বর্ণাকার

দিন কয়েক পরে অফিসে এসে শিউলীর কাছ থেকে আরেকখানা টেলিফোন পেলো কাসেদ।

শিউলী বললো, আহ গলাটা চিনতে পারছেন তো?

কাসেদ জবাব দিলো, অবশ্যই পারছি।

শিউলী বললো, তাহলে শুনুন, আপনাকে কয়েকটা খবর দেবার আছে। বাবা কুমিল্লায় বদলী হয়ে গেলেন।

তাই নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি এখন বাসা ছাড়া পাখি।

তার মানে?

মানে এখন হোষ্টেলে আছি।

হোষ্টেলে?

জী।

ওটা কি মুক্ত বিচরণ ভূমি নাকি?

কেন বলুন তো?

নিজেকে এইমাত্র বাসা ছাড়া পাখির সঙ্গে তুলনা করলেন কিনা, তাই।

ওই যা, আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে, আপনি কবি মানুষ। টেলিফোনে মিহি হাসির শব্দ শোনা গেলো ওর। শিউলী হাসছে।

কাসেদ শুধালো, আপনার খবর বলা শেষ হলো?

শিউলী বললো, না আছে। হ্যালো, শুনুন, প্রত্যেক শুক্রবার আর রোববার আমাদের বাইরে বেরুতে দেয়া হয়।

ভালো কথা, তারপর?

সামনের শুক্রবার আপনার কোন কাজ আছে কি?

আছে কি-না এখনো বলতে পারি নে।

না থাকলে আসুন না বিকেলের দিকে একটু বেড়ানো যাক।

কাসেদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো, হঠাৎ বেড়াবার সাথী হিসেবে…

শিউলী পরক্ষণে জবাব দিলো, আপনাকে ভাল লাগে বলে। সেই পরিচিত শব্দে হেসে উঠলো সে।

কাসেদ বিব্ৰত বোধ করলো। রিসিভারটা ডান হাত থেকে বা হাতে সরিয়ে নিয়ে আস্তে করে বললো, এবার রেখে দিই?

কেন, কথা বলতে বিরক্তিবোধ করছেন বুঝি?

না, তা নয়। কাসেদ ইতস্ততঃ করে বললো, অনেকক্ষণ ধরে ফোনটা আটকে রেখেছি কিনা।

বুঝলাম। শিউলী মৃদু গলায় বললো, ফোনটা কষ্ট পাচ্ছে, রেখে দিন। বলে আর দেরি করলো না সে। রিসিভারটা রাখার শব্দ শুনতে পেল সে।

দু’টার পর থেকে অফিসে আর কারো মন বসতে চায় না।

কখন চারটা বাজবে আর কখন তারা এই চেয়ার-টেবিল আর ফাইলের অরণ্য থেকে বেরিয়ে বাইরে মুক্ত আকাশের নিচে গিয়ে দাঁড়াবে সে চিন্তায় সবার মন উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে।

দুটো থেকে চারটের মাঝখানকার সময়টা তাই কাজের চেয়ে আলাপ-আলোচনা আর গল্প করেই কাটে বেশির ভাগ সময়।

এ সময় হেড ক্লার্কের পানের ডিবে দ্রুত ফুরিয়ে আসতে থাকে। হয়তো তাই কথা বলার মাত্রা বেড়ে যায়। মেজাজ রুক্ষ থাকলে সকলকে গাল দেয়। প্ৰসন্ন থাকলে সবার সঙ্গে হেসে কথা বলে। সকলের কুশল জিজ্ঞেস করে। আজ বিকেলে অফিস থেকে বেরুবার আগে হেড ক্লার্ক বললেন, আজ আপনি আমার বাসায় যাবেন কাসেদ সাহেব, আপনার ছাতাটা নিয়ে আসবেন। শুনছেন?

কাসেদ বললো, আমি তো আপনার বাসা চিনি না। চেনেন না, চিনে নেবেন। পান চিবুতে চিবুতে হেড ক্লার্ক আবার বললেন, চলুন না আমার সঙ্গে আজ যাবেন বাসায়। বিকেলে বিশেষ কারো সঙ্গে কোন এনগেজমেণ্ট নেই তো? শেষের কথাটার ওপর যেন তিনি বিশেষ জোর দিলেন।

কাসেদ মুখ তুলে তাকালেন ওর দিকে। হেড ক্লার্কের কথা বলার ভঙ্গিটা ভালো লাগলো না ওর। ভেবেছিলো চুপ করে যাবে। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তবু বাড়াতে হলো, আমার বিশেষ কেউ আছে সেটা আপনি জানলেন কোত্থেকে?

আহা, রেগে গেলেন নাকি? হেড ক্লার্ক পরক্ষণে বললেন, কথাটা যদি বলেই থাকি এমন কী অন্যায় করেছি বলুন? এ বয়সে সবার বিশেষ কেউ একজন থেকে থাকে, আমাদেরও ছিলো। ক্ষণকাল থেমে আবার শুধোলেন তিনি, আপনার বুঝি কেউ নেই?

থাকলেই বা আপনাকে বলতে যাবে কে? কাসিদের হয়ে জবাবটা দিলেন এক নম্বর কেরানী।

হেড ক্লার্ক সরোষ দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। তারপর বললেন, আপনাকে যে কাজটা করতে দিয়েছি ওটা হয়েছে?

এক নম্বর কেরানীর মুখখানা মুহুর্তে ম্লান হয়ে গেলো। হেড ক্লার্ক মুখে একটা পান তুলে দিয়ে বললেন, আগে কাজ শেষ করুন, তারপর কথা বলবেন।

ঘাড় নিচু করে কাজে মন দিলো এক নম্বর কেরানী।

কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারলো না।

হেড ক্লার্ক চুপ।

কাসেদ নীরব।

দেয়ালে কুলান বড় ঘড়িটা শুধু আওয়াজ তুলে এগিয়ে চলেছে তার নির্দিষ্ট গতিতে।

আর কোন শব্দ নেই।

অফিস থেকে দু’জনে এক সঙ্গে বেরিয়ে এলো ওরা।

দু’জন গম্ভীর।

রাস্তায় নেমে এসে কাসেদ প্রথমে কথা বললো, আপনি কি এখন সোজা বাসায় যাবেন?

গুমোট অবস্থাটা কেটে যাওয়ায় যেন খুশি হলেন ভদ্রলোক, অফিস থেকে বেরিয়ে আমি অন্য কোথাও যাইনে।

কাসেদ বললো, বেশ তাহলে চলুন আপনার বাসায় যাওয়া যাক।

বলে হেড ক্লার্কের মুখের দিকে তাকালো কাসেদ। তাঁর কোন ভাবান্তর হয়েছে কিনা লক্ষ্য করলো, কিন্তু কিছু বুঝা গেল না।

হেড ক্লার্ক মৃদু গলায় বললেন, বেশ তো চলুন। আপনার ছাতাটা–বলতে গিয়ে থেমে গেলেন তিনি, কথাটা শেষ করলেন না।

অফিস থেকে মকবুল সাহেবের বাসাটা বেশ দূরে নয়, তবু অনেক দূর। পল্টন থেকে লালবাগ।

মাসের শুরুতে বাসে চড়ে অফিসে আসেন তিনি। বাসে চড়ে বাসায় ফেরেন। মাসের শেষে বাস ছেড়ে পদাতিক হন। হেঁটে আসেন, হেঁটে যান। কিছুদূর এসে মকবুল সাহেব বললেন, আমি পারতপক্ষে বাসে চড়িনে বুঝলেন। ওতে বড় ভিড়, আমার মাথা ঘু্রোয়। আগে রিক্সায় করে আসতাম যেতাম। কিন্তু ব্যাটারা এমন হুড়মুড় করে চালায়, দু’বার ট্রাকের নিচে পড়তে পড়তে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছি। সেই থেকে আর রিক্সায় চড়িনে। আজকাল শ্ৰীচরণ ভরসা করেছি। এতে কোরে বিকেল বেলায় বেড়ানোটাও হয়ে যায়।

কী বলেন?

তাকে সমর্থন জানাতে গিয়ে শুধু একটুখানি হাসলো কাসেদ, কিছু বললো না। কারণ কিছু বলতে গেলে বিকেল বেলায় বেড়ানোর চেয়ে টাকাকড়ির সমস্যাটা এসে পড়ে সবার আগে।

লালবাগে একটা সরু গলির ভেতরে একখানা আস্তর উঠা একতলা দালান, আর একটা দোচালা টিনের ঘর নিয়ে থাকেন মকবুল সাহেব। বড় পরিবার। ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি।

বাইরের একখানা ঘর বৈঠকখানা এবং স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলের শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি।

ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের চেয়ে ধুলোবালি আর আবর্জনার আধিপত্য সবার আগে চোখে পড়ে। জানালা দু’খানায় পর্দা সেই কবে লাগানো হয়েছে কে জানে। নিচের দিক থেকে কিসে যেন খেয়ে অর্ধেকটা করে ফেলেছে। বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছে সেগুলো। আর কিছু নয়, শুধু ওই পর্দাগুলোর দিকে তাকালেই গৃহকর্তার দীনতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভেতরে ঢুকে একখানা চেয়ারে ওকে বসতে বললেন মকবুল সাহেব। দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে পঞ্চাশোত্তর বৃদ্ধ এখন ক্লান্ত। কাসেদকে বসতে বলে নিজে একখানা চৌকির উপর বসে পড়লেন। চারপাশে তাকিয়ে বললেন, বাড়িটা বিশেষ ভাল না। তবু, সেই পার্টিশানের পর থেকে আছি, একটা মায়া বসে গেছে। ছাড়ি ছাড়ি করেও ছাড়া যায় না।

বাইরের ঘরে তাঁর গলার আওয়াজ পেয়ে ভেতরে থেকে কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে এসে জুটলো এ-ঘরে। কারো পরনে ময়লা ফ্রক, কারো পরনে ছেঁড়া হাফপ্যাণ্ট, কেউ-বা ন্যাংটা।

বুড়ো মকবুল উঠে গিয়ে তাদের দু’জনকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর চোখমুখে চিবুকে চুমু দিয়ে একগাল হেসে বললেন, এরা সব আমার নাতি নাতনি। বিকেলটা এদের নিয়ে কাটে আমার। বুড়োর চোখে-মুখে কী এক প্রশান্তি। এ মুহুর্তে যেন নিজের সকল দীনতা ভুলে গেছেন তিনি। চেয়ে দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো কাসেদের। কিছুক্ষণের জন্যে হয়তো সে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ নজরে এলো, জানালায় ঝোলানো আধখানা পর্দার ওপাশে একটি মেয়ে এদিকে পিছন করে আছে। কালো ঘন চুলগুলো তার পিঠময় ছড়ানো। গায়ের রংটাও কালো। চিকন হাত জোড়া দিয়ে চুলের অরণ্যে উকুন খুঁজছে সে। চেহারাটা ভাল করে দেখবার উপায় নেই। পাশ থেকে যেটুকু দেখা গেল তাতে মনে হল নাকটা বেশ তীক্ষ্ণ আর চোখজোড়া বড় বড়।

মকবুল সাহেব তার নাতি নাতনিদের নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। বলে গেলেন, আপনি বসুন, আমি এক্ষুণি আসছি।

কাসেদ নড়েচড়ে বসলো।

জানালার পাশ থেকে চোখজোড়া সরে এসেছিলো, আবার সেদিকে তাকালো কাসেদ। মেয়েটি এখনো বসে আছে। মকবুল সাহেবের মেয়ে। হয়তো সবার বড়। কিম্বা মেজো, কিম্বা সেজো। বিকেল বেলার ম্লান আলোয় ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসছে সে। একটু পরে তাকে আর দেখা যাবে না। কালো মেয়ে সন্ধ্যার আলোতে হারিয়ে যাবে।

কাসেদ নিজেও জানে না, কখন সে জানালার দিকে ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছিলো, ঔৎসুক্যে আনত দেহ সহসা সচকিত হলো। মনে মনে লজ্জা পেলো কাসেদ। একটা অপরিচিত মেয়েকে দেখার জন্যে অমন করছে কেন সে? এ প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারবে না। সে জানে মেয়েটাকে দেখতে তার ইচ্ছা করছে, ভালো লাগছে, সুন্দর লাগছে। অন্তত বিকেলের এই বিশেষ মুহুর্তটিতে। এযে কাসেদ সাহেব, আপনাকে অনেকক্ষণ একা বসিয়ে রেখেছি, কিছু মনে করেন নি তো? মকবুল সাহেব এসে ঢুকলেন ভেতরে। পানে মুখখানা ভরে এসেছেন তিনি। হাতে একখানা ছাতা। ছাতাটার দিকে চোখ পড়তে কাসেদ চিনলো তার ছাতা। কিন্তু যেমনটি ছিলো তেমনটি নেই। উপরে, নিচে, মাঝখানে অনেকগুলো ক্ষত। মকবুল সাহেব একবার ছাতা আর একবার কাসেদের মুখের দিকে তাকিয়ে সলজ্জ কণ্ঠে বললেন, ছাতাটা আপনাকে দেয়া গেলো না কাসেদ সাহেব, ওটা মেরামত করতে হবে।

কাসেদ পরক্ষণে বললো, ঠিক আছে, আমি নিজেই মেরামত করে নেবো।

মকবুল সাহেব বললেন, না, না, তা কেমন করে হয়। বলতে গিয়ে মুখখানা বিরক্তিতে ভরে এলো তার। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এই ছেলে পিলেদের নিয়ে আর পারা গেলো না। একটা জিনিস এদের জন্যে ঠিক থাকে না, এত মারধোর করি– সহসা দরজার দিকে চোখ পড়তে থেমে গেলেন তিনি।

Leave a Reply