চলুন, এবার ওঠা যাক। বড় সাহেব আস্তে করে বললেন।
কোন কথা না বলে উঠে দাঁড়ালো কাসেদ।
হয়তো সে অনেক বদলে গেছে।
এখন দেখলে আর সেই পুরনো মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ঘরে উঠে যাবার পথে ভাবলো কাসেদ।
বারান্দার এককোণে একটা মোড়ার উপর বসেছিলো সালমা। চুলগুলো পিঠের ওপরে ফেলে দিয়েছে সে। পরনে একখানা কালো পাড়ের মিহি শাড়ি সাদা জমিনের ওপর হলুদ সুতোর ফুল আঁকা। কানে, গলায়, হাতে অলঙ্কারের বোঝা। সালমা চোখ তুলে কিছুক্ষণ এক পলকে তাকিয়ে রইলো। সহসা কিছু বলতে পারলো না সে, ওর ঠোঁটের কোণে ধীরে ধীরে এক টুকরো মিষ্টি হাসি জেগে উঠলো। পরক্ষণে সারা মুখে সে হাসি ছড়িয়ে পড়লো, কাসেদ ভাই।
কাসেদ বললো, তোমাকে দেখতে এলাম সালমা।
সালমার মুখখানা অকারণে রাঙা হলো। উঠে দাঁড়িয়ে মোড়াটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল সে, বস।
কাসেদ বসলো।
বাড়িতে আজ অনেক অতিথি এসেছে। ঘরে, বারান্দায় ছাদে ছড়িয়ে আছে ওরা। কথা বলছে, হাসছে, আলাপ করছে এটা-সেটা নিয়ে।
ব্যাপার কী, অনেক শুকিয়ে গেছ যে।
সালমার কথার জবাবে কাসেদ কী বললো স্পষ্ট বোঝা গেলো না।
সালমা আবার শুধালো, প্রেমে পড় নি তো?
কাসেদ অপ্ৰস্তুত গলায় বললো, তার মানে?
মাথার চুলগুলো দু’হাতে খোপাবদ্ধ করতে করতে সালমা বললো, শুনেছি প্রেমে পড়লে নাকি লোক শুকিয়ে যায়।
ওসব বাজে কথা। প্রসঙ্গটা পাল্টাবার জন্য হয়তো, কাসেদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, তোমার মেয়ে হয়েছে জানাও নি তো, একটা চিঠি লিখলেও তো পারতে।
সালমা বললো, জানাতাম, কয়েকবার ইচ্ছেও হয়েছিল লিখি, কিন্তু কী জানো, আজকাল বড় আলসে হয়ে গেছি। একখানি চিঠি লিখবো তাও লিখি লিখি করে হয়ে ওঠে না।
কাসেদ বললো, কুড়িতেই বুড়ি হয়ে গেলে মনে হচ্ছে।
সালমা বললো, বুড়ি হই নি তো কি, ক’বছর পরে মেয়ে বিয়ে দেবো।
বলতে গিয়ে নিজেই হেসে দিলো সালমা, তুমি বস, আমি পলিকে নিয়ে আসি।
আলসে মেয়েটি চপল ভঙ্গি করে ঘরে চলে গেলো, একটু পরে আবার যখন সে সামনে এসে দাঁড়ালো তখন তার কোলে একটা ফুটফুটে মেয়ে।
সালমা বললো, দেখতে ঠিক ওর বাবার মত হয়েছে।
কাসেদ বললো, গায়ের রঙটাও।
সালমা বললো, চোখজোড়া কিন্তু আমার।
হবেও-বা। কাসেদ মৃদু গলায় বললো, নাম কী রেখেছো?
সালমা জবাব দিলো, পলি। ওর বাবার দেয়া নাম। তোমার নিশ্চয় পছন্দ হয় নি?
কাসেদ সংক্ষেপে বললো, না।
ঘাড়টা ঈষৎ বাঁকা করে সালমা অপুর্ব কণ্ঠে শুধালো, তুমি হলে কী নাম রাখতে?
এসব বাতুল প্রশ্নের কোন মানে হয় না। কাসেদ নড়েচড়ে বসলো।
সালমা বললো, তবু বল না শুনি।
কাসেদ ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, তারপর বললো, কী নাম রাখতাম জানি না, তবে এ মুহুর্তে একটা নাম মনে পড়ছে আমার, বিপাশা, হয়তো তাই রাখতাম।
বিপাশা। বার-কয়েক নামটা উচ্চারণ করলো সালমা। কী যে ভাবলো, ভেবে পরক্ষণে বললো, আমি ওকে বিপাশা নামেই ডাকবো।
এতে আমার আপত্তি আছে, ওর কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কাসেদ বললো, ওর বাবা যে নাম দিয়েছে সেই নামে তোমাকেও ডাকতে হবে। কাসেদের কণ্ঠে যেন ধমকের সুর। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কাসেদ। পরিচিত একজন মহিলাকে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে থেমে গেলো।
কাসেদের মনে হল যেন এর আগে কোথাও দেখেছে তাকে। মহিলার চাউনি দেখে মনে হলো, তিনিও যেন তাকে চিনতে পেরেছেন। সালমা বললো, ইনি মিসেস চৌধুরী। ওর স্বামী বিপাশার বাবার সঙ্গে এক সাথে কাজ করতো কুড়িগ্রামে। আর ইনি হলেন–
ওকে আমি চিনি। সালমাকে থামিয়ে দিয়ে মিসেস চৌধুরী অর্থপূর্ণ হাসি ছড়ালেন।
কাসেদ তখন স্মৃতির খাতায় মহিলার ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। সহসা শুধালো, আপনাকে এর আগে কোথায় যেন দেখেছি?
জী হ্যাঁ। মহিলা মৃদু হেসে বললেন, জাহানারাদের ওখানে।
বেশি ভাবতে হলো না মিসেস চৌধুরীর জন্যে। জাহানারাদের বাসায় আলাপ হওয়া মিলি চৌধুরীকে একটু পরেই খুঁজে পাওয়া গেলো।
মিলি চৌধুরী একটু শুধোলেন, ভালো আছেন তো?
কাসেদ সংক্ষেপে বললো, ভালো।
হঠাৎ কেন যেন সালমাকে গভীর দেখালো। কাসেদের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে কী যেন আবিষ্কার করার চেষ্টায় মেতে উঠেছে সে।
মিলি বললেন, নতুন কিছু লিখলেন?
কাসেদ বললো, না।
আলাপ জমলো না। একটু পরে বারান্দা ছেড়ে ঘরে চলে গেলেন মিলি চৌধুরী। এখানে দু’জন নীরব।
নীরবতা গুঁড়িয়ে কাসেদ শুধালো, হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেলে যে?
না, এমনি। সালমা সহজ হতে চেষ্টা করলো, পলির চোখেমুখে আদর করলো সে। দুহাতে দোলনার মত করে বার কয়েক দোলাল তাকে।
তারপর যতদূর সম্ভব সহজ গলায় শুধালো, জাহানারাটা কে?
জাহানারা? সহসা কিছু বলতে পারলো না কাসেদ। অপ্ৰস্তুত ভাবটা কাটিয়ে নিতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো তার। একটু পরে বললো, জাহানারা আমার একজন বান্ধবীর নাম।
বান্ধবী না আর কিছু? কাসেদের চোখেমুখে কী যেন খুঁজছে সালমা।
ওর চোখের মণিজোড়া সহসা বড় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি। সে হাসির কোন অর্থ আছে হয়তো, কিম্বা নেই।
কাসেদ শুধালো, বান্ধবীর অন্য কোন মানে আছে নাকি?
সালমা বললো, আগে ছিলো না। এখন আছে। আগের দিনে ছেলের সঙ্গে ছেলের বন্ধুত্ব হতো। মেয়েদের সঙ্গে মেয়ের। আজকাল ছেলেতে মেয়েতে বন্ধুত্বের পালাটা বড় জোরেশোরে শুরু হয়েছে।
তাতে কি এর অর্থগত রূপটা পাল্টেছে?
পাল্টেছে বই কী? সালমা দৃঢ় গলায় বললো, এখন তার অর্থ এক নয়, অনেক। বন্ধুর স্ত্রীকেও বলি বান্ধবী, নিজের স্ত্রীকেও বলি বান্ধবী। বন্ধুর প্রেমিকা, তাকেও ডাকি বান্ধবী বলে, আবার নিজের প্ৰেয়সী তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলি, বান্ধবী। সব বান্ধবী এক হলো নাকি?
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সালমা।
কাসেদ নীরব।
ওকে চুপ থাকতে দেখে সালমা আবার শুধালো, তোমার বান্ধবীটি কোন শ্রেণীর জানতে পারি কি? বলতে গিয়ে সামনে ঝুঁকে এলো সালমা। কয়েকগুচ্ছ চুল মাথার উপর থেকে গড়িয়ে এসে কপালে ঢলে পড়লো, চুলগুলো এখন বাতাসে দুলছে।
কাসেদ তখনো নীরব।
খানিকক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙে সে বললো, তুমি যে কয়েকটি শ্রেণীর কথা বললে তার কোনটিতেই সে পড়ে না।
সামান্য জবাবটা দিতে এত দেরি হলো কেন? ভ্রূজোড়া বিস্তৃত করে আবার শুধালো সালমা।
সহসা রেগে উঠলো কাসেদ। তোমার সঙ্গে বাজে তর্ক করতে আমি আসি নি সালমা।
এসব আমার ভাল লাগে না। বলে উঠে দাঁড়ালো সে। সে আমি জানি। ম্লান গলায় আস্তে করে বললো সালমা! বলে মুখখানা কেন যেন অন্যদিকে সরিয়ে নিলো, সে হয়তো আড়াল করে নিলো কাসেদের কাছ থেকে। কাসেদ শুধু একবার ফিরে তাকাল, কিছু বললো না।
ঘরের ভেতর যেখানে ফরাস পেতে বুড়ো-বুড়িরা গল্পে মেতে উঠেছে সেখানে যাবার জন্যে পা বাড়ালো কাসেদ।
বুড়ো-বুড়িদের আলোচনার ধারা ভিন্ন রকমের।
এখানকার আলাপের প্রসঙ্গ অতি জাগতিক।
সোনা রূপোর দর কমলো কী বাড়লো।
কোন্ বাজারে ভালো তারি-তরকারি পাওয়া যায়।
কোন্ দোকানে সস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি হয়।
কোথায় গেলে মেয়ের জন্য একটা ভালো পাত্র জোটার সম্ভাবনা আছে–এমনি সব আলোচনা।
কাসেদকে আসতে দেখে খালু বললেন, এসো বাবা, বোসো।
মা সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকালেন ওর দিকে।
খালা পান চিবেচ্ছিলেন বসে বসে। আঙ্গুলের ডগা থেকে একটুখানি চুন চুষে নিয়ে বললেন, তুমি এলে ভালই হলো, শোনো বাবা, তোমার খালুজী নাহারের জন্য একটা ভালো প্ৰস্তাব এনেছেন।
মা বললেন, ওকে খুলে বলো না সব। ওই তো এখন বিয়ে দেবার মালিক। খালু বললেন, শোনো বাবা, ছেলে তেমন কেউকেটা একটা কিছু নয়। আই-কম পর্যন্ত পড়ে, পরীক্ষা দিয়েছিলো, পাশ করেনি। এখন ইডেন বিল্ডিং-এ চাকরি করে। সোয়া শ’ টাকা বেতন।
কাসেদ আবার জিজ্ঞেস করলো, পরীক্ষাটা আবার দেয় নি ক্যান?
দেয় নি নয়, দেবে, আবার দেবে। খালু জবাব দিলেন, ছেলে ভালো এতে কোন সন্দেহ নেই।
ঘরের কোণে পানের পিক ফেলে এসে বললেন, এক মায়ের এক ছেলে, বাবা মারা গেছে ছেলেবেলায়। এক ঘর।
মা বললেন, কোন ঝামেলা নেই, নাহার সুখেই থাকবে।
কাসেদ কোন মন্তব্য করলো না।
কথার ফাঁকে সালমা এসে বসেছে একপাশে। একটু গভীর। একটু যেন অন্যমনস্ক।
খালু বললেন, আজকাল মেয়ে বিয়ে দেবার মত ঝকমারী আর নেই বড়বু। যাদের টাকা আছে তারা টাকা-পয়সা নিয়ে ভালো ভালো ছেলে বেছে নেয়।
খালা বললেন, শুধু মেয়ে কেন, ছেলে বিয়ে দিতেও কী কম ঝামেলা!! একটা ভালো মেয়ে পাওয়া যায় না, আমাদের নজরুলের জন্য মেয়ে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম, যা-ও পাওয়া গেলো, ও খোদা মেয়ের বাবা সি. এস. পি. সি. এস. পি. করে পাগল। সি. এস. পি. ছাড়া মেয়ে বিয়ে দিবেন না।
মা বললেন, আগের দিনে লোকে বংশ দেখতো। এখন সি. এস. পি. ছাড়া দেখে না।
খালু বললেন, ও কিছু না বড়বু, যুগের হাওয়া। যেমন আদি যুগ, মধ্যযুগ, আর কলিযুগ আছে, তেমনি বিয়ের ব্যাপারেও কতগুলো যুগ রয়েছে। ডাক্তার যুগ, ইঞ্জিনিয়ার যুগ, সি. এস. পি, যুগ। এখন সি. এস. পি, যুগ চলছে। বলে শব্দ করে হেসে উঠলেন তিনি। অন্যমনস্ক সালমাও না হেসে পারলো না।
হাসলো সবাই।
খাওয়ার ডাক পড়ায় বৈবাহিক আলোচনা আর এগুলো না। আসর ছেড়ে সকলে উঠে পড়ল।
সালমা সামনে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো, খাওয়ার টেবিলে তোমার পাশের চেয়ারটিতে আমি ছাড়া আর কাউকে বসতে দিয়ো না যেন, তুমি যাও, আমি বিপাশাকে বিছানায় রেখে আসি।
কাসেদ কিছু বলার আগেই সামনে থেকে সরে গেলো সালমা। সে শুধু বোকার মত তাকিয়ে রইলো। ওর চলে যাওয়া পথের দিকে।