মকবুল সাহেব। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত মকবুল সাহেব কি ভালো হবেন?

এ রোগ তো ভালো হবার নয়। আর তিনি যদি ভালো না হন তাহলে তার জায়গায় নিশ্চয় এই অফিসের একজনকেই নেয়া হবে। কাকে নেবে কিছু জানেন? এক নম্বর কেরানী চাপাস্বরে শুধোলেন দু’নম্বর কেরানীকে।

দু’নম্বর কী বললেন কিছু শোনা গেলো না।

দুপুরে বড় সাহেব ডেকে পাঠালেন তাকে।

কিছু টাকা দিলেন।

খোঁজখবর নিলেন।

বললেন, আমি অবশ্য বিকেলের দিকে একবার যাবো।

কাসেদও ভাবছিলো বিকেলে একবার হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসবে লোকটাকে।

লোকটাকে দেখতে যাওয়ার আগ্রহের আড়ালে আরেকটি বাসনা লুকিয়ে ছিলো। সেই মেয়েটিকে দেখবে। বিকেলের রঙে যার দেহ রাঙানো। কিন্তু অফিস ছুটি হবার একটু আগে সালমা এসে হাজির।

মুখখানা গভীর। কালো। চুলগুলো এলোমেলো। চোখে চরম বিতৃষ্ণা। কাসেদ চমকে উঠলো। কী ব্যাপার, হঠাৎ অফিসে?

সালমা বললো, বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি।

কাসেদ বললো, দাঁড়িয়ে কেন, বসো।

সালমা বললো, এখানে একগাদা লোকের সামনে কিছু বলতে পারবো না আমি। তোমার কি বাইরে আসতে অসুবিধা হবে?

না, অসুবিধা কিসের। এইতো একটু পরেই অফিস ছুটি হবে, তারপর বাইরে বেরুনো যাবে খ’ন। কিন্তু অমন কী ঘটলো কিছু বুঝতে পাচ্ছিনে। তোমাকে যেন একটু ক্লান্ত মনে হচ্ছে?

ক্লান্ত বইকি, সালমা চাপাস্বরে বললো, বড় ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। শেষের কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেলো না।

কাসেদ বুঝলো, কিছু একটা ঘটেছে। হয়তো স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করেছে সে। কিম্বা মা-বাবার সঙ্গে।

অফিসে আর কোন আলাপ হলো না।

রাস্তায় নেমে কাসেদ বললো, কী দরকার বলো।

সালমা বললো, এই রাস্তায়? চলো না কোথাও গিয়ে বসা যাক।

কোথায় যাবে?

কেন, কোন রেষ্টুরেণ্টে?

খোলা রেস্তোরায় বসা ঠিক হবে না।

তাহলে কেবিনে বসবে।

কাসেদ ইতস্তত করলো কিন্তু সালমার অনুরোধ এড়াতে পারলো না সে।

চায়ের পেয়ালা সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো সালমা।

টেবিলের ওপর হিজিবিজি কাটলো।

কাসেদ বললো, কী চুপ করে রইলে যে, কিছু বলবে না?

সালমা একবার আড়চোখে দেখে নিলো তাকে। তারপর বললো, আচ্ছা আমাকে দেখে তোমার কী মনে হয় বলতো?

কাসেদ শুধালো, হঠাৎ এ প্রশ্ন?

সালমা বললো, না মানে বলছিলাম কী, আমাকে দেখে কি তোমার মনে হয় আমি খুব সুখী?

চায়ের পেয়ালাটা মুখের কাছ থেকে নামিয়ে এনে কাসেদ বললো, এ প্রশ্নের জবাব দেয়া অত্যন্ত কঠিন। কারণ সুখ জিনিসটা হচ্ছে মনের ব্যাপার, ওটা যদি বাইরের হতো, তাহলে সাদা চোখে দেখা যেতো। তোমার মনকে তো আর আমি দেখতে পাচ্ছি নে।

দেখবার চেষ্টাই-বা করলে কবে। সালমার কণ্ঠস্বরে অভিমান ঝরছে, নিজেকে নিয়েই তো ব্যস্ত থাকলে চিরকাল, অন্যের কথা ভাববার অবকাশ কোথায়। কথা বলতে গিয়ে বারবার মুখখানা লাল হয়ে উঠছিলো ওর। কিন্তু কাসেদের দিকে একবারও দেখলো না সে।

চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো কাসেদ। বিব্রত গলায় বললো, আমার কথা বাদ দাও। তোমার নিজের কথা কী বলছিলে তাই বলো।

অল্পক্ষণের জন্যে চুপ করে গেলো সালমা।

কাসেদের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারে নি সে।

এক চুমুক চা খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সালমা আবার বললো, সব মানুষই জীবনে সুখী হতে চায়। আমিও চেয়েছি। যাকে ভালবাসলাম তাকে পেলাম না। যাকে বিয়ে করতে হলো তাকে ঠিক মনের মতোটি করে পেতে চাইলাম। কিন্তু–

বলতে গিয়ে সহসা থেমে পড়লো সালমা।

মাথার ওপরে ফ্যানটা ঘুরছে জোরে।

এলোমেলো চুলগুলো উড়ছে বাতাসে।

মুখ খুলে কাসেদের দিকে তাকালো সালমা। আস্তে করে বললো, সে চাইলো আমি তার মতো হই। পাতলা সিফনের শাড়ি পরে ঠোঁটে আর মুখে রঙ মেখে ওর সঙ্গে ক্লাবে যাই। ওর বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিই, গল্প-গুজব করি। দুই মন, দুই মেরুতে বসে। মিল যেখানে নেই সেখানে সুখের তালাশ করা পাগলামো, তাই না?

কাসেদ কী বলবে ভেবে পেলো না।

সালমা নীরব।

কাসেদের কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে।

কাসেদ বললো, এ নিয়ে চিন্তা করে কী হবে সালমা? এ চিন্তার কি কোন শেষ আছে?

সালমা উত্তরে বললো, বিপাশাকে যদি তোমার কাছে দিয়ে যাই তুমি রাখবে? কাসেদ অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে, কেন বলতো?

 

সালমা কী যেন ভাবলো। ভেবে বললো, ওকে তোমার কাছে রেখে আমি কোথাও চলে যাবো।

এ পাগলামোর কোন মানে হয় না, কাসেদ হাসতে চেষ্টা করলো। বললো, জীবনের পথ যত কঠিন আর যত দুৰ্যোগময় হোক না কেন, তার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না। ওটা কাপুরুষতার লক্ষণ।

তাই নাকি? অপূর্ব হাসলো সালমা। টেনে টেনে বললো, কাপুরুষ আমি না তুমি?

কাসেদ ইতস্তত করে বললো, তার মানে?

মানে, তুমি কি বলতে চাও, তুমি একজন বীর-পুরুষ?

কাসেদ হেসে দিয়ে বললো, বীর-পুরুষ হয়তো নই, তবে কাপুরুষও নই।

কাপুরুষ নও? সালমা শব্দ করে হাসলো, তাহলে একটা কথা বলি?

বলো।

সালমা নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। ওর ঠোঁটের কোণে মৃদু মৃদু হাসি। তারপর টেনে টেনে বললো, আজ এখান থেকে বেরিয়ে, তুমি আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে দূরে বহু দূরে কোথাও?

কাসেদ চমকে উঠলো। সহসা সে বুঝতে পারলো না কী বলবে। কী বলা যেতে পারে। সালমা আবার লাল হলো। মুখখানা সরিয়ে নিলো অন্যদিকে।

কিছুক্ষণ দু’জনে একেবারে চুপ।

একটু পরে সালমা আবার বললো, কী, চুপ করে রইলে যে, বীর-পুরুষের সাহসে কুলোচ্ছে না বুঝি?

কাসেদ গম্ভীর গলায় বললো, একটা অসম্ভব প্রস্তাব করে বসলে তো আর চলে না।

অসম্ভব? টেবিলের উপর ঝুঁকে এলো সালমা, তীক্ষ্ণ গলায় বললো, সাহসে কুলোচ্ছে না তাই বলো। কেন মিছামিছি বাজে অজুহাত দেখাচ্ছে! সালমা নড়েচড়ে বসলো। বেয়ারাকে ডাকো। বিলটা চুকিয়ে দিই।

কাসেদ বললো, কিন্তু কী দরকারী কথা আছে বলেছিলে, তাতো বললে না।

সালমা বললো, থাক তার প্রয়োজন আর নেই। যে গাছে প্ৰাণ নেই তার গোড়ায় পানি ঢেলে কী হবে? খুব তো বড়াই করছিলে কাপুরুষ নই, কাপুরুষ নই। সহসা কান্নায় গলাটা ধরে এলো তার।

কাসেদ বললো, অকারণে কেন একটা সহজ সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছ বলো তো? তুমি কী চাও আমার কাছ থেকে?

কিছু না। কিছু না। কিছু না। এতক্ষণে সত্যিকার কান্না নেমে এলো তার দু’চোখ বেয়ে। কাপড়ের আঁচলে অশ্রুবিন্দু মুছে নিতে নিতে সে আবার বললো, কিছুই চাই না, আমি। চাই শুধু ঝগড়া করতে। সারাটা জীবন তাইতো করে এসেছি।

এতক্ষণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কাসেদ। বললো, ওটা বোধ হয় আমাদের কপালে লেখা ছিলো সালমা। নইলে যখনই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, আমরা ঝগড়া করেছি। করি। কেন করি?

তুমি আমাকে আঘাত দিয়ে আনন্দ পাও, তাই।

কাউকে আঘাত দিয়ে কেউ আনন্দ পায় না সালমা।

সালমা কোন জবাব দিলো না।

পরনের শাড়িটা গুছিয়ে নিতে নিতে উঠে দাঁড়ালো সে।

ওকি, চললে নাকি?

চিরকাল বসে থাকবো বলে এখানে আসি নি নিশ্চয়। সালমার গলার স্বরটা অদ্ভুত শোনালো।

কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলো কাসেদ। সালমা ততক্ষণে কেবিনের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবিন ছেড়ে কাসেদও বেরিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে।

Leave a Reply