উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়
হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর
চার
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেবার পর হঠাৎ মনে হল সামনে দীর্ঘ তিনমাস ছুটি, কী করা যায় এখন?
তাছাড়া কলকাতা তখন বেশ ফাঁকা। আড্ডা মারবার লোকও খুঁজে পাওয়া শক্ত।
আগেই বলেছি সেটা ছিল ১৯৪২ সাল। ইউরোপের যুদ্ধ তখন ঘোরতরভাবে শুরু হয়ে গেছে। যে ক’জন লোক পাড়াতে আছেন, সকালবেলা সংবাদপত্র নিয়ে তাঁদের মধ্যে বেশ খানিকটা বচসা লেগে যেত। বচসার বিষয় চিরপুরাতন—ইংরেজ জিতবে না জার্মানি জিতবে।
আমিও মাঝে মাঝে সেই তর্কে যোগ দিতুম। তারপরে জাপান যুদ্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার লোক হল ভয়ে সারা।
বর্মায় বোমা পড়ল, আর ভয়ে পালালো কলকাতার লোক। কিন্তু সব যাবে কোথায়? ট্রেনে জায়গা নেই, গ্রামও ভর্তি। শুনেছি যাঁদের গ্রাম বা দেশ ছিল না, তাঁরা সাঁওতাল পরগনায় বা ওই ধরনের কোনো স্বাস্থ্যকর জায়গায় পরিবারের সকলকে পাঠিয়ে দিলেন। আর নিজে কলকাতায় একা থেকে চাকরি বাঁচাতে লাগলেন।
লোকজনও পাওয়া যেত না। সন্ধে হতে না হতেই ঠুঙ্গিপরা আলোগুলো কর্পোরেশনের লোকেরা জ্বেলে দিয়ে যেত। তাতে না হতো আলো, না হত কিছু। রাত্রে পাছে যদি কলকাতা আক্রান্ত হয়, তাই এ. আর পি.১ আর সিভিক গার্ডদের২ সুবিধের জন্য আলোর সঙ্গে একটা করে দড়ি বাঁধা ছিল। যাতে সময় এলেই সেটাকে টেনে নিচে থেকে নিভিয়ে দেওয়া যায়। ফলে হল কী, কর্পোরেশনের লোক আলো জ্বেলে দিয়ে গেলেই, পাড়ার ছেলেরা যারা বাইরে যেতে পারেনি, তারা দড়ি ধরে টেনে আলোগুলো দিত নিভিয়ে। রাস্তা হয়ে যেত অন্ধকার।
তাছাড়া ব্রিটিশ সরকারের ছিল কড়া শাসন—বাড়ির আলো রাস্তায় এসে পড়বে না। যদি কারো বাড়ির আলো রাস্তায় এতটুকু এসে পড়েছে, অমনি এ আর. পি. আর সিভিক গার্ড এসে প্রথমে গৃহস্থকে সাবধান করতেন আলো দেখা যাচ্ছে বলে। গৃহস্থ যদি তাতে সাবধান হতেন তো ভালো, নইলে হত ফাইন।
যতদিন পরীক্ষা হয়নি, ততদিন কোনোরকম করে সময় কেটেছে। এখন সময় কাটাই কী করে? তাই ঠিক করলাম, এবারে একটু গান শিখব।
ছেলেবয়েস থেকে পড়ায় ফাঁকি দিয়ে যাত্রাদলের কোরাস গানগুলো একদম মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু তবুও, কী জানি কেন, কারোর সামনে গাইতে লজ্জা করত। ভাবতাম, আমার গলার আওয়াজ শুনে যদি কেউ হাসে? কোরাসে চলছে, চলুক না!
অনেকসময় মুখ নেড়ে গেছি, গান গাইনি। গলা দিয়ে একটা টুঁ শব্দও বার করিনি। অথচ আসরের কোনো শ্রোতা হয়তো যাত্রাশেষে বাড়ি আসবার সময় আমার পিঠ চাপড়ে বললেন— ‘বাঃ, বেড়ে গান গেয়েছ তো ছোকরা!’
তাই সময় পেতেই ভাবলাম ও বিদ্যেটা একটু আয়ত্ত করে নিতে ক্ষতি কি?
তাছাড়া গান শেখার আর একটা উদ্দেশ্য ছিল। ফিল্মে অভিনয় করব এ ছিল আমার মনের তখন একটা স্বপ্ন। রুপালি পর্দার ওপর তখনকার দিনে নায়ক কে. এল. সাইগল৩, পাহাড়ী সান্যাল৪, এমন অনেককেই গান গাইতে দেখলাম।
এমন কি জহরদাও৫ বাদ যাননি। তাই ভাবতাম, ভালো গান না জানলে বুঝি ছবিতে অভিনয় করা সম্ভব হবে না।
কবে গান শিখব, বা কার কাছে গান শিখব, এই প্রশ্নটাই তখন আমার মনে দিবারাত্র ঘুরে বেড়াতে লাগল।
অনেক কষ্টে সংগীতশিল্পী নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়৬ মহাশয়ের কাছে গেলাম।
ভেবেছিলাম, গান যদি শিখতেই হয় তো উচ্চাঙ্গসংগীত শেখা ভালো। তাতে গলাটাও তৈরি হবে, আর যখন কেউ আমার গলা পরীক্ষা করবে তখন গিটকিরি আর তান মেরে সকলকে চমকে দেব।
হায় তখন কি জানতাম ফিল্মে গান গাইবার জন্য প্রযোজকরা কোনোদিনই আমাকে সুযোগ দেবেন না! ক্যামেরার সামনে অপরের গাওয়া গানের সঙ্গে আমার ঠোঁট নাড়াই সার হবে! আর ওই জায়গাটায় শ্রোতারা শুনবেন অন্য কোনো সুগায়কের কণ্ঠস্বর!
যাক, তখন তো আর এত কথা বুঝিনি। তাই সংগীতজ্ঞ নিদানবন্ধুর কাছে গিয়ে বললাম— ‘দয়া করে আমাকে একটু গান শেখাবেন?’
আমার আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ্য করে নিয়ে তিনি বললেন— ‘গান আগে কখনও শিখেছ কি?’
মাথা চুলকে বললাম— ‘আজ্ঞে, তেমন কিছু নয়, তবে একটু একটু মানে, ইয়ে হয়েছে—মানে—’
ভাবলুম যাত্রাদলে কোরাস গানের কথা বলব নাকি? পরক্ষণে মনে হল কোরাস গানের মধ্যে বাহাদুরি তো কিচ্ছু নেই! তাই কথাটা চেপে গিয়ে বললাম— ‘আজ্ঞে, একটু আধটু উঁঃ আঁঃ করতে পারি।’
আমার দিকে চোখ রেখে তিনি বললেন— ‘করো দিকিনি!’
মাথা চুলকে বললাম— ‘আজ্ঞে, আমি তো হারমোনিয়াম বাজাতে জানি না।’
তিনিও ছাড়বার পাত্র নন। সামনে-রাখা একটা হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বলেন— ‘গাও, আমি বাজাচ্ছি।’
গান শেখা যতটা সহজ ভেবেছিলাম, তার চেয়ে ঢের শক্ত বুঝি একা কারোর সামনে গান গাওয়া। কোথায় গেল আমার সেই ষাঁড়ের মতো আওয়াজ! তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ! গলার আওয়াজ যেন বারই হতে চায় না। জিভ, তালু যেন একেবারে শুকিয়ে কাঠ! তবুও সাহস করে ধরে ফেললাম যাত্রাদলের একটা গান— ‘এসো হে নন্দকিশোর’। অনেক কষ্টে গান থামলে, আমি দেখছি আমার জামা তখন ঘামে ভিজে গেছে। নিদানবাবুর মুখের দিকে চাইতে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, চেষ্টা করলে হতে পারে। এসো তুমি আগামী শুক্রবার। দেখি কী করা যায় তোমায় নিয়ে।’
ভয়ে ভয়ে গেলাম পরের শুক্রবার। মা সরস্বতীকে প্রণাম করে তিনি বললেন— ‘গান তো শিখতে এসেছ, গলা সাধতে পারবে? তোমার গলাটা সামান্য বেসুরো আছে। রীতিমতো অভ্যাস করলে ঠিক হয়ে যেতে পারে। এখন এসো, কীভাবে গলা সাধতে হয় তোমায় শিখিয়ে দিই।’
বেশ খানিকক্ষণ সময় তাঁর কাছে বসে, সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, র্সা সাধা গেল এবং গলা সাধবার কয়েকটা নিয়মও তিনি শিখিয়ে দিলেন। তারপরে বললেন— ‘এসো তুমি আবার পরে, গলা ঠিক হলে গান দেব। এখন নিয়মিত কেবল গলা সেধে যাও।’
শুধু গলা সাধাই নয়, তখন নিয়ম করে শরীরচর্চাও শুরু করে দিয়েছি। কারণ আমি তখনই বুঝেছিলাম, সিনেমায় ঢুকতে গেলে এ ধরনের ‘ল্যাকপ্যাকে’ চেহারা চলবে না। রীতিমতো ডন বৈঠক, এমন কি বক্সিংও শুরু করলাম। তখনকার সময় আমাকে বক্সিং শিখিয়েছিলেন শ্রীভবানী দাস। আজ অবশ্য তাঁর নাম, ‘ববি ডায়াস’। বক্সার হিসাবে নয়, ইংরেজি নাচ জানেন বলে তিনি আজ বিখ্যাত।
আমার আগামী ছবির জন্য তাঁরই কাছ থেকে ‘বলড্যান্স’ শিক্ষা করছি।
কলকাতার মানুষ আবার ফিরে এল, আবার শুরু হল মানুষের সরল জীবনযাত্রা। কলেজে পড়া ইস্তফা দিতে হল, কারণ তখন দেখা দিয়েছে সংসারে অভাব অনটন। একটা যেকোনো চাকরি আমাকে জুটিয়ে নিতেই হবে।
কিছুদিন ঘোরাঘুরি আর ধরাধরি করবার পর চাকরি আমার একটা জুটল—পোর্ট কমিশনার অফিসে ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে।
অফিসে যাতায়াত নিত্য করছি। কিন্তু কিছুতেই আমি যা চাইছি তা পাচ্ছি না। কীসের যেন বরাবর একটা অভাব থেকে যাচ্ছে।
তখন স্বর্গীয় শিশির ভাদুড়ি মশাই শ্রীরঙ্গম আবার নতুন করে খুলেছেন। মাঝে মাঝে দেখতেও যাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই আমার মন আরও ভরে না।
এমনিভাবে কেটে গেল আমার জীবনের আরও তিনটি বছর। পাড়ার ক্লাবে মাঝে মাঝে থিয়েটার করি, রীতিমতো ছবিও দেখি। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সবেমাত্র মারা গেছেন, বাংলা ছবিতে তাঁর স্থান নিয়েছেন শ্রদ্ধেয় প্রমথেশ বড়ুয়া৭ ও শ্রদ্ধেয় ছবিদা (শ্রীছবি বিশ্বাস)।
তাঁদের অভিনয় মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আর মনে মনে ভাবতাম—আমি কবে এমন অভিনয় করতে পারব।
দর্শকদের করতালি শুনে মনে হত, আমি কি এমন করতালিধ্বনির অধিকারী কোনোদিন হতে পারব?
যাক এমনি যখন আমার মনের অবস্থা তখন একদিন দেখা হয়ে গেল পুর্বোক্ত সেই মেয়েটির সঙ্গে। তখন তার বয়স কতই বা! চোদ্দো পনেরো হবে! গায়ের ফর্সা রং, ওই মুখ ইত্যাদি যেন আমায় আকর্ষণ করতে লাগল।
আমার জেঠতুতো বোন অন্নপূর্ণার কাছ থেকে সেদিন যেই মেয়েটি চলে গেল, ভাবলাম, লজ্জার মাথা খেয়ে তাকে একবার জিজ্ঞাসা করি ওই মেয়েটির বিষয়। কিন্তু রাজ্যের লজ্জা যেন আমায় পেয়ে বসল।
‘কী রে অন্নপূর্ণা, কী করছিস’—ওই পর্যন্ত বলেই আমার সব কথা যেন ফুরিয়ে গেল।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- এ. আর. পি-র পুরো কথাটি হলো ‘এয়ার রেড প্রোটেকশন (AIR RAID PROTECTION)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কলিকাতায় সাধারণ যুবকদের নেওয়া হয়েছিল এ. আর. পি হিসেবে। এরা মিলিটারিদের সাহায্যকারী হিসেবে ছিল। বোমা পড়ার সম্ভবনা দেখা গেলে, মানুষকে আগাম সতর্ক করা বা তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি আরো কিছু কাজ ছিল এ. আর. পি-র। এদের পোশাক ছিল নীল-সাদা রঙের।
- সিভিক গার্ড হল সাময়িক ভিত্তিতে নিযুক্ত শান্তিরক্ষক বাহিনী। যারা পুলিশ-মিলিটারিকে বিভিন্ন অশান্তি দমনের বিষয়ে সাহায্য করত। এদের মধ্যে অনেকে পুলিশ বিভাগে স্থায়ী চাকরিতেও বহাল হতো। এদের ধরনের সঙ্গে পরবর্তীকালের ‘হোমগার্ড’—দের ধরনের একটা মিল ছিল।
- ভারতীয় সংগীতজগতের এক উজ্জ্বল যুগস্রষ্টা কুন্দনলাল সাইগল (১৯০৭-১৯৪৭)। অবিস্মরণীয় কণ্ঠস্বর ও সাংগীতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই সংগীতশিল্পী। কলিকাতায় এসে নিউথিয়েটার্সের (১৯৩৩) হিন্দি ‘পুরাণ ভকত’ ছবিতে প্রথম দেখা যায় সাইগলকে। ১৯৩২ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির উদ্বোধনের বছরেই সাইগলের গাওয়া-‘হরি হে ব্রজরাজ দুলারে.’ গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। নায়ক-গায়ক হিসেবে নিউথিয়েটার্সের বেশকিছু বাংলা-হিন্দি ছবিতে সারা ভারত মাতিয়ে!ছলেন তিনি। বাংলার মধ্যে- ‘দেবদাস’, ‘জীবনমরণ’, ‘দেশের মাটি’, ‘দিদি’, ‘পরিচয়’, ও হিন্দিতে-‘দুশমন’, ‘দেবদাস’, ‘ধূপছাঁও’, ‘প্রেসিডেন্ট’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত ‘জীবনমরণ’ ছবিতে সায়গলের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত, ‘আমি তোমায় যত…’ চিরস্মরণীয়। এরপর মুম্বাই গিয়ে ওমর খৈয়াম, তানসেন, পরোয়ানা, শাহজাহান ইত্যাদি ছবিতে অভিনয়সহ অসাধারণ গান উপহার দেন এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী।
- পাহাড়ী সান্যাল (১৯০৭-১৯৭৪) বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক কালজয়ী অভিনেতা। প্রকৃত নাম নগেন্দ্রনাথ। শৈলশহর দার্জিলিঙে জন্মেছিলেন বলে ডাকনাম হয় ‘পাহাড়ী’। লক্ষ্নৌ-এর মরিস কলেজে রীতিমতো নিষ্ঠা সহকারে হিন্দুস্থানি সংগীত শেখেন। দেবকীকুমার বসুর ‘মীরাবাঈ’ (১৯৩৩) ছবিতে প্রথম অভিনয়। এরপর, ‘ভাগ্যচক্র’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘বড়দিদি’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘গিরিশচন্দ্র’, ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র’, ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘নির্জন সৈকতে’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয়ের নমুনা পেশ করেছেন পাহাড়ী সান্যাল। মঞ্চাভিনয় বিশ্বরূপায় ‘আসামী হাজির’ নাটকে। অনেক ছবিতে অভিনয়সহ বেশকিছু গানও গেয়েছেন।
- ‘জহরদা’ হলেন বাংলা নাট্য ও চিত্রজগতের চিরভাস্বর অভিনেতা জহর গঙ্গোপাধ্যায় (১৯০৩- ১৯৬৯)। ‘সুলাল’ নামে পরিচিত ছিলেন। মিত্র থিয়েটারে যুক্ত হয়ে ‘শ্রীদুর্গা’ নাটকে (১৯২৬) প্রথম মঞ্চে ওঠেন। ১৯৩১ সালে তিনকড়ি চক্রবর্তী পরিচালিত নির্বাক ‘সীতা’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ। ‘চাঁদ সদাগর’ (১৯৩৪) ছবিতে প্রথম সবাক ছবির দুনিয়ায় প্রবেশ। তবে, রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে কানন দেবীর বিপরীতে প্রথম নায়কের চরিত্র পান জহরবাবু। এরপর, আর পিছনদিকে তাকাতে হয়নি। নায়ক ও পরে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে একের পর এক- ‘শহর থেকে দূরে’, ‘যোগাযোগ’, ‘মানে না মানা’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘প্রিয়বান্ধবী’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘চিড়িয়াখানা’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে কয়েক দশকজুড়ে অসামান্য অভিনয়নৈপুণ্যে মাতিয়ে দিয়েছেন। মঞ্চাভিনয়ের ক্ষেত্রে ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘তটিনীর বিচার’, ‘পরিণীতা’, ‘শ্যামলী’, ‘অ্যান্টনী কবিয়াল’ ইত্যাদি বহু নাটকে তাঁর প্রতিভার নমুনা রেখেছেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়। ‘নটী বিনোদিনী’ নাটকে শেষবার মঞ্চে ওঠেন। ভালো গান গাইতে পারতেন। প্রবীন বয়সে ‘অ্যান্টনী কবিয়াল’ নাটকে ‘ভোলাময়রা’ চরিত্রে গানসহ দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন। মোহনবাগান ক্লাবের অন্ধ সমর্থক ছিলেন। এই ক্লাবের হকি-সচিবও হয়েছিলেন। বেতার ও রেকর্ডেও অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন।
- নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৩-২০১২) একজন গুণী সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক। ধ্রুপদ, ধামার, খেযাল, ঠুংরি ইত্যাদি রীতিমতো তালিম নিয়ে শিখেছেন। প্রথিতযশা বিভিন্ন সংগীতগুরুর কাছে সঙ্গীতশিক্ষা নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে আছেন ধ্রুপদিয়া অমর ভট্টাচার্য, বিনোদ মল্লিক, মণিলাল দাস, খেয়ালিয়া মেহেদি হাসান (রামপুর), কে.জি. ঢেকনে (গোয়ালিয়র), কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায় (রামপুর), সত্যেন সেন (পাতিয়ালা), রামদাস মিশ্র (বেনারস) প্রমুখ গুণীজন। উত্তমকুমারের এরকম একজন সংগীতগুরুকে নির্বাচন করা অত্যন্ত যথাযথ।
- প্রমথেশ বড়ুয়া (১৯০৩-১৯৫১) ছিলেন চলচ্চিত্রজগতের রাজকুমার। অসমের গৌরীপুরের রাজপরিবারে জন্ম। ১৯২৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক হন। ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মস লিমিটেডের বোর্ড অব ডিরেক্টরর্সের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন এবং এই প্রতিষ্ঠানের ছবি ‘পঞ্চশর’-এ ছোটো চরিত্রে অভিনয়ের প্রথম সুযোগ পান প্রমথেশ। ১৯৩০-এ প্যারিসে গিয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষা নেন। ফিরে এসে ১৯৩১-এ ‘বড়ুয়া ফিল্ম’ তৈরি করে ‘অপরাধী’ ছবি নির্মাণ করেন ও ঐ ছবিতে নায়করূপে অবতীর্ণ হন। প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত প্রথম সবাক ছবি ‘বাংলা ১৯৮৩’। ১৯৩৩ সালে নিউ থিয়েটার্স-এ যোগ দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন প্রমথেশ বড়ুয়া-মুক্তি, দেবদাস, গৃহদাহ, জিন্দেগী, অধিকার ইত্যাদি বেশকিছু অসাধারণ ছবি সৃষ্টি হল। এরপর, মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করেন এম. পি. প্রোডাকসন্স। ‘শেষ উত্তর’, ‘মায়ের প্রাণ’ মিলিয়ে অসাধারণ জনপ্রিয় কিছু ছবি উপহার দেন এই সংস্থা, যার পিছনের মূল কারিগর ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। বিয়ে করেছিলেন চিত্রাভিনেত্রী যমুনা বড়ুয়াকে। পরিচালকের পাশাপাশি এক অসম্ভব জনপ্রিয় ‘স্টার’ হিসেবেও তাঁর জীবদ্দশাতেই নিজেকেই তুলে ধরেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া।