সরু গলিটা জুড়ে ধীরে ধীরে এগুতে লাগলো রিক্সাটা। কিছুদূর এলে, মরিয়ম বললো, এবার নামতে হবে লিলি। সামানে আর রিক্সা যাবে না। বলতে বলতে রিক্সা থেকে নেমে পড়লো সে। তার পিছু পিছু লিলিও নামল নিচে।
চারপাশে নোঙরা আবর্জনা ছড়ানো। কলার খোসা, মাছের আমিষ, মরা ইঁদুর, বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পায়খানা–সব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। দুর্গন্ধে এক-মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
আঁচলে নাক ঢেকে লিলি বললো, আর কতদূর?
এই তো আর অল্প একটু–বলে সামনে হাত দিয়ে দেখালো মরিয়ম।
এদিকে গলিটা আরো সরু হয়ে গেছে। একজনের বেশি লোক পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারে না। মরিয়ম আগে লিলিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে। নাকে ওর শাড়ি দিতে হয় নি, রোজ দুবেলা এ পথে আসা যাওয়া করতে করতে এসব দুর্গন্ধ ওর নাক-সহ্য হয়ে গেছে। আরো খানিকটা পথ হেঁটে এসে একটা আস্তর-ওঠা লাল দালানের সামনে দাঁড়ালো মরিয়ম।
লিলি বললো, এটা বুঝি তোমাদের বাসা?
মরিয়ম মাথা নেড়ে সায় দিলো, হ্যাঁ।
দোরগোড়ায় একটা নেড়ি কুকুর বসে বসে গা চুলকাচ্ছিলো।
ওদের দেখে এক পাশে সরে গেলো সে। এতক্ষণে নাকের উপর চেপে রাখা আঁচলটা নামিয়ে নিলো লিলি।
দরজাটা পেরুলে একটা সরু বারান্দা। দুপাশে দুটো কামরা। একটিতে মাহমুদ থাকে। আরেকটিতে মরিয়ম আর হাসিনা। বারান্দার শেষ প্রান্তে আরো একটি কামরা আছে। ওটাতে মা আর বাবা থাকেন। দুলু আর খোকনও থাকে ওখানে। ও ঘরটার পেছনে পাকঘর আর কুয়োতলা। কুয়োতলায় যেতে হলে মা-বাবার কামরার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অন্য কোন পথ নেই।
ভেতরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলো লিলি।
মরিয়ম বললো, এসো।
ওর নিজের কামরাটায় লিলিকে এনে বসালো মরিয়ম। একপাশে চওড়া একখানা চৌকির ওপর বিছানা পাতা। দুটো বালিশ পাশাপাশি সাজানো। একটা হাসিনার আর একটা মরিয়মের। দেয়ালে ঝোলান আলনার সাথে তাদের কাপড়গুলো সুন্দর করে গোছানো। তার নিচে একটা কেরোসিন কাঠের টেবিল। টেবিলে বই-খাতা রাখা। আর কোন আসবাব নেই ঘরে। আছে একটা মাদুর। ওটা মেঝেতে বিছিয়ে পড়ে ওরা।
বিছানার ওপর এসে বসলো লিলি, এটা বুঝি তোমার ঘর?
হাতের বই-খাতাগুলো টেবিলের ওপর রেখে মরিয়ম জবাব দিলো, হ্যাঁ, হাসিনা আর আমি থাকি এখানে।
এ ঘরে অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে দুলু এসে উঁকি মারছিলো ভেতরে। ওকে দেখে মরিয়ম বললো, দুলু, মা কোথায় রে?
দুলু ভাঙ্গা গলায় বললো, পাকঘরে।
মরিয়ম বললো, আমার ছোট বোন দুলু, সবার ছোট ও।
লিলি কাছে ডাকলো ওকে, এস, এদিকে এস।
ওর ডাক শুনে গুটিগুটি পায়ে পিছিয়ে গেলো দুলু। তারপর ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো সে।
মরিয়ম বললো, তুমি বসো লিলি, আমি এক্ষুণি আসছি। বলে আলনা থেকে গামছাটা নামিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে।
মায়ের ঘরটা খালি। বাবা অফিস থেকে ফেরেন নি এখনো। খোকন আর হাসিনা স্কুলে। মাহমুদ বোধ হয় এখনো ঘুমুচ্ছে ওর ঘরে। সারা রাত ডিউটি দিয়ে এসে সারাদিন ঘুমোয় ও।
কুয়ো থেকে এক বালতি পানি তুলে, মুখ হাত ধোবার জন্যে কাপড়টা গুটিয়ে নিয়ে ভালো করে বসলো মরিয়ম।
পাকঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে মা শুধালেন, কে এসেছে রে মরিয়ম?
মরিয়ম মুখে পানি ছিটোতে ছিটোতে জবাব দিলো, আমার এক বান্ধবী।
মা জানতে চাইলেন, এক সঙ্গে পড়তো বুঝি?
মরিয়ম বললো, হ্যাঁ।
মা আর কোন প্রশ্ন করলেন না। ভাতগুলো মজে এসেছে, এখনি নামিয়ে ফেন ঢালতে হবে। তারপর জলের কড়াটা চড়িয়ে দিতে হবে চুলোর উপর। মরিয়ম পাকঘরে এসে ঝুঁকে পড়ে বললো, এক কাপ চা দিতে পারবে, মা?
সালেহা বিবি বললেন, দেখি, চা পাতা আছে কিনা, বলে চুলোর পেছনে রাখা কৌটোগুলোর দিকে হাত বাড়ালেন তিনি। অনেকগুলো কৌটা রাখা আছে সেখানে। কোনটাতে মরিচ, কোনটায় হলুদ, রসুন কিংবা পেয়াজ। মাঝখান থেকে একটা তুলে নিয়ে খুলে দেখলেন সালেহা বিবি। তারপর বললেন, দুকাপ আন্দাজ আছে। তুই যা আমি করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। হঠাৎ কি মনে হতে পেছন থেকে তাকে আবার ডাকলেন সালেহা বিবি, শুধু চা দেবো?
কিছু আছে কি? মরিয়ম প্রশ্ন করলো, থাকলে দাও।
মা ঘাড় নাড়লেন, নেই। থাকবার কি উপায় আছে ওই দুলু আর খোকনটার জন্যে। কাল মাহমুদ কিছু বিস্কুট এনেছিলো, সাধ্য কি যে লুকিয়ে রাখবো। আজ সকালে বের করে দুজনে খেয়ে ফেলেছে।
‘যদি পার, বাইরে থেকে কিছু আনিয়ে দিও মা।’ যাবার সময় বলে গেলো মরিয়ম। মায়ের ঘর থেকে সে শুনতে পেলো, ও ঘরে কার সঙ্গে কথা বলছে লিলি। বোধ হয় হাসিনা ফিরেছে স্কুল থেকে। বাংলাবাজারে পড়ে সে ক্লাস এইটে। লম্বা দোহারা গড়ন। রঙটা শ্যামলা। সরু নাক। মুখটা একটু লম্বাটে ধরনের। বাড়ির অন্য সবার চেয়ে চেহারা একটু ভিন্ন রকমের ওর। চোখ জোড়া বড় হলেও তার মণিগুলো কটা কটা। বাঁ চোখের নিচে একটা সরু কাটা দাগ। ছোটবেলায় দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে বঁটির ওপর পড়ে গিয়ে কেটে গিয়েছিলো। সে চিহ্নটা এখনো মুছে যায় নি।
এ ঘরে এসে মরিয়ম দেখলো লিলির পাশে বসে গল্প জমিয়েছে হাসিনা। আপনার শাড়িটা কত দিয়ে কিনেছেন?
লিলি বললো, মনে নেই, বোধ হয় আঠারো টাকা।
হাসিনা বললো, কি সুন্দর, আমিও কিনবো একখানা। কোত্থেকে কিনেছেন আপনি?
লিলি জবাব দিলো নিউ মার্কেট থেকে।
হাসিনা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শাড়িটা দেখতে লাগলো। ওর ওই স্বভাব- কারো পরনে একটা ভালো শাড়ি কিংবা ব্লাউজ দেখলে অমনি তার দাম এবং প্রাপ্তিস্থান জানতে চাইবে এবং সেটা কেনার জন্য বায়না ধরবে। কিনে না দিলে কেঁদেকেটে একাকার করবে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রাখবে হাসিনা। মরিয়ম এসে বললো, ওর সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে কি লিলি ও আমার ছোট বোন হাসিনা।
লিলি হেসে বললো, নতুন করে পরিচয় দিতে হবে না, ও নিজেই আলাপ করে নিয়েছে।
হাসিনা বললো, আপার কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। বলে হঠাৎ কি মনে হতে ওর দিকে ঘুরে বসে সে আবার বললো, আচ্ছা আপনি বলুন তো, আপা সুন্দর না আমি সুন্দর। ওর প্রশ্ন শুনে হেসে দিলো লিলি। মরিয়ম বললো, নতুন কেউ এলেই ওই এক প্রশ্ন ওর–আপা সুন্দর, না আমি সুন্দর।
ক-দিন বলেছি তুমি সুন্দর, তুমি সুন্দর, আমি কুৎসিত, হলো তো?
গলার স্বর শুনে মনে হলো ও রাগ করেছে। আসলে মনে মনে হাসছে মরিয়ম। কারণ সে জানে যে, হাসিনার চেয়ে ও অনেক বেশি সুন্দর। রঙটা ওর ফর্সা, ধবধবে। মায়ের দেহ-লাবণ্যের উত্তরাধিকারী হয়েছে সে। চেহারাটাও মায়ের মত সুশ্রী। আর চোখজোড়া খুব বড় না হলেও হাসিনার মত কটা নয়।
মা বলেন, ও ঠিক আমার মত হয়েছে, স্বভাবটাও আমারই পেয়েছে সে, আর তোরা হয়েছিস তোদের বাবার মত ছন্নছাড়া।
এ নিয়ে রোজ মায়ের সঙ্গে ঝগড়া বাধায় হাসিনা। বলে, তুমি তো সব সময় ওর প্রশংসাই করো, আমরা যেন কিছু না।
শুনে মা হাসেন।
লিলিও হাসলো আজ। হেসে বললো, মরিয়ম ঠিকই বলেছে। ও দেখতে কুৎসিত। তুমি ওর চেয়ে অনেক সুন্দর হাসিনা।
শুনে হাসিনা বড় খুশি হলো। লিকলিকে বেণিজোড়া দুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বললো, আপনি বসুন, আমি এক্ষুণি আপনার জন্য চা বানিয়ে আনছি। বলে ঘর থেকে বেরুতে যাবে এমন সময় বারান্দায় মাহমুদের তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেলো, ক’দিন বলেছি আমার বইপত্র ঘাঁটাঘাটি করিস নে, তবু রোজ তাই করবি। এরপর আমি তোকে মাথার ওপরে তুলে আছাড় মারবো হাসিনা।
হাসিনার খোঁজে এ ঘরে এসে মুহূর্তে চুপসে গেলো মাহমুদ। লিলির দিকে অপ্রস্তুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো সে। তারপর যেমন হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলো, তেমনি দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
ও চলে যেতে আঁচলে মুখ চেপে ঘরময় লুটোপুটি খেলো হাসিনা। মরিয়ম ধমকের সুরে বললো, আবার হাসছে দেখ না, লজ্জা-শরম বলে কিছু যদি থাকতো। ক’দিন দাদা নিষেধ করে দিয়েছে ওর বইপত্র না ঘটতে তবু– কথাটা শেষ করলো না মরিয়ম।
একদিন মাহমুদের বই ঘাঁটতে গিয়ে একটা এক টাকার নোট পেয়েছিলো হাসিনা। আরেক দিন একটা আট আনি। সেদিন থেকে যখনি মাহমুদ বাইরে বেরিয়ে যায় তখনি ওর বইপত্র ওলটায় গিয়ে সে। মরিয়মের ধমক খেয়ে চুপ করে গেলো হাসিনা। পরক্ষণে কি মনে হতে লিলির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো, আপনার ক্যামেরা আছে লিলি আপা?
লিলি বললো, কেন ক্যামেরা দিয়ে কি করবে তুমি?
হাসিনা বললো, ছবি তুলবো।
তাই নাকি? লিলি মৃদু হেসে বললো, না ভাই, ক্যামেরা আমার নেই। বিমর্ষ হয়ে লিলির জন্য চা আনতে গেলো হাসিনা।
একটা পিরিচে দুটো সন্দেশ আর দুটো রসগোল্লা। পাশে রাখা দুকাপ গরম চা। দেখে চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো হাসিনার। নাচের তালে জোড় ঘুরনী দিয়ে টুপ করে বসে পড়লো সে, মা আমি একটা খাবো। বলে এক মুহূর্তও দেরি না করে পিরিচ থেকে একটা রসগোল্লা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলো সে।
সালেহা বিবি কড়াইতে পানি ঢেলে ডাল চড়াচ্ছিলেন, পেছনে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি–ওকি হচ্ছে, ওকি হচ্ছে হাসিনা।
রসগোল্লাটা গিলে ফেলে হাসিনা বললো, অমন করছো কেন, একটা তো খেয়েছি, আরো তিনটে আছে।
সালেহা বিবির ইচ্ছে হলো চুলের গোছা ধরে মুখে একটা চড় বসিয়ে দিতে ওর, শুধু তিনটে ইয়ে মেহমানের সামনে কেমন করে দেয়, অ্যাঁ? তোদের নিয়ে আর পারি নে আমি। খাওয়ার জন্য এত হা-হা কেন তোদের, রসগোল্লা কি দেখিস নি জীবনে?
মায়ের ভর্ৎসনা শুনে মুখ কালো করলো হাসিনা। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো ওর। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমায় যে তুমি দেখতে পারো না তা আমি জানি। আপার মেহমান এসেছে বলে আজ মিষ্টি আনিয়েছো। আমার কেউ এলে এক কাপ চা-ও দিতে না।
আঁচলে চোখ মুছে ধুপধাপ শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলো সে। এখন ছাদে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে হাসিনা।
শুধু একটা সন্দেশ খেলো লিলি।
দুলু এসে উঁকি দিচ্ছিলো দোর গোড়ায়। তার হাতে একটা সন্দেশ তুলে দিলো সে। অবশিষ্ট একটা রসগোলা পড়ে রইলো প্লেটের ওপর। সালেহা বিবি অনুরোধ করলেন, কি হাত তুলে বসে রইলে যে, ওটা খেয়ে নাও।
লিলি বললো, না, আর খাবো না। মিষ্টি বেশি খাই নে আমি। মরিয়ম তুমি খাও। হাসিনা গেলো কোথায়?
মরিয়ম কিছু বলার আগে সালেহা বিবি জবাব দিলেন, কোথায়, ছাদে গিয়ে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছে। বলে আর সেখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলেন না তিনি। চুলোর ওপর ডাল চড়িয়ে এসেছেন সে কথা মনে পড়তে দুলুর হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন সালেহা বিবি। দুলুর চোখজোড়া তখনো পিরিচে অসহায়ভাবে পড়ে থাকা রসগোল্লাটার দিকে নিবদ্ধ ছিলো। যাবার পথেও বার কয়েক সেদিকে তাকিয়ে গেলো সে।
শহরে সন্ধ্যা নামার অনেক আগে এখানে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বাইরে যখন বিকেল এ গলিতে তখন রাত। আর বাইরে যখন ভোর হয় তখনো এ গলিতে তমসায় ঢাকা থাকে। অনেক বাধা ডিঙিয়ে, অনেক প্রাসাদের চুড়ো পেরিয়ে তবে এখানে প্রবেশের অধিকার পায় সূর্য। এ পাড়ার বাসিন্দাদের বড় সাধনার ধন সে। তাই বেলা দুপুরে যখন এক চিলতে রোদ এসে পড়ে এই হীন দালানগুলোর ওপর তখন তার বাসিন্দারা বড় চঞ্চল হয়ে উঠে। ভিজে কাপড়-চোপড়গুলো রোদে বিছিয়ে দেয় তারা। খানিক পরে ধীরে ধীরে আবার সূর্যটা নেমে যায় পশ্চিমে। কে যেন জোর করে টেনে নিয়ে যায় তাকে। তখন এখানে অন্ধকার। অন্ধকার শুধু। বাইরে চোখ পড়তে লিলি বললো, চলো, এবার উঠা যাক মরিয়ম, রাত হয়ে এলো। মরিয়ম বললো, একটু বসো, মাকে বলে আসি।
গলির মাথায় এসে লিলিকে বিদায় দিলো মরিয়ম। ও বাসায় যাবে এখন। মরিয়ম যাবে নারিন্দায়, ছাত্রী পড়াতে। রিক্সায় উঠে লিলি বললো, কাল আবার দেখা হবে ম্যারি।
আদর করে মাঝে মাঝে মরিয়মকে ম্যারি বলে সম্বোধন করে সে।
ও চলে গেলে কিছুক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে রইল মরিয়ম। তারপর মাথার ওপরের কাপড়টা আরো একটু টেনে দিয়ে রাস্তার পাশ ধরে এগিয়ে গেলো সে।
রোজ পায়ে হেঁটে ছাত্রীর বাড়ি যায় মরিয়ম।
পায়ে হেঁটে ফিরে আসে।
রিক্সায় যদি আসা-যাওয়া করে তাহলে হিসেব করে দেখেছে সে যা পায় তার অর্ধেকটা ব্যয় হয়ে যায়। তাছাড়া হাঁটতে যে খুব খারাপ লাগে ওর, তা নয়। মাসের শেষে ত্ৰিশটা টাকা পাওয়ার আনন্দ হাঁটার ক্লান্তির চেয়ে অনেক বেশি অনেক সুখপ্রদ।
দুপাশের দোকানপাট, লোকজন দেখতে দেখতে এমনি পায়ে চলার পথে অনেক কিছু ভাবে মরিয়ম। বাবার কথা। মায়ের কথা। মাহমুদের কথা। আর নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই বিপর্যয়ের কথা। অনেক কিছু ভাবে মরিয়ম। ইদানীং সেলিনার বড় বোনের দেবর মনসুরের কথাও মাঝে মাঝে ভাবনার মধ্যে এসে যায়। সেলিনা ওর ছাত্রীর নাম।
মনসুর আজকাল বড় বেশি আসা-যাওয়া করছে ওদের বাসায়। প্রায় বিকেলেই আসে। বিশেষ করে মরিয়ম যখন সেলিনাকে পড়াতে যায় তখন। মরিয়ম ভাবে এবার থেকে লোকটা এলে তার সাথে আর কথা বলবে না সে। কে জানে মনে কী আছে লোকটার। কোন বদ উদ্দেশ্যও তো থাকতে পারে। মানুষের মনের খবর জানা সহজ নয়। জাহেদকে কত কাছ থেকে দেখেছিলো মরিয়ম তবুও কি তার মনের গোপন কথাটি জানতে পেরেছিলো কোনদিন? যদি এক মুহূর্ত আগেও জানতে পারতো তাহলে এমন একটা বিপর্যয় ঘটতে দিতো না মরিয়ম।
দোরগোড়ায় পা দিতেই ভেতরে মনসুরের গলার স্বর শোনা গেলো।
আজ আগে থেকেই এসে বসে আছে লোকটা।
ওর সামনে দিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে চলে এলো মরিয়ম।
সোজা সেলিনার ঘরে।
ওর ঘরটা বড় সুন্দর করে সাজানো আর বেশ পরিপাটি। একপাশে নতুন কেনা একখানা খাটের উপর সেলিনার বিছানা। নীল রঙের একখানা বেড কভার দিয়ে ঢাকা। মাথার কাছে একটা গোল টিপয়, তার উপর ফুলদানিতে বহু বর্ণের ফুল সাজানো। দেখে মনে হয় তাজা ফুল। আসলে কাগজের তৈরি।
দেয়ালে কয়েকখানা ছবি টাঙ্গানো। কোন এক শিল্পীর আঁকা একখানা পোট্রেট।
এ ঘরে ছিলো না সেলিনা। খবর পেয়ে এসে কপালে হাতের তালু ঠেকিয়ে বললো, আজ পড়বো না আপা, শরীরটা ভালো লাগছে না।
মরিয়ম সহানুভূতির সাথে বললো, কি হয়েছে?
ধপ করে বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে সেলিনা জবাব দিলো, মাথাটা ভীষণ ধরেছে আপা।
মরিয়ম জানে এটা মিথ্যে কথা। যেদিন পড়ায় ফাঁকি দেবার ইচ্ছে থাকে সেদিন একটা কিছু ছুতো বের করে বসে সেলিনা। কোনদিন মাথা ব্যথা। কোনদিন পেট কামড়। কোনদিন বমি বমি ভাব। মরিয়ম কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, সত্যি তোমার মাথা ব্যথা করছে সেলিনা?
সেলিনা পাশ ফিরে শুয়ে বললো, তুমি সব সময় আমায় সন্দেহ কর আপা।
মরিয়ম বললো, এতদূর হেঁটে এসে না পড়িয়ে ফিরে যেতে আমার খারাপ লাগে কিনা, তাই।
ওই যা, হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সেলিনা, তুমি বসো আপা, আমি এক্ষুণি আসছি। বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো সে। খানিকক্ষণ পরে আবার ফিরে এলো। হাতে তিনখানা দশ টাকার নোট। মরিয়মের হাতে নোটগুলো গুঁজে দিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো সেলিনা, সত্যি বলছি আপা, মাথাটা আজ ভীষণ ধরেছে।
মরিয়ম জানে হাজার বুঝালেও, ওকে আর এখন পড়াতে বসানো যাবে না। এখানে বুঝি হাসিনার সঙ্গে মিল আছে ওর। হাসিনাও এমনি ফাঁকি দেয় লেখাপড়ায়। গালাগাল করেও বইয়ের সামনে বসানো যায় না। এঘর থেকে ওঘরে পালিয়ে বেড়ায়। ছাদে গিয়ে বসে থাকে।
বাবা বলেন, ছোট বেলায় তোমরাও এমন ছিলে। এখনও কম বয়স ওর, বুদ্ধি হয় নি, বুদ্ধি হলে তখন আর বকবিকি করতে হবে না; আপনা থেকেই পড়তে বসবে।
মা বলেন, ওর বুঝি অল্প বয়স? আসছে মাসে তেরো পেরিয়ে চৌদ্দয় পড়বে। ও বয়সে মরিয়মকে দেখি নি। ওকে পড়তে বলতে হতো? আসলে তুমি ওকে বড় বেশি লাই দিচ্ছো। দেখবে ওর কিছু হবে না জীবনে।
বাবা সব সময় হাসিনার পক্ষ নেন। মা মরিয়মের। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কথাই ভাবছিলো মরিয়ম।
সেলিনা জিজ্ঞেস করলো, কি ভাবছো আপা?
না, কিছু না। হাতের নোটগুলো ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়ে মরিয়ম বললো, তাহলে আমি চলি সেলিনা, তোমার মাকে বলো আমি এসেছিলাম। কাল আবার দেখা হবে, কেমন?
সেলিনা পাশ ফিরে শুয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো, আচ্ছা।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে পা বাড়াতে গতি যেন শ্লথ হয়ে এলো তার। বৈঠকখানা ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনসুর। লম্বা গড়ন। সরু দেহ। পরনে একটা ঢোলা পায়জামা আর গায়ে ঘি রঙের মিহি পাঞ্জাবি। পায়ের শব্দে ওর দিকে ফিরে তাকালো মনসুর। একেবারে ওর মুখোমুখি। চোখজোড়া মাটিতে নামিয়ে নিয়ে ওর পাশ কেটে চলে যাবে ভাবছিলো মরিয়ম।
একি এসেই ফিরে চললেন যে? চলার পথে তার প্রতিরোধ করলো মনসুর।
সেলিনা আজ পড়বে না। ছোট্ট উত্তরটা দিয়ে চলে যাচ্ছিলো মরিয়ম।
মনসুর বললো, চলুন আমিও যাবো ওপথে।
ওর নিজের তরফ থেকে কোন আমন্ত্রণ না জানালেও, কিছুদূর পিছুপিছু তারপর পাশাপাশি রাস্তায় নেমে এলো মনসুর।
আজ প্রথম নয়। এর আগেও এ ধরনের প্রস্তাব সে পেয়েছে মনসুরের কাছ থেকে। শুধু প্রস্তাব নয়, মরিয়মকে বাসার কাছাকাছি এগিয়ে দিয়েও গেছে সে।
মরিয়মের ভালো লাগে নি। বড় বিরক্তিকর মনে হয়েছে এই অনাহুত সঙ্গদান। কথাবার্তা যে খুব হয়েছে রাস্তায় তা নয়। একদিন জিজ্ঞেস করছিলো, মরিয়ম কোথায় থাকে। আর একদিন জানতে চেয়েছিলো, পরীক্ষা কেমন দিয়েছ মরিয়ম। এছাড়া এমনও দিন গেছে, যে দিন সারা পথ নীরবে হেটেছে ওরা। বাসার কাছাকাছি তেমাথায় এসে মনসুর বলেছে আচ্ছা আসি এবার। আপনি তো ও পথে যাবেন, আমি এ পথে। কিছুদূর গিয়ে লোকটা রিক্সা নিয়েছে তা ঠিক লক্ষ্য করেছে মরিয়ম। মরিয়ম জানে বেশ টাকা-পয়সা আছে লোকটার, রিক্সা কেন ইচ্ছা করলে মোটরে চড়ে চলাফেরা করতে পারে। তবু এ পথটা মরিয়মের সঙ্গে হেঁটে আসতো মনসুর।
রাস্তায় নেমে মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিলো মরিয়ম; কেন সে নিষেধ করলো না লোকটাকে? ইচ্ছে করলে তো মুখের ওপর জবাব দিতে পারতো। বলতে পারতো আপনি সঙ্গে আসুন তা পছন্দ হয় না আমার। দয়া করে আর পিছু নেবেন না। ইচ্ছে করলে আরো রূঢ় গলায় আসতে নিষেধ করতে পারতো মরিয়ম। তবু কেন, একটা কথাও বলতে পারলো না সে?