» » আলেকজান্ডারের পলায়ন

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

আলেকজান্ডারের পলায়ন

ভারতের শাসনদণ্ড হস্তগত করে ইংরেজ আমাদের কী শিক্ষা দিতে চেয়েছিল?

‘শৌর্যে-বীর্যে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে—সবদিক দিয়েই শ্বেতাঙ্গরা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ এবং কৃষ্ণাঙ্গরা হচ্ছে নিকৃষ্ট।’

কালি-কলমে ভারতের আধুনিক ইতিহাস আরম্ভ হয় গ্রিক দিগবিজয়ী আলেকজান্ডারের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই।

এবং তখন থেকেই ইংরেজি ইতিহাস আমাদের সগর্বে জানিয়ে দিতে চেয়েছে—আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ জয় করে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন সগৌরবে।

কিন্তু নিরপেক্ষ ইতিহাস কী বলে?

আলেকজান্ডার ভারতে প্রবেশ করলেন এক লক্ষ বিশ হাজার পদাতিক ও পনেরো হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে (গ্রিক লেখক প্লুটার্কের মতে)। তারপর একে একে কয়েকজন ছোট ছোট নগণ্য রাজাকে হারাতে হারাতে এগিয়ে চললেন। প্রায় প্রত্যেক পরাজিত রাজাই তাঁকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে বাধ্য হলেন—ফলে গ্রিক সৈন্যেরা দলে রীতিমতো ভারী হয়ে উঠল। তারপর এই বিপুল বাহিনী নিয়ে আলেকজান্ডার আক্রমণ করলেন রাজা পুরুকে। তিনিও একজন স্থানীয় রাজা মাত্র—তাঁর সৈন্যসংখ্যা ছিল মোট পঞ্চাশ হাজার। কাজেই পুরুও গ্রিক শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলেন না।

এই যুদ্ধ ‘ঝিলামের যুদ্ধ’ নামে বিখ্যাত এবং এইটিই হচ্ছে ভারতের ভিতরে আলেকজান্ডারের সব চেয়ে বড় যুদ্ধ। বিদেশি ঐতিহাসিকদের অত্যুক্তির ফলে ঝিলামের যুদ্ধ ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

কিন্তু ঝিলামের যুদ্ধ যে বিশেষভাবে স্মরণীয় নয়, আজ এই সত্য উপলব্ধি করবার সময় এসেছে। দুর্বল পুরু এবং প্রবল আলেকজান্ডার! এ তো কাঁসার বাসনের সঙ্গে মাটির বাসনের ঠোকাঠুকি! পুরু তো আলেকজান্ডারের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না! ঝিলামের যুদ্ধও ওয়াটার্লু, অস্টারলিটজ, পানিপথ বা পলাশির যুদ্ধের মতো চরম যুদ্ধ নয়। তার ফলে আসল ও বৃহত্তর ভারতবর্ষের পতন হয়নি! ঝিলামের যুদ্ধের ফলে আলেকজান্ডারের হস্তগত হয়েছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতের এক অংশ মাত্র।

আলেকজান্ডারের জীবনীলেখক প্লুটার্ক বলেছেন, প্রথম যৌবনে চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক শিবিরে গিয়ে আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত তখন সহায়সম্পদহীন, মগধ থেকে নির্বাসিত। পিতৃরাজ্য মগধ পুনরুদ্ধার করবার জন্যেই তিনি অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন গ্রিক দিগবিজয়ীকে।

তিনি বলেছিলেন, ‘মগধ সাম্রাজ্যই হচ্ছে ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আর শক্তিশালী। ভারতবর্ষ জয় করতে হলে আগে আপনাকে পরাজিত করতে হবে নন্দ রাজাকে।’

আলেকজান্ডার তখন মুখে কিছু না বললেও মনে মনে যে সেই প্রস্তাবই কার্যে পরিণত করবেন বলে স্থির করেছিলেন, এমন অনুমানের কারণ আছে।

‘শনৈঃ পর্বতলঙ্ঘনম্!’ আলেকজান্ডারের মত রণকৌশলী সেনাপতির কাছে এটা অজ্ঞাত ছিল না যে, একেবারে মগধ সাম্রাজ্যের উপরে গিয়ে হানা দিলে পিছনে থেকে যাবে অনেক অপরাজিত শত্রু। একসঙ্গে সামনে ও পিছনে শত্রু রাখার মতো নির্বুদ্ধিতা আর নেই। তাই গন্তব্য পথের আশপাশে পড়ল যে সব ছোট ছোট রাজার রাজ্য, আলেকজান্ডার আগে তাদের দমন করতে লাগলেন।

তারপর যখন পুরুর পতন হল, আলেকজান্ডার তখন বুঝলেন যে, ঝিলামের যুদ্ধ বিশেষ বড় যুদ্ধ না হলেও এর ফলে তাঁর পিছনে আর কোনও শত্রুর মতো শত্রু রইল না। এইবার নির্বিঘ্ন হল তাঁর মগধ যাত্রার বা ভারত বিজয়ের পথ।

বর্তমান গুরুদাসপুর ও কাংগ্রা জেলার মাঝখানে যেখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ‘বিয়াস’ বা বিপাশা নদী, আলেকজান্ডার অগ্রসর হয়ে তারই তীরে শিবির স্থাপন করলেন।

গ্রিক দিগবিজয়ীর চোখের সামনে নাচতে লাগল পারস্য সাম্রাজ্যের পর ভারত সাম্রাজ্যের সম্রাট উপাধি!

নতুন করে যুদ্ধের আয়োজন আরম্ভ হল। ভারতীয় রাজারা আরও সৈন্য সাহায্য পাঠাতে লাগলেন, এমনকি পরাজিত রাজা পুরুও এলেন পাঁচ হাজার সৈন্য ও রণহস্তী প্রভৃতি নিয়ে স্বয়ং! দুদিন আগেই যিনি স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে প্রাণপণে অস্ত্রধারণ করেছিলেন, যবনের পক্ষ নিয়ে আজ তিনি হলেন ভারতবর্ষের শত্রু!

পুরুকে আমরা স্বদেশপ্রেমিক বীর বলে অতুলনীয় সম্মান দিয়েছি, কিন্তু তাঁর চরিত্রের এই দুর্বলতার দিকে আমাদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়নি।

আসলে সে যুগের স্বদেশপ্রেমই ছিল এমনি সংকীর্ণ। তখনকার রাজারা স্বদেশ বলতে বুঝতেন কেবল নিজের রাজ্যটকুই। ভারতবর্ষকে বৃহত্তর জন্মভূমি বলে তাঁরা ধারণায় আনতে পারতেন না।

অনতিবিলম্বেই এই সত্য প্রথম বুঝিয়েছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, একচ্ছত্রের ছায়ায় এনে সমগ্র ভারতবর্ষকে। তিনিও পুরুর যুগের লোক, কিন্তু বিপুল প্রতিভার অধিকারী, তাই তাঁর দৃষ্টি ছিল প্রশস্ত।

চন্দ্রগুপ্ত, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত ও হর্ষবর্ধন প্রভৃতির দৃষ্টান্ত দেখেও ভারতবাসীরা কিছুই শিক্ষালাভ করেনি। আবার বার বার তারা একতার বন্ধনকে অস্বীকার করেছে এবং সেই সুযোগেই ভারতবর্ষে ইসলাম এবং ব্রিটিশ সিংহের প্রবেশ।

যবনের কাছে নতি স্বীকার করে পুরু যথেষ্ট লাভবানও হয়েছিলেন। পুরু ছিলেন ছোট রাজা, কিন্তু আলেকজান্ডার তাঁর হাতে সমর্পণ করে যান সমগ্র পাঞ্জাব প্রদেশ। তবে তাঁর এ সৌভাগ্য স্থায়ী হয়নি। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কিছু পরেই ইউডেমস নামে এক দুরাত্মা গ্রিক সেনানী পুরুকে হত্যা করে ভারত ছেড়ে পালিয়ে যায়।

প্লুটার্ক বলেছেন : ‘মগধ অধিকার করার পর চন্দ্রগুপ্ত নাকি বলতেন, আলেকজান্ডার ইচ্ছা করলে খুব সহজেই গোটা দেশটাকে দখল করতে পারতেন, কারণ দেশের সমস্ত লোকই নীচবংশজাত ও নিষ্ঠুরচরিত্র বলে রাজাকে (নন্দকে) ঘৃণা করত!’

কিন্তু এসব জেনেশুনেও এবং মগধ আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েও আলেকজান্ডার বিপাশা নদীর তীর থেকে আর অগ্রসর হলেন না কেন?

ভাগেলা নামে এক স্থানীয় রাজা সংবাদ দিলেন, ‘মগধের অধীশ্বরের অধীনে আছে বিশ হাজার অশ্বারোহী, দুই হাজার রথারোহী, তিন-চার হাজার গজারোহী ও দুই লক্ষ পদাতিক সৈন্য।’ (ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ হিসাব করে দেখিয়েছেন আসলে মগধপতির সৈন্যবল ছিল এইরকম : ছয় লক্ষ পদাতিক, তিরিশ হাজার অশ্বারোহী, ছত্রিশ হাজার গজারোহী ও চব্বিশ হাজার রথারোহী, অর্থাৎ মোট ছয় লক্ষ নব্বই হাজার সৈন্য।)

রাজা পুরুও মগধপতির বিপুল সৈন্যবলের কথা স্বীকার করলেন।

আলেকজান্ডার মনে মনে নিশ্চয় চমকিত ও বিস্মিত হয়েছিলেন, তবে মুখে প্রকাশ করলেন না মনের ভাব। বাইরে তিনি করতে লাগলেন যুদ্ধের আয়োজন।

কিন্তু টনক নড়ল অন্যান্য গ্রিক সেনানি ও সৈন্যগণের। পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের অধিকারী রাজা পুরুকে বশ করতেই তাদের দস্তুর মতো হিমশিম খেতে হয়েছিল। তার আগে ও পরে নানা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের লোকক্ষয়ও হয়েছে যথেষ্ট। এখন এই রণক্লান্ত স্বল্পসংখ্যক লোক নিয়ে এই সুদূর বিদেশে প্রায় সাত লক্ষ তাজা ও শিক্ষিত সৈন্যের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করতে হবে? না, অসম্ভব! দারুণ আতঙ্কে তাদের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। না, না, তারা আর অগ্রসর হতে পারবে না!

আলেকজান্ডারও ব্যাপারটা বুঝলেন। তিনি উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে সৈন্যদের সঙ্কুচিত বীরত্বকে আবার উৎসাহিত করে তুলতে চাইলেন। বললেন, ‘এগিয়ে চল আমার সঙ্গে, সারা এশিয়ার ঐশ্বর্য আমি তোমাদের পায়ের তলায় বিছিয়ে দেব!’

কিন্তু কে বা শোনে কার কথা! সৈন্যেরা পাথরের মতো নীরব ও নিশ্চল!

অনেকক্ষণ স্তব্ধতার পর এগিয়ে এলেন সেনাপতি কয়নস, ঝিলামের যুদ্ধে ইনিই পুরুর বিরুদ্ধে অশ্বারোহীদের চালনা করেছিলেন। তিনি বললেন, ‘মহারাজ, অতি জিনিসটা ভালো নয়, সমস্তরই সীমা আছে। ভেবে দেখুন মহারাজ, আমাদের কত সৈন্য রোগে বা যুদ্ধে মৃত আর কত লোক আহত হয়ে অকর্মণ্য। যারা এখনও সঙ্গে আছে তাদেরও স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছে, তাদের পোশাক ছিন্নভিন্ন, অস্ত্রশস্ত্রও উন্নত নয়। এদের নিয়ে আবার অগ্রসর হলে নিয়তি আমাদের উপরে কখনওই প্রসন্ন হবে না।’

কয়নসের উক্তি শুনে সেনাদলের প্রত্যেকেই উচ্চকণ্ঠে তাঁকে অভিনন্দিত করলে।

সৈন্যদের এমন বিরুদ্ধতা কল্পনাতীত! আলেকজান্ডার একেবারে স্তম্ভিত! বুঝলেন এর পরেও গোঁ না ছাড়লে নিশ্চয়ই ওরা বিদ্রোহ প্রকাশ করবে! আর কয়নসও তো যুক্তিহীন কথা বলছেন না, তার যুক্তি উড়িয়ে দেওয়াও চলে না।

ভারতবর্ষ জয় করবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর মন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল। তিনি আর একটিমাত্র বাক্য উচ্চারণ না করে ধীরে ধীরে নিজের তাঁবুর ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন। সেদিন গেল, তার পরের দিনও গেল, তাঁবুর ভিতর থেকে আলেকজান্ডারের কোনও সাড়া নেই। বোধহয় তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন।

তৃতীয় দিনে তিনি আবার বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

সুযোগ বুঝে সুবিধাবাদী গণৎকারের দল এসে জানালেন, ‘মহারাজ, গুণে দেখলুম আর অগ্রসর হলে অমঙ্গলের আশঙ্কা!’

আলেকজান্ডার নীরস কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ, আর অগ্রসর হওয়া উচিত নয়। তাঁবু তোল, ফিরে চল।’

কিন্তু প্রত্যাবর্তনের আগে আলেকজান্ডার আর একটি কাজ করে গেলেন। ভারতের ভিতরে তিনি কতদূর অগ্রসর হয়েছিলেন তার নিশানা রাখবার জন্যে বিপাশা নদীর তীরে বারোজন দেবতার নামে প্রতিষ্ঠিত করলেন বারোটি বেদি। প্রত্যেক বেদির উচ্চতা ছিল পঞ্চাশ ফুট। ওই দ্বাদশ দেবতার মধ্যে ছিলেন আমাদের সূর্যদেবও। বেদি প্রতিষ্ঠার পর দেবতাদের উদ্দেশ্যে পূজা ও অর্ঘ্য নিবেদন করা হল এবং সেই উপলক্ষ্যে গ্রিকদের জাতীয় ক্রীড়াকৌতুকও বাদ গেল না।

তারপর আলেকজান্ডার করলেন স্বদেশের দিকে প্রত্যাবর্তন। কিন্তু আমরা যদি এই প্রত্যাবর্তনের নাম দিই—পলায়ন, তাহলে অন্যায় হবে কি? আরব্ধ কার্য শেষ না করে প্রত্যাবর্তনের নামান্তরই হচ্ছে পলায়ন। নেপোলিয়নের মস্কো থেকে প্রত্যাবর্তনও কি পলায়ন নয়?

একজন নিরপেক্ষ গ্রিক ঐতিহাসিক স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন : ‘মগধাধিপতির ভয়ে আলেকজান্ডার ভারত জয় না করেই পলায়ন করেছিলেন।’

এইটেই হচ্ছে সত্যকথা। আলেকজান্ডার পাঞ্জাব বিজেতা মাত্র। এবং তাঁর পক্ষে তাও সম্ভবপর হত কিনা সন্দেহ, একতাবদ্ধ পঞ্চনদে তখন যদি চন্দ্রগুপ্তের মতো কোনও বড় রাজা থাকতেন।