।। একুশ।।
এ-সময়ে এ-সমুদ্রে কিছু ঝড়ঝঞ্ঝা থাকে। এবং চার পাঁচ দিন ধরে আকাশ গরম সিসের মতো, বিদ্যুতের ফালা ফালা আকাশফাটানো গুম গুম শব্দ। জাহাজ আবার কিছুদিন লাফিয়ে লাফিয়ে প্রায় দ্রুতবেগে কোন অশ্বারোহী পুরুষের দুর্গম বনভূমি পার হয়ে যাবার মতো ছুটে যাচ্ছে। হিগিনস তখনই ভেতরে ভীষণ পুলক বোধ করেন। তিনি ঝড়ের দরিয়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন। সিসের মতো আকাশের মেঘ এবং ঘন বৃষ্টিপাতের ভেতর নীল জলরাশির অজস্র সাদা ফেনা, এবং চারপাশে যেদিকে তখন চোখ যায় যেন, হাজার হাজার অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক জীব জলের নিচে ফুঁসে বেড়াচ্ছে। জলের রঙ নীল থাকছে না। একেবারে সাদা। পঁচিশ ত্রিশ ফুট উঁচু ঢেউ সব ফুঁসে ফুঁসে ফুলে ফুলে যত জাহাজটার দিকে এগিয়ে আসে তত এক মজার খেলা, ওরা পারে না। তাঁর এমন বিশ্বস্ত জলযানের সঙ্গে পারে না। ঢেউ কাটিয়ে ছোট শশকের মতো ঘাসের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে যেন ছুটে যাচ্ছে জাহাজটা। তিনি বুঝতে পারেন, এ-ভাবেই এক আকর্ষণ, যেন এই জাহাজ তখন জাহাজ থাকে না। কোনো ইতিহাসের বিশ্বস্ত অশ্বের মতো। আর তিনি অশ্বারোহী পুরুষ। সেই অশ্বারোহী পুরুষটি লাগাম ধরে আছেন। সমুদ্রের এইসব ঝড়ঝঞ্ঝা, বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালার ভেতর দিয়ে বেগে চালিয়ে জাহাজ মুক্ত আকাশের নিচে চলে এলে তখন সমুদ্র বিজয়ের কি যে আনন্দ! আহা, আনন্দ, আনন্দ ধরে না প্রাণে। হিগিনস সারা দিনমান নিজের সেই প্রিয় ডেকচেয়ারে বসে জাহাজ আর সমুদ্রের খেলা দেখতে দেখতে চোখ বুজে ফেলেন।
তখন কেউ পাশে এসে দাঁড়ালেও টের পান না, কেউ দাঁড়িয়ে আছে। যেন এই যে চলে আসা, এবং জাহাজ, ঝড়ঝঞ্ঝা সবই মহামহিমের ইচ্ছায় চলে, তবু কেন যেন সব কিছুর ভেতর নিজেকেই খুব বড় এবং সর্বময় ভাবতে ভাল লাগে। যত বয়স বাড়ছে, তত ভাবছেন, নিজেকে সর্বময় ভাবার ভেতর কি আর আছে! তত তিনি বুঝতে পারেন, যতই বয়স বাড়ক, নিজেকে সর্বময় ভাবতে না পারলে, বেঁচে থাকার আনন্দ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এবং এ ভাবে যখনই চিন্তা-ভাবনা ক্রমে মগজ কুরে খায়, তখন রাতের অজস্র নক্ষত্রমালার ভিতর দাঁড়িয়ে সমুদ্র এবং আকাশের মাঝামাঝি হাত তুলে বলতে ইচ্ছে করে তাঁর—ঈশ্বর, আপনার এই অসীম সমুদ্রে, আমার ছোট্ট জাহাজ সিউলব্যাংকে রক্ষা করুন। তিনি তাঁর অহংকারের জন্য ঈশ্বরের কাছে এ-ভাবে আবার কখনও ক্ষমা প্রার্থনার সময় নতজানু হয়ে নীরবে চোখের জল ফেলেন।
ন’দিনের দিন সিউল-ব্যাঙ্ক লিমন উপসাগরে এ-ভাবে নেমে এল। সামনে দেখা যাচ্ছে পানামা ক্যানেল অঞ্চলের সব পাহাড় শ্রেণী। ক্রমে তা মেঘের মতো সমুদ্রে ভেসে উঠছে। বোঝাই যায় না পাহাড়ের মাথায় খাল কাটা আছে। পাহাড়ের এত কাছে এসেও জাহাজিরা কিছু বুঝতে পারছিল না। জাহাজের স্পীড কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাহাজ এগুচ্ছে কি সেই ছায়া ছায়া পাহাড়টা এগিয়ে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। বিকেলের দিকে সিউল-ব্যাংক একেবারে পাহাড়ের নিচে এসে থেমে গেল। সমুদ্রের ঢেউ পাথর অথবা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। এবং সব সময় মনে হচ্ছে জলের গভীরে এ-ভাবে চারপাশে পাহাড় এবং পাথর ডুবে যাচ্ছে আবার ভেসে উঠছে।
আর সামনে, জাহাজিরা দেখল, লাইন দিয়ে সব জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে ও-পারে যাবে বলে। ছোটবাবু, জ্যাক কিছুতেই বুঝতে পারছে না, খালটা কোথায়। ডেবিড এলে বোঝা যেত। কিন্তু ডেবিডের এখন চব্বিশ ঘন্টা সতর্ক থাকতে হবে। কিনার থেকে সব মেকসিকান কুলি উঠে এসেছে। হাসিল এবং লোহার তার লম্বা করে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। সামনে পাঁচ-সাতশো গজ দূরে দুটো জাহাজ। তিনটে ছিল, এইমাত্র একটা কি করে যে হারিয়ে গেল। ঠিক যেন লাইন দিয়ে টিকিট কেনার মতো এবং হলঘরে ঢুকে যাওয়া। কিছু সময় গেলে অমিয় দেখতে পেল সেই হারিয়ে যাওয়া জাহাজটা ক্রমে এক আশ্চর্য যাদুবলে ওপরে উঠে যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথায় উঠে যাচ্ছে। এবং ওরা দেখতে পেল পাশে তেমনি আর একটা জাহাজ এভাবে পাহাড় থেকে নেমে আসছে। আর ওরা টের পাচ্ছে না, সেই সঙ্গে ওরাও যে এবার ধীরে ধীরে সেই বড় দুটো লোহার দরজা, প্রায় চিচিং ফাঁকের মতো, কোন এক যাদুবলে দরজা খুলে যাচ্ছে এবং সেই অতিকায় জাহাজ ঢুকে যাচ্ছে। দু’পাশে ট্রামলাইন বসানো। দু’পাশের ট্রাম জাহাজটাকে টেনে এক লক-গেট থেকে আর এক লগ-গেটে পৌঁছে দিচ্ছে। এবং এক সময় সূর্য অস্ত যাবার মুখে সিউল-ব্যাঙ্ক পাহাড়ের ওপর আশ্চর্যভাবে ঝুলতে থাকল। জলে ভেসে রয়েছে—সমুদ্র থেকে কিছুতেই বোঝা যায় না। যেন সহসা জাহাজটা পাখা গজিয়ে গেছে। এবং পাখায় ভর করে ভেসে রয়েছে ওপরে।
জাহাজিরা দেখল, অনেক নিচে আবার তিন-চারটে জাহাজ, লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা যে জাহাজটাকে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসতে দেখেছিল, সেই জাহাজ যেন খানিক সময় একটা বিপদের মুখে পড়ে চুপচাপ ছিল, পাহাড় থেকে নেমেই আবার তরতর করে সমুদ্রে ভেসে চলেছে। আর কি ছোট দেখাচ্ছে জাহাজগুলোকে। কাগজের নৌকার মতো ভাসতে ভাসতে সমুদ্রে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
এখন দু’পাশে শহর। কোলেন শহর। খুব বেশি সময় ওরা শহর দেখতে পেল না। ওরা একটা হ্রদের মতো অঞ্চলে ঢুকে গেল। ছোটবাবুর মনে হল তখন পূর্ববঙ্গের বর্ষাকালের মতো পানামা উপত্যকার এ অঞ্চলটা। চারপাশে ছোট ছোট ঢিবি, ঘাস বনজঙ্গলে সবুজ হয়ে আছে, এবং নীল জল, অর্থাৎ পাহাড়ের উপত্যকায় মনে হয়, এক বর্ষাকাল, যেন জাহাজিরা উঁকি দিলে জলে পুঁটিমাছ ডারকিনা মাছ পর্যন্ত দেখে ফেলবে। আর সব গাছপালা দেখলে মনে হবে, সেই লক্ষ্মীপুজোর দিনে ছোটবাবু যেমন টুনি ফুল খুঁজতে যেত তার মায়ের জন্য, এও যেন এক পৃথিবী যেখানে সে এই বড় জাহাজ নিয়ে টুনি ফুল খুঁজতে বের হয়েছে। হাত দিলেই প্রায় যেন সেই সব নানা বর্ণের ফুল সে তুলে আনতে পারে। মনেই হয় না জীবনে এমন দৃশ্য সে কোথাও আর দেখতে পাবে।
এভাবে কত কিছু মনে হয়। জাহাজিরা এখন সব রেলিঙে দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্যাবলী কোথায় আর দেখা যাবে। সমুদ্র থেকে ওরা এখন অনেক উঁচুতে রয়েছে। ওরা যেন প্রায় বলতে গেলে ডাঙ্গার ওপর দিয়ে জাহাজ চালিয়ে নিচ্ছে। দু’পাশের কৃত্রিম হ্রদে সব জলাধার দেখলে বিশ্বাসই হবে না মানুষের তৈরী এমন একটা সমুদ্র পারাপারের ভেতর অজস্র গাছপালা আর তার ছায়ায় সিউল-ব্যাঙ্ক হেলে দুলে যেতে পারে। খুব ধীর গতি। বেশি স্পীডে চলতে পারছে না। এমন কি মনে হয় প্রপেলার খুব জোরে ঘুরলে নিচের ঘোলা জল উপরে উঠে আসবে। খুব ধীর গতিতে সুমহান জাহাজ সিউল-ব্যাঙ্ক যাচ্ছে। তার ভেতর রয়েছে কলকব্জার মতো জাহাজিরা। সে আছে বলেই যারা আছে, এবং রক্ত সঞ্চালনের কাজ যারা করে থাকে—সেই সব ছোট ছোট মানুষদের সুখ-দুঃখ এমন একটা গ্রাম গ্রাম জায়গায় না এলে টের পাওয়া যায় না। বোঝা যায় এখন, এরা সবাই প্রায় গ্রামের মানুষ, শাকান্ন এদের ভীষণ প্রিয়। এবং এই প্রথম জাহাজিরা দেখল সিউল-ব্যঙ্ক সার্চ লাইট জ্বালিয়েছে। রাতের বেলায়, ঠিক নদীতে স্টিমারের মতো দু-পাড়ের ঢিবি, বনজঙ্গল, আলো ফেলে দেখছে।
রাত আটটা পর্যন্ত ছোটবাবু দাঁড়াতে পেরেছিল। ডাইনিং হলে খাবার সাজানো হচ্ছে। এখন রাতের পোশাক পরে খেতে যেতে হবে। ছোটবাবুর রাতের পোশাক বলতে কিছু নেই। কোলন বন্দরে জাহাজ থামেনি। বলবোয়া বন্দরেও জাহাজ থামবে না। নিউ-প্লাইমাউথ না যাওয়া পর্যন্ত কিছু হবে না। ডেবিড ছোটবাবুকে কিছু পোশাক দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ছোটবাবু যেই পরে বের হল, সঙ্গে সঙ্গে জ্যাক হেঁসে বাঁচল না। একেবারে জোকারের মতো। ঢোলা খাট বেঢপ পোশাকে নিজেই কিঞ্চিৎ বিমূঢ় হয়ে গেছিল।
খাবার টেবিলে ছোটবাবুর অসুবিধা হত। সে মাথা গুঁজে খেত। কেমন সঙ্কোচ হত। কাঁটা চামচের ব্যবহার সে জানত না। ডেবিড তাকে ভীষণ সাহায্য করে আসছে। এবং টেবিল ম্যানার্স বলতে যা কিছু জেনেছে সবই ডেবিডের সাহায্যে! এখন পোশাকের জন্য অথবা টেবিল ম্যানার্সের জন্য ততটা সঙ্কোচ বোধ করে না। কাপ্তান এখন প্রায় তার সঙ্গে কথা বলেনই না। জ্যাকও চুপচাপ খেয়ে উঠে যায়। খেতে বসলে মনে হয় না জ্যাক ছোটবাবুকে চেনে। আর এই যে ছোটবাবু জাহাজে ছ’নম্বর হয়ে গেল, তাতে জ্যাকের কিছু আসে যায় না। কেবল প্রথম দিন যখন ডেকে বের হয়ে জ্যাক হেঁটে যাচ্ছিল, কাকে যেন খুঁজছে চারপাশে এবং দেখে ফেলেই না দেখার মতো, কিছুটা সহজ স্বাভাবিক কথা বলার মতো, তুমি এখানে ছোটবাব!
তাড়াতাড়ি ছোটবাবু উইনচের নিচে থেকে বের হয়ে বলেছিল, জ্যাক আমি এখন এনজিন রুমের ছ’নম্বর। দেখা হয়নি বলে খবরটা দিতে পারিনি। জ্যাক কোন কথা বলল না। সামান্য হাসল।
—তোমার ঠিক নিচের কেবিনে আছি।
—সত্যি!
—সত্যি, তুমি জান না আমি যে নিচে রয়েছি?
—না, তুমি কী ছোটবাবু! তারপর বলার ইচ্ছে হয়েছিল, আমি জানব না তুমি কোথায় আছ! তোমার কেবিনে কোথায় কি আছে, লকারে তোমার কি আছে তুমি দেয়ালে কি টানিয়েছ, আমি সব জানি। দেয়ালে তোমার মায়ের ছবি টানিয়ে রেখেছ ছোটবাবু। তোমার কেবিনের কোথায় কি আছে, আমি তোমার চেয়ে ভাল জানি।
ছোটবাবু ডেকেছিল, জ্যাক
জ্যাক বলেছিল, কেমন লাগছে?
—বেশ ভাল লাগছে। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
জ্যাক বলেছিল, কি বিশ্রী ওয়েদার।
ছোটবাবু কেমন থতমত খেয়ে বলেছিল, তাই।
জ্যাক বলেছিল, মনে হয় আকাশে আর কখনও সূর্য উঠবে?
তখন বিশ্রী আকাশ, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলকণা সব বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। ছোটবাবুর পোশাক প্রায় ভিজে গেছিল।
জ্যাক বলেছিল শুধু, এভাবে ভিজে জামা-প্যান্ট পরে থাকলে অসুখ করবে তো।
—শুকোয় না। নিউ-প্লাইমাউথ থেকে কিনে নেব।
—কেন তাহিতিতে কিনতে পারবে।
—নামা যাবে?
—খুব যাবে।
ছোটবাবুর দুটো কাজের পোশাক। বয়লার সুট সে তাহিতি থেকে কিনে নেবে ভেবেছিল। কিন্তু নামতে পারবে কি পারবে না সে জানত না। মাঝরাতে জাহাজ আবার খাল ধরে লক-গেট ধরে প্রশান্ত মহাসাগরে নেমে যাবে কথা আছে। তখন ডেবিড একা বোট-ডেকে, সে সারাক্ষণ দূরবীন নিয়ে জেগে থাকবে। ছোটবাবু খুব ছেলেমানুষ বলে সকাল সকাল ঘুম পায়। বেশী রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পারবে না। ডেবিড কত বলেছে, আবার কবে পানামা খালে আসবে, কখনও আসতে পারবে কিনা তাও ঠিক কি, দেখে নাও। আমি তো যেখানে যতবার যাই বসে থাকি। রাত জেগে বসে থাকতে আমার ভাল লাগে ছোটবাবু। খালের পাড়ে পাড়ে প্রশান্ত মহাসাগরে নেমে যাবার আগে আবার আমরা শহর পাব। তুমি একটা দারুণ চান্স মিস করবে জেগে না থাকলে।
ছোটবাবু তবু ঘুমিয়ে পড়েছিল। যদিও ইচ্ছে হয়েছিল, ঘুমিয়ে পড়ার আগে একবার চুপি চুপি আফটার-পিকে যাবে। সেখানে গেলেই সে দুটো ভাত খেতে পায়। বাঁধাকপি ভাজা দিয়ে ভাত। কারণ অফিসার্স গ্যালিতে ইংলিশ মেনু। রাইস কারি সপ্তাহে মাত্র একদিন। সেদিন ছোটবাবুর উৎসবের মতো ভোজ। তাছাড়া ওর মনে হয় বাকি ছ’দিন প্রায় না খেয়ে আছে। ভাত না খেলে তার কিছুতেই পেট ভরে না। কখনও কখনও গোপনে মৈত্র একটা প্লেটে ভাত মাংস দিয়ে যায়। সে নিজের কেবিনে চুরি করে দরজা বন্ধ করে কোনরকমে খেয়ে হাত মুখ সাবানে ধুয়ে ফেলে। আর প্লেটটা কাজে যাবার আগে জামার নিচে ভরে নেয়। অমিয়, সারেঙসাব, মনু, মান্নান যেই আসুক, কথা বলার অছিলায় দিয়ে দেয়। প্লেট বের করে চার পাশে সতর্ক নজর রাখে—এই তাড়াতাড়ি নিয়ে যা। মৈত্ৰদাকে দিবি। দিয়েই আবার উইনচের তলায়। স্ট্রেপারগুলো খুলে মেরামত করার দরকার। এবং তখন মনে হয় জ্যাক কিংবা ডেবিড এবং এমন কি পাঁচ নম্বর পর্যন্ত ভাত না খেয়ে থাকে কি করে! সে তো পেট ভরে দুটো ভাত খাবে বলে জাহাজের এমন একটা কাজে চলে এসেছিল। অথচ নসিব এমন, শেষ পর্যন্ত, সেই ভাত রোজ কপালে জুটছে না। সে নিজের নসিবের কথা উইনচের তলায় শুয়ে শুয়ে এভাবে কখনও ভাবত। চিল্ড গ্রুেপ-ফ্রুট, ওটমিল-পরিজ, পরিজটা মন্দ লাগে না। এরা ঝাল-ঝোল একেবারে খায় না। খেতে কি যে বিস্বাদ। ব্রেক ফাস্টে ফ্রাইড-এগ খেতে তার ভাল লাগে। বেকন খাবার সময় তো প্রায় বমি আসার মতো। কি রকম সব গন্ধ—এত সুন্দর রং-বেরংয়ের খাবার খেতে এমন বিস্বাদ সে জানত না। পালিয়ে পালিয়ে ভাত, ভাত না খেলে রাতে ঘুম আসে না ছোটবাবুর। একটু রাত করে আজ অমিয় এক প্লেট ভাত, সারডিন মাঝের ঝোল, সরষে বাটা দিয়ে কি যে রেঁধেছে ভান্ডারী জ্যাঠা। সে এত খেয়েছে যে খাবার পরই চোখ জড়িয়ে আসছিল। ডেবিডের সঙ্গে কিছুতেই ডেকে জেগে থাকতে পারেনি। বড় বড় ঢেঁকুর তুলে জোরে পাখা চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভীষণ গরমে এমন ঘুমটা মাটি হবার আশঙ্কাতে সে ফুল স্পীডে পাখা চালিয়ে শুয়েছে।
বেশ গভীর রাতে মনে হল, কেউ তাকে ডাকছে। খুব ফিসফিস গলায়।
—এই ছোটবাবু সে চোখ মেলে বুঝতে পারল না কে ডাকছে। দরজা লক করা। তার সুন্দর মেহগিনি কাঠের বাংক। রোজ সাদা দামী চাদর পাল্টে দিয়ে যায় মেস-রুম-বয়। মায়ের ছবিটা এ-ঘরে টানাতে পেরে সে ভীষণ খুশী। লকার কাঠের। বড় আয়না। শুয়ে থাকলে সবটা আয়নায় দেখা যায়। সে জেগে গেলে বুঝল, আলো জ্বালিয়ে সে ঘুমোচ্ছিল। আয়নায় সে দেখল তার পোশাক বলতে প্রায় খালি গা। ঘামে জবজবে ভেজা শরীর। সে উঠে বসল। কেউ ডেকেছে। দরজা বন্ধ। ভেতরেই কেউ আছে তার মনে হল, একেবারে যেন কানের কাছে কেউ এসে ডেকেছে, এই ছোটবাবু, তুমি ঘুমোচ্ছ!
তারপরই সে দেখে অবাক, পোর্ট-হোলের কাঁচ খোলা, পর্দা সরিয়ে জ্যাক ওকে দেখছে। ও প্রথমে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিল এত রাতে জ্যাকের হঠাৎ এ-ভাবে ঝুঁকে থাকা পোর্ট-হোলে সত্যি ভয়ের। সে বলল, ওঃ তুমি!
সে ওর তোয়ালে দিয়ে সারা শরীরের ঘাম মুছল। সে খুব কাছে গিয়ে বলল, কী ব্যাপার!
—তুমি ঘুমোচ্ছ!
—কেন কি হয়েছে!
—আমি, ডেবিড বসে আছি। তুমি আসবে না?
—খুব ঘুম পাচ্ছে জ্যাক।
—সকালে তো আবার সমুদ্র। তোমার ডাঙা দেখতে ভাল লাগে না!
সে কি করে বলবে, কিছুদিন পর পর ভাত খেলে নেশার মতো হয়। সে যে ওর কেবিনে আজ পেট ভরে ভাত খেয়েছে। দুবার ভাত চেয়ে পাঠিয়েছে। এত লোভ ভাল না ছোটবাবু একবার বন্ধু হেসে এমন বলেছে, তুমি আমাদের ভাতে কম ফেলে দেবে। আসলে সে আজ তিন চারদিন পর প্রায় ভাত খেয়েছে। আকন্ঠ খেয়ে কেবল ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। ডাঙা সমুদ্র তার কাছে এখন সমান। সে বলল, কি আছে?
—আবার আমরা খালের ভেতর ঢুকে গেছি। শহর দেখা যাচ্ছে।
—আর কিছু না?
—না।
—তবে আর যাচ্ছিনে। বলেই সে লাফ দিয়ে ফের বাংকে শুয়ে পড়ল। বাংকে সে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল।
জ্যাক বলল, দূরবীনে সেকেন্ড কি সব চুরি করে দেখছে!
—তুমি দেখছ না!
—চাইলে দিচ্ছে না।
—ডেবিড তো ভারি স্বার্থপর।
—ভীষণ। তুমি গেলে তোমাকে দিতে পারে।
আর তখনই মনে হল জ্যাক তবে আর আগের মতো নেই। বড় হয়ে যাচ্ছে জ্যাক। তারও বুঝি মেয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। এতদিনে যেন জ্যাক আরও লম্বা হয়ে গেছে। যত লম্বা হচ্ছে, তত সে তার পোশাক কিম্ভূত কিমাকার করে ফেলছে। জ্যাকের পোশাক দেখে তারও মাঝে মাঝে কম হাসি পায় না। সে বলল, দাঁড়াও ডেবিডকে একা একা দেখা বের করছি। বলেই সে বের হয়ে গেল। যেহেতু ওর কেবিনটা নিচে, ওকে সিঁড়ি ধরে বোট-ডেকে উঠে যেতে হল। জ্যাক আসছে ওপাশ দিয়ে। সে গ্যাঙ-ওয়ে ধরে সোজা ব্রীজের সামনে চলে যাবে। এবং জ্যাক ও-ভাবে সিঁড়ি ধরে উঠে আসার আগে সে ডেবিডের কাছে পৌঁছে যাবে। আর এটা ছোটবাবু দেখেছে, জ্যাক এলি-ওয়ে ধরে কখনও আসে না। জ্যাক তো ইচ্ছে করলেই ওর দরজায় নক্ করতে পারত। সে তা না করে, ও- পাশে, জাহাজের বাইরের দিকটায় সে দাঁড়িয়ে থাকে। এলি-ওয়েতে জ্যাক কেন যে আসে না! আসলে কি জ্যাক এলি-ওয়েতে ভয়ের কিছু দেখে ফেলেছে! সে যেমন দেখে ফেলে দৌড়েছিল!
ছোটবাবু ডেবিডের ঠিক সামনে গিয়ে বসল। জ্যাক সিঁড়ি ভেঙে ছুটে আসছে। ছোটবাবু বলল, তুমি ভারি স্বার্থপর ডেবিড। জ্যাককে দেখতে দাওনি।
—জ্যাক না দেখলে আমি কি করব।
—কিছু দেখলে?
—না।
—আমাকে দাও। যদি পেয়ে যাই।
সেকেন্ড বলল, দ্যাখো। এবং ওরা তিনজন পাশাপাশি বসে বলবোয়া বন্দরের শহর, ইট, কাঠ, গীর্জা, এবং গাছপালা, দূরের বিন্দু বিন্দু আলোর মালা, কখনও সামনে একেবারে সামনে ওরা দেখতে পাচ্ছে শহর ধরে একটা গাড়ি, ছায়া ছায়া অন্ধকারে ওরা কি করছে। ছোটবাবু বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি দ্যাখো।
সেকেন্ড দূরবীনটা চোখে লাগিয়েই চিৎকার করে উঠল, ওম্যান।
—যা!
—হ্যাঁ দ্যাখো।
ছোটবাবুর ইচ্ছে হল জ্যাক দেখুক। কারণ জ্যাক বড় হচ্ছে। সে বললে, তুমি দ্যাখো জ্যাক। জ্যাক বলল, না তুমি দ্যাখো।
ছোটবাবু তখন দেখল—একটা গাড়ি। দু’জন মানুষের ছায়া, পুরুষ না মেয়ে, কি দুজনেই মেয়ে, কি দুজনেই পুরুষ, বোঝা যাচ্ছে না। এবং নিভৃতে পার্কের পাশে রাস্তায় ওরা দুজন। ওরা এই এমন গ্রহে বেঁচে আছে, তারা যাই হোক, পুরুষ রমণী হওয়াই ভাল, কারণ, সে বুঝতে পারছে, নারীজাতি মানুষের বড় প্রিয়। প্রিয় বলেই পুরুষ রমণী ভাবতে ভাল লাগছে। সে বলল, আর দেখা যাচ্ছে না। আসলে জাহাজ ক্রমাগত দু-তীর পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে।
এবং এ-ভাবে জ্যাক যা চাইছিল, একটু ছোটবাবুর সান্নিধ্য। এটুকুর জন্য সে ওকে ডেকে এনেছে। ওর পাশে বসে থাকতে জ্যাকের ভাল লাগছে। কিছুক্ষণের ভেতর জাহাজ সমুদ্রে পড়বে। ডেক-জাহাজিরা জেগে রয়েছে। সেকেন্ড-অফিসার, ডেবিড এবং চিফ-অফিসার জাহাজিদের নিয়ে ছোটাছুটি করছে। এমন মধ্যরাতে জ্যাক দূরে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেল। সেই সব দ্বীপ, যেমন হনলুলু অথবা পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জমালা থেকে বাতাস দ্রুত ছুটে আসছে। বাতাসের সঙ্গে আসছে অজস্র সমুদ্রের ঢেউ, ওরা প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে কি যে সুহাস গতিতে ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। জ্যাকের মনে হল, প্রায় কাব্যগাঁথার মতো, নীল জলে ছোট একটা সাদা রঙের বোট, লাল রঙের পাল, একপাশে ওরা দুজন, এবং ক্রমে কি করে যে সে দেখতে পেল, বিন্দু বিন্দু হয়ে যাচ্ছে সব ঢেউ-এর জলকণা, তার ভেতর দিয়ে ছোটবাবু বোট এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এবং জ্যাক সহসা প্রায় আর্তনাদের মতো চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল—ছোটবাবু তুমি মরে যাবে। কিন্তু তখনই মনে হল ছোটবাবু তার বনবাস সহজেই স্বীকার করে নিয়েছে। কি নিশ্চন্ত মুখ চোখ। ঢেউয়ের ভেতর বোট ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রে আর সেই ভাঙা জাহাজটাও দেখা যাচ্ছে না। কেবল জ্যাক কেন যে দেখতে পেল, দূরে একটা পাখি আকাশের নিচে চক্রাকারে উড়তে উড়তে নেমে আসছে। সেই বড় পাখি, অতিকায় যার ডানা, যেন আকাশ জুড়ে সে নেমে আসছে। সাদা রঙের অতিকায় এ্যালবাট্রস বোটের একপাশে বসতেই বোটটা কেমন নড়ে উঠেছিল।
যখন দূরবীনে ছোটবাবু শহর দেখছিল, তখন দু হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে দিয়েছিল জ্যাক। এবং মাথা গুঁজে সে কি আজগুবী দৃশ্য দেখে ফেলল। আর যা হয়, এমন কেন যে সব দৃশ্য সে চোখের ওপর ভাসতে দেখল! ছোটবাবুকে বললে, ছোটবাবু পর্যন্ত ভয় পেয়ে যাবে। সে জানে ছোটবাবু সহজ সরল মানুষ, সহজেই ভয় পায়। ছোটবাবুর মুখ দেখলেই এটা সে বুঝতে পারে। এবং ছোটবাবু ভয় পাবে বলেই যেন এমন একটা দৃশ্য সে দেখেছে বলা ঠিক হবে না। কেবল ডেবিডকে সে বলতে পারে।
কিন্তু সকালে যখন সিউল-ব্যাংক সমুদ্রে ভেসে গেছে আবার, তীর দেখা যাচ্ছে না, ঝিকঝিক শব্দে সিউল-ব্যাংক আপন গতিবেগে নির্ভাবনায় বেশ চলেছে, জাহাজিরা শেষ ডাঙা দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছে, আর দেখা যাচ্ছে না কিছু, কেবল নীল জল, নীল আকাশ এবং সমুদ্রের প্রশান্ত চেহারা তখনই জ্যাক দেখল, অনেক দূরে, প্রায় দিগন্তের কাছাকাছি দুটো বিন্দুর মতো সাদা রঙের কিছু ভাসছে। এমন নীল আকাশে দুটো বিন্দুর মতো সাদা রঙ নড়ছে দেখে, দৌড়ে সে চার্টরুমে উঠে গেল। এবং এই প্রথম সে বাবার দূরবীনটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকল—হ্যাঁ নড়ছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ও দুটো কি। তবু মনে হয় দুটো পাখির মতো। দুটো পাখি আকাশের গায়ে যেন ঢেউয়ের মতো কাঁপছে। আর উড়ে উড়ে ওরা এদিকে আসছে।
ছোটবাবু তখন চড়ুই পাখি দুটোকে খাওয়াচ্ছিল। সকালের চা এসেছে। চা, একটা আপেল, দু’টুকরো স্যান্ড উইচ এবং কলা। উইনচের ভেতর থেকে বের হয়ে সে ময়লা হাত ঝেড়ে নিল, এবং কোনরকমে কিছুটা খেয়ে পাখি দুটোকে শিস দিয়ে ডাকল। শিস দিলেই ওরা চলে আসে। জ্যাক এখন খাওয়ায় তাদের। সেও। কিন্তু জ্যাক ব্রীজে দূরবীনে কি দেখছে। সেই কখন থেকে জাহাজের পেছনের দিকে সে তাকিয়ে আছে। এত কি দেখছে জ্যাক। জ্যাক পরেছে সুন্দর হলুদ রঙের বয়লার স্যুট। চোখে দূরবীন। সকালের সূর্য এই সমুদ্রে এবং জাহাজের চারপাশে ক্রমে ওপরে উঠে যাচ্ছে। বোট-ডেক থেকে জ্যাকের দূরবীনে এ-ভাবে দেখা সত্যি বিস্ময়ের। আগে হলে সে চিৎকার করে বলত, জ্যাক আমি এখানে। ইচ্ছে করলে ছুটে চলেও যেতে পারত বোট-ডেকে, কিন্তু এখন পারবে না। কারণ আর্চি ক্রমে ওর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। তার সব কিছু গোপনে যেন লক্ষ্য রাখছে আর্টি। এবং ক্রমে সে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছে, সেকেন্ড এনজিনিয়ার আর্চিকে খুশি করতে না পারলে তার এই সমুদ্র সফর বৃথা। সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আপ্রাণ সে খেটে যাচ্ছে। তবু ঠিকমতো সে, দক্ষ কারিগরের মতো সব কাজ পারছে না বলে, আর্চি ভীষণ বিরক্ত। আর্চি কাছে এসে দাঁড়ালেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়।
সে নড়তে পারল না। কেবল পাখি দুটোকে সকালের খাবার খাইয়ে সে ফের উইনচের ভেতর ঢুকে গেল। এখন ওর সারা হাতে মুখে কালি। একটা বলতিতে নানা সাইজের স্প্যানার। নাট বোল্ট। কেরোসিন তেল। সে নাট খুলে—কারণ দু’চারদিন যেতে না যেতে এই যেমন কোন উইনচের গিয়ার খারাপ, বিয়ারিং লুজ, একজস্ট স্টীম ঠিকমতো ক্লিয়ার হচ্ছে না অথবা হুইল জ্যাম হয়ে যাচ্ছে, এ- সব কাজ তাকে করতে হয় বলে বেশ সময় লেগে যায় একটা কাজ শেষ করে উঠতে। যখন সে নাট বোল্ট ভেতর থেকে খুলে আনে তখন একটা সে বড়রকমের কাজ করতে পারল বলে ভেবে থাকে। এবং সে কাজটা খুব খেটে মনোযোগের সঙ্গে শেষ করে যখন অপেক্ষা করে মেজ-মিস্ত্রি এসে দেখবে, তখন কেবল প্রার্থনা, হে ঈশ্বর হাতের কাজ দেখে তিনি যেন খুশী হন। কিন্তু হলে কি হবে, আর্চি এলেই, ওর মুখ শুকিয়ে যায়! এবং নির্ঘাত এসেই গিয়ার টেনে বালব ছেড়ে উইনচ চালিয়ে হঠাৎ ক্ষেপে যান। একেবারে জ্যাম। ঘুরছে না। ছোটবাবু কিছুতেই বোঝে না, কেন এমন হয়। সে নিজে বালব্ ঘুরিয়ে দেখেছে—সব ঠিকঠাক, লুজ নেই। টাইট ফিটিঙ, আর মেজ-মিস্ত্রি এসে ধরতেই সব কেমন গুবলেট হয়ে যায়। তার তখন ভয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আর অকথ্য গালিগালাজ দু’একদিন থেকে সবে শুরু করেছে। ছোটবাবু এ-সব একেবারে গ্রাহ্য করে না। কেবল মৈত্রদা অথবা অমিয় না শুনে ফেলে। শুনে ফেললেই মেজ-মিস্ত্রিকে অপমান করে বসতে পারে। তা হলে কি যে একটা কেলেঙ্কারী হবে! ভয়ে মুখ এ-জন্য আরও বেশি শুকিয়ে যায়।
তখন জ্যাক দাঁড়িয়েই আছে। নড়ছে না। সিউল-ব্যাংক যাচ্ছে, ক্রমে জলে ভেসে যাচ্ছে। একটা প্রাচীন যান্ত্রিক দানবের মতো নীল জলরাশি ফালা ফালা করে ভেসে যাচ্ছে। এবং জ্যাকের পলক পড়ছে না। কাপ্তানবয় জ্যাকের আপেল কলা স্যান্ড-উইচ একটু বাদেই রেখে যাবে। এখন ওর চা খাবার সময়। আর একঘন্টা পরে ব্রেকফাস্ট। সে কেমন দূরবীনে চোখ লাগিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেবল পাখি দুটোর এগিয়ে আসা দেখছে। তার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, কাপ্তান বয় দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশে, কিছুই লক্ষ্য করছে না।
জাহাজিরা যে যার কাজ করে যাচ্ছে, এই যেমন সারা ডেকে জল মারা। একদল জাহাজি কাঠের পাটাতনে হলিস্টোন মারছে। ডেক-টিন্ডাল হাঁকছে, মারো টান হাইয়, জোরে মারো হাইয়। ডেরিক মাস্তুলের কাছাকাছি ছিল, সব খুলে নিচে ফল্কার ওপর ফেলে রাখা হচ্ছে। এমনি সব টুকিটাকি কাজ সব চলছে। ডেক-ভান্ডারি এনজিন-ভান্ডারী খুব তাড়াহুড়ো করছে। ওয়াচের লোক উঠে আসবে। সকালের চপাটি এবং গোস্ত সেদ্ধ এ-সময়ের ভেতর করে না ফেলতে পারলে চিল্লাবে জাহাজিরা। চিফ-কুক লোহার গনগনে চুল্লিতে দুটো আস্ত মুরগী মাখন মাখিয়ে রোস্টের জন্য ভরে দিচ্ছে ভেতরে। লাঞ্চের মেনু দেখে দেখে সব ঠিক করতে হচ্ছে। স্টুয়ার্ড খাবারের স্টক—রেজিষ্ট্রার খুলে—কি আছে কি কমে আসছে, এখন জাহাজ হাজার মাইলের ওপরে এক নাগাড়ে চলবে, মোটামুটি তাহিতিতে পৌঁছবার আগে সব ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে নিচ্ছে। রেশন খুব সকালে বের করে দিয়েছে। জমাখরচ বসে বসে লিখছে। সমুদ্রের বুকে এখন এদের এ-সব কাজকর্ম দেখলে মনেই হয় না, দেশবাড়ি বলে কিছু আছে তাদের—এরা সবাই যেন সিউল-ব্যাংকের শিরা উপশিরা। এবং এ-ভাবে ওদের কাজকর্ম সিউল-ব্যাংকের রক্ত সঞ্চালনের মতো। নিচে আগয়ালাদের মুখ দেখলেই বুঝা যাবে কি কঠিন শ্রমে আপ্রাণ জাহাজের স্টীম ঠিক রাখার জন্য লড়ে যাচ্ছে।
ছোট-টিণ্ডালের ওয়াচ এখন। এনজিন-রুমে আলি তেল যোগাচ্ছে। বড় বড় সব পিস্টন রড একেবারে রুপোর পাতে মনে হয় মোড়া, কি উজ্জ্বল এবং আর কি দানবের মতো ওঠানামা, এরই ফাঁকে প্রতিটি জয়েণ্টে ভীষণ মনোযোগের সঙ্গে তেল ঢেলে দিচ্ছে আলি। একটু অন্যমনস্ক হলেই হাত টেনে নিচে ফেলে দেবে—এবং হাড় মাংস অস্থি পিণ্ডাকারে পড়ে থাকবে ক্র্যাংক-ওয়েভের নিচে। গ্রিজার আলির চোখ ভীষণ সজাগ। তার অয়েল ক্যান ঠিক তালে তালে নিচে ওপরে নামছে উঠছে। একটু অন্যমনস্ক হলেই সব গেল।
আর তখনই আসছে। সেই দুটো সাদা মতো পাখি ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওরা জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে। পাখি দুটো ক্রমে এত বড় হয়ে যাচ্ছে কেন! প্রায় আকাশ জুড়ে ডানা মেলে রেখেছে! যেন দুটো সি-প্লেন। তাড়াতাড়ি চোখ থেকে দূরবীন খুলে ফেলতেই দেখল, না এত বড় দেখাচ্ছে না। এখনও বেশ দূরে রয়েছে। এবং ওরা যে জাহাজের পেছনে উড়বে এটা বোঝাই যাচ্ছে। তবু মনে হয় পাখি দুটো ঠিক আর দশটা পাখির মতো নয়। এমন অতিকায় যে, জ্যাক সমুদ্রে কখনও এত বড় এ্যালবাট্রস দেখেনি। দূর থেকেই যা মনে হচ্ছে, কাছে এলে কি বড় না জানি মনে হবে! সে আবার চোখে দূরবীন লাগালেই কাপ্তান-বয় বলল, সাব টি।
জ্যাক বুঝতে পারল, কাপ্তান-বয় আবার চা এনেছে। সে তাড়াতাড়ি যেন কোনরকমে চা খেয়ে আবার দেখতে থাকল। ওরা আসছে। এবং প্রায় সে ওদের ঠোট, চোখ দেখতে পাচ্ছে। চোখ নীল রংয়ের। থাবা বেশ বড়। অতিকায় ঈগল পাখির মতো। ওরা জাহাজের চার-পাশে চক্রাকারে ঘুরতে থাকল। ওদের পিঠের রং সোনালী। তারপর ওরা জাহাজের পেছনে জলের ওপর একবার বসল, কি তুলে নিল মুখে। দুটো ছোট মাছ। প্রপেলার জল ভেঙ্গে গেলে দুটো একটা মাছ মরে যায়, জলে ভেসে ওঠে। ওরা দুটো-একটা মাছের লোভে চলে এসেছে। এবং জ্যাক আশ্চর্য, এমন সুন্দর দুটো পাখি আবার কেন উড়তে থাকল, এবারে উড়ে আসছে ঠিক মাস্তুলের ডগায়, আর তখনই সে দেখল চিৎকার করতে করতে যাচ্ছে ডেবিড, ওহো—নো নো।। ছোটবাবু পাগলের মতো ছুটে আসছে—সেকেণ্ড দ্যাখো। সে হাত তুলে দেখাল সমুদ্রে।
সেকেণ্ড দেখে কি করবে ভেবে পেল না।
ছোটবাবু বলল, প্লিজ কিল দেম।
এখন একমাত্র ওদের গুলি করে নামান যায়। সে ডাকল নিচ থেকে, জ্যাক—শিগগির।
জ্যাক বুঝতে পারল না। আর সে ছুটে যাবার সময় আবার একটা ধূর্ত মুখ, সেই ধূর্ত চোখ, যেন আড়ালে ছুটে এসেছে ওপরে, টাংকির ওপাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে বলছে, ইউ নটি গার্ল!
সঙ্গে সঙ্গে জ্যাক চিৎকার করে উঠবে ভাবল, নো, মি বয়। কিন্তু যত জোরে বলবে ভেবেছিল, ঠিক ততটা গলা আস্তে হয়ে গেল। বলল, নো, মি বয় আর্চি।
আর্চি দাঁড়িয়ে গেছে, একেবারে স্থবির। সে যেন আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। ইউ নটি গার্ল। গার্ল। নো, মি বয়। মি বয়।
জ্যাকের হাত-পা শক্ত হয়ে গেল। চোখ ঝাপসা। আতঙ্কে হাত-পা কাঁপছে। সে দেখতে পেল না, বড় এ্যালবাট্রসটা মরিয়া। মিসেস স্প্যারোকে থাবায় তুলে নেবে বলে নেমে আসছে। কি দ্রুত গতি! গ্লাইড করতে থাকলে, ছোটবাবু একটা বড় ঢিল নিয়ে ছুটছে পিছু পিছু। যেন মিসেস স্প্যারোকে ডানার ভেতর আটকে ফেলেছে। আর ডেবিড লাফ দিয়ে সেই পাখার নিচ থেকে ভাবল, চড়ুই পাখিটাকে ছিনিয়ে নেবে, সে নিলও, কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে, ওর পিঠের জামা ফালা ফালা করে কিছুটা মাংস তুলে নিয়ে গেছে। মুহূর্তের ভেতর এমন ঘটল। জাহাজিরা ছুটে এসেও কিছু করতে পারল না। সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করে পাখিটা আবার কেমন নির্ভাবনায় উড়ে যাচ্ছে। চড়ুই পাখিটাকে কব্জা করতে পারল না বলে যেন আক্রোশে ডেবিডকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়ে গেল।
ডেবিড হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল। চারপাশে জাহাজিরা ঘিরে ধরেছে। মিসেস স্প্যারো রক্ষা পেয়েই একেবারে জালির ভেতর। মিঃ স্প্যারো বের হচ্ছে না ভয়ে। ডেবিডের জামা ছোটবাবু খুলে দিচ্ছে। চীফ-অফিসার ছুটে এসেছে, এবং ডেবিডের এমন ছেলেমানুষী দেখে হাসবে কি ধমক দেবে বুঝতে পারল না। পিঠের ওপর নখের ক্ষত। বেনজিন দিয়ে সব পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং যন্ত্রণায় ডেবিডের মুখ বেঁকে যাচ্ছে।
চীফ-অফিসার তবু রুষ্ট মুখে বলল, কি দরকার ছিল ওর মুখের খাবার কেড়ে নেবার!
সেকেণ্ড মুখ বাঁকিয়ে রয়েছে তেমনি। ভীষণ জ্বলছে। সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। সামান্য ব্যাণ্ডেজের দরকার। এবং কেবিনের ভেতর ডেবিডকে নিয়ে যেতে বললেন কাপ্তান।
—ম্যান এ্যালব্রাটস!
চীফ বলল, তাই মনে হচ্ছে।
–লক্ষ্য করেছেন ওর পিঠ সোনালী রংয়ের!
—না তো।
জ্যাক সব দেখে-শুনে অবাক। সেই পাখি দুটো বেশ দূরে এখন। উড়ছে। কখনও সমুদ্রের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে, কখনও ডুবে ডুবে প্রায় সাঁতার কাটার মতো। খাবার তুলে নিতে পারে নি বলে আক্রোশে যেন সমুদ্রের জলে পাখা ঝাপ্টাচ্ছে।
জ্যাক বলল, আবার আসবে।
ডেবিড বলল, আমারও মনে হয়, আবার আসবে।
ছোটবাবু বলল, তা হলে কি হবে।
—কিছু একটা করতে হবে। মৈত্র পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে আর অযথা কথা বলতে পারে না। তবু যেন বলে গেল।—কিছু একটা করতে হবে। এভাবে তো আর এমন একটা অসহায় পাখিকে ম্যান-এ্যালব্রাটসটার থাবার ভেতর ফেলে দেওয়া যায় না।
কি এক দুয়ে সত্যাসত্য আবিষ্কার-এর মুখে কেউ তখন আর কথা বলতে পারল না। মৈত্র কেমন একটা দৈত্যের মতো হেলে দুলে নেমে গেল।
আর আর্চি তখন নিজের কেবিনে হা-হা করে হাসছে। নো মি বয়! সে দরজা খুলেই হাসছে। এনজিনের বিরাট আওয়াজে ওর হাসির শব্দ কেউ শুনতে পাচ্ছে না—নো মি বয়! চার্মিং! কি সুন্দর মিষ্টি কথা। ওটা কে! আয়নায় সে যেন কি দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গেল।
সে কাছে গেল, আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি কে হে। ও হো বাছা তুমি! থু!
নো মি বয়! নো, ইউ নটি গার্ল! গার্ল! সেকেণ্ড জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, ইউ নটি গার্ল। কোন ভয় নেই! আমি কিছু করব না। কাপ্তানের মেয়ে তুমি। তোমাকে আমি কিছু করতে পারি! সে আনন্দের চোটে শিস দিতে দিতে চান করল। পৃথিবীতে এমন একটা গোপন খবর সে আবিষ্কার করতে কখনও পারবে বুঝতে পারে নি। ওর সন্দেহ, সংশয় সব ঘুচে গেছে। ডেকে ছোটবাবু আর জ্যাক দু’জন জড়াজড়ি করছিল। নেশার ঘোরে সে এতটুকু ভুল দেখে নি তবে!
আবার আয়নায় একটা সুন্দর মানুষ হেঁটে হেঁটে চলে আসছে। লকারের আয়নাটা মাথাসমান উঁচু। সে কাছে গিয়ে বলল, কে! না’ কিছুই নেই। সে ভাল জামা প্যান্ট পরে দেখল, না, পছন্দ হচ্ছে না। জ্যাকের পাশে সে বড় বেমানান। সবচেয়ে দামী নাইটি পরে দাঁড়াল, না কেমন সেকেলে সেকেলে। কিছুতেই সে রূপবান হতে পারছে না। বয়সের দাগ সমস্ত মুখে, হাতে পায়ে, আর ঠিক তেমনি কেউ অনেক দূর থেকে সে দেখতে পাচ্ছে হেঁটে হেঁটে আয়নার ভেতরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে বলতে গেল, হেল! তুমি কেন? ঘুসি মেরে কাঁচ ভেঙ্গে দিতে পারলে যেন ভাল করত।
নো, মি বয়,—ইয়েস ইউ বয় সে দেখল তখন সুন্দর পোশাকে কেউ হেঁটে আসছে। অ মাই গড। আবার তুমি!
এখনও লাঞ্চের দেরি আছে। এমন একটা গোপন আনন্দের জন্য সে এখন মদ্যপান করতে পারে। থ্রি চিয়ার্স। থ্রি চিয়ার্স কাকে উদ্দেশ্য করে। –না, কেউ জানবে না। জ্যাক, কাউকে বলব না। বলে জাহাজে দাঙ্গা বাধিয়ে দিই আর কি। সব পবিত্রতা, ঈশ্বর চিন্তা একেবারে মুহূর্তে ভেসে যাবে। না কেউ জানবে না তুমি মেয়ে।
আবার সেই কে যেন দূর থেকে হেঁটে আসছে। ওর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তুমি তো খুব জ্বালাচ্ছ হে! সে বেশ বড় করে এক সিপ খেয়ে বলল, আঃ ভারি মজা। তারপর কি করা যায়। দুটো উলঙ্গ মেয়ের ছবি, না দুটোতে হবে না, সে খেতে থাকল। পর পর সব উলঙ্গ মেয়েদের ছবি তাস খেলার মতো সামনে সাজিয়ে রাখল। দেখতে দেখতে আবার বলল, নো মি বয়। ইয়েস ইউ বয়, কেউ জানবে না, কেবল একজন জানবে, এ-জাহাজে অসামান্য এক সুন্দরী বালিকা ক্রমে যুবতী হয়ে উঠছে। বালিকা এখন নিজের সৌরভে বিভোর।
তারপরই মনে হল, না, আর একজন আছে, ছ’নম্বর। তার আগেই সে টের পেয়েছে। নারীজাতি সুধা পারাবার। সে সুধা পারাবারে আগেই মুখ রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা ভীষণ শক্ত হয়ে গেল। এবারে সে স্পষ্ট দেখল, আয়নায় ছোটবাবু দাঁড়িয়ে আছে। হাসি হাসি মুখ। আর্চি এবার গ্লাস ছুঁড়ে মারল আয়নায়। কাঁচটা ভেঙ্গে গেল। কেউ নেই। ফাঁকা। সে ভয় পেয়ে প্রাণপণ চিৎকার করে উঠল, বয়!
মেস-রুম বয় এসে অবাক, অসময়ে মেজ-মিস্ত্রি মদ খেয়ে মাতলামি করছে। গ্লাস ছুঁড়ে আয়নার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলেছে।