো ক্রুর দৃষ্টি মেলে তাকায় নিজের পা দুখানার দিকে। দুপাটি দাঁত চেপে ধরে নিচের ঠোঁট।

ঘোপচরের মাতব্বর ছিল সোহরাব মোড়ল। তার ছেলের বিয়ের বরযাত্রী হয়ে জঙ্গুরুল্লা দক্ষিণপাড়ের কলুকাঠি গিয়েছিল। আসুলির ভাল্ মানুষ। মেহমানদের জন্য সাদা ধবধবে ফরাস বিছিয়েছিল বৈঠকখানায়। সেই ফরাসের ওপর জঙ্গুরুল্লা তার থেবড়া পায়ের কয়েক জোড়া ছাপ ফেলেছিল। তা দেখে চোখ টেপাটিপি করে হেসেছিল কনেপক্ষের লোকেরা। তাদের অবজ্ঞার হাসি বরপক্ষের লোকদের চোখ এড়ায়নি। রাগে সোহরাব মোড়লের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। কোনো রকমে সে সামলে নেয় নিজেকে।

কিন্তু বাড়ি ফেরার পথেই সে পাকড়াও করে জঙ্গুরুল্লাকে জুতা খুলে মারতে যায়। আর সবাই না ঠেকালে হয়তো জুতার বাড়ি দু-একটা পড়ত জঙ্গুরুল্লার পিঠে।

সোহরাব মোড়ল রাগে গজগজ করে, ‘শয়তান, ওর কি এট্টু আক্কেল-পছন্দ নাই? ও আধোয়া পায়ে ক্যামনে গিয়া ওঠল অমন ফরাসে। দেশ-কুলের তারা আমাগ কি খামাখা নিন্দে? খামাখা কয় চরুয়া ভূত?’

দুলার ফুফা হাতেম খালাসি বলে, ‘এমুন গিধড় লইয়া ভর্দ লোকের বাড়িতে গেলে কইব না কি ছাইড়া দিব? আমাগ উচিত আছিল বাছা বাছা মানুষ যাওনের।’

‘ঠিক কথাই কইছ, এইবারতন তাই করতে অইব।’

‘আইচ্ছা, ওর ঘাড়ের উপরে দুইটা চটকানা দিয়া জিগাও দেহি, ওর চরণ দুইখান পানিতে চুবাইলে কি ক্ষয় অইয়া যাইত?’

বরযাত্রীদের একজন বলে, ‘কারবারডা অইছে কি, হোনেন মোড়লের পো। জুতা তো বাপ-বয়সে পায়ে দেয় নাই কোনো দিন। নতুন রফটের জুতা পায়ে দিয়া ফোস্কা পড়ছে। নায়েরতন নাইম্যা খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে কিছুদূর আইছিল। হেরপর খুইল্যা আতে লয়। বিয়াবাড়ির কাছে গিয়া ঘাসের মইদ্যে পাও দুইখান ঘইষ্যা ত্বরাত্বরি জুতার মইদ্যে ঢুকাইছিল।’

‘ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ! জাইতনাশা কুত্তা! ওর লেইগ্যা পানির কি আকাল পড়ছিল? কই গেল পা-না-ধোয়া শয়তানডা?’

একটা হাসির হল্লা বরযাত্রীদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সবাই খোঁজ করে জঙ্গুরুল্লার, ‘কইরে পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা? কই? কই গেল পা-না-ধোয়া গিধড়?’

জঙ্গুরুল্লাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি সেখানে। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সে পেছন থেকে সরে পড়েছিল।

কিন্তু সরে পড়লে কি হবে? দশজনের মুখে উচ্চারিত সেদিনকার সেই পা-না-ধোয়া বিশেষণটা তার নামের আগে এঁটে বসে গেছে। নামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিরাজ করছে সেদিন থেকে। নামের সঙ্গে এ বিশেষণটা যোগ না করলে তাকে চেনাই যায় না আর।

পা-না-ধোয়া বললে প্রথম দিকে খেপে যেত জঙ্গুরুল্লা। মারমুখী হয়ে উঠত। কিন্তু তার ফল হতো উল্টো। সে যত বেশি চটত তত বেশি করে চটাত পাড়া-প্রতিবেশীরা। শেষে নিরুপায় হয়ে নিজের কর্মফল হিসেবেই এটাকে মেনে নিতে সে বাধ্য হয়।

চার বছর পর ঘোপচর নদীতে ভেঙে যায়। জঙ্গুরুল্লা চণ্ডীপুর মামুর বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ কাজে সে কাজে সাতঘাটের পানি খেয়ে সে যখন জীবিকার আর কোনো পথ পায় না তখন ঘড়িশার কাছারির নায়েবের কথা মনে পড়ে তার।

চণ্ডীপুর আসার মাস কয়েক পরের কথা। ঘড়িশার কাছারির নায়েব শশীভূষণ দাস স্টিমার ধরবার জন্য নৌকা করে সুরেশ্বর স্টেশনে গিয়েছিলেন। খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে তিনি প্রাতঃকৃত্যের জন্য নদীর পাড়ে কাশঝোঁপের আড়ালে গিয়ে বসেছিলেন। ঐ সময়ে জঙ্গুরুল্লা ঝকিজাল নিয়ে ওখানে মাছ ধরছিল। জালটা গোছগাছ করে সে কনুইর ওপর চড়িয়েছে এমন সময় শুনতে পায় চিৎকার। জালটা ঐ অবস্থায় নিয়েই সে পেছনে ফিরে দেখে একটা পাতিশিয়াল খ্যাঁকখ্যাঁক করে একটা লোককে কামড়াবার চেষ্টা করছে। লোকটা চিৎকার করছে, পিছু হটছে আর লোটা দিয়ে ওটাকে ঠেকাবার চেষ্টা করছে। জঙ্গুরুল্লা দৌড়ে গিয়ে জাল দিয়ে খেপ মারে পাতিশিয়ালের ওপর। পাতিশিয়াল জালে জড়িয়ে যায়। লোকটার হাত থেকে লোটা নিয়ে সে ওটার মাথার ওপর মারে দমাদম। ব্যস, ওতেই ওর জীবনলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়।

ডাক-চিৎকার শুনে বহু লোক জমা হয়েছিল সেখানে। তাদের কাছে জানা যায়–আগের দিন ঐ এলাকার পাঁচ জনকে পাগলা শিয়ালে কামড়িয়েছে। সবাই বুঝতে পারে–ওটাই সেই পাগলা শিয়াল।

জঙ্গুরুল্লার বুদ্ধি ও সাহসের প্রশংসা করে সকলেই। নায়েব তাকে দশ টাকা বখশিশ দিয়ে বলেন, ‘যদি কখনো দরকার পড়ে, আমার ঘড়িশার কাছারিতে যেও।’

দুঃসময়ে নায়েবের কথা মনে পড়তেই সে চলে গিয়েছিল ঘড়িশার কাছারিতে। নায়েব তাকে পেয়াদার চাকরিতে বহাল করে নেন। মাসিক বেতন তিন টাকা। বেতন যাই হোক, এ চাকরির উপরিটাই আসল। আবার উপরির ওপরে আছে ক্ষমতা যাকে জঙ্গুরুল্লা বলে ‘পাওর’। এ কাজে ঢুকেই জঙ্গুরুল্লা প্রথম প্রভুত্বের স্বাদ পায়। সাড়ে তিন হাত বাঁশের লাঠি হাতে সে যখন মহালে যেত তখন তার দাপটে থরথরিয়ে কাঁপত প্রজারা। নায়েবের হুকুমে সে বকেয়া খাজনার জন্য প্রজাদের ডেকে নিয়ে যেত কাছারিতে। দরকার হলে ধরেও নিত। কখনো তাদের হাত-পা বেঁধে চিৎ করে রোদে শুইয়ে রাখত, কখনো কানমলা বাঁশডলা দিয়ে ছেড়ে দিত।

একবার এক প্রজাকে ধরতে গিয়েছিল জঙ্গুরুল্লা। লোকটা অনেক কাকুতি-মিনতি করে শেষ সম্বল আট আনা এনে দেয় তার হাতে। কিন্তু কিছুতেই জঙ্গুরুল্লার মন গলে না। শেষে লোকটা তার পা জড়িয়ে ধরে।

চমকে ওঠে জঙ্গুরুল্লা। অনেকক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে। শেষে বলে, ‘যা তোরে ছাইড়া দিলাম। পাট বেইচ্যা খাজনার টাকা দিয়া আহিস কাছারিতে।’

তারপরেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। প্রত্যেকবারই মাপ করে দেয়ার সময় তার অন্তরে আকুল কামনা জেগেছে, সোহরাব মোড়লরে একবার পায়ে ধরাইতে পারতাম এই রহম!

শুধু কামনা করেই ক্ষান্ত হয়নি জঙ্গুরুল্লা। সোহরাব মোড়লকে বাগে পাওয়ার চেষ্টাও অনেক করেছে সে। তার চেষ্টা হয়তো একদিন সফল হতো, পূর্ণ হতো অন্তরের অভিলাষ। কিন্তু পাঁচটা বছর–যার বছর দুয়েক গেছে ওত-ঘাত শিখতে–পার হতে না হতেই তার পেয়াদাগিরি চলে যায়। প্রজাদের ওপর তার জুলুমবাজির খবর জমিদারের কানে পৌঁছে। তিনি জঙ্গরুল্লাকে বরখাস্ত করার জন্য পরোয়ানা পাঠান নায়েবের কাছে। জমিদারের পরোয়ানা না মেনে উপায় কি? নায়েব জঙ্গুরুল্লাকে বরখাস্ত করেন বটে, তবে কৃতজ্ঞতার প্রতিদান হিসেবে নতুনচর বালিগাঁয়ে তাকে কিছু জমি দেন।

জঙ্গুরুল্লা বালিগাঁয়ে গিয়ে ঘর বাঁধে। লাঙ্গল-গরু কিনে আবার শুরু করে চাষ বাস। আগের মতো হাবা-গোবা সে নয় আর। একেবারে আলাদা মানুষ হয়ে ফিরে এসেছে সে। আগে ধমক খেলে যার মূৰ্ছা যাওয়ার উপক্রম হতো, সে এখন পানির ছিটে খেলে লগির গুঁতো দিতে পারে।

জমিদারের কাছারিতে কাজ করে নানা দিক দিয়ে তার পরিবর্তন ঘটেছে। সে দশজনের সাথে চলতে ফিরতে কথাবার্তা বলতে শিখেছে। জমা-জমি সংক্রান্ত ফন্দি-ফিকির, প্যাঁচগোছও শিখেছে অনেক। তাছাড়া বেড়েছে তার কূটবুদ্ধি ও মনের জোর। যদিও প্রথম দিকে গায়ের বিচার-আচারে তাকে কেউ পুছত না, তবুও সে যেত এবং সুবিধে মতো দু-চার কথা বলতো। এভাবে গায়ের সাদাসিধে লোকদের ভেতর সে তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই সে গাঁয়ের অন্যতম মাতব্বর বলে গণ্য হয়।

তারপর আসে ১৩৪৬ সাল–জঙ্গুরুল্লার ভাগ্যোদয়ের বছর। বর্ষার শেষে আশ্বিন মাসে মাঝ-নদীতে একটার পর একটা চর পিঠ ভাসাতে শুরু করে। পদ্মার প্রধান স্রোত দু’ভাগ হয়ে সরে যায় উত্তরে আর দক্ষিণে। জঙ্গুরুল্লা বালিগাঁয়ের লোকজন নিয়ে কয়েকটা চরই দখল করে নেয়। তারপর কুণ্ডু আর মিত্র জমিদারদের কাছারি থেকে বন্দোবস্ত এনে বসিয়ে দেয় কোলশরিক। তাদের কাছ থেকে মোটা হারে সেলামি নিয়ে সে তার অবস্থা ফিরিয়ে ফেলে।

চরগুলো দখল করার পর জঙ্গুরুল্লা চরপাঙাশিয়ায় নতুন বাড়ি করে। উত্তর, পুব আর পশ্চিম ভিটিতে চৌচালা ঘর ওঠে। দক্ষিণ ভিটিতে ওঠে আটচালা কাছারি ঘর। নতুন ঢেউটিনের চালা আর পাতটিনের বেড়া নিয়ে ঘরগুলো দিনের রোদে চোখ ঝলসায়। রাত্রে চাঁদের আলোয় বা চলন্ত স্টিমারের সার্চলাইটের আলোয় ঝলমল করে।

ঘরগুলো তুলতে অনেক টাকা খরচ হয়েছিল জঙ্গুরুল্লার। সে নিজের পরিবার-পরিজনের কাছে প্রায়ই বলে, ‘গাঙ অইল পাগলা রাক্‌কস। কখন কোন চরের উপ্‌রে থাবা মারে, কে কইতে পারে? এইডা যদি চর না অইত, তয় আল্লার নাম লইয়া দালানই উডাইতাম।’

যত বড় পয়সাওয়ালাই হোক, পদ্মার চরে দালান-কোঠা তৈরি করতে কেউ সাহস করে না। দালান মানেই পোড়া মাটির ঘর। মাটির ওপর যতক্ষণ খাড়া থাকে ততক্ষণই এ মাটির ঘরের দাম। ভেঙে ফেললে মাটির আর কী দাম? তাই চরের লোক টিনের ঘরই পছন্দ করে। চর-ভাঙা শুরু হলে টিনের চালা, টিনের বেড়া খুলে, খাম-খুঁটি তুলে নিয়ে অন্য চরে গিয়ে ঠাঁই নেয়া যায়।

বিভিন্ন চরে জঙ্গুরুল্লার অনেক জমি আছে। কোলশরিকদের মধ্যে জমির বিলি-ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজের জন্য বাছাবাছা জমিগুলো রেখেছে সে। নিজে বা তার ছেলেরা আর হাল চাষ করে না এখন। বর্গাদার দিয়ে চাষ করিয়ে আধাভাগে অনেক ধান পাওয়া যায়। সে ধানে বছরের খোরাক হয়েও বাড়তি যা বাঁচে তা বিক্রি করে কম সে-কম হাজার দুয়েক টাকা ঘরে আসে। নিজেরা হাল-চাষ না করলেও জমা-জমি দেখা-শোনা করা দরকার, বর্গাদারদের থেকে ভাগের ভাগ ঠিকমতো আদায় করা দরকার। এ চর থেকে দূরের চরগুলোর দেখাশোনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই সে কিছুদিন আগে কুমিরডাঙ্গা আর বগাদিয়ায় আরো দুখানা বাড়ি করেছে। কুমিরডাঙ্গায় গেছে প্রথমা স্ত্রী আসমানি বিবি তার সেজো ছেলে জহিরকে নিয়ে। ঘরজামাই গফুর আর মেয়ে খায়রুনও গেছে তাদের সাথে। বড় ছেলে জাফর বগাদিয়ায় গিয়ে সংসার পেতেছে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী শরিফন আর মেজো ছেলে ও ছেলে বউ রয়েছে বড় বাড়িতে। জঙ্গুরুল্লা বেশির ভাগ সময় ও বাড়িতেই থাকে। মাঝে মাঝে নিজের পানসি নিয়ে চলে যায় কুমিরডাঙ্গা, না হয় বগাদিয়া।

টাকার জোর, মাটির জোর আর লাঠির জোর–এ তিনটার জোরে জোরোয়ার জঙ্গুরুল্লা। এখন ‘সর্মানের’ জোর হলেই তার দিলের আরজু মেটে। সম্মানের নাগাল পেতে হলে বিদ্যার জোরও দরকার–সে বুঝতে পারে। বড় তিন ছেলেতো তারই মতো চোখ থাকতে অন্ধ। তারা ‘ক’ লিখতে কলম ভাঙে। তাই সে ছোট ছেলে দুটিকে স্কুলে পাঠিয়েছে। তারা হোস্টেলে থেকে মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুলে পড়ে।

মান-সম্মান বাড়াবার জন্য জঙ্গুরুল্লা টাকা খরচ করতেও কম করছে না। গত বছর সে মৌলানা তানবীর হাসান ফুলপুরীকে বাড়িতে এনে মস্ত বড় এক জেয়াফতের আয়োজন করেছিল। সে জেয়াফতে গরুই জবাই হয়েছিল আঠারোটা। দাওয়াতি-বে-দাওয়াতি মিলে অন্তত তিন হাজার লোক হয়েছিল। সে জনসমাবেশে মৌলানা সাহেব তাকে চৌধুরী পদবিতে অভিষিক্ত করে যান। সেদিন থেকেই সে চৌধুরী হয়েছে। নতুন দলিলপত্রে এই নামই চালু হচ্ছে আজকাল। চরপাঙাশিয়ার নামও বদলে হয়েছে চৌধুরীর চর। কিন্তু এত কিছু করেও তার নামের আগের সে পা-না-ধোয়া খেতাবটা ঘুচল না। তার তাবে আছে যে সমস্ত কোলশরিক আর বর্গাদার, তারাই শুধু ভয়ে ভয়ে তার চৌধুরী পদবির স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তা-ও সামনা-সামনি কথা বলার সময়। তার অগোচরে আশপাশের লোকের মতো এখানে তারা পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লাই বলে।

কিছুদিন আগে তার সেজো ছেলে জহিরের বিয়ের সম্বন্ধের জন্য সে ঘটক পাঠিয়েছিল উত্তরপাড়ের ভাটপাড়া গ্রামের কাজিবাড়ি। শামসের কাজি প্রস্তাব শুনে ‘ধ্যুত ধ্যুত’ করে হাঁকিয়ে দেন ঘটককে। বলেন, ‘চদরি নাম ফুডাইলে কি অইব! সাত পুরুষেও ওর বংশের পায়ের ময়লা যাইব না।’

এ সবই জঙ্গুরুল্লার কানে যায়। রাগের চোটে সে দাঁতে দাঁত ঘষে। নিন্দিত পা দুটোকে মেঝের ওপর ঠুকতে থাকে বারবার। তার ইচ্ছে হয়, পা দুটো দিয়ে সে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু, পদানত করে চারদিকের সব মাটি আর মানুষ। এমনি করেই এক রকমের দিগ্বিজয়ের আকাক্ষা জন্ম নেয় তার মনে। তাই আজকাল আশেপাশে কোনো নতুন চর জাগলেই লাঠির জোরে সে তা দখল করে নেয়। জমির সত্যিকার মালিকেরা উপায়ান্তর না দেখে হাতজোড় করে এসে তার কাছে দাঁড়ায়। দয়া হলে কিছু জমি দিয়ে সে তাদের কোলশরিক করে রাখে।

চরদিঘলির উত্তরে বড় একটা চর জেগেছে–খবর পায় জঙ্গুরুল্লা। চরটা তার এলাকা থেকে অনেক দূরে, আর কারা নাকি ওটা দখল করে বসেছে। এসব অসুবিধের কথা ভেবেও দমে না সে। নানা প্রতিকূল অবস্থার ভেতর পরপর অনেকগুলো চর দখল করে তার হিম্মত বেড়ে গেছে। তাই কোনো রকম অসুবিধাই সে আর অসুবিধা বলে মনে করে না। চর আর চরের দখলকারদের বিস্তারিত খবর আনবার জন্য সে তার মেজো ছেলে হরমুজকে দু’জন কোলশরিকের সাথে নতুন চরের দিকে পাঠিয়েছিল। তারা ফিরে এসে খবর দেয়–চরটার নাম খুনের চর, দখল করেছে এরফান মাতব্বর, ভাঙর ঘর উঠেছে ঊনষাটটা।

সেদিনই জঙ্গুরুল্লা তার বিশ্বস্ত লোকজন ডাকে যুক্তি-পরামর্শের জন্য। তার কথার শুরুতেই শোনা যায় অনুযোগের সুর, ‘কি মিয়ারা, এত বড় একটা চর জাগল, তার খবর আগে যোগাড় করতে পার নাই?’

কোলশরিক মজিদ খালাসি বলে, ‘ঐ দিগেত আমাগ চলাচল নাই হুজুর।’

‘ক্যান্?’

‘আমরা হাট-বাজার করতে যাই দিঘিরপাড় আর হাশাইল। হাশাইলের পশ্চিমে আমাগ যাওয়া পড়ে না।’

‘যাওয়া পড়ে না তো বোঝলাম। কিন্তুক এদিকে যে গিট্টু লাইগ্যা গেছে।’

‘গিট্টু! কিয়ের গিট্টু?’ দবির গোরাপি বলে।

‘হোনলাম, এরফান মাতব্বর চরডা দখল কইরা ফালাইছে।’

‘হ, আগের বার আট-দশ বচ্ছর আগে যহন ঐ চর পয়স্তি অইছিল তহন এরফান মাতব্বরই ওইডা দখল করছিল।’

‘হ, তার বড় পোলা ঐ বারের কাইজ্যায় খুন অইছিল।’ মজিদ খালাসি বলে।

প্রতিপক্ষ খুবই শক্তিশালী, সেটাই ভাবনার কথা। জঙ্গুরুল্লার কথা-বার্তায় কিন্তু ভাবনার বিশেষ কোনো আভাস পাওয়া যায় না।

সে স্বাভাবিক ভাবেই বলে, ‘খবরডা আগে পাইলে বিনা হ্যাঁঙ্গামে কাম ফতে অইয়া যাইত। যাক গিয়া, তার লেইগ্যা তোমরা চিন্তা কইর‍্য না। চর জাগনের কথাডা যখন কানে আইছে তখন একটা উল্লাগুল্লা না দিয়া ছাইড়্যা দিমু!’

‘কিন্তু হুজুর, রেকট-পরচায় ঐ চরতো এরফান মাতব্বরের নামে আছে।’ মজিদ খালাসি বলে।

‘আরে রাইখ্যা দ্যাও তোমার রেকট-পরচা। চরের মালিকানা আবার রেকট-পরচা দিয়া সাব্যস্ত অয় কবে? এইখানে অইল, লাডি যার মাডি তার।’

‘তবুও কিছু একটা….।’

‘সবুর করো, তারও ব্যবস্থা করতে আছি। ঐ তৌজিমহলের এগারো পয়সার মালিক বিশুগাঁয়ের জমিদার রায়চৌধুরীরা। আমি কাইলই বিশুগাঁও যাইমু। রায়চৌধুরীগ নায়েবরে কিছু টাকা দিলেই সে আমাগ বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ করব।’

‘নালিশ করব!’

‘হ, কয়েক বচ্ছরের বকেয়া খাজনার লেইগ্যা নালিশ করব। আমরাও তখন খাজনা দিয়া চেক নিমু। তারপর এরফান মাতব্বরও যেমুন রাইয়ত, আমরাও তেমুন।’

‘কি কইলেন হুজুর, বোঝতে পারলাম না।’ মজিদ খালাসি বলে।

‘থাউক আর বেশি বুঝাবুঝির দরকার নাই। যদি জমিন পাইতে চাও, তবে যার যার দলের মানুষ ঠিক রাইখ্য। ডাক দিলেই যেন পাওয়া যায়। কারো কাছে কিন্তু ভাইঙ্গা কইও না, কোন চর দখল করতে যাইতে লাগব। এরফান মাতব্বরের দল খবর পাইলে কিন্তু হুঁশিয়ার অইয়া যাইব।’

‘কবে নাগাদ যাইতে চান হুজুর?’ দবির গোরাপি জিজ্ঞেস করে।

‘তা এত ত্বরাত্বরির কি দরকার? আগে নালিশ অউক, খাজনার চেক-পত্র নেই, আর ওরাও ধান-পান লাগাইয়া ঠিকঠাক করুক। এমুন বন্দোবস্ত করতে আছি, দ্যাখবা মিয়ারা, তোমরা ঐ চরে গিয়া তৈয়ার ফসল ঘরে উডাইতে পারবা।’

লোকজন খুশি মনে যার যার বাড়ি চলে যায়।