ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ওগো, ওঠো! কাপড় ছেড়ে মুখহাত ধোও—রতন চা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে।
আমার সাড়া না পাইয়া রাজলক্ষ্মী পুনরায় ডাকিল, বেলা হ’লো—কত ঘুমোবে?
পাশ ফিরিয়া জড়িত কণ্ঠে বলিলাম, ঘুমোতে দিলে কই? এই ত সবে শুয়েছি।
কানে গেল টেবিলের উপর চায়ের বাটিটা রতন ঠক করিয়া রাখিয়া দিয়া বোধ হয় লজ্জায় পলায়ন করিল।
রাজলক্ষ্মী বলিল, ছি-ছি, কি বেহায়া তুমি! মানুষকে মিথ্যে কি অপ্রতিভ করতেই পারো। নিজে সারারাত কুম্ভকর্ণের মত ঘুমোলে, বরঞ্চ আমিই জেগে বসে পাখার বাতাস করলুম পাছে গরমে তোমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আবার আমাকেই এই কথা! ওঠো বলচি, নইলে গায়ে জল ঢেলে দোব।
উঠিয়া বসিলাম। বেলা না হইলেও তখন সকাল হইয়াছে, জানালাগুলি খোলা। সকালের সেই স্নিগ্ধ আলোকে রাজলক্ষ্মীর কি অপরূপ মূর্তিই চোখে পড়িল। তাহার স্নান, পূজা-আহ্নিক সমাপ্ত হইয়াছে, গঙ্গার ঘাটে উড়ে-পাণ্ডার দেওয়া শ্বেত ও রক্তচন্দনের তিলক তাহার ললাটে, পরনে নূতন রাঙ্গা বারাণসী শাড়ি, পুবের জানালা দিয়া একটুকরা সোনালী রোদ আসিয়া বাঁকা হইয়া তাহার মুখের একধারে পড়িয়াছে, সলজ্জ কৌতুকের চাপাহাসি তাহার ঠোঁটের কোণে, অথচ কৃত্রিম ক্রোধে আকুঞ্চিত ভ্রূ-দুটির নীচে চঞ্চল চোখের দৃষ্টি যেন উচ্ছল আবেগে ঝলমল করিতেছে—চাহিয়া আজও বিস্ময়ের সীমা রহিল না। সে হঠাৎ একটুখানি হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, কাল থেকে কি অত দেখচো বলো ত?
কহিলাম, তুমিই বলো ত কি অত দেখচি?
রাজলক্ষ্মী আবার একটু হাসিয়া বলিল, বোধ হয় দেখচো এর চেয়ে পুঁটু দেখতে ভালো কিনা, কমললতা দেখতে ভালো কিনা—না?
বলিলাম, না। রূপের দিক দিয়ে কেউ তারা তোমার কাছেও লাগে না সে এমনিই বলা যায়। অত করে দেখতে হয় না।
রাজলক্ষ্মী বলিল, সে যাক গে। কিন্তু গুণে?
গুণে? সে বিষয়ে অবশ্য মতভেদের সম্ভাবনা আছে তা মানতেই হবে।
গুণের মধ্যে ত শুনলুম কেত্তন করতে পারে।
হাঁ চমৎকার।
চমৎকার—তা তুমি বুঝলে কি করে?
বাঃ—তা আর বুঝিনে? বিশুদ্ধ তাল, লয়, সুর—
রাজলক্ষ্মী বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, হাঁ গা, তাল কাকে বলে?
বলিলাম, তাল তাকে বলে ছেলেবেলায় যা তোমার পিঠে পড়ত। মনে নেই?
রাজলক্ষ্মী কহিল, নেই আবার! সে আমার খুব মনে আছে। কাল খামকা তোমায় ভীতু বলে অপবাদ দিয়েছি বৈ ত নয়, কিন্তু কমললতা শুধু তোমার উদাসী মনের খবরটাই পেলে, তোমার বীরত্বের কাহিনীটা শোনেনি বুঝি?
না, আত্মপ্রশংসা আপনি করতে নেই, সে তুমি শুনিয়ো। কিন্তু তার গলা সুন্দর, গান সুন্দর, তাতে সন্দেহ নেই।
আমারও নেই। বলিয়াই সহসা তাহার দুই চক্ষু প্রচ্ছন্ন কৌতুকে জ্বলিয়া উঠিল, কহিল, হাঁ গা, তোমার সেই গানটি মনে আছে? সেই যে পাঠশালার ছুটি হলে তুমি গাইতে, আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতুম—সেই—কোথা গেলি প্রাণের প্রাণ বাপ দুর্যোধন রে-এ-এ-এ-এ—
হাসি চাপিতে সে মুখে আঁচল চাপা দিল, আমিও হাসিয়া ফেলিলাম।
রাজলক্ষ্মী কহিল, কিন্তু বড্ড ভাবের গান। তোমার মুখে শুনলে গোরু-বাছুরের চোখেও জল এসে পড়ত—মানুষ ত কোন ছার।
রতনের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। অনতিবিলম্বে সে দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া বলিল, আবার চায়ের জল চড়িয়ে দিয়েছি মা, তৈরি হতে দেরি হবে না। এই বলিয়া সে ঘরে ঢুকিয়া চায়ের বাটিটা হাতে তুলিয়া লইল।
রাজলক্ষ্মী আমাকে বলিল, আর দেরি ক’রো না, ওঠো। এবার চা ফেলা গেলে রতন খেপে যাবে! ওর অপব্যয় সহ্য হয় না। কি বলিস রতন?
রতন জবাব দিতে জানে। কহিল, আপনার না সইতে পারে মা, কিন্তু বাবুর জন্যে আমার সব সয়। এই বলিয়া সে বাটিটা লইয়া চলিয়া গেল। তাহার রাগ হইলে রাজলক্ষ্মীকে সে ‘আপনি’ বলিত, না হইলে ‘তুমি’ বলিয়া ডাকিত।
রাজলক্ষ্মী বলিল, রতন তোমাকে সত্যই বড় ভালোবাসে।
বলিলাম, আমারও তাই মনে হয়।
হাঁ। কাশী থেকে তুমি চলে এলে ও ঝগড়া করে আমার কাজ ছেড়ে দিলে। রাগ করে বললুম, আমি যে তোর এত করলুম রতন, তার কি এই প্রতিফল? ও বললে, রতন নেমকহারাম নয় মা। আমিও চললুম বর্মায়, তোমার ঋণ আমি বাবুর সেবা করে শোধ দেব। তখন হাতে ধরে, ঘাট মেনে তবে ওকে শান্ত করি।
একটু থামিয়া বলিল, তারপরে তোমার বিয়ের নেমন্তন্নপত্র এলো।
বাধা দিয়া বলিলাম, মিছে কথা ব’লো না। তোমার মতামত জানার জন্যে—
এবার সেও আমাকে বাধা দিল, কহিল, হাঁগো হাঁ, জানি। রাগ করে যদি লিখতুম করো গে—করতে ত?
না।
না, বৈ কি। তোমরা সব পার।
না, সবাই সব কাজ পারে না।
রাজলক্ষ্মী বলিতে লাগিল, কি জানি রতন মনে মনে কি বুঝলে, কেবলি দেখি আমার মুখের পানে চেয়ে তার দু’চোখ ছলছল করে আসে। তারপরে, তার হাতে যখন চিঠির জবাব দিলুম ডাকে ফেলতে, সে বললে না, এ চিঠি ডাকে ফেলতে পারব না—আমি নিজে নিয়ে যাব হাতে করে। বললুম, মিথ্যে কতকগুলো টাকা খরচ করে লাভ কি বাবা?
রতন চোখটা হঠাৎ মুছে ফেলে বললে, কি হয়েচে আমি জানিনে মা, কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয় যেন পদ্মাতীরের তলা ক্ষয়ে গেছে—গাছপালা, বাড়িঘর নিয়ে কখন যে তলিয়ে যাবে তার ঠিকানা নেই! তোমার দয়ায় আমারও আর অভাব নেই মা—এ টাকা তুমি দিলেও আমি নিতে পারব না, কিন্তু বিশ্বনাথ মুখ তুলে যদি চান, আমার দেশের কুঁড়েতে তোমার দাসীটাকে কিছু প্রসাদ পাঠিয়ে দিয়ো, সে বর্তে যাবে।
বলিলাম, ব্যাটা নাপতে কি সেয়ানা!
শুনিয়া রাজলক্ষ্মী মুখ টিপিয়া শুধু একটু হাসিল। বলিল, কিন্তু আর দেরি করো না যাও।
দুপুরবেলা আমাকে সে খাওয়াইতে বসিলে বলিলাম, কাল পরনে ছিল আটপৌরে কাপড়, আজ সকাল থেকে বারাণসী শাড়ির সমারোহ কেন বলো ত?
তুমি বলো ত কেন?
আমি জানিনে।
নিশ্চয় জানো। এ কাপড়খানা চিনতে পারো?
তা পারি। বর্মা থেকে আমি কিনে পাঠিয়েছিলাম।
রাজলক্ষ্মী বলিল, সেদিন আমি ভেবে রেখেছিলুম জীবনের সবচেয়ে বড় দিনটিতে এটি পরব—তা ছাড়া কখনো পরব না।
তাই পরেছ আজ?
হ্যাঁ, তাই পরেচি আজ।
হাসিয়া বলিলাম, কিন্তু সে ত হয়েছে, এখন ছাড়ো গে!
সে চুপ করিয়া রহিল। বলিলাম, খবর পেলাম তুমি এখুনি নাকি কালীঘাটে যাবে।
রাজলক্ষ্মী আশ্চর্য হইয়া কহিল, এখনি? সে কি করে হবে? তোমাকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তবে ত ছুটি পাব।
বলিলাম, না, তখনো পাবে না। রতন বলছিল তোমার খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে, শুধু কাল দুটিখানি খেয়েছিলে, আবার আজ থেকে শুরু হয়েছে উপবাস। আমি কি স্থির করেচি জানো? এখন থেকে তোমাকে কড়া শাসনে রাখব, যা খুশি তাই আর করতে পাবে না।
রাজলক্ষ্মী হাসিমুখে বলিল, তা হলে ত বাঁচি গো মশাই! খাই-দাই থাকি, কোন ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় না।
কহিলাম, সেইজন্যেই আজ তুমি কালীঘাট যেতে পাবে না।
রাজলক্ষ্মী হাতজোড় করিয়া বলিল, তোমার পায়ে পড়ি, শুধু আজকের দিনটি আমাকে ভিক্ষে দাও, তারপরে আগেকার দিনে নবাব-বাদশা’দের যেমন কেনা-বাঁদী থাকত তার বেশি তোমার কাছে চাইব না।
এত বিনয় কেন বলো ত?
বিনয় ত নয়, সত্যি। আপনার ওজন বুঝে চলিনি, তোমাকে মানিনি তাই অপরাধের পরে অপরাধ করে কেবলই সাহস বেড়ে গেছে। আজ আমার সেই লক্ষ্মীর অধিকার তোমার কাছে আর নেই—নিজের দোষে হারিয়ে বসে আছি।
চাহিয়া দেখিলাম তাহার চোখে জল আসিয়াছে, বলিল, শুধু আজকের দিনটির জন্য হুকুম দাও, আমি মায়ের আরতি দেখে আসি গে।
বলিলাম, না হয় কাল যেয়ো। নিজেই বললে সারারাত জেগে বসে আমার সেবা করেছো—আজ তুমি বড় শ্রান্ত।
রাজলক্ষ্মী বলিল, না, আমার কোন শ্রান্তি নেই। শুধু আজ বলে নয়, কত অসুখেই দেখচি রাতের পর রাত জেগেও তোমার সেবায় আমার কষ্ট হয় না। কিসে আমার সমস্ত অবসাদ যেন মুছে দিয়ে যায়। কতদিন হ’লো ঠাকুর-দেবতা ভুলে ছিলুম, কিছুতে মন দিতে পারিনি—লক্ষ্মীটি, আজ আমাকে মানা ক’রো না—যাবার হুকুম দাও।
তবে চলো, দু’জনে একসঙ্গে যাই।
রাজলক্ষ্মীর দুই চক্ষু উল্লাসে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, কহিল তাই চলো। কিন্তু মনে মনে ঠাকুর-দেবতাকে তাচ্ছিল্ল্য করবে না ত?
বলিলাম, শপথ করতে পারব না, বরঞ্চ তোমার পথ চেয়ে আমি মন্দিরের দোরে দাঁড়িয়ে থাকব। আমার হয়ে দেবতার কাছে তুমি বর চেয়ে নিয়ো।
কি বর চাইব বলো।
অন্নের গ্রাস মুখে করিয়া ভাবিতে লাগিলাম, কিন্তু কোন কামনাই খুঁজিয়া পাইলাম না। সেকথা স্বীকার করিয়া প্রশ্ন করিলাম, তুমি বলো ত লক্ষ্মী, কি আমার জন্যে তুমি চাইবে?
রাজলক্ষ্মী বলিল, চাইব আয়ু, চাইব স্বাস্থ্য, আর চাইব আমার ওপর এখন থেকে যেন তুমি কঠিন হতে পার, প্রশ্রয় দিয়ে আর যেন না আমার সর্বনাশ করো। করতেই ত বসেছিলে।
লক্ষ্মী, এ হ’লো তোমার অভিমানের কথা।
অভিমান ত আছেই। তোমার সে চিঠি কখনো কি ভুলতে পারব!
অধোমুখে নীরব হইয়া রহিলাম।
সে হাত দিয়া আমার মুখখানা তুলিয়া ধরিয়া বলিল, তা বলে এও আমার সয় না। কিন্তু কঠোর হতে ত তুমি পারবে না, সে তোমার স্বভাব নয়, কিন্তু একাজ আমাকে এখন থেকে নিজেই করত হবে, অবহেলা করলে চলবে না।
জিজ্ঞাসা করিলাম, কাজটা কি? আরও খাড়া উপোস?
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া বলিল, উপোসে আমার শাস্তি হয় না, বরং অহঙ্কার বাড়ে। ও আমার পথ নয়।
তবে পথটা কি ঠাওরালে?
ঠাওরাতে পারিনি, খুঁজে বেড়াচ্চি।
আচ্ছা, সত্যিই আমি কখনো কঠিন হতে পারি এ তোমার বিশ্বাস হয়?
হয় গো হয়—খুব হয়।
কখ্খনো হয় না—এ তোমার মিছে কথা।
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, মিছে কথাই ত। কিন্তু সেই হয়েছে আমার বিপদ গোঁসাই। কিন্তু বেশ নামটি বার করেছে তোমার কমললতা। কেবল ওগো হ্যাঁগো করে প্রাণ যায়, এখন থেকে আমিও ডাকব নতুনগোঁসাইজী বলে।
স্বচ্ছন্দে।
রাজলক্ষ্মী কহিল, তবু হয়ত আচমকা কখনো কমললতা বলে ভুল হবে—তাতেও স্বস্তি পাবে। বলো, ঠিক না?
হাসিলাম, লক্ষ্মী, স্বভাব কখনো মলেও যায় না। বাদশাহী আমলের কেনা-বাঁদীদের মত কথাই হচ্ছে বটে। এতক্ষণে তারা তোমাকে জল্লাদের হাতে সঁপে দিত।
শুনিয়া রাজলক্ষ্মীও হাসিয়া ফেলিল, বলিল, জল্লাদের হাতে নিজেই ত সঁপে দিয়েছি।
বলিলাম, চিরকাল তুমি এত দুষ্ট যে, কোন জল্লাদের সাধ্য নেই তোমাকে শাসন করে।
রাজলক্ষ্মী প্রত্যুত্তরে কি একটা বলিতে গিয়াই তড়িৎবেগে উঠিয়া দাঁড়াইল—এ কি! খাওয়া হয়ে এলো যে! দুধ কই? মাথা খাও, উঠে প’ড়ো না যেন। বলিতে বলিতে দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।
নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, এ, আর সেই কমললতা !
মিনিট-দুই পরে ফিরিয়া আসিয়া পাতের কাছে দুধের বাটি রাখিয়া পাখা-হাতে বাতাস করিতে বসিল, বলিল, এতকাল মনে হ’ত, এ নয়—কোথায় যেন আমার পাপ আছে। তাই, গঙ্গামাটিতে মন বসল না, ফিরে এলুম কাশীধামে। গুরুদেবকে ডাকিয়া এনে চুল কেটে গয়না খুলে একবারে তপস্যা জুড়ে দিলুম। ভাবলুম আর ভাবনা নেই, স্বর্গের সোনার সিঁড়ি তৈরি হ’লো বলে। এক আপদ তুমি—সে ত বিদায় হ’লো। কিন্তু সেদিন থেকে চোখের জল যে কিছুতে থামে না। ইষ্টমন্ত্র গেলুম ভুলে, ঠাকুর-দেবতা করলে অন্তর্ধান, বুক উঠল শুকিয়ে, ভয় হ’লো এই যদি ধর্মের সাধনা তবে এ-সব হচ্চে কি ! শেষে পাগল হবো নাকি !
আমি মুখ তুলিয়া তাহার মুখের প্রতি চাহিলাম, বলিলাম, তপস্যার গড়াতে দেবতারা সব ভয় দেখান ! টিকে থাকলে তবে সিদ্ধিলাভ হয়।
রাজলক্ষ্মী কহিল, সিদ্ধিতে আমার কাজ নেই, সে আমি পেয়েচি।
কোথায় পেলে?
এখানে। এই বাড়িতে।
অবিশ্বাস্য। প্রমাণ দাও।
প্রমাণ দিতে যাব তোমার কাছে ! আমার বয়ে গেছে।
কিন্তু ক্রীতদাসীরা এরূপ উক্তি কদাচ করে না।
দ্যাখো, রাগিও না বলচি। একশ’বার ক্রীতদাসী-ক্রীতদাসী করো ত ভালো হবে না।
আচ্ছা, খালাস দিলাম। এখন থেকে তুমি স্বাধীন।
রাজলক্ষ্মী পুনরায় হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, স্বাধীন যে কত, এবার তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। কাল কথা কইতে কইতে তুমি ঘুমিয়ে পড়লে, আমার গলার ওপর থেকে তোমার হাতখানি সরিয়ে রেখে আমি উঠে বসলুম। হাত দিয়ে দেখি ঘামে তোমার কপাল ভিজে—আঁচলে মুছিয়ে দিয়ে একখানা পাখা নিয়ে বসলুম, মিটমিটে আলোটা দিলুম উজ্জ্বল করে, তোমার ঘুমন্ত মুখের পানে চেয়ে চোখ আর ফিরুতে পারলুম না। এ যে এত সুন্দর এর আগে কেন চোখে পড়েনি? এতদিন কানা হয়ে ছিলুম কি? ভাবলুম, এ যদি পাপ তবে পুণ্যে আমার কাজ নেই, এ যদি অধর্ম তবে থাক গে আমার ধর্মচর্চা—জীবনে এই যদি হয় মিথ্যে তবে জ্ঞান না হতেই বরণ করেছিলুম একে কার কথায়? ও কি, খাচ্চো না যে? সব দুধই পড়ে রইল যে।
আর পারিনে।
তবে কিছু ফল নিয়ে আসি?
না, তাও না।
কিন্তু বড় রোগা হয়ে গেছ যে।
যদি হয়েও থাকি সে অনেক দিনের অবহেলায়। একদিনে সংশোধন করতে চাইলেই মারা যাব।
বেদনায় মুখ তাহার পাংশু হইয়া উঠিল, কহিল, আর হবে না। যে শাস্তি পেলুম সে আর ভুলব না। এই আমার মস্ত লাভ। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, ভোর হলে উঠে এলুম। ভাগ্যে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা অল্পে ভাঙ্গে না, নইলে লোভের বশে তোমাকে জাগিয়ে ফেলেছিলুম আর কি! তারপর দরোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গা নাইতে গেলুম—মা যেন সব তাপ মুছে নিলেন। বাড়ি এসে আহ্নিকে বসলুম, দেখতে পেলুম তুমি কেবল একাই ফিরে আসোনি, সঙ্গে ফিরে এসেছে আমার পূজার মন্ত্র। এসেছেন আমার ইষ্টদেবতা, গুরুদেব—এসেছে আমার শ্রাবণের মেঘ। আজও চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল, কিন্তু সে আমার বুকের রক্ত-নেঙড়ানো অশ্রু নয়, আমার আনন্দের উপচে-ওঠা ঝরনার ধারা—আমার সকল দিক ভিজিয়ে দিয়ে, ভাসিয়ে দিয়ে, বয়ে গেল। আনি গে দুটো ফল? বঁটি নিয়ে কাছে বসে নিজের হাতে বানিয়ে অনেকদিন তোমায় খেতে দিইনি—যাই? কেমন?
যাও।
রাজলক্ষ্মী তেমনি দ্রুতবেগে প্রস্থান করিল।
আমার আবার নিশ্বাস পড়িল। এ, আর সেই কমললতা!
কি জানি কে উহার জন্মকালে সহস্র নামের মধ্যে বাছিয়া তাহার রাজলক্ষ্মী নাম দিয়াছিল!
দু’জনে কালীঘাট হইতে যখন ফিরিয়া আসিলাম তখন রাত্রি নয়টা। রাজলক্ষ্মী স্নান করিয়া কাপড় ছাড়িয়া সহজ-মানুষের মত কাছে আসিয়া বসিল।
বলিলাম, রাজপোশাক গেছে—বাঁচলাম।
রাজলক্ষ্মী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ও আমার রাজপোশাকই বটে। কিন্তু রাজার দেওয়া যে! যখন মরব, ঐ কাপড়খানা আমাকে পরিয়ে দিতে ব’লো।
তাই হবে। কিন্তু সারাদিন ধরে আজ কি তুমি শুধু স্বপ্ন দেখেই কাটাবে, এইবার কিছু খাও।
খাই।
রতনকে বলে দিই ঠাকুর এইখানে তোমার খাবার দিয়ে যাক।
এইখানে? বেশ যা হোক! তোমার সামনে বসে আমি খাবো কেন? কখনো দেখেচো খেতে?
দেখিনি, কিন্তু দেখলে দোষ কি?
তা কি হয়। মেয়েদের রাক্ষুসে খাওয়া তোমাদের আমরা দেখতেই বা দেবো কেন?
ও ফন্দি আজ খাটবে না লক্ষ্মী। তোমাকে অকারণ উপোস করতে আমি কিছুতেই দেবো না। না খেলে তোমার সঙ্গে আমি কথা ক’বো না।
নাই বা কইলে।
আমিও খাবো না।
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া ফেলিল, বলিল, এইবার জিতেছো। এ আমার সইবে না।
ঠাকুর খাবার দিয়া গেল, ফল-মূল-মিষ্টান্ন। সে নামমাত্র আহার করিয়া বলিল, রতন তোমাকে নালিশ জানিয়েছে আমি খাইনে, কিন্তু কি ক’রে খাব বলো ত? কলকাতায় এসেছিলুম হারা-মকদ্দমার আপিল করতে। তোমার বাসা থেকে প্রত্যহ রতন ফিরে আসত, আমি ভয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারতুম না পাছে সে বলে, দেখা হয়েছে, কিন্তু বাবু এলেন না। যে দুর্ব্যবহার করেছি আমার বলবার ত কিছুই নেই।
বলবার দরকার ত নেই। তখন বাসায় স্বয়ং উপস্থিত হয়ে কাঁচপোকা যেমন তেলাপোকা ধরে নিয়ে যায় তেমনি নিয়ে যেতে।
কে তেলাপোকা—তুমি ?
তাই ত জানি। এমন নিরীহ জীব সংসারে কে আছে?
রাজলক্ষ্মী একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া বলিল, অথচ তোমাকেই মনে মনে আমি যত ভয় করি এমন কাউকে নয়।
এটি পরিহাস। কিন্তু হেতু জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
রাজলক্ষ্মী আবার ক্ষণকাল আমার পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, তার হেতু তোমাকে আমি চিনি। আমি জানি মেয়েদের দিকে তোমার সত্যিকার আসক্তি এতটুকু নেই, যা আছে তা লোকদেখানো শিষ্টাচার। সংসারে কোন কিছুতেই তোমার লোভ নেই, যথার্থ প্রয়োজনও নেই। তুমি ‘না’ বললে তোমাকে ফেরাব কি দিয়ে?
বলিলাম, একটু ভুল হ’লো লক্ষ্মী। পৃথিবীর একটি জিনিসে আজও লোভ আছে—সে তুমি। কেবল ঐখানে ‘না’ বলতে বাধে। ওর বদলে দুনিয়ার সব-কিছু যে ছাড়তে পারে শ্রীকান্তের এই জানাটাই আজও তুমি জানতে পারনি।
হাতটা ধুয়ে আসি গে, বলিয়া রাজলক্ষ্মী তাড়াতাড়ি উঠিয়া চলিয়া গেল।
পরদিন দিনের ও দিনান্তের সর্ববিধ কাজকর্ম সারিয়া রাজলক্ষ্মী আসিয়া আমার কাছে বসিল। কহিল, কমললতার গল্প শুনবো, বলো।
যতটা জানি সমস্তই বলিলাম, শুধু নিজের সম্বন্ধে কিছু কিছু বাদ দিলাম, কারণ, ভুল বুঝিবার সম্ভাবনা।
আগাগোড়া মন দিয়া শুনিয়া সে ধীরে ধীরে বলিল, যতীনের মরণটাই ওকে সবচেয়ে বেজেছে। ওর দোষেই সে মারা গেল।
ওর দোষ কিসে? দোষ বৈ কি। কলঙ্ক এড়াতে ওকেই ত কমললতা ডেকেছিল সকলের আগে আত্মহত্যায় সাহায্য করতে। সেদিন যতীন স্বীকার করতে পারেনি, কিন্তু আর একদিন নিজের কলঙ্ক এড়াতে তার ঐ পথটাই সকলের চোখে পড়ে গেল। এমনিই হয়, তাই পাপের সহায় হতে কখনো বন্ধুকে ডাকতে নেই—তাতে একের প্রায়শ্চিত্ত পড়ে অপরের ঘাড়ে। ও নিজে বাঁচল, কিন্তু ম’লো তার স্নেহের ধন।
যুক্তিটা ভালো বোঝা গেল না লক্ষ্মী।
তুমি বুঝবে কি করে? বুঝেছে কমললতা, বুঝেছে তোমার রাজলক্ষ্মী।
ওঃ—এই?
এই বৈ কি! আমার বাঁচা কতটুকু বলো ত যখন চেয়ে দেখি তোমার পানে?
কিন্তু কালই যে বললে তোমার মনের সব কালি মুছে গেছে—আর কোন গ্লানি নেই—সে কি তবে মিছে?
মিছেই ত। কালি মুছবে ম’লে—তার আগে নয়। মরতেও চেয়েচি, কিন্তু পারিনে কেবল তোমারই জন্য!
তা জানি। কিন্তু এ নিয়ে বার বার যদি ব্যথা দাও, আমি এমনি নিরুদ্দেশ হবো, কোথাও আর আমাকে খুঁজে পাবে না।
রাজলক্ষ্মী সভয়ে আমার হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া একেবারে বুকের কাছে ঘেঁষিয়া বসিল, বলিল, এমন কথা আর কখনো মুখেও এনো না। তুমি সব পারো, তোমার নিষ্ঠুরতা কোথাও বাধা মানে না।
এমন কথা আর বলবে না বলো?
না।
ভাববে না বলো?
তুমি বলো আমাকে ফেলে কখনো যাবে না?
আমি ত কখনো যাইনি লক্ষ্মী, যখনি দূরে গেছি—তুমি শুধু চাওনি বলেই।
সে তোমার লক্ষ্মী নয়—সে আর কেউ।
সেই আর কেউকেই আজও ভয় করি যে।
না, তাকে আর ভয় ক’রো না, সে রাক্ষুসী মরেছে। এই বলিয়া সে আমার সেই হাতটাই খুব জোর করিয়া ধরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
মিনিট পাঁচ-ছয় এইভাবেই থাকিয়া হঠাৎ সে অন্য কথা পাড়িল, বলিল, তুমি কি সত্যিই বর্মায় যাবে?
সত্যিই যাবো।
কি করবে গিয়ে—চাকরি? কিন্তু আমরা ত দু’জন—কতটুকুতেই বা আমাদের দরকার?
কিন্তু সেটুকুও ত চাই!
সে ভগবান দিয়ে দেবেন। কিন্তু চাকরি করতে তুমি পারবে না, ও তোমার ধাতে পোষাবে না।
না পোষালে চলে আসব।
আসবেই জানি। শুধু আড়ি ক’রে অতদূরে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে কষ্ট দিতে চাও।
কষ্ট না করলেই পার।
রাজলক্ষ্মী ক্রুদ্ধ কটাক্ষ করিয়া বলিল, যাও চালাকি ক’রো না।
বলিলাম, চালাকি করিনি, গেলে তোমার সত্যি কষ্ট হবে। রাঁধাবাড়া, বাসন মাজা, ঘরদোর পরিষ্কার করা, বিছানা পাতা—
রাজলক্ষ্মী বলিল, তবে ঝি-চাকররা করবে কি?
কোথায় ঝি-চাকর? তার টাকা কৈ?
রাজলক্ষ্মী বলিল, নাই থাক। কিন্তু যতই ভয় দেখাও আমি যাবই।
চলো। শুধু তুমি আর আমি। কাজের তাড়ায় না পাবে ঝগড়া করবার অবসর, না পাবে পুজো-আহ্নিক-উপোস করার ফুরসৎ।
তা হোক গে। কাজকে আমি কি ভয় করি নাকি।
করো না সত্যি, কিন্তু পেরেও উঠবে না। দু’দিন বাদেই ফেরবার তাড়া লাগাবে।
তাতেই বা ভয় কিসের? সঙ্গে করে নিয়ে যাব, সঙ্গে করে ফিরিয়ে আনব। রেখে আসতে হবে না ত! এই বলিয়া সে একমুহূর্ত কি ভাবিয়া বলিয়া উঠিল, সেই ভালো। দাস-দাসী লোকজন কেউ নেই, একটি ছোট্ট বাড়িতে শুধু তুমি আর আমি—যা খেতে দেব তাই খাবে, যা পরতে দেব তাই পরবে,—না, তুমি দেখো, আমি হয়ত আর আসতেই চাইব না।
সহসা আমার কোলের উপর মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িল এবং বহুক্ষণ পর্যন্ত চোখ বুজিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।
কি ভাবচ?
রাজলক্ষ্মী চোখ চাহিয়া হাসিল, আমরা কবে যাব?
বলিলাম, এই বাড়িটার একটা ব্যবস্থা করে নাও, তারপরে যেদিন ইচ্ছে চল যাত্রা করি।
সে ঘাড় নাড়িয়া সায় দিয়া আবার চোখ বুজিল।
আবার কি ভাবচ?
রাজলক্ষ্মী চাহিয়া বলিল, ভাবচি একবার মুরারিপুরে যাবে না?
বলিলাম, বিদেশে যাবার পূর্বে একবার দেখা দিয়ে আসব তাঁদের কথা দিয়েছিলাম।
তবে চল কালই দু’জনে যাই।
তুমি যাবে?
কেন ভয় কিসের? তোমাকে ভালোবাসে কমললতা, আর তাকে ভালোবাসে আমাদের গহরদাদা। এ হয়েছে ভালো।
এ-সব কে তোমাকে বললে?
তুমিই বলেছ।
না, আমি বলিনি।
হাঁ, তুমিই বলেছ, শুধু জানো না কখন বলেছ।
শুনিয়া সঙ্কোচে ব্যাকুল হইয়া উঠিলাম, বলিলাম, সে যাই হোক, সেখানে যাওয়া তোমার উচিত নয়।
কেন নয়?
সে বেচারাকে ঠাট্টা করে তুমি অস্থির করে তুলবে।
রাজলক্ষ্মী ভ্রূ কুঞ্চিত করিল, কুপিত-কণ্ঠে কহিল, এতকালে আমার এই পরিচয় পেয়েছ তুমি? তোমাকে সে ভালোবাসে এই নিয়ে তাকে লজ্জা দিতে যাবো আমি? তোমাকে ভালোবাসাটা কি অপরাধ? আমিও ত মেয়েমানুষ। হয়ত বা তাকে আমিও ভালোবেসে আসব।
কিছুই তোমার অসম্ভব নয় লক্ষ্মী—চল যাই।
হাঁ চল, কাল সকালের গাড়িতেই বেরিয়ে পড়ব দু’জনে—তোমার কোন ভাবনা নেই—এ জীবনে তোমাকে অসুখী করব না আমি কখনো।
বলিয়াই সে কেমন একপ্রকার বিমনা হইয়া পড়িল। চক্ষু নিমীলিত, শ্বাস-প্রশ্বাস থামিয়া আসিতেছে—সহসা সে যেন কোথায় কতদূরেই না সরিয়া গেল।
ভয় পাইয়া একটা নাড়া দিয়া বলিলাম, ও কি?
রাজলক্ষ্মী চোখ মেলিয়া চাহিল, একটু হাসিয়া কহিল, কৈ না—কিছু ত নয়!
তাহার এই হাসিটাও আজ যেন আমার কেমনধারা লাগিল।