আর কিছু নয়, গফরগাঁ থাইকা পীর সাইবেরে নিয়া আস তোমরা। অনেক ভেবেচিন্তে বললেন রহমি সর্দার।

তাই করেন, হুজুর, তাই করেন। একবাক্যে সায় দিল চাষীরা।

গফরগাঁ থেকে জবরদস্ত পীর মনোয়ার হাজীকেই নিয়ে আসবে ওরা। দেশজোড়া নাম মনোয়ার হাজীর। অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি তিনি। মুমূর্ষু রোগীকেও এক ফুঁয়ে ভালো করেছেন এমন দৃষ্টান্ত আছে।

সেবার করিমগঞ্জে যখন ওলাবিবি এসে ঘরকে ঘর উজার করে দিচ্ছিল তখন এই মনোয়ার হাজীই রক্ষা করেছিলেন গাঁটাকে। সাধ্য কি ওলাবিবির মনোয়ার হাজীর ফুঁয়ের সামনে দাঁড়ায়। দিন দুয়েকের মধ্যে তল্পিতল্পাগুটিয়ে পালিয়ে গেল ওলাবিবি, দু’দশ গাঁ ছেড়ে। এমন ক্ষমতা রাখেন মনোয়ার হাজী।

গাঁয়ের লোক খুশি হয়ে অজস্র টাকা পয়সা আর অজস্র জিনিসপত্র ভেট দিয়েছিল তাঁকে।

কেউ দিয়েছিল বাগানের শাকসব্জি, কেউ দিয়েছিল পুকুরের মাছ। কেউ মোরগ হাঁস। আবার কেউ দিয়েছিল নগদ টাকা।

দুধের গরুও নাকি কয়েকটা পেয়েছিলেন তিনি। এত ভেট পেয়েছিলেন যে, সেগুলো বাড়ি নিতে নাকি তিন তিনটে গোরুর গাড়ি লেগেছিল তাঁর। সেই সৌভাগ্যবান পীর মনোয়ার হাজী। তাঁকেই আনবে বলে ঠিক করল গাঁয়ের মাতব্বরেরা, চাষী আর ক্ষেত মজুররা।

কিন্তু পীরকে আনতে হলে টাকার দরকার। পীর সাহেব কি এমনি আসবেন? তাঁর জন্যে বিশেষ ধরনের পাল্‌কি চাই। আট বাহকের পাল্‌কি। ঘি ছাড়া কোন কিছু মুখেই রোচে না পীর সাহেবের। গোস্ত ছাড়া ভাত খান না। খাবার শেষে এক প্রস্ত মিষ্টি না হলে খাওয়াটাই অসম্পূর্ণ রয়ে যায় তাঁর। তাই টাকার দরকার।

টাকার চিন্তা করলে তো চলবো না। যেমন কইরা অউক পীর সাহেবের আনতে হইবো। কোমর খিঁচে বলল জমির ব্যাপারি। পর পর দুইডা বছর ফসল নষ্ট অইয়া গেল, খোদা না করুক, এই বার যদি কিছু অয়, তাইলে যে কোনমতেই জান বাঁচান যাইবো না। শেষের দিকে কান্নায় ভিজে এল জমির ব্যাপারির কণ্ঠস্বর।

পর পর কত বছর বন্যার জলে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে ওদের। ভরা বর্ষা শুরু হতেই বাঁধটা ভেঙ্গে যায়। আর হড় হড় করে পানি এসে ভাসিয়ে দিয়ে যায় সমগ্র প্রান্তরটাকে।

কপাল চাপড়িয়ে খোদাকে অনেক ডেকেছে ওরা। অনেক কাকুতি মিনতি ভরা প্রার্থনা জানিয়েছে খোদার দরবারে। কিছুতেই কিছু হয়নি। খোদা কান দেননি ওদের প্রার্থনায়। নীরব থেকেছেন তিনি। নীরব থাকবো না? খোদা কি আর যার তার ডাকে সাড়া দেয়? গায়ের লোকদের বোঝাতে চেষ্টা করল জমির মুন্সি। খোদার ওলিদের দিয়া ডাকাইলে পর খোদা শুনবো। মন টলবো। তাই কর, পীর সাইবেরে নিয়া আস তোমরা।

ঠিক হল বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলবে ওরা। অবশ্য চাঁদা সবাই দেবে। দেবে না কেন? বান ডাকলে তো আর একা রহিম সর্দারের ফসল নষ্ট হবে না, হবে সবার। সবার ঘরেই অভাব অনটন দেখা দেবে। সবাই দুঃখ ভোগ করবে। এঁকে এঁকে মরবে, যেমন মরেছে গত দু’বছর। কিন্তু মতি মাস্টার যুক্তি তর্কের ধার ধারে না। চাঁদা চাইতেই রেগে বলল, চাঁদা দিমু? কিসের লাইগা দিমু? ওই লোকড়ার পিছে ব্যয় করবার লাইগা?

মতি মাস্টারের কথায় দাঁতে জিভ কাটল জমির মুন্সি।

তওবা, তওবা, কহেন মাস্টার সাব। খোদাভক্ত পীর, আল্লার ওলি মানুষ । দশ গাঁয়ে যারে মানে, তার নামে এত বড় কুৎসা।

ভালা কাজ করলা না মাস্টার, ভালা কাজ করলা না। ঘন ঘন মাথা নাড়ল জমির ব্যাপারি। পীরের বদ দোয়ায় ছাই অইয়া যাইবা।

কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠল মতি মাস্টার। কি যে কও চাচা, তোমাগো কথা শুনলে হাসি পায়।

হাসি পাইবো না, লেখাপড়া শিখা তো এহন বড় মানুষ অইয়া গেছ। মুখ ভেংচিয়ে বললেন জমির ব্যাপারি। চাঁদা দিলে দিবা, না দিলে নাই, এত বাহাদুরি কথা ক্যান?

কিন্তু বাহাদুরি কথা আরো একজনের কাছ থেকে শুনতে হয় তাদের। শোনালো দৌলত কাজীর মেজ ছেলে রশিদ। শহরে থেকে কলেজে পড়ে। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে বেড়াতে। চাঁদা তোলার ইতিবৃত্ত শুনে সে বলল, পাগল আর কি, পীর আইনা বন্যা রুখবো। এ একটা কতা অইলো? কথা নয় হারামজাদা! জমির মুন্সি কোন জবাব দেবার আগেই গর্জে উঠলেন দৌলত কাজী নিজে। আল্লার ওলি, পীর দরবেশ, ইচ্ছা করলে সব কিছু করতে পারে। সব কিছু করতে পারে তাঁরা। এই বলে নুহ নবী আর মহাপ্লাবনের ইতিকথাটা ছেলেকে শুনিয়ে দিলেন তিনি!

খবরটা রহিম সর্দারের কানে যেতে দেরি হল না। দু-দশ গাঁয়ের মাতাব্বর রহিম সর্দার। পঞ্চাশ বিঘে খাস আবাদীজমির মালিক। একবার রাগলে, সে রাগ সহজে পড়ে না তাঁর। জমির মুন্সির কাছ থেকে কথাটা শুনে রাগে থরথর করে কেঁপে উঠলেন তিনি, এ্যাঁ! খোদার পীরেরে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা। আচ্ছা, মতি মাস্টারের মাস্টারি আমি দেইখা নিমু। দেইখা নিমু ম‍ইত্যা। এ গেরামে কেমন কইরা থাহে। অত্যন্ত রেগে গেলেও একেবারে হুঁশ হারাননি রহিম সর্দার। কাজীর ছেলে রশিদের নামটা অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে গেলেন তিনি। কাজী বাড়ি কুটুম বাড়ি, বেয়াই বেয়াই সম্পর্ক, তাই।

 

পীর সাহেবের নূরানি সুরত দেখে গাঁয়ের ছেলে বুড়োরা অবাক হল। আহা! এমন যার সুরত, গুণ তার কত বড়, কে জানে। ভক্তি সহকারে পীর সাহেবের পায়ের ধুলো নিল সবাই। গরীব মানুষ হুজুর। মইরা গেলাম, বাঁচান। হুজুরের পা জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন জমির ব্যাপারি। জমির ব্যাপারি বোকা নন। বোঝেন সব। খোদার মন টলাতে হলে আগে পীর সাহেবের মন গলাতে হবে। পীর সাহেবের মন গললে এ হতভাগাদের জন্যে খোদার কাছে প্রার্থনা করবেন তিনি। তারপরেই না খোদা মুখ তুলে তাকাবেন ওদের দিকে।

পীর সাহেব এসে পৌঁছলেন সকালে। আর ঘটা করে বৃষ্টি নামল বিকেলে।

বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সারাটা বিকেল বৃষ্টি হল। সারা রাত চলল তার একটানা ঝপঝপ ঝনঝন শব্দ। সকালেও তার বিরাম নেই।

প্রতিবছর এ সময়ে শ্রাবণ মাসের ‘ডাওর’। কেউ কেউ বলে বুড়ো বুড়ির ‘ডাওর’। এই ডাওরের আয়ুষ্কাল পনের দিন। এ পনের দিন একটানা ঝড় বৃষ্টি হবে। জোরে বাতাস বইবে। বাতাস যদি বেশি থাকে আর অমাবস্যা কি পূর্ণিমার জোয়ারের যদি নাগাল পায় তাহলে সর্বনাশ। নির্ঘাত বন্যা।

‘খোদা রক্ষা কর। রক্ষা কর খোদা। রহম কর এই অধমগুলোর উপর। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন জমির ব্যাপারি। মনে মনে মানত করলেন। যদি ফসল নষ্ট না হয় তাহলে হালের গরু জোড়া পীর সাহেবকে ভেট দেবেন তিনি।

গম্ভীর পীর সাহেব ঢুলে ঢুলে তছবি পড়েন আর খোদার মহিমা বর্ণনা করেন সবার কাছে। খোদার মহিমা বর্ণনা শেষ হলে পীর সাহেবের মহিমা বর্ণনা প্রসঙ্গে অসংখ্য আজগুবি ঘটনার অবতারণা করেন তাঁর সাগরেদরা।

মনে আশা জাগে চাষীদের। আনন্দে চকচক করে ওঠে কোটরে ঢোকা চোখগুলো। ভিড়ের মাঝ থেকে গনি মোল্লা ফিসফিসিয়ে বললেন, কই, কই মনার পো? এই পীর যেই সেই পীর নয়। খোদার খাস পীর।

কথাটা মিনু পাটারির কানে যেতে গদ্গদ হয়ে বলল সে, শুন নাই তোমরা? সেইবার এক বাঁজা মাইয়া পোলারে এক তাবিজে পোয়াতি বানাইয়া দিছিলেন তিনি। শুন নাই?

যারা শুনেছে তারা মাথা নেড়ে সায় দিল, হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। আর যারা শোনেনি তারাও সেই মুহূর্তে বিশ্বাস করল কথাটা। পীর সাহেব সব পারেন। ইচ্ছে করলে এই ঝড় বৃষ্টিটাকে এই মুহূর্তে থামিয়ে দিতে পারেন তিনি। কিন্তু, থামাচ্ছেন না প্রয়োজনবোধে থামাবেন তাই।

কিন্তু, মতি মাস্টার বিশ্বাস করল না কথাটা। হেসে উড়িয়ে দিল। বলল, ঝড় থামাবে ওই বুড়োটি। মন্তর পড়ে ঝড় থামাবে?

হ্যাঁ, থামাবে, আলবৎ থামাবে। আকাশভেদী হুংকার ছাড়লেন গনি মোল্লা। চোখ রাঙিয়ে ফতোয়া দিলেন। এই নাফরমান বেদীনগুলো গাঁয়ে আছে দেইখাই তো গাঁয়ের এই দুরবস্থা।

হ্যাঁ, ঠিক কইছ মোল্লার পো। তাঁকে সমর্থন করলেন বুড়ো তিনজী মিঞা। এই কাফেরগুলারে গাঁ থাইকা না তাড়াইলে গাঁয়ের শান্তি নাই। কিন্তু গাঁয়ের শান্তি রক্ষার চাইতে ‘ঢল’ রোখাটাই এখন বড় প্রশ্ন। প্রকৃতি উন্মাদ হয়ে পড়েছে। ক্ষুব্ধ বাতাস বার বার সাবধান করছে। ঢল হইবো, ঢল। পানি ভরা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনজী মিঞা। রক্ত দিয়ে বোনা সোনার ফসল!

হায়রে ফসল!

হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠেন তিনি, খোদা!

মসজিদে আজান পড়ছে। পীর সাহেব ডাকছেন সবাইকে। এস মিলাদ পড়তে এস। এস মঙ্গলের জন্য এস।

টুপিটাকে মাথায় চড়িয়ে বৃষ্টির ভেতর ভিজে ভিজেই মসজিদের দিকে ছুট দিলেন জমির ব্যাপারি। যাবার সময় ঘরের বৌ-ঝিদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন, এ রাত ঘুমাইবার রাত নয়। বুঝলা? অজু কইরা বইসা খোদারে ডাক।

অজুটা সেরে উঠে দাঁড়াতেই কার একটা হাত এসে পড়ল ছকু মুন্সির কাঁধের উপর। জমির মুন্সির ছেলে ছকু মুন্সি। গাঁট্টাগোট্টা জোয়ান মানুষ। প্রথমটায় ভয়ে আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল কে?

ভয় নাই আমি মতি মাস্টার।

ব্যাপার কি? এ রাত্তির বেলা? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ছকু।

মতি মাস্টার বলল যাস কনহানে?

যাই মসজিদে। ছকু জবাব দিল। ক্যান তোমরা যাইবা না?

না। স্বল্প থেমে মতি মাস্টার বলল, এক কাজ কর ছকু। মসজিদে যাওয়া এহন রাখ। ঘর থাইকা কোদাল নিয়া বাইর অইয়া আয়। যা জলদি কর।

কোদাল দিয়া কি অইবো? রীতিমত ঘাবড়ে গেল ছকু মুন্সি।

যা ছকা। কোদাল আন। পেছন থেকে বললো মস্তু শেখ।

এতক্ষণ পুরো দলটার দিকে চোখ পড়লো ছকু মুন্সির। একজন দু’জন নয়, অনেক অন্তত পঞ্চাশেক হবে। সবার হাতে কোদাল আর ঝুড়ি। মতি মাস্টার এত লোক জোটালো কেমন করে? কাজী বাড়ির পড়ুয়া ছেলে রশিদকে দলের মধ্যে দেখে আরো একটু অবাক হল ছকু।

ব্যাপারটা অনেক দূর আঁচ করতে পারল সে। গতকাল এ নিয়েই কাজী পাড়ায় বুড়ো কাজীর সঙ্গে তর্ক করছিল মতি মাস্টার। গত কয়েক বছর কি খোদারে ডাকেন নাই আপনারা? হ্যাঁ, ডাকছিলেন। কিন্তু ফল কি হয়েছে? ফসল কি বাঁচছে আপনাগো? বাঁচে নাই। তাই কইতে আছলাম কেবল বইসা বইসা খোদারে ডাকলে চলবো না। এ কয়টা গাঁয়ে মানুষ তো আমরা কম নই। সবাই মিলে বাঁধটারে যদি পাহারা দিই, সাধ্য কি বাঁধ ভাঙে?

মতি মাস্টারের কথা শুনে দাঁত-খিঁচিয়ে তেড়ে এসেছিলেন বুড়ো কাজী। অশ্রাব্য গালি গালাজ করেছিলেন তাকে! সে কাল বিকেলের কথা। মসজিদে আজান হচ্ছে। পীর সাহেব ডাকছেন সবাইকে, এস, মিলাদ পড়তে এস। এস, মঙ্গলের জন্য এস।

সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল ছকু। তারপর টুপিটাকে মাথায় চড়িয়ে মসজিদের দিকে পা বাড়ালো সে । খপ করে ওর একখানা হাত চেপে ধরলো রশিদ, ছকু।

এই ছকা। ক্ষেপে উঠলো পণ্ডিত বাড়ির চাঁদু।

অগত্যা, কোদাল আর ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে এলো ছকু মুন্সি।

মাইল খানেক হাঁটতে হবে ওদের, তারপর বাঁধ।

নবীন কবিরাজের পুকুর পাড়ে এসে পৌঁছতেই জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠে। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল একটা।

ভয়ে আঁতকে উঠে থমকে দাঁড়ালো ছকু। খোদা সাবধান করছে তাদের। খবরদার যাইও না।

যাইও না মাস্টার। থামো, থামো। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো ছকু মুন্সি। খোদা নারাজ হইবো, মসজিদে চল সবাই।

ইস, চুপ কর ছকু। বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছে মতি মাস্টার। এখন কথা কবার সময় না। জলদি চল। আবার চলতে শুরু করলো ওরা।

দূরে মসজিদ থেকে দরুদের শব্দ ভেসে আসছে। পীর সাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দরূদ পড়ছে তিনজী মিঞা, জমির ব্যাপারি, রহিম সর্দার ও আরো কয়েকশ জোয়ান মানুষ। অসহায়ের মতো ঊর্ধ্বে হাত তুলে চিৎকার করছে তারা। হে আসমান জমিনের মালিক, হে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা, হে রহমানের রহিম! তুমিই সব! তুমি রক্ষা কর আমাদের।

ওদিকে মরিয়া হয়ে কোদাল চালাচ্ছে মতি মাস্টারের দল। এ বাঁধ ভাঙতে দেবে না তারা। কিছুতেই না।

তাদের সোনার ফসল ডুবতে দেবে না তারা। কখনই না।

ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ আকাশে বিদ্যুৎ চমকিয়ে বাজ পড়ছে। সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস বইছে। খরস্রোতা নদী ফুলে ফেঁপে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। অমাবস্যার জোয়ার। নির্ঘাত বাঁধ ভেঙে পড়বে।

হায় খোদা! ঘরের বৌ-ঝিয়ের, করুণ আর্তনাদ করে ফরিয়াদ জানায় আকাশের দিকে চেয়ে। দুনিয়াতে ইমান বলে কিছু নেই তাই তো খোদা রাগ করেছেন। মানুষ গোরু সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন তিনি। ধ্বংস করে দেবেন এই পৃথিবীটাকে, পাপে ভরা এই পৃথিবী।

দুরু দুরু বুক কাঁপছে তিনজী মিঞার। চোখের জলে ভাসছেন জমির ব্যাপারি আর ঢুলে ঢুলে তছবি পড়ছেন।

হায়রে ফসল!

সোনার ফসল!

এ ফসল নষ্ট হতে পারে না। টর্চ হাতে ছুটোছুটি করছে মতি মাস্টার। কোদাল চালাও। আরো জোরে!

বাঁধে ফাটল ধরেছে।

এ ফাটল বন্ধ করতেই হবে।

অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে কোদাল চালাচ্ছে ওরা।

মন্তু শেখ চিৎকার করে বললে, আলির নাম নাও ভাইরা, আলির নাম নাও।

আলির নামে কাম হইবো শেখের পো? বললে বুড়ো কেরামত।

তারচে একডা গান গাও। গায়ে জোস আইবো।

মন্তু শেখ গান ধরলো।

গানের শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ বাজ পড়লো একটা কাছেই কোথায়।

কোদাল চালাতে চালাতে মতি মাস্টারকে আর তার চৌদ্দ পুরুষকে মনে মনে গাল দিতে লাগলো ছকু মুন্সি, খোদার সঙ্গে লাঠালাঠি। হা-খোদা, এই কি জমানা আইছে। খোদা, এই অধমের কোন দোষ নাই। এই অধমেরে মাপ কইরা দিও।

ঝুড়ি মাথায় বিড়বিড় করে উঠলো পণ্ডিত বাড়ির চাঁদু, হাত পা গুটাইয়া মসজিদে বইসা বইসা ঢল রুখবো না আমার মাথা রুখবো। তারপর হঠাৎ এক সময়ে মতি মাস্টারের গলার শব্দ শোনা গেল, আর ভয় নাই চাঁদ। আর ভয় নাই । এবার তোরা একটু জিরাইয়া নে!

এতক্ষণে হাসি ফুটলো সবার মুখে। শান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁধের ওপর এলিয়ে পড়লো অবশ দেহগুলো। পঞ্চাশটি ক্লান্ত মানুষ। সূর্য তখন পূর্ব আকাশে উঁকি মারছে।

আধ আলো অন্ধকার আকাশ বেয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। মৃদুমন্দ বাতাসের তালে তালে নাচছে সোনালি ফসল। মসজিদ থেকে বেরিয়ে হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়তে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো জমির বেপারি। ডোবেনি ডোবেনি। ফসল তাদের ডোবেনি, ডুবতে দেননি পীর সাহেব।

খুশিতে চক্‌চক্‌ করে উঠলো জমির মুন্সির চোখ দুটো। দৌড়ে এসে পীর সাহেবের পায়ে চুমো খেলেন গনি মোল্লা। ডোবেনি ডোবেনি। ফসল তাদের ডোবেনি ডুবতে দেননি পীর সাহেব।

এক মুহূর্তে যেন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সমস্ত গাঁ-টা। ছেলে বুড়ো সবাই হুমড়ি খেয়ে খেয়ে আসছে পীর সাহেবের পায়ে চুমো খাবার জন্য।

ঘুম চোখে তখনও ঢুলছেন পীর সাহেব। স্বল্প হেসে বললেন, খোদার কুদরতের শান কে বলতে পারে।

সাগরেদরা সমস্বরে বলে উঠলো, সারারাত না ঘুমাইয়া খোদারে ডাকছেন আমাগো পীর সাব। বাঁধ ভাঙ্গে সাধ্য কি?

পীর সাহেব তখনো হাসছেন। স্বল্প পরিমিত হাসি আপেলের রক্তিমাভার মতো ফেটে ছড়িয়ে পড়ছে মুখের সর্বত্র।

Leave a Reply