কাসেদের আপন বোন নয় নাহার।

মায়ের দূর সম্পৰ্কীয় এক খালাতো বোনের মেয়ে। ছোটবেলায় ওর মা মারা যান। ওর বাবা তখন কী একটা কোম্পানীতে চাকরি করতেন।

স্ত্রীকে হয়তো বড় ভালবাসতেন তিনি, তবুও কিছুদিন পরে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মিলিটারীতে চলে যান। নাহারকে রেখে যান মায়ের কাছে। মাঝে মাঝে চিঠি আসতো।

কখনো মাদ্রাজ থেকে। কখনো পেশোয়ার থেকে। কখনো কানপুর।

শেষ চিঠি এসেছিলো আরাকান থেকে।

তারপর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি।

কেউ বলেছে যুদ্ধে মারা গেছে।

কেউ বলেছে, জাপানীরা ধরে নিয়ে গেছে টোকিওতে।

লড়াই শেষ হলো।

সন্ধি হলো শত্ৰু-মিত্ৰে।

তারপর আরো কত বছর গেলো নাহারের বাবা আর ফিরে এলেন না।

মা বলতেন, আমার কোন মেয়ে নেই, তুই আমার মেয়ে। তোকে মানুষ করে বড় ঘরে বিয়ে দেবো আমি। তোর ঘরের নাতি-পুতি দেখবো, তবে মরবো।

বাবা বলতেন, বেশ হলো, এতদিনে মেয়ের সখ মিটলো তোমার।

মা বলতেন, মিটবে না। খোদার কাছে কত কেঁদেছি, কত বলেছি আমায় একটা মেয়ে দাও। দেখলে তো, খোদার কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। তবু তুমি এক বেলা নামাজ পড় না। কেন পড় না বলতো? তোমার কি পরকালের একটুও ভয় হয় না?

আবার ইহকাল পরকাল নিয়ে এলে কেন বলতো? বাবা ক্ষেপে উঠতেন, বেশ তো কথা হচ্ছিলো।

মা স্নান হেসে বলতেন, নামাজের নাম নিলেই তোমার গায়ে জ্বর আসে কেন বলতে পারো?

বাবা কিছু বলতেন না, শুধু সরোষ দৃষ্টিতে এক পলক তাকাতেন মায়ের দিকে। মা আফসোস করে বলতেন, তুমি আমাকে দোজখে না নিয়ে ছাড়বে না। বাবা নির্বিকার গলায় জবাব দিতেন, বেহেস্তের প্রতি আমার লোভ নেই। তোমার যদি থেকে থাকে তুমি যেও, আমি তোমার পথ আগলে দাঁড়াবো না। এরপর মা থেমে যেতেন, অবুঝ স্বামীর সঙ্গে তর্ক করা নিরর্থক তা তিনি ভালো করেই জানতেন।

সামনে খোলা খাতাটার দিকে চোখ পড়তেই কাসেদ বিব্রত বোধ করলো। কবিতা লিখতে বসে খাতার মধ্যে এতক্ষণ সব কী লিখছে সে? ইকবাল, জাহানারা, বিয়ে, নাহার, মিলিটারী, কানপুর, নামাজ, শিউলী। একটার পর একটা হিজিবিজি লেখা। সাদা কাগজটা আরো অনেক শব্দের ভরে ভরে উঠছে। খাতা থেকে পাতাটা ছিড়ে নিয়ে বাইরে ফেলে দিলো কাসেদ।

দরজার দিকে চোখ পড়তে দেখলো, নাহার দাঁড়িয়ে।

কী ব্যাপার কিছু বলবে?

নাহার বললো, মা ডাকছেন। বলে চলে গেল সে।

মা তখনো গল্প করছিলেন খালুর সঙ্গে। খালু একটা মোড়ার ওপর বসে। মা চৌকির ওপর পা ছড়িয়ে খালুর পান বানাচ্ছেন, আর কী যেন আলাপ করছেন।

নাহার একপাশে দাঁড়িয়ে।

কাসেদ আসতে মা বললেন, বস।

খালু বললেন, তুমি কি সেই কেরানীগিরির চাকরিটা এখনো আঁকড়ে রেখেছো নাকি?

কাসেদ সায় দিয়ে বললো, হ্যাঁ।

খালু বললেন, অন্য কোথায় ভালো দেখে একটা কিছু পাওয়া যায় কিনা চেষ্টা-চরিত্র করো। এ দিয়ে কতদিন চলবে।

খালু নিজে এককালে কেরানী ছিলেন; তাই কেরানীগিরির বেদনা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন।

কাসেদকে চুপ থাকতে দেখে তিনি আবার বললেন, ধোপার গাধা আর কোম্পানীর অফিসের কেরানীর মধ্যে পার্থক্য নেই বুঝলে? এতে না আছে কোন রোজগার, না আছে সম্মান।

কাসেদ বললো, তিনজন মানুষ আমরা, এ রোজগারেই চলে যাবে। টাকা টাকা করে, টাকা দিয়ে করবো কী?

মা বললেন, শোন, ছেলের কথা শোন। যেন সংসার এই থাকবে। ঘরে আর বউ ছেলে আসবে না। বলি তুই এমন হলি কী করে বলতো, তোর বাবা তো এমনটি ছিলেন না। কাসেদ কোন উত্তর দেবার আগেই খালু বললেন, ‘এ নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। বড়বু’। মাথায় বোঝা চাপলে আপনা থেকেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে একগাল হাসলেন তিনি। নাহার হঠাৎ বললো, মা ভাত দেবো?

মা ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, তাইতো, কথায় কথায় দেখছি অনেক রাত হয়ে গেছে। যাও ভাত বেড়ে নাও, তোমার খালুও এখানে খাবেন।
খালু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না বড়বু, আমি বাসায় গিয়ে খাবো। ওরা সবাই বসে থাকবে।

মা হেসে বললেন, মেয়ে আসছে বেড়াতে, বাসায় নিশ্চয়ই খুব ভালো পাক-শাক হচ্ছে। আমাদের এখানে ডাল-ভাত কি আর মুখে রুচবে?
কী যে বলেন বড়বু, খালু বিনয়ের সঙ্গে বললেন, বাসায় কি আর আমরাও কোর্মা পোলাও খাই, ডাল ভাত সব জায়গায়। এখন চলি, আরেক দিন এসে খেয়ে যাবো। যাবার উদ্যোগ করতে করতে আবার থেমে গেলেন খালু। কাসেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সালমা এসেছে ঢাকায়। বড়বু’কে বলে গেলাম রোববার দিন ওকে নিয়ে বাসায় এসো। কাসেদ অবাক হয়ে বললো, রোববার দিন কেন?

মা বললেন, তোমাদের দাওয়াত করে গেলেন উনি। নাতিনের আকিকা হবে। প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না কাসেদ। যখন বুঝতে পারলো তখন আরো চিন্তিত হলো সে, সালমার মেয়ে হয়েছে নাকি?

মা পরক্ষণে বললেন, ওমা তুই জানিসনে? বলতে গিয়ে কথাটা গলার মধ্যে আটকে গেলো তার। ঢোক গিলে আবার বললেন, আজ তিন মাস হতে চললো, তা তুই জানবি কোত্থেকে, আত্মীয়-স্বজন কারো খোঁজ কী তুই রাখিস। কী যে হলি বাবা।

খালু হেসে বললেন, ও কিছু না বড়বু। এ হলো কেরানী রোগ।

আর কারো কথা মনে থাকে না, সব ভুলে যেতে হয়।

আরেকটা পান মুখে পুরে দিয়ে একটু পরে বিদায় নিলেন খালু।

পাকঘরে বসে খাওয়ার আয়োজন করছে নাহার।

মা কলতলায় বসে বসে অজু করছেন। এশার নামাজ না পড়ে ভাত মুখে দেন না তিনি।

কাসেদ তখনো মায়ের বিছানায় বসে।

নীরব।

নীরবে ভাবছে সে।

কী আশ্চৰ্য, সালমা মা হয়েছে।

সেই সালমা–

পরনে কালো ডোরাকাটা ফ্রক। মাথায় সাপের মত সরু একজোড়া বিনুনী। পায়ে স্লিপার।

অপরিসর বারান্দায় রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

পেছন থেকে পা টিপে টিপে এসে ওর চোখজোড়া দু’হাতে চেপে ধরলো কাসেদ।

এই কী হচ্ছে, হাতজোড়া ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সালমা। কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সে সহসা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, সেই কখন থেকে বসে আছি। আর উনি এতক্ষণে এলেন।

ওর একটা বিনুনীতে টান মেরে কাসেদ বললো, এই তোকে একশো বার নিষেধ করে দিয়েছি না মিথ্যে কথা বলিসনে।

সালমা অবাক হয়ে বললো, বা-রে মিথ্যে কথা কই বললাম।

এই তো বললি।

কই, কখন?

এইতো একটু আগে।

ইস, উনি বললেই হলো, ঠোঁট উল্টে মুখ ভেংচালো সালমা।

ওর বেণী জোড়া ধরে আবার টান দিলো কাসেদ, বসে আছি বললি কেন, তুই তো আসলে দাঁড়িয়েছিলি।

চুলে টান পড়ায় যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো সালমা। তারপর চিৎকার করে উঠে বললো, বলবো, একশোবার মিথ্যে কথা বলবো আমি। তাতে তোর কী শুনি।

কাসেদ ক্ষেপে গিয়ে ওর মাথাটা রেলিঙের সঙ্গে ঠুকে দিয়ে বললো, তুই করে বললি কেন রে, আমি কি তোর ছোট না বড়?

সালমা ততক্ষণে কাঁদতে শুরু করেছে।

ওকে কাঁদতে দেখে কাসেদ বিব্ৰতবোধ করলো। বার কয়েক হাফপ্যাণ্টে হাত মুছলো সে। তারপর কাছে এসে দাঁড়িয়ে কোমল গলায় বললো, লেগেছে না-রে?

সালমা কোনো জবাব দিলো না।

একটু পরে ওর পিঠের উপর ভয়ে ভয়ে একখানা হাত রেখে কাসেদ শুধালো, পার্কে যাবি না?

এক ঝটিকায় ওর হাতখানা দূরে সরিয়ে দিলো সালমা।

কাসেদ আবার রেগে গিয়ে বললো, এই এক দুই করে আমি দশ পর্যন্ত গুনবো; এর মধ্যে যদি তুই না যাস তাহলে আমি চললাম। বলে জোরে জোরে এক দুই গুনতে শুরু করলো সে। ন’য়ে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো কাসেদ। সালমা তখনো কাঁদছে। কাসেদকে চুপ করে থাকতে দেখে একবার শুধু আড়চোখে তাকালো সালমা।

কাসেদ অতি কষ্টে দশ উচ্চারণ করলো; কিন্তু সঙ্গে বললো; দেখ তোকে পনেরো পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দিলাম। এবার কিন্তু একটুও নড়াচড় হবে না। বলে আবার গুনতে শুরু করলো সে।

পনেরো বলার পূর্ব মুহূর্তে সালমা চিৎকার করে উঠলো, তুই আমাকে মেরেছিস কেন?

কাসেদ হেসে দিয়ে বললো, আর মারবো না, চল।

ডান হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো সালমা। তারপর ফিক্‌ করে হেসে দিয়ে বললো, আজ কিন্তু আমাকে দোলনায় চড়াতে হবে।

আর একদিন।

তখন ফ্রক ছেড়ে সালওয়ার পায়জামা ধরেছে সালমা।

বয়স বেড়েছে। হয়তো পনেরো কিম্বা ষোল।

Leave a Reply