» » ইন্দ্র-পতন

বর্ণাকার

ইন্দ্র-পতন

তখনও অস্ত যায়নি সূর্য, সহসা হইল শুরু

অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরুগুরুগুরু গুরু।

আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন্ ইন্দ্রের আগমনি?

শুনি, অম্বুদ-কম্বু-নিনাদে ঘন বৃংহিত-ধ্বনি।

বাজে চিক্কুর-হ্রেষা-হর্ষণ মেঘ-মন্দুরা-মাঝে,

সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলংকর সাজে!

ঘনায় অশ্রু-বাষ্প-কুহেলি ঈশান-দিগঙ্গনে,

স্তব্ধ-বেদনা দিগ্‌বালিকারা কী যেন কাঁদনি শোনে!

কাঁদিছে ধরার তরুলতাপাতা, কাঁদিতেছে পশুপাখি,

ধরার ইন্দ্র স্বর্গে চলেছে ধূলির মহিমা মাখি।

বাজে আনন্দ-মৃদঙ গগনে, তড়িৎ-কুমারী নাচে,

মর্ত্য-ইন্দ্র বসিবে গো আজ স্বর্গ-ইন্দ্র কাছে!

সপ্ত-আকাশ-সপ্তস্বরা হানে ঘন করতালি,

কাঁদিছে ধরায় তাহারই প্রতিধ্বনি – খালি, সব খালি!

হায় অসহায় সর্বংসহা মৌনা ধরণি মাতা,

শুধু দেব-পূজা তরে কি মা তোর পুষ্প হরিৎ-পাতা?

তোর বুকে কি মা চির-অতৃপ্ত রবে সন্তান-ক্ষুধা?

তোমার মাটির পাত্রে কি গো মা ধরে না অমৃত-সুধা?

জীবন-সিন্ধু মথিয়া যে-কেহ আনিবে অমৃত-বারি,

অমৃত-অধিপ দেবতার রোষ পড়িবে কি শিরে তারই?

হয়তো তাহাই, হয়তো নহে তা,–এটুকু জেনেছি খাঁটি,

তারে স্বর্গের আছে প্রয়োজন, যারে ভালোবাসে মাটি।

কাঁটার মৃণালে উঠেছিল ফুটে যে চিত্ত-শতদল,

শোভেছিল যাহে বাণী কমলার রক্ত-চরণ-তল,

সম্ভ্রমে-নত পূজারি মৃত্যু ছিঁড়িল সে-শতদলে –

শ্রেষ্ঠ অর্ঘ অর্পিবে বলি নারায়ণ-পদতলে!

জানি জানি মোরা, শঙ্খ-চক্র-গদা যাঁর হাতে শোভে–

পায়ের পদ্ম হাতে উঠে তাঁর অমর হইয়া রবে।

কত সান্ত্বনা-আশা-মরীচিকা, কত বিশ্বাস-দিশা

শোক-সাহারায় দেখা দেয় আসি, মেটে না প্রাণের তৃষা!

দুলিছে বাসুকি মণিহারা ফণী, দুলে সাথে বসুমতী,

তাহার ফণার দিনমণি আজ কোন্ গ্রহে দেবে জ্যোতি!

জাগিয়া প্রভাতে হেরিনু আজিকে জগতে সুপ্রভাত,

শয়তানও আজ দেবতার নামে করিছে নান্দীপাঠ!

হে মহাপুরুষ, মহাবিদ্রোহী, হে ঋষি, সোহম্-স্বামী!

তব ইঙ্গিতে দেখেছি সহসা সৃষ্টি গিয়াছে থামি,

থমকি গিয়াছে গতির বিশ্ব চন্দ্র-সূর্য-তারা,

নিয়ম ভুলেছে কঠোর নিয়তি, দৈব দিয়াছে সাড়া!

যখনই স্রষ্টা করিয়াছে ভুল, করেছ সংস্কার,

তোমারই অগ্রে স্রষ্টা তোমারে করেছে নমস্কার।

ভৃগুর মতন যখনই দেখেছ অচেতন নারায়ণ,

পদাঘাতে তাঁর এনেছ চেতনা, কেঁপেছে জগজ্জন!

ভারত-ভাগ্য-বিধাতা বক্ষে তব পদ-চিন ধরি

হাঁকিছেন, ‘আমি এমনি করিয়া সত্য স্বীকার করি।

জাগাতে সত্য এত ব্যাকুলতা এত অধিকার যার,

তাহার চেতন-সত্যে আমার নিযুত নমস্কার।’

আজ শুধু জাগে তব অপরূপ সৃষ্টি-কাহিনি মনে,

তুমি দেখা দিলে অমিয়-কণ্ঠ বাণীর কমল-বনে!

কখন তোমার বীণা ছেয়ে গেল সোনার পদ্ম-দলে,

হেরিনু সহসা ত্যাগের তপন তোমার ললাট-তলে!

লক্ষ্মী দানিল সোনার পাপড়ি, বীণা দিল করে বাণী,

শিব মাখালেন ত্যাগের বিভূতি কণ্ঠে গরল দানি।

বিষ্ণু দিলেন ভাঙনের গদা, যশোদা-দুলাল বাঁশি,

দিলেন অমিত তেজ ভাস্কর, মৃগাঙ্ক দিল হাসি।

চীর গৈরিক দিয়া আশিসিল ভারত-জননী কাঁদি,

প্রতাপ-শিবাজী দানিল মন্ত্র, দিল উষ্ণীষ বাঁধি।

বুদ্ধ দিলেন ভিক্ষাভাণ্ড, নিমাই দিলেন ঝুলি,

দেবতারা দিল মন্দার-মালা, মানব মাখাল ধূলি।

নিখিল-চিত্ত-রঞ্জন তুমি উদিলে নিখিল ছানি –

মহাবীর, কবি, বিদ্রোহী, ত্যাগী, প্রেমিক, কর্মী, জ্ঞানী!

হিমালয় হতে বিপুল বিরাট, উদার আকাশ হতে,

বাধা-কুঞ্জর তৃণসম ভেসে গেল তব প্রাণ-স্রোতে।

ছন্দ-গানের অতীত হে ঋষি, জীবনে পারিনি তাই

বন্দিতে তোমা, আজ আনিয়াছি চিত্ত-চিতার ছাই!

বিভূতি-তিলক! কৈলাস হতে ফিরেছ গরল পিয়া,

এনেছি অর্ঘ্য শ্মশানের কবি ভস্ম-বিভূতি নিয়া!

নাও অঞ্জলি, অঞ্জলি নাও, আজ আনিয়াছি গীতি,

সারা জীবনের না-কওয়া-কথার ক্রন্দন-নীরে তিতি!

এত ভালো মোরে বেসেছিলে তুমি, দাওনিকো অবসর

আমারেও ভালোবাসিবার, আজ তাই কাঁদে অন্তর!

আজিকে নিখিল-বেদনার কাছে মোর ব্যথা কতটুক্,

ভাবিয়া ভাবিয়া সান্ত্বনা খুঁজি, তবু হা হা করে বুক!

আজ ভারতের ইন্দ্র-পতন, বিশ্বের দুর্দিন,

পাষাণ বাংলা পড়ে এককোণে স্তব্ধ অশ্রুহীন।

তারই মাঝে হিয়া থাকিয়া থাকিয়া গুমরি গুমরি ওঠে,

বক্ষের বাণী চক্ষের জলে ধুয়ে যায়, নাহি ফোটে!

দীনের বন্ধু, দেশের বন্ধু, মানব-বন্ধু তুমি,

চেয়ে দেখো আজ লুটায় বিশ্ব তোমার চরণ চুমি।

গগনে তেমনই ঘনায়েছে মেঘ, তেমনই ঝরিছে বারি,

বাদলে ভিজিয়া শত স্মৃতি তব হয়ে আসে ঘন ভারী।

পয়গম্বর ও অবতার-যুগে জন্মিনি মোরা কেহ,

দেখিনিকো মোরা তাঁদেরে, দেখিনি দেবের জ্যোতির্দেহ।

কিন্তু যখনই বসিতে পেয়েছি তোমার চরণ-তলে,

না জানিতে কিছু না বুঝিতে কিছু নয়ন ভরেছে জলে।

সারা প্রাণ যেন অঞ্জলি হয়ে ও-পায়ে পড়েছে লুটি,

সকল গর্ব উঠেছে মধুর প্রণাম হইয়া ফুটি।

বুদ্ধের ত্যাগ শুনেছি মহান, দেখিনিকো চোখে তাহে,

নাহি আপশোশ, দেখেছি আমরা ত্যাগের শাহানশাহে,

নিমাই লইল সন্ন্যাস প্রেমে, দিইনিকো তাঁরে ভেট,

দেখিয়াছি মোরা ‘রাজা-সন্ন্যাসী’ প্রেমের জগৎ-শেঠ।

শুনি, পরার্থে প্রাণ দিয়া দিল অস্থি বনের ঋষি;

হিমালয় জানে, দেখেছি দধীচি গৃহে বসে দিবানিশি!

হে নবযুগের হরিশচন্দ্র! সাড়া দাও, সাড়া দাও!

কাঁদিছে শ্মশানে সুত-কোলে সতী, রাজর্ষি ফিরে চাও!

রাজকুলমান পুত্র-পত্নী সকল বিসর্জিয়া,

চণ্ডাল বেশে ভারত-শ্মশান ছিলে একা আগুলিয়া,

এসো সন্ন্যাসী, এসো সম্রাট, আজি সে শ্মশান-মাঝে,

ওই শোনো তব পুণ্যে জীবন-শিশুর কাঁদন বাজে!

দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যূপে ফেলে

ত্যাগের করাতে কাটিয়াছ বীর বারেবারে অবহেলে।

ইব্রাহিমের মতো বাচ্চার গলে খঞ্জর দিয়া

কোরবানি দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবি-হিয়া।

ফেরেশতা সব করিছে সালাম, দেবতা নোয়ায় মাথা,

ভগবান-বুকে মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা!

প্রজা-রঞ্জন রাম-রাজা দিল সীতারে বিসর্জন,

তাঁরও হয়েছিল যজ্ঞে স্বর্ণ-জানকীর প্রয়োজন;

তব ভাণ্ডার-লক্ষ্মীরে রাজা নিজ-হাতে দিল তুলি

ক্ষুধা-তৃষাতুর মানবের মুখে, নিজে নিলে পথ-ধূলি।

হেম-লক্ষ্মীর তোমারও জীবনযাগে ছিল প্রয়োজন,

পুড়িলে যজ্ঞে, তবু নিলে নাকো দিলে যা বিসর্জন!

তপোবলে তুমি অর্জিলে তেজ বিশ্বামিত্র-সম,

সারা বিশ্বের ব্রাহ্মণ তাই বন্দিছে নমো নমো!

হে যুগ-ভীষ্ম। নিন্দার শরশয্যায় তুমি শুয়ে

বিশ্বের তরে অমৃতমন্ত্র বীর-বাণী গেলে থুয়ে।

তোমার জীবনে বলে গেলে – ওগো কল্কি আসার আগে

অকল্যাণের কুরুক্ষেত্রে আজও মাঝে মাঝে জাগে

চিরসত্যের পাঞ্জজন্য, কৃষ্ণের মহাগীতা,

যুগে যুগে কুরু-মেদ-ধূমে জ্বলে অত্যাচারের চিতা।

তুমি নবব্যাস, গেলে নবযুগ-জীবন-ভারত রচি,

তুমিই দেখালে – ইন্দ্রেরই তরে পারিজাত-মালা, শচী!

আসিলে সহসা অত্যাচারীর প্রাসাদ-স্তম্ভ টুটি

নব-নৃসিংহ-অবতার তুমি, পড়িল বক্ষে লুটি

আর্ত-মানব-হৃদি-প্রহ্লাদ, পাগল মুক্তি-প্রেমে!

তুমি এসেছিলে জীবন-গঙ্গা তৃষাতুর তরে নেমে।

দেবতারা তাই স্তম্ভিত হেরো দাঁড়ায়ে গগন-তলে,

নিমাই তোমারে ধরিয়াছে বুকে, বুদ্ধ নিয়াছে কোলে।

তোমারে দেখিয়া কাহারও হৃদয়ে জাগেনিকো সন্দেহ

হিন্দু কিংবা মুসলিম তুমি অথবা অন্য কেহ।

তুমি আর্তের, তুমি বেদনার, ছিলে সকলের তুমি,

সবারে যেমন আলো দেয় রবি, ফুল দেয় সবে ভূমি।

হিন্দুর ছিলে আকবর, মুসলিমের আরংজিব,

যেখানে দেখেছ জীবের বেদনা, সেখানে দেখেছ শিব!

নিন্দা-গ্লানির পঙ্ক মাখিয়া, পাগল, মিলন-হেতু

হিন্দু-মুসলমানের পরানে তুমিই বাঁধিলে সেতু!

জানি না আজিকে কী অর্ঘ্য দেবে হিন্দু-মুসলমান,

ঈর্ষাপঙ্কে পঙ্কজ হয়ে ফুটুক এদের প্রাণ।

হে অরিন্দম, মৃত্যুর তীরে করেছ শত্রু জয়,

প্রেমিক! তোমার মৃত্যু-শ্মশান আজিকে মিত্রময়!

তাই দেখি, যারা জীবনে তোমায় দিল কণ্টক-হুল,

আজ তাহারাই এনেছে অর্ঘ্য নয়ন-পাতার ফুল!

কে যে ছিলে তুমি, জানি নাকো কেহ, দেবতা কি আওলিয়া,

শুধু এই জানি, হেরে আর কারে ভরেনি এমন হিয়া।

আজ দিকে দিকে বিপ্লব-অহিদল খুঁজে ফেরে ডেরা,

তুমি ছিলে এই নাগ-শিশুদের ফণি-মনসার বেড়া।

তুমিই রাজার ঐরাবতের পদতল হতে তুলে

বিষ্ণু-শ্রীকর-অরবিন্দরে আবার শ্রীকরে থুলে!

তুমি দেখেছিলে ফাঁসির গোপীতে বাঁশির গোপীমোহন

তোমার ভগ্ন চাকায় জড়ায়ে চালায়েছে এরা রথ,

আপন মাথার মানিক জ্বালায়ে দেখায়েছে রাতে পথ।

আজ পথ-হারা আশ্রয়হীন তাহারা যে মরে ঘুরে,

গুহা-মুখে বসি ডাকিছে সাপুড়ে মারণমন্ত্র সুরে!

যেদিকে তাকাই কূল নাহি পাই, অকূল হতাশ্বাস,

কোন শাপে ধরা স্বরাজরথের চক্র করিল গ্রাস?

যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে রণে পড়িল সব্যসাচী,

ওই হেরো, দূরে কৌরবসেনা উল্লাসে ওঠে নাচি।

হিমালয় চিরে আগ্নেয়-যান চিৎকার করি ছুটে,

শত ক্রন্দন-গঙ্গা যেন গো পড়িছে পিছনে টুটে!

স্তব্ধ-বেদনা গিরিরাজ ভয়ে জলদে লুকায় কায় –

নিখিল অশ্রু-সাগর বুঝিবা তাহারে ডুবাতে চায়!

টুটিয়াছে আজ গর্ব তাহার, লাজে নত উঁচু শির,

ছাপি হিমাদ্রি উঠিছে প্রণাম সমগ্র পৃথিবীর!

ধূর্জটি-জটাবাহিনী গঙ্গা কাঁদিয়া কাঁদিয়া চলে,

তারই নীচে চিতা–যেন গো শিবের ললাটে অগ্নি জ্বলে!

মৃত্যু আজিকে হইল অমর পরশি তোমার প্রাণ,

কালো মুখ তার হল আলোময়, শ্মশানে উঠিছে গান!

অগুরু-পুষ্প-চন্দন পুড়ে হল সুগন্ধতর,

হল শুচিতর অগ্নি আজিকে, শব হল সুন্দর।

ধন্য হইল ভাগীরথীধারা তব চিতা-ছাই মাখি,

সমিধ হইল পবিত্র আজি কোলে তব দেহ রাখি।

অসুরনাশিনী জগন্মাতার অকাল উদ্‌বোধনে

আঁখি উপাড়িতে গেছিলেন রাম, আজিকে পড়িছে মনে,

রাজর্ষি! আজি জীবন উপাড়ি দিলে অঞ্জলি তুমি,

দনুজদলনী জাগে কিনা – আছে চাহিয়া ভারতভূমি।

হুগলি

১১ই আষাঢ় ১৩৩২