উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

ঊনিশ

১৯৫০ সালে আমার একমাত্র সন্তান গৌতম জন্মালো সেপ্টেম্বর মাসে। অদ্ভুত এই সেপ্টেম্বর মাস! এই মাসেই জন্মেছি আমি, এই মাসে জন্মেছে গৌরী, আর আমাদের একমাত্র সন্তান সেও জন্ম নিয়েছে এই সেপ্টেম্বর মাসেই।

ফিল্ম করি বটে, ছবি চলে না বলে আনন্দ পাই না। সমাজে স্বীকৃতি কই? তা ছাড়া, অভিনেতা হিসেবে যে যশ আমি আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম তা কিছুইতো পেলাম না!

তাহলে, এ লাইন ছাড়ব? অফিস পালিয়ে স্যুটিংই বা করব ক’দিন? ওদিকে গোরাচাঁদবাবু ছিলেন, তাই চলে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে দু নৌকোয় বেশিদিন পা দিয়ে থাকলে তো আমার চলবে না।

যা হোক, জীবনের একটা লক্ষ্য ঠিক করে নিতে হবে। হয় ফিল্ম, না হয় অফিস। অফিসে উন্নতি কতদূর হবে তাতো জানাই আছে। আমার মতো বিদ্যের ছেলে আর কতদূরই বা এগোতে পারবে। অফিসে উন্নতি করতে গেলে চাই ব্যাকিং, চাই বিদ্যে। কিন্তু ও দুটোই আমার নেই। এই না থাকার দরুন চাকরিতে উন্নতির আশাও আমার মন থেকে চলে গেছে। তাহলে?

ফিল্মে তো তিন-চারখানা ছবি করলাম, সবকটাতেই সেই একই ভাব। উন্নতি কোথায়? দর্শকরা যদি আমাকে মেনে না নেন, প্রডিউসাররাই বা নেবেন কেন?

এমনি সময় আমার জীবনে ঘটল একটা ঘটনা। এম. পি.তে তখন নতুন ছবি খোলা হবে। নাম ‘বসু পরিবার’। কাহিনিটা শোনা যায় মুরলীবাবুর (এম. পি.র স্বত্বাধিকারী) নিজের। শৈলেন রায় মশায় পরে সাজিয়ে গুছিয়ে তাকে লিপিবদ্ধ করেন। এই বইটির জন্য তখনকার দিনে এম. পি., নির্মল দে নামে এক পরিচালককে ঠিক করেছিলেন।

সুন্দর সৌম্য মূর্তি তাঁর। দেখলেই শ্রদ্ধা হয়। থাকতেন তিনি আমাদেরই এই ভবানীপুরে ‘ইন্দুভূষণের’ দোকানের ওপর এক মেসে। ‘বসু পরিবার’ বইটা পড়ে অবধি নিজেকে নায়ক সুধীন বলে কল্পনা করতে আমার ভালো লাগত।

একদিন এম.পি.র অফিসে গিয়ে আভাসে বিমলবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম— ‘নতুন ছবির নায়ক কে হবে?’

বিমলবাবু বললেন— ‘বোধহয় নির্মলবাবু অভি ভটচার্য, মহাশয়কে ঠিক করেছেন। তাঁকে না পাওয়া গেলে অসিতবাবু মানে অসিতদা।’

চুপ করে থাকি, বলতে পারি না কোনো কথা। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিমলবাবু বললেন— ‘কিছু কি বলবি আমাকে?’

বলবার ইচ্ছে তো অনেক কিছুই। কিন্তু বলব কোন মুখে? কোম্পানি আমাকে নায়ক সাজিয়ে একটা ছবিতেও পয়সা পায়নি। সে ক্ষেত্রে আমি কী করে বলি আমাকে আপনারা নায়ক মনোনীত করুন।

তবুও আমতা আমতা করে বলি— ‘বিমলদা, আমাকে আর একটা চান্স দিতে পারেন?’

— ‘চান্স, উত্তম! তোকে তো দিতে ইচ্ছে করে ভাই’—বিমলদা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন— ‘কিন্তু—’

আমি একটু উৎসাহিত হয়েই প্রশ্ন করি— ‘কিন্তু কী বিমলদা?’

— ‘তোর নাম নায়কের তালিকায় দেখলে ধর্মতলা তো টাকা দিতে চায় না।’

ধর্মতলা মানে ডিস্ট্রিবিউটিং কোম্পানিগুলি। এই ডিস্ট্রিবিউটিং কোম্পানির কাজ হল, ছবির কাজ কিছুদূর এগোলে ফিল্ম কোম্পানিগুলিকে টাকা দেওয়া। পরে ছবি শেষ হলে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই ছবিগুলো থাকে তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে। ফলে, তাঁরা যা টাকা দিয়েছেন তা তখন উঠে যায়। ছবি ভালো হলে আসল তো ওঠেই, তার সঙ্গে প্রচুর লাভও হয়। এইভাবেই চলে ফিল্মের ব্যবসা।

আমার নাম যদি নায়কের ক্ষেত্রে থাকে, তাতে যদি কোম্পানি টাকা না পায়, এবং সেই কারণেই তাঁরা যদি আমাকে ছবিতে চান্স না দেন, তাতে আমার দুঃখের কিছু থাকতে পারে না, অভিযোগ করবারও কিছু নেই।

কিন্তু তবু দুঃখ হল। বিমলদার কথা শুনে সমস্ত বুকের ভেতরটা যেন মুচড়ে উঠল। ভাবলাম মিথ্যে আমার এতদিন স্বপ্ন দেখা। মিথ্যে আমার জীবনের অলীক কল্পনা। তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন ছুটে বেড়ায় মরীচিকার পেছনে, শেষকালে নিজের জীবন দিয়ে আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে রৌদ্রকিরণে বালির ওপর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে যেমন তার নিজের ভুল বুঝতে পারে, আমিও ঠিক যেন এতদিন পরে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম।

মনে হল কার পেছনে ছুটেছি এতদিন? ও মায়াবিনী রাক্ষুসী। ফিরে যাই আমার পোর্ট অফিসের চাকরিতে। ছেড়ে দিই এ সমস্ত স্বপ্নবিলাস।

আমার মুখে বোধহয় হতাশার চিহ্ন খানিকটা ফুটে উঠেছিল, তাই বিমলদা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন— ‘আচ্ছা, দেখি একবার নির্মলবাবুকে বলে। যদি তিনি— ‘

অভিমানক্ষুব্ধ স্বরে আমি বলি— ‘না না বিমলদা, ওঁকে বলে শুধু শুধু— ‘

বিমলদা বললেন— ‘শুধু শুধু নয় রে। দেখি কী করা যায়।’

কেটে গেল আরও দু’চার দিন। গোরাবাবুকে জানিয়েছি, আমি শীঘ্রই ফের নিয়মিত অফিস করব। এ লাইন জন্মের মতো ছেড়ে দেব।

শুনে গোরাবাবু আমাকে বললেন— ‘তুই উন্নতি করলে আমি সত্যিই সুখী হতাম। আর এ লাইন যদি সত্যিই ছেড়ে দিবি মনে করিস, তবে মন দিয়ে অফিস কর।’

সে রাত্রি আমার জীবনে একটা দুর্যোগের রাত্রি। মুখ দেখেই বোধহয় গৌরী আঁচ করেছিল ব্যাপারটা। আমাকে প্রশ্ন করলো— ‘কী হয়েছে গো?’

আমি বলি— ‘কিছু নয়।’

গৌরী বলে— ‘লুকোবে কাকে, মুখ তোমার কালো হয়ে গেছে। তবুও তুমি আমাকে বলছ, কিছু নয়!’

আমি ব্যর্থ হাসবার চেষ্টা করি, বলি— ‘গৌরী, ফিল্ম লাইন ছেড়ে দেব ভাবছি। আমি আবার পোর্ট অফিসের চাকরিতে নিয়মিতভাবে যাব।’

— ‘চাকরিতে ফিরে যাবে? তুমি বলছ কী? আমি তো ভাবছিলুম তুমি চাকরিটা এবার ছেড়ে দেবে। যা করছ সেই কাজটাই মন দিয়ে করবে। ওতেই তোমার উন্নতি হবে।’

— ‘উন্নতি, না অবনতি হবে! দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করলুম এই লাইনে, কিন্তু বলো তো কী পেলাম! এখনও— ‘

কথাটা আর আমি শেষ করতে পারি না। মনের জমাট দুঃখ গলে চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

ঢাকবার চেষ্টা করতে অন্য দিকে মুখ ফেরালাম, কিন্তু লুকোতে পারলাম না।

গৌরী বুঝতে পারল। শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো— ‘তুমি অত ভাবছো কেন? যা চাইছ, তা নিশ্চয়ই পাবে। মাথার ওপরে ভগবান বলে একজন আছেন।’

ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করে বলি—ভগবান নেই। তাহলে এতদিনে নিশ্চয় তিনি আমার প্রার্থনা শুনতেন। গৌরী ব্যথা পাবে বলে বললাম না।

সে রাত্রে ভালো করে ঘুম আসতে চাইল না। কেমন যেন একটা অস্বস্তি, কেমন যেন একটা অশান্তি।

মনে মনে ভাবলাম ভগবান বলে যদি কেউ থাকেন, (থাকেন কেন বলছি নিশ্চয়ই আছেন, নইলে এত লোক কি মিথ্যের পেছনে ছুটছে?) প্রাণভরে একবার তাঁকে ডাকি।

অশান্তি আর হতাশায় মানুষ যেমন করে ভগবানকে ডাকতে পারে, হয়তো সুখের দিনে তেমন করে ডাকতে পারে না। বোধহয় ডাকতে চায়ও না। সে রাত্রে কখন যে তাঁর নাম করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা আর মনে নেই। পরের দিন যখন ঘুম ভাঙল বেশ বেলা হয়ে গেছে। শরীর মন তখনও অবসন্ন।

মুখ হাত ধুয়ে গেলাম মা’র কাছে। মুখের চেহারা দেখেই তিনি বললেন— ‘কী হয়েছে রে খোকা? শরীরটা খারাপ নেই তো?’

— ‘না, মা, শরীর আমার ভালোই আছে। তবে— ‘

— ‘তবে কী রে?’

আমি বলি— ‘নাঃ, কিছু না।’

মা বলেন— ‘তুই আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছিস?’

আমি বলি— ‘না, মা, লুকোইনি। বলছি— ‘

বলে তাঁকে সমস্ত ঘটনা বললাম। তারপরে বলি— ‘এর পরে কি আর কারোর কিছু ভালো লাগে!’

আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বললেন— ‘খোকা, ভগবানের খেলা বোঝা ভারী শক্ত। মানুষ মিথ্যে অহংকারে ভাবে সে সবটাই বুঝতে পারছে।’ তাঁর খেলা বোঝা যে কী শক্ত সে কথা বুঝেছিলাম খানিক পরেই।

সেইদিন খাওয়াদাওয়া সেরে গেলাম পোর্ট অফিসে। সেখান থেকে গেলাম এম. পি.তে।

বিমলদা আমায় দেখেই বললেন— ‘এই যে উত্তম, আরে তোকেই খুঁজছিলাম এতক্ষণ! অভি ভটচাযকে কলকাতায় আসবার জন্যে টি. এম. ও. করেছিলাম বম্বেতে। টাকা ফেরত এসেছে। সে এখন অন্য ছবির কাজে ব্যস্ত। এ ছবি করা সম্ভব হবে না। এখন তোকে নিয়ে একবার আমায় যেতে হবে নির্মলবাবুর কাছে। দেখা যাক কী হয়। ওদিকে অসিতবাবুকেও খবর দিয়েছি। নির্মলবাবু কাকে পছন্দ করেন, দেখি।’

আমি বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে বলি— ‘আমি?’

বিমলবাবু বলেন— ‘হ্যাঁ তুই। অভিনয় কি তুই খারাপ করিস!’

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ১৯৫২ সালের ১১ এপ্রিল এম.পি. প্রোডাকসন্সের ‘বসু পরিবার’ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটির পরিচালক ছিলেন নির্মল দে। এই ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন উত্তমকুমার। প্রথম অভিনীত ছবি থেকে পরপর ৭ খানি ছবি মুখ থুবড়ে পড়ার পর, এই ‘বসু পরিবার’ ছবি থেকেই উত্তমকুমারের ভাগ্যের চাকা ঘোরে। প্রতিষ্ঠা পান চলচ্চিত্রজগতে। এ ছবির নায়িকা ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং একটি ছোটো চরিত্রে অভিনয় করেন সুপ্রিয়া দেবী।
  2. বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার শৈলেন রায় (১৯০৫-১৯৬৩) কুচবিহারে জন্মেছিলেন। কাজী নজরুলের সহায়তায় রেকর্ডের জন্যে গান লিখতে শুরু করেন। ১৯২৭ সালে কুচবিহারনিবাসী অসামান্য লোকসংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিন রেকর্ডে গেয়েছিলেন, ‘স্মরণপারের ওগো প্রিয়…’ গানটি। এই গানটিই ছিল শৈলেন রায়ের লেখা প্রথম রেকর্ডস্থ গান। পরপর, কয়েকদশক জুড়ে নন-ফিল্ম ও ফিল্মের জগতে অসংখ্য অবিস্মরণীয় গানের বাণী রচনা করেছিলেন এই গীতিকার। ‘প্রেমের সমাধি তীরে…’, ‘রাতের ময়ূর ছড়ালো…’, ‘গানের সুরে জ্বালব তারার দীপগুলি…’ (স্বপ্ন ও সাধনা’), ‘মানুষের মনে ভোর হলো আজ…’ (সমাপিকা’), ‘তোমারই পথপানে চাহি…’ ইত্যাদি শৈলেন রায় রচিত কিছু উল্লেখযোগ্য গান।
  3. বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমী পরিচালক ছিলেন নির্মল দে। যে ছবি থেকে উত্তমকুমারের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার শুরু, সেই ‘বসু পরিবার’ ছবির পরিচালক ছিলেন ইনিই। তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবী সহ আরো অনেকের অবিস্মরণীয় অভিনয়ে ভরা সর্বকালের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় হাসির ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩) ছবিটিরও পরিচালক ছিলেন নির্মল দে। প্রসঙ্গত, এই ছবি থেকেই উত্তম-সুচিত্রা জুটির যাত্রা শুরু। এছাড়াও, উত্তমকুমারের অসাধারণ অভিনয় সংবলিত এবং নিপুণভাবে পরিচালিত ‘চাঁপাডাঙার বউ’ (১৯৫৪) ছবিটিও নির্মল দে পরিচালনা করেন।
  4. ১৯২০ সালে বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীতে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রাভিনেতা অভি ভট্টাচার্যের জন্ম। প্রখ্যাত ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের (ডি.জি.) ‘পুনর্জন্ম’ (১৯৩২) ছবিতে মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম চিত্রাবতরণ। কলেজে পড়ার সময় অনেক নাটক করেছেন। আবার চলচ্চিত্রে এসে হীতেন চৌধুরির ‘নৌকাডুবি’ ছবিতে বড়ো চরিত্রে নামলেন। এরপর, ‘দেবদূত’, ‘মায়ের ডাক’, ‘অশ্রু’, ‘বিষের ধোঁয়া’, ‘ভৈরব মন্ত্র’, ‘পরিত্রাণ’, ‘রত্নদীপ’ (হিন্দি), ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘অমানুষ’, ‘অনুসন্ধান’— দীর্ঘকাল ধরে নানা ছবিতে অভি ভট্টাচার্যকে দেখা গেছে। মুম্বই চিত্রজগতে পাকাপাকিভাবে গিয়ে স্থায়ী আসন পেয়েছিলেন এই অভিনেতা। অনেক জনপ্রিয় হিন্দি ছবিতে তাঁকে নায়ক ও চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দেখা গেছে। বিশিষ্ট চিত্রাভিনেত্রী প্রণতি ঘোষকে বিবাহ করেন অভিবাবু। বেশ কয়েকবছর আগে প্রয়াত হয়েছেন অভি ভট্টাচার্য।