বিকেলে কাসেদের মনটা হঠাৎ উদাস হয়ে গেলো।
বাড়িতে মায়ের অসুখ। তবু বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করলো না তার।
ইচ্ছে হলো জাহানারাদের ওখানে যেতে।
কী করছে জাহানারা?
হয়তো বাগানে বসে বসে গল্প করছে পাড়ার বান্ধবীদের সঙ্গে।
কিম্বা তার শোবার ঘরে জানালার পাশে বই পড়ছে, উপন্যাস, গল্প অথবা কবিতা।
জাহানারা, এভাবে আর কতদিন চলবে বলতে পারে? কতদিন আমি ভেবেছি আমার মনের একান্ত গোপন কথাটা ব্যক্ত করবো তোমার কাছে। বলবো সব। বলবো এসো আমরা ঘর বাঁধি। তুমি আর আমি। আমরা দু’জনা, আর কেউ থাকবে না সেখানে।
কেউ না।
রাস্তায় কত লোক। আসছে। যাচ্ছে। কথা বলছে। ওরাও হয়ত ভাবছে কারো কথা। কারো স্বপ্ন আঁকছে মনে মনে, কল্পনার চোখে দেখবার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতের দিনগুলোকে, রোমাঞ্চকর অনাগত দিন।
আজকাল জাহানারাকে নিয়ে একটু বেশি করে ভাবছে কাসেদ।
মূলে রয়েছে মা। রোজ একবার করে তাড়া দিচ্ছেন তিনি। বিয়ে করো। আমি বেঁচে থাকতে একটা বউ নিয়ে আয় ঘরে।
আর বিয়ের কথা যখনি ভাবে কাসেদ জাহানারা ছাড়া অন্য কারো চিন্তা মনে আসে না তার।
একমাত্র জাহানারা স্ত্রী হিসেবে ঘরে আসতে পারে তার।
আর কেউ নয়।
বাইরে, বাসার সামনে কমলা রঙের শাড়ি পরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে, সে জাহানারা নয়, শিউলী।
শিউলীর সঙ্গে সেই অনেকদিন আগে জাহানারার জন্মদিনে এই বাড়িতেই প্ৰথম আলাপ হয়েছিলো তার।
শিউলী হাসলো। জাহানারার কাছে এসেছেন বুঝি?
কাসেদ সংক্ষেপে বললো, হ্যাঁ।
শিউলী বললো, ও এখন সেতার শিখছে, ডিষ্টার্ব করা ঠিক হবে না। আসুন না, আমরা এখানে মাঠের ওপর বসি।
কাসেদ ইতস্তত করে বললো, হ্যাঁ বসা যেতে পারে, আমার কোন আপত্তি নেই।
শিউলী ঠোঁট টিপে হাসলো। মনে হলো কিছু বলবে। বললো না।
মাঠের ওপরে যেখানে কয়েকটা ফুলের টবে লাল, সাদা ফুল ফুটে আছে সেখানে এসে বসলো ওরা।
কাসেদ বললো, কই আপনি এলেন না তো একদিনও?
শিউলী বললো, যেতাম। কিন্তু, পরে ভাবলাম আসা-যাওয়ার উৎসাহ দেখে আপনি যদি শেষে ভুল বুঝে বসেন আমায়?
ভুল! ভুল কিসের? কাসেদ অবাক হলো।
শিউলী হেসে হেসে বললো, যদি ভাবেন আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি তাহলে? বলে শব্দ করে হেসে উঠলো। সে হাসির দমকে সরু দেহটা যেন নেতিয়ে পড়তে চাইলো ঘাসের ওপরে।
কাঁধের ওপর থেকে কোলে নেমে আসা আঁচলখানা আবার যথাস্থানে তুলে দিয়ে শিউলী বললো, আচ্ছা একটা কথার জবাব দিতে পারেন?
কী কথা?
মাঝে মাঝে আপনাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে, কেন বলুন তো?
শিউলী তার চোখের দিকে তাকালো।
পর পর কয়েকটা ঢোক গিললো কাসেদ।
জবাব দেবার মত কোন কথা খুঁজে পেলো না সে। আলোচনাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়ার জন্যেই হয়তো সে পরক্ষণে বললো, চলুন না, জাহানারার ঘরে গিয়ে বসা যাক। এতক্ষণে তার সেতার শেখা নিশ্চয় শেষ হয়েছে। এত শিঘ্রী? শিউলী যেন চীৎকার করে উঠলো। তারপর ঠোঁটের কোণে অর্থপূর্ণ হাসির ঈষৎ তরঙ্গ তুলে ধীর গলায় বললো, আপনি কি ভাবেন সেতার শেখানটাই মুখ্য?
কাসেদ শুধালো, কেন বলুন তো?
শিউলী হাসলো, আপনি কিছুই জানেন না তাহলে?
কাসেদের বুকটা কেঁপে উঠলো সহসা। কিছু বলতে গিয়ে আবার বার কয়েক ঢোক গিললো, কই জানি না তো?
শিউলীর চোখেমুখে কৌতুক। সামনে ঝুঁকে এসে আস্তে বললো, তারের সঙ্গে তারের জোর প্ৰেম চলছে।
তার মানে? হৃৎপিণ্ডতা গলার কাছে এসে আঘাত করছে যেন। সপ্ৰসন্ন দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কাসেদ।
শিউলী বললো, এখনো বুঝলেন না? ঠোঁট টিপে আবার হাসলো সে। এই সহজ কথা বুঝতে এত দেরি হচ্ছে আপনার? চারপাশে এক পলক দেখে নিয়ে আরো কাছে সরে এলো শিউলী। মাষ্টার আর ছাত্রীতে মন দেয়া নেয়ার পালা চলছে, বুঝলেন?
কাসেদের মনে হলো, ওর দেহটা যেন ক্লান্তি আর অবসাদে ভেঙে আসতে চাইছে। উঠে দাঁড়াবার শক্তি পাচ্ছে না সে।
কেন এমন হলো জাহানারা?
এ সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলে কী ক্ষতি হয়ে যেতো তোমার? আমি নিশ্চয় বাধা দিতাম না, কেন দেবো?
পৃথিবীতে আমরা সবাই প্রথমে নিজের কথা ভাবি, পরে অন্যেরা। তুমি তোমার পথে চলবে, আমি আমার পথে। তোমারটা আমি কোনদিনও কেড়ে নিতাম না। তবে কেন তুমি সব কিছু লুকিয়ে গেলে আমার কাছ থেকে?
ওকি আপনি একেবারে চুপ করে গেলেন যে? শিউলীর কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞাসার সুর, কী ভাবছেন?
না, কিছু না তো? কাসেদ নিজেকে আড়াল করতে চাইলো শিউলীর দৃষ্টি থেকে।
শিউলী আবার বললো, আপনি যেন কেমন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন মনে হচ্ছে?
তাই নাকি? না, এমনি। কাসেদ নড়েচড়ে বসলো।
শিউলী শুধালো, উঠবেন নাকি?
কাসেদ বললো, হ্যাঁ, না ভাবছি–।
কী ভাবছেন?
এখানে আর একটু বসা যাক, কি বলেন? অনেকটা সহজ হবার চেষ্টা করলো কাসেদ।
শিউলী বললো, জাহানারার সঙ্গে দেখা করবেন না?
করবো না কেন? দেখা করতেই তো এসেছি। বলতে গিয়ে গলার স্বরটা কাঁপলো ওর।
কী আশ্চর্য! আজি বিকেলে জাহানারাদের বাসার পথে আসতে আসতে অনেক কিছু ভেবেছে কাসেদ, অনেক কল্পনার জাল বুনেছে। কিন্তু ভুলেও ভাবে নি, মাষ্টারের সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক পাতিয়ে বসতে পারে জাহানারা। কেন এমন হলো?
শিউলী শুধালো, আপনার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে?
কাসেদ উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, শিউলী তাকে বাধা দিয়ে আবার বললো, ওই যে জাহানারা।
মাঠ থেকে বারান্দার দিকে দেখলো কাসেদ।
এইমাত্র মাষ্টারকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে জাহানারা।
মাষ্টার বললো, এবার যাই তাহলে?
জাহানারা বললো যাই নয়, আসি। কাল ঠিক সময় আসবেন তো? আসবেন কিন্তু। নইলে আরো বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখবো। একটু শাসন, একটু রাগ, একটু অভিমান।
এমন করে তো কাসেদের সঙ্গে কথা বলে নি জাহানারা।
শিউলী বিড়বিড় করে কী বললো কিছু বোঝা গেল না।
জাহানারা তার মাষ্টারের দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে।
দাঁতগুলো চিকচিক করছে বিকেলের রোদে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো ওরা।
শিউলী ডাকলো, জাহানারা।
ওদের দেখে চোখ জোড়া বড়ো বড়ো করে তাকালো জাহানারা, তোমরা ওখানে করছো কী?
শিউলী হেসে দিয়ে বললো, প্ৰেমালাপ করছি, তাই না কাসেদ সাহেব?
ঘাড় বাকিয়ে বাঁকা চোখে কাসেদের দিকে তাকালো সে।
জাহানারা ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে সামনে।
কাসেদ কোন উত্তর না দিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলো।
জাহানারা শুধালো, আপনি কখন এসেছেন?
কাসেদ কোন জবাব দেবার আগেই শিউলী বললো, অনেকক্ষণ হয়। উনি এসেছেন, আমি আটকে রেখেছি এখানে।
জাহানারা বললো, ভিতরে গেলেই তো পারতেন।
না, ভাবলাম আপনার অসুবিধা হতে পারে। যতই লুকোতে ইচ্ছে করুক না কেন, গলার স্বর অস্বাভাবিক শুনালো জাহানারার কানে।
জাহানারা মিষ্টি হাসলো, কী যে বলেন, অসুবিধে কেন হবে! আসুন ভেতরে বসবেন।
কাসেদের মনে হলো জাহানারার কথাবার্তায় আগের সেই আন্তরিকতা নেই। বাড়িতে এসেছে। যখন বসাতে হবে তাই বসতে বলছে সে।
সামনে জাহানারা আর পেছনে শিউলী আর কাসেদ। পাশাপাশি। শিউলী চাপা স্বরে শুধালো, আপনার কী হয়েছে বলুন তো, সেই তখন থেকে কেমন যেন গুম হয়ে আছেন।
কাসেদ বললো, ও কিছু না।
জাহানারা পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে কিছু বললেন কি?
কাসেদ সংক্ষেপে বললো, না।