দিন কয়েক থেকে মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

মাঝে মাঝে জ্বর আসে। ছেড়ে যায়। আবার আসে।

এই জ্বরের মধ্যেও মা নামাজ পড়া বাদ দেন নি। পড়েন, বসে বসে।

আর সারাক্ষণ শব্দ করে দোয়া দরুদ পাঠ করেন।

মাঝে মাঝে দুঃখ প্রকাশ করেন নাহারের জন্যে আর কাসেদের জন্যে।

বলেন, আমি মরে গেলে তোদের যে কী হবে ভেবে পাই না।

আজ বিকেলে কাসেদ বাসায় ফিরে এলে মা কাছে ডাকলেন ওকে।

বললেন, এখানে এসে বসো, আমার মাথার কাছে।

কপালে হাত রেখে কাসেদ দেখলো জ্বর আছে কিনা। নেই।

নাহার বললো, এই একটু আগে জ্বর নেমে গেছে।

মা বললেন, আমাকে নিয়ে তোরা ভাবিস নে। বুড়ো হয়ে গেছি, আর ক’দিন বাঁচবো।

কাসেদ বললো, ওসব অলক্ষুণে কথা কেন বলছো মা, তুমি এখন ঘুমোও। এইতো কাল সকালেই ভাল হয়ে যাবে।

মা চুপ করলেন না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো তাঁর। তবু বললেন, তোর খালু এসেছিলো, নাহারের বিয়ের সেই পুরানো প্রস্তাবটা নিয়ে।

শ্বাস নেবার জন্যে থামলেন মা।

নাহার বিছানার ওপাশে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো। বিয়ের কথা শুনে বার-কয়েক ইতস্তত করে পাশের ঘরে সরে গেলো সে।

মা আবার বললেন, আমি এ বিয়েতে মত দিয়েছি। অসুখে যেমন ধরেছে কে জানে কখন মরে যাই। যাবার আগে ওকে স্বামীর ঘরে তুলে দিয়ে যেতে চাই। নইলে মরেও শান্তি পাবো না আমি। গলাটা ধরে এলো মায়ের। বার দু’য়েক ঢোক গিলে নিয়ে বললেন, তাছাড়া ছেলেটাও তো খারাপ না, ভালোই, এখন তুই মত দিলেই হয়ে যায়।

মায়ের কথায় মৃদু হাত বুলোতে বুলোতে কাসেদ আস্তে করে বললো, আমার মতামতের কী আছে, তোমরা যা ভালো মনে করো, করবে। অবশ্য নাহারকে একবার জিজ্ঞেস করে নিয়ো।

ওকে আবার জিজ্ঞেস করবো কী? মা চোখ তুলে তাকালেন ওর দিকে।

আমরা কি ওর খারাপ চাই? ছেলেটা শুনেছি, দেখতে শুনতে ভালো।

মা পাশ ফিরে শুলেন।

কাসেদ নীরবে ওঁর মাথায় হাত বুলোতে লাগলো।

রাতে ওর ঘরে খাবার নিয়ে এলে নাহারকে বসতে বললো কাসেদ।

বললো তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

নাহার ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে তাকালো ওর দিকে। বসলো না। দরজার কপাট ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

কাসেদ ভাবলো কথাটা কিভাবে বলা যেতে পারে।

বিছানার ওপর থেকে উঠে টেবিলের পাশে গিয়ে বসলো সে।

নাহার অপেক্ষা করছে দাঁড়িয়ে।

থালার মধ্যে ভাত ঢেলে নিতে নিতে কাসেদ বললো, তোমার বিয়ের জন্যে খালু একটা প্ৰস্তাব এনেছেন শুনেছো–

নাহার কোন জবাব দিলো না।

কাসেদ ভাতের থালা থেকে মুখ তুলে দেখলো তাকে।

তবু সে চুপ।

কাসেদ বললো, মা অবশ্য তাঁর মত দিয়েছেন। তুমি যদি মত দাও, তাহলে আমারও আপত্তির কিছু নেই।

নাহার নড়েচড়ে দাঁড়ালো।

ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হলো দরজায়।

কাসেদ এবার আর তাকালো না।

নিঃশব্দে ভাত খেতে লাগলো সে। খেতে খেতেই বললো, তোমার ইচ্ছা হলে ছেলেটিকে দেখতেও পারো। আর যদি মত না থাকে তাও বলতে পারো। সঙ্কোচের কিছু নেই।

তবু চুপ করে রইলো নাহার। মুখখানা নুইয়ে পায়ের পাতার দিকে চেয়ে রইলো সে।

কী ব্যাপার, কিছু বলছে না যে?

নাহার নীরব।

তোমার কি কোন মতামত নেই?

তবু চুপ সে।

তুমি কি কিছুই বলবে না? কাসেদ স্থির দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে।

আমি কী বলবো? এতক্ষণে কথা বললো নাহার। ওর গলার স্বরে বিরক্তি আর বিতৃষ্ণা, আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই করবেন, আমার কোন মতামত নেই। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো সে।

শেষের দিকে গলাটা জড়িয়ে এলো তার।

তখনো দাঁড়িয়ে সে।

হ্যারিকেনের আলোয় মুখখানা ভালো করে দেখা গেলো না।

পাশের ঘরে মা দরুদ পড়ছেন শুয়ে শুয়ে। এখান থেকে সব কিছু শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট।

ভাত খেয়ে উঠে দাঁড়াতে থালাবাসনগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলো নাহার।

ও চলে যেতে খাতা-কলম নিয়ে বসলো কাসেদ।

লিখবে।

ভীষণ লিখতে ইচ্ছে করছে ওর।

 

অফিসের কানাঘুষো ইদানীং অন্য রূপ নিয়েছে।

মকবুল সাহেবের প্রতি বড় সাহেবের পক্ষপাতিত্ব সবার মনে ঈর্ষার জন্ম দিয়েছে। আর তাই রোজ অফিসে এসে কাজের ফাঁকে তারা চাপা সুরে এই অর্থপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার ঝড় তুলছে। রোজ বিকেলে সাহেব হাসপাতালে যান অসুস্থ মকবুল সাহেবকে দেখতে, তাঁর খবরাখবর নিতে।

কিন্তু কেন, কিসের জন্য?

শহরে এমন আরেকটি অফিস কী কেউ দেখাতে পারবে যার একজন কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়লে বড় সাহেব রোজ তাকে দেখতে যান? শুধু কী দেখতে যাওয়া?

রোজ যাবার সময় বিস্কিট, হরলিক্স, ফলমূল কত কিছু নিয়ে যান তিনি। তাছাড়া ওঁর পেছনে টাকা খরচ করার ব্যাপারেও এতটুকু কাৰ্পণ্য করছেন না তিনি। শোনা যাচ্ছে কোলকাতা থেকে একজন নামকরা ডাক্তার আনার কথাও ভাবছেন বড় সাহেব।

কিন্তু কেন?

কাসেদ বলে, যদি টাকা খরচ করেই থাকেন, আপনাদের এত মাথাব্যথা কেন? শুনে বিশ্ৰীভাবে হাসে এক নম্বর কেরানী। বলে, মাথাব্যথা হতো না, যদি না এই টাকা খরচের পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য লুকানো থাকতো।

বলে আবার হাসে লোকটা।

কাসেদ বুঝতে পারে না, ও কী বলতে চায়। ইতস্তত করে আবার প্রশ্ন করে, তার মানে?

মানে? মানে অত্যন্ত সহজ। চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে এক নম্বর বলে, মকবুল সাহেবের একটি বয়স্ক মেয়ে আছে সে খবর রাখেন?
কাসেদ বলে, হ্যাঁ রাখি। একটি নয় দু-তিনটি মেয়ে আছে তাঁর।

ব্যাস। মাথা দুলিয়ে এক নম্বর কেরানী আবার বলে, বাকিটুকু আপনি নিজেই বুঝে নিন।

কাসেদের বুঝতে বাকি থাকে না।

একাউণ্টেণ্ট তার টেবিল থেকে গলা বাড়িয়ে বলেন, পরশু দিন বিকেলে দেখলাম বড় সাহেব তাঁর গাড়ি করে ওদের হাসপাতাল থেকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছেন।

কাসেদ পরক্ষণে বলে, ওটা অন্যায় কিছু করেন নি তিনি।

আরে সাহেব আপনার এত গা জুলছে কেন শুনি? এক নম্বর কেরানী টেনে টেনে বলেন, আমরা তো আর আপনাকে বলছি না।

জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কাসেদ, বড় সাহেবকে এদিকে আসতে দেখে চুপ করে গেলো সে।

বড় সাহেব কেন যে এ ঘরে এলেন কিছু বুঝা গেল না।

লম্বা অফিস ঘরটায় বার কয়েক পায়চারী করলেন তিনি। মনে হলো কী যেন গভীরভাবে ভাবছেন, চিন্তা করছেন।

স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হবার আগে এবং পরে সব সময় তাঁকে কিছুটা চিন্তাক্লিষ্ট দেখাতো।

কিন্তু আজকের ভাবনার মধ্যে রয়েছে একটা অনিবাৰ্য অস্থিরতা। কেরানীরা এখন আর কথা বলছে না।

কাজ করছে।

Leave a Reply