সুউচ্চ আসনে উপবিষ্ট বনহুর। সামনে কয়েকজন দস্যু দণ্ডায়মান। সকলেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে—আজ আমরা মধুনগরের জমিদার বাড়িতে হানা দেব। মধুনগরের জমিদার বাসব নারায়ণ অতি দুষ্ট, শয়তান লোক। শুনেছি, একটা পয়সাও সে ভিখারীকে দান করে না। আমি চাই তার অর্থ নিয়ে ধুলোয় ছড়িয়ে দিতে। তোমরা প্রস্তুত?
সমস্বরে বলে ওঠে দস্যু দল—হ্যাঁ সর্দার।
বনহুর আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, তারপর বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে। সমস্ত দস্যু তাকে অনুসরণ করলো।
বনহুর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেই নূরী এসে দাঁড়ালো তার সামনে। একটা গোলাপ ফুল তার দিকে এগিয়ে ধরে বলে সে—হুর, তোমার যাত্রা শুভ হোক।
বনহুর ফুলটা নিয়ে গুঁজে দিল নূরীর খোঁপায়, তারপর ওর চিবুক ধরে একটু নাড়া দিয়ে বলে—আল্লাহ হাফেজ!
তাজের পিঠে চড়ে বসলো বনহুর, সঙ্গে সঙ্গে তাজ উল্কাবেগে ছুটে চললো, সমস্ত দস্যু অশ্ব ছুটিয়ে দিল তার পিছু পিছু।
গভীর রাত।
জমিদার বাসব নারায়ণ গভীর ঘুমে অচেতন।
অন্যান্য দস্যুদের নিয়ে জমিদার বাড়ির প্রাচীর টপকে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলো। এক মুহূর্তে গোটা বাড়ি প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। যে যেখানে যা পেল, লুটে নিতে লাগলো। বনহুর প্রবেশ করলো জমিদার বাসব নারায়ণের কক্ষে।
দুগ্ধফেননিভ বিছানায় বাসব নারায়ণ তখন সুখস্বপ্ন দেখছিল। বনহুর তার শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রিভলবারের মৃদু আঘাত করে ডাকলো—নারায়ণ মশায়, উঠুন।
ধড়মড় করে উঠে বসে বাসব নারায়ণ। সামনে তাকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল তার কণ্ঠ। যমদূতের মত কালো পোশাকে পরা বনহুরকে রিভলবার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হৃদকম্প শুরু হলো তার। শুষ্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো—কে তুমি, কি চাও?
বনহুরের চোখ দুটো ধক্ করে জ্বলে উঠলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো—দস্যু বনহুর!
জমিদার বাসব নারায়ণের আড়ষ্ট কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো অস্ফুট একটা শব্দ—দস্যু বনহুর!
হ্যাঁ।
কিন্তু, কি চাও আমার কাছে?
কি চাই জান না? টাকা—তোমার সমস্ত টাকা আমাকে এ মুহূর্তে দিয়ে দাও। নইলে এ দেখছো, এর এক গুলিতে তোমার টাকার মোহ ঘুচিয়ে দেব।
বাসব নারায়ণ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বনহুরের পায়ের কাছে বসে পড়লো—বাবা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। টাকা কোথায় পাবো?
কোথায় পাবে? এসো আমার সঙ্গে, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। বনহুর দু’পা এগুতেই বাসব নারায়ণ ছুটে গিয়ে সিন্দুক জড়িয়ে ধরলো।
বনহুর এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিয়ে সিন্দুক খুলে যত টাকা পয়সা, সোনা-দানা নিয়ে অন্তপুর থেকে বেরিয়ে এলো।
পরদিন গোটা শহরময় ছড়িয়ে পড়লো দস্যু বনহুরের এ দুঃসাহসিক দস্যুতার কথা। পুলিশ মহলে পর্যন্ত ত্রাসের সঞ্চার হলো।
পুলিশ ইন্সপেক্টার মি. হারুন চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাঁর বহু প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, কিছুতেই এ দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হননি। তাঁর অভিজ্ঞ জীবনে এ যেন চরম পরাজয়।
পুলিশ সুপার মি. বশির আহমদ পর্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তিনি নিজেও বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য উঠে পড়ে লেগে যান। গোপনে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. শঙ্কর রাওয়ের সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং কেসটা তাঁর হাতে অর্পণ করেন। অনুরোধ জানিয়ে বলেন, মি. রাও, আপনি দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করে দেশবাসীকে রক্ষা করুন।
মি. আহমদের কথা রাখবেন বলে আশ্বাস দেন মি. রাও। তিনি ভরসা দিয়ে বলেন—আমি আপনার অনুরোধ রাখবো, দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো।
থ্যাঙ্ক ইউ মি. রাও, আপনার ওপর আমার ভরসা রইলো। দেখুন এ ব্যাপারে আপনার যত টাকা-পয়সা এবং লোকজনের প্রয়োজন হবে পাবেন, পুলিশ ফোর্স সব সময়ের জন্য আপনাকে সাহায্য করবে।
মি. আহমদের গাড়ি বেরিয়ে যেতেই মি. রাওয়ের সহকারী গোপালবাবু এসে এজির হলেন, মি. রাওকে লক্ষ্য করে বলেন—কি হে, ব্যাপার কি? হঠাৎ যে পুলিশ সুপারের আগমন?
একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বলেন মি. রাও—ব্যাপার নতুন নয়, পুরানো।
পাশের সোফায় বসে পড়ে বলেন গোপালবাবু—পুরোনো? তাহলেই সেরেছে, রোগ সারতে অনেক ঔষধের প্রয়োজন হবে।
ঠাট্টা নয়, শুনো গোপাল।
বল, সব শুনতে রাজি আছি।
দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের নোটিস নিয়ে পুলিশ সুপারের আগমন হয়েছিল।
কী বললে, বনহুরকে গ্রেপ্তার? তুমি ঐ কেস হাতে নিলে নাকি?
না নিয়ে কি আর উপায় ছিল? পুলিশ সুপার যখন এসেছেন।
কিন্তু এ কথা ভেবে দেখলে না শঙ্কর, কোথায় দস্যু বনহুর, আর কোথায় তুমি। আজ পর্যন্ত পুলিশবাহিনী যার টিকিটি দেখতে পায়নি, তাকে গ্রেপ্তার করবে তুমি? যা খুশি করোগে, আমি কিন্তু ওসবের মধ্যে নেই।
গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেন শঙ্কর রাও—কেউ যখন তার টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পায়নি, সে কারণেই আমি এগুতে চাই। দেখতে চাই কে এই বনহুর, কেমন তার শক্তি। গোপাল শুনো, আরও সরে এসো আমার কাছে।
এলাম বল।
গোপাল, গত পরশু রাতে জমিদার বাসব নারায়ণের বাড়িতে হানা দিয়ে দস্যু বনহুর সর্বস্ব লুটে নিয়ে গেছে।
এ কথা আমি শুনেছি।
শুনো, সব কথা মন দিয়ে শুনো, তারপর যা হয় বল। আমি একটা বুদ্ধি এঁটেছি।
কি বুদ্ধি শুনি? হাতি ধরবার মত বনহুরকে গ্রেপ্তারের ফাঁদ পাততে চাও নাকি?
এক রকম তাই।
বল, তাহলে শুনি তোমার বুদ্ধির ফাঁদ কত মজবুত হবে?
শুনো, আমাকে পুলিশ ইন্সপেক্টার মি. হারুনের নিকট যেতে হচ্ছে। কিছু সংখ্যক পুলিশ প্রয়োজন।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার বুদ্ধির কৌশল কিছুটা শুনাও। পুলিশ নিয়ে বনহুরের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করবে নাকি?
না না, তা নয়, কথা হচ্ছে আগামী শনিবারে রায় বাহাদুর শ্যামাচরণের তিন লাখ টাকা তার দেশের বাড়ি থেকে শহরের বাড়িতে আনবে।
একথা তুমি জানলে কি করে?
জানতে হয় না, জেনেছি।
তার মানে?
মানে এই রকম একটা অভিনয় করতে হবে। আমি আজই একবার রায় শাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। তিনি যেন এই রকম একটা কথা সকলের মধ্যে রটিয়ে দেন এবং নিজের সই করা কয়েকটা কাগজ—যাক সব বলে আর কাজ নেই, পরে সব জানতে পারবে।
তবু একটু বল না?
তারপর কয়েকজন পাহারাদার সঙ্গে করে শ্যামাচরণ মহাশয়ের নায়েব দেশের বাড়ি থেকে মোটরে তিন লাখ টাকা নিয়ে রওনা দেবে, কিন্তু আসলে তাদের কাছে কোন টাকা-পয়সা থাকবে না। দস্যু বনহুর জানবে তিন লাখ টাকা যাচ্ছে। এ সুয়োগ কিছুতে নষ্ট করা যায় না, তখন নিশ্চয়ই সে গাড়িতে হানা দেবে।
খাসা বুদ্ধি তোমার!
হ্যাঁ, খাসা বুদ্ধি এটেছি গোপাল। যে গাড়িতে টাকা আসছে, সে গাড়িকে অনুসরণ করবে পুলিশ ফোর্স, সকলের হাতেই থাকবে গুলিভরা রাইফেল। অতি গোপনে থাকবে, যেন কেউ জানতে না পারে।
উঠে পড়েন মি. শঙ্কর রাও—গোপাল তৈরি হয়ে এসো, এক্ষণি বেরুবো।
হাই তুলে উঠে দাঁড়ায় গোপালবাবু যাত্রা তোমার জয়যুক্ত হউক!
বনহুর কক্ষে পায়চারী করছে। এক পাশে বিরাট একটা মশাল জ্বলছে। সম্মুখে দণ্ডায়মান তার অনুচরবৃন্দ। মশালের আলোতে দস্যু বনহুরের জমকালো পোশাক চকচক করে উঠছে। বনহুরের আসনের সামনে একটা টেবিল, টেবিলে একখানা চিঠি খোলা অবস্থায় পড়ে আছে।
বনহুর কাগজখানা হাতে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন—এ চিঠি কোথায় পেলে?
একজন দস্যু বলে ওঠে—সর্দার, একটা লোকের পকেট থেকে চিঠিখানা পড়ে গিয়েছিল, রহমান কুড়িয়ে এনে আমাকে দিয়েছে।
হঠাৎ বনহুর হেসে ওঠে হাঃ হাঃ করে। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে ঐ রকম আর একখানা কাগজ বের করে ঐ কাগজখানার পাশে রাখে। তারপর ঐ দস্যুটিকে বলে—কাগজ দু’খানা পড়।
দস্যুটি কাগজ দু’খানা হাতে তুলে নিয়ে বলে ওঠে—একি সর্দার, দুটোতেই যে একই কথা লেখা রয়েছে!
চিঠি দুটোতে লেখা ছিল—
নায়েব বাবু, আমার তিন লাখ টাকার
প্রয়োজন। আগামী পরশু আমার গাড়ি
পাঠাবো। কয়েকজন পাহারাদার সহ
ঐ টাকা নিয়ে আপনি স্বয়ং চলে আসবেন।
—রায় বাহাদুর শ্যামচরণ।
দস্যুটি কাগজ দু’খানা পড়া শেষ করে আবার টেবিলে রাখে। আশ্চর্য। দু’খানা কাগজের লেখা একই লোকের।
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে—দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের এটা একটা নতুন ফন্দি। শুধু ঐ দুটি নয়, অমনি আরও অনেক চিঠি এখানে সেখানে গোপনে ছড়ানো হয়েছে। হাঃ হাঃ হাঃ, দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করে এমন লোক পৃথিবীতে আছে নাকি? যাক এবার তোমরা বিশ্রাম করোগে।
দস্যুগণ বেরিয়ে যায়। বনহুর নিজের বিশ্রামঘরে প্রবেশ করে।
এমন সময় নূরী এসে দাঁড়ায় সেখানে। মধুর কন্ঠে ডাকে—হুর!
নূরী বনহুরকে আদর করে ‘হুর’ বলে ডাকতো।
বনহুর মাথার পাগড়িটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলে—কি খবর নূরী?
—হুর, তোমার দেখাই যে পাওয়া যায় না। সারাটা দিন তুমি কোথায় কাটাও?
বনহুর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলে—সারাটা দিন আমি তোমার পাশেই থাকি, তুমি আমাকে দেখতে পাও না নূরী?
নূরী বনহুরের পাশে গিয়ে বসে, তার জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলে—মিছে কথা। আমি অন্ধ বুঝি?
নূরী, বনহুর কি মেয়েছেলে, তাই…
হুর, আমি যে বড় একা। এ গহন বনে তুমি ছাড়া আর আমার কে আছে? নূরীর কণ্ঠে বেদনা ঝরে পড়ে।
বনহুর অবাক হয়ে তাকায় নূরীর মুখের দিকে।
নূরী বনহুরের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে—এ বনে আসা অবধি আমি তোমাকে সাথীরূপে পেয়েছি, হুর। তুমিই যে আমার সব।
নূরী, তুমি আমাকে ধরে রাখতে চাও?
না, ধরে রাখতে চাইনে, কিন্তু…
বুঝেছি, আবার যেন ফিরে আসি এ তো? হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে বনহুর—পাগলী আর কী!
না, আমি নই, তুমি পাগল। কিছু বুঝ না, বুঝতে চাও না। এখনও তোমার ছেলেমানুষি গেল না, হুর!
নূরী, এখন বিশ্রাম করবো। তুমি এখন যাও লক্ষ্মী মেয়ে।
বনহুরের কথায় নূরী অভিমানভরে উঠে দাঁড়ায়—আচ্ছা আমি যাচ্ছি। আর তোমাকে বিরক্ত করতে আসবো না।
খপ করে নূরীর হাত ধরে ফেলে বনহুর—রাগ হলো?
আমি রাগ করলে তাতে তোমার কী আসবে যাবে? ছেড়ে দাও আমার হাত।
নূরী, অভিমান করো না। একটু বিশ্রাম করেই আবার আমাকে বেরুতে হবে।
তার মানে, আবার এ রাতেই তুমি বেরুবে?
হ্যাঁ নূরী, আমার অনেক কাজ।
শুধু কাজ আর কাজ, আজ নাই-বা বেরুলে!
তা হয় না নূরী, বেরুতেই হবে।
নূরী ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।
বনহুর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।
গভীর রাত। তাজের পিঠে চড়ে বসলো বনহুর। আজ শরীরে স্বাভাবিক ড্রেস, প্যান্ট-কোট-টাই, মাথায় ক্যাপ। পকেটে কিন্তু গুলিভরা রিভলবার।
গহন বন বেয়ে, নিস্তব্ধ প্রান্তরের বুক চিরে ছুটে চললো বনহুরের অশ্ব। প্রান্তর পেরিয়ে এক পল্লীতে এসে পৌঁছল বনহুর। এবার গতি অতি মন্থর করে নিল সে। শস্যক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললো। অদূরে দেখা যাচ্ছে ধবধবে সাদা রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের বাড়ি।
বনহুর এ বাড়ির সামনে গিয়ে অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়ালো।
সদর গেটে একজন পাহারাদার বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছিল, হেঁকে উঠলো পাহারাদার—কোন্ হ্যায়?
বনহুর তাজকে রেখে এগিয়ে গেল পাহারাদারের নিকটে— আমি শহর থেকে আসছি। রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয় পাঠিয়েছেন। নায়েব বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
পাহারাদার লম্বা একটা সেলাম ঠুকে বলেন—আইয়ে বাবুজী, হল্ ঘরমে বঠিয়ে, হাম নায়েব বাবুকো বুলাতা হুঁ।
আচ্ছা, —বনহুর হলঘরে গিয়ে বসলো।
পাহারাদার লণ্ঠন হাতে অন্দরবাড়িতে প্রবেশ করে।
কিছুক্ষণ পর নিদ্রাজড়িত চোখ দু’টি মুছতে মুছতে কক্ষে প্রবেশ করেন নায়েব বাবু।
বনহুর উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালো, তারপর বললো—আমি শহর থেকে আসছি। রায় মহাশয় আমাকে পাঠিয়েছেন।
বৃদ্ধ নায়েব মহাশয় বলে ওঠেন—হঠাৎ এত রাতে তিনি কি মনে করে আপনাকে পাঠালেন?
বনহুর পকেট থেকে সে চিঠিখানা বের করে নায়েব মহাশয়ের হাতে দিয়ে বলে—এই চিঠি তিনি দিয়েছেন।
লণ্ঠনের আলোতে বৃদ্ধ চিঠিখানা দেখলেন, তারপর তাকালেন বনহুরের মুখে।
বনহুর হেসে বলে—আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না? দেখুন পরশু যেভাবে টাকা পাঠানোর কথা ছিল, সেভাবে পাঠানো নিরাপদ নয়, সে কারণেই রায় মহাশয় পাঠিয়েছেন। আমি যেন গোপনে টাকা নিয়ে তাঁর হাতে পৌঁছে দিই।
বৃদ্ধ নতমস্তকে কিছু ভাবতে লাগলেন।
বনহুর গম্ভীরভাবে বলে—এ চিঠি রায় মহাশয়ের লেখা কিনা ভাবছেন বুঝি?
না, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। তিরিশ বছর ধরে আমি রায় মহাশয়ের কাজ করছি, তাঁর হাতের লেখা চিনবো না, কি যে বলেন!
তাহলে অবিশ্বাসের কিছু নেই?
কিন্তু…
আর কিন্তু কি আছে নায়েব বাবু?
আমি বলছিলাম, হঠাৎ এভাবে টাকা…
দেয়াটা কি উচিত হবে, এই তো ভাবছেন? আমি আমার নাম-ঠিকানা সব লিখে দিয়ে যাচ্ছি।
বেশ, তাই হবে। বসুন আমি টাকা নিয়ে আসছি। নায়েব বাবু কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। আগের দিনের সরল সহজ মানুষ, বনহুরকে এতটুকু অবিশ্বাস করলেন না। কিছুক্ষণ পর একগাদা নোট নিয়ে ফিরে এলেন, তারপর বনহুরের হাতে দিয়ে বলেন—সাবধানে নিয়ে যাবেন, পথে চোর-ডাকাত না হামলা করে।
সে কারণেই তো এত রাতে, এত গোপনে আমার আসা।
টাকাগুলো গুছিয়ে নিয়ে, নাম আর ঠিকানাসহ একটা রসিদ লিখে দিল বনহুর নায়েব বাবুর হাতে—এটা রেখে দিন।
বনহুর বেরিয়ে যেতেই নায়েব বাবুর লণ্ঠনের সামনে রসিদখানা মেলে ধরলেন, সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন।
কাগজখানায় লেখা আছে—
নায়েব শশধর বাবুর নিকট হতে
তিন লাখ টাকা বুঝে পেয়ে
রসিদ লিখে দিলাম।
—‘দস্যু বনহুর’
বৃদ্ধ নায়েবের শুষ্ক কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো—সর্বনাশ হয়েছে, ওরে কে কোথায় আছিস, সর্বনাশ হয়েছে…
নায়েব বাবুর চিৎকারে দারোয়ান ছুটে এলো, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সবাই।
সকলেই একসঙ্গে প্রশ্ন করছে—কী হলো, কী হলো?
হাঁপাতে হাঁপাতে নায়েব বাবু আঙ্গুল দিয়ে বাইরে দেখিয়ে দিয়ে বলেন—দস্যু বনহুর সব নিয়ে গেছে। ঐ দিকে গেছে, তোমরা ধরো—ধরো ওকে…
সবাই ছুটলো সদর গেটের দিকে। বাইরে যখন এসে দাঁড়ালো ওরা, তখন চারদিকে শুধু ঘন জমাট অন্ধকার। দূরে—অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে অশ্ব পদশব্দ—খট্ খট্ খট্……