সকালের ডাকে আসা চিঠিখানা বারকয়েক নেড়েচেড়ে দেখলো লিলি। আঁকাবাঁকা অক্ষরে মাহমুদের নাম আর ঠিকানা লেখা। অপরিচিত হস্তাক্ষর।
দুপুরে সে বাসায় এলে লিলি বললো, তোমার চিঠি এসেছে একখানা। টেবিলের ওপর রাখা আছে।
খামটা ছিড়ে চিঠিখানা পড়লো মাহমুদ।
শাহাদাত লিখেছে ভৈরব থেকে।
মাহমুদ,
অনেক দিন তোমার কোন খোঁজ-খবর পাই নি। জানি না কেমন আছো। আজ বড় বিপদে পড়ে চিঠি লিখছি তোমাকে। জানি এ বিপদ থেকে তুমি কেন কেউ উদ্ধার করতে পারবে না আমায়। তবু মানসিক অশান্তির চরম মুহূর্তে নিজের দুঃখের কথা ব্যক্ত করার মতো তুমি ছাড়া আর কাউকে পেলাম না। তাই লিখছি।
আমেনার যক্ষ্মা হয়েছে।
ঢাকা থাকতেই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছিলো। এখন বোধ হয় তার শেষ দিন ঘনিয়ে এলো।
তুমি হয়তো অবাক হয়ে ভাবছো, এতদিন পরে এ খবরটা তোমাকে জানাতে গেলাম কেন। আসলে আমিও এ ব্যাপারে প্রায় অজ্ঞ ছিলাম। আমাকে সে কিছুতেই জানতে দেয় নি। মাঝে মাঝে লক্ষ করতাম, একটানা অনেকক্ষণ ধরে খক্খক করে কাশতো সে। বড় বেশি কাশতো। কখনো কখনো তার কাপড়ে রক্তের ছিটেফোটা দাগ দেখে প্রশ্ন করেছি। কিন্তু কোন উত্তর পাই নি। আবার, একদিন রাতে অকস্মাৎ রক্তবমি করতে করতে মুছা গেল সে। ডাক্তার ডাকলাম। রোগী দেখে তিনি ভীষণ গালাগাল দিলেন আমায়। বললো, তক্ষুনি ঢাকায় নিয়ে যেতে।
কিন্তু, আমেনা কিছুতে রাজী হলো না।
তার স্বভাব তোমার অজানা নয়।
একদিন ভাইদের অমতে সে বিয়ে করেছিলো আমায়। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো মাথা উঁচিয়ে। সেসব কথা তুমি জানো। ভাইদের কাছ থেকে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছিলো তাকে। আজ তাদের সামনে তিল তিল করে মরতে সে রাজী নয়। টাকা-পয়সার জন্যে হাত পাতবে এ কথা কল্পনাও করতে পারে না সে।
এদিকে আয় বড় কমে গেছে। দোকানের অবস্থা খুব ভালো নয়। লোকের হাতে টাকা নেই, চাহিদা থাকলেও জিনিসপত্র কিনবে কি দিয়ে?
জীবনে কিছুই করতে পারলাম না মাহমুদ।
আমেনার জন্যও যে এ মুহূর্তে কিছু করতে পারবো, ভরসা হয় না। সারাটা জীবন ও শুধু আমাকে দিয়ে গেলো। ওকে আমি কিছু দিতে পারলাম না। দোয়া করো, ওর সঙ্গে আমিও যেন কবরে যেতে পারি।
এ দুনিয়াতে এর চেয়ে বড় কোন চাওয়া কিংবা পাওয়া আর নেই আমার। ছেলে-মেয়েগুলোর জন্য মাঝে মাঝে ভাবনা হয়। খোদা দিযেছেন, খোদাই চালিয়ে নেবেন ওদের। এতক্ষণ শুধু নিজের কথা লিখলাম, কিছু মনো করো না।
তোমাদের দিনকাল কেমন চলছে জানিও। লিলি কেমন আছে? মিতাকে আমার চুম্বন দিয়ো।
তোমার শাহাদাত।
চিঠিখানা একবার পড়ে শেষ করে আবার পড়লো মাহমুদ। তারপর চোয়ালে হাত রেখে অনেকক্ষণ বসে বসে কিছু ভাবলো সে। মিতাকে কোলে নিয়ে লিলি এসে দাঁড়ালো পাশে। মৃদু গলায় শুধালো কার চিঠি ওটা?
মাহমুদ বললো, শাহাদাত লিখেছে।
লিলি জানতে চাইলো, ওরা ভালোতো?
মাহমুদ চিঠিখানা এগিয়ে দিলো ওর দিকে।
লিলির পড়া শেষ হলে মাহমুদ আস্তে করে বললো, আমাকে এক্ষণি আবার বেরুতে হচ্ছে লিলি।
এই বেলায় কোথায় যাবে? লিলি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।
মাহমুদ ধীর গলায় বললো, আমেনাকে এখানে নিয়ে আসার জন্যে একখানা টেলিগ্রাম করবো ভাবছি।
লিলির মুখখানা অকস্মাৎ স্নান হয়ে গেলো। ইতস্তত করে সে বললো, এখানে আনবে?
মাহমুদ লক্ষ করলো লিলি ভয় পেয়েছে। একটা যক্ষ্মা রোগীকে বাসায় আনা হবে, বিশেষ করে যে ঘরে একটি বাচ্চা মেয়ে রয়েছে সেখানে, ভাবতে আতঙ্ক বোধ করছে লিলি।
ওর খুব কাছে এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বললো, আমার যদি কোন কঠিন অসুখ হয় তাহলে কি আমাকে তুমি দূরে সরিয়ে দিতে পারবে লিলি? তবে ওর জন্যে তুমি ভয় করছো কেন?
লিলি গম্ভীর কষ্ঠে জবাব দিলো, ওটা যা ছোঁয়াচে রোগ-না, ওকে এখানে আনতে পারবে না তুমি। মিতাকে বুকের মধ্যে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরলে সে।
দেখো তোমাদের এ স্বভাবটা আমার একেবারে পছন্দ হয় না, সহসা রেগে উঠলো মাহমুদ সব সময় নিজেকে নিয়ে চিন্তা করো তোমরা। লিলির চোখে-মুখে কোন ভাবান্তর হলো না। মিতাকে কোলে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে।
মাহমুদ নীরব।
পায়ের শব্দে লিলি ফিরে তাকিয়ে দেখলো বাইরে বেরিয়ে গেল মাহমুদ। রাস্তায় নেমে, কাছের পোস্টাফিস থেকে শাহাদাতকে একখানা টেলিগ্রাম করে দিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে এলো মাহমুদ। এসে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পড়লো সে।
লিলি এখনও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাতের নখ খুঁটছে। মিতাকে সে একটু আগে শুইয়ে দিয়েছে তার দোলনায়।
ঈষৎ তন্দ্রায় চোখজোড়া জড়িয়ে আসছিলো মাহমুদের। লিলির ডাকে চোখ মেলে তাকালো সে।
লিলি কোমল কণ্ঠে ডাকলো, শুনছো?
মাহমুদ আস্তে শুধালো, কী?
আমি বলছিলাম কি, টেলিগ্রাম করে কি হবে, ওর কাছে এসে বসলো লিলি–তারচে, তুমি নিজে গিয়ে দেখে এসো ওকে।
লিলির কণ্ঠস্বরটা এখন সহানুভূতির সুরে ভরা।
মাহমুদ দুহাতে ওকে কাছে টেনে নিয়ে মৃদু স্বরে বললো, আমি জানতাম লিলি, তুমি ওকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না।
লিলি সলজ্জ হেসে ঘুমন্ত তার দিকে তাকালো এক পলক, কিছু বললো না। কাল মিতার জন্মদিন। রাতে শুয়ে শুয়ে সে ব্যাপারে আলোচনা করেছে ওরা। মাহমুদ বলেছে বেশি লোককে ডাকা চলবে না, ওতে অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য ক্ষুণ্ণ হয়।
ওর বাহুর উপর মাথা রেখে লিলি শুধিয়েছে, তুমি কাকে বলতে চাও?
মাহমুদ মৃদু স্বরে বলেছে, রফিককে বলবো, আর বলবো নঈমকে।
আমি মনসুরকে বলে দিয়েছে, বউকে সঙ্গে নিয়ে সে আসবে। লিলি আস্তে করে বলেছে, তসলিমকেও খবর দিয়েছি।
মাহমুদ সংক্ষেপে বলেছে, ঠিক আছে।
তারপর ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা।
ভোরে উঠে হাতমুখ ধুয়ে চা-নাস্তার পরে মাহমুদ যখন বেরুতে যাবে তখন লিলি স্মরণ করিয়ে দিলো, যাদের বলার আছে এই বেলা বলে এসো। আর শোন, ভৈরব কবে যাচ্ছো তুমি?
যাওয়ার পথে থামলো মাহমুদ। থেমে বললো, দেখি, কাল কিংবা পরশু যাবো। আমেনা যখন মেয়ে নিশ্চয় আসতে চাইবে না, টেলিগ্রামটা পেয়েছে কিনা কে জানে। কাটা কাটা কথাগুলো বলে রাস্তায় নেমে এলো সে।
জিন্নাহ এভিনুতে নতুন অফিস করেছে রফিক।
এখন আর অন্যের অধীনে কাজ করছে না, সে নিজস্ব কোম্পানি খুলেছে একটা। স্বাধীন ব্যবসা। বড় বড় কনট্রাক্ট পাচ্ছে আজকাল। রাস্তা মেরামত, বাড়ি ঘর তৈরি কিংবা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ইট, চুন, সুরকি ও লোহা-লক্কর সরবরাহের কনট্রাক্ট। প্রেস হয়ে যখন রফিকের অফিসে এসে পৌঁছলো মাহমুদ, তখন বেশ বেলা হয়েছে। বাইরের ঘরে কয়েকজন কর্মচারী নীরবে কাজ করছে। তাদের একপাশে নঈমকে দেখতে পেলো মাহমুদ। মস্ত বড় একটা খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন হিসেব করছে। ওর দিকে চোখ পড়তে ইশারায় কাছে ডাকলো, মাহমুদ যে, কি মনে করে?
মাহমুদ বললো, কাল মিতার জন্মদিন, তাই তোমাদের নেমন্তন্ন করতে এলাম। রফিক আছে কি?
আছে। পর্দা ঝুলানো চেম্বারটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে নঈম বললো, একটু আগে এসেছে। যাওনা, দেখা করো গিয়ে। এই শোনো–।
হঠাৎ কি মনে হতে ওকে আবার কাছে ডাকলো নঈম–তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে, ভীষণ সিরিয়াস কথা, বসো বলছি।
মাহমুদ বসলো।
সামনে খোলা খাতাটা বন্ধ করে এক পাশে ঠেলে রেখে দিলো নঈম।
চার পাশে তাকিয়ে নিয়ে চাপা গলায় ধীরে ধীরে বললো, রফিক একটা মেয়েকে ভালবাসতো মনে আছে তোমার?
হ্যাঁ, মাহমুদ মাথা দুলিয়ে সায় দিলো?
সে মেয়েটা এখনো তাকে ভালোবাসে।
হুঁ।
আজ কদিন ধরে রফিক কি বলছে জানো?
না।
বলছে–বলতে গিয়ে বার কয়েক নড়েচড়ে বসলো নঈম–রফিক বলছে মেয়েটাকে নাকি আমাকে বিয়ে করতে হবে।
সেকি? মাহমুদ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। তুমি করতে যাবে কেন?
দেখতো মজা। ঠোঁটের ফাঁকে মিটিমিটি হাসলো নঈম। এককালে ভালবাসতো রফিক একথা ঠিক, এখন সেসব কোথায় উবে গেছে। কিন্তু মেয়েটা ভীষণ হ্যাংলা, কিছুতে ওর পিছু ছাড়বে না। এখন হয়েছে কি–বলতে গিয়ে আরো সামনে ঝুঁকে এলো সে, চাপা গলায় বললো, মেয়েটা প্রেগনেন্ট হয়ে গেছে। এবোরসন করার জন্য চাপ দিয়েছিলো রফিক। কিন্তু মেয়েটা কিছুতে রাজী হচ্ছে না। মাঝখান থেকে বড় বিপদে পড়ে গেছে রফিক। তাই আজ কদিন ধরে সে আমায় ধরে বসেছে। বলছে আমার বেতন আরো বাড়িয়ে দেবে আর বিয়ের খরচ-পত্র সব নিজে বহন করবে। নঈম হাসলো।
মাহমুদ নীরব। সারা দেহ পাথর হয়ে গেছে।
ওকে চুপ থাকতে দেখে নঈম আবার বললো, বন্ধু হিসেবে ওর এ দুঃসময়ে ওকে বাঁচানো উচিত সেকথা আমি বুঝি কিন্তু– কিছু বলতে গিয়ে ইতস্তত করছিলো নঈম। সহসা উঠে দাঁড়ালো মাহমুদ।
ওকি চললে কোথায়? বসো। নঈম অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে। মাহমুদ মৃদু গলায় বললো, কাজ আছে, চলি এখন।
রফিকের সঙ্গে দেখা করবে না?
না।
দ্রুতপায়ে বেরিয়ে আসছিলো মাহমুদ। পেছনে রফিকের উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো সে। আরে মাহমুদ যে, ওকি, এসে চুপি চুপি আবার চলে যাচ্ছো? মাহমুদকে পেয়ে অধীনস্থ কর্মচারীদের উপস্থিতি যেন ভুলে গেছে সে। এগিয়ে এসে ওর একখানা হাত চেপে ধরে বললো, এসো তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার, চেম্বারে এসো।
মাহমুদ বললো, না, আমার কাজ আছে, যাই এখন।
কাজ কাজ আর কাজ। কাজ কি শুধু তোমার একলার। আমি বেকার নই। আমারও কাজ আছে। এসো, একটু বসে যাবে। মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে চেম্বারে ফিরে আসার পথে আড়চোখে একবার নঈমের দিকে তাকালো রফিক। লম্বা খাতাটার ওপর ঝুঁকে পড়ে গভীর মনোযোগসহকারে হিসেব মিলাচ্ছে সে।
সোনালি রঙের কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে দুঠোঁটের ফাকে গুঁজে দিলো রফিক, আরেকটা সিগারেট মাহমুদকে দিলো, তারপর বললো, তোমরা আসো না। এলে কত ভাল লাগে সে আর কি বলবো। এইতো সারাদিন ব্যস্ত থাকি। যখর একটু অবকাশ পাই তখন তোমাদের কাছে পাই নে! কেমন আছো বলো। বউ আর মেয়ে ভালো আছে তো? কলিং বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডাকলো, দুকাপ চা আনার ফরমায়েশ দিলো। তারপর আবার বলতে লাগলো খোদাবক্সের দোকানে আজকাল যাও না? আমিও যাই না অনেকদিন হলো। সেদিন পাশ দিয়ে আসছিলাম। দেখলাম বেশ চলছে ওর রেস্তোরাঁ। আজকাল রেকর্ডে সারাদিন ধরে হিন্দি গান বাজায় সে। দেয়ালে অনেকগুলো ফিল্মস্টারের ছবি বুলিয়ে রেখেছে, তাই না? একটানা কথা বলে গেলেও মাহমুদ লক্ষ করলো অবচেতন মনে কি যেন ভাবছে রফিক।
চা খেয়ে নিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো সে। চেয়ারে হেলান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললো, নঈমের আমি একটা বিয়ে দিতে চাই, দিন দিন ও বড় খেয়ালি হয়ে যাচ্ছে, ওর সংসারী হওয়া উচিত। আড়চোখে একবার মাহমুদের দিকে তাকালো সে।
মাহমুদ বললো, তুমি নিজে কি চিরকুমার থাকবে নাকি?
না, না, মোটেই না। সামনে এগিয়ে টেবিলের ওপর দুহাতের কনুই রেখে পরক্ষণে জবাব দিলো, তবে হ্যাঁ, আপাতত ও ধরনের কোন প্ল্যান নেই আমার। সময় কোথায় বল, সময় থাকলে তবু চিন্তা করা যেতো।
মাহমুদ মৃদু হাসলো।
রফিক ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সহসা বললো, নঈমকে তুমি একটু বোঝাতে পারো? তোমার কথা সে নিশ্চয় শুনবে। ওর জন্যে ভালো একটি মেয়ে ঠিক করেছি আমি। কিন্তু, ও রাজী হচ্ছে না। বললাম, সব খরচ আমার তবু–
আরো কিছু যেন বলতে যাচ্ছিলো সে, মাহমুদ মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো, ওর জন্যে অত মাথা ঘামিয়ে মূল্যবান নষ্ট করা কি উচিত? বলে উঠে দাঁড়ালো মাহমুদ। চলি আজ।
আরে শোন, দাঁড়াও। রফিক পেছনে থেকে ডাকলো। কি জন্যে এসেছিলে কিছু বললে না তো?
এমনি। বলে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে এলো সে। পাখার নিচে বসেও এতক্ষণে রীতিমত ঘেমে উঠেছে মাহমুদ।
মিতার জন্মদিনে বড় রকমের কোন আয়োজন করে নি ওরা। কিছু প্যাস্ট্রি, ডালমুট আর কলা। এক কাপ করে চা সকলের জন্যে। বিকেলে আমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে এলো।
মনসুর আর সেলিনা। তসলিম আর নঈম। ছোট ঘরে বেশি লোককে বসাবার জায়গা নেই। তাই অনেককে বলতে পারেনি ওরা। তবু ছোটখাট আয়োজনটা বেশ জমে উঠলো অনেকক্ষণ।
মিতাকে আগের থেকে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিলো লিলি। কোলে নিয়ে সবাই আদর করলো তাকে।
সেলিনা বললো, দেখতে ঠিক মায়ের মত হয়েছে।
মনসুর বললো, রঙটা পেয়েছে বাবার।
লিলি বললো মেয়ে হয়ে বিপদ হলো, ছেলে হলে তোমাদের জামাই বানাতাম।
সেলিনা বললো, আমার কিন্তু ছেলে হবে, দেখো লিলি আপা।
মনসুর বললো, আমি কিন্তু মেয়ে চাই।
সেলিনা ঠোঁট বাকিয়ে বললো, তুমি চাইলেই হলো নাকি?
হয়েছে মান-অভিমানের পালাটা তোমরা বাসায় গিয়ে করো–লিলি হেসে বললো।
এখন সবাই মিলে মিতার স্বাস্থ্য পান করবে এসো।
মেয়েকে মাহমুদের কোলে বাড়িয়ে দিয়ে, খাবারগুলো এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখলো লিলি।
সবার অনুরোধে নঈম একটা গান শোনালো ওদের।
তারপর খাওয়ার পালা।
প্যাস্ট্রি। ডালমুট। কলা। সবশেষে চা ৷
তসলিমের দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে লিলি মৃদু হেসে বললো, তুমি একা এলে, রানুকে আনলে না যে?
তসলিম লজ্জা পেয়ে বললো, আসার কথা ছিলো। কিন্তু বাসা থেকে বেরুতে পারেনি ও।
লিলি মুখ টিপে আবার হাসলো ওর বাবা-মা বুঝি ওকে কড়া নজরে রেখেছে আজকাল?
তসলিম দ্রুত ঘাড় নাড়িয়ে বললো, হ্যাঁ।
মনসুর চায়ের কাপে চুকুম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বিয়ের দিন তারিখ কি এখনো ঠিক হয় নি?
না, এখনো কথাবার্তা চলছে। মৃদু জবাব দিলো তসলিম। লিলি আবার ঠোঁট টিপে হাসলো, বেচারা বড় অস্থির হয়ে পড়েছে। তসলিম লজ্জায় লাল হয়ুএ গিয়ে বললো, হুঁ তোমাকে বলেছে আর কী। শুধু শুধু বাজে কথা বলো।
চা-নাস্তা শেষ হলে আরো অনেকক্ষণ গল্প করলো ওরা। সিমেনা নিয়ে আলোচনা করলো। পত্র-পত্রিকা আর রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হলো। তারপর একে একে বিদায় নিয়ে চলে গেলো সবাই।
মিতাকে কোলে নিয়ে আদর করছিলো মাহমুদ। লিলি বললো তোমার কি হয়েছে বলতো, সবাই বললো, তুমি একটা কথাও বললে না?
মাহমুদ হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, তুমি তো জানো লিলি, অতিরিক্ত হুল্লোড় ভালো লাগে না আমার।
তাই বলে বুঝি একটা কথাও বলতে হবে না? কপট অভিমান করে লিলি বললো, ওরা কি মনে করলো বল তো?
কেন, তুমিতো কথা বলেছে সবার সাথে। মাহমুদ জবাব দিলো মৃদু গলায়। মিতা ঘুমিয়ে পড়েছে কোলে।
লিলি বিছানায় নিয়ে শোয়াল তাকে। কপালে একটু চুমু খেয়ে আদর করলো। গায়ের কাপড়টা মিতার আস্তে করে টেনে দিলো সে।
টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে সার সার বই। মাহমুদ বইগুলো উলটে খোঁজ করছিলো খাতাটা।
লিলি কাছে এসে বললো, কি খুঁজছো?
মাহমুদ বললো, আমার সেই খাতাটা সেই লাল কভার দেয়া।
লিলি বললো, তুমি বসো, আমি খুঁজে দিচ্ছি।
মিতার পাশে এসে বসলো মাহমুদ। লিলি বইগুলো উল্টে পাল্টে খোঁজ করছিলো খাতাটা। হঠাৎ একটা বই থেকে কি যেন পড়ে গেলো মাটিতে। উপুড় হয়ে ওটা হাতে তুলে নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো লিলি।
মাহমুদ বললো, কি ওটা? বলতে বলতে লিলির পেছনে এসে দাঁড়ালো সে।
লিলির হাতে একখানা ফটো। গ্রুপ ফটো। হাসমত আলী, মাহমুদ, সালেহা বিবি, মরিয়ম, হাসিনা সকলে আছে। তসলিম তুলেছিলো ওটা, আজও মনে আছে মাহমুদের।
ফটোর দিকে চেয়ে মৃদু গলায় লিলি জিজ্ঞেস করলো, ক-বছর হলো?
মাহমুদ ওর কাঁধের ওপর হাত জোড়া রেখে বললো, পাঁচ বছর।
পাঁচটা বছর চলে গেছে, তাই না? লিলির দৃষ্টি তখনো হাতে ধরে রাখা ফটোটার উপর। ধীরে ধীরে মাহমুদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর মুখে চোখ তুলে তাকালো লিলি। চোখজোড়া পানিতে টলমল করছে ওর।
দুজনে মৌন।
দুজনে নীরব।
মাহমুদের গলা জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো লিলি। বুকটা অস্বাভাবিক কাঁপছে ওর। অসহায়ের মত কাঁপছে।
ওর ঘনকালো চুলগুলোর ভেতর সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে মাহমুদ মৃদু গলায় বললো, কেন কাঁদছো লিলি। জীবনটা কি কারো অপেক্ষায় বসে থাকে? আমাদেরও একদিন মরতে হবে। তখনো পৃথিবী এমনি চলবে। তার চলা বন্ধ হবে না কোনদিন। যে-শক্তি জীবনকে চালিয়ে নিয়ে চলেছে তার কি কোন শেষ আছে লিলি?
⌘