চিত্তনামা

‘চিত্তনামা’ কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কাব্যগ্রন্থ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ২রা আষাঢ় ১৩৩২ বঙ্গাব্দ (১৬ জুন ১৯২৫ খৃষ্টাব্দ) মঙ্গলবার, দার্জিলিঙে পরলোকগমন করেন। দেশবন্ধুর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে নজরুল অর্ঘ্য, অকাল-সন্ধ্যা, সান্ত্বনা, ইন্দ্রপতন, রাজভিখারী নামে কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন যেগুলো সমকালীন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ (১৯২৫ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট) মাসে কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকা থেকে জানা যায়, গ্রন্থটি ১৮ই কার্ত্তিক ১৩৩২ বঙ্গাব্দ, মুতাবিক ৪ নভেম্বর ১৯২৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশের তারিখ নিয়ে সংশয় রয়েছে, কেননা, ‘ছায়ানট’ ও ‘চিত্তনামা’ কাব্যে প্রকাশকাল মুদ্রিত হয়নি, অধিকন্তু বেঙ্গল লাইব্রেরীর তালিকায় ‘ছায়ানটে’র প্রকাশকাল ২২ সেপ্টেম্বর ১৯২৫ এবং ‘চিত্তনামা’র প্রকাশকাল ৪ নভেম্বর ১৯২৫ বলে উল্লিখিত হয়েছে। এই সব তারিখ গ্রন্থপ্রকাশের প্রকৃত তারিখ নাও হতে পারে তবুও ‘বাংলা একাডেমি’ প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলী’ জন্মশতবর্ষ সংস্করণে চিত্তনামার আগে ছায়ানটের স্থান দেওয়া হয়েছে। আমরাও এই ক্রম অনুসরণ করে ‘চিত্তনামা’কে ‘ছায়ানটে’র পরে স্থান দিয়েছি।

‘চিত্তনামা’ কাব্যের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে। তিনি ছিলেন খুবই স্নেহশীলা নারী। পাঠকমাত্রেই জানেন নজরুলের মধ্যে ছিল মাতৃস্নেহ পাবার আগ্রহ; কেননা, কোন বিশেষ অজ্ঞাত কারণে নিজের মায়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিল না। নজরুল বাসন্তী দেবীকে মা বলে ডাকতেন। কবি ‘চিত্তনামা’র উৎসর্গ পাতায় লেখেন—

মাতা বাসন্তী দেবীর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দে—

‘চিত্তনামা’ সম্পর্কে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণের ‘প্রবাসী’ বলেন—

“৪০ পাতা বইয়ের দাম এক টাকা। … বইয়ের কবিতাগুলি পড়িয়া ভাল লাগিল। লেখকের দেশবন্ধুর প্রতি ভক্তি প্রতি ছত্রে প্রকাশ পাইয়াছে। বইখানির বাঁধান, ছাপা, কাগজ—সবই খুব ভাল।”

‘অর্ঘ্য’ সম্পর্কে শ্রীপ্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন—

“দেশবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শুনে কবি কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে ‘অর্ঘ্য’ গানটি লেখেন ১৩৩২ সালের ৩রা আষাঢ়। দেশবন্ধুর শবাধারে রচনাটি মালার সঙ্গে অর্ঘ্য-স্বরূপ জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।”

— [কাজী নজরুল, ৩৭ পৃষ্ঠা]

‘অকালসন্ধ্যা’ ১৩৩২ শ্রাবণের ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনামের নিচে বন্ধনীর মধ্যে লেখা ছিল : ‘জয় জয়ন্তী কীর্ত্তন—একতালা’। পাদটীকায় লেখা ছিল : ‘স্বর্গীয় দেশবন্ধুর শোকযাত্রার গান’।

‘সান্ত্বনা’ ১৩৩২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় পঞ্চম বর্ষের ৩১ সংখ্যক ‘বিজলী’তে বের হয়।

‘ইন্দ্রপতন’ ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১২ই আষাঢ় তারিখের ‘আত্মশক্তি’তে প্রকাশিত হয়। এ-সম্পর্কে চৌধুরী শামসুর রহমান লিখেছন—

“‘ইন্দ্রপতন’ সাপ্তাহিক ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায়ই ছাপা হয়েছিল। … কবি তাঁর এ কবিতায় মহান নেতার গুণকীর্তন করতে গিয়ে তাঁকে নবীদের সাথে তুলনা ক’রে উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে বলে ফেলেছিলেন : ‘হে মানব-আম্বিয়া।’ তা ছাড়া, কবিতাটিতে এমন আরও কতকগুলি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল, যা ইসলামী ভাবধারার অনুকূল নয়। এ সব ত্রুটির প্রতি কবির দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে খোলা চিঠির আকারে লেখা আমার প্রবন্ধ মফঃস্বলের কাগজ ‘বগুড়ার কথা’য় দীর্ঘ দুপৃষ্ঠা স্থান নিয়ে প্রকাশিত হয়। আমার এ প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলমান সমাজে তৎকালে সাড়া প’ড়ে গিয়েছিল। … পরে যখন কবিতাটি তাঁর ‘চিত্তনামা’ বইয়ে প্রকাশিত হয়, কবি নজরুল তখন আপত্তিকর লাইনগুলি সংশোধন করে এবং কোনো কোনো লাইন বাদ দিয়েই তা ছেপেছিলেন।”

— [পঁচিশ বছর, ৪২-৪৪ পৃষ্ঠা]

কবিতাটি গ্রন্থব্ধ হওয়ার কালে ‘হে মানব-আম্বিয়া’ পদটি পরিবর্তিত হয় ‘হে মানব নবি-হিয়া’ রূপে এবং তার চারটি পঙ্‌ক্তি পরিবর্জিত হয়। যতদূর মনে পড়ে, পরিত্যক্ত পঙ্‌ক্তিগুলি ছিল এরূপ:

জন্মিলে তুমি মোহাম্মদের আগে, হে পুরষবর!

কোরানে ঘোষিত তোমার মহিমা, হতে পয়গাম্বর।

যে জ্যোতি পারেনি সহিতে স্বয়ং মুসা-ও কোহ-ই-তুরে,

সেই জ্যোতি তুমি রেখেছিলে তব নয়ন-মণিতে পুরে।

‘রাজভিখারী’ ১৩৩২ শ্রাবণের ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

উৎসর্গ

মাতা বাসন্তী দেবীর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দে—

নজরুল ইসলাম